ধর্ম অধর্ম : সন্ন্যাসী মুখ্যমন্ত্রী
ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের ২১তম মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে এক বিতর্কিত হিন্দু সন্ন্যাসী যোগী আদিত্যনাথকে। তীব্র সাম্প্রদায়িক ও মুসলিম-বিদ্বেষী বক্তব্যের জন্য তার পরিচিতি আছে। উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর দলিত ও ব্রাহ্মণ নেতাদের নাম আলোচিত হলেও অবশেষে এই হিন্দু সন্ন্যাসীকে নেতা নির্বাচন করা হয়। নির্বাচনের সময় তার সমর্থকদের শ্লোগান ছিল- ‘দেহলী মে মোদী, ইউপি মে য়োগী’।
গোরখপুরের এক মন্দিরের প্রধান যোগী আদিত্যনাথের পূর্বনাম অজয় সিং বিস্ত। প্রায় বিশ বছর আগে এক ছাত্রবিক্ষোভের মধ্য দিয়ে যোগী আদিত্যনাথ রাজনীতিতে পা রাখে। এরপর তীব্র সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের কারণে রাতারাতি হিন্দু যুবসমাজের মাঝে তার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে।
সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনী প্রচারের সময়েও তার বক্তব্য ছিল, ‘রাজ্যের সমাজবাদী পার্টির সরকার উন্নয়ন করেছে শুধু কবরস্থানগুলোর, কিন্তু বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এলে অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে রামমন্দির প্রতিষ্ঠা করবে।’
গত বছরের জুন মাসে তার একটি বক্তব্য, ‘যেখানে অযোধ্যার বিতর্কিত স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলা কেউ ঠেকাতে পারেনি তো মন্দির তৈরি করা কে ঠেকাবে?’
২০১৫-এর জুন মাসে তার একটি বক্তব্য ছিল, ‘যে সকল লোক যোগের বিরোধিতা করছে তাদের ভারত ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। যারা সুরায়া নমস্কার মানে না তাদের সমুদ্রে ডুবে যাওয়া উচিত।’
যোগী আদিত্যনাথের উপরের কথাগুলো যে কেউ বিবিসির বাংলা ও উর্দূ সাইটে দেখে নিতে পারেন।
একজন সচেতন মুসলিমের জন্য এ সকল দৃষ্টান্ত অভাবনীয় নয়; কারণ ইসলাম তার সূচনা থেকেই সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার মোকাবিলা করে এসেছে। আর এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পৌত্তলিক সাম্প্রদায়িকতা। মক্কী যুগে মুসলিমেরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতন সয়েছেন মূর্তিপূজারি সম্প্রদায়ের মাধ্যমেই। কাজেই এই বিষয়টা নতুন নয় এবং এখান থেকে নতুন করে জানার-বোঝার মতো কোনো কিছু একজন সচেতন ও নিষ্ঠাবান মুসলিমের নেই।
নিজ আদর্শের বিষয়ে আস্থা ও অবিচলতা মুমিন লালন করে ঈমানের কারণেই। তাওহীদের বিশ্বাস আর শিরকের ঘৃণাও তার ঈমানেরই অংশ। কাজেই পরিস্থিতি যা-ই হোক মুমিন তার ঈমানী চেতনা ও আদর্শের উপরেই থাকে। নিজ ধর্মাদর্শের উপর মুসলিমের আস্থা ও অবিচলতা কোনো অবস্থা বা পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়াবশত নয়। মুসলিম যা কিছু গ্রহণ করে ঈমানের কারণে গ্রহণ করে। যা কিছু বর্জন করে ঈমানের কারণেই বর্জন করে। মুমিনের ঈমানী জ্ঞান ও প্রজ্ঞা তার সামনে স্পষ্ট করে দেয়, কোন্ চিন্তা ও মতবাদ গ্রহণীয় আর কোন্ মতবাদ ও চিন্তা বর্জনীয়। কিন্তু এখন বড় সমস্যা হচ্ছে দ্বীনী ইলম ও বসীরতের অভাব ও অনুপস্থিতি। দ্বীনী জ্ঞানের অভাব এবং ঈমানী দুর্বলতার কারণে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মত কুফরী মতবাদও মুসলিমসমাজে বিস্তার লাভ করার সুযোগ পেয়েছে এবং এর ফলে সহজ-সরল মুসলমানদের মধ্যে আপন ধর্মের বিষয়ে অনীহা ও অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে। দিনের পর দিন সমাজ ও রাষ্ট্র, শিক্ষা ও সংস্কৃতি থেকে ইসলামকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলার আহ্বান ও প্রচেষ্টাও যেন একটি দালীলিক ও যৌক্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সকল অসচেতন মুসলিমের জন্য ইউপির এই দৃষ্টান্ত এবং এজাতীয় দৃষ্টান্তমালাও কি চিন্তার উপাদান হতে পারে না?
বাইরের চিন্তাধারা হজম করে দিনের পর দিন নিজ হাতে নিজের পরিচয় মুছে ফেলা, যেখানে যেখানে ইসলামের শুধু নামটুকু আছে তা মোচন করে যেন পাপমোচনের স্বস্তি অর্জন করা এবং ধর্ম ও রাজনীতির বিরোধের প্রশ্ন এনে এক দীর্ঘ অন্তর্দ্বন্দে ও আত্মকলহে লিপ্ত হয়ে নিজেদের শতধা বিভক্ত করার পর যখন দেখা যাচ্ছে, যারা মুসলিমসমাজে ধর্ম-বিদ্বেষ ও ধার্মিক বিদ্বেষ প্রচার করছে, খোদ তাদেরই অনেকের অবস্থান নিজ নিজ ধর্মের ব্যাপারে সম্পূর্ণ আলাদা; তখনও কি এই চিন্তার যৌক্তিকতা প্রমাণ হয় না যে, মুসলিমসমাজে এইসব মতবাদের বিস্তার একান্তই প্রতারণামূলক। মুসলিমসমাজকে শতধা বিভক্ত ও হীনবল করাই এর প্রধান উদ্দেশ্য।
মুসলিমসমাজের উন্নতি-অগ্রগতির মূল উপাদান হতে পারে ইসলাম। যদি তা সঠিকভাবে বোঝা হয় এবং সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয়। এ কথাটা পরিষ্কার ভাষায় বলতে কোনো বাঁধা নেই যে, অন্য অনেক সমাজের ক্ষেত্রে ধর্মটা সাম্প্রদায়িকতার অনুষঙ্গ হতে পারে, কিন্তু মুসলিমসমাজের ক্ষেত্রে ইসলাম শান্তি, কল্যাণ ও প্রকৃত উন্নতির উপায়। এই পার্থক্যটা ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মের শিক্ষা ও আদর্শগত পার্থক্যের কারণেই। একটি দৃষ্টান্ত দেখুন :
ইসলামে সংখ্যালঘু অমুসলিমদের প্রতি জুলুম-অবিচারের সুযোগ নেই। কুরআন মাজীদের স্পষ্ট নির্দেশ-
وَ لَا یَجْرِمَنَّكُمْ شَنَاٰنُ قَوْمٍ عَلٰۤی اَلَّا تَعْدِلُوْا ؕ اِعْدِلُوْا ۫ هُوَ اَقْرَبُ لِلتَّقْوٰی .
এবং কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদেরকে ইনসাফ পরিত্যাগে প্ররোচিত না করে। ইনসাফ অবলম্বন করো। এ পন্থাই তাকওয়ার বেশি নিকটবর্তী। -সূরা মাইদা (৫) : ৮
কাজেই রাজ্য-চালনায় ইসলামী আদর্শ অনুসৃত হলে সংখ্যালঘুর অধিকার খর্ব হবে না; সংরক্ষিত হবে। ইসলামের রাজ্য-চালনার যুগে এমন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে যে, ইসলামী শাসন-ব্যবস্থার মাধ্যমেই সংখ্যালঘু অমুসলিমের অধিকার সংরক্ষিত হয়েছে।
কোথাও যদি যথার্থ ইসলামী হুকুমাত কায়েম থাকে তাহলে আলোচিত যোগীর মতো বিদ্বিষ্ট ও উগ্র মানসিকতা পোষণকারী কোনো ব্যক্তি স্বাভাবিক নিয়মে কখনোই ক্ষমতাসীন হতে পারবে না। কারণ, এই ধরনের ব্যক্তির দ্বারা ইসলামের ঐ বিধান লঙ্ঘিত হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা থাকবে।
আলোচিত সন্ন্যাসী মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার তিন দিনের মধ্যে ইউপির একটি শহরে মুসলমানদের মালিকানাধীন তিনটি গোশতের দোকানে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ বিবিসির রিপোর্ট অনুযায়ী ঐ পুড়ে যাওয়া দোকানগুলোতে শুধু ছাগল বা পাঠার মাংস বিক্রি হত বলেই প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। ঐ জেলার পুলিশ সুপার দিলীপ কুমার বিবিসিকে জানিয়েছেন, দোকানগুলোতে অনেক রাতে আগুন ধরেছে। ফলে ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শীকে আমরা খুঁজে পাইনি।
এই পরিস্থিতিতে শুধু দুটো কথাই আরজ করতে ইচ্ছে হয় : প্রথম কথাটি হচ্ছে, প্রতিবেশী দেশের রাজনীতিতে ধর্ম ও ধর্মীয় উগ্রপন্থী লোকদের এই প্রকাশ্য অনুপ্রবেশের পরও কোথাও কোনো প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে না। আমাদের দেশের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ‘চিন্তাশীল’ বুদ্ধিজীবীদের তো চুপ করে থাকা শোভন নয়। দেশে দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশে এবং মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের উত্থানে উদ্বেগ প্রকাশে যারা পরিচিতমুখ পাশের দেশের এই ঘটনা-ধারা কি তাদের ঐ দর্শনের মুখে সজোর চপেটাঘাত নয়?
দ্বিতীয় কথাটি হচ্ছে, এই সকল ঘটনা-ধারা থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের ঐ মশহুর কথাটির একটি বাস্তব অর্থ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, তারা বলে থাকেন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়।’ প্রতিবেশী বৃহৎ ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্রের বাস্তব অবস্থান দ্বারা তারা তাদের এই বাক্যের অর্থটা ঠিক করে নিতে পারেন। এতদিন এর অর্থ তারা করেছেন ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মদ্রোহ করেও একজন ধার্মিক হতে পারে! আরো স্পষ্ট করে বললে, ইসলাম ও কুফরের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থেকেও একজন মুসলিম হতে পারে। তাওহীদ ও শিরকের ক্ষেত্রে কোনো পক্ষে না গিয়েও বরং শিরকের পক্ষে গিয়েও একজন মুমিন হতে পারে?! এই অবাস্তব ও সোনার পাথরবাটি শ্রেণীর কথা না বলে তাদের কর্তব্য প্রতিবেশী দেশের বাস্তব অবস্থানের আলোকে তাদের এই বাক্যের অর্থ ঠিক করা।
বাস্তব দৃষ্টান্ত প্রমাণ করছে যে, রাজনীতিতে হিন্দুত্বের সাম্প্রদায়িক অনুপ্রবেশের পরও ভারত-রাষ্ট্রের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ থাকা আটকাচ্ছে না। অর্থাৎ ভারত যেন উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করছে যে, ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার জন্য রাজ্য চালনা ও রাজনীতি থেকে হিন্দুত্ব বাদ দিয়ে ‘ধর্মহীন’ হওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্ম-হীনতা নয়”! শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাজ্য-চালনা ও রাজনীতি সবক্ষেত্রে ধর্মকে ধারণ করেও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ থাকা যায়!
কুরআন-হাদীসের বিধান এবং সাহাবা-তাবেয়ীনের বাস্তব জীবন থেকে যারা আলো গ্রহণে অক্ষম হয়ে যারা ‘ধর্ম নিরপেক্ষ ধার্মিক’ হয়েছেন তারা অন্তত ‘ধর্মনিরপেক্ষ পৌত্তলিক’ সম্প্রদায়ের জীবন ও কর্ম থেকেও তো বাস্তবতার সঠিক উপলব্ধিটুকু অর্জন করতে পারেন!