একটি বই, একটি চিঠি : আযান ও ইকামত
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
মুহতারাম,
এরপর আমরা বেজোড় বাক্যে ইকামত দান সংক্রান্ত কী হাদীস আছে সেগুলো একটু দেখি তারপর পর্যালোচনায় যাই। বেজোড় বাক্যে ইকামত দান সংক্রান্ত দলীলসমূহ ও হাদীসসমূহ নিম্নরূপ।
দলীল-১
হযরত আবদুল্লাহ ইব্ন যায়েদ রা. কর্তৃক দেখা স্বপ্নে ইকামতের বাক্যগুলো ছিল একবার করে
বেজোড় বাক্যে ইকামত : হাদীস-১
عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ عَبْدِ اللّهِ بْنِ زَيْدِ بْنِ عَبْدِ رَبِّه قَالَ : حَدّثَنِي أَبِي عَبْدُ اللّهِ بْنُ زَيْدٍ قَالَ : لَمّا أَمَرَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- بِالنّاقُوسِ يُعْمَلُ لِيُضْرَبَ بِهِ لِلنّاسِ لِجَمْعِ الصلاَةِ طَافَ بِي وَأَنَا نَائِمٌ رَجُلٌ يَحْمِلُ نَاقُوسًا فِى يَدِه فَقُلْتُ يَا عَبْدَ اللَّهِ أَتَبِيعُ النّاقُوسَ قَالَ وَمَا تَصْنَعُ بِهِ فَقُلْتُ نَدْعُو بِهِ إِلَى الصّلاَةِ. قَالَ أَفَلاَ أَدُلّكَ عَلَى مَا هُوَ خَيْرٌ مِنْ ذَلِكَ فَقُلْتُ لَهُ بَلَى. قَالَ فَقَالَ تَقُولُ اللّهُ أَكْبَرُ اللّهُ أَكْبَرُ اللّهُ أَكْبَرُ اللّهُ أَكْبَرُ، أَشْهَدُ أَنْ لاّ إِلَهَ إِلاّ اللّهُ أَشْهَدُ أَنْ لاّ إِلَهَ إِلاّ اللّهُ، أَشْهَدُ أَنّ مُحَمّدًا رّسُولُ اللّهِ، أَشْهَدُ أَنّ مُحَمّدًا رّسُولُ اللّهِ، حَيّ عَلَى الصّلاَةِ حَيّ عَلَى الصّلاَةِ، حَيّ عَلَى الْفَلاَحِ حَيّ عَلَى الْفَلاَحِ، اللّهُ أَكْبَرُ اللّهُ أَكْبَرُ، لاَ إِلهَ إِلاّ اللّهُ. قَالَ : ثُمّ اسْتَأْخَرَ عَنِّي غَيْرَ بَعِيدٍ ثُمّ قَالَ وَتَقُولُ إِذَا أَقَمْتَ الصّلاَةَ : اللّهُ أَكْبَرُ اللّهُ أَكْبَرُ، أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاّ اللّهُ، أَشْهَدُ أَنّ مُحَمّدًا رّسُولُ اللّهِ، حَيّ عَلَى الصّلاَةِ، حَىّ عَلَى الْفَلاَحِ، قَدْ قَامَتِ الصّلاَةُ قَدْ قَامَتِ الصّلاَةُ، اللّهُ أَكْبَرُ اللّهُ أَكْبَرُ، لاَ إِلَهَ إِلاّ اللّهُ. فَلَمّا أَصْبَحْتُ أَتَيْتُ رَسُولَ اللّهِ -صلى الله عليه وسلم- فَأَخْبَرْتُهُ بِمَا رَأَيْتُ فَقَالَ : إِنّهَا لَرُؤْيَا حَقّ إِنْ شَاءَ اللّهُ، فَقُمْ مَعَ بِلاَلٍ فَأَلْقِ عَلَيْهِ مَا رَأَيْتَ، فَلْيُؤَذِّنْ بِهِ فَإِنّهُ أَنْدَى صَوْتًا مِنْكَ .
আবদুল্লাহ ইব্ন যায়েদ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন শিংগা ধ্বনি করে লোকদেরকে সালাতের জামাআতের জন্য একত্র করার নির্দেশ দিলেন তখন আমি একদিন স্বপ্নে দেখি যে, এক ব্যক্তি শিংগা হাতে নিয়ে যাচ্ছে। আমি তাকে বললাম, হে আল্লাহর বান্দাহ, তুমি কি শিংগাটি বিক্রয় করবে? সে বলল, শিংগা দিয়ে তুমি কী করবে? আমি বললাম, আমি এটা দ্বারা সালাতের প্রতি আহ্বান জানাব। সে বলল, আমি কি এর চেয়ে উত্তম কোনো কিছুর সন্ধান তোমাকে দেব না? আমি বললাম, কেন নয়? নিশ্চয়ই দেবে। সে বলল, তুমি এইরূপ বলবে, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার; আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ; আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ, আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ; হাইয়া ‘আলাস সালাহ, হাইয়া আলাস সালাহ; হাইয়া ‘আলাল ফালাহ, হাইয়া ‘আলাল ফালাহ; আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার; লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। আবদুল্লাহ ইব্ন যায়েদ রা. বলেন, অতপর লোকটি আমার থেকে একটু দূরে সরে যায় এবং বলে, অতপর যখন তুমি সালাতে দাঁড়াবে তখন বলবে, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার; আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ, হাইয়া ‘আলাস সালাহ, হাইয়া ‘আলাল ফালাহ, কাদ কামাতিস সালাহ, কাদ কামাতিস সালাহ; আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার; লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। অতপর সকালে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসলাম এবং আমার দেখা স্বপ্নবৃত্তান্ত তাঁকে শোনালাম। তিনি বললেন, আল্লাহ চাহেন তো এটা সত্য স্বপ্ন। তুমি বেলালকে সংগে নিয়ে যাও এবং তাকে তুমি যা দেখেছ তা শিখিয়ে দাও। কেননা, সে তোমা অপেক্ষা অধিক উচ্চস্বরের অধিকারী। -সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস ৪৯৯; জামে তিরমিযী হাদীস ১৮৯
মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব তার বইতে হাদীসটি উল্লেখ করেননি। তবে ইন্টারনেটে তিনি বা তাঁর পক্ষের কেউ হাদীসটিকে উল্লেখ করেছেন এবং উপরিউক্ত বরাতের সাথে সাথে মুসলিম শরীফের বরাতও উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আব্দুল্লাহ ইবনে যায়েদ রা. কর্তৃক স্বপ্নে আযান দেখা সংক্রান্ত এরূপ কোনো হাদীস মুসলিম শরীফে আমি পাইনি।
দলীল-২
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক হযরত বেলাল রা.-কে বেজোড় বাক্যে ইকামত দানের নির্দেশ
বেজোড় বাক্যে ইকামত : হাদীস-২
হযরত আনাস রা. বলেন,
أُمِرِ بِلَالٌ أَنْ يّشْفَعَ الْأَذان وَيُوتِرَ الْإِقَامَةَ. زَادَ يَحْيى فَي حَدِيْثِه عَنِ ابْنِ عُلَيّةَ فَحَدّثْتُ بِهِ أَيّوْبَ فَقَالَ إِلاّ الْإِقَامَةَ.
বিলালকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জোড় বাক্যে আযান দিতে এবং বেজোড় বাক্যে ইকামত দিতে। ইয়াহ্ইয়া তার বর্ণনায় ‘ইব্ন উলাইয়াহ হতে’ এই কথাটি বৃদ্ধি করেছেন যে, ইব্ন উলাইয়াহ বলেন, আমি হাদীসটি আইয়ূবের নিকট বর্ণনা করলে তিনি বললেন, তবে ইকামত ব্যতীত (অর্থাৎ কাদ কামাতিস সালাহ ব্যতীত)। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮৬৪
দলীল-৩
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে ইকামত দেওয়া হত একবার একবার করে
বেজোড় বাক্যে ইকামত : হাদীস-৩
হযরত ইব্ন উমার রা. বলেন,
إِنّمَا كَانَ الأَذَانُ عَلى عَهْدِ رَسُولِ اللّهِ -صلى الله عليه وسلم- مَرّتَيْنِ مَرّتَيْنِ وَالإِقَامَةُ مَرّةً مَرّةً، غَيْرَ أَنّهُ يَقُولُ : قَدْ قَامَتِ الصّلاَةُ قَدْ قَامَتِ الصّلاَةُ. فَإِذَا سَمِعْنَا الإِقَامَةَ تَوَضّأْنَا ثُمّ خَرَجْنَا إِلَى الصّلاَةِ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে আযানের শব্দ দুবার করে এবং ইকামতের শব্দ একবার করে বলা হত। তবে কাদ কামাতিস সালাহ দুবার বলা হত। আমরা ইকামত শুনলে ওযূ করতাম অতপর সালাত আদায় করতে যেতাম। -সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস ৫১০; সুনানে নাসাঈ, হাদীস ৬৬৮; সহীহ ইব্ন খুযাইমাহ, হাদীস ৩৭৪; মুসতাদরাকে হাকেম হাদীস ৭০৯
মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব তাঁর বইতে এই হাদীসটি উল্লেখ করেননি। তবে তিনি বা তাঁর সমর্থক কেউ ইন্টারনেটে হাদীসটি উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, হাকেম প্রমুখ সহীহ বলেছেন, যাহাবী চুপ থেকেছেন। এর সনদ হাসান। কেননা, এর আরও সাক্ষ্য সহীহ আবূ আওয়ানাহ ও দারাকুতনীতে আছে।
দলীল-৪
বিলাল রা.-এর আযান ছিল দুইবার করে
আর ইকামত ছিল একবার করে
বোজোড় বাক্যে ইকামত : হাদীস-৪
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুআযযিন সা‘দ বর্ণনা করেন :
أَنّ أَذَانَ بِلاَلٍ كَانَ مَثْنَى مَثْنَى، وَإِقَامَتَهُ مُفْرَدَةٌ.
অর্থ : বিলালের আযান ছিল দুই দুই বাক্যে এবং ইকামত ছিল এক এক বাক্যে। সুনানে ইব্নে মাজাহ হাদীস ৭৩১
মুহতারাম, এই হাদীসটি মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবগণ ইন্টারনেটে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এর যে সনদ তাঁরা উল্লেখ করেছেন তা ভুল। এরপর সনদটির যে তরজমা করেছেন তা এক কথায় বলা যায় জঘন্য রকমের ভুল এবং রীতিমত হাস্যকর। সনদটি আসলে এইরূপ :
حَدّثَنَا هِشَامُ بْنُ عَمّارٍ حَدّثَنَا عَبْدُ الرّحْمنِ بْنُ سَعْدِ بْنِ عَمّارِ بْنِ سَعْدٍ مُؤّذِّنِ رَسُوْلِ الله صَلّى الله عَلَيْهِ وَسَلّمَ حَدّثَنِى أبِي عَنْ أَبِيْهِ عَنْ جَدِّه أَنّ أَذَانَ بِلَالٍ...
সনদটিতে দেখা যাচ্ছে যে, হিশাম ইবনে আম্মারের নিকট হাদীসটি বর্ণনা করেছেন আব্দুর রহমান, যাঁর পিতার নাম সা‘দ এবং পিতামহের নাম আম্মার। আবদুর রহমানের পিতা সা‘দের পিতামহের তথা আম্মারের পিতার নামও ছিল সা‘দ। আম্মারের পিতা সা‘দ ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুআযযিন। তো আবদুর রহমান হাদীসটি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, হাদীসটি আমার নিকট বর্ণনা করেছেন আমার পিতা (সা‘দ) তাঁর পিতা (আম্মার) থেকে, আর তাঁর পিতা আম্মার তাঁর (তথা সা‘দের) পিতামহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুয়াযযিন সা‘দ থেকে, বিলালের আযান ছিল দুই বাক্যে এবং ইকামত ছিল এক বাক্যে।
হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুআযযিন সা‘দ কর্তৃক।
অথচ মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবগণ লিখেছেন, রসূলূল্লাহ (স) এর মুয়াযযিন আম্মার ইবনে সা‘দ (রা)-এর পিতামহ থেকে বর্ণিত যে প্রশ্ন হল, ‘রসূলুল্লাহ (স) এর মুয়াযযিন’ বিশেষণটি কার বিশেষণ? আম্মারের, না আম্মারের পিতামহের? বিশেষণটি এদের দুইজনের যার জন্যই সাব্যস্ত করা হোক তা নিশ্চিতরূপে ভুল। কারণ, না আম্মার রাসূলের মুয়াযযিন ছিলেন, না আম্মারের পিতামহ তাঁর মুয়াযযিন ছিলেন। আর তা ছাড়া না আম্মার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংসর্গ পেয়েছেন, না আম্মারের পিতামহ ‘আইয মুসলমান ছিলেন।
যাদের জ্ঞানের থলি এতটা ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ তারা যে কেন হাদীসের গবেষণায় নেমে মুজতাহিদ বনে যাওয়ার খাহেশ পোষণ করেন তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না। আল্লাহ তাআলা এদেরকে সুমতি দান করুন।
হাদীসটি নিঃসন্দেহে যঈফ। এর সনদে আবদুর রহমান ও তাঁর পিতা সা‘দ দুইজনই যঈফ।
বেজোড় বাক্যে ইকামত : হাদীস-৫
আবূ রাফে‘ বলেন,
رَأَيْتُ بِلَالًا يُؤَذِّنُ بَيْنَ يَدَيْ رَسُوْلِ الله صلى الله عليه وسلم مَثْنَى مَثْنَى وَيُقِيْمُ وَاحِدَةً
আমি বিলাল রা.-কে দেখেছি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপস্থিতিতে আযান দিতে দুইবার দুইবার, আর ইকামত একবার একবার। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৭৩২; দারাকুতনী, হাদীস ৯৩৪
এই হাদীসটি সকলের মতে যঈফ। হাদীসটির দুজন রাবী মা‘মার ইবনে মুহাম্মাদ এবং তাঁর পিতা মুহাম্মাদ ইব্ন উবাইদুল্লাহ মুহাদ্দিসগণের মতে চরম দুর্বল। বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন দেখছি না। কারণ, মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবগণও হাদীসটিকে যঈফ বলে স্বীকার করেছেন। তবে তাঁরা বলেছেন, হাদীসটি যঈফ। কিন্তু পূর্বের সহীহ হাদীসগুলোর সাক্ষ্যমূলক হিসাবে হাদীসটি হাসান। এ কথার অর্থ যে কী, তার মাথামু-ু কিছুই বুঝলাম না। কোনো যঈফ হাদীস কোনো সহীহ হাদীসের সাক্ষী ও সমর্থক হলে তা হাসান হয়ে যায়- এই নীতির প্রবক্তা কোনো মুহাদ্দিস ও শাস্ত্র-বিশেষজ্ঞ আছেন বলে আমাদের জানা নাই।
বেজোড় বাক্যে ইকামত : হাদীস-৬
আবদুল্লাহ ইব্ন উমার রা. বলেন,
كَانَ الْأَذَانُ عَلَى عَهْدِ رَسُوْل الله صَلّى الله عَلَيْهِ وَسَلّمَ مَثْنى مَثْنى وَالْإقَامَةُ مَرّةً مَرّةً.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে আযান ছিল দুইবার দুইবার এবং ইকামত একবার একবার। -সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস ৫১০; সুনানে নাসাঈ, হাদীস ৬২৮, ৬৬৮; সহীহ ইবনে খুযায়মাহ, হাদীস ৩৭৪
হাদীসটিতে দুইজন রাবী আছেন আবূ জাফর আল মুআযযিন ও আবুল মুছান্না মুসলিম ইবনুল মুছান্না নামে। এই দুইজন সম্পর্কে হাদীস শাস্ত্রজ্ঞগণের পক্ষ থেকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় প্রকারের মন্তব্যই পাওয়া যায়। ফলে হাদীসটিকে যঈফ না বললেও সহীহ বলা যায় না। বড় জোর হাদীসটিকে হাসান বলা যায়। যেহেতু মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবগণ হাদীসটিকে হাসান বলেই স্বীকার করেছেন তাই রাবী দুইজন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন মনে করছি না।
মুহতারাম, আপনার সামনে দুই দুই বাক্যে ইকামতদান সংক্রান্ত হাদীস এবং এক এক বাক্যে ইকামতদান সংক্রান্ত হাদীস- এই উভয় প্রকার হাদীসই তুলে ধরা হল। মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব তাঁর ‘জাল হাদীসের কবলে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ছালাত’ বইটিতে এক এক বাক্যে ইকামতদান সংক্রান্ত হাদীসসমূহের মধ্য হতে মাত্র দুইটি হাদীস উল্লেখ করেছিলেন। পরবর্তীতে মাওলানা আবদুল মতিন ছাহেবের ‘দলীলসহ নামাযের মাসায়েল’ বইটির জবাব লিখতে গিয়ে তিনি বা তাঁর অনুসারী কেউ ইন্টারনেটে আরও কিছু হাদীস উল্লেখ করেছেন। আমি তাদের উপস্থাপিত সব কয়টি হাদীসই আপনার সামনে তুলে ধরলাম। বেজোড় বাক্যে ইকামতের পক্ষে চারটি দলীলে পাঁচটি হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। আর জোড় বাক্যে ইকামতের পক্ষে পাঁচটি দলীলে আটটি হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে।
উভয়পক্ষের হাদীস নিয়ে পর্যালোচনা
বেজোড় বাক্যে ইকামত দান সংক্রান্ত হাদীসগুলোর দ্বিতীয় হাদীসটি সহীহ; প্রথম, তৃতীয় ও ষষ্ঠ হাদীসদুইটি হাসান এবং চতুর্থ ও পঞ্চম হাদীসদুইটি যঈফ। আর জোড় বাক্যে ইকামত দান সংক্রান্ত হাদীসগুলোর প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ, অষ্টম ও নবম হাদীসসাতটি সহীহ আর পঞ্চম ও সপ্তম হাদীসদুইটি হাসান। হাদীসগুলো পাঠ করার পর আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়েছে যে, জোড় বাক্যে তথা দুই দুই বাক্যে ইকামত দান সম্পর্কে যেমন সহীহ ও হাসান হাদীস রয়েছে তেমনি বেজোড় বাক্যে তথা এক এক বাক্যে ইকামত দান সম্পর্কেও সহীহ ও হাসান হাদীস রয়েছে। কাজেই কোনোটাকেই সুন্নাহ বিরোধী বলার অবকাশ নেই। তবে আমরা জোড় বাক্যে ইকামত দানের পদ্ধতিটিকে প্রাধান্য দান করেছি নি¤œলিখিত সমূহ কারণে।
(ক) যদিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার কারণেই আব্দুল্লাহ ইবনে যায়েদ রা. কর্তৃক দেখা স্বপ্নের আযান ও ইকামতের বাক্যগুলো শরীয়তে বিধিবদ্ধ হয়েছিল, কিন্তু এটা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই যে, তাঁর দেখা স্বপ্নটিই ছিল প্রচলিত আযান ও ইকামতের উৎস। আর সেই স্বপ্নের ইকামতের বাক্যগুলো ছিল জোড়া জোড়া বাক্যে।
আপনি বলতে পারেন যে, বেজোড় বাক্যে ইকামত হাদীস ১ শিরোনামে উদ্ধৃত আবূ দাউদের ৪৯৯ নং হাদীস দ্বারা তো বুঝা যায় যে, আবদুল্লাহ ইবনে যায়েদ রা.-এর স্বপ্নে দেখা ইকামতের বাক্যগুলো ছিল একবার করে। এই আপত্তি ও তার জবাব নিয়ে আমি পূর্বে ‘জোড় বাক্যে ইকামত হাদীস ১’-এর অধীনে বিস্তারিত আলোচনা করে এসেছি। একটু কষ্ট করে আলোচনাটি আবার পাঠ করুন (আলকাউসার জুমাদাল উলা ১৪৩৮ হি./ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ঈ. সংখ্যা)। অবশ্য ইবনে হাযম রাহ. দাবি করেছেন যে, জোড় বাক্যে ইকামত দানের বিধানটি ছিল প্রথম দিকে। পরবর্তীতে তা মানসূখ বা রহিত হয়ে গেছে। তাঁর এই দাবি সম্পর্কে পূর্বে বলেছিলাম যে, এ নিয়ে পরে আলোচনা করব। তো বলছি যে, ইবনে হাযমের এই দাবি যথার্থ নয়। তার কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবনের শেষ দিকে নবম হিজরীতে হযরত আবূ মাহযূরাহ রা.-কে জোড় বাক্যে ইকামত দিতে শিখিয়েছিলেন। সুতরাং যদি নাসিখ ও মানসূখের বিষয়টিকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয় তাহলে বরং বিষয়টি উল্টো করে বলতে হবে যে, বেজোড় বাক্যে ইকামত দানের বিধানটিই মানসূখ বা রহিত হয়ে গেছে। নাসিখ হল, হযরত আবূ মাহযূরাহ রা.-এর জোড় বাক্যে ইকামত সংক্রান্ত হাদীস। কারণ, আবূ মাহযূরাহ রা.-কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জোড়া বাক্যে ইকামত শিক্ষা দিয়েছিলেন তাঁর জীবনের শেষের দিকে। আর যে বিধানটি তিনি পরে দিয়েছেন সেটি পূর্ববতী বিধানের জন্য নাসিখ বা রহিতকারী হয়। পূর্ব বিধানটি হয় মানসূখ বা রহিত।
দেখুন, মজার বিষয় হল, লা মাযহাবী জামাতের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব স্বয়ং আল্লামা শাওকানী রাহ. আবূ মাহযূরাহ রা.-এর হাদীসকেই নাসিখ ও বিলাল রা.-কে বেজোড় বাক্যে ইকামতদানের নির্দেশ সম্বলিত হাদীসকে মানসূখ বলে সাব্যস্ত করেছেন এবং তিনি জোড় বাক্যের ইকামতকেই সুনির্দিষ্ট সুন্নাহ বলে মত প্রকাশ করেছেন। তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ নাইলুল আওতারে হযরত আবূ মাহযূরাহ রা.-এর হাদীসের উপর আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন,
وَهُوَ حَدِيْثٌ صَحّحَهُ التِّرْمِذِيّ وَغَيْرُهُ وَهُوَ مُتَأَخِّرٌ عَنْ حَدِيْثِ بِلَالٍ الّذِيْ فِيْهِ الْأَمْرُ بِإِيْتَارِ الْإقَامَةِ لِأَنّهُ بَعْدَ فَتْحِ مَكّةَ لِأَنّ أَبَا مَحْذُوْرَةَ مِنْ مُسْلِمَةِ الْفَتْحِ وَبِلَالٌ أُمِرَ بِإِفْرَادِ الْإقَامَةِ أَوّلَ مَا شُرِعَ الْأَذَانُ فَيَكُوْنُ نَاسِخًا. وَقَدْ رَوَى أَبُوْ الشّيْخِ (أَنََ بِلَالًا أَذّنَ بِمِنَى وَرَسُوْلُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَآلِه وَسَلّمَ ثَمّ مَرّتَيْنِ مَرّتَيْنِ وَأَقَامَ مِثْلَ ذَلِكَ) إِذَا عَرَفْتَ هَذَا تَبَيّنَ لَكَ أَنّ أَحَادِيْثَ تَثْنِيَةِ الْإقَامَةِ صَالِحَةٌ لِلْاِحْتِجَاجِ بِهَا لِمَا أَسْلَفْنَاهُ وَأَحَادِيْثُ إِفْرَادِ الْإقَامَةِ وَإِنْ كَانَتْ أَصَحّ مِنْهَا لِكَثْرَةِ طُرُقِهَا وَكَوْنِهَا فِيْ الصّحِيْحَيْنِ لكِن أَحَادِيْثَ التّثْنِيَةِ مُشْتَمِلَة عَلَى الزِّيَادَةِ فَالْمَصِيْرُ إِلَيْهَا لَازِمٌ لَا سِيِّمًا مَعَ تَأَخّرِ تَارِيْخِ بَعْضِهَا كَمَا عَرفْنَاكَ.
অর্থাৎ এবং এটি এরূপ হাদীস, ইমাম তিরমিযী প্রমুখ যেটিকে সহীহ বলেছেন। হাদীসটি একবার করে ইকামতের বাক্য বলার আদেশ সম্বলিত বিলালের হাদীসের পরের হাদীস। কারণ, এটি মক্কা বিজয়ের পরের ঘটনা। কারণ, আবূ মাহযূরাহ ছিলেন তাঁদের একজন, যাঁরা মক্কা বিজয়ের পরে মুসলমান হয়েছিলেন। পক্ষান্তরে বিলাল রা.-কে বেজোড় বাক্যে ইকামতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল আযান বিধিবদ্ধ হওয়ার শুরুর দিকে। সুতরাং আলোচ্য হাদীসটি নাসিখ ও রহিতকারী। এদিকে আবুশ শাইখ বর্ণনা করেন যে, মিনাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপস্থিতিতে বিলাল রা. দুই দুই বাক্যে আযান দিয়েছিলেন এবং ইকামতও অনুরূপ দুই দুই বাক্যে দিয়েছিলেন।
তুমি যখন বিষয়টি জানলে তখন তোমার সামনে নিশ্চয়ই স্পষ্ট হয়েছে যে, জোড় বাক্যে ইকামতদান সংক্রান্ত হাদীসসমূহ দলীল ও প্রমাণ হওয়ার উপযুক্ত। এর কারণ আমি পূর্বেই ব্যক্ত করে এসেছি। আর বেজোড় বাক্যে ইকামতদান সংক্রান্ত হাদীসগুলো যদিও অধিক সনদে বর্ণিত হওয়ার কারণে এবং বুখারী মুসলিমে থাকার কারণে সনদগত দৃষ্টিকোণ থেকে অধিকতর সহীহ কিন্তু জোড় বাক্যে ইকামতদান সংক্রান্ত হাদীসগুলোতে রয়েছে বাড়তি বিষয়। সুতরাং জোড় বাক্যে ইকামতদান সংক্রান্ত হাদীসগুলো অনুসারে আমল করা অপরিহার্য, বিশেষত এইসব হাদীসের কিছু কিছু হাদীস যখন পরবর্তীকালের বলে প্রমাণিত। যেমনটা তুমি পূর্বে জেনেছ। -নাইলুল আওতার, খ- ২ পৃষ্ঠা ২২
মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবগণ মাওলানা আবদুল মতিন ছাহেবের বইয়ে বিবৃত আল্লামা শাওকানীর উদ্ধৃতির জবাব দিতে গিয়ে লিখেছেন : প্রকৃতপক্ষে উপস্থাপনাটি ইমাম শাওকানীর নিজস্ব কথা নয়। বরং আলেমদের মধ্যকার বিতর্কগুলো তুলে ধরার ধারাবাহিকতায় উক্ত আলোচনাটি এসেছে। কেননা তিনি রাহ. উক্ত উদ্ধৃতির কিছু পরে আবূ মাহযূরা (রা) এর ইকামতের ব্যাপারেও অন্যান্য আলেমগণ বিশ্লেষণ করে বলেছেন, তারা আবূ মাহযূরার হাদীসটিকে মানসূখ বলেছেন। কেননা মক্কা বিজয়ের পর মদীনাতে ফিরেও বিলাল (রা) আযান ও ইক্কামত দিয়েছেন
মুহতারাম, আমি শাওকানী রাহ.-এর পুরো বক্তব্য উদ্ধৃত করে দিচ্ছি। যদ্দারা আপনি বুঝতে পারবেন যে, মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবগণ আরবী বোঝেন না, বা বুঝেও সত্য গোপন করে থাকেন। কার বক্তব্য কতটুকু তিনি বা তাঁরা যে বোঝেন না তা আমি এর পূর্বে কোনো এক চিঠিতে উল্লেখ করে এসেছি। যা ইতোমধ্যে ‘প্রচলিত সালাত কি জাল হাদীসের কবলে?’ নামক বইয়ে মুদ্রিত আকারে জনসাধারণের সামনে চলে এসেছে।
দেখুন, শাওকানী রাহ. উপরিউক্ত বক্তব্যের পরে যা বলেছেন তা নিম্নরূপ-
وَقَدْ أَجَابَ الْقَائِلُوْنَ بِإِفْرَادِ الْإقَامَةِ عَنْ حَدِيْثِ أَبِيْ مِحْذُوْرَةَ بِأَجْوِبَةٍ، مِنْهَا : إِنّ مِنْ شَرْطِ النّاسِخِ أَنْ يّكُوْنَ أَصَحّ سَنَدًا وَأَقْوَمَ قَاعِدَةً وَهَذَا مَمْنُوْعٌ فَإِنّ الْمُعْتَبَرَ فِي النّاسِخِ مُجَرّدُ الصِّحّةِ لَا الْأَصَحِّيّةُ وَمِنْهَا أَنّ جَمَاعَةً مِّنَ الْأَئِمّةِ ذَهَبُوْا إِلَى أَنّ هَذِهِ اللّفْظَةُ فِيْ تَثْنِيةِ الْإقَامَةِ غَيْرُ مَحْفُوْظَةٍ وَرَوَوْا مِنْ طَرِيْقِ أَبِيْ مَحْذُوْرَةَ أَنّ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَآلِهِ وَسَلّمَ أَمَرَهُ أَنْ يَشْفَعَ الْأَذانَ وَيُوْتِرَ الْإقَامَةَ كَمَا ذَكَرَ ذلِكَ الْحَازِمِيّ فِي النّاسِخِ وَالْمَنْسُوْخِ. وَأَخْرَجَهُ الْبُخَارِيّ فِي تَارِيْخِه وَالدّارَقُطْنِي وَابْنُ خُزَيْمَةَ وَهَذَا الْوَجْهُ غَيْرُ نَافِعٍ لِأَنّ الْقَائِلِيْنَ بِأَنّهَا غَيْرُ مَحْفُوْظَةٍ غَايَةُ مَا اعْتَذَرُوْا بِه عَدَمُ الْحِفْظِ وَقَدْ حَفِظَ غَيْرُهُمْ مِنَ الْأَئِمّةِ كَمَا تَقَدّمَ وَمَنْ عَلِمَ حُجّةٌ عَلَى مَنْ لَا يَعْلَمُ. وَأَمّا رِوَايَةُ إِيْتَارِ الْإقَامَةِ عَنْ أَبِيْ مَحْذُوْرَةَ فَلَيْسَتْ كَرِوَايَتِه التّشْفِيْعَ عَلَى أَنّ الْاِعْتِمَادَ عَلَى الرِّوَايَةِ الْمُشْتَمِلَةِ عَلى الزِّيَادَةِ.
وَمِنَ الْأَجْوِبَةِ أَنّ تَثْنِيةَ الْإقَامَةِ لَوْ فُرِضَ أَنّهَا مَحْفُوْظَةٌ وَأَنّ الْحَدِيْثَ بِهَا ثَابِتٌ لَكَانَتْ مَنْسُوْخَةً فَإِنّ أَذَانَ بِلَالٍ هُوَ آخِرُ الْأَمْرَيْنِ لِأَنّ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَآلِهِ وِسَلّمَ لَمّا عَادَ مِنْ حُنَيْنٍ وَرَجَعَ إِلَى الْمَدِيْنَةِ أَقَرّ بِلَالًا عَلَى أَذَانِه وَإِقَامَتِه. قَالُوْا : وَقَدْ قِيْلَ لِأَحْمَدَ بْنِ حَنْبَلٍ : أَلَيْسَ حَدِيْثُ أَبِيْ مَحْذُوْرَةَ بَعْدَ حَدِيْثِ عَبْدِ اللهِ بْنِ زَيْدٍ لِأَنّ حَدِيْثَ أَبِيْ مَحْذُوْرَةِ بَعْدَ فَتْحَ مَكّةَ قَالَ : أَلَيْسَ قَدْ رَجَعَ رَسُوْلُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ إِلَى الْمَدِيْنَةِ فَأَقَرّ بِلَالًا عَلَى أَذَانِ عَبْدِ اللهِ بْنِ زَيْدٍ وَهَذَا أَنْهَضُ مَا أَجَابُوْا بِهِ وَلَكِنّهُ مُتَوَقّفٌ عَلَى نَقْلٍ صَحِيْحٍ أَنّ بِلَالًا أَذّنَ بَعْدَ رُجُوْعِ النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَآلِهِ وَسَلّمَ الْمَدِيْنَةَ وَأَفْرَدَ الْإقَامَةَ وَمُجَرّدُ قَوْلِ أَحْمَدَ بْنِ حَنْبَلٍ لَا يَكْفِيْ فَإِنْ ثَبَتَ ذلِكَ كَانَ دَلِيْلًا لِمَذْهَبِ مَنْ قَالَ بِجَوَازِ الْكُلِّ وَيَتَعَيّن الْمَصِيْرُ إِلَيْهَا لِأَنّ فِعْلَ كُلِّ وَاحِدٍ مِنَ الْأَمْرَيْنِ عَقِبَ الْآخَرِ مُشْعِرٌ بِجَوَازِ الْجَمِيْعِ لَا بِالنّسْخِ.
অর্থাৎ, বেজোড় বাক্যে ইকামতের প্রবক্তাগণ আবূ মাহযূরাহর হাদীসের বেশ কিছু জবাব দিয়েছেন। সেসব জবাবের একটি হল এই : নাসিখ হওয়ার জন্য শর্ত হল, সনদগত দিক থেকে নাসিখকে হতে হবে অধিকতর বিশুদ্ধ এবং কায়দার দিক থেকে অধিকতর সঠিক।
এই বক্তব্যটি ঠিক নয়। কেননা, নাসিখের ক্ষেত্রে যেটা লক্ষ্যযোগ্য তা হচ্ছে শুধু বিশুদ্ধ হওয়া, অধিকতর বিশুদ্ধ হওয়া নয়।
জবাবসমূহের আরেকটি হল এই যে, ইমামগণের একদল এই মত ব্যক্ত করেন যে, জোড় বাক্যে ইকামতের ক্ষেত্রে এই শব্দ মাহফূয ও সংরক্ষিত নয়। এবং তাঁরা আবূ মাহযূরাহর সূত্রে বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে নির্দেশ দিয়েছেন, আযান জোড়া বাক্যে দিতে এবং ইকামত বেজোড় বাক্যে দিতে। যেমনটা হাযিমী তাঁর গ্রন্থ ‘আন নাসিখ ওয়াল মানসূখ’-এ উল্লেখ করেছেন। বর্ণনাটিকে তাখরীজ করেছেন ইমাম বুখারী তাঁর ‘তারীখ’ গ্রন্থে এবং আরও তাখরীজ করেছেন দারাকুতনী ও ইবনে খুযায়মাহ।
জবাবের এই দিকটি (তাদের জন্য) লাভজনক নয়। কারণ, যাঁরা বলেন যে, ঐ শব্দের বর্ণনা মাহফূয নয় তাঁদের এই অজুহাতের সর্বোচ্চ কথা হল, সংরক্ষিত না থাকা। অথচ অন্যান্য ইমামগণ ঐ শব্দকে সংরক্ষণ করেছেন। পূর্বে যেমনটা বিবৃত হয়েছে। আর যে জানে সে ব্যক্তি ঐ ব্যক্তির বিপক্ষে হুজ্জত, যে জানে না। বাকি রইল আবূ মাহযূরাহর সূত্রে বর্ণিত বেজোড় বাক্যের ইকামতের বর্ণনাটি। তো সেটি তাঁর কর্র্তৃক বর্ণিত জোড় বাক্যে ইকামতের বর্ণনার সমপর্যায়ের নয়। তা ছাড়া নির্ভরস্থল হল, ঐ বর্ণনাটি যা অতিরিক্ত বিষয় ধারণ করে।
তাঁদের জবাবসমূহের আরেকটি জবাব হল, যদি ধরেও নেওয়া যায় যে, জোড় বাক্যে ইকামত সংক্রান্ত আবূ মাহযূরাহর হাদীসটি সংরক্ষিত এবং তা প্রমাণিত তবুও বলতে হবে যে, সেটা মানসূখ হয়ে গেছে। কারণ, বিলালের আযান ছিল দুটো ঘটনার (আবূ মাহযূরাহর আযান ও বিলালের আযান) শেষ ঘটনা। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হুনায়ন হতে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন তখন তিনি বিলাল রা.-কে তাঁর (পূর্ব) আযান ও ইকামতের উপর বহাল রাখেন। তাঁরা বলেন, আহমাদ ইবনে হাম্বাল রহ-কে বলা হল, আবূ মাহযূরাহর হাদীস কি বিলালের হাদীসের পরে নয়? কেননা, আবূ মাহযূরার হাদীসটি তো মক্কা বিজয়ের পরের হাদীস? জবাবে আহমাদ ইবনে হাম্বাল রাহ. বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি মদীনায় প্রত্যাবর্তন করে বিলালকে আব্দুল্লাহ ইবনে যায়েদের আযানের উপর বহাল রাখেননি?
তাঁদের জবাবসমূহের মধ্য হতে এই জবাবটি অপেক্ষাকৃত অধিক শক্তিশালী। কিন্তু এটা নির্ভর করে এই বিশুদ্ধ বর্ণনার উপর যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পরে বিলাল রা. আযান দিয়েছিলেন এবং বেজোড় বাক্যে ইকামত দিয়েছিলেন। শুধু আহমাদ ইবনে হাম্বালের উক্তি এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। যদি তা প্রমাণিত হয় তাহলে ঐ সকল ব্যক্তিবর্গের অভিমতের পক্ষে এটি একটি দলীল হবে যাঁরা উভয়রকমের ইকামতের বৈধতার কথা বলেন। কেননা, দুটির প্রত্যেকটির একটির অপরটির পরে হওয়া উভয়প্রকারের বৈধতার কথা জানান দেয়, না নাস্খ বা রহিত হওয়ার কথা।’
মুহতারাম, লক্ষ করেছেন নিশ্চয়ই যে, যাঁরা আবূ মাহযূরাহর হাদীসের জবাব দিতে চেষ্টা করেছেন আল্লামা শাওকানী রাহ. প্রথমে তাঁদের জবাবগুলোকে একটি একটি করে বর্ণনা করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্রতিটি জবাবের পর ঐ জবাবকে খ-ন করতে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। স্বাভাবিক বর্ণে লিখিত কথাগুলো তাঁদের, যাঁরা আবূ মাহযূরাহর হাদীসের জবাব দিতে চেষ্টা করেছেন। আর ইটালিক করা অংশগুলো আল্লামা শাওকানীর বক্তব্য। আল্লামা শাওকানী তাঁদের শেষ জবাবের যে প্রতিজবাব দিয়েছেন তাতে তিনি দেখিয়েছেন যে, তাঁদের এই জবাবটি উভয়টাই আমলযোগ্যতার ও বৈধতার প্রমাণ বহন করে; আবূ মাহযূরাহর হাদীসটির মানসূখ হওয়া প্রমাণ করে না। আল্লামা শাওকানীর মূল কথা এই যে, বিলাল রা.-এর বেজোড় বাক্যে ইকামতদানের বিধানটিই মানসূখ হয়ে গেছে। এরপর আবূ মাহযূরাহর হাদীস সম্পর্কে যাঁরা বিভিন্ন জবাব দিয়েছেন তাঁদের জবাবের জবাব দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে, তাঁদের জবাবটি বেশির চেয়ে বেশি এই কথা প্রমাণ করে যে, উভয়টাই আমলযোগ্য; এটা প্রমাণ করে না যে, আবূ মাহযূরাহর হাদীসটি মানসূখ।
আল্লামা শাওকানীর বক্তব্য মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবরা বুঝতে পারেননি। ফলে তাঁরা তাঁর বক্তব্য নিয়ে যে মন্তব্য বা বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন তা হ য ব র ল হয়ে গেছে।
তবে আল্লামা শাওকানী রাহ. বিলাল রা.-এর বেজোড় বাক্যের ইকামতকে মানসূখ বলে যে দাবি করেছেন তা আমি সমর্থন করি না। আবার ইবনে হাযমসহ অন্যান্যরা আবূ মাহযূরাহর হাদীসকে যে মানসূখ বলেছেন তাও সমর্থন করি না। কারণ, শুধু পরবর্তিতা নাসিখ হওয়ার একটা লক্ষণ মাত্র, নিশ্চিত কোনো দলীল নয়। কোনো হাদীস বা আমলকে অপর কোনো হাদীস বা আমলের জন্য নাসিখ হিসাবে সাব্যস্ত করতে হলে আরও যেসব প্রমাণ ও লক্ষণাবলী বিদ্যমান থাকা প্রয়োজন তা এখানে অনুপস্থিত।
তা ছাড়া আবূ মাহযূরাহ রা.-কে জোড়া বাক্যে ইকামতদান শিক্ষা দেওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনায় ফিরে আসেন তখন বিলাল রা.-এর বেজোড় বাক্যে ইকামতদানকে বহাল রাখেন বলেই অনুমিত হয়। এটি সুনিশ্চিত না হলেও সম্ভাবনাযুক্ত তো বটে। অপরদিকে বিলাল রা. কর্তৃক রাসূলের ইন্তিকালের পরে জোড় বাক্যে ইকামতদানের বিষয়টি সুপ্রমাণিত। কাজেই এখানে কোনোটাকেই কোনোটার জন্য নাসিখ বলা এবং অপরটিকে মানসূখ বলার অবকাশ আছে বলে আমি মনে করি না। বরং উভয়টিকেই আমলযোগ্য মনে করি। তবে আমরা জোড় বাক্যের ইকামতকে আমলের জন্য নির্বাচন কেন করলাম সে আলোচনাই করছিলাম। তার একটি কারণ উল্লেখ করেছি (ক) চিহ্ন যুক্ত করে। এরপর আরও কারণ উল্লেখ করছি।
(খ) হযরত বিলাল রা.-কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুল্লাহ ইবনে যায়েদের স্বপ্ন অনুযায়ী আযান ও ইকামত দিতে বলেছিলেন। আর তাই তিনিও বেশ কিছুদিন জোড়া জোড়া বাক্যেই ইকামত দিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে যে বেজোড় বাক্যে ইকামত দিতে বলেছিলেন তা ছিল আরও পরের ঘটনা। বুখারী মুসলিমসহ অন্যান্য গ্রন্থের হাদীসে যেটি বলা হয়েছে যে, বিলাল রা. এক এক বাক্যে ইকামত দিতে আদিষ্ট হয়েছিলেন তা পরবর্তীকালের ঘটনা। প্রথমে তিনি আবদুল্লাহ ইবনে যায়েদ ইবনে আবদি রাব্বিহির দেখা স্বপ্নের বাক্যগুলো দিয়েই ইকামত দিতেন।
কেউ বলতে পারে যে, হযরত বিলাল রা. প্রথম থেকেই ইকামত একবার করে দেওয়ার জন্য আদিষ্ট হয়েছিলেন। এর দলীল হল, হযরত আনাস রা. কর্তৃক বর্ণিত এই হাদীস-
عَنْ أَنَسٍ قَالَ ذَكَرُوا النّارَ وَالنّاقُوْسَ فَذَكَرُوا الْيَهُوْدَ وَالنّصَارَى فَأُمِرَ بِلَالٌ أَنْ يَشْفَعَ الْأَذَانَ، وَأَنْ يُوْتِرَ الْإقَامَةَ.
অর্থাৎ, হযরত আনাস বলেন, লোকেরা আগুন ও নাকূসের উল্লেখ করল তো সঙ্গে সঙ্গে তারা ইয়াহূদী ও নাসারাদের কথাও স্মরণ করল। ফলে বিলালকে নির্দেশ দেওয়া হল আযান জোড়া বাক্যে দিতে এবং ইকামত এক বাক্যে দিতে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০৩, ৬০৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮৬৫
এই হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, আযান বিষয়ে পরামর্শের অব্যবহিত পরেই বিলাল রা.-কে উপরিউক্ত নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কাজেই বলা যায় যে, বিলাল রা. প্রথম থেকেই ইকামত এক এক বাক্যে দিতেন। তিনি জোড়া বাক্যে ইকামত কখনওই দেননি।
এর জবাবে বলব যে, এখানে বর্ণনাকারী হযরত আনাস রা. আযানের সূচনা সংক্রান্ত ইতিহাসের বিস্তারিত বিবরণ দান করেননি। তিনি ইতিহাসের কিছু অংশ সংক্ষিপ্তরূপে উল্লেখ করেছেন এবং এরপর বিলাল রা.-কে আযান ও ইকামতের বাক্যগুলো কীভাবে বলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তা উল্লেখ করেছেন। এর সবচেয়ে বড় দলীল হল, জোড়া বাক্যে ইকামতদান সংক্রান্ত হাদীসসমূহের মধ্য হতে উল্লেখকৃত প্রথম হাদীস। যেটি আমাদের জানান দেয় যে, আবদুল্লাহ ইব্ন যায়েদ রা. কর্তৃক আযান ও ইকামত স্বপ্নে দেখে তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ব্যক্ত করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেলাল রা.-কে আবদুল্লাহ ইব্ন যায়েদ রা. কর্তৃক স্বপ্নে দেখা আযান ও ইকামতের অনুরূপ আযান ও ইকামতদানের নির্দেশ দেন। এর আরও নিদর্শন হল, সহীহ বুখারীর ৬০৪ নং হাদীস। হাদীসটি এই :
أَنّ اِبْنَ عُمَرَ كَانَ يَقُوْلُ كَانَ الْمُسْلِمُوْنَ حِيْنَ قَدِمُوْا الْمَدِيْنَةَ يَجْتَمِعُوْنَ فَيَتَحَيّنُوْنَ الصّلَاةَ لَيْسَ يُنَادَى لَهَا فَتَكَلّمُوْا يَوْمًا فِيْ ذلِكَ. فَقَالَ بَعْضُهُمْ : اِتّخِذُوْا نَاقُوْسًا مِثْلَ نَاقُوْسِ النّصَارَى وَقَالَ بَعْضُهُمْ بَلْ بُوْقًا مِثْلَ قَرْنِ الْيَهُوْدِ. فَقَالَ عُمَرُ أَوَلَا تَبْعَثُوْنَ رَجُلًا يُنَادِيْ بِالصّلَاةِ، فَقَالَ رَسُوْلُ الله صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَا بِلَالُ قُمْ فَنَادِ بِالصّلَاةِ.
অর্থাৎ ইব্ন উমার রা. বলতেন, মুসলমানেরা যখন মদীনায় আগমন করল তখন তারা একত্রিত হয়ে সালাতের জন্য একটা সময় নির্ধারণ করে নিত (যাতে তারা সেই সময়ে সালাতে একত্রিত হতে পারে)। একদিন তারা এ ব্যাপারে পরামর্শ করল। তাদের কেউ কেউ বলল, নাসারাদের ঘণ্টার মত ঘণ্টা অবলম্বন কর। আর কেউ কেউ বলল, ইহুদীদের মত শিংগা অবলম্বন কর। তখন উমর রা. বললেন, তোমরা একজন ব্যক্তিকে প্রেরণ কর না কেন, যে সালাতের আহ্বান জানাবে? তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘বেলাল, যাও, সালাতের আহ্বান জানাও।’
এই হাদীসে দেখা যাচ্ছে যে, পরামর্শের পর হযরত উমার রা. যখন বললেন, তোমরা একজন লোককে সালাতের জন্য আহ্বান করতে কেন পাঠাওনা তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেলালকে বললেন, সালাতের জন্য আহ্বান জানাতে। হযরত আনাসের হাদীসে এই কথাটুকুও বিবৃত হয়নি। বুঝা গেল, তিনি আযানের সূচনা সংক্রান্ত ইতিহাসকে সংক্ষিপ্তরূপে বর্ণনা করেছেন।
তাছাড়া এই হাদীসের قُمْ فَنَادِ بِالصّلَاةِ (যাও, সালাতের আহ্বান জানাও) কথাটির ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. বলেন,
قَوْلُهُ (فَنَادِ بِالصّلَاةِ) فِىْ رِوَايَةِ الْإسْمَاعِيْلِى "فَأَذِّنْ بِالصَلَاةِ " قَالَ عِيَاضٌ اَلْمُرَادُ اَلْإعْلَامُ الْمَحضُ بِحُضُوْرِ وَقْتِهَا لَاخُصُوْصُ الْأَذَانِ الْمَشْرُوْعِ.
অর্থাৎ ইয়ায বলেছেন, এটা দ্বারা ‘সালাতের জামাতের সময় হয়েছে’- এই বিষয়টি জানান দেওয়ার কথা বুঝানো হয়েছে। প্রচলিত ও বিধিবদ্ধ আযানের মাধ্যমে আহ্বান জানানো বুঝানো হয়নি।
ঐ সময়ে যে শব্দ দ্বারা বেলাল রা. সালাতের জামাতের সময় হওয়ার কথা জানান দিতেন তা কী ছিল? তো সে সম্পর্কে সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব রাহ.-এর একটি মুরসাল হাদীস তবাকাতে ইবনে সা‘দ-এ বিবৃত হয়েছে যে, তা ছিল الصّلَاةُ جَامِعَةٌ (সালাতের জামাত শুরু হতে যাচ্ছে)। -ফাতহুল বারী, খ- ২, পৃষ্ঠা ১০২, ১০৩, প্রকাশক : দারুল হাদীস, কায়রো
ইবনে হাজার রাহ. আরও বলেন,
وَالظّاهِرُ أَنّ إِشَارَةَ عُمَرَ بِاِرْسَالِ رَجُلٍ يُنَادِيْ لِلصَلَاةِ كَانَتْ عَقِبَ الْمُشَاوَرَةِ فِيْمَا يَفْعَلُوْنَهُ، وَ إِنّ رُؤْيَا عَبْدِ اللهِ بْنِ زَيْدٍ كَانَتْ بَعْدَ ذالِكَ.
অর্থাৎ স্পষ্ট বিষয় হচ্ছে এই যে, উমার রা. কর্তৃক সালাতের আহ্বান জানাতে কোনো ব্যক্তিকে পরামর্শদানটা ছিল তারা কী করবে সে বিষয়ে পারস্পরিক পরামর্শের পরে। আর আবদুল্লাহ ইবনে যায়েদের স্বপ্নটি ছিল এরও পরে। -ফাতহুল বারী, খ- ২, পৃষ্ঠা ১০২
অতএব এই বিষয়টি দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, হযরত বিলাল রা.-কে বেজোড় বাক্যে ইকামত দান করার নির্দেশ দেওয়ার ঘটনাটি ছিল পরবর্তীকালের ঘটনা। প্রথমে তিনি আবদুল্লাহ ইবনে যায়েদ কর্তৃক দেখা স্বপ্নের বাক্যগুলো দিয়েই আযান ও ইকামত দিতেন। আর সে ইকামত ছিল জোড়া জোড়া বাক্যে।
এইজন্যই পূর্বে বলেছিলাম যে, সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমসহ অন্যান্য সুনান গ্রন্থের যে হাদীসের কথা আপত্তিকারী বলেছেন তা আযানের ইতিহাস সংক্রান্ত নয়। সেটি ভিন্ন প্রকৃতির হাদীস। সুতরাং আবদুল্লাহ ইবনে যায়েদের স্বপ্ন সংক্রান্ত হাদীস বাহ্য দৃষ্টিতে ঐসব হাদীসের বিরোধী হওয়ার কারণে শায হতে পারে না। কোনো হাদীসকে শায বলা যায় তখন, হাদীসটির সনদের সকল রাবী ছিকাহ হওয়া সত্ত্বেও যখন সেটি হয় দলবিচ্ছিন্ন বর্ণনা। কিংবা হাদীসটির সনদ সহীহ হওয়া সত্ত্বেও যখন হাদীসটির বক্তব্য হয় বিচ্ছিন্ন একটি বক্তব্য, যার কোনো সমর্থন অন্য কোনো বর্ণনা দ্বারা পাওয়া যায় না এবং যেটিকে তার বিরোধী হাদীসের সাথে কোনোভাবেই সমন্বয় করা যায় না। আলোচ্য ক্ষেত্রে এইসব কারণের কোনো একটিকেও দেখতে পাচ্ছি না।
আমার পুরো আলোচনাটি পাঠ করলে আপনি দেখতে পাবেন যে, সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত বেজোড় বাক্যে ইকামতদান সংক্রান্ত হাদীসটির সঙ্গে জোড় বাক্যে ইকামতদান সংক্রান্ত হাদীসসমূহের কোনো বিরোধ নেই। কাজেই জোড় বাক্যে ইকামতদান সংক্রান্ত প্রত্যেকটি হাদীসের জবাবে মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবরা যে দাবি করেছেন যে, হাদীসটি সহীহ মুসলিমের সহীহ হাদীসের বিরোধী বিধায় শায ও পরিত্যাজ্য তা যুক্তিতে টেকে না।
(গ) হযরত বিলাল রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় প্রথম দিকে যেমন আবদুল্লাহ ইবনে যায়েদ রা.-এর স্বপ্নে দেখা বাক্যগুলোর অনুসরণে জোড়া জোড়া বাক্যে ইকামত দিতেন তেমনই রাসূলের ইন্তিকালের পরেও তিনি জোড়া জোড়া বাক্যে ইকামত দিয়েছেন। সুওয়াইদ ইবনে গাফালাহ ও আসওয়াদ ইবনে ইয়াযীদের হাদীস দ্বারা তা প্রমাণিত। বিশিষ্ট তাবিঈ ইবরাহীম নাখাঈর একটি মুরসাল বর্ণনাও প্রমাণ করে যে, বিলাল রা. জোড়া জোড়া বাক্যে ইকামত দিতেন। আর পূর্বেই আলোচনা করে এসেছি যে, ইবরাহীম নাখাঈর মুরসাল বর্ণনা মুহাদ্দিসগণের নিকট গ্রহণযোগ্য।
আপনি প্রশ্ন করতে পারেন যে, বিলাল রা. প্রথমে জোড়া জোড়া বাক্যে ইকামত দিলেও পরবর্তীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাঁকে বেজোড় বাক্যে ইকামত দিতে আদেশ করলেন আর তিনিও রাসূলের জীবদ্দশার পুরো সময়টা বেজোড় বাক্যে ইকামত দিলেন তখন রাসূলের ইন্তিকালের পর তিনি রাসূলের আদেশ অমান্য করে কেন জোড়া জোড়া বাক্যে ইকামত দিলেন?
এই প্রশ্নের জবাবে বলব যে, এই বেশিটি তো সুনির্দিষ্টভাবেই প্রমাণিত যে, বেলাল রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকাল পর্যন্ত বেজোড় বাক্যেই ইকামাত দিয়েছেন। তাছাড়া বেলাল রা. রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সকল শিক্ষাকে সামনে রেখে বুঝেছিলেন যে, বেজোড় বাক্যে ইকামত দেওয়া যেমন সুন্নাহসম্মত তেমনই জোড়া জোড়া বাক্যে ইকামত দেওয়াটাও সুন্নাহসম্মত। কারণ, তিনি জানতেন যে, মক্কার মুআযযিন আবূ মাহযূরাহ রা.-কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জোড়া জোড়া বাক্যে ইকামত শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং আবূ মাহযূরাহ রা. সারা জীবন সেইমতেই জোড়া জোড়া বাক্যে ইকামত দিয়েছেন। এবং খোদ তিনিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপস্থিতিতে মিনাতে জোড়া জোড়া বাক্যে ইকামত দিয়েছিলেন। যেমনটি আবুশ শায়েখের বরাতে শাওকানী রাহ. উল্লেখ করেছেন। কাজেই জোড়া জোড়া বাক্যে ইকামত দিলে তাতে রাসূলের আদেশ লংঘিত হবে না।
(ঘ) সাহাবীগণের বহু শিষ্যের আমল ছিল জোড়া জোড়া বাক্যে ইকামত দেওয়া। যেমনটা আমরা জানতে পেরেছি যে, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. ও আলী রা.-এর শিষ্যগণ জোড়া জোড়া বাক্যে ইকামত দিতেন।
(ঙ) সেই সঙ্গে ইবরাহীম নাখাঈর উক্তি ও ফতোয়া আমাদের জানান দেয় যে, তাবিঈগণের মধ্যে জোড়া জোড়া বাক্যে ইকামত দেওয়ার রীতি ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল।
(চ) হুনায়নের যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে হযরত আবূ মাহযূরাহ রা.-কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জোড়া জোড়া বাক্যে ইকামত শিক্ষা দিয়েছিলেন। এটি ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের শেষদিকের ঘটনা।
সারকথা
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যায়েদ রা. যে আযান ও ইকামত স্বপ্নে দেখেছিলেন সেই আযান ও ইকামত উভয়টি ছিল জোড়া জোড়া বাক্যে। (আমাদের দেশে ঐ আযান ও ইকামতই প্রচলিত।) হযরত বিলাল রা. আযান ও ইকামতের সূচনালগ্ন থেকে বেশ কিছুদিন জোড়া জোড়া বাক্যেই ইকামত দিয়েছিলেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের পরও তিনি জোড়া জোড়া বাক্যে ইকামত দিয়েছিলেন বলে প্রামাণ্য বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত। সাহাবীগণের শিষ্যগণও জোড়া জোড়া বাক্যে ইকামত দিয়েছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। সহীহ সনদে বিখ্যাত তাবিঈ ইবরাহীম নাখাঈর উক্তি ও ফতোয়া পাওয়া যাচ্ছে জোড়া জোড়া বাক্যে ইকামতদানের পক্ষে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবনের শেষ দিকে তাঁর কর্তৃক মক্কায় নিয়োজিত মুয়াযযিন হযরত আবূ মাহযূরাহ রাযি-কে যে ইকামত শিক্ষা দিয়েছিলেন তা ছিল জোড়া জোড়া বাক্যে। ইত্যাদি কারণে আমরা জোড়া জোড়া বাক্যের ইকামতকে প্রাধান্য দান করেছি। এবং সেই অনুযায়ীই আমরা আমল করছি। কিন্তু আমরা মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবদের ন্যায় ভিন্ন আমলকে তথা বেজোড় বাক্যে ইকামতদানের উপর আমল করাকে পথভ্রষ্টতা, গোমরাহী ইত্যাদি বলি না।
মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব তাঁর বইতে একদিকে বলেছেন ইকামতের শব্দগুলো জোড়া জোড়া বলা জায়েয, তবে বেজোড় বাক্যে দেওয়া উত্তম। অপরদিকে তিনি বা তাঁর পক্ষালম্বীরা ইন্টারনেটে জোড়া জোড়া বাক্যে ইকামত দেওয়াকে বলছেন পথভ্রষ্টতা ও গোমরাহী। তাঁদের এই গুরুচ-ালী চরিত্রটি তাঁরা কোত্থেকে অর্জন করেছেন জানি না। আচ্ছা বলুন, যেটা জায়েয সেটা করা কি গোমরাহী? পথভ্রষ্টতা? সুবহানাল্লাহ! এরা নিজেদের গোঁয়ার্তুমি বজায় রাখতে হেন কোনো ভাষা নেই যা এরা ব্যবহার করতে দ্বিধা করে। আপনার মাধ্যমে তাঁদেরকে বলছি, আল্লাহ তাআলার নির্দেশের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ রাখতে। নির্দেশটি হল এই-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَقُولُوا قَوْلًا سَدِيدًا
হে মুমিনগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল। -সূরা আহযাব (৩৩) : ৭০
শেষ কথা
আমি পূর্বেই বলেছি যে, জোড় বাক্যে ইকামত ও বেজোড় বাক্যে ইকামত উভয়টিই সুন্নাহসম্মত। কোনো একটির উপর আমল করাকে না গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতা বলা যায়, না গোঁড়ামি বলা যায়। পূর্ববর্তীকালের বড় বড় ফকীহ ইমামগণের মধ্যেও বিষয়টি নিয়ে মতভেদ ছিল। কিন্তু তাঁদের কেউ কাউকে গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট আখ্যা দেননি। আল্লামা ইব্ন আবদুল বার রাহ.-এর বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম আহমাদ, ইসহাক, দাউদ যাহিরী ও ইবনে জারীর তাবারী প্রমুখ মুহাদ্দিস ও ফকীহগণ এই মতভেদকে সুন্নাহভিত্তিক মতভেদ আখ্যা দিয়েছেন এবং বলেছেন, যে যেভাবেই আমল করুক তা বৈধ বলে পরিগণিত হবে। এখন এ সম্পর্কে দুইজন বরেণ্য আলেম, ফকীহ ও মুহাদ্দিসের অভিমত উদ্ধৃত করে আমার আলোচনা শেষ করব। লা-মাযহাবী আলেম তিরমিযী শরীফের বিখ্যাত ভাষ্যকার আবদুর রহমান মুবারকপুরী সাহেব লেখেন :
مَا ذَهَبَ إِلَيْهِ الْإمَامُ أَحْمَدُ وَإِسْحَاقُ بْنُ رَاهُوْيَهْ وَغَيْرُهُمَا مِنْ جَوَازِ إِفْرَادِ الْإقَامَةِ وَتَثْنِيتِهَا هُوَ الْقَوْلُ الرّاجِحُ الْمَعْمُوْلُ عَلَيْهِ بَلْ هُوَ الْمُتَعَيِّنُ عِنْدِيْ
অর্থাৎ, একবার করে বলা বা দুইবার বলা উভয়টিই জায়েয বলে আহমাদ ও ইসহাক ইবনে রাহুইয়াহ যে মত অবলম্বন করেছেন সেটিই অগ্রগণ্য ও বাস্তবসম্মত মত। বরং এই মতটিই আমার দৃষ্টিতে সুনির্দিষ্ট।
আল্লামা ইবনে তাইমিয়াহ রাহ. -যাঁর মতামতকে বর্তমানকালের লা মাযহাবীরাও অত্যধিক গুরুত্ব সহকারে মূল্যায়ণ করেন এবং গ্রহণ করে থাকেন- বলেন :
فَمَنْ شَفَّعَ الْإِقَامَةَ فَقَدْ أَحْسَنَ وَمَنْ أَفْرَدَهَا فَقَدْ أَحْسَنَ وَمَنْ أَوْجَبَ هَذَا دُوْنَ هَذَا فَهُوَ مُخْطِئٌ ضَالٌّ وَمَنْ وَالَى مَنْ يَفْعَلُ هَذَا دُوْنَ هَذَا فَهُوَ مُخْطِئٌ ضَالٌّ.
অর্থাৎ, তো যে ব্যক্তি দুই দুই বাক্যে ইকামত দিল সে উত্তম কাজ করল। আর যে ব্যক্তি এক এক বাক্যে ইকামত দিল সেও উত্তম কাজ করল। আর যে ব্যক্তি একটাকে বাদ দিয়ে অপরটাকে অপরিহার্য সাব্যস্ত করল সে বিভ্রান্ত, পথভ্রষ্ট। আর যে ব্যক্তি কোনো ব্যক্তিকে শুধু এ কারণেই বন্ধুরূপে গ্রহণ করল যে সে একটাকে বাদ দিয়ে অপরটিকে গ্রহণ করেছে সে বিভ্রান্ত, পথভ্রষ্ট। -মাজমূউল ফাতাওয়া, খ- ২২, পৃষ্ঠা ২৫৪
এরপর ইবনে তাইমিয়াহ রাহ. প্রত্যেক মাযহাবের বাড়াবাড়িকারীদের সম্পর্কে বলেছেন যে, শাফিঈ মতাবলম্বীদের মধ্য থেকে যারা অসহিষ্ণু, অনুদার ও সংকীর্ণচিত্ত তাদেরকে তুমি দেখবে হানাফী মাযহাবের বিরোধিতায় বাড়াবাড়ি করতে, তদ্রূপ হানাফী মতাবলম্বীদের মধ্য হতে যারা অসহিষ্ণু, অনুদার ও সংকীর্ণচিত্ত তাদেরকে তুমি দেখবে শাফিঈ মাযহাবের বিরোধিতায় বাড়াবাড়ি করতে। ফলে তারা দ্বীন থেকে বের হয়ে যায়। অনুরূপভাবে তুমি হাম্বালী মাযহাবের অসহিষ্ণু ও অনুদার ব্যক্তিদেরকে দেখবে এই মাযহাবের, ঐ মাযহাবের বিরোধিতায় বাড়াবাড়ি করতে। তদ্রূপ মালেকী মাযহাবের অসহিষ্ণু, অনুদার ও সংকীর্ণচিত্ত ব্যক্তিদেরকে দেখবে এই মাযহাব, ঐ মাযহাবের বিরোধিতায় বাড়াবাড়ি করতে।
এরপর তিনি লেখেন :
وَكُلّ هَذَا مَنَ التّفَرّقِ وَالْاخْتِلَافِ الّذِي نَهَى اللهُ وَرَسُوْلُهُ عَنْهُ، وَكُلّ هَؤُلَاءِ الْمُتَعَصِّبِيْنَ بِالْبَاطلِ الْمُتّبِعِيْنَ الظّنّ وَمَا تَهْوَى الْأَنْفُسُ، الْمُتّبِعِيْنَ لِأَهْوَائِهِمْ بِغَيْرِ هُدًى مِّنَ اللهِ، مُسْتَحِقُوْنَ لِلذّمِّ وَالْعِقَابِ.
অর্থাৎ, এগুলো সব আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কর্তৃক নিষিদ্ধ বিচ্ছিন্নতা ও বিভেদের অন্তর্ভুক্ত। আর এই সব বাতিল অসহিষ্ণু ব্যক্তিরা -যারা ধারণা ও মন যা চায় তার অনুসারী, আল্লাহ তাআলার হেদায়েতশুন্য-প্রবৃত্তির অনুসারী- নিন্দা ও শাস্তির উপযুক্ত। -মাজমূঊল ফাতাওয়া, খ- ২২, পৃষ্ঠা ২৫৪
তাহলে বুঝুন, যে সকল মুযাফফর বিন মুহসিন বেজোড় বাক্যের ইকামতকে একমাত্র গ্রহণযোগ্য বলে থাকে এবং জোড় বাক্যের ইকামত গ্রহণকারীদেরকে পথভ্রষ্ট ও গোমরাহ আখ্যা দেয় তারা তাঁদেরও বরণীয় আবদুর রহমান মুবারকপুরী ও ইবনে তাইমিয়ার বক্তব্য অনুযায়ী কোন্ পর্যায়ের? গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট কি তারা, যারা ইকামতের বাক্যগুলোকে দু’বার করে বলাকে সুন্নাহসম্মত মনে করে তদনুযায়ী আমল করেন কিন্তু বেজোড় বাক্যে ইকামত দেওয়াকে সুন্নাহ-বিরোধী বলে মনে করেন না, নাকি মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবরা?
কথা শেষ হয়েও শেষ হচ্ছে না। কারণ, মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবদের ধারণা অনুযায়ী বুখারী ও মুসলিমের হাদীস থাকতে অন্য কিতাবের হাদীসের দিকে ধাবিত হওয়া ভ্রষ্টতা ও গোমরাহী। এ সম্পর্কে তাদের বক্তব্য নিয়ে আলোচনা করা হয়নি। এখন করছি।
বুখারী ও মুসলিমের হাদীসের বিপরীতে অন্য কিতাবের হাদীস দ্বারা দলীলগ্রহণ কি ভ্রষ্টতা?
মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবগণ লিখেছেন : আমাদের পরবর্তী আলোচনায় দেখাব আমাদের লেখক (‘দলীলসহ নামাযের মাসায়েল’ বইয়ের লেখক আবদুল মতীন সাহেব) সহীহ বুখারী ও মুসলিমের ঐকমত্যের বিরোধিতায় কিভাবে ইবনে আবী শাইবাহ, তাহাবী, অন্যান্য সুনান ও মুসনাদের গ্রন্থকে ব্যবহার করেছেন, যা সুস্পষ্ট বিদআত ও মুমিনদের বিরোধী পথ (সূরা নিসা : ১১৫)। উল্লেখ্য, কুরআনের দাবী অনুযায়ী যা আল্লাহ নাযিল করেছেন তা পরস্পর বিরোধী হবে না (সূরা নিসা : ৮২)। নবী (স) এর হাদীস অনুযায়ী কিতাবের একাংশকে অপরাংশ দ্বারা দলীল উপস্থাপন করে বিতর্ক অবস্থায় রাখা যাবে না (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)। এর কিছু পরে তাঁরা লিখেছেন : আসুন এখন আমরা দেখি কিভাবে সহীহ হাদীসের মোকাবেলায় এই উম্মতের ধ্বংসপ্রাপ্তরা যঈফ ও জাল হাদীস উপস্থাপন করে।
মুহতারাম, এরা সহীহ বুখারী ও মুসলিমের বিরোধিতায় ইবনে আবী শাইবাহ, তাহাবী, অন্যান্য সুনান ও মুসনাদ গ্রন্থের হাদীস উপস্থাপন করাকে সুস্পষ্ট বিদআত বলে আখ্যা দিয়েছে এবং এর পক্ষে দলীল হিসাবে তারা সূরা নিসার ১১৫ নং আয়াতের বরাত দিয়েছে। আপনি একটু কষ্ট করে দেখুন তো সূরা নিসার ঐ আয়াতে কোথায় বলা হয়েছে যে, বুখারী ও মুসলিমের বিরোধিতায় ঐ সকল গ্রন্থের হাদীস দ্বারা দলীল গ্রহণ সুস্পষ্ট বিদআত? কুরআনের ঐ আয়াতটি কি তাহলে রাসূলের ইন্তিকালের সোয়া দুইশত বছর পরে বুখারী মুসলিম সংকলিত হওয়ার পর নাযিল হয়েছে? সুবহানাল্লাহ! এরা যে কিরকম জালিয়াতির আশ্রয় নিতে পারে এটি তার একটি জ¦লন্ত নিদর্শন। আয়াতটিতে এ কথা বলা হয়েছে যে, (তরজমা) “সৎপথ স্পষ্ট হওয়ার পর যে ব্যক্তি রাসূলের বিরোধিতা করে এবং মুমিনদের পথ ভিন্ন অন্য কোনো পথের অনুসরণ করে, আমি তাকে সেই পথেই পরিচালিত করব যে পথ সে অবলম্বন করেছে এবং তাকে আমি জাহান্নামে প্রবেশ করাবো এবং জাহান্নাম অত্যন্ত মন্দ ঠিকানা।”
বুখারী ও মুসলিমে সব সহীহ হাদীস নেই
মুহতারাম, অনেকের মত মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবরাও সম্ভবত এই ধারণা পোষণ করেন যে, বুখারী ও মুসলিম ব্যতীত অন্য কোনো গ্রন্থে সহীহ হাদীস নেই। থাকলেও তা বুখারী ও মুসলিমের সহীহ হাদীসের সমপর্যায়ের সহীহ নয়। এই কারণে কোনো বিষয়ে হাদীস পেশ করা হলে বলে, হাদীসটি বুখারী ও মুসলিমে নেই, বুখারী মুসলিমের হাদীস দেখান। কিংবা বলে, এর বিপরীতে বুখারী মুসলিমে যে হাদীস আছে তা অধিকতর সহীহ।
এটা উসূলুল ফিকহ ও উসূলুল হাদীস সম্পর্কে অজ্ঞতাজনিত কথা। এইসব আল্লাহর বান্দাহরা যদি এ সম্পর্কে খোদ বুখারী ও মুসলিমের বক্তব্য কী তা জানার চেষ্টা করত তাহলে এইরূপ কথা বলত না। কারণ খোদ ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম রাহ. পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন যে, তাঁরা তাঁদের কিতাবুস সহীহতে সব সহীহ হাদীস সংকলন করেননি। তার ইচ্ছাও করেননি। কথাটি উভয় ইমাম থেকে সহীহ সনদে প্রমাণিত।
ইমাম বুখারী রাহ. বলেছেন,
مَا أَدْخَلْتُ فِى كِتابِيْ "اَلْجَامِعِ" إِلّا مَا صَح وَتَرَكْتُ مِنَ الصِّحَاحِ لِحَالِ الطُّوْلِ.
আমি আমার কিতাবুল জামি‘তে শুধু সহীহ হাদীস এনেছি। তবে গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় (বহু) সহীহ হাদীস আনা থেকে বিরত থেকেছি। -ইবনে আদী, আল কামিল, খ- ১, পৃষ্ঠা ২২৬; খতীব বাগদাদী, তারীখে বাগদাদ, খ- ২, পৃষ্ঠা ৮-৯
‘শুরূতুল আইম্মাতিল খামছা’য় (পৃষ্ঠা ১৬০-১৬৩) ইমাম ইসমাঈলীর সূত্রে ইমাম বুখারীর বক্তব্যের আরবী পাঠ এইরূপ :
لَمْ أُخَرِّجْ فِيْ هَذَا الْكِتَابِ إِلّا صَحِيْحًا وَمَاتَرَكْتُ مِنَ الصّحِيْحِ أَكْثَرُ
আমি এই কিতাবে শুধু সহীহ হাদীস এনেছি। আর যে সহীহ হাদীস আনিনি তার সংখ্যা বেশি।
বুঝা গেল, ইমাম বুখারী মনস্থ করেছিলেন, তাঁর কিতাবে তিনি যা আনবেন তা হবে সহীহ হাদীস। কিন্তু তিনি এই মনস্থ করেননি যে, সব সহীহ হাদীস তিনি তাঁর কিতাবে আনবেন। সব সহীহ হাদীস আনার ইচ্ছাও করেননি, আনেনওনি। অনেক সহীহ হাদীস তাঁর কিতাবের বাইরে রয়ে গেছে।
ইমাম মুসলিমের ব্যাপারটিও একই রকম। তিনিও তাঁর কিতাবে সব সহীহ হাদীস আনার ইচ্ছাও করেননি, আনেনওনি। খতীব বাগদাদী রাহ. ‘তারীখে বাগদাদে’ (খ- ১২, পৃষ্ঠা ২৭৩, তরজমা : আহমদ ইবনে ঈসা আততুসতুরী) এবং হাযেমী ‘শুরূতুল আইম্মাতিল খামসা’য় (পৃষ্ঠা ১৮৫) বর্ণনা করেছেন যে, ইমাম আবূ যুর‘আ রাযী রাহ. (ইমাম মুসলিম রাহ.-এর উস্তায) একবার সহীহ মুসলিম সম্পর্কে বললেন, এর দ্বারা তো বিদ‘আতপন্থীদের জন্য পথ খুলে দেওয়া হল। তাদের সামনে যখন কোনো হাদীস দ্বারা দলীল দেওয়া হবে তখন তারা বলবে, এ তো কিতাবুস সহীহতে নেই।
আবূ যুর‘আ রাযী রাহ. বুঝাতে চাচ্ছেন যে, সব সহীহ হাদীস তো সহীহ মুসলিমে সংকলিত হয়নি। কাজেই কিতাবের নামের সাথে যখন সহীহ কথাটি যুক্ত করা হয়েছে তখন এর দ্বারা পরবর্তীতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে এবং মানুষ সহীহ মুসলিমে কোনো হাদীস না পেলে সেটা সহীহ হওয়া সত্ত্বেও সেটাকে গ্রহণ করতে চাইবে না- শুধু এই অজুহাতে যে, হাদীসটি সহীহ মুসলিমে নেই। আবূ যুর‘আ রাযীকে আল্লাহ তাআলা জাযায়ে খায়র দান করুন। তিনি আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন। না হলে আমরাও হয়তো মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবদের মত তার আশংকা অনুযায়ী বিদআতপন্থী হয়ে যেতাম।
আরও দেখুন, ইমাম ইবনে ওয়ারা রাহ.ও সরাসরি ইমাম মুসলিমকে সম্বোধন করে এই আশংকা ব্যক্ত করেছিলেন। তখন ইমাম মুসলিম রাহ. বলেছিলেন, ‘আমি এই কিতাব সংকলন করেছি এবং বলেছি, এই হাদীসগুলো সহীহ। কিন্তু আমি তো বলিনি যে, এ কিতাবে যে হাদীস নেই তা যঈফ।’
অতএব বোঝা গেল যে, অন্যান্য গ্রন্থেও সহীহ হাদীস আছে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে।
একমাত্র বুখারী ও মুসলিমের হাদীসই কি অধিকতর বিশুদ্ধ? আর অন্যান্য গ্রন্থের সব হাদীসই কি বুখারী ও মুসলিমের হাদীসের তুলনায় নিম্নমানের?
এই প্রশ্নের এক কথায় জবাব হল, ‘না’। কারণ, ইমাম বুখারী ও মুসলিম তো তাঁদের নিজেদের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ অনেক হাদীসই তাঁদের কিতাবে আনেননি। দেখুন, হাম্মাদ ইবনে সালামাহ বর্ণিত কোনো হাদীস ইমাম বুখারী তাঁর কিতাবে আনেননি। কেন আনেননি সে প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ইমাম আবূ বকর ইসমাঈলী রাহ. (৩৭১ হি.) ‘আল মাদখাল ইলাল মুসতাখরাজ ‘আলা সহীহিল বুখারী’তে বলেছেন, ‘বুখারী তো তার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ অনেক সহীহ হাদীসও বর্ণনা করেননি। তবে তা এ জন্য নয় যে, তাঁর দৃষ্টিতে হাদীসগুলো যঈফ কিংবা সেগুলোকে তিনি বাতিল সাব্যস্ত করতে চান। তো হাম্মাদ ইবনে সালামাহ বর্ণিত কোনো হাদীস তাঁর কিতাবে না আনার বিষয়টিও সেরকমই।’ -আন নুকাত ‘আলা মুকাদ্দিমাতি ইবনিস সালাহ, বদরুদ্দীন যারকাশী, খ- ৩, পৃষ্ঠা ৩৫৩
ইমাম আবূ নু‘আইম আসপাহানী রাহ. (৪৩০ হি.) ‘আল মুসতাখরাজ ‘আলা সহীহি মুসলিম’-এ একটি হাদীসের মান সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন,
فَإِنّهُمَا رَحِمَهُمَا الله قَدْ تَرَكَا كَثِيْرًا مِّمّا هُوَ بِشَرْطهِمَا أَوْلى وَإِلى طَرِيْقَتِهِمَا أَقْرَبُ.
‘বুখারী মুসলিম এমন অনেক হাদীস ছেড়ে দিয়েছেন, যেগুলো তাঁদের সংকলিত হাদীস অপেক্ষাও তাঁদের নীতি ও মানদণ্ডের অধিক নিকটবর্তী।’ -আল মুসতাখরাজ, খ- ১, পৃষ্ঠা ৩৬
বুখারী ও মুসলিম ব্যতীত অন্যান্য গ্রন্থে এরূপ বহু হাদীস রয়েছে যেগুলো বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হাদীসসমূহের সমপর্যায়ের বা বুখারী ও মুসলিমের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ। শুধু মুসতাদরাকে হাকেমেই এই পর্যায়ের হাদীস, হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রাহ.-এর বক্তব্য অনুযায়ী হাজারের কাছাকাছি। -আন নুকাত আলা কিতাবি ইবনিস সালাহ
মুসনাদে আহমাদ এখন ৫২ খণ্ডে বিস্তারিত তাখরীজসহ প্রকাশিত হয়েছে। টীকায় শায়েখ শুআইব আলআরনাঊত রাহ. ও তাঁর সহযোগীবৃন্দ সনদের মান সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-এর উচ্চতর হাদীস বিভাগের একজন ছাত্র শুধু প্রথম চৌদ্দ খণ্ডের হাদীসের হিসাব করেছেন, তো দেখা গেছে যে, সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, সুনানে আবূ দাউদ, জামে তিরমিযী, সুনানে নাসাঈ, সুনানে ইবনে মাজাহ- এই ছয় কিতাবে নেই এমন হাদীসগুলোর মধ্য হতে ৪০১টি হাদীস রয়েছে বুখারী ও মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী। শুধু বুখারীর শর্ত অনুযায়ী আছে ৬৪টি, শুধু মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী আছে ২১৫টি।
এ ছাড়া সহীহ লিযাতিহী বা সহীহ লিগাইরিহী হাদীসের সংখ্যা ১০০৮টি। হাসান লিযাতিহী বা হাসান লিগাইরিহী হাদীসের সংখ্যা ৬১৫টি। এসব সংখ্যা স্বতন্ত্র ও অতিরিক্ত হাদীসসমূহের, অর্থাৎ যেগুলোর কোনো মুতাবি‘ বা শাহিদ তাখরীজের বিবরণ অনুযায়ী ছয় কিতাবে নেই।
দেখুন, শায়েখ আলবানী রাহ. ‘সিফাতুস সালাহ’ (নবীজীর নামাযের পদ্ধতি) সম্পর্কে যে কিতাব লিখেছেন তাতে ছয় কিতাবের বাইরে ৮৬টি হাদীস রয়েছে। এবং সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের বাইরে সুনানের কিতাবের হাদীস রয়েছে ১৫৬টি।
স্বয়ং ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম রাহ. তাঁদের অন্যান্য কিতাবে এমন অনেক হাদীসকে সহীহ বলেছেন বা দলীল হিসাবে উল্লেখ করেছেন, যেগুলো তাঁদের এই দুই কিতাবে নাই। নিশ্চিত হতে চাইলে ‘জুযউল কিরাআতি খালফাল ইমাম’ এবং ‘জুযউ রাফইল ইয়াদাইন’ ইত্যাদি কিতাব খুলে দেখতে পারেন। জামে তিরমিযী খুললেও দেখতে পাবেন, ইমাম তিরমিযী রাহ. ইমাম বুখারীর উদ্ধৃতিতে এমন অনেক হাদীসকে সহীহ বলেছেন, যা সহীহ বুখারীতে নেই।
সুতরাং অন্যান্য গ্রন্থের হাদীসগুলোকে শুধু এই অজুহাতে পরিত্যাগ করা যে, এগুলো বুখারী মুসলিমে নেই অর্বাচিনতা ছাড়া কিছু নয়। কাজেই মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবগণ কর্তৃক বুখারী ও মুসলিমের বিরোধিতায় অন্যান্য গ্রন্থের হাদীস উপস্থাপন করাকে বিদআত বলে আখ্যায়িত করণ অতপর তাঁদের এই উক্তি ‘আসুন আমরা দেখি কিভাবে সহীহ হাদীসের মোকাবেলায় এই উম্মতের ধ্বংসপ্রাপ্তরা যঈফ ও জাল হাদীস উপস্থাপন করে’ তাঁদের অজ্ঞানতা বা জ্ঞানপাপিতাকে স্পষ্ট করে তোলে।
তাকসীমে সাবঈ নিয়ে আলোচনা
অনেক অজ্ঞ ব্যক্তির ন্যায় মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবগণও এই ধারণা পোষণ করে থাকেন যে, বুখারী ও মুসলিমের হাদীস সর্বাবস্থায় অগ্রগণ্য। তাঁরা তাঁদের এই চিন্তার ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করেছেন সপ্তম শতাব্দীতে তৈরিকৃত ‘তাকসীমে সাবঈ’কে। আর এ সম্পর্কে তিনি শাহ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভীর একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। তাকসীমে সাবঈ অর্থ সাত প্রকারে বিভক্তকরণ। সম্ভবত মুহাদ্দিস ইবনুস সালাহ রাহ. (৬৪৬ হি.) সর্বপ্রথম এই ধারণা প্রকাশ করেন যে, সহীহ হাদীস সাত প্রকার এবং প্রত্যেক উপরের প্রকার নীচের প্রকারের চেয়ে তুলনামূলক বেশি সহীহ। প্রকারগুলো এই:
১. যে হাদীস সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম দুই কিতাবেই আছে।
২. যে হাদীস শুধু বুখারীতে আছে।
৩. যে হাদীস শুধু মুসলিমে আছে।
৪. যে হাদীস এই দুই কিতাবে নেই তবে এই দুই কিতাবের মানদণ্ডে সহীহ।
৫. যে হাদীস শুধু বুখারীর মানদণ্ডে সহীহ।
৬. যে হাদীস শুধু মুসলিমের মানদণ্ডে সহীহ।
৭. যে হাদীস না এই দুই কিতাবে আছে, না এই দুই কিতাবের মানদণ্ডে সহীহ। তবে অন্য কোনো ইমাম একে সহীহ বলেছেন। -মুকাদ্দিমাতু ইবনিস সালাহ, পৃ. ১৭০
এ সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য হল, যাঁরা এই শ্রেণীবিন্যাস করেছেন খোদ তাঁরাই আবার বলেছেন,
أَمّا لَوْ رُجِّحَ قِسْمٌ عَلَى مَا فَوْقَهُ بِأُمُوْرٍ أُخْرَى تَقْتَضِي التّرْجِيْحَ، فَإِنّهُ يُقَدّمُ عَلى مَا فَوْقَهُ، إِذْ قَدْ يَعْرِضُ لِلْمَفُوْقِ مَا يَجْعَلُهُ فَائِقًا.
অর্থাৎ ‘অগ্রগণ্যতার অন্যান্য কারণে কোনো প্রকার যদি তার উপরস্থ প্রকারের চেয়ে অগ্রগামী হয় তাহলে তাকে তার উপরের প্রকারের চেয়ে অগ্রগণ্য সাব্যস্ত করা হবে। কারণ, এই বিন্যাসে উল্লেখকৃত নীচের প্রকারের বর্ণনার সাথে কখনও কখনও এমন বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়, যা তাকে উপরের পর্যায়ের বর্ণনার সমকক্ষ বা অগ্রগণ্য করে।’
কথাটি বলেছেন হাফেজ ইবনে হাজার রাহ. (৭৫২ হি.) তাঁর শরহু নুখবাতিল ফিকারে (পৃষ্ঠা ৩২)। তাঁর শাগরিদ মুহাদ্দিস শামসুদ্দীন সাখাভী রাহ.ও (৯০২ হি.) ‘ফাতহুল মুগীছে’ তা আরও স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন। মুহাদ্দিস বদরুদ্দীন যারকাশী রাহ. (৭৯৪ হি.) ‘আন নুকাত আলা মুকাদ্দিমাতি ইবনিস সালাহ-এ (খ- ১, পৃষ্ঠা ২৫৬-২৫৭) এবং জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহ. তাদরীবুর রাবীতে (খ- ১, পৃষ্ঠা ৮৮) পরিষ্কার লিখেছেন যে, সহীহ মুসলিমের তুলনায় সহীহ বুখারীর অধিক সহীহ হওয়ার অর্থ সমষ্টিগত বিচারে অধিক সহীহ হওয়া। এই নয় যে, সহীহ বুখারীর প্রতিটি হাদীস সহীহ মুসলিমের প্রতিটি হাদীসের চেয়ে অধিক সহীহ। যারকাশী রাহ. আরও লিখেছেন, অগ্রগণ্যতার কারণ বিচারে মুহাদ্দিসগণ কখনও কখনও মুসলিমের হাদীসকে বুখারীর হাদীসের উপর প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।
সুতরাং বুঝা গেল যে, তাঁদের কাছেও ‘তাকসীমে সাবঈ’ সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য অটল নীতি নয়।
আমরা যদি বাস্তবতা বিচার করি তাহলে আমরা বুঝতে পারব যে, এই প্রকারভেদ আসলে উসূলে হাদীসের আলোকে সহীহ হতে পারে না। কারণ সহীহ হাদীসের শ্রেণী ও পর্যায় নির্ধারিত হবে ছিহহাত বা শুদ্ধতার শর্ত ও বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে, বিশেষ কোনো কিতাবে থাকা বা না থাকার ভিত্তিতে নয়। যেমন অনেক হাদীস শুধু সহীহ বুখারীতে আছে, সহীহ মুসলিমে নেই, কিন্তু তার সনদ এমন যে, তা মুসলিমের মানদণ্ডেও সহীহ। এ ধরনের হাদীসকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে নেওয়ার কী অর্থ থাকতে পারে? তেমনি কোনো হাদীস বুখারীতে নেই, শুধু মুসলিমে আছে, কিন্তু তার সনদ এমন যে, তা বুখারীর নিকটেও সহীহ। এ হাদীসকে তৃতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করা কি অর্থহীন নয়? তদ্রূপ যেসব হাদীস উভয় ইমামের মানদণ্ডে সহীহ সেগুলো কি শুধু এই দুই কিতাবে সংকলিত হয়নি বলেই চতুর্থ শ্রেণীতে চলে যাবে?
এই বাস্তবতা বিচার করেই অনেক মুহাক্কিক ও গবেষক মুহাদ্দিস বলেছেন, এই প্রকারভেদ উসূলে হাদীসের আলোকে সহীহ নয়। দূর অতীতের মুহাদ্দিসগণের ন্যায় নিকট অতীতের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আহমাদ শাকির রাহ.ও (মৃত্যু ১৩৭৭ হি.) এই তাকসীম ও প্রকারভেদের কঠোর সমালোচনা করেছেন। দেখুন, মুসনাদে আহমাদে সহীফায়ে হাম্মাম ইবনে মুনাব্বিহের উপর তার ভূমিকা, খ- ৮, পৃষ্ঠা ১৮২
আশা করি উপরিউক্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনা পাঠ করে আপনি তাকসীমে সাবঈর ভিত্তির উপর গড়ে উঠা মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবদের মানসিকতার জবাব পেয়ে গেছেন।
এই মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবগণ ইন্টারনেটে শাহ ওয়ালীউল্লাহ রাহ.-এর একটি বক্তব্যকে তাদের মানসিকতার পক্ষে একটি দলীল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এর জবাবে বলব যে, শাহ ওয়ালীউল্লাহ রাহ.-এর বক্তব্য দ্বারা এটা বুঝা যায় না যে, তিনি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের হাদীসকে সর্বক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় অগ্রগণ্য বিবেচনা করেছেন। তিনি ঐ বক্তব্যের পরে পরস্পরবিরোধী দুই হাদীসের মধ্যকার বিরোধ দূরীভূত করার যে উপায়গুলো ব্যক্ত করেছেন তন্মধ্যে একটি উপায়ও এই বলেননি যে, পরস্পরবিরোধী দুই হাদীসের একটি যদি বুখারী বা মুসলিমের হয় তাহলে বুখারী বা মুসলিমের হাদীস অগ্রগণ্য বলে বিবেচিত হবে।
তিনি আসলে বিশুদ্ধতা ও প্রসিদ্ধতার বিচারে হাদীসের কিতাবসমূহকে চার স্তরে বিভক্ত করেছেন। প্রথম স্তরে তিনি স্থান দিয়েছেন মুয়াত্তা মালেক, বুখারী ও মুসলিম শরীফকে। কিন্তু এ কথা বলেননি যে, মুয়াত্তা মালেক, বুখারী ও মুসলিমের প্রতিটি হাদীস অন্যান্য গ্রন্থের প্রতিটি হাদীসের চেয়ে অগ্রগণ্য বলে বিবেচিত হবে। শাহ ওয়ালীউল্লাহ রাহ.-এর বক্তব্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে এই পত্রের কলেবর আর বৃদ্ধি করতে চাচ্ছি না। যতটুকু বললাম তা-ই যথেষ্ট বলে মনে করি।
অধিকতর সহীহ বর্ণনাই কি সর্বদা ও সর্বক্ষেত্রে অগ্রগণ্য?
মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবসহ অনেকের ধারণা হল, ‘যে হাদীস সনদের বিচারে অধিক সহীহ তা-ই শ্রেষ্ঠ ও অগ্রগণ্য, বিপরীত হাদীসটি সহীহ হলেও।’ এ কারণেই এই ভাইয়েরা জোড় বাক্যে ইকামত সংক্রান্ত সহীহ হাদীসগুলোর প্রত্যেকটির ক্ষেত্রে অন্য জবাবের সঙ্গে সঙ্গে এই কথাও বলেছেন যে, তাছাড়া হাদীসটি মুসলিমের হাদীসের বিরোধী হওয়ায় শায। কাজেই তা প্রত্যাখ্যাত।
অথচ হাদীসের মাঝে বাহ্যত বিরোধ দেখা দিলে অন্য কোনো বিবেচনা ছাড়াই অধিক সহীহ হাদীসটিকে গ্রহণ করা এবং বিপরীতটিকে বর্জন করা কোনো নিয়মের মধ্যে পড়ে না। স্বীকৃত নিয়ম এই যে, এই বিরোধের ক্ষেত্রে জমা, তারজীহ ও নাস্খ তথা সমন্বয় সাধন, অগ্রগণ্য বিচার ও নাসিখ-মানসূখের নিয়ম কার্যকর করতে হবে। তারজীহ বা অগ্রগণ্য বিচারের প্রসঙ্গ যদি আসে তাহলে ‘উজূহুত তারজীহ’ বা অগ্রগণ্যতার কারণসমূহের ভিত্তিতে যে হাদীস রাজিহ বা অগ্রগণ্য হবে সে হাদীসের উপরই আমল হবে। মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবগণ সনদের বিচারে অধিক সহীহ হওয়াকেই একমাত্র কারণ বলে মনে করেন। এবং বিশেষত বুখারী মুসলিমের হাদীসকে সর্বাবস্থায় অগ্রগণ্য বলে মনে করেন। অথচ অধিকতর সহীহ হওয়া বা বুখারী মুসলিমে থাকা অগ্রগণ্যতার কারণসমূহের মধ্য হতে একটি কারণ মাত্র। অগ্রগণ্যতার আরও অনেক কারণ আছে।
ইমাম আবূ বকর মুহাম্মাদ ইবনে মূসা আল হাযেমী রাহ. তাঁর ‘আলই‘তিবার ফিন নাসিখি ওয়াল মানসূখি মিনাল আছার’ কিতাবে (খ- ১, পৃষ্ঠা ১৩২-১৬০) পঞ্চাশটি উজূহুত তারজীহ (অগ্রগণ্যতার কারণ) উল্লেখ করেছেন, যেগুলোর দ্বারা পরস্পরবিরোধী দুই হাদীসের মধ্যে অগ্রগণ্য নির্ধারণে সহযোগিতা নেওয়া হয়।
এই পঞ্চাশটি কারণের মধ্য হতে একটি কারণও এই বলেননি যে, পরস্পরবিরোধী দুই হাদীসের মধ্যে একটি বুখারী বা মুসলিমে আর অন্যটি অন্য কোনো হাদীসের কিতাবে থাকলে বুখারী বা মুসলিমের হাদীসটি অগ্রগণ্য হবে। তিনি পঞ্চাশটি উজূহুত তারজীহ উল্লেখ করার পর বলেছেন, ‘এই পঞ্চাশটি কারণ ছাড়াও অগ্রগণ্যতার আরও অনেক কারণ আছে, এই সংক্ষিপ্ত কিতাবের কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় আমি সেগুলোর উল্লেখ থেকে বিরত থাকলাম।’
হাফেজ যাইনুদ্দীন আলইরাকী রাহ. (৭২৫-৮০৬ হি.) মুকাদ্দিমাতু ইবনিস সালাহর উপর তাঁর লিখিত টীকা-গ্রন্থ ‘আত তাক্ঈদ ওয়াল ঈজাহ শারহু মুকাদ্দিমাতি ইবনিস সালাহ’-এ (খ- ১, পৃষ্ঠা ২৮৯) হাযেমী রাহ.-এর উক্ত বক্তব্য উদ্ধৃত করার পর বলেছেন, উজূহুত তারজীহ বা অগ্রগণ্যতার কারণসমূহের সংখ্যা একশতেরও বেশি। এরপর তিনি ঐ পঞ্চাশটি কারণ সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করেছেন অতপর অবশিষ্ট কারণগুলো ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি ১১০টি উজূহুত তারজীহ বা অগ্রগণ্যতার কারণ উল্লেখ করেছেন। কিন্তু অগ্রগণ্যতার কারণ হিসাবে বুখারী মুসলিমে কোনো হাদীস থাকাকে একটি কারণ হিসাবে যখন উল্লেখ করেছেন তখন সেই কারণকে তিনি ১০২ নম্বরে ফেলেছেন। তাহলে বুঝুন ব্যাপারটা!
লা মাযহাবী ঘরানার বিশিষ্ট আলেম শাওকানী রাহ. তাঁর ‘ইরশাদুল ফুহূল’ গ্রন্থে অগ্রগণ্যতার ১৬০টি কারণ উল্লেখ করেছেন। সনদগত বিচারে অগ্রগণ্যতার ৪২টি কারণ উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্য হতে বুখারী মুসলিমের হাদীসকে অন্যান্য হাদীস গ্রন্থের হাদীসের উপর অগ্রগণ্যতার বিষয়টিকে উল্লেখ করেছেন ৪১ নম্বরে ।
তো সনদগত বিচার ছাড়াও অন্যান্য বিচারে অগ্রগণ্যতার কারণসমূহকে উপেক্ষা করে এবং সনদগত বিচারে অগ্রগণ্যতার কারণসমূহের মধ্য হতে সর্বশেষ কারণটিকে প্রথমেই বিবেচনায় নিয়ে এই কথা বলে দেওয়া যে, হাদীসটি বুখারী মুসলিমের বিরোধী বিধায় শায বা প্রত্যাখ্যাত বা তা গ্রহণযোগ্য নয় কিরূপ অর্বাচিনতা ও হঠকারিতা তা আপনি একটু চিন্তা করে দেখবেন কি?
যঈফ হাদীসও অনেক সময় সহীহ হাদীসের উপর অগ্রগণ্য বলে বিবেচিত হয়
মুহতারাম, অনেকে মনে করে থাকেন যে, পরস্পরবিরোধী দুইটি হাদীসের মধ্যে যেটি অধিকতর সহীহ সেটিকেই আমলের জন্য অগ্রাধিকার দিতে হবে। সেটিই অপরটির তুলনায় অগ্রগণ্য বিবেচিত হবে। কিন্তু উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে, না, এটি মূলনীতি নয়। কেননা, অগ্রগণ্যতা বিচারের বহুবিধ দিক ও কারণ রয়েছে। কাজেই সবসময় অধিকতর সহীহ হাদীস অগ্রগণ্য বলে বিবেচিত হয় না। তদ্রƒপ যঈফ হাদীসের উপর সহীহ হাদীসকে সবসময় অগ্রগণ্য বলে বিবেচনা করা যায় না। কারণ, হাদীসের ছিহহাত বা শুদ্ধতা অগ্রগণ্যতার কারণসমূহের মধ্য হতে একটি কারণ মাত্র, একমাত্র কারণ নয়। অনেক সময় যঈফ হাদীসকেও সহীহ হাদীসের উপর অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তাকেই অগ্রগণ্য বলে বিবেচনা করা হয়।
দেখুন স্বয়ং ইমাম বুখারী রাহ. একটি যঈফ হাদীসকে সহীহ হাদীসের উপর প্রাধান্য দান করেছেন। তিনি বুখারী শরীফের কিতাবুস সালাহ-এর দ্বাদশ অধ্যায়ে (بَابُ مَا يُذْكَرُ فِي الْفَخِذِ) উরূ সতরের অন্তর্ভুক্ত কি না- এ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন-
وَ حَدِيْثُ أَنَسٍ أَسْنَدُ وَ حَدِيْثُ جَرْهَدٍ أَحْوَطُ حَتّى يخْرُجَ مِنْ إِخْتِلَافِهِمْ.
অর্থাৎ আনাস রা.-এর হাদীস (যার দ্বারা উরূ সতর না হওয়া প্রমাণিত হয়) সনদের বিচারে অধিক সহীহ হলেও জারহাদের হাদীস (যাতে উরূ সতর হওয়ার কথা আছে) সতর্কতার বিচারে অগ্রগণ্য, যাতে ইখতিলাফের মধ্যে থাকতে না হয়।
ফাতহুল বারীতে (খ- ১, পৃষ্ঠা ৫৭১) আছে, ইমাম বুখারী রাহ. ‘আত-তারীখুল কাবীরে’ জারহাদের হাদীসকে ইযতিরাবের কারণে যঈফ বলেছেন। তাহলে দেখুন, ইমাম বুখারী রাহ. সহীহের বিপরীতে যঈফ হাদীসের উপর আমল করাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। কারণ এটাই সতর্কতার দাবি। যে মাযহাবে উরূ সতর হওয়ার কথা আছে সেই মাযহাব অনুসারেও যেন গুনাহগার হওয়ার আশংকা না থাকে।
অতএব বুঝা গেল যে, অগ্রগণ্যতার একটিমাত্র কারণকে সর্বক্ষেত্রে প্রাধান্যের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা এবং সনদের বিচারে যেটি শ্রেষ্ঠ সেটিকেই চূড়ান্তভাবে অগ্রগণ্য বলে মনে করা আর তা-ও বিনা তাহকীকে, শুধু এ কারণে যে, বিপরীত হাদীসটি বুখারী মুসলিমে নেই- এই চিন্তা মোটেও ঠিক নয়। সুতরাং অগ্রগণ্যতার অন্যান্য দিক ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি। যেমনটা আমরা স্বয়ং ইমাম বুখারী রাহ.-এর কাছ থেকে দেখলাম।
সুতরাং মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবরা যে জোড় বাক্যে ইকামতদান সংক্রান্ত প্রতিটি হাদীস সম্পর্কে বলেছেন, এটি মুসলিমের হাদীসের বিপরীত বিধায় শায ও প্রত্যাখ্যাত তা কতটুকু যুক্তিযুক্ত আপনিই বিচার করুন।
কথা আরও আছে। তা হল, যদি এমন দুই হাদীসের মাঝে বাহ্যত বিরোধ পরিদৃষ্ট হয় যে দুই হাদীসের উভয়টি বুখারী কিংবা উভয়টিই মুসলিমে আছে তাহলে মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবরা কী করবেন? যে কোনো একটিকে শায বলবেন?
আমি ফজরের মুস্তাহাব সংক্রান্ত আলোচনায় দেখিয়েছি যে, মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবদের উপস্থাপিত বুখারীর একটি হাদীসের সঙ্গে বুখারীরই অপর একটি হাদীসের বিরোধ পরিলক্ষিত হয়। সে ক্ষেত্রে মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব একটিকে গ্রহণ করেছেন আর অপরটিকে বর্জন করেছেন। কী কারণে তিনি সেটিকে বর্জন করলেন তা বলেননি। যেটিকে বর্জন করেছেন সেটি কি তাহলে শায হওয়ার কারণে বর্জন করেছেন? আমি উভয় হাদীসের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে দেখিয়েছি যে, উভয়টিই যথাস্থানে সঠিক ও আমলযোগ্য।
ইকামত সংক্রান্ত আলোচনা এখানেই আপাতত শেষ করছি। মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবগণ যদি এরপর আরও কিছু বলতে চান তো বলতে পারেন। তখন আমিও চেষ্টা করব তার বক্তব্যের ব্যবচ্ছেদ করতে।
উল্লেখ্য, ‘তাকসীমে সাবঈ’সহ শেষের ছয়টি শিরোনামে আলোচিত অগ্রগণ্যতা বিষয়ক আলোচনাটি আমি ইষৎ হ্রাস বৃদ্ধিসহ প্রায় হুবহু গ্রহণ করেছি হযরত মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেব রচিত ‘উম্মাহর ঐক্য : পথ ও পন্থা’ পুস্তক থেকে। পুস্তকটির রচয়িতার কাছে আমি ঋণি হয়ে থাকলাম।
আজ এ পর্যন্তই। জানি না আপনি কেমন আছেন। আপনার সুস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা কামনা করি। আমার দরখাস্ত, আপনি আমার জন্য দুআ করবেন, আল্লাহ যেন আমাকে সালেহীনদের অন্তর্ভুক্ত করে দেন।
৫ রবিউস সানি ১৪৩৮ হি.
৫ জানুয়ারী ২০১৭ ঈ.