প্রাণী থেকে শিক্ষা : নেতাজী
পশু-পাখীর কাছ থেকেও অনেক কিছু শেখার আছে। মানুষ শিখেও এসেছে, এখনো শিখছে। কুরআন মাজীদে হযরত আদম আলাইহিস সালামের পুত্রদ্বয়ের বৃত্তান্ত শুরুই হয়েছে وَاتْلُ عَلَیْهِمْ ‘তাদের সামনে বর্ণনা করুন’- এই আদেশবাণীর মাধ্যমে। সেই বৃত্তান্তেরই একটি অংশ-
فَبَعَثَ اللهُ غُرَابًا یَّبْحَثُ فِی الْاَرْضِ لِیُرِیَهٗ كَیْفَ یُوَارِیْ سَوْءَةَ اَخِیْهِ قَالَ یٰوَیْلَتٰۤی اَعَجَزْتُ اَنْ اَكُوْنَ مِثْلَ هٰذَا الْغُرَابِ فَاُوَارِیَ سَوْءَةَ اَخِیْ فَاَصْبَحَ مِنَ النّٰدِمِیْنَ .
অতপর আল্লাহ এক কাক পাঠালেন, যে তার ভাইয়ের শবদেহ কীভাবে গোপন করা যায় তা দেখাবার জন্য মাটি খনন করতে লাগল। সে বলল, হায়! আমি কি এই কাকের মতোও হতে পারলাম না, যাতে আমার ভাইয়ের শবদেহ গোপন করতে পারি? অতপর সে অনুতপ্ত হল। -সূরা মাইদা (৫) : ৩১
এখানে মানুষ শিখছে কাকের কাছ থেকে। আর কুরআন বলছে, এই কাককে পাঠিয়েছেন আল্লাহ তাআলা আদম-সন্তানকে শেখাবার জন্য।
হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালাম পশু-পাখীর কথা বুঝতেন, তাদের সাথে কথাও বলতে পারতেন। কুরআন মাজীদে আছে তাঁর ‘ওয়াদিন নামলে’ পিপীলিকা উপত্যকায় ভ্রমনের বৃত্তান্ত-
حَتّٰۤی اِذَاۤ اَتَوْا عَلٰی وَادِ النَّمْلِ قَالَتْ نَمْلَةٌ یّٰۤاَیُّهَا النَّمْلُ ادْخُلُوْا مَسٰكِنَكُمْ لَا یَحْطِمَنَّكُمْ سُلَیْمٰنُ وَ جُنُوْدُهٗ وَ هُمْ لَا یَشْعُرُوْنَ .
যখন তারা পিঁপড়ে-উপত্যকায় পৌঁছুল তখন এক পিঁপড়া বলল, হে পিঁপড়েদল! তোমরা তোমাদের গৃহে প্রবেশ কর, যেন সুলায়মান ও তাঁর বাহিনী অজ্ঞাতসারে তোমাদের পদপিষ্ট না করে। -সূরা নাম্ল (২৭) : ১৮
স্বজাতির প্রতি দরদ ও দায়িত্বশীলতার এ এক অনুপম দৃষ্টান্ত।
পিঁপড়ে-নেতার বক্তব্য শুনে আল্লাহর নবী সুলায়মান মৃদু হাসলেন। শুধু হাসলেনই না, আল্লাহর দরবারে শোকরগোযারির তাওফীকও প্রার্থনা করলেন। কারণ, তিনিই তো তাকে দান করেছেন পশু-পাখীর ভাষা বোঝার শক্তি। দান করেছেন আরো কত নিআমত। কুরআনের ভাষায়-
فَتَبَسَّمَ ضَاحِكًا مِّنْ قَوْلِهَا وَ قَالَ رَبِّ اَوْزِعْنِیْۤ اَنْ اَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِیْۤ اَنْعَمْتَ عَلَیَّ وَ عَلٰی وَالِدَیَّ وَ اَنْ اَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضٰىهُ وَ اَدْخِلْنِیْ بِرَحْمَتِكَ فِیْ عِبَادِكَ الصّٰلِحِیْنَ.
সুলায়মান ওর উক্তিতে মৃদু হাসল এবং বলল, পরওয়ারদেগার! আমাকে সামর্থ্য দিন, যাতে আমি আপনার শোকরগোযারি করি আমার প্রতি ও আমার পিতামাতার প্রতি আপনি যে অনুগ্রহ করেছেন তার জন্য। এবং আমি যেন সৎকাজ করতে পারি, যা আপনি পসন্দ করেন আর নিজ অনুগ্রহে আমাকে আপনার সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের শামিল করুন। -সূরা নামল (২৭) : ১৯
পর্যবেক্ষণী দৃষ্টিতে দেখলে পশু-পাখীর জীবন-আচরণেও বহু বিস্ময়কর ব্যাপার দেখতে পাওয়া যায়। আজ সে রকমই একটি অভিজ্ঞতা পাঠকবৃন্দের সাথে ভাগাভাগী করব। অভিজ্ঞতার আলোচনায় বোধ হয় দোষের কিছু নেই, এতে শিক্ষা ও বিনোদন দু’টোই একসাথে পাওয়া যায়।
গত বছর মারকাযের মূল প্রাঙ্গণের কাছে একটি ঘর নির্মাণের পর বহু দিনের শহুরে জীবন ছেড়ে আবার গ্রামে বসবাস শুরু হয়। গ্রামের বাসায় স্থানান্তরের পরপরই মুহাতারামা আম্মাজান মুরগি পালার তাকিদ দিতে থাকেন। কিন্তু এদিক সেদিক ভেবে সে হুকুম তামিল করতে দেরি হচ্ছিল। আম্মা এবার নিজ থেকে লোক দিয়ে খোঁয়াড় বানিয়ে দিলেন এবং কয়েকটি মুরগি দিয়ে সেগুলো পালার নির্দেশ দিলেন। এদিকে এক প্রতিবেশী দুটি বাচ্চা মোরগ দিয়ে যান জবাই করে খাওয়ার জন্য। কিন্তু গৃহকর্ত্রী মোরগের গলায় ছুরি দিতে নারাজ। অতএব এগুলোও আম্মার দেওয়া মুরগীগুলোর সাথে যুক্ত হয়ে গেল। এভাবে দেখতে দেখতে অনেকগুলো মুরগির সমাগম হয়ে গেল।
এদিকে ঐ মোরগের বাচ্চা দু’টি বড় হয়েছে। দেখতে শুনতেও বেশ সুদর্শন হয়ে উঠেছে। একপর্যায়ে এদের একজন হয়ে উঠল সবার নেতা। জানি না এদের মধ্যে কোনো নির্বাচন বা মনোনয়ন হয়েছিল কি না? তবে স্বতস্ফূর্তভাবেই ছোট-বড় সকল মোরগ-মুরগি একজনের নেতৃত্বে চলা শুরু করল।
মুরগির এই দলটি ঘরের সবার খুব প্রিয়। এরাও যেন এই পরিবারেরই সদস্য। আমিও অবসর সময়ে এদের উঠোনময় বিচরণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি, বেশ লাগে। তবে আমি কৌতুহলী হয়ে উঠেছিলাম এদের দলনেতা মোরগটির প্রতি। আমি ওর নাম দিলাম ‘নেতাজী’। আদর্শ নেতৃত্বের গুণাবলী- শৃঙ্খলা বিধান বলুন, কিংবা নিরাপত্তা বিধান, অথবা খাদ্য-ব্যবস্থাপনা সবগুলোই তার চরিত্রে লক্ষ্য করলাম। দলে সব মিলে ২০/২২ টি মোরগ-মুরগি ছিল। নেতাজীর উপস্থিতিতে কেউ কাউকে ঠোকরাবে এটা কখনো সম্ভব ছিল না। এই পালে নানা বয়েসী মোরগ-মুরগি ছিল, একেবারে ছোট বাচ্চাও ছিল, কিন্তু সবাই নিরাপদ।
ওদের খাবারের ব্যবস্থা দুই ভাবেই হত। ভেতর থেকেও, বাইরে থেকেও। ঘরের চারপাশ এবং খোলা ছোট উঠোনটি ওদের বিচরণস্থল।
সব এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে এটা সেটা খাচ্ছে। হঠাৎ একদিক থেকে শোনা গেল নেতাজীর কণ্ঠ। চারপাশ থেকে সব ছানা-বুড়ো হাজির। কী হয়েছে? নেতাজী শিকার ধরেছেন! সেই শিকার সবাইকে খেতে দিয়ে নিজে শীর উঁচু করে দেখছেন! আশ্চর্যের ব্যাপার হল, অধিকাংশ সময় সে নিজে খেত না এবং অন্যদের খাওয়ার আগে তো কখনোই না, নিজে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে অন্যদের খাওয়া দেখত।
ঘর থেকে কখনো অতিরিক্ত খাবার দেওয়া হলেও এই ব্যাপারটা আমরা সবাই মিলে লক্ষ্য করতাম যে, নেতাজী ঠোটে নিয়েও রুটির টুকরাটা আরেক জনকে দিয়ে দিলেন। একদিন তো গৃহকর্ত্রী বলেই বসলেন, ‘দেখুন, ও বোধহয় আপনাদের পুরুষদের শেখাচ্ছে!’ সত্যি কথা। অনেক কিছুই আমাদের শেখার আছে, উপলব্ধি করবার আছে।
একদিন হঠাৎ তার চিৎকার। চিৎকারের আর থামাথামি নেই! কী হল? কী হল? দলের দুই সদস্যকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। খোঁজ! খোঁজ! কোথায় গেল! দেখা গেল, ঐ দুইজন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রতিবেশীর বাড়িতে চলে গেছে। আর এ কারণে নেতাজী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। তাড়াতাড়ি সীমান্তের এপারে সহী-সালামতে আনার পর নেতাজী ঠাণ্ডা হলেন।
আমি বলি, এই না হলে তিনি কীসের নেতা। নেতাকে তার অধীনস্তদের নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং আন্তরিক হতে হবে। বিপদ দেখলে উদ্বিগ্ন হতে হবে। যথাসাধ্য বিপদ থেকে আগলে রাখার চেষ্টা করতে হবে। বিশেষত প্রতিবেশীদের সীমান্তরক্ষীরা যদি ঘনঘন গুলি চালনায় বেশি পারদর্শী হন। আমাদের প্রতিবেশী অবশ্য এরকম নন, তবুও নেতাজীর এত উৎকণ্ঠা।
এই সকল গুণাবলীর পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনে নেতাজী ছিলেন খুবই বিনয়ী, মিশুক ও সুশৃঙ্খল। ঘরে ঢুকে ঘর ময়লা করার স্বভাব তার ছিল না। কেউ বাড়ির সদর দরজা খোলামাত্র ইস্তিকবালের জন্য তিনি হাজির। কোথাও যাচ্ছি বা ঘরে ফিরছি নেতাজী দরজার কাছেই আছেন। তার কক্ কক্ কক্ শব্দের আমার কাছে দুই অর্থই হত- অভ্যর্থনা ও বিদায় সম্ভাষণ!
মাঝে মাঝে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতাম, নেতাজী কেমন আছেন। সঙ্গে সঙ্গে কক্ কক্ শব্দ করে দুই ডানা নেড়ে এগিয়ে যেত। জানি না সে কিছু বুঝত কি না!
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সকল মোরগ-মুরগীকে দেখে রাখা, শৃঙ্খলা রক্ষা করাই ছিল তার মূল কাজ। এর ফাঁকে ফাঁকে কিছুক্ষণ পরপরই জানালা বা দরজায় এসে তার পালনকারী (গৃহকত্রী)কে একনজর দেখে চলে যেত।
তবে হাঁ, ভুল সবারই হয়। কিন্তু ভালো মানুষের পরিচয় হচ্ছে, সে অল্পতেই নিজেকে সংশোধন করে। একবার ছেলেরা ফুল গাছের চারা এনে রেখেছে। মোরগটি একটি ডালে ঠোকর দেওয়ায় ডালটা ভেঙ্গে যায়। ছেলেরা বিরক্ত। ওদের শখের গাছ! তো নেতাজীকে ধরে কয়েদ করা হল। ২/৪ ঘন্টা পর আবার ছেড়েও দেওয়া হল। কিন্তু আশ্চর্য্যের ব্যাপার হল, এরপর থেকে তাকে আর কখনো কোনো ফল-ফুল গাছে ঠোঁট লাগাতে দেখা যায়নি। হতে পারে এটা ঘটনাচক্রের ব্যাপার, কিন্তু কেন যেন মনে হয় ওর স্বভাবটাই এমন ছিল।
একবার আমার ছোটভাই মাওলানা আব্দুল মাজীদ বেড়াতে এল। সকালে সে বলল, ভাইজান! এই মোরগটা তো খুব ভালো। এ তো সাহরীর সময় ডাক্ দেয়। যেন তাহাজ্জুদের জন্য ডাকছে।
সাধারণত মোরগেরা সুবহে সাদিকের পর ডাকে। গ্রামে বলে, মোরগ ফজরের আযান দিচ্ছে। কিন্তু এ মোরগটি সব সময়ই ফজরের সময়ের কিছুক্ষণ আগ থেকে ডাকা শুরু করত।
পশু-পাখীর তাসবীহের কথা তো হাদীস-আছারে আছে। শেষ রাতের বরকতময় মুহূর্তটা হয়ত পশু-পাখীও উপলব্ধি করতে পারে।
যাই হোক সবকিছু মিলে নেতাজী সবার বেশ মনোযোগ আকষর্ণ করেছিলেন। কিন্তু কথায় আছে, ভালো মানুষ বেশিদিন বাঁচে না। এই ‘ভালোমানুষটির’ ক্ষেত্রেও আমার তা-ই মনে হল। হঠাৎ একদিন সে অসুস্থ হয়ে পড়ল। চিকিৎসা করা হল। দান-সদকাও হল। কিন্ত নেতাজীর স্বাস্থের উন্নতি ঘটল না। সদকার পরিমাণ দেখে কেউ একজন বলে উঠল মোরগের দাম কত যে, তার সুস্থতার জন্য এত সদকা করা হচ্ছে। শুনেই কেঁদে উঠলেন সদকাদাত্রী, ‘আরে এরা তো বে-গুনাহ, আমাদের পাপের কারণে এদেরকে আল্লায় রোগ দেন’। কেউ আর কথা বাড়ায় না।
অসুস্থতার এই সময়ে আমরা দেখলাম, দলের সদস্যরা তাকে ঘিরে রয়েছে। সবাই যেন উদ্বিগ্ন, শোকাতুর। দলের সিনিয়র সদস্যরা দুই দিনব্যাপী এভাবে তাকে ঘিরে রাখল। তারা যেন নিজেদের খানা-দানার কথাও ভুলে গেল। শেষে অসুস্থতা যখন সারলই না তখন তার কষ্ট বেড়ে যাওয়ার কথা ভেবে আমরা তাকে বিদায় জানালাম। না! গলায় ছুরি চালানোর নিয়ম আমাদের বাড়িতে নেই। এক প্রতিবেশীর হাতে তাকে অর্পণ করলাম।
এখনও প্রায়ই নেতাজীকে মনে পড়ে। তার জীবনের শেষ দু’টো দিন এই দৃষ্টান্ত রেখে গেল যে, যে নেতা জীবনকালে তার সঙ্গীদের আগলে রাখেন জীবন সায়াহ্নে সঙ্গীরাও তাকে ভুলতে পারে না। এমনকি তার বিদায়ের পরদিনও সকল মোরগ-মুরগী বিমর্ষ হয়ে থাকল। আর ঘরের লোকদের অবস্থা কী হয়েছে তা এ থেকে কিছুটা অনুমান করা যাবে যে, আমার মেয়ে এ লেখার প্রুফ দেখতে গিয়ে কান্না থামাতে না পেরে জায়গা থেকে উঠে গেছে।
প্রিয় পাঠক, আপনাদের সময় নেয়া শুধুই অভিজ্ঞতা ভাগাভাগির জন্য নয়। বরং মোরগটি বেঁচে থাকতেই আমার বারবার ইচ্ছে হয়েছিল, ইসলামের দৃষ্টিতে নেতৃত্বের গুণাগুন নিয়ে আলকাউসারে কিছু লেখার। সম্ভবত মারকাযে হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগার খিলাফত বিষয়ক আলোচনার দরসেও আমি ওর কথা বলেছি। আমাদের এই পৃথিবীতে, মুসলিম জাহানে, এই দেশে, অনেকেরই নিজ প্রতিষ্ঠানে, নিজ এলাকায় একজন এমন নেতার অভাব নয় কি, যিনি নিজের থেকে ভালবাসবেন তার অধীনস্তদের, যার জীবন-মরণ হবে অন্যদের জন্য, নিজ খাবার-দাবার, শরীর-স্বাস্থ্যের থেকে তার কাছে তার আওতাধীন লোকদের শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা প্রাধান্য পাবে। এবং সর্বোপরি তার শীর নত থাকবে তার এবং তার সকল অধীনস্তের সৃষ্টিকর্তার হুকুমের কাছে। ফলে তার জনগণ হয়ে যাবে তার জন্য নিবেদিত তখন তাকে রক্ষার জন্য বিশেষ বাহিনী তো দূরে থাক সাধারণ বাহিনীরও প্রয়োজন হবে না। আসুন, মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে কুরআনের ভাষায় প্রার্থনা করি-
اجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا وَاجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ نَصِيرًا .
(হে প্রভু!) আপনি আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য একজন অভিভাবক পাঠান এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদেরকে দান করুন সাহায্যকারী। আমীন।