মেজবান ও মেহমানের কিছু আদব
মেহমানদারি একটি মহৎ গুণ, যা আত্মীয়তার বন্ধনকে মজবুত করে, বন্ধুত্বকে করে সুদৃঢ় এবং সামাজিক সৌহার্দ সৃষ্টিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। মেহমানদারি মুসলিমের একটি বিশেষ গুণ। সাহাবা-চরিত অধ্যয়ন করলে আমরা মুসলিমের এ গুণের অনন্য নজীর দেখতে পাই। আনসার-মুহাজিরদের মেহমানদারির নজীর পৃথিবীর ইতিহাসে মেলা ভার। আর তাঁরাই আমাদের পূর্বসূরী।
মেহমানদারি ছিল আমাদের নবীজীর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। নবীজীর উপর সর্বপ্রথম ওহী নাযিল হওয়ার পর যখন তিনি হয়রান-পেরেশান হয়ে খাদিজা রা.-এর কাছে আসলেন তখন খাদিজা রা. তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, আল্লাহ আপনাকে অপদস্থ করবেন না। এরপর নবীজীর যে উত্তম গুণাবলীর উল্লেখ করেছিলেন তার মধ্যে একটি ছিল- وَتَقْرِي الضَّيْفَ ‘আপনি তো মেহমানের সমাদর করেন’। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ সুন্নতকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরেছিলেন তাঁর হাতেগড়া সাহাবায়ে কেরাম।
হাদীস শরীফে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষয়টির প্রতি তাকিদ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَاليَوْمِ الآخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ.
আল্লাহ ও পরকালের প্রতি যে ঈমান রাখে সে যেন মেহমানের সমাদর করে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬১৩৬
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لَا خَيْرَ فِيمَنْ لَا يُضِيفُ
যে মেহমানদারি করে না তার মাঝে কোনো কল্যাণ নেই। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৭৪১৯
আরেক হাদীসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা.-কে লক্ষ করে বলেন, ...নিশ্চয়ই তোমার উপর তোমার মেহমানের হক রয়েছে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬১৩৪
আর মেহমানদারির এ গুণে গুনাম্বিত ছিলেন মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম। তাঁর মেহমানদারির বর্ণনা কুরআনে কারীমে উল্লেখিত হয়েছে। আজকের অবসরে প্রথমে কুরআনে বর্ণিত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের মেহমানদারির ঘটনা এবং তা থেকে শিক্ষণীয় কিছু আদব আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। সাথে সাথে মেহমান ও মেজবানেরও কিছু আদব আলোচনা করব। যাতে আমরা মেহমানের যথাযথ সমাদর করতে পারি এবং মেহমানদারির ফযীলত লাভ করতে পারি।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
هَلْ اَتٰىكَ حَدِیْثُ ضَیْفِ اِبْرٰهِیْمَ الْمُكْرَمِیْنَ، اِذْ دَخَلُوْا عَلَیْهِ فَقَالُوْا سَلٰمًا قَالَ سَلٰمٌ قَوْمٌ مُّنْكَرُوْنَ، فَرَاغَ اِلٰۤی اَهْلِهٖ فَجَآءَ بِعِجْلٍ سَمِیْنٍ، فَقَرَّبَهٗۤ اِلَیْهِمْ قَالَ اَلَا تَاْكُلُوْنَ، فَاَوْجَسَ مِنْهُمْ خِیْفَةً قَالُوْا لَا تَخَفْ، وَ بَشَّرُوْهُ بِغُلٰمٍ عَلِیْمٍ.
(হে রাসূল!) আপনার কাছে কি ইবরাহীমের সম্মানিত অতিথিদের বৃত্তান্ত পৌঁছেনি! যখন তারা ইবরাহীমের কাছে উপস্থিত হয়ে বলল, সালাম, তখন সেও বলল, সালাম এবং মনে মনে চিন্তা করল যে, এরা তো অপরিচিত লোক। অতপর সে চুপিসারে নিজ পরিবারবর্গের কাছে গেল এবং একটি মোটাতাজা (ভুনা) বাছুর নিয়ে আসল, এবং তা সে অতিথিদের সামনে রাখল এবং বলল, আপনারা খাচ্ছেন না যে! এতে তাদের সম্পর্কে তার মনে ভীতির সঞ্চার হল। তারা বলল, ভীত হয়ো না। অতপর তারা তাকে এক জ্ঞানী পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিল। -সূরা যারিয়াত (৫১) : ২৩-২৭
সূরা হুদে আছে-
فَمَا لَبِثَ اَنْ جَآءَ بِعِجْلٍ حَنِیْذٍ، فَلَمَّا رَاٰۤ اَیْدِیَهُمْ لَا تَصِلُ اِلَیْهِ نَكِرَهُمْ وَ اَوْجَسَ مِنْهُمْ خِیْفَةً ...
অতপর সে (ইবরাহীম আ.) অবিলম্বে তাদের আতিথেয়তার জন্য একটি ভুনা করা বাছুর নিয়ে আসল। কিন্তু যখন দেখল তাদের হাত সেদিকে (অর্থৎ বাছুরের দিকে) এগুচ্ছে না তখন তাদের ব্যাপারে তার খটকা লাগল এবং তাদের দিক থেকে অন্তরে শংকা বোধ করল। -সূরা হুদ (১১) : ৬৯-৭০
উপরোক্ত আয়াতগুলোর আলোকে উলামায়ে কেরাম মেহমানদারির কিছু আদব বর্ণনা করেছেন :
১. মেজবান নিজেই মেহমানের আপ্যায়ন করবে। কেননা, ইবরাহীম আ. মেহমানের জন্য নিজেই খাবার নিয়ে এসেছেন। অন্য কাউকে আদেশ করেননি। -জিলাউল আফহাম, পৃ. ১৭৪
তাই পারতপক্ষে নিজেই আপ্যায়নের চেষ্টা করা উচিৎ। আর খাদেম বা অন্য কারো দ্বারা মেহমানদারি করালে নিজেও খাবার আনা নেয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে।
২. মেহমান আসার পর দ্রুত মেহমানদারির ব্যবস্থা করা। -তাফসীরে কুরতুবী (৯/৪৩)
উপস্থিত যা থাকবে তা দিয়েই আপ্যায়ন করা। চাই তা শরবত বা চা-বিস্কুটই হোক। এরপর সাধ্য ও সামর্থ্যরে ভেতরে ভারসাম্যপূর্ণভাবে আরো ভাল কিছু করার চেষ্টা করা। কেননা, প্রথমেই ঘটা করে আপ্যায়নের জন্য মেহমানকে অভুক্ত বসিয়ে রাখা আদবের পরিপন্থী। ইবরাহীম আ.-এর ঘটনা থেকে এই আদবটা পাওয়া যায়। সূরা হুদের আয়াতে বলা হয়েছে فَمَا لَبِثَ অর্থাৎ মেহমান আসার পর অনতিবিলম্বে তিনি ভুনা বাছুর নিয়ে এলেন।
৩. আপ্যায়নের জন্য উপস্থিত যা থাকবে তার মধ্যে উত্তম ও উৎকৃষ্ট খাবার দ্বারা আপ্যায়ন করা। হযরত ইবরাহীম আ. অতিথিদের জন্য অল্প বয়সী হৃষ্টপুষ্ট বাছুর ভুনা করে নিয়ে এসেছেন। যা একটি উৎকৃষ্ট ও সুস্বাদু খাবার। মেহমানদারির জন্য তাঁর কাছে যা কিছু ছিল তন্মধ্যে এটিই ছিল সর্বোৎকৃষ্ট। -ইবনে কাসীর ৪/৩৬৩; রুহুল মাআনী ১২/৯৪
৪. মেহমানের সামনে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার পরিবেশন করা। যেন খাদ্য স্বল্পতার কারণে তৃপ্তিসহকারে খেতে তার লজ্জাবোধ না হয়। আমরা উপরের ঘটনায় দেখেছি, ইবরাহীম আ. মেহমানের সামনে ভুনাকরা গোটা একটি বাছুর পেশ করেছেন। অথচ এক বর্ণনা মতে জানা যায়, মেহমান ছিলেন শুধু তিন জন। -রুহুল মাআনী ১২/৯৩; কুরতুবী ৯/৪২
৫. মেহমানকে যেখানে বসানো হয়েছে সম্ভব হলে খাবার সেখানেই পেশ করার চেষ্টা করা। ইবরাহীম আ.-এর ঘটনা থেকে আমরা এই আদবটা পাই। কেননা তাঁর মেহমানদারির বর্ণনায় আছে- فَقَرَّبَهٗۤ اِلَیْهِمْ ভুনা বাছুরটি তিনি তাদের কাছে নিয়ে এলেন।
তবে প্রয়োজন হলে বা বিশেষ কারণ থাকলে এর ব্যতিক্রম করতেও দোষ নেই।
৬. মেহমানকে খাবার শুরু করার আবেদন করতে গিয়ে আদেশ বাচক শব্দ ব্যবহার না করা। বরং কোমল, মার্জিত ও নম্র ভাষা ব্যবহার করা। (গিযাউল আলবাব ২/১১৬) যেমন, ‘মনে হয় খাবার শুরু করা যায়’, ‘খাবার শুরু করলে কেমন হয়’, ‘খাবারের পর্বটা সেরে ফেলা যায় না!’ ইত্যাদি।
খাবার পরিবেশনের পর ইবরাহীম আ. যখন দেখলেন, তারা খাচ্ছেন না তখন কোমল ভাষায় বললেন, اَلَا تَاْكُلُوْنَ আপনারা খাচ্ছেন না যে! -ইবনে কাসীর ৪/৩৬৩
৭. খাবার বা নাস্তা দিব কি না- এমন প্রশ্ন মেহমানকে না করাই ভালো। কোনো কোনো সময় মেহমানকে তা সংকোচ ও দ্বিধায় ফেলে দেয়। যেমন ইবরাহীম আ. মেহমানদের জিজ্ঞেস করেননি; বরং অনতিবিলম্বে তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেছেন।
তদ্রূপ খাবার নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে মেহমানের সামনে থেকে এমনভাবে উঠে আসা ভালো, যেন সে বিষয়টা টের না পায়। কারণ মেযবান খাবার নিয়ে আসতে যাচ্ছে- এই ভাব প্রকাশ মেহমানের জন্য চাপ ও সংকোচের কারণ হতে পারে। ইবরাহীম আ.-এর মেহমানদারির ঘটনায় খাবার আনতে যাওয়ার বিষয়টি বিবৃত হয়েছে এভাবে- فَرَاغَ اِلٰۤی اَهْلِهٖ। এ বাক্যে رَاغَ শব্দটি روغان ক্রিয়ামূল থেকে এসেছে, যার অর্থ, চুপিসারে বা অগোচরে গমন। অর্থাৎ তিনি চুপিসারে মেহমানের সামনে থেকে উঠে স্ত্রীর কাছে গেলেন। -ইবনে কাসীর ৪/৩৬৩
তবে যে ক্ষেত্রে মেহমানের সংকোচবোধের সম্ভাবনা থাকবে না, সেক্ষেত্রে জিজ্ঞেস করেও খাবার আনা যেতে পারে।
৮. খাবার শুধু পরিবেশন করার দ্বারাই মেযবানের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বরং মেহমান খাচ্ছেন কি না- সেদিক লক্ষ্য রাখাও কর্তব্য। তবে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে মেহমানের মুখ ও পাতের দিকে তাকিয়ে থাকবে না, এতে তার অস্বস্তি বোধ হতে পারে। বরং উড়াল দৃষ্টিতে লক্ষ রাখবে। এই আদবটাও উক্ত ঘটনা থেকে বুঝা যায়। -তাফসীরে কুরতাবী ৯/৪৯; মা’আরিফুল কুরআন ৪/৬৪৯
এমনিভাবে খাওয়ার সময় কোন্ মেহমানের কী দরকার- সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা কর্তব্য। খাবার বা পানীয় না পেয়ে মেহমানকে যেন অপেক্ষা কিংবা খাবার সমাপ্ত করে ফেলতে না হয়। অনেক সময় এটা মেহমানের জন্য বিব্রতবোধের কারণ হয়।
কুরআনের এই আয়াতগুলো থেকেই আমরা মেহমানদারির আটটি আদব জানতে পারলাম। ইবনুল কায়্যিম রাহ. বলেন, ইবরাহীম আ.-এর ঘটনাসংবলিত উক্ত আয়াতে মেহমানদারির যে আদবগুলো এসেছে তা অত্যন্ত উৎকৃষ্ট আদব। -জিলাউল আফহাম, পৃ. ১৭৫
এ ছাড়াও মেহমানদারির আরো কিছু আদব রয়েছে। এখানে তার কয়েকটি পেশ করা হলো :
৯. মেহমান একাধিক হলে যিনি বয়স, ইলম বা মর্যাদায় বড় তার থেকে পরিবেশন শুরু করা। এরপর তাঁর ডানে যে থাকবে তাকে দেওয়া। তবে যদি উপস্থিত সবাই সমপর্যায়ের বা কাছাকাছি পর্যায়ের হয় তাহলে পরিবেশকের ডান পাশ থেকে শুরু করবে। -মিন আদাবিল ইসলাম পৃ. ৬১
১০. একাধিক মেহমানকে দাওয়াত দেওয়া হলে খাবারের সময় যদি দু’একজন অনুপস্থিত থাকে তাহলে তাদের জন্য এত বেশি অপেক্ষা না করা, যা উপস্থিত মেহমানদের জন্য বিরক্তিকর ও অসহনীয় হয়ে পড়ে।
১১. মেহমানের সাথে দস্তরখানে অংশগ্রহণের চেষ্টা করা। তবে কোনো কারণবশত না পারলে দোষ নেই।
১২. আপ্যয়নের ক্ষেত্রে বাহুল্য না করে সামর্থ্যরে মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণভাবে মেহমানের সমাদর করা। -ফিকহুল আখলাক ২/৩৪৬; মিন আদাবিল ইসলাম, পৃ. ৭০
হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. বলেছেন, ইসলামের সরলতা ও অনাড়ম্বরতার উপর আমাদের থাকা উচিত। মেহমানের জন্য কোনো আয়োজন করা হলে সেটা ভারসাম্যপূর্ণ হওয়া চাই। -ইসলাহুল মুসলিমিন, পৃ. ১২৬
১৩. মেহমানের আগমনে বিরক্ত না হওয়া। বরং সওয়াবের আশা করে ও তার হক আদায়ের উদ্দেশ্যে যথাসাধ্য সমাদর করার চেষ্টা করা। কেননা, মেহমান যা কিছু গ্রহণ করেন সেটা তার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকেই নির্ধারিত রিযক। আমাদের তো এটাকে সৌভাগ্য মনে করা উচিত যে, আল্লাহর রিযক তারই বান্দা পর্যন্ত পৌঁছতে তিনি আমার মতো এক নগণ্যকে সামান্য শ্রম ব্যয়ের সুযোগ দিয়েছেন। যে শ্রমের বিনিময়ে তিনি আমাকে অশেষ নেকী দান করবেন। তাছাড়া মেহমানের সমাদর করা আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনেক বড় সুন্নত। মুমিন তো তাঁর প্রিয় নবীর সুন্নত সৌভাগ্য মনে করে পালন করবে।
১৪. নামাযের সময় হলে কেবলার দিক জানিয়ে দেয়া। তদ্রূপ অযুর জায়গা ও হাম্মাম চিনিয়ে দেয়া। -ইহইয়াউল উলূম ২/১৫
১৫. অযুর পর হাত-মুখ মোছার জন্য মেহমানকে নিজেদের ব্যবহৃত গামছা বা তোয়ালে না দেয়া। বরং তার জন্য আলাদা পরিচ্ছন্ন তোয়ালের ব্যবস্থা করা। -মিন আদাবিল ইসলাম, পৃ. ৭১
কারণ, নিজেদের ব্যবহৃত গামছা অনেক সময় একটু অপরিচ্ছন্ন থাকতে পারে। তাছাড়া অপরের গামছা/তোয়ালে ব্যবহার করতে অনেকের রুচিতে বাঁধে।
১৬. মেহমানের জন্য যে হাম্মাম ব্যবহারের ব্যবস্থা করা হবে সেখানে যেন এমন কোনো কাপড়-চোপড় না থাকে যা দৃষ্টিকটু। -প্রাগুক্ত
১৭. ঘরের মানুষের আওয়াজ ও শব্দের কারণে মেহমানের নিদ্রা ও বিশ্রামের যেন ব্যঘাত না ঘটে সেদিকে পূর্ণ লক্ষ রাখা। -প্রাগুক্ত
১৮. মেহমানের খাতিরে ভাল পোষাক-পরিচ্ছেদ পরে পরিপাটি থাকা এবং সুন্দর বেশভূষা অবলম্বনের চেষ্টা করা। তবে অতিরঞ্জন না হয় সেটাও লক্ষণীয়। -প্রাগুক্ত
১৯. মেহমান যেই হোক পূর্ণ যত্ন ও রুচিশীলতার সাথে মেহমানদারি কাম্য। মেহমান পরিচিত বা ঘনিষ্ঠজন হওয়ার কারণে তার সমাদরের ক্ষেত্রে ত্রুটি না করা। -প্রাগুক্ত
২০. মেহমানের ব্যক্তিত্ব, অবস্থা, পরিবেশ ও স্থান কাল বুঝে তার সাথে কিছু সরস কথাবার্তা বলা।
২১. কারো কোনো অসংলগ্ন কথা, কাজ কিংবা অন্য কোনো কারণে মেহমানের সামনেই তার উপর রেগে যাওয়া উচিত নয়। হাঁ, তখনই বলা আবশ্যক হলে আড়ালে গিয়ে বলবে। -গিযাউল আলবাব ২/১১৭
তেমনি ঘরওয়ালাদের সাথেও কোনো বিষয় নিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করবে না; এতে মেহমান ভাবতে পারেন আমার আগমনে হয়তো ঘরওয়ালা বিরক্ত।
২২. মেহমানের সামনে সহাস্যবদনে থাকার চেষ্টা করা। -প্রাগুক্ত
২৩. খাবারের পর্ব পরিপূর্ণভাবে শেষ হওয়ার আগেই দস্তরখান না উঠানো।
২৪. মেহমান বিদায়ের সময় দরজা পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দেওয়া এবং সাথে সাথে দরজা লাগিয়ে না দেওয়া; বরং খানিকটা দূরে চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা।
মেহমানের আদব
মেযবানের মতো মেহমানেরও কিছু করণীয় ও আদব রয়েছে। নিম্নে তার কিছু উল্লেখ করা হল-
১. কারো বাড়িতে প্রবেশের সময় দৃষ্টি অবনত রাখা, যেন ঘরের কোনো নারীর প্রতি দৃষ্টি না পড়ে যায়। -মিন আদাবিল ইসলাম, পৃ. ৩৪
২. (পরিস্থিতি বিবেচনা করা) মেযবান বসতে বলার আগে না বসা। তদ্রূপ নিজের থেকে কোনো জায়গায় বসে না পড়া। বরং মেযবান যেখানে বসতে বলবেন সেখানে বসবে। -মিন আদাবিল ইসলাম, পৃ. ৩৫
৩. যে ঘরে বা যে দিকে নারীরা অবস্থান করে সেদিকে দৃষ্টিপাত না করা।
৪. মেযবানের কাছে এত বেশি সময় অবস্থান না করা, যা তার জন্য কষ্টের কারণ হয়। -মিন আদাবিল ইসলাম, পৃ. ৩৯
৫. মেযবানের কাছে নির্দিষ্ট কোনো খাবারের আবদার না করা। হাঁ, যদি তার সাথে উষ্ণ সম্পর্ক হয় এবং এই আবদারে তিনি খুশি হন তাহলে দোষ নেই।
৬. খাবার পর্ব শেষ হওয়ার পর বেশি কথাবার্তা বা আলাপচারিতায় লিপ্ত না হয়ে যত দ্রুত সম্ভব মেযবানের কাছ থেকে বিদায় নেয়া। -আহকামুল কুরআন, ইবনুল আরাবী ৩/১৭৭
৭. মেজবানের অবস্থা বুঝতে চেষ্টা করা। এত বেশিদিন অবস্থান না করা, যে কারণে মেজবানের কষ্ট হয় এবং মেহমানকে খাওয়ানোর মতো ভালো কিছু তার কাছে থাকে না ।
হাদীস শরীফে এসেছে, কোনো মুসলিমের জন্য এটা বৈধ নয় যে, সে তার ভাইয়ের কাছে এত বেশিদিন অবস্থান করে যে তাকে গুনাহে লিপ্ত করে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, এটা কীভাবে? নবীজী বললেন, মেহমান এতদিন অবস্থান করল যে তাকে খাওয়ানোর মত কিছু মেজবানের কাছে অবশিষ্ট থাকল না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৮
৮. মেহমানের সাথে যদি অনিমন্ত্রিত কেউ যুক্ত হয় তাহলে মেযবানের কাছে তার ব্যাপারে অনুমতি নেয়া।
৯. মেযবানের জন্য দুআ করা। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিভিন্ন দুআ বর্ণিত হয়েছে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার আব্দুল্লাহ ইবনে বুস্র রা.-এর বাবার আতিথ্য গ্রহণের পর তার জন্য নি¤েœাক্ত দুআ করেছিলেন-
اَللّٰهُمَّ بَارِكْ لَهُمْ فِيْ مَا رَزَقْتَهُمْ، وَاغْفِرْ لَهُمْ وَارْحَمْهُمْ.
হে আল্লাহ! আপনি তাদের রিযিকে বরকত দান করুন, তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং তাদের প্রতি রহম করুন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২০৪২
তেমনি কারো কাছে ইফতার করলে বা আতিথ্য গ্রহণ করলে নিম্নের দুআও পড়বে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার সা‘দ ইবনে উবাদার কাছে এলে তিনি তার সামনে খাবার পেশ করলেন। খাবার শেষে নবীজী দুআ করলেন-
أفْطَرَ عِنْدَكُمُ الصَّائِمُوْنَ، وَأَكَلَ طَعَامَكُمُ الْأَبْرَارُ، وَصَلَّتْ عَلَيْكُمُ الْمَلاَئِكَةُ.
রোজাদারেরা তোমাদের কাছে ইফতার করুন, নেক লোকেরা তোমার আতিথ্য গ্রহণ করুন এবং ফিরিশতারা তোমাদের জন্য রহমতের দুআ করুন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৫৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২১৭৭
অন্য বর্ণনায় দুআটি এভাবে আছে-
أَكَلَ طَعَامَكُمُ الْأَبْرَارُ، وَصَلَّتْ عَلَيْكُمُ الْمَلَائِكَةُ، وَأَفْطَرَ عِنْدَكُمُ الصَّائِمُونَ
-মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২৪০৬
তেমনিভাবে যে পান করালো বা আহার করালো তার জন্য নিম্নোক্ত শব্দমালায় দুআ করা যেতে পারে-
اَللّهُمَّ أَطْعِمْ مَنْ أطْعَمَنِيْ، وَاسْقِ مَنْ سَقَانِيْ.
হে আল্লাহ! যে আমাকে আহার করাল আপনি তাকে আহার দান করুন এবং যে আমাকে পান করাল তাকে আপনি পান করান। -সহীহ মুসলিম ২/২৮৪, হাদীস ২০৫৫ (ভিন্ন একটি প্রেক্ষাপটে)
এগুলোর সাথে সাথে বা এ সকল আরবী দুআ জানা না থাকলে নিজ ভাষায়ও মেজবানের জন্য দুআ করা যায়।
১০. মেহমানদারিতে কোনো অসঙ্গতি বা ত্রুটি দেখা দিলে কোনো মন্তব্য না করা এবং মনক্ষুন্ন না হওয়া; বরং হাসিমুখে বিদায় নেওয়া।
মেহমান-মেযবানের কিছু আদব বর্ণনা করার পর মেহমানদারির অনন্য নজীর ও মেহমানদারির ফযীলত বিষয়ে এক সাহাবীর ঘটনা উল্লেখ করে শেষ করছি।
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে কোনো মেহমান আসলে তিনি আগে নিজে তার মেহমানদারির চেষ্টা করতেন অন্যথায় সাহাবীদের তার মেহমানদারির জন্য উৎসাহিত করতেন। হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, একবার নবীজীর কাছে এক মেহমান এল। নবীজী তাঁর স্ত্রীগণের ঘরে খোঁজ নিলেন- মেহমানদারির মত কিছু আছে কি না। কিন্তু জবাব এল- ঘরে পানি ছাড়া আর কোনো খাবার নেই। তখন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণের উদ্দেশে বললেন, তোমাদের মধ্যে কে আছ তার মেহমানদারি করতে পারো? এক আনসারী সাহাবী বললেন, আমি আছি ইয়া রাসূলাল্লাহ! তখন তিনি মেহমানকে নিজের বাসায় নিয়ে গেলেন। স্ত্রীকে বললেন, নবীজীর মেহমানের কদর কর। স্ত্রী বললেন, আমাদের কাছে বাচ্চাদের খাওয়ার পরিমাণ খাবার ছাড়া আর কিছুই নেই। সাহাবী বললেন, খাবার প্রস্তুত কর এবং বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে দাও। আর আমরা খাবার শুরু করার সময় তুমি বাতি ঠিক করার বাহানা করে বাতি নিভিয়ে দিবে। স্ত্রী তাই করলেন। খাবারের সময় অন্ধকারে তারা এমন ভাব করলেন যেন মেহমানের সাথে তারাও খাচ্ছেন। মেহমান তৃপ্তিভরে খেলেন আর তারা উপোস রাত কাটিয়ে দিলেন। তাদের এ কাজে আল্লাহ খুশি হলেন। সকালে যখন সাহাবী নবীজীর কাছে আসলেন, তিনি বললেন, গত রাতে আল্লাহ তোমাদের প্রতি হেসেছেন এবং তোমাদের উক্ত কাজে খুব খুশি হয়েছেন। আয়াত নাযীল হল-
وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ ...
এবং তারা অন্যদেরকে নিজেদের উপর অগ্রাধিকার দেয় নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও। যাদেরকে অন্তরের কার্পণ্য থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে তারাই সফলকাম। [সূরা হাশর (৫৯) : ৯] -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৭৯৮
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে মেহমানদারির উসূল ও আদবের দিকে লক্ষ রেখে মেহমানের হক আদায় করা এবং আদর্শ মেহমান হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।