আল্লাহুম্মা হাব্বিব ইলাইনাল ঈমান
হাদীস শরীফের একটি দুআ-
اللّٰهُمَّ حَبِّبْ إِلَيْنَا الْإِيمَانَ وَزَيِّنْهُ فِيْ قُلُوْبِنَا، وَكَرِّهْ إِلَيْنَا الْكُفْرَ، وَالْفُسُوْقَ، وَالْعِصْيَانَ، وَاجْعَلْنَا مِنَ الرَّاشِدِيْنَ.
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুআর যত শব্দমালা হাদীসের কিতাবসমূহে আছে তার মধ্যে এই দুআটিও প্রসিদ্ধ। মুসনাদে আহমাদে (হাদীস ১৫৪৯২) তা বর্ণিত হয়েছে। এ দুআর উৎস হল কুরআন মাজীদের একটি আয়াত, যে আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সাহাবায়ে কেরামের ব্যাপারে বলছেন-সাহাবায়ে কেরামের কাছে আল্লাহ তাআলা ঈমানকে ‘মাহবূব’ (সবচেয়ে প্রিয়) বানিয়ে দিয়েছেন।
পাক্কা মুমিন যারা হয় তাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কী হয়? ঈমান। ঈমান নিয়ে ফিকির করতে, ঈমানের দাওয়াত দিতে, ঈমানকে কীভাবে সংরক্ষণ করা যায় এই ফিকির করতে তারা আনন্দ পায়, স্বস্তি পায়। সাহাবাদের এই অবস্থার কথা আল্লাহ বলছেন-حَبَّب إِلَيْكم الْإِيمَانَ ঈমানকে তিনি তোমাদের কাছে পছন্দনীয় ও মুহাব্বতের বিষয় বানিয়ে দিয়েছেন। ঈমানের কথা বলতেই ভালো লাগে। ঈমানকে তোমাদের দিলে সবচেয়ে সুন্দর করে স্থাপিত করে দিয়েছেন। ঈমানের সাথে সংশ্লিষ্ট যা কিছু আছে সবকিছু তাদের কাছে ভালো লাগে, আকর্ষণীয় মনে হয়।
وَ زَیَّنَهٗ فِیْ قُلُوْبِكُمْ
(ঈমানকে তোমাদের হৃদয়গ্রাহী করেছেন) তোমাদের দিলে ঈমানকে আল্লাহ সবচেয়ে সুন্দর করে পেশ করেছেন। দিলের আয়নায় ঈমান সবচেয়ে ভালো দেখায়।
وَ كَرَّهَ اِلَیْكُمُ الْكُفْرَ وَ الْفُسُوْقَ وَ الْعِصْیَانَ
(এবং কুফ্র, পাপাচার ও নাফরমানীকে তোমাদের কাছে ঘৃণ্য বানিয়ে দিয়েছেন) তোমাদের দৃষ্টিতে কুফ্র, র্শিক, ফাসেকী, নাফরমানী-যত পাপাচার আছে সবকিছুকে তোমাদের দৃষ্টিতে ঘৃণিত থেকে ঘৃণিততর বানিয়ে দিয়েছেন আল্লাহ তাআলা। কোনো গুনাহ, কোনো পাপাচার, কোনো অপরাধ ভালো লাগে না। দুর্নীতি ভালো লাগে না, ভেজাল ভালো লাগে না। আর কুফ্র র্শিক তো বলার অপেক্ষা রাখে না। আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াটাকে তারা যতটুকু ভয় পায়, অপছন্দ করে, এর চেয়ে বেশি ঘৃণা করে কুফ্র ও র্শিককে। এ কথায় বলা হয়েছে-
وَ كَرَّهَ اِلَیْكُمُ الْكُفْرَ وَ الْفُسُوْقَ وَ الْعِصْیَانَ
(এবং কুফ্র, পাপাচার ও নাফরমানীকে তোমাদের কাছে ঘৃণ্য বানিয়ে দিয়েছেন)
যাদের মধ্যে এই গুণগুলো রয়েছে; ঈমান তাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয়, ঈমান সংশ্লিষ্ট সবকিছু ভালো লাগে এবং র্শিক, কুফ্র, যত পাপাচার, যত গুনাহ সবকিছুর প্রতি ঘৃণা থাকে, তাদের ব্যাপারে বলা হচ্ছে-
اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الرّٰشِدُوْنَ
(তারাই সঠিক পথে আছে) হেদায়েতের উপর আছে। -সূরা হুজুরাত, (৪৯): ৭
তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের এসব গুণাবলীর কথা আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের জন্য ও উম্মতের জন্য সবসময় দুআ করতেন। আল্লাহ তাআলা সাহাবীদের প্রশংসায় যে আয়াত নাযিল করেছেন তিনি ঐ আয়াত থেকে দুআ গ্রহণ করেছেন-
اللّٰهُمَّ حَبِّبْ إِلَيْنَا الْإِيمَانَ وَزَيِّنْهُ فِيْ قُلُوْبِنَا، وَكَرِّهْ إِلَيْنَا الْكُفْرَ، وَالْفُسُوْقَ، وَالْعِصْيَانَ، وَاجْعَلْنَا مِنَ الرَّاشِدِيْنَ.
আল্লাহ! আমাদের কাছে ঈমানকে সবচেয়ে প্রিয় বানিয়ে দিন। তা আমাদের হৃদয়ে সুশোভিত করুন এবং কুফ্র, পাপাচার ও নাফরমানীকে সবচেয়ে ঘৃণ্য বানিয়ে দিন। আমাদেরকে করুন সৎপথপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৫৪৯২; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ১৮৬৮
সাহাবীদের ব্যাপারে আল্লাহ বলছেন-তিনি সাহাবীদের কাছে ঈমানকে সবচেয়ে প্রিয় বানিয়ে দিয়েছেন। সেখান থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুআ নিয়ে নিয়েছেন-আল্লাহ! এই গুণ আমাদেরও দান কর। এই গুণ তো তাঁদের মাঝে আছে, তারপরও কেন চাচ্ছেন? উদ্দেশ্য হল, এই গুণ যেন সবসময় থাকে, বেশি থেকে বেশি মাত্রায় বৃদ্ধি পায় এবং এই গুণ যেন কখনো হাতছাড়া না হয়। এ জন্য আমরা আপনার মুখাপেক্ষী হে আল্লাহ! নবীজী নিজে এই দুআ করছেন, উম্মতকে এই দুআ করতে বলছেন-
اللهُمَّ حَبِّبْ إِلَيْنَا الْإِيمَانَ
আল্লাহ! আমাদের কাছে ঈমানকে সবচেয়ে প্রিয় বানিয়ে দিন।
وَزَيِّنْهُ فِي قُلُوبِنَا
আমাদের অন্তরে ঈমানকে খুব সুন্দর করে পেশ করুন। (ঈমানের যে কোনো কিছু যেন দেখতে-শুনতে ভালো লাগে।)
একটি বিষয় লক্ষ করুন-বেঈমানী তবিয়তের (স্বভাবের) মানুষ আর ঈমানী তবিয়তের মানুষের মাঝে পার্থক্য আছে। সরাসরি বেঈমান হোক বা বেঈমানী তবিয়তের (স্বভাবের) হোক-ওদের কাছে ঈমানের কথা শুনতে ভালো লাগে না। ঈমান সংশ্লিষ্ট কোনো কিছু দেখতে ভালো লাগে না। মাদরাসা-ঈমানের শিক্ষালয়; মাদরাসা দেখতে ভালো লাগে না, তাবলীগ জামাত দ্বীনের তলব পয়দা করার জন্য মেহনত করে; তাবলীগ জামাত দেখলে ভালো লাগে না। ঈমানের যত প্রতীক আছে, ঈমানের যত নিদর্শন আছে, ঈমানের যত আমল আছে, ভালো লাগে না। এগুলো বেঈমানী। আল্লাহর রাসূল আমাদের দুআ শিখাচ্ছেন, আমাদের যেন এ অবস্থা না হয়, ভুলেও যেন এ অবস্থা না হয়; ঈমান যেন আমাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় জিনিস হয় এবং দিলের আয়নায় সবচেয়ে ভালো হিসেবে প্রতিভাত হয়-এরকম বানিয়ে দিন আমাদের চোখকে, আমাদের দিলকে, আমাদের তবিয়ত-স্বভাবকে হে আল্লাহ! এ দুআই করা হচ্ছে-
اللهُمَّ حَبِّبْ إِلَيْنَا الْإِيمَانَ وَزَيِّنْهُ فِي قُلُوبِنَا.
এ দু বাক্যের মর্ম ও অর্থ যত বিস্তৃত ও গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারব তত ভালো।
‘ভালো লাগা’বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোনো খারাপ জিনিস যদি কারো কাছে ভালো লাগা শুরু করে, এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কিছু হতে পারে না। তার চেয়ে হতভাগা আর কেউ নেই। এর সংশোধন হবে কীভাবে! আপনি ঘৃণিত জিনিসের ব্যাপারে কাউকে সতর্ক করতে পারেন-এ ঘৃণিত জিনিস, এটা খারাপ,দুর্গন্ধযুক্ত, এ তুমি বর্জন কর। এখন কারো কাছে এ দুর্গন্ধযুক্তটাই যদি ভালো লাগে। তো এর হৃদয়ই তো বিকৃত হয়ে গেছে। একে আপনি কী করবেন? তার কাছে খারাপ কথা ভালো লাগে, ভালোটা খারাপ লাগে। এটা যে কত বড় রোগ চিন্তাই করা যায় না। চিন্তার সূত্রই তার পরিবর্তন হয়ে গেছে। খারাপটা ভালো লাগে, ভালোটা খারাপ লাগে। এ এক কঠিন রোগ। দুআর মধ্যে বলা হচ্ছে, এ রোগ যেন আমাদের মাঝে না আসতে পারে। ভালোটাই যেন আমাদের কাছে ভালো লাগে, খারাপটাই যেন আমাদের কাছে খারাপ লাগে। সুন্দরটাকে যেন আমরা সুন্দর হিসেবে দেখি।
যত অশ্লীল আছে, অশ্লীল যত দৃশ্য আছে, তা যদি ভাল লাগে, এটা দিল খারাপ হওয়ার লক্ষণ। মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে। আর নেট তো কোনো বিষয়ই না আজকাল। নেটে ঢোকে আর মগ্ন হয়ে যায়। যত অশ্লীল দৃশ্য আছে তার কাছে ভালো লাগে। এর মানে ঈমান তার কাছে প্রিয় জিনিস নয়। ভালোটা তার অন্তরে ভালো হিসেবে পেশ হয় না, খারাপটা তার অন্তরে খারাপ হিসেবে দেখায় না। খারাপটা তার কাছে ভালো লাগে আর ভালোটা খারাপ লাগে।
তার যদি এ অবস্থা হত-ঈমান তার কাছে সবচেয়ে প্রিয়, তার দিলের আয়নায় ঈমান ও ঈমান সংশ্লিষ্ট সবকিছু সুন্দর দেখায়, ঈমান পরিপন্থী কোনো কিছু সুন্দর দেখায় না, তাহলে সে এভাবে অশ্লীল কোনো দৃশ্যে মগ্ন হতে পারত না। তার ঈমান তাকে বাধা দিত। সে বলত, বিশ্রী, ছি! বন্ধ কর এগুলো, ফেলে দাও। নেটের সংযোগ বিচ্ছিন্ন কর। কিন্তু দিলের অবস্থা ভালো না হলে সে যত অশ্লীল বিষয় আছে তাতে মগ্ন হয়ে পড়বে। এ অবস্থাটা হয় দিলের পরিবর্তনের কারণে।
দুআর মধ্যে নবীজী এটাই বলছেন, আমাদের দিলের হালত যেন এমন না হয় যে, অশ্লীল ও বিশ্রী কাজ আমাদের কাছে ভালো লাগে। ঘৃণিত জিনিস আমার কাছে পছন্দের ও প্রিয় হয়। দিলের হালাত হতে হবে এমন যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে যা ভালো তা আমার কাছে ভালো লাগে, যা খারাপ তা আমার কাছে খারাপ লাগে।
اللهُمَّ حَبِّبْ إِلَيْنَا الْإِيمَانَ وَزَيِّنْهُ فِي قُلُوبِنَا.
সুন্নত যেন আমার কাছে ভালো লাগে, বিদআত খারাপ লাগে। নেক আমল ভালো লাগে, পাপ খারাপ লাগে। র্শিক খারাপ লাগে, তাওহীদ ভালো লাগে। গাফেল ও উদাসীন হয়ে থাকার মাঝে যেন আমি স্বস্তি না পাই; আমি যেন যিকিরের মধ্যে, আপনার বিধানকে স্মরণ রাখা, আপনাকে স্মরণ রাখার মাঝে যেন স্বস্তি পাই।
وَكَرِّهْ إِلَيْنَا الْكُفْرَ، وَالْفُسُوقَ، وَالْعِصْيَانَ.
কুফর, কুফরের যত শাখা, কুফরের যত প্রকাশক্ষেত্র সব যেন আমার কাছে ঘৃণ্য মনে হয়। আমার দিলে যেন এগুলো কোনো স্থান না পায়। আমার চোখে যেন এগুলো ভালো না লাগে। وَالْفُسُوقَযত ফাসেকী আছে, যত পাপাচার, যত দুর্নীতি, যত ভেজাল, যুলুম-অত্যাচার যেন আমার কাছে ভালো না লাগে। وَالْعِصْيَانَআল্লাহর নাফরমানী যা কিছু আছে, এক কথায় গুনাহে কবীরা, গুনাহে সগীরা যত আছে সব যেন আমার কাছে ঘৃণিত লাগে। আমার দিলে যেন ওর প্রতি কোনো আকর্ষণ না থাকে। ওদিকে যেন আমি না তাকাই।
وَاجْعَلْنَا مِنَ الرَّاشِدِينَ
আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে ‘রাশিদ’দের অন্তর্ভুক্ত করেন, হেদায়েতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করেন, যাদের মধ্যে এই গুণগুলো আছে। এই গুণগুলো নিয়ে যেন পুরো জীবন থাকতে পারি এবং মৃত্যুও যেন এর উপরেই হয়।
এটা কোনো বিশেষ সময়ের দুআ নয়। কিছু দুআ তো আছে বিশেষ সময়ের, বিশেষ প্রেক্ষাপটে পড়া হয়। এই দুআটি যখনই মনে হয় পড়তে পারেন। নামাযের পর হাত ওঠাচ্ছেন পড়তে পারেন। নামাযে দরূদের পর দুআ মাছূরার সাথেও পড়েন। বসে-শুয়ে আছেন, যে কোনো হালতে এটা পড়তে পারেন।
এই দুআতে কী চাওয়া হয়েছে? এই শব্দমালার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে কী চাওয়া হচ্ছে এটাও বুঝার বিষয়, অনুধাবন করার বিষয়। এ কথা আমি বাংলাতে বলি, ইংলিশে বলি দুআ হয়ে গেল। আর আরবীতে বললাম এবং অর্থটাও দিলে হাজির রাখলাম তাহলে সবচেয়ে ভালো। কারণ, এই শব্দমালা তো রাসূলের শেখানো। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের এই দুআ পড়ার তাওফীক নসীব করুন এবং এই দুআর মাধ্যমে আমি আল্লাহর কাছে যা চাচ্ছি আমি যেন নিজেকে সেরকম বানাতে পারি সেই মেহনত করারও তাওফীক নসীব করুন।
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.
[ধারণ ও লিখন :
মুহাম্মাদ ফজলুল বারী]