জুমাদাল আখিরাহ ১৪৩৮   ||   মার্চ ২০১৭

হযরত মাওলানা সালীমুল্লাহ খান রাহমাতুল্লাহি আলাইহি

হযরত মাওলানা মুফতি তকী উছমানী

গত (জানুয়ারী ২০১৭) মাস এ উপমহাদেশের জন্য বরং সমগ্র ইসলামী বিশ্বের দ্বীনী পরিম-লের লোকদের জন্য সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ- শাইখুলকুল (সকলের মুরুব্বী) হযরত মাওলানা সালীমুল্লাহ খান ছাহেবের ওফাতের সংবাদ। হযরতের ইন্তেকালের কারণে উম্মতে মুসলিমাহ্র এমন সকল ব্যক্তির অন্তর দুঃখ ও বেদনায় ডুবে গেছে, যে ব্যক্তিই হযরত রহমাতুল্লাহি আলাইহির সাথে কোন না কোন সম্পর্কে সম্পৃক্ত ছিলেন।

হযরত রাহমাতুল্লাহি আলাইহির অস্তিত্ব বর্তমান সময়ে উপমহাদেশের উলামায়ে কেরাম ও দ্বীনী পরিম-লের জন্য বিশেষভাবে দ্বীনী মাদরাসাসমূহের জন্য আল্লাহপাকের রহমতের বিশাল সামিয়ানা ছিল। যাঁর কথা কল্পনা করলেই এ ফিতনার যুগে অন্তর সান্ত¡না লাভ করত। এ মাসেই (জানুয়ারী ২০১৭) আমরা মহান এ আশ্রয়স্থল হারিয়ে ফেললাম।

اِنَّا لِلّٰهِ وَ اِنَّا اِلَيْهِ رَاجِعُوْنَ

এ পৃথিবীতে কেউই চিরদিন থাকার জন্য আসে না। এখানে আগত সকলেরই মৃত্যুর মুখোমুখী হতে হয়। কিন্তু কোনো কোনো মহান ব্যক্তিত্বের বিদায়ের বেদনা কেবল তাঁর পরিবার-পরিজন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং তাঁদের বিদায়ে সমগ্র পৃথিবী ব্যথিত হয়। শোকাহত হয়।

وما كان قيس هلكه هلك واحد

ولكنه بنيان قوم تهدما

তাঁর মৃত্যু তো কেবল ব্যক্তি মাত্রের মৃত্যু নয়।

তার মাধ্যমে তো কওমের প্রাচীরই ধ্বসে গেল।

আমাদের শ্রদ্ধেয় উস্তায হযরত মাওলানা সালীমুল্লাহ খান ছাহেব রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এমন ব্যক্তিত্বদেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আমি হযরত রাহমাতুল্লাহি আলাইহিকে দাফনের সময় দেখেছি বড় বড় উলামায়ে কেরাম একে অন্যকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। একে অন্যের প্রতি শোক প্রকাশ করছেন। এমনটিই হওয়ার কথা। হযরত এই পৃথিবীতে এ অধমের সর্বশেষ জীবিত উস্তায ছিলেন। আমার অন্য সকল উস্তায হযরতের পূর্বেই দুনিয়া ত্যাগ করেছিলেন। কারো কোনো মুরুব্বী বা উস্তাযের ছায়া মাথার উপর থাকার ফলে যে মহাপ্রশান্তি ও স্বস্তি লাভ হতে থাকে, হযরতের ওফাতের কারণে আজ আমার সেই প্রশান্তি ও স্বস্তির পরিসমাপ্তি ঘটল।

আল্লাহ পাক হযরত রাহমাতুল্লাহি আলাইহির দ্বারা অনেক বড় বড় কাজ নিয়েছেন। বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ারূপে হযরতের বিশাল কীর্তি সকলের সামনে বিদ্যমান, যা আলহামদু লিল্লাহ্! কালের ফিতনা ও ষড়যন্ত্রের ঘূর্ণাবর্তের মধ্যেও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থেকে নিজ শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে এক বিশাল মহিরূহ আকারে আমাদের সম্মুখে বিদ্যমান আছে। যার ছায়ায় সকলে মিলে বসে স্বস্তি ও প্রশান্তি লাভ করে থাকি।

 এক্ষেত্রে হযরত মাওলানা সালীমুল্লাহ খান ছাহেব রাহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর ব্যক্তিত্ব, তাঁর কীর্তিসমূহ ও অবদানের পূর্ণ বিবরণ সংক্ষিপ্ত কোনো লেখায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবে আশা করি যে, এ বিষয়ে প্রমাণসিদ্ধ, বিস্তারিত কোনো লেখা অচীরেই এমন কোন মহান ব্যক্তিত্বের কলম থেকে আসবে ইনশাআল্লাহ, যিনি এর যথাযথ হক আদায় করে লেখার যোগ্যতা রাখেন।

এখন অবশ্য আমার কিছু বিক্ষিপ্ত স্মৃতিকথা লিখতে আগ্রহ হচ্ছে। নিম্নে এ সম্পর্কিত সামান্য কিছু কথা লেখার সৌভাগ্য অর্জন করছি।

আমি আমার শ্রদ্ধেয় উস্তায হযরত মাওলানা সালীমুল্লাহ খান ছাহেব দামাত বারাকাতুহুমের পবিত্র নাম সর্বপ্রথম ১৩৭৬ হিজরী (মোতাবেক ১৯৫৭ ঈসায়ী) সনে (তখন আমার বয়স ছিল চৌদ্দ বছর) আমার ভগ্নিপতি ও দারুল উলূম করাচীর সাবেক নাযেম হযরত মাওলানা নূর আহমাদ ছাহেব রাহ.-এর মুখ থেকে ঐ সময় শুনেছি, যখন আমাদের দারুল উলূম (পুরাতন করাচীর) নানকওরা নামক এলাকা হতে (করাচী শহরের পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্তে, সে সময় শহর এলাকা হতে অনেক দূরে) শরাফীঘোট নামক স্থানের কাছাকাছি নতুন ভবনে স্থানান্তরিত হচ্ছিল। ঘটনাক্রমে ঐ বছরই হযরত মাওলানা ইউসুফ বান্নূরী রাহ. মাদরাসা আরাবিয়া ইসলামিয়া নামে করাচীর নিউ টাউন জামে মসজিদ সংলগ্ন জায়গায় নতুন একটি মাদরাসা স্থাপন করেন। এ সময় আমাদের বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য সুযোগ্য উস্তায (যেমন হযরত মাওলানা মুফতী ওলী হাসান রাহ., হযরত মাওলানা ফযল মুহাম্মাদ ছাহেব রাহ.) শহরের বাহিরে (বেশ দূরে অবস্থিত) দারুল উলূমের নতুন ভবনে স্থানান্তরিত হওয়ায় সেখানে গিয়ে খেদমত করাটা নিজেদের জন্য অসুবিধাজনক মনে করছিলেন এবং হযরত বান্নূরী রাহ.-এর আহ্বানে নিউ টাউন মাদরাসায় যোগদান করতে মনস্থ করেছিলেন। এ সকল মুরুব্বী ও উচ্চপর্যায়ের উস্তাযের চলে যাওয়ার কারণে দারুল উলূমের উচ্চশ্রেণীতে শিক্ষক সংকট দেখা দেয়ার সম্ভাবনা ছিল। যদিও আব্বাজান রাহ.-এর সব সময়ের নীতি এটাই ছিল যে, কোনো উস্তাযকে অন্য কোনো মাদরাসায় খেদমতরত থাকা অবস্থায় সেখানের দায়িত্ব ছেড়ে নিজের প্রতিষ্ঠানে আসার দাওয়াত দিতেন না। তিনি এ প্রসঙ্গে বলতেন, “এক মাদরাসাকে বিরাণ করে অন্য মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা কোনোভাবেই উচিত নয়। কিন্তু এ সময়ে হযরত মাওলানা নূর আহমাদ ছাহেব রাহ. জানতে পারলেন যে, কয়েকজন মুরুব্বী ও উচ্চ পর্যায়ের উস্তায নিজেরাই পুরানো জায়গা ছেড়ে অন্যত্র যেতে চাচ্ছেন। কাজেই তাদেরকে দারুল উলূমে আসার দাওয়াত দিতে কোনো ক্ষতি নেই। এ সময় তিনি যে সকল উস্তাযকে দারুল উলূমে এসে শিক্ষকতা করার জন্য দাওয়াত দিলেন, তাদের মধ্যে হযরত মাওলানা রশীদ আহমাদ ছাহেব রাহ., হযরত মাওলানা আকবার আলী ছাহেব রাহ., হযরত মাওলানা সালীমুল্লাহ খান ছাহেব রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তখন হযরত মাওলানা নূর আহমাদ ছাহেব একথাও বলেছিলেন যে, হযরত মাওলানা সালীমুল্লাহ খান ছাহেব থানাভবনের নিকটবর্তী এলাকা জালালাবাদের লোক। তিনি (সিন্দের) ট্যান্ডোল্লাইয়ার মাদরাসা থেকে ইস্তফা দিয়ে দারুল উলূম আসবেন।

১৩৭৬ হিজরীর শাওয়াল মাসে দারুল উলূমের নতুন ভবনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হচ্ছিল। সে সময় দারুল উলূমের এ জায়গা জনবসতিহীন প্রায় মরুঅঞ্চল ছিল। পশ্চিম দিকে সমুদ্র উপকূল পর্যন্ত বালুর ছোট ছোট টিলা ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। দক্ষিণ দিকে বর্তমান কোরঙ্গীর এলাকা বন-জঙ্গল ও বন্যপ্রাণীর বিচরণ ক্ষেত্র ছিলো। পূর্ব দিকে বর্তমান লান্ডি এলাকা পর্যন্ত ফসলিজমি ও বাগান ছিল। কেবলমাত্র পূর্ব-উত্তর প্রান্তে শরাফীঘোট নামক বসতি এলাকা ছিল।

যে সকল নতুন উস্তাযকে শিক্ষাবর্ষের শুরুতে এখানে শিক্ষকতার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল তাদের বসবাসের জন্য দারুল উলূমের ভেতরেই ছোট ছোট কিছু কাঁচা এবং কিছু পাকা বাড়ী নির্মাণ করা হয়েছিল। এ সকল মহান ব্যক্তিবর্গ এই বিরানভূমিতে থেকেই দারুল উলূমের শিক্ষকতার খেদমত আরম্ভ করলেন।

এ বছর আমি ও আমার বড় ভাই হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ রফী উসমানী ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম হেদায়া আখেরাইন-এর জামাতে পড়ছিলাম। আমাদের যে সকল কিতাব পড়ানো হচ্ছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল হেদায়া আখেরাইন, তাওযীহ, মায়বুযী, মুল্লা হাসান, সিরাজী ও তাসরীহ। হযরত মাওলানা সালীমুল্লাহ খান ছাহেব রহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর সাথে এ শিক্ষা বর্ষের প্রারম্ভে সর্বপ্রথম সাক্ষাৎ হয়। হযরত রাহ. সে সময় একেবারে যুবক ছিলেন। সুন্দর ও বিকশিত মুখ-ম-ল। আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি। সাদাসিধে আড়ম্বরহীন জীবন-যাপন পদ্ধতি। এ সকল গুণাবলী খুব দ্রুতই হযরত রাহ.-এর সাথে আমাদের একটি প্রীতিকর সম্পর্ক সৃষ্টি করে দিল। এ বছর আমাদের দুটি কিতাব হযরতের নিকট ছিল। একটি হল, ‘মায়বুযী, আর অপরটি হলো, ‘হেদায়া আখেরাইন

উস্তাযুল আসাতিযা হযরত মাওলানা সালীমুল্লাহ খান ছাহেব রাহ. সে সময় টগবগে তরুণ ছিলেন। তিনি শাইখুল ইসলাম হযরত মাওলানা হোসাইন আহমাদ মাদানী রাহ.-এর শিষ্য ও ছাত্র ছিলেন। আমার দ্বিতীয় শায়েখ মাসীহুল্লাহ খান ছাহেব রাহ.-এর মাদরাসা মিফতাহুল উলূম জালালাবাদে দীর্ঘদিন শিক্ষাদানের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাসের ইচ্ছায় পাকিস্তান তাশরীফ এনেছিলেন।

যদিও ঐ বছর আমাদের দুটি সবক (১. হেদায়া আখেরাইন, ২. মায়বুযী) হযরত রাহ.-এর দায়িত্বে ছিল। কিন্তু এখন যতটুকু মনে পড়ছে, প্রথম দিন সকালে সকল জামাতের ছাত্রদের একত্র করে শিক্ষাবর্ষের প্রথম সবক দান অনুষ্ঠানের পর আর সময় ছিল না। আর বিকালে হযরত রাহ.-এর নিকট আমাদের মায়বুযীর র্দস ছিল। এজন্য হযরত রাহ.-এর নিকট জীবনের প্রথম সবক মায়বুযী পড়েছিলাম। আমার যেহেতু স্বভাবগতভাবেই মানতেক ও ফালসাফাহ (দর্শনশাস্ত্র)-এর প্রতি তেমন আকর্ষণ ছিল না, ঠেকায় পড়েই (নেসাবভুক্ত) মানতেকের কিতাব পড়তাম। অবশ্য দর্শনের এটাই প্রথম এবং এটাই শেষ কিতাব ছিল। কিন্তু হযরত রাহ.-এর প্রতি আল্লাহ পাকের বিশেষ অনুগ্রহ ছিল। তিনি প্রথম দিন প্রথম সবকই আমাদেরকে এমন আকর্ষণীয় আঙ্গিকে পড়ালেন যে, কিতাব এবং উস্তায উভয়ের সাথে এমন গভীর সম্পর্ক স্থাপিত হল যে, আমি বিগত বছরগুলোর বিপরীত পূর্ণ বছর মায়বুযী কঠোর পরিশ্রম করে অত্যন্ত আগ্রহ-উদ্দীপনাসহ পড়তে থাকলাম। হযরত রাহ.-এর নিকট আমাদের দ্বিতীয় সবক ছিল হেদায়া আখেরাইন। সে কিতাব মাশাআল্লাহ হযরত খুবই আকর্ষণীয় আঙ্গিকে পড়ালেন। হযরত রাহ. এ কিতাব দারুল উলূম দেওবন্দে শাইখুল আদব ওয়াল ফিক্হ হযরত মাওলানা ইযায আলী আহ.-এর নিকট পড়েছিলেন। এজন্য তিনি অত্যন্ত আগ্রহভরে নিজ শায়েখের অনুসরণ করতেন। তিনি সকালের প্রথম ঘণ্টায় এ কিতাব পড়ানোর জন্য সর্বদা সময় মতো উপস্থিত হতেন। লাগাতার দুই ঘণ্টা পড়াতেন। এই দীর্ঘ সময়ে স্বীয় হাস্যোজ্জ্বল চেহারা ও আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গিতে আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ বানিয়ে রাখতেন। এত লম্বা সময়েও আমরা কখনো ক্লান্তি অনুভব করিনি।

পরবর্তী বছর আমরা মওকুফ আলাইহি (মেশকাত শরীফ)-এর ছাত্র ছিলাম। এ বছর আমাদের কোনো সবক হযরত রাহ.-এর নিকট ছিল না। কিন্তু গত বছর হযরত রাহ.-এর সাথে যে বিশেষ সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল, এ বছর সবক না থাকা সত্ত্বেও তার ভিত্তিতে তাঁর সাথে যোগাযোগ ও সম্পর্ক পূর্ববৎ বহাল ছিল। (আমাদের আরেক উস্তায) হযরত মাওলানা শামছুল হক ছাহেব রাহ. হযরতের বিশেষ ও অন্তরঙ্গ শিষ্য ছিলেন। তিনি যদিও হযরতের ছাত্র ছিলেন কিন্তু হযরত রাহ. তাঁর সাথে বন্ধুসুলভ আন্তরিক আচরণ করতেন। আর হযরত মাওলানা শামছুল হক ছাহেব রাহ.-এর সাথে আমাদের সম্পর্কও অনেকটা ঐ ধাঁচেরই ছিল। এজন্য এ দুই বুযুর্গের হৃদ্যতাপূর্ণ সোহবত দ্বারা আমরা সর্বদা সিক্ত হতে থাকতাম। এর পরের বছর যখন আমরা দাওরায়ে হাদীসে পৌঁছলাম, এ বছরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিতাব জামে তিরমিযী পড়ানোর দায়িত্ব হযরত রাহ.-এর নিকট ছিল। হযরত রাহ. আমাদেরকে এ সবক অত্যন্ত গুরুত্ব ও তাহকীকসহ পড়িয়েছেন। হযরত রাহ. এ কিতাব পড়ানোর সময় ফিক্হ ও উলূমে হাদীসের আলোচনা বিস্তারিতভাবে করতেন। ছাত্রদের উপকারার্থে বক্তব্য লেখাতেন। লেখানোর কারণে যেহেতু কিছুটা বিরতি পাওয়া যেত, এজন্য আমি হযরত রাহ-এর পাঠ আরবীতে লিখতাম। হযরতের এ সকল দরসী তাকরীর এতই সাজানো-গোছানো হত যে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সকল দিক সুবিন্যস্তরূপে একত্রিত হয়ে যেত। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের যে সকল কথা হাদীস শরীফের বিভিন্ন ভাষ্যগ্রন্থে বিভিন্ন অধ্যায়ে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পাওয়া যায়, সে সকল আলোচনা হযরতের দরসে স্বাভাবিক বিন্যাসে সাজানো-গোছানো অবস্থায় পাওয়া যেত। হযরতের সে সকল দরসী তাকরীরের লিখিত কপি এখনো আমার নিকট সংরক্ষিত আছে। সে সময় তো হযরত রাহ.-এর এ সকল সুবিন্যস্ত আলোচনার মূল্য ঐভাবে অনুভূত হয়নি, কিন্তু পরবর্তীতে যখন হাদীস শরীফের বিভিন্ন ভাষ্যগ্রন্থ অধ্যয়ন করার সুযোগ আসলো তখন বুঝলাম হযরত রাহ. এ সকল বিক্ষিপ্ত আলোচনাকে কত কষ্ট করে একত্রিত করে সুবিন্যস্তরূপে আমাদেরকে লিখিয়েছেন। হযরতের মেহনতের ফলে এ সকল সাজানো-গোছানো বক্তব্য আয়ত্ব করা ও স্মরণ রাখা আমাদের জন্য কতই না সহজ হয়ে গিয়েছিল।

এটাও জানা কথা যে, ছাত্রদেরকে বক্তব্য লিখিয়ে দিতে গিয়ে সময় অনেক লেগে যেত। ফলে সবকের গতিও মন্থর ছিল। বছর প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। অথচ কিতাব মাত্র আরকানে আরবাআ (অর্থাৎ, কিতাবুস সালাত, কিতাবুস সাওম, কিতাবুয যাকাত ও কিতাবুল হজ্ব) পর্যন্ত পৌঁছলো। অপরদিকে তিরমিযী শরীফের ২য় খণ্ড হযরত রাহ. লেখানো ছাড়াই পড়াতেন। ফলে সেটা অনেক বেশী পড়ানো হয়েছিল। বছর যখন প্রায় শেষ হতে চলল, তখন হযরত রাহ. বললেন, এখন সামনে যে সকল হাদীস আসবে তার অধিকাংশই তো বুখারী শরীফ, নয় তো মুসলিম শরীফ বা আবু দাউদ শরীফ ইত্যাদি কিতাবে চলে গেছে। কাজেই বাকী অংশ রেওয়ায়াতান (অর্থাৎ শুধু হাদীসের শব্দ) পড়ানো হলেও যথেষ্ট হবে। এজন্য তিনি দরসের বাহিরেও (রাতে) অতিরিক্ত সময় দিয়ে কিতাব শেষ করার পদক্ষেপ নিলেন। এভাবেও যখন প্রায় একশত পৃষ্ঠা অবশিষ্ট থাকলো, তখন তিনি একদিন পুরো রাত সবক পড়ালেন। সে রাতের জন্য হযরত স্টোভ (চুলা) দরসগাহে এনে বিরতি দিয়ে দিয়ে চা বানিয়ে নিজেও পান করতে থাকলেন এবং ছাত্রদেরকেও পান করাতে লাগলেন। এভাবে সম্ভবত এক বা দুরাতেই কিতাব সমাপ্ত করলেন।

আমরা আমাদের এ মহান উস্তাযের পাঠদানের আগ্রহ-উদ্দীপনা সে সময় দারুল উলূমে (করাচী) খুব প্রত্যক্ষ করেছি। সে সময় এটাও অনুভব করেছি যে, হযরত রাহ. কেবল আগ্রহভরে পড়ান তা-ই নয় বরং উস্তায গড়ার ব্যাপারেও হযরত রাহ.-এর বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। হযরত রাহ.-এর বিশেষ এই আগ্রহের দিকের বাস্তব রূপ প্রথম তো জামেআ ফারুকিয়ার মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে যে, দেখতে দেখতে অতি অল্প সময়ের মধ্যে এই দ্বীনী শিক্ষালয় দেশের শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে একটি জায়গা করে নিয়েছে। দ্বিতীয়ত হযরত রাহ.-এর সার্বিক ও কল্যাণকর এই বিশেষ যোগ্যতার বিকাশ পূর্ণ মাত্রায় তখন ঘটেছে, যখন তাঁকে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার সর্বোচ্চ পদে সমাসীন করা হয়। বেফাকুল মাদারিস যদিও অনেক পূর্ব হতে প্রতিষ্ঠিত ছিল, বড় বড় উলামায়ে কেরাম ও বুযুর্গানে দ্বীন এ প্রতিষ্ঠানকে প্রতিষ্ঠিত রাখার এবং সচল রাখার জন্য নিজেদের সামর্থ্য ব্যয় করেছেন, কিন্তু এ ক্ষেত্রে যে বিশাল ও গভীর প্রভাব অর্জিত হয়েছে তা নির্দ্বিধায় ও নিঃসঙ্কোচে বলা যায়, সেটা হযরত মাওলানা সালীমুল্লাহ খান ছাহেব রাহ.-এর অক্লান্ত পরিশ্রম, অব্যাহত মেহনত ও চেষ্টা, মাদরাসা ও দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের মেযায-রুচি-প্রকৃতির বাস্তবসম্মত অনুধাবন, সংশোধনের বিপুল আগ্রহ ও অব্যাহত চেষ্টারই ফল।

হযরত রাহ.-এর অসীম সাহসিকতা ও হিম্মত আমাদের মতো লোকদের জন্য সর্বদাই ঈর্ষণীয় বিষয় ছিল। হযরত রাহ. যে মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কাজে নেমে পড়তেন, সেক্ষেত্রে কোনো প্রকার কষ্টও পরিশ্রম তার লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে বাধা হতে পারত না। তিনি যে প্রকারের কঠিন থেকে কঠিনতর পরিশ্রম ও কষ্ট হাসিমুখে বরণ করে নিতেন, তা আমাদের মত লোকদের সর্বদা লজ্জায় ফেলে দিত। বেফাকুল মাদারিসকে সুসংগঠিত করার জন্য এবং তার প্রভাববলয় সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য হযরত রাহ. স্বয়ং মারাত্মক কষ্টকর সফর করে এমন গ্রাম-পাড়া ও দুর্গম এলাকায় পৌঁছেছেন যে, এ উদ্দেশ্যে হযরতের পূর্বে সেখানে কেউ গমন করেনি। এই কষ্ট ও কুরবানীর এমন বরকত আল্লাহ পাক দান করলেন যে, বেফাকুল মাদারিস এখন বিশাল মহিরূহের আকার ধারণ করেছে। শত ষড়যন্ত্র ও বিরুদ্ধাচরণের মারাত্মক ও ভয়াবহ তুফানের মধ্যেও আল্লাহ পাকের অনুগ্রহে দৃঢ়পদ থেকে খেদমত করে যাচ্ছে। আল্লাহ পাক হযরত রাহ.-এর এই ফয়েযকে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত রাখুন- আমীন।

হযরত রাহ. আকাবির উলামায়ে দেওবন্দের মাসলাকের ব্যাপারে অতি কঠোর হওয়া সত্ত্বেও, দ্বীনী মাদরাসাসমূহের কল্যাণে অন্য ঘরানার লোকদের সাথে মিলে-মিশে কাজ করার ক্ষেত্রে এই কঠোরতাকে বাধা হতে দেননি। আর এটা হযরতেরই বিজ্ঞজনোচিত প্রজ্ঞা ও চেষ্টার ফল ছিল যে, বিভিন্ন ঘরানার মাদরাসাসমূহের একটি সম্মিলিত প্লাটফর্ম ইত্তিহাদে তানযিমাতে মাদারেসে দ্বীনিয়া নামে কেবল একটি সংগঠন অস্তিত্বই লাভ করেনি, বরং এই সংগঠন সম্মিলিতভাবে দ্বীনী মাদরাসাসমূহের বিরুদ্ধে যত ধরনের ষড়যন্ত্র হয়েছে এবং যত প্রকারের প্রোপাগান্ডা চালানো হয়েছে সবকিছু অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধ করে মাদরাসাসমূহের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রেখেছে এবং আমার এই প্রবন্ধ লেখা পর্যন্ত আলহামদু লিল্লাহ সফলভাবে নিজ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।

হযরত রাহ. যে সকল আকাবির থেকে তালীম ও তারবিয়াত (শিক্ষা ও দীক্ষা) হাসিল করেছিলেন এটা তাদেরই প্রভাব ছিল যে, দ্বীনী আকীদা-বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে তিনি কোনো প্রকার শৈথিল্য সহ্য করতে পারতেন না। ফলে তিনি যা সত্য ও হক মনে করতেন, তা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে কোনো দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিতেন না।

জীবনের শেষ প্রান্তে এসে হযরতের জন্য চলা-ফেরা করাটা তো অনেকটা অসম্ভব ব্যাপার ছিলই বরং কথা বলাটাও অত্যন্ত কষ্টকর ছিল। এতদসত্ত্বেও দ্বীনী অঙ্গনে ঘটিত ঘটনাবলীর প্রতি গভীর দৃষ্টি রাখতেন। এক্ষেত্রে যেখানে প্রয়োজন মনে করতেন নিজ মতামত মৌখিক বা লিখিতভাবে প্রকাশ করতেন। আলহামদু লিল্লাহ! এ সকল ব্যাপারে হযরত আমার মতো তাঁর অযোগ্য শিষ্যকেও অংশগ্রহণের সৌভাগ্যে ধন্য করতেন। জাতীয় ও ধর্মীয় বিষয়ে হযরত রাহ.-এর নির্দেশনা মৌখিক বা লিখিতরূপে আমার কাছে পৌঁছতে থাকত। অনেক সময় এ সকল ব্যাপারে হযরত রাহ. আমাদের সাথে পরামর্শও করতেন। আমি যদি কখনো ছাত্রসূলভ কোনো পরামর্শ দিতাম হযরত রাহ. সেটা গ্রহণ করে আমাকে ধন্য করতেন।

শেষ দিকে এসে হযরতের শারীরিক দুর্বলতা ও অসুস্থতার কারণে দেখা-সাক্ষাৎও কম হত। এ সময়ে হযরতের সাথে বেশীরভাগ সময় ফোন ও পত্রের মাধ্যমেই যোগাযোগ হত। কিন্তু ইন্তেকালের কিছুদিন পূর্বে বেফাকুল মাদারিস (-এর গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত এমন একজন বুযুর্গকে কেন্দ্র করে মারাত্মক এক অচলাবস্থা সৃষ্টি হল, যিনি তার যোগ্যতার সবটুকু উজাড় করে বেফাকুল মাদারিসের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছিলেন)-কে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অচলাবস্থা নিরসনের জন্য এক সপ্তাহের মধ্যেই অনেকবার হযরত রাহ-কে দেখার এবং সাক্ষাতের সৌভাগ্য লাভ হয়েছে। সৃষ্ট ঐ অচল অবস্থা নিরসনের জন্য হযরত রাহ. বেফাকুল মাদারিসের আকাবিরদের যে বৈঠক ডেকেছিলেন সে বৈঠকে এই অকর্মণ্যকে কেবল বিশেষভাবে দাওয়াত দিয়েই ক্ষান্ত হননি, বরং ঐ বৈঠকের সভাপতির দায়িত্ব হযরত মাওলানা ডক্টর আবদুর রাজ্জাক ইস্কান্দার ছাহেব দামাত বারাকাতুহুমের উপর দিয়ে, আমাকে নির্দেশ দিলেন আমি যেন সভাপতি সাহেবের নায়েব হিসেবে তাঁর সহযোগিতায় এই সভা পরিচালনা করি। আলহামদু লিল্লাহ! হযরত রাহ. এ বৈঠকের ফলাফলে আশ্বস্ত হয়েছেন, সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এ সময় আরেকবার হযরত রাহ.-এর হস্তচুম্বন করার সৌভাগ্য লাভ হয়েছে। সে সময় তো কোনভাবেই বুঝতে পারিনি যে, এটাই হযরতের সাথে অধমের শেষ সাক্ষাৎ হবে।

এর কয়েকদিন পর হযরতের অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ার সংবাদ পেয়ে তাঁর চিকিৎসক ও ছেলেদের সাথে বরাবর যোগাযোগ রাখছিলাম। কখনো কিছুটা সুস্থ হওয়ার, আবার কখনো অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ার সংবাদ পাচ্ছিলাম। এ সময় হযরত রাহ. কিছুটা সুস্থতা অনুভব করায় হাসপাতাল থেকে বাসায়ও এসেছেন। কিন্তু ১৬ই রবিউস সানী ১৪৩৮ হিজরী (১৫ জানুয়ারী ২০১৭ ঈসায়ী) রবিবার দিন রোগের প্রকোপ বেড়ে যায় এবং হৃদযন্ত্রের কষ্ট আরম্ভ হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই ১৭ রবিউস সানী হযরতের নির্ধারিত ক্ষণ এসে যায়। তিনি আসল মালিক আল্লাহ পাকের সান্নিধ্যে চলে যান।

إنا لله و إنا إليه راجعون، اللهم أكرم نزله ووسع مدخله، وأبدله دارا خيرا من داره، وأهلا خيرا من أهله، ونقه من الخطايا كما ينقى الثوب الأبيض من الدنس، وأسكنه بحبوة جنانك يا أرحم الراحمين. ولا تحرمنا أجره ولا تفتنا بعده.

ভাষান্তর : মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান খান মাসিক আলবালাগ

জুমাদাল উলা ১৪৩৮ হিজরী সংখ্যা

 

 

advertisement