জুমাদাল আখিরাহ ১৪৩৮   ||   মার্চ ২০১৭

দ্বীনী রচনাবলী পাঠ : শৈথিল্য ও সীমালংঘন

মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম

যে কোনও বিষয়ে জ্ঞানলাভের একটা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম সেই বিষয়ক রচনাবলি পাঠ করা। দ্বীনী জ্ঞানও এর ব্যতিক্রম নয়। এটা একটা সহজ ও টেকসই মাধ্যম। সহজ এই অর্থে যে একটু অক্ষরজ্ঞান থাকলেই এ মাধ্যমকে কাজে লাগানো যায়। বই পড়া যায় যে কোনও অবস্থায়। বাড়িতে-সফরে-শুয়ে-বসে ও চলতিপথে কোনও অবস্থায়ই বই পড়তে বাধা নেই। সংগে বই থাকলে যানবাহনে বসেও পড়া যায়। সময়ও কাটে ভালো, সংগে জ্ঞানপিপাসাও মেটে। অফিসে, দোকানে ও যে কোনও কর্মক্ষেত্রে অবসর সময় কাজে লাগানোর এটি এক চমৎকার ব্যবস্থা। এতে সময় না-কাটার ভারই লাঘব হয় না, সেই ভারলাঘবের ভেতর দিয়ে জ্ঞানার্জনের আনন্দও পাওয়া যায়। তাই বলি, বইপাঠ জ্ঞানার্জনের এক সহজ মাধ্যম।

এটা সহজ এ কারণে যে এর জন্য পৃথক আয়োজনের দরকার হয় না। বই পড়ার জন্য টাকা-পয়সা খরচ করে কোথাও যেতে হবে এমন নয়। আলাদা সময়েরও বন্দোবস্ত করতে হয় না। ব্যস যখন যেখানে যে হালে থাকা হয় তখনই বই পড়া যায়। এমনকি এর জন্য দু-চার মিনিট সময়কেও কাজে লাগানো যায়। কেউ যদি তার সব কাজকর্ম ঠিক রেখে কেবল অবসর সময় থেকে একটা অংশ পড়ার পেছনে ব্যয় করে, কম করে হলেও তার পক্ষে রোজ দশ পৃষ্ঠা পড়া সম্ভব। এত সহজে সম্ভব যে গায়েই লাগবে না। নিয়মিত পড়তে থাকলে মাসে অন্ততপক্ষে তিনশ পৃষ্ঠার একটা বই পড়া হয়ে যাবে। বছরে পড়া হবে বারোখানি বই। সুচিন্তিতভাবে বিজ্ঞজনের পরামর্শক্রমে পড়তে থাকলে পাঁচ বছরে যে বই পড়া হবে, তা একজন আমলোকের দ্বীনী জরুরত মেটানোর পক্ষে যথেষ্ট। আকায়েদ, ইবাদাত, আখলাক, আয়-ব্যায়, লেনদেন ও অর্থ-সম্পদ সংক্রান্ত মাসায়েল, পারিবারিক ও সমাজ-জীবন সম্পর্কিত নির্দেশনা, সীরাত, সাহাবা-চরিত  ও ইসলামী ইতিহাস এবং এরকম দ্বীনের আরও যত প্রয়োজনীয় বিষয় আছে, সব কিছু সম্পর্কেই মৌলিক জ্ঞান এই আসান ও অনায়াস পাঠের ভেতর দিয়ে হাসিল হয়ে যেতে পারে। যদি আগ্রহ একটু বেশি থাকে, তবে কেবল অবসর সময়ের পাঠ দ্বারাই পাঁচ বছরে ষাটটি নয়, শত-শত বই পড়ে ফেলা যায়। দরকার শুধু প্রয়োজনের বোধ ও একটুখানি আগ্রহ।

এই আগ্রহ পূরণের জন্য কি অনেক টাকা প্রয়োজন? মোটেই নয়। মাসে এক-দুটো বই পড়া মাত্র দু-তিন শ টাকার মামলা। আরও কমেও হয়ে যায়। এ ব্যাপারে অর্থব্যয় কোনও বিষয়ই নয়। পাঠক হতে পারলে বিনা অর্থব্যয়েও পাঠচাহিদা মিটতে পারে। সম্ভবত টাকার অভাবে বই পড়া হয় না, এই অভিযোগ কেউ কখনও করেও না। টাকা থাকা সত্ত্বেও বই কেনা হয় না কিংবা বই থাকা সত্ত্বেও পড়া হয় নাÑ অধিকাংশের ক্ষেত্রে এটাই হল বাস্তবতা। জানি না, অতি সহজ হওয়ার কারণেই মাধ্যমটি এত অবহেলিত কি না।

বলেছিলাম, সহজ হওয়ার পাশাপাশি এটি টেকসইও বেশি। অর্থাৎ পাঠমাধ্যমে যে জ্ঞান অর্জিত হয়, তা বেশিকাল স্থায়ী থাকে। লিখিত বিষয় বোঝার জন্য চিন্তাশক্তি প্রয়োগ ও বাড়তি মনোযোগ দেওয়ার দরকার হয়। বিষয়টা যেহেতু সামনেই আছে, তাই একবারে বুঝে না আসলে বারবার পড়ার সুযোগ থাকে। এরূপ মন-মস্তিষ্ক খাটিয়ে যা আয়ত্ত করা হয়, তা স্মৃতিপটে অঙ্কিত হয়ে যায়। তারপর ভুলে গেলেও পুনর্পাঠ দ্বারা তা তাজা হয়ে যায়। শোনা কথা এরকম মনেও থাকে না এবং ভুলে যাওয়ার পর তা পুনরায় শোনার সুযোগও সচরাচর ঘটে না, যদিও অন্যের কাছ থেকে শোনার আলাদা ফায়দা আছে। আসলে প্রতিটি মাধ্যমই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। একটি আরেকটির পুরোপুরি বিকল্প হতে পারে না। তাই জ্ঞানার্জনের জন্য উচিত সম্ভাব্য সবগুলো মাধ্যমই অবলম্বন করা।

তো কথা হচ্ছে, ‘পাঠসম্পর্কে। অর্থাৎ রচনাবলি পাঠের মাধ্যমে দ্বীনী জ্ঞান হাসিল করা। অত্যন্ত সহজ ও টেকসই হওয়া সত্ত্বেও এ মাধ্যমটি চরমভাবে অবহেলিত। দ্বীনী বই-পুস্তক খুব কম লোকেই পড়ে। যে কোনও বিষয়ে পাঠক সংখ্যা এমনিতেই কম। তার মধ্যে দ্বীন-বিষয়ক পাঠক আরও কম। কারও বাসায় গেলে হয় বুক সেলফনজরেই পড়বে না। আর যাও পড়বে, তা যতসব হাবিজাবি বইতে ঠাসা। এমনকি শিক্ষিতজনদের ঘরে তার বিশেষ শিক্ষা সংক্রান্ত বইও খুব কমই চোখে পড়ে। আরও ভয়াবহ কথা হল, শিক্ষকের ঘরে পর্যন্ত তার শিক্ষাদান সংক্রান্ত বইয়ের বড় আকাল। এই যখন সাধারণ শিক্ষাবিষয়ক বইপত্রের অবস্থা, তখন দ্বীনী রচনাবলীর কী বেহালদশা হবে তা সহজেই অনুমেয়। অধিকাংশ লোকের ঘরেই দ্বীনী কোনও বই চোখে পড়ে না। কারও কারও ঘরে দু-চারটা দেখা যায় বটে, কিন্তু তার চেহারা সাক্ষ্য দেয় খুব শীঘ্র তাতে কারও হাতের ছোঁয়া লাগেনি। হয়ত বা কেনা বা হাদিয়াই যা পেয়েছে, কখনও পৃষ্ঠা নাড়াচাড়া করে দেখেনি। অনেকেই যে তা দেখেনি, একথা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

দ্বীনী রচনাবলী পাঠে এহেন অবহেলা মানুষকে অজ্ঞতার চরম স্তরে পৌঁছে দিয়েছে। নামাযী মানুষও এমনকি নামায ও পাক-পবিত্রতার মাসায়েল সম্পর্কেও বড় কম জানে। কি করে জানবে, যখন সময়ের সিংহভাগ কাটে রোজগারসহ নানারকম পার্থিব দৌড়ঝাঁপে। তারপর যে সময় হাতে থাকে তাও নষ্ট হয় যত্তসব বেহুদা কাজে। কোনও বই-পুস্তকও পড়া হয় না, কারও কাছে জিজ্ঞেসও করা হয় না। জিজ্ঞেস করে করেও কতটা জানা যাবে, যখন জানার বিষয় বেশুমার! বিপুল জানার অতি সামান্য অংশই জিজ্ঞাসা দ্বারা মিটতে পারে। বেশিটা মেটানো সম্ভব পাঠাভ্যাস দ্বারাই। সেই অভ্যাস যারা গড়েনি, তাদের জরুরি বিষয়েরও সিংহভাগ অজানা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তাই অজ্ঞতা থেকে যায় পাক-নাপাকির মাসায়েলেও। আর অন্যান্য বিষয়ের তো কথাই নেই।

আজ যে মুসলিম জাতির ঘোর দুর্দিন তার একটা বড় কারণ কি দ্বীন সম্পর্কে তাদের ব্যাপক অজ্ঞতা নয়? শিরক-বিদআতের প্রচার হচ্ছে, বেদ্বীনী কাজকে দ্বীনের নামে চালানো হচ্ছে, কুসংস্কারকে দ্বীন-ধর্ম মনে করা হচ্ছে, অমূলক সন্দেহ সৃষ্টি দ্বারা মানুষের দ্বীন ও ঈমানের ভিত নাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, উগ্রবাদ ও তার বিপরীত ইলহাদ ও লাদ্বীনীয়াত ধার্মিকদেরও বিভ্রান্ত করার সুযোগ পাচ্ছে। নিঃসন্দেহে দ্বীনের সহীহ জ্ঞানের অভাব এর জন্য বহুলাংশে দায়ী। এর থেকে উম্মতের সুরক্ষার জন্য দ্বীনের সর্বাত্মক জ্ঞানচর্চার কোনও বিকল্প নেই। সেই চর্চার সুযোগ এখন যথেষ্ট। বাংলাভাষায় এখন প্রচুর লেখাজোখা হচ্ছে। মাসিক পত্রিকা বের হচ্ছে। কুরআন মাজীদের তরজমা-তাফসীর, বিভিন্ন আঙ্গিকে হাদীস বিষয়ক রচনাবলি, ফিকহী মাসায়েল ও আখলাক চরিত্র সংক্রান্ত বিভিন্ন বই-পুস্তক একটু চেষ্টা করলেই পাওয়া যাচ্ছে। প্রত্যেকেরই এসব পড়া উচিত।

দ্বীন সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার জন্য এবং দ্বীনী ইলম মানুষের হাতের নাগালে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমাদের উলামা ইসলামের সেই শুরু যুগ থেকেই চেষ্টা করে আসছেন। তারা কলম ধরেছেন সকল বিষয়েই। লোকে পড়বে বলেই তো তারা তা করেছেন। পড়া শুরুও হয়ে গেছে তখন থেকেই। পড়েছেন সাহাবা-তাবিঈন, পড়েছেন আইম্মা-মুজতাহিদীন, পড়েছেন ফুকাহা-মাশাইখ, পড়েছেন রাজা-বাদশা, পড়েছেন আমীর-উমারা, পড়েছেন আমজনতা। উম্মতের সর্বস্তরের মানুষ পড়াকে তার অবশ্যকর্তব্য গণ্য করেছে। কারণ পড়াহচ্ছে তার জন্মশব্দ। পড়া’-ই তার প্রতি প্রথম নির্দেশ। প্রথম ওহীর প্রথম শব্দই ছিল اِقْرَاْ  পড়। এর দ্বারা এ উম্মতের ভিত রচনা হয়েছে। হয়েছে তার অস্তিত্বের সূচনা। তাই না পড়ে সে পারে কি করে? সে পড়তে থেকেছে আর অগ্রসর হতে থেকেছে।

পড়ার তাড়না ও পড়ার চাঞ্চল্যই তাকে সচল করে রেখেছে। যতদিন সে তার পাঠাভ্যাস চালু রেখেছে ততদিন সে গতিশীল থেকেছে। সারা জাহান দাপিয়ে বেড়িয়েছে। সবার উপর প্রভাবশালী হয়ে থেকেছে। কিন্তু একটা সময় আসল, যখন পড়ার উপর বিলাসিতাকে প্রাধান্য দিল। সেই ফাঁকে অজ্ঞতা তার মধ্যে শেকড় ছাড়তে থাকল। আর সে অজ্ঞতার গর্ভাশয় থেকে জন্ম নিতে লাগল নানা ফিতনা-নানা ফিরকা। এভাবে সে কেবল জ্ঞানই হারাল না, হারাল তেজস্বিতাও। সেই নিস্তেজ জাতি পরিণত হল অন্যের গরাসে। কারণ পাঠ ও জ্ঞানচর্চার যে জিয়নকাঠি সে ছুঁড়ে ফেলেছে ইতোমধ্যে তার শত্রু তা লুফে নিয়েছে। পাঠাভ্যাস  তাদের মধ্যে জুগিয়েছে প্রাণশক্তি। ক্রমে তারা বলবান হতে থাকে। এক পর্যায়ে মুসলিম জাতিকে টপকে চলে যায় বহুদূরÑ জ্ঞানশক্তিতেও এবং বস্তুশক্তিতেও। তারা আধিপত্য বিস্তার করল সারা মুসলিম জাহানে। মুসলিম উম্মাহ আগেই তো তার ইলম ও জ্ঞানগত অবস্থান থেকে অনেক দূরে নেমে গিয়েছিল। সেই অবনতিতে আরও মাত্রাযোগ করল শত্রুর আগ্রাসন। অতপর জ্ঞান ও রাজ্যহারা মুসলিম উম্মাহ্র কী পরিণতি হয়েছে সে তো সকলের চোখের সামনে। নিঃসন্দেহে কুরআনী ইলমের চর্চা থেকে দূরে সরারই খেসারত এটা।

আমাদের উলামা উম্মাহর এ পতনের কারণ যথার্থই উপলব্ধি করতে পেরেছেন। সুতরাং তারা উম্মাহকে তার পূর্ব অবস্থানে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য শুরু করে দেন জোর প্রচেষ্টা। এ উপমহাদেশে আমাদের উলামায়ে দেওবন্দ সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে কলম ধরেন শক্ত হাতে। দ্বীনের সকল বিষয়ে তারা ছোট-বড়, সরল ও গভীর বই-পুস্তক রচনা করতে থাকেন। তাদের সে রচনা-সংকলনের তালিকা অনেক দীর্ঘ। বাংলাভাষায় তাদের রচিত শত-শত গ্রন্থ অনূদিত হয়েছে। আরও হচ্ছে। মৌলিক রচনার ধারাও চালু আছে। সর্বস্তরের মুসলিমকেই সেসব পড়তে হবে।

শিরক থেকে তাওহীদে, বিদআত থেকে সুন্নতে, কুসংস্কার থেকে বিশুদ্ধ দ্বীনে আমাদের সামগ্রিক উত্তরণ কেবল তখনই সম্ভব, যখন অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারব। সে লক্ষ্যে দ্বীনের বিশুদ্ধ রচনাবলী আমাদের পড়তেই হবে। বিশেষত হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রাহ., শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রাহ., মাওলানা হিফজুর রহমান রাহ., হযরত শামছুল হক ফরিদপুরী রাহ., হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ মনযুর নোমানী রাহ., হযরত মাওলানা মুফতী তাকী উছমানী দা. বা. এবং তাঁদের মত অন্যান্য শীর্ষ উলামার রচনাসমূহ সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে সকলকে পড়তে হবে। ঘরে-ঘরে যাতে তা পড়া হয়, নারী-পুরুষ সকলেই যাতে মনোযোগ দিয়ে তা পড়ে- কলম চালনার মেহনত সে লক্ষ্যেই তো তাঁরা করেছেন। এটা আমাদের দ্বীনেরই বৈশিষ্ট্য যে, সে তার জ্ঞানের দুয়ার কারও জন্য বন্ধ করে না। এটা পৌরহিত্যের ধর্ম নয়। আহবার ও রুহবানের দ্বীন নয়। এটা ইসলাম। এর পাঠাহ্বান সকলের জন্য। দ্বীনের অনুসরণ সকলেই করবে জেনে-বুঝে। প্রত্যেকেই বুঝবে তার সামর্থ্য অনুযায়ী। মুজতাহিদ তার সক্ষমতা অনুযায়ী এবং মুকাল্লিদ তার সীমানা অনুযায়ী। উলামা-মাশায়েখ পড়বেন তাদের বিস্তার হিসেবে আর আমজনগণ পড়বে তাদের সীমারেখা অনুপাতে। সমাজ থেকে অধর্মের অন্ধকার এ পথেই ঘুচতে পারে। উম্মত যদি মুক্তি পেতে চায়, তবে তার জন্ম ও সূচনার আহ্বানে তাকে সাড়া দিতেই হবে।

এর জন্য দরকার মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা। তাদের উৎসাহ যোগানো চাই মসজিদের মিম্বর থেকে, উলামার মজলিস থেকে এবং যে কোনও রকমের ধর্মানুষ্ঠান থেকে।

এটা কোনও কঠিন বিষয় নয়, যেমন প্রবন্ধের শুরুতে বলা হয়েছে। যারা রোজই দৈনিক পত্রিকা পড়ে, তারা দ্বীনী পত্র-পত্রিকা কেন পড়বে না? যাদের হাতে প্রচুর অবসর কিংবা কিছু না কিছু অবসর সময় আছে, বলা বাহুল্য তা আছে প্রত্যেকেরই, তারা অবশ্যই পড়বে, যদি পড়ার প্রয়োজন তাদের বোঝানো যায় এবং তারা বুঝতে সক্ষম হয়। এর জন্য মসজিদে-মসজিদে ও মহল্লায় মহল্লায় দ্বীনী পাঠাগার গড়ে তোলারও প্রয়োজন রয়েছে।

একবার এক ভাই তার দুঃখের কথা আমাকে বললেন। তার  বড় ইচ্ছা ছিল মসজিদে একটি পাঠাগার গড়ে তুলবেন। কিন্তু মসজিদের ইমাম সাহেব কিছুতেই রাজি হলেন না। অগত্যা তাকে রণে ভঙ্গ দিতে হল। আমি সে ইমাম সাহেবের অসম্মতির কারণ বুঝি।

পাঠকের সীমালংঘন

তাঁর অসম্মতির কারণ একশ্রেণীর পাঠকের বাড়াবাড়ি। এই শ্রেণীর পাঠকের হজমশক্তি বড় কম। অথচ নিজের ওপর বেজায় আস্থা। একটু পড়েই ওগড়াতে শুরু করে। দু-চারটি বই পড়েই মহাপ-িত বনে যায়। তাদের ফতোয়া দিতেও বাধে না। বুখারী শরীফের বাংলা অনুবাদ পড়েই অনুসৃত মাযহাব পাল্টে ফেলে। কেউ এমনও আছে যে, কোথাকার কোন্ বইতে রফয়ে ইয়াদাইন’-ই সুন্নত লেখা পেয়েছে কিংবা পেয়েছে আমীনজোরেই বলতে হয়। আর যায় কোথা। ইমাম সাহেবকে এসে পাকড়াও করে আপনি রফয়ে ইয়াদাইনকরেন না কেন? আমীন জোরে বলার সুন্নত ছাড়ছেন কেন?

এই শ্রেণীর পাঠক মূলত অসুস্থ। যা খায় তাতেই বদহজম হয়ে যায়। এই অসুস্থদের কারণে যাদের পাকযন্ত্র শক্তিশালী তাদেরকে তো খেতে বারণ করা যায় না। বরং তারা খেয়ে যত শক্তিশালী হবে, অসুস্থদের চিকিৎসার আওতায় আনা ততই সহজ হবে।

সব পাঠকেরই নিজ সীমারেখার ভেতর থাকা অবশ্যকর্তব্য। আগে নিজ সীমানা বুঝতে হবে। যে আলেম হতে চায়, তাকে যথারীতি আলেম হওয়ার পথ ও পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। নিজে নিজে পড়ে কখনও আলেম হওয়া যায় না। কোনও বিদ্যায় বিশেষজ্ঞ হওয়ার নিয়ম এটা নয়। বিশেষজ্ঞ হতে চাইলে সে বিদ্যায় বিশেষজ্ঞের হাতে নিজেকে সঁপে দিতে হয় এবং তার আনুষঙ্গিক যাবতীয় বিষয় রপ্ত করতে হয়। এটা কেবল দু-চারটি বই পড়ার দ্বারা হয় না। শ-দুশটি পড়েও কাজ হয় না। অনুবাদ পড়ে তো নয়ই। শিক্ষক ও উসতাযের তত্ত্বাবধানে নিয়মতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমেই তা সম্ভব। সেই সময় ও সুযোগ যার নেই, তার কর্তব্য সর্বাবস্থায় নিজেকে আমসাধারণেরই একজন গণ্য করা, তা সে যতই পড়ক না কেন। উসতাযের তত্ত্বাবধানে নিয়মতান্ত্রিক বা প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা যে করবে না, বিস্তর পাঠাভ্যাস দ্বারাও সে আমসাধারণের সীমারেখা অতিক্রম করতে পারে না, তা করা সম্ভব নয়। যে ব্যক্তি তা করতে চায়, সে বিপথগামী হয় এবং সে নিজের জন্য তো বটেই সমাজের জন্যও মসিবতের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর দৃষ্টান্তের অভাব নেই।

কাজেই প-িত হওয়ার চিন্তা বাদ। পড়তে হবে দ্বীন সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে। নিজের আমল সহীহ করার মানসে কিংবা বলুন সহীহ-শুদ্ধভাবে আমল করার মানসে। সবকথা যেহেতু জিজ্ঞেস করে জানা যায় না এবং সেভাবে জানার অবকাশও সকলের সর্বদা হয় না; তাই প্রাথমিক অজ্ঞতা দূর করার লক্ষ্যেই দ্বীনী রচনাবলী পড়তে হবে। দ্বীন সম্পর্কে মোটামুটি জানাশোনা থাকলে যেমন আমল শুদ্ধ হয়, অর্থাৎ শিরক-বিদআত-কুসংস্কার ইত্যাদি থেকে বাঁচা যায় ও ইবাদত-বন্দেগীর বিশুদ্ধতা রক্ষা সম্ভব হয়, তেমনি আমলে মনোযোগ আনয়ন এবং তৃপ্তি ও প্রশান্তির সাথে শরীআতের উপর চলা সহজ হয়। ব্যস পড়াশুনার উদ্দেশ্য এর মধ্যেই সীমিত রাখা জরুরি। এর বেশি মুফতী হয়ে যাওয়া বা শরীআতের ব্যাখ্যাতা হয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখা ঠিক নয়। কিংবা দু-একটি কথা শিখে তা নিয়ে সমাজে যুগের পর যুগ চলে আসা প্রমাণসিদ্ধ আমলের বিপরীতে অবস্থান নেওয়া আর এভাবে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ-পরিস্থিতির ভেতর কলহ-বিবাদের সূত্রপাত ঘটানোও কিছু ভালো কাজ নয়। সারকথা, পড়তেও হবে এবং নিজ সীমারেখাও বুঝতে হবে। এটাই মধ্যপন্থা ও মাত্রাজ্ঞানের দাবি।

এর জন্য করণীয় উলামায়ে কিরামের পরামর্শ মোতাবেক পড়া। যে কোনও বই পড়ার আগে নির্ভরযোগ্য কোনও আলেমের পরামর্শ গ্রহণ জরুরি। এ ব্যাপারে মূলকথা তিনটিÑ

এক. প্রথমত লেখক বিচার। লেখককে অবশ্যই আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকীদা-বিশ্বাসসম্পন্ন হতে হবে। তাও কেবল নামসর্বস্ব হলে চলবে না। কত লোক আছে গুরুতর বিদআতে লিপ্ত থাকা সত্ত্বেও নিজেকে সুন্নী বলে পরিচয় দেয়। প্রকৃতই যে ব্যক্তি সুন্নতের অনুসারী কেবল তার রচনাই বেছে নিতে হবে। তাও নিজে নিজে নয়; বরং কোনও হক্কানী আলেমের পরামর্শক্রমে।

দুই. বিশুদ্ধ আকীদাসম্পন্ন লেখকেরও সব লেখা সকলের উপযোগী হয় না। এ ব্যাপারে পাঠকের যোগ্যতা ও সামর্থ্যরে পর্যায়ক্রমও বিবেচ্য। যে রচনা কোনও পাঠকের ক্ষমতার ঊর্ধ্বে, সে রচনা ওই পাঠকের জন্য বিপদের কারণ হতে পারে। এর দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারেÑ কোনও আয়াত বা হাদীস কোনও একজন সাহাবীরও বিভ্রান্তির কারণ হয়নি এবং তাদের পদাঙ্ক-অনুসারী পরবর্তীকালীন উলামা-ফুকাহাও তা নিয়ে সমস্যা বোধ করেনি, অথচ পরবর্তীকালের অনেক অযোগ্য লোক বিভিন্ন আয়াত ও হাদীসের যথাযথ মর্ম বুঝতে ব্যর্থ হয়ে ভ্রান্ত পথের পথিক হয়ে গেছে। বোঝা গেল কথা সঠিক হওয়াই যথেষ্ট নয়। পাঠক বা শ্রোতার বুঝ-সমঝেরও একটা ব্যাপার আছে। সুতরাং পাঠকের যোগ্যতা অনুপাতেই বই-কিতাব নির্বাচন করতে হবে।

তিন. নির্বাচিত রচনাবলী পাঠের ক্ষেত্রে নিজেকে স্বাধীন ভাবা যাবে না। ভুল হতে পারে মুদ্রণে, বিচ্যুতি ঘটতে পারে বুঝ-সমঝে। অনেক সময় একটা সহজ কথাও বুঝের ভুলের কারণে ফ্যাসাদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমন অনেক ঘটনার মুখোমুখি আমি নিজেও হয়েছি। যাতে সঠিক কথার ভুল অর্থ বোঝার দরুণ অনর্থের সূত্রপাত হয়েছে। তা থেকে বাঁচার জন্যই এমনকি বেহেশতি যেওর’-এর মত সহজ কিতাব পাঠেও নিজেকে উলামায়ে কিরামের মুহতাজ গণ্য করা চাই। অর্থাৎ যখনই কোনও বিষয় বুঝতে অসুবিধা বোধ হবে কিংবা মনে খটকা জাগবে, তখনই তার সমাধানকল্পে কোনও আলেমের শরণাপন্ন হতে হবে।

এ নিয়মে পাঠাভ্যাস চালু রাখলে অনেক উন্নতির আশা থাকে। আলহামদু লিল্লাহ এরকমের অনেক পাঠক আছেও। এমন লোকও দেখা গেছে, যিনি উলামায়ে কিরামের তত্ত্বাবধানে থেকে পড়া অব্যাহত রেখেছেন এবং এক পর্যায়ে দ্বীনের বুঝ-সমঝ ও জানা শোনার ঈর্ষণীয় স্তরে পৌঁছে গেছেন। তা সত্ত্বেও তারা নিজেদের আলেম গণ্য করেন না। এটা দৃষ্টান্ত। যে-কেউ উপরিউক্ত নিয়ম মেনে পড়াশুনা জারি রাখলে, ওই স্তরে না হোক, অন্ততপক্ষে দ্বীন সম্পর্কে মৌলিক ধারণা তার অবশ্যই হাসিল হবে এবং নিত্যদিনের দ্বীনী মাসায়েল সম্পর্কেও সাধারণ জ্ঞান তার অর্জিত হয়ে যাবে। ফলে সে যে কেবল বিশুদ্ধ আমল করতে সক্ষম হবে তাই নয়, আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় সব ধরনের বিভ্রান্তি থেকেও নিজেকে হেফাজত করতে পারবে। কাজে যে যত ব্যস্তই থাকুক না কেন, দ্বীনী রচনাবলী পাঠের জন্য একটা সময় অবশ্যই বরাদ্দ রাখা উচিত। আল্লাহ তাআলা সকলকে সবরকম প্রান্তিকতা থেকে মুক্ত রেখে দ্বীন শেখায় যতœবান থাকার তাওফীক দান করুনÑ আমীন। 

 

 

 

advertisement