জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০০৮ : একটি সমীক্ষা
গত ৮ মার্চ ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি’ নামে একটি নীতিমালা গোষণা করেছে সরকার। এটি প্রস্ত্তত করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। আর ঘোষণা করেছেন স্বয়ং সরকার প্রধান মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা।
নীতিমালাটি ঘোষিত হওয়ার কয়েক দিন আগ থেকেই এর বিভিন্ন ধারা-উপধারার তথ্য মিডিয়ায় চলে আসে এবং এ নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। বিভিন্ন সচেতন মহল থেকে এমন নীতি প্রণয়ন না করার জন্য সরকারকে পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু যখন এটি ঘোষিত হয় তখন দেখা যায়, যেসব বিষয়ে অভিজ্ঞ মহল আশংকা প্রকাশ করেছিলেন সেগুলো তাতে বহাল তবিয়তেই রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পুরো দেশ। মুসলিম নারী ও পুরুষ সমাজ তীব্র নিন্দা জানায় এর বিরুদ্ধে এবং অবিলম্বে তা প্রত্যাহার বা সংশোধনের দাবি জানাতে থাকে। এক শ্রেণীর এনজিও এবং তাদের দোসর কয়েকটি পত্র-পত্রিকা আর মন-মগজে ভিনদেশী বলে পরিচিত একটি মহল ছাড়া সকল পক্ষই এ ব্যাপারে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। উলামা-মাশায়েখ থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষিত সমাজ, সংবাদপত্র এবং সর্বস্তরের নারী ও পুরুষ মুসল্লীদের পক্ষ থেকে এ নীতির প্রতিবাদ জ্ঞাপন অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত নীতিমালাটি প্রত্যাহার বা সংশোধন করার কোন খবর পাওয়া যায়নি।
নীতিমালায় সংখ্যার ভুল :
জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ’০৮ -এর দ্বিতীয় অধ্যায়ের ক্রমিক নম্বর বর্ণনায় সম্ভবত মারাত্মক ভুল করে ফেলেছেন এর প্রণেতাগণ। কারণ এ অধ্যায়ে উপধারাগুলোর সংখ্যা বসানো হয়েছে ১.১ থেকে ১.১৯ পর্যন্ত। অথচ হওয়া উচিত ছিল ২.১ থেকে ২.১৯ পর্যন্ত। দেশের সর্বোচ্চ ফোরামে (উপদেষ্টা পরিষদ) পাশ হওয়া এবং একটি মন্ত্রণালয় কর্তৃক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রকাশ করা একটি নীতিমালায় কীভাবে এমন ভুল থেকে যেতে পারল তা সত্যি আশ্চর্যের ব্যাপার।
কি আছে এ নীতিতে :
আমরা আলোচিত নীতিমালাটির কপি সংগ্রহ করে এর প্রত্যেকটি ধারা-উপধারা পড়েছি। এটি ব্যাপকভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, বিষয়ের বিবেচনায় ‘নারী উন্নয়ন নীতি ২০০৮’ কে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। যেমন :
১. ইসলাম সমর্থিত যৌক্তিক ধারা-উপধারাসমূহ।
২. ইসলাম বিরোধী ধারা-উপধারাসমূহ।
৩. এমন বিষয়াবলি যেগুলো নারী পুরুষ সকলের প্রাপ্য অধিকার।
৪. অযৌক্তিক ধারাসমূহ।
যৌক্তিক অংশ :
নীতিমালার ১.২ (হওয়া দরকার ২.২) এ বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের সকল ক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
এটি যৌক্তিক নীতি। আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশত বছর পূর্বে ইসলাম নারীর নিরাপত্তা বিধান নিশ্চিত করেছে। পবিত্র কুরআন ও হাদীস অধ্যয়নকারী সকলেই এ সম্পর্কে অবগত রয়েছেন।
* ধারা ১.৪ (হওয়া দরকার ছিল ২.৪) ‘নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা’ সাধারণ অর্থে (তথাকথিত পশ্চিমা মানবাধিকার নয়) উপযুক্ত পরামর্শ। আর নারীদেরকে পরিপূর্ণ মানুষের মর্যাদা প্রদান করেছে একমাত্র ইসলাম। এর আগে তো অনেকে তাদেরকে মানুষই বিবেচনা করত না।
* ধারা ১.৮ (আসলে ২.৮) ‘সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিমন্ডলে নারীর অবদানের যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান করা।’ অবশ্যই স্বীকৃতি প্রদান দরকার। যদি শুধু গৃহস্থালী কাজকর্ম ও শিশু পরিচর্যারও যথাযথ হিসেব করা হয় তবুও দেখা যাবে নারীগণ তাদের সংসারে অনেক বড় অবদান রাখছেন। অবশ্য নারীর এসব অবদানের যথাযথ স্বীকৃতি একমাত্র ইসলামই দিয়েছে।
* ধারা ১.৯ (মূলত ২.৯)‘নারী ও মেয়ে শিশুর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূর করা।’ অবশ্যই দূর করতে হবে যদি তা বাস্তবেই বৈষম্য হয়। যেমন মেয়ে শিশুকে অবহেলা করা, তাকে বোঝা বা অকল্যাণকর ভাবা এগুলো কোনো অবস্থাতেই ঠিক নয়।
* ধারা ১.১৩ ‘নারীর জন্য উপযুক্ত আশ্রয় ও গৃহায়ন ব্যবস্থায় নারীর অগ্রাধিকার নিশ্চিত করা।’
আসলে এখানে অগ্রাধিকারের প্রশ্ন আসে না। কারণ নারীর আশ্রয়স্থলের ব্যবস্থা মুসলিম সমাজে ইসলামী বিধান দ্বারা নিশ্চিত করা আছে। শরীয়ত নারীকে বলেনি স্বামীর থাকার ব্যবস্থা করতে বরং স্বামীর উপর নারীর আশ্রয়স্থলের দায়িত্ব অর্পণ করেছে। তাহলে এখানে পূর্ণ অধিকারই তো তার।
* ধারা ৫.১ ‘পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে সকল নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ, পতিতাবৃত্তি, যৌতুক ও সহিংসতা দূরা করা।’
কোন কোন পরিবারে মেয়েদের উপর নির্যাতন হয় এটি বাস্তব এবং তা বন্ধ করার ব্যবস্থা অবশ্যই নেয়া দরকার। আর যৌন নিপীড়ন, ধর্ষন ও পতিতাবৃত্তি তো সমূলেই বন্ধ করা দরকার। ইসলামে বিবাহ বহির্ভূত সকল যৌনতাই হারাম এবং কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জোরপূর্বক কাউকে ব্যভিচারে বাধ্য করা বা স্বেচ্ছায় পরস্পরে এ অপকর্মে লিপ্ত হওয়া উভয় ক্ষেত্রেই রয়েছে নির্ধারিত শাস্তি, যা ক্ষেত্রবিশেষে মৃত্যুদন্ডও হতে পারে। কিন্তু পতিতাবৃত্তিকে শিল্প হিসাবে আখ্যা দানকারী এবং পতিতাদেরকে সেক্স ওয়ার্কার বা যৌনকর্মী খেতাব দেয়া নারীবাদীগণ যারা অনেকেই বিবাহ বহির্ভূত যৌনতা তথা পশ্চিমাদের অনুকরণে ফ্রি সেক্সের দাবিদার তারা এ ধারাটি পড়ে খুশি হতে পারবেন তো?
* ধারা ৫. ৩ ও ৫.৪ ‘নির্যাতিতা নারীকে আইন গত সহায়তা করা, নারী পাচার বন্ধ ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা।’
অবশ্য পালনীয় ও শরীয়তসম্মত সুপারিশ।
* ধারা ৬. ১ ‘সশস্ত্র সংঘর্ষ ও জাতিগত যুদ্ধে নারীর অধিকতর নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিরুদ্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা।’
খুবই দুর্বল উপস্থাপন। এটা কি এ জন্য যে, ফিলিস্তিন, ইরাক, আফগানিস্তান, কাশ্মির, পাকিস্তানের উপজাতীয় এলাকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় যে সকল মুসলিম নারী হামলা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তারা প্রায় সকলেই মুসলিম। ইসলামে তো শত্রুপক্ষের নারীকেও আক্রমণ করতে নিষেধ করা হয়েছে জিহাদের ক্ষেত্রে।
* ধারা ১২.১০: মায়ের দুধ শিশুর অধিকার.........’
ভাল প্রস্তাব। পবিত্র কুরআনে সন্তানের জন্য মাতৃদুগ্ধ পানের বিষয়টিকে সবিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বহু আগেই, যা চিকিৎসা বিজ্ঞান বুঝতে পেরেছে বহু পরে। ঁ
* ধারা ১৬. ‘প্রতিবন্ধী নারীসহ বিশেষভাবে দুর্দশাগ্রস্ত নারীর প্রয়োজনীতা উপলব্ধি করে তাদেরকে বিশেষ সুবিধা প্রদান’
ভাল প্রস্তাব, যা অবিলম্বে কার্যকর করা উচিত।
উপরোক্ত ধারাগুলো ছাড়াও নারী উন্নয়ন নীতিমালায় আরো কিছু ধারা রয়েছে যেগুলোর কোন কোনটি মৌলিকভাবে এবং অনেকগুলো আংশিকভাবে ইতিবাচক। এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে সেগুলো নিয়ে আর দীর্ঘ আলোচনা করা গেল না।
অযৌক্তিক ধারাসমূহ :
জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০০৮ এ বহু ধারা এমন রয়েছে যেগুলো অনেকটাই অযৌক্তিক ও বাস্তবতা বিবর্জিত। এবার এমন কয়েকটি ধারা পেশ করা হচ্ছে।
* ধারা ১.৩: (শুদ্ধ হল ২.৩) ‘নারীর রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা।’
* ধারা ১০.৫: ‘জাতীয় সংসদে ১/৩ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ ও সংরক্ষিত আসনে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা’ এবং ১০ম অধ্যায়ের অন্যান্য উপধারাসমূহ।
* ধারা ১১.১: প্রশাসনিক কাঠামোর উচ্চ পর্যায়ে নারীর জন্য সরকারী চাকুরীতে প্রবেশ সহজ করার লক্ষ্যে চুক্তিভিত্তিক এবং পার্শ্ব প্রবেশের ব্যবস্থা করা।
* ধারা ১১.৪: নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষে প্রবেশ পর্যায়সহ সকল পর্যায়ে, গেজেটেড ও নন গেজেটেড পদে কোটা বৃদ্ধি করা।
* ধারা ১১.৫: সকল ক্ষেত্রে নারীর জন্য নির্ধারিত কোটা পূরণ নিশ্চিত করাসহ কোটা পদ্ধতি চালু করা।
* ধারা ১১.৬: কোটার একই পদ্ধতি স্বায়ত্বশাসিত ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে যথাযথ অনুসরণ করা এবং বেসরকারী ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানসমূহকেও এই নীতি অনুসরণে উৎসাহিত করা।
উপরোক্ত ধারাগুলো ছাড়াও সরকার ও স্থানীয় সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে এবং প্রশাসন, দূতাবাস, ইউজিসিসহ বিভিন্ন স্তরে কোটাভিত্তিক চাকুরীর নিশ্চয়তা প্রদানের কথা আলোচিত নীতিমালার আরো অনেক ধারা-উপধারায় রয়েছে।
মহিলাদেরকে জোরপূর্বক সংসদে ও স্থানীয় সরকারে নিয়ে আসার এ প্রয়াস পুরনো। সরকারী চাকুরীতে তাদের জন্য আগে থেকেই কোটা পদ্ধতি চালু আছে। অর্থাৎ অধিক যোগ্য পুরুষ প্রার্থী থাকলেও নির্ধারিত কোটায় কম যোগ্যতা সম্পন্ন মহিলাদেরকে তাদের বিপরীতে নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। অথচ সাধারণ নারী সমাজের উন্নয়নে যে এসব নীতি কোন ভূমিকা পালন করতে পারেনি তা তো ঐতিহাসিকভাবেই সত্য। সংসদে কোটাভিত্তিক মহিলা সদস্য নেওয়া হচ্ছে দুই দশকেরও বেশি সময় আগে থেকে। প্রথমে ছিল ৩০ জন করে পরে করা হয়েছে ৪৫ জন। কিন্তু এখন স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে যে, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের করুণার বদৌলতে নিয়োগ পাওয়া এসব মেম্বারগণ কোন ভূমিকাই রাখতে পারছেন না। তাহলে এত বছর পর্যন্ত রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা তাদের পিছনে ব্যয় করা হল কেন? এখন বলা হচ্ছে (সুপারিশকৃত নীতিমালায়) ৩৩% আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে এবং তারা প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন। সংসদের ৩০০ আসনে মহিলা ও পুরুষ সকলেই নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবে কিন্তু ১০০টি আসন শুধু মহিলাদের জন্য থাকবে এবং আগের মত সংসদ সদস্যদের ভোটে নয় বরং তারা নিজেরা (শুধু মহিলারা) সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সংসদ সদস্য হবেন। কিন্তু এতে কি কোন সুফল আসবে? কারণ তাদের কথা মত বর্তমান মনোনয়ন ব্যবস্থার মাধ্যমে সংসদ সদস্য হওয়া মহিলাগণ সংসদে তেমন কিছু করার সুযোগ পান না। কারণ তাঁরা পুরুষের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হয়ে আসেননি। তাহলে সুপারিশকৃত প্রত্যক্ষ নির্বাচনেও একই কথা থাকছে। এখানেও তো সাধারণ আসনে পুরুষের সাথে প্রতিযোগিতার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তারা সংরক্ষিত আসনে নিজেদের (নারীদের) মাঝে প্রতিযোগিতা করে সংসদে গেলে তাদের মান ও দাম কি সাধারণ আসনে পাশ করাদের সমান হয়ে যাবে?
তখনও তো তারা বলতে পারবে তোমরা তো আমাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামনি। বরং নিজেরা নিজেদের মধ্যে লড়ে জিতে এসেছ।
আসলে নারীবাদীরা ইতিহাস এবং বাস্তবতাকে চেপে যেতে চায়। জাতিসংঘের নারী দশক ঘোষিত হয়েছে ১৯৭৫ সালে। এর পর তিন দশকেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। আর এরও অনেক আগে থেকে এক শ্রেণীর এনজিও এবং নারীবাদী খেতাবধারী লোকেরা তোড়জোড় করে আসছে নারীর তথাকথিত ক্ষমতায়নের জন্য। অথচ দেখা যাচ্ছে, ১৯৯১ সনে প্রত্যক্ষভাবে ভোটে ৫জন মাত্র নারী জয়ী হয়েছিলেন। আর ২০০১-এ এর সংখ্যা হয়েছে ৭। বংশ ও পারিবারিক ঐতিহ্য বাদ দেওয়া হলে এ সংখ্যাও কি শূন্যে গিয়ে দাঁড়াতো কিনা তা প্রত্যক্ষ ভোটে জয়ী হওয়া ব্যক্তিত্বদের নামের দিকে একটু দৃষ্টিটাকে ঘুরিয়ে আনলেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
দেশে ১৬ বছর পর্যন্ত সরকার প্রধান ছিলেন ২ জন নারী। তারা সর্ববৃহৎ দু’টি দলেরও প্রধান। তাদের মন্ত্রী সভাগুলোতে কতজন নারী ছিলেন? বর্তমানে যে সরকার ‘নারী উন্নয়ন নীতি ’০৮-এর অনুমোদন দিলেন সেখানে কি মহিলা বিষয়ক উপদেষ্টা ছাড়া আর কোনো নারী উপদেষ্টা আছেন (এ উপদেষ্টা পরিষদের অন্তর্ভুক্তির জন্য তো সংসদ সদস্য হওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই।) বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে দলীয় প্রধান ছাড়া আর কোনো নারী আছে? জাতীয় নির্বাহীকমিটির ৭৯ জনের মধ্যে নারী সদস্য সংখ্যা ৬, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামে দলীয় প্রধানসহ নারীর সংখ্যা ৪। আর সচিব কমিটির ৩১ জনের মধ্যে নারী আছেন ৩ জন। জাতীয় পার্টির ৪১ সদস্যের প্রেসিডিয়ামে নারী হলেন ২ জন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দী্রয় কমিটিতে ৩৫ জনের মধ্যে নারীর সংখ্যা ৪। জাসদ (ইনু) র ১০১ জনের কমিটিতে নারী আছেন ৩ জন। ওয়ার্কার্স পার্টির ৪১ সদস্যের কমিটিতে নারী রয়েছেন ২ জন। আর তাদের পলিটব্যুরোতে কোনো নারী সদস্য নেই।
এই যখন জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থা তখন বর্তমান নির্বাচন কমিশন শর্ত দিয়েছেন ৩৩% নারী তাদের কমিটিতে নিতে হবে। কিন্তু বড় কোনো দলই এ শর্ত পূরণ করতে তাৎক্ষণিকভাবে সম্মত হয়নি। তারা ইসিকে বাস্তবতা উপলব্ধির পরামর্শ দিয়েছে। যার প্রেক্ষিতে এখন ইসি বলছে দলগুলোকে এ শর্ত পূরণ করতে হবে পর্যায়ক্রমে ২০২০ সনের মধ্যে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, এ সময় আরো বৃদ্ধি করা হোক। এসবই হচ্ছে কঠোর বাস্তবতা। এবার নজর দেওয়া যাক আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে। জাতিসংঘ প্রধানের আসনে এ পর্যন্ত কি কোনো নারী আসীন হয়েছেন? গণতন্ত্রের প্রবক্তা আমেরিকায় এ পর্যন্ত কি কোনো নারী প্রেসিডেন্ট হয়েছেন? সেখানে প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটে নারীর সংখ্যা কত ভাগ? কতজন গভর্নর আছেন নারী? এসব কিছুর উত্তর নারীবাদীদের প্রতিকূলে। আসলে তারা কঠিন বাস্তবতাকে এড়িয়ে চলতে চায়। আর নারী ক্ষমতায়নের ধুয়া তুলে নিজেরাই লুফে নিতে চায় সাধারণ জনগণের অর্থে পরিচালিত রাষ্ট্রের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা। তারা জনগণকে বুঝতে দিতে চায় না যে, এভাবে জবরদস্তি ক্ষমতায়নের ব্যবস্থা দ্বারা শুধুমাত্র এলিট শ্রেণীর নারীরাই উপকৃত হবে। তেল লাগবে শুধু তেলার মাথাতেই। সাধারণ নারীসমাজের এর দ্বারা কোনোই লাভ হবে না। কারণ সংরক্ষণ ও কোটার বদৌলতে কিছু লোক চেয়ার পেয়ে গেলেও এতে আপামর নারীসমাজের ক্ষমতায়ন তো দূরের কথা এতে তাদের সামান্য উপকারও হবে না বা হচ্ছে না, বরং তাদের নাম ভাঙ্গিয়ে সুবিধা ভোগ করবে মুষ্টিমেয় এলিট শ্রেণী।
* ধারা ৭. ১: ‘শিক্ষা সুযোগের বৈষম্য দূরা করা’
বৈষম্য তো উল্টো দিকে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত তো এখনো নারীদের বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ রয়েছে, যা পুরুষদের নেই।
* ধারা ৭.২: ‘নারী সমাজের শিক্ষায় সর্বাধিক গুরুত্ব দান’
তাহলে কি পুরুষ সমাজের শিক্ষায় এরচেয়ে একটু কম গুরুত্ব দিতে হবে?
* ধারা ৯.১৪: ‘চাকুরীতে কোটা বৃদ্ধি’: প্রকৃত মেধাবীদেরকে (ছেলে হওয়ার কারণে) বাদ দিয়ে কোটাভিত্তিক নিয়োগ দিতে দিতে পরে রাষ্ট্রযন্ত্রই না আবার কোটার বেড়াজালে আটক হয়ে যায়।
‘নারী উন্নয়ন নীতি’তে অযৌক্তিক ও বাস্তবতা বহির্ভূত ধারার কমতি নেই। সচেতন কোনো ব্যক্তি নিরপেক্ষভাবে তা পড়লেই সেগুলো দেখতে পাবেন। এখানে শুধু নমুনা স্বরূপ কয়েকটি দেয়া হল।
জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ও ইসলাম
যদিও সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাঁর সৃষ্ট মানবজাতিকে নারী-পুরুষ দু’ভাগে বিভক্ত করে তাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব ও অধিকার ঠিক করে দিয়েছেন এবং ইসলামী বিধানেই একমাত্র নারী-পুরুষ উভয়ের মুক্তি ও উন্নয়নের নিশ্চয়তা রয়েছে। তথাপি নারীবাদীরা সব সময়েই ধর্মকে তাদের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করিয়ে আসছে। নারীকে ধর্মীয় গন্ডির বাইরে আনতে পারলেই তারা খুশি হয়। এরই ধারাবাহিকতায় রচিত হয়েছে জাতিসংঘের ‘সিডও’ সনদ। তথাকথিত মুক্তি ও উন্নয়নের নামে মাতৃজাতিকে আল্লাহ-রাসূলের বিধান থেকে সরিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করাই যে এর উদ্দেশ্য, তা তো আর খোলাসা করে বলার প্রয়োজন নেই।
৮ মার্চ ’০৮ এ ঘোষিত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিতেও ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মদ্রোহীতার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। যেমন : দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১ম ধারাতে বলা হয়েছে ‘জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা করা’ অথচ আল্লাহ তাআলা অনেক ক্ষেত্রে নারীদেরকে পুরুষের অতিরিক্ত অধিকার দিয়েছেন। যেমন, কন্যা সন্তানের খোরপোষ পিতা বা অভিভাবককে বহন করতে হয় তার বিয়ে হওয়া পর্যন্ত অথচ ছেলের বেলায় তা হল বালেগ হওয়া পর্যন্ত। বিবাহের সময় স্ত্রীকে মোহর ও সাজানী দেওয়া স্বামীর দায়িত্বে, এক্ষেত্রে স্ত্রীর কোনো দায়িত্ব নেই। বিবাহের পর স্ত্রী ও সন্তানদের খোরপোষ বহন করতে হয় স্বামীকে, কিন্তু স্ত্রীকে এমন কোনো দায়িত্ব নিতে হয় না। আবার অনেক বিষয় রয়েছে যেখানে দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে পুরুষকে। নারীবাদীদের কৃত্রিম ক্ষমতায়নের চেষ্টা সত্ত্বেও বাস্তব জীবনে এখনো বিশ্বব্যাপী এর প্রতিফলন দেখা যায়। এ বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত একটু আগেই করা হয়েছে। সুতরাং সমতা, সমান অধিকার ও সাম্যের শব্দগুলো একেবারেই অবান্তর। তার স্থলে হওয়া দরকার ন্যায্য, ইনসাফভিত্তিক ইত্যাদি শব্দ।
* ধারা ৯.৫ ‘সম্পদ, কর্মসংস্থান ও ব্যবসায় নারীকে সমান সুযোগ ও অংশিদারিত্ব দেয়া’।
এ ধারায় ‘সম্পদ’ দ্বারা উদ্দেশ্য যদি হয় উত্তরাধিকার সম্পদ তবে কুরআনের বিধানকে বিলুপ্ত করা হচ্ছে। নারীর খরচাদির সকল দায়িত্ব অন্যের উপর দিয়েও ইসলাম যেখানে উত্তরাধিকার সম্পদের ক্ষেত্রে নারীকে পুরো অর্ধেক সম্পত্তির হকদার করেছে সেখানে তারা নতুন করে আবার কী বলতে চাচ্ছেন? আর যদি বলা হয় সম্পদের দ্বারা উত্তরাধিকার উদ্দেশ্য নয় যা তারা মুসলমানদের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের পর দাবি করছেন তবে এটা কার সম্পদ? নারীর নিজের? তা হলে অংশিদারিত্বের প্রশ্ন আসবে কেন? আর যদি বলা হয়, না এটা তার স্বামীর সম্পদ, তাহলে কি জীবিত থাকতেই নারী স্বীয় স্বামীর সম্পদের অর্ধেকের অংশিদার হয়ে যাবে? যদি এমনটিই তাদের উদ্দেশ্য হয় তবে নীতিমালার একটি স্থানে নারীর জন্য আশ্রম তৈরির সুপারিশের কথা যুক্তিসঙ্গত। কারণ পশ্চিমা কোনো কোনো রাষ্ট্রের মত অনেক অবোধ নারী স্বামীর কামাই করা সম্পদের অর্ধেক হাতিয়ে নিয়ে যখন সমাজচ্যুত হবে তাকে তো তখন বৃদ্ধাশ্রমেই আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে। লক্ষণীয় বিষয় হল, নারীনীতি ঘোষিত হওয়ার আগে ও পরে জাতীয় পত্রিকাগুলোতে যখন নিয়মিত লেখা হচ্ছিল যে, উত্তরাধিকার সম্পদে সমানভাগের বিষয়টি এবারের নীতিমালায় রয়েছে তখন কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহল ছিল সম্পূর্ণ নিরব। তারা একবার ও এর প্রতিবাদ করেনি। কিন্তু যখন দেশব্যাপী ঈমানদার লোকগণ বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠল তখন তারা অস্বীকারের রাস্তা বেছে নিলেন। অথচ আজ পর্যন্ত এ ধারার জবাবে কোন যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা তারা উপস্থাপন করতে পারল না। আসলে শাক দিয়ে তো আর সব সময় মাছ ঢাকা যায় না। ‘নারী নীতিমালা’র বিভিন্ন অংশে এমন আরো অনেক ধারা-উপধারা রয়েছে যেগুলো শব্দ ও বাক্যের ব্যাপকতা এমনভাবে রাখা হয়েছে যেগুলোকে কুরআন বিরোধী আইন বানানোর ছুতো হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
দেশের ইসলামপন্থীরা যখন তাদের ঈমানী দায়িত্ব পালনার্থে এ নীতির সংশোধনীর দাবী উঠালেন, তখন গাত্রদাহ শুরু হয়ে গেল সেই চিহ্নিত তথাকথিত স্বঘোষিত প্রগতিশীল মহলটির এবং সরকারের ভিতর ঘাপটি মেরে থাকা এক শ্রেণীর ইসলাম বিরোধী এনজিওদের দোসর লোকের। তারা আলেম-উলামাদেরকে প্রকাশ্যে গালমন্দ করা শুরু করল। সরকারের মহিলা উপদেষ্টা তো ক্ষেপেই গেলেন! তিনি বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে (যাদের বড় বড় প্রায় সব নেতাকে তারাই জেলে আটক রেখেছেন) আহবান জানালেন আলেম সমাজের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার! বলেছেন ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া মৌলবাদীদের দমানো যাবে না। জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় চাকুরী করা একজন ব্যক্তি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ লোকদেরকে দমিয়ে দেয়ার প্লান পেশ করার সাহস কোথা থেকে পান তা কি চিন্তা করার বিষয় নয়? আসলে মনোনয়নের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা অনির্বাচিত সরকারের কিছু কিছু অসুবিধার মধ্যে এটিও একটি যে, এর সুযোগ নিয়ে কখনো কখনো এমন ব্যক্তিরাও ক্ষমতার মসনদে বসে নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার সুযোগ পেয়ে যায়।
একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক এ বিষয়ে কলাম লিখে ফেলেছেন একটি চিহ্নিত দৈনিকে। শিরোনাম হচ্ছে ‘নারী উন্নয়ন নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কেন’। তাঁর কথা হচ্ছে ‘জরুরি আইনের মধ্যে ইসলামপন্থীদের বিক্ষোভ করতে দেওয়া হল কেন? এর আগে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিরোধী কার্টুন প্রকাশের বিরুদ্ধে জরুরি অবস্থার মধ্যে বিক্ষোভের সুযোগ দেওয়ারও তিনি কঠোর সমালোচনা করেছেন এ লেখায়। এ সকল বুদ্ধিজীবীদের স্ব-বিরোধী অবস্থা দেখলে সত্যিই করুণা হয়। যারা নিজেদের মতলবের সবক্ষেত্রে গণতন্ত্রের দোহাই দেয়, মুক্ত চিন্তার কথা বলে, প্রগতির ধুয়া তুলে জরুরি আইনসহ অনেক নিয়মনীতিকে মানবাধিকার-পরিপন্থী আখ্যা দেন তারাই আবার আল্লাহর বিধান লংঘনের বিরুদ্ধে, আল্লাহর রাসূলের অবমাননার বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদেরকে জরুরি আইন লংঘনের দায়ে শাস্তি না দেওয়ায় রেগে উঠেন। মনে পড়ে গেল আরেক মহিয়ষীর (!) কথা। একটি নামকরা মানবাধিকার সংস্থার বাঙ্গালী বংশদ্ভূত এ কর্ণধার ক’মাস আগে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। এর কিছুদিন আগে একটি পত্রিকায় রাসূলের মর্যাদা পরিপন্থী কার্টুন প্রকাশের বিরুদ্ধে দেশ ছিল উত্তাল। ঐ নেত্রী এসে বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে একটি কথাই বার বার উচ্চারণ করলেন, তা হল, কেন জরুরি আইনের মধ্যে ঐ কার্টুনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করতে দেয়া হয়েছে। কেন মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। কেন কার্টুনিষ্টকে আটক করা হয়েছে। হায়রে মানবাধিকার! তোমার মহাসচিবই যখন আল্লাহর বিধানের মোকাবেলায় মৌলিক অধিকার পরিপন্থী (তাদের ভাষায়) জরুরি আইনকে দাঁড় করায়, রাসূলের ইজ্জতের মোকাবেলায় তাদের পত্রিকা ও কার্টুনিষ্টের পক্ষ নেয় তখন তোমার (মানবাধিকার) অর্থ ও মতলব যে কি তা কি আর পর্দায় ঢাকা থাকে?
হাঁ, প্রিয় পাঠক সে প্রখ্যাত(!) কার্টুনিষ্ট বেকসুর ছাড়া পেয়ে গেছে। কবে জানেন, বারই রবিউল আউয়ালের প্রাক্কালে। ছাড়া পাওয়ার কারণ? তার বিরুদ্ধে মামলার বাদী তেজগাঁও থানার উপস্থিত হননি। সুতরাং আদালত তাকে বন্দী রাখা আর যুক্তিযুক্ত মনে করেননি। জানি না এ মুক্তির পিছনে ঐ মানবাধিকার নেত্রীর কতটুকু হাত রয়েছে। তাহলে কি সরকারের পক্ষ থেকে ঐ মামলাটি দায়েরই করা হয়েছিল শুধুমাত্র বিক্ষুব্ধ তৌহিদী জনতার ঈমানী জযবা থামিয়ে দেওয়ার জন্য। না হলে কেন সরকার এ মামলার শুনানি করালো না। কেন বাদী একবারের জন্যও আদালতে গেল না।
যাক কথা হচ্ছিল ‘নারী নীতি ’০৮ নিয়ে। সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা, উপরোক্ত অধ্যাপক সাহেব এবং তাঁদের মত আরো কারো অভিযোগ হল ‘ইসলামপন্থীরা নীতিমালাটি না পড়েই এর বিরুদ্ধে বলছে’।
অথচ যারা এ নীতির প্রতিবাদ করেছেন তারা ধারা উপ-ধারার ক্রমিক নং এবং বাক্য উদ্বৃত করে তাদের মতামত পেশ করছেন। বিভিন্ন ইসলামী ফোরাম থেকে পৃথক পৃথকভাবে দেয়া প্রতিবাদ লিপি, বিবৃতি ও সংবাদ সম্মেলনে তারা সু-নির্দিষ্টভাবেই বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন। মাসিক আলকাউসারের তত্ত্বাবধায়ক মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক সাহেবও একটি প্রতিনিধি দলসহ আইন ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে তাদের মতামত উপস্থাপন করেছেন এবং কুরআন-হাদীসের রেফারেন্সসহ ইসলামের সাথে ধারা-উপধারাগুলোর সংঘর্ষের দিকটি তুলে ধরেছেন।
আসলে ইসলামপন্থীদেরকে নীতিমালা না পড়ার দায়ে অভিযুক্ত করে ঐ সকল বুদ্ধিজীবী তাঁদের নিজেদের চরিত্রেরই প্রকাশ ঘটাচ্ছেন। তাঁরা যেমনিভাবে ধর্মীয় লেখাপড়া না করেও এবং কুরআন-হাদীসের প্রাথমিক জ্ঞান না রেখেও ধর্মের যেকোনো মনগড়া ব্যাখ্যা দিতে দ্বিধাবোধ করেন না, আবার আরেক শ্রেণী ইংরেজী বা বাংলা অনুবাদ পড়েই কুরআনের গবেষক সেজে যান তাঁরা হয়ত ভেবেছেন আলোচিত নীতির বিরোধীতাকারীরাও তেমনটিই করছে।
এ কারণেই নীতিমালার ৩.৫ ধারার বক্তব্য নিয়ে কথা উঠেছে। যাতে বলা হয়েছে ‘স্থানীয় বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোন ধর্মের, কোন অনুশাসনের ভুল ব্যাখ্যার ভিত্তিতে নারীস্বার্থের পরিপন্থী এবং প্রচলিত আইন বিরোধী কোন বক্তব্য বা অনুরূপ কাজ করা বা কোন উদ্যোগ না নেয়া।’
ধারাটিতে ধর্মের বা অনুশাসনের ভুল ব্যাখ্যা দ্বারা কী বুঝানো হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। আর কার ব্যাখ্যা শুদ্ধ এবং কার ব্যাখ্যা ভুল তাও বলা হয়নি। এমন তো নয় যে, উপরোক্ত বুদ্ধিজীবী ও অধ্যাপকদের মত লোকেরা ধর্মের যে ব্যাখ্যা দিবেন তা হবে সঠিক এবং কুরআন-হাদীস পড়ুয়া এবং সারা জীবন এ নিয়ে গবেষণাকারীগণ যা বলবেন তা হবে ভুল ব্যাখ্যা।
নারী নীতি ও কথার ফুলঝুড়ি!
‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ’০৮ এ দরিদ্র নারীদের কথাও আছে। হাঁ, নারীকে দারিদ্রে্যর অভিশাপ থেকে মুক্ত করা, নারীর সু-স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করা, দুর্দশাগ্রস্ত নারীর চাহিদা পূরণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের পুনর্বাসন, নারীর খাদ্য নিরপত্তা বিধান, নারীর জন্য উপযুক্ত গৃহায়নের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি অনেক ধারা রয়েছে যেগুলো পড়লে ও শুনলেও ভালই লাগে।
যে দেশে নারী-পুরুষ নির্বেশেষে অর্ধেকেরও বেশি লোক চরম দারিদ্রে্যর মধ্যে বাস করে, দু মুঠো আহার জোগানো যাদের প্রায়ই সাধ্যে কুলায় না, সে দেশে অন্তত নারী শ্রেণীর জন্যও যে এমন শ্রুতিমধুর সুপারিশ ও অঙ্গিকার করা হচ্ছে তা দেখে ভাল লাগারই কথা। যদিও পুরুষ দরিদ্রে্যর জন্য এমন কোন সরকারী অঙ্গিকার বা নীতি প্রণিত হয়েছে বলে শোনা যায়নি, তবুও যদি দরিদ্র মহিলাদের বেলায় তা আংশিক হলেও কার্যকরী হয় সেটিও হবে সুখের কথা। দরিদ্র নারী সরকারী খাদ্য, বাড়ী ও স্বাস্থ্য সেবা পেলে সে তো আর একা ভোগ করবে না। নিশ্চয় তার পিতা, স্বামী, ভাই ও ছেলে সন্তানদেরকেও তাতে শেয়ার করবে। এতে পুরুষগণও উপকৃত হবে বৈকি।
নারীদের জন্য আসলে যা করা দরকার ছিল!
পশ্চিমাদের দেখানো মরিচিকাময় তথাকথিত নারী উন্নয়নের পথ দেখিয়ে এ দেশের ধর্মপ্রাণ নারী সমাজকে যেভাবে ধ্বংসের মুখে পতিত করা হচ্ছে, যেভাবে মাতৃজাতি নারীদেরকে পণ্য বানিয়ে, তাদের বিনোদনের খোরাক বানিয়ে তাদেরকে অসম্মান করা হচ্ছে এবং যেভাবে পুরুষের সাথে অসম প্রতিযোগিতায় তাদেরকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, আবার অর্ধেক ক্ষেত্রে দাঁড় করানো হচ্ছে পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে তা যে মহিলাদেরই সর্বনাশ করছে তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আসলে এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী পুরুষ এবং তাদের দোসর স্বল্প সংখ্যক নারীই তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বিশ্বব্যাপী নারীদেরকে বিপথে ধাবিত করছে। মডেলের নামে নারীকে ব্যবহার করছে যত্রতত্র, এমনকি সিগারেটের বিজ্ঞাপনেও, বিনোদনের নামে নারী দ্বারা তাদের ভোগ বিলাসের ব্যবস্থা করছে, কাজের নামে তাদের থেকে নিচ্ছে
শস্তা শ্রম, সাহায্যের নামে তাদের থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে ৪০%-৫০% বা তার থেকেও অধিক হারের সুদ। মুসলমান নারীদের দারিদ্র্য ও ধর্মজ্ঞানহীনতার সুযোগে তাদের সাথে করছে হারাম সুদী ব্যবসা। দরিদ্র নারীদের তৈরি কারুকাজের পোশাক অভিজাত শপে এনে বিক্রি করছে আকাশচুম্বি দামে এবং তাদেরকে মুজুরী দিচ্ছে খুবই সামান্য। আর এ সবের নাম দেওয়া হয়েছে নারী স্বাধীনতা ও নারী উন্নয়ন।
এই ভুল পথে না চলে নারীদের জন্য যা করা দরকার ছিল তা হল, তাদের জন্য প্রয়োজনীয় বাস্তবমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা করা, নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য পর্যাপ্ত ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করা, যেন তারা একে অন্যের হক চিনতে পারে এবং আল্লাহর বিধান মত চলতে পারে। সুখী হতে পারে। এ ছাড়া নারীদেরকে শরীয়ত যে যে অধিকার দিয়েছে সেগুলো পাওয়ার ব্যবস্থা করা। উদাহরণ স্বরূপ ‘মহর’ নারীর প্রাপ্য হক। এ দেশে কতজন লোক মহর আদায় করে? অথচ এ সম্পর্কে ‘নারী নীতি ’০৮’ এ নির্দেশনা নেই।
মীরাস
নারীর জন্য কুরআনে যে উত্তরাধিকার সম্পদ বরাদ্দ হয়েছে তা পাচ্ছে কতভাগ নারী। দরকার ছিল তা যেন নারীগণ বিনা হযরানীতে পেয়ে যায় তার ব্যবস্থা করা।
যৌতুকের অভিশাপ
যৌতুক কি বন্ধ হয়েছে? প্রয়োজন ছিল প্রয়োজনীয় ধর্মীয় জ্ঞান দিয়ে মানুষের মধ্যে খোদাভীতি সৃষ্টি করা যেন তারা এ হারাম দাবী না করে এবং কন্যা দায়গ্রস্ত অভিভাবকদেরকে মেয়ে বিয়ের ব্যাপারে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া।
হিজাব
নারীগণ যেন শরীয়তের বিধান মত পর্দা করে চলে সে ব্যবস্থা সর্বাত্মক করা প্রয়োজন। আল্লাহর হুকুম পালন এবং মাতৃ জাতির সম্মান এতে বৃদ্ধি পায়।
দুষ্টদের কঠোর শাস্তি
যারা নারীদের উত্তক্ত করে, গুনাহের পথে তাদেরকে ঠেলে দেয় প্রয়োজন তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা এবং এসব ব্যাপারে ইসলামের হুদুদ ও তাজীর-এর চেয়ে উত্তম কোন ব্যবস্থা পৃথিবীতে নেই।
বিনা কারণে তালাক দাতার শাস্তি
যারা একত্রে স্ত্রীকে তিন তালাক দেয়, বিনা কারণে বউ ছেড়ে দেয় প্রয়োজন তাদেরকে কঠোর শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা এবং তা অবশ্যই ইসলামের বিধি অনুযায়ী। নারীদের জন্য ইসলামের নেওয়া ব্যবস্থাদি এবং তাদের অধিকার বিষয়ে আরো কিছু কথা লেখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু পত্রিকা প্রেসে চলে যাচ্ছে বিধায় আরও বিস্তারিত লেখা সম্ভব হল না। ইনশাআল্লাহ। আলকাউসার-এর পাতায় এ বিষয়ে আরও প্রবন্ধ প্রকাশিত হবে।
নারী উন্নয়ন নীতির উপর লেখার মোটেই ইচ্ছা ছিল না আমার। এর কারণ হল, আমি এ বিষয়টিকে নারীর উপর প্রতারণা হিসাবেই দেখি। এ সব নীতির ইতিবাচক অংশগুলো, শুধুই আইওয়াস। আর দ্বিতীয় কারণটি হল, আমরা যারা শিক্ষা ও দ্বীনি দাওয়াতের সাথে জড়িত তারা সহজে অন্যকে কড়া কথা বলতে চাই না, অথচ নারী নীতির উপর লিখতে গেলে এটি অনিবার্য হয়ে যায়। যা হোক কোন ব্যক্তি বিশেষকে হেয় করা আমার মোটেই উদ্দেশ্য নয়, নীতি সম্পর্কে ব্যক্তির বিষয় এসেছে শুধুই প্রসঙ্গের প্রয়োজনে। তবুও সহকর্মীদের চাপে আমাকে এ প্রসঙ্গে লিখতেই হল।
আসুন আমরা নারী-পুরুষ বিভক্ত সমাজ নয়, বরং একে অপরের সম্পূরক হিসাবে যার যার দায়িত্ব আদায় করি। আমাদের সকল নারী ও পুরুষদেরকে যিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর বিধানাবলী মেনে চলি। পুরুষগণ নারীদেরকে আল্লাহপ্রদত্ত তাদের অধিকারগুলো দিতে এগিয়ে আসি, তাদের প্রতি সদয় হই। এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হবে সুন্দর পরিবার, সুন্দর সমাজ ও ইনসাফভিত্তি রাষ্ট্র। আল্লাহ তাওফীক দিন। আমীন। #