প্রযুক্তি : প্রযুক্তির অপব্যবহার
গত মাসের শেষের দিকে বিটিআরসি জানিয়েছে যে ‘বাংলাদেশে ইন্টারনেট-পর্নোগ্রাফি ও আপত্তিকর কন্টেন্ট প্রকাশ বন্ধের প্রক্রিয়ার শুরুতে ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ৫৬০ টি সাইট বন্ধ করেছে।’
এটা একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ। ফাঁক ফোকর কতটুকু বন্ধ করা যাবে বা করা হবে সে আলোচনায় না গিয়ে আপাতত এই পদক্ষেপটিকে সাধুবাদযোগ্য বলা প্রয়োজন। প্রযুক্তির নামে এখন যে এক প্রকারের ‘হিস্টিরিয়াগ্রস্ততা’- এ অবস্থায় এ পদক্ষেপও কম নয়! এটা প্রমাণ করছে পরিস্থিতি আসলেই কত ভয়াবহ।
একটি দৈনিকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বেসরকারী সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী ঢাকার স্কুলগামী শিশুদের প্রায় ৭৭ শতাংশ নিয়মিত পর্নোগ্রাফি দেখছে। (দৈনিক নয়াদিগন্ত, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬, পৃ. ১১)
এই প্রজন্মের বর্তমান ও ভবিষ্যত নানা দিক থেকে চরম ঝুঁকিগ্রস্ত হয়ে পড়ার কারণেই হয়তো বাধ্য হয়ে এই পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। যে কারণেই নেয়া হোক, এখন এই বোধোদয় প্রয়োজন যে, মানুষের জীবনে সংযমের কোনো বিকল্প নেই। সুস্থ জীবন-যাপনের জন্য এ এক বিকল্পহীন ব্যাপার। মনের সকল ইচ্ছা পূরণ করা, এককথায় প্রবৃত্তিপরায়ণতা মানুষের সুস্থতা ও সুখী-সুন্দর জীবনের জন্যই হুমকি। আর এর জন্য যেমন দরকার ব্যক্তিগত চেতনা তেমনি দরকার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ।
এই চেতনাও প্রয়োজন যে, যৌনতা জীবনের একটি অংশমাত্র; এটিই জীবন নয়। আর জীবনের এই অংশেও অতি প্রয়োজন সংযম রক্ষা । কারণ এক্ষেত্রের স্বেচ্ছাচারও একজন মানুষের শেষ হয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট।
ইসলাম এই সীমা-সরহদই স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, যা রক্ষা করা মানুষের নিজের স্বার্থেই প্রয়োজন। এ কারণে যে বন্ধুরা জীবন-যাপনে ইসলামের বিধি-বিধান সম্পর্কে অমনোযোগী এবং যারা ইসলামের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বিরোধী তাদের জন্য বেদনাবোধ হয় বৈকি।
সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বশীল অনেক বড় আশা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘৮০ থেকে ৭০ শতাংশ পারলেও বড় কাজ হবে।’ এই আগ্রহটা ইতিবাচক। সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থাই গ্রহণ করা উচিত। সদিচ্ছা ও নিষ্ঠা থাকলে কিছু সফলতাও যে আসবে না, তা নয়। কিন্তু একইসাথে এই কথাটিও মনে রাখলে ভালো হবে যে, এটি খুবই সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক কিছু সুফল পাওয়ার মতো একটি ব্যবস্থা। গোটা সমাজ-ব্যবস্থা যখন এক ধারায় চলে তখন দু’এক জায়গায় কিছু বিধি নিষেধ বিশেষ কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না।
এখানেই বড় পার্থক্য সমাজ-সংস্কারের ইসলামী ব্যবস্থা ও তথাকথিত প্রগতিবাদী ব্যবস্থায়। ইসলামেও দৃষ্টির সংযমের সুস্পষ্ট বিধান আছে। কিন্তু ইসলাম যখন দৃষ্টির সংযমের বিধান দিয়েছে তখন একটি মাত্র বিচ্ছিন্ন বিধান দেয়নি, ঐ ব্যবস্থাটাও দিয়েছে, যা এই সংযমের পক্ষে সহায়ক। ইসলামের পর্দা-ব্যবস্থায় সতর থেকে শুরু করে নারী-পুরুষের সম্পর্ক ও লেবাস-পোষাক পর্যন্ত নানা বিষয়ে এবং ব্যক্তি ও পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষা-দীক্ষা,বিচরণ-উপার্জন, সংস্কৃতি-বিনোদন, পর্ব-উৎসব প্রভৃতি নানা ক্ষেত্রে বিস্তৃত এক ব্যবস্থা, যা দৃষ্টির সংযম থেকে শুরু করে চারিত্রিক শুদ্ধতা রক্ষা পর্যন্ত পবিত্রতার সব কিছুকেই সহজ করে তোলে। আর এই ব্যবস্থার সাথে রয়েছে ইসলামের খোদাভীতি, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য, আখিরাতে জবাবদিহিতার অনুভূতির মতো গভীর চেতনা ও বিশ্বাসের পৃষ্ঠপোষকতা, যা একজন মানুষকে সংযমের বিধান পালনে স্বতঃস্ফূর্ততা দান করে। সারকথা এই যে, ইসলামে একেকটি বিধানের পেছনে একেকটি ব্যবস্থা কাজ করে তেমনি এর প্রতিটি বিধান ইসলামী চেতনা ও বিশ্বাসের গভীর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। এটা তার সাফল্যের এক বড় কারণ। আর এ কারণে বর্তমান প্রতিকূল স্রোতেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে এর সাফল্যের উদাহরণ একেবারে কম নয়।
পক্ষান্তরে এখনকার প্রগতিবাদী সমাজে অপারগতাবশত যে সকল সংযমের বিধান বা ব্যবস্থা কখনো কখনো আসছে এগুলো সাধারণত সাফল্যের মুখ দেখছে না। কারণ, এসব বিধান ও ব্যবস্থা ‘বিচ্ছিন্ন’ ও ‘আরোপিত’। অর্থাৎ বিশেষ কোনো ক্ষেত্রের ঐ বিধানটি এসংক্রান্ত ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, সাংঘর্ষিক। যেমন, আলোচ্য বিষয়টিই ধরুন। এখানে বিশেষ একটি ক্ষেত্রে একটি বিধি-নিষেধ আরোপিত হলেও নারী-পুরুষের সম্পর্ক, মেলা-মেশা, লেবাস-পোষাক ও অন্যান্য ক্ষেত্রের প্রচলিত ধারাটা ঐ ব্যবস্থার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। বরং বলা যায়, বিদ্যমান পরিবেশ-পরিস্থিতির একটি বড় অংশ দৃষ্টির স্বেচ্ছাচারের অনুকূল ও প্রেরণাদানকারী। এ অবস্থায় এ ধরনের বিচ্ছিন্ন কোনো পদক্ষেপ কীভাবে সফল হতে পারে? তাছাড়া এই বিধি-নিষেধ স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করার মতো শক্তিশালী কোনো চেতনা ও প্রেরণাও তো কার্যকর নেই। বরং নানাভাবে ঈমান ও তাকওয়ার চেতনাকেই দুর্বল ও বিলুপ্ত করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ফলে এইসকল বিধি-ব্যবস্থা হয়ে যাচ্ছে অনেকটাই ‘আরোপিত’ প্রকৃতির। কাজেই ফাঁক ফোকর খোঁজার ব্যাপারটা অনেক বড় ও ব্যাপকভাবেই এসে যাচ্ছে। এ কারণে সত্যিকার অর্থেই জাতি ও সমাজকে অশ্লীলতা ও তার কুফল থেকে রক্ষা করতে হলে ঈমান ও তাকওয়া;বিশ্বাস ও খোদাভীতির চর্চার কোনো বিকল্প নেই। চিন্তা-চেতনায়, বিশ্বাস ও কর্মে ইসলামী শিক্ষা ও জীবনধারা অনুসরণের দাওয়াতই আল্লাহর ইচ্ছায়- ব্যক্তি ও সমাজকে আত্মসংযমের পথে নিয়ে আসতে পারে। তখন দায়িত্বশীলদের পক্ষ হতে অন্যায়-অপরাধ নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ-আয়োজনগুলোও সফলতার মুখ দেখবে।
এই সংযম ও নিয়ন্ত্রণ কোনোভাবেই সত্যিকারের প্রগতি ও চিন্তার মুক্তির পরিপন্থী নয়; বরং তার সহায়ক ও পৃষ্ঠপোষক। দৃষ্টির সংযম থেকে শুরু করে চরিত্র ও নৈতিকতার শুদ্ধি পর্যন্ত গোটা ব্যবস্থাটা ব্যক্তি ও সমাজের সুস্থতার জন্যই প্রয়োজন। সমাজ যদি সুস্থ থাকে তবেই না প্রগতি ও প্রযুক্তি। অসুস্থ মৃতপ্রায় সমাজে প্রযুক্তি ও প্রগতি কী কাজে আসবে?