প্রতিবেশীর সুবিধা অসুবিধা
রাত এগারটা। আব্দুল করীম সাহেব অফিস থেকে ফিরেছেন। সারাদিনের কাজ শেষে খুব ক্লান্তি অনুভব করছেন, মাথাও খুব ব্যথা করছে। তাই খাওয়া-দাওয়া সেরে দ্রম্নত শুয়ে গেছেন।
তিনি শোওয়া মাত্রই পাশের বাসা থেকে বিরক্তিকর খট খট আওয়াজ শুরু হল; দেয়ালে কিছু একটা লাগানো হচ্ছে। তিনি কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করলেন। নাহ! বিরক্তিকর আওয়াজ। কিছুতেই ঘুমানো সম্ভব নয়। মাথা ব্যথাও ক্রমে বেড়ে চলেছে।
তিনি ছোট ছেলে হাসানকে ডাকলেন। বাবা হাসান! পাশের বাসায় গিয়ে আমাদের প্রতিবেশীকে একটু বল, সারাদিন কাজ শেষে আবক্ষু একটু ক্লান্ত, তার মাথাও ব্যথা করছে। দ্রম্নত শুয়ে গেছেন; কিন্তু আওয়াজের কারণে ঘুমাতে পারছেন না। দয়া করে যদি আপনাদের কাজটি সকালে করেন তাহলে ভাল হয়। হাসান যেতে উদ্যত হল তখন মা বললেন, বাবা! মনে রেখ তারা আমাদের প্রতিবেশী, আর প্রতিবেশীর উপর প্রতিবেশীর হক রয়েছে। সুন্দর ও নম্রভাবে বলবে, রাগারাগি করবে না।
হাসান পাশের বাসায় গিয়ে বেল চাপলো।
প্রতিবেশী মাজেদ : কে রে এত রাতে! কে?
হাসান : আমি হাসান, তোমাদের প্রতিবেশী।
মাজেদ : তা আমি ভালোভাবে জানি। তো এত রাতে কী কাজে এসেছ বলে ফেল জলদি।
হাসান : সারাদিন কাজ শেষে আবক্ষু একটু ক্লান্ত, তার মাথাও ব্যথা করছে। তিনি দ্রম্নত শুয়ে গেছেন... তোমাদের কাজটা সকালে করলে ভাল হয়।
মাজেদ : না! না!! এখনো পাঁচটি স্ক্রু লাগানো বাকি আছে। রাতেই সেটা শেষ করতে হবে। তুমি বাসায় যাও তো, ডিস্টটার্ব করো না; হাতে অনেক কাজ।
হাসান : কিন্তু...
মাজেদ : কোনো কিন্তু টিন্তু বুঝি না, আমাকে দ্রম্নত কাজ শেষ করতে হবে। যাও তো। যত্তোসব!
হাসান : কিন্তু আওয়াজের কারণে যে আবক্ষু ঘুমাতে পারছেন না।
মাজেদ : তাতে আমার কী! তাকে গিয়ে বল, এক গস্নাস গরম দুধ খেয়ে লেপ মুড়ি দিতে; দেখবে সুন্দর ঘুম এসে গেছে। (এই বলে মুখের উপর ধরাম করে দরজা বন্ধ করে দিল।)
হাসান : ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন!
হাসান গম্ভীর চোহারা নিয়ে বাসায় প্রবেশ করল।
মা জিজ্ঞেস করলেন : কীরে মন ভার কেন, কী হয়েছে?
হাসান : তারা কাজ বন্ধ করবে না।
মা : নিশ্চয় তুমি গিয়ে রাগারাগি করেছ। হাসান : না মা। আবক্ষু যা বলেছেন আমি তাই বলেছি। আর সে বলেছে...। সে বলেছে...।
মা : বল, কী বলেছে?
হাসান : সে বলেছে, তোমার আবক্ষুকে গিয়ে বল, এক গস্নাস গরম দুধ খেয়ে লেপ মুড়ি দিতে; দেখবে সুন্দর ঘুম এসে গেছে।
মা : ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন! এ কেমন কথা!
এরই মাঝে একটা ভারি বস্ত্ত দেয়ালে লাগাতে গিয়ে মাথায় পড়ে মাজেদের মাথা ফেটে গেছে। তার ছোট ভাই চিৎকার করতে করতে হাসানদের বাসায় ছুটে এসেছে। হাসানের আবক্ষা দৌড়ে গেলেন এবং তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন।
হাসান মাকে বলল, আবক্ষু কেন তাকে হাসপাতালে নিল; ওর মাথা ফেটেছে ভালো হয়েছে। মা বললেন, ছি বাবা! এরকম কথা বলতে নেই। সে আমাদের প্রতিবেশী আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ করে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৮৫
নবীজী আরো বলেছেন, জিবরীল আ. আমাকে প্রতিবেশীর হকের ব্যাপারে এত বেশি তাকিদ করেছেন যে, আমার কাছে মনে হয়েছে প্রতিবেশীকে মিরাছের অংশিদার বানিয়ে দেয়া হবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০১৪) সে আমাদের সাথে খারাপ আচরণ করেছে তাই বলে কি আমরা প্রতিবেশীর বিপদে এগিয়ে যাব না।
হাদীস শরীফে এসেছে, আল্লাহ তিন ব্যক্তিকে পছন্দ করেন, তাদের একজন ঐ ব্যক্তি, যার একজন মন্দ প্রতিবেশী রয়েছে, সে তাকে কষ্ট দেয়। তখন ঐ ব্যক্তি ছবর করে এবং আল্লাহর ছাওয়াবের আশা রাখে। ...। মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২১৩৪০
হাসান : জী আম্মু, আবক্ষু খুব ভালো কাজ করেছেন। আমিও তাকে হাসপাতালে দেখতে যাব।
মাজেদের মাথায় ব্যান্ডেজ লাগানো। সে এখন কিছুটা সুস্থতা অনুভব করছে। হাসান তাকে সালাম দিল। সালামের জবাব দিয়ে মাজেদ বলল, কেমন আছ ভাই হাসান! আল্লাহ আমাকে মাফ করুন। আমি প্রতিবেশীকে কষ্ট দিয়েছি। আমার ভুল হয়েছে! তোমরা আমাকে মাফ করে দিও। হাসান হেসে বলল, না ভাই! আল্লাহ তোমাকে দ্রম্নত সুস্থ করুন। সকলে বলল, আমীন।
ডাক্তার বললেন, তুমি নিশ্চয় পড়েছ- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৮৩
আব্দুল করীম সাহেব বললেন, হাঁ মাজেদ তুমি তোমার ভুল বুঝতে পেরেছ। আল্লাহ তোমাকে সহীহ বুঝ দান করুন। প্রতিবেশীর উপর প্রতিবেশীর অনেক হক রয়েছে এবং ইসলাম একে অনেক গুরুত্ব দিয়েছে। এমনকি প্রতিবেশী যদি অমুসলিমও হয় তবু তার হকসমূহ রক্ষা করতে হবে।
কী সেই হকসমূহ চাচা! (মাজেদের জিজ্ঞাসা)। আব্দুল করীম সাহেব বললেন, ১. তার সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করা। ২. সদা তার সুবিধা অসুবিধার প্রতি খেয়াল রাখা। ৩. অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া ও সেবা করা। ৪. তার বিপদে পাশে দাঁড়ানো। ৫. তার দোষ-ত্রুটি খুঁজে না বেড়ানো; বরং গোপন করা। ৬. ঘরের ভেতর উঁকি না দেওয়া। ৭. তার কষ্টের কারণ না হওয়া। ৮. প্রতিবেশী প্রবাসে থাকলে তার পরিবারের খোঁজ-খবর রাখা। ৯. প্রতিবেশীর সন্তানদের সাথে দয়ার আচরণ করা।
মাজেদ বলল, জী চাচা! আমি এখন থেকে প্রতিবেশীর হক আদায়ে যত্নবান হব ইনশাআল্লাহ।