জুমাদাল উলা ১৪৩৮   ||   ফেব্রুয়ারি ২০১৭

একটি বই, একটি চিঠি : আযান ও ইকামত

মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল গাফফার

 

[জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ছালাত নামের বইটি ইলমী মুনাকাশার চেয়ে অপবাদ ও না-ইনসাফিরই উপর বেশি নির্ভরশীল। বইটির নাম থেকেই যা অনুমেয়। এর আরবী নামটিও বড় অদ্ভুত-

صلاة الرسول صلى الله عليه وسلم بقبضة الأحاديث الضعيفة والموضوعة

নাম তো আক্রোশে ঠাসা, কিন্তু বিশুদ্ধতার দিক দিয়ে শূন্য! আল্লাহর মেহেরবানী যে, এ বইয়ের একটি কপি জনৈক আলেমের হস্তগত হয়, যিনি হযরত মাওলানা আব্দুল গাফফার সাহেবের ভক্ত এবং এক সময় তার মুসল্লিও ছিলেন- তিনি তা মাওলানার কাছে পৌঁছান এবং এ বই সম্পর্কে তার মতামত প্রকাশের অনুরোধ জানান। এই অনুরোধকে গুরুত্বের সাথে আমলে নিয়ে মাওলানা এ বিষয়ে এক দীর্ঘ চিঠি লেখেন, যা একটি স্বতন্ত্র প্রবন্ধের রূপ লাভ করে। বিষয়বস্ত্ত পুরোপুরি ইলমী ও সূক্ষ্ম হওয়া সত্ত্বেও ভাষার সাবলীলতা ও পাঠ-মাধুর্য তাতে ব্যাহত হয়নি। ইলমী দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনার যতখানি হক আদায় করা সম্ভব তাতেও প্রবন্ধটি সফল, আলহামদু লিল্লাহ। পাঠকদের কাছে নিবেদন, চিঠিটি তারা চিন্তা সহকারে পড়বেন এবং বারবার পড়বেন। দলীলের বিশ্লেষণসহ ইখতিলাফি মাসায়েল অধ্যয়ন করে যারা অভ্যস্ত- ইনশাআল্লাহ তারা এতে সেই চাহিদা নিবারণের প্রচুর উপাদান পাবেন।

পূর্বে এ প্রবন্ধের কয়েকটি কিস্তি প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তীতে তা বই আকারেও ছেপেছে প্রচলিত সালাত কী জাল হাদীসের কবলে? এটি মাকতাবাতুল আযহার প্রকাশ করেছে। আলহামদু লিল্লাহ এর দ্বারা ব্যাপক ফায়েদা হচ্ছে। প্রবন্ধের এ অধ্যায়টি আযান ও ইকামতের উপর। এর একটি অংশ এ সংখ্যায় ছাপা হল। বাকি অংশ আগামীতে প্রকাশিত হবে ইনশাআল্লাহ।

(মুহাম্মাদ আবদুল মালেক)]

بسم الله الرحمن الرحيم

আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ

 

মুহতারাম, বহুদিন পর আবার মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবের বইটি নিয়ে বসলাম। এর পূর্বে সালাতের ওয়াক্ত সম্পর্কে তাঁর লেখা ও বক্তব্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলাম। এর পরের অধ্যায়ে তিনি আযান ও ইকামত সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেছেন। তাঁর বক্তব্যের এদিক সেদিক নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা করব বলে  আল্লাহর নামে লিখতে শুরু করলাম।

 

আযান ও ইকামত

এই অধ্যায়ের (১), (২), (৩) ও (৪) নং অনুচ্ছেদে তিনি যা লিখেছেন তাঁর সে লেখার উপস্থাপন ও বাকরীতি আমার পছন্দ না হলেও তাঁর মূল বক্তব্যের সাথে আমি মোটামুটিভাবে সহমত পোষণ করি। এক নম্বর শিরোনামে আযানের ফযীলত সম্পর্কে  বর্ণিত প্রথম হাদীসটি যঈফ। তিনি যেমনটা বলেছেন। তবে হাদীস যঈফ হলেই তা বর্ণনা করা যাবে না- বিষয়টি সেরকম নয়। লেখকের পুরো বই পাঠ করলে বুঝা যায় যে, লেখকের নিকট যঈফ ও জাল হাদীস একই পর্যায়ের। অথচ যঈফ ও জাল এক কথা নয়। যদি যঈফ ও জাল উভয়টি এক পর্যায়ের হত তাহলে মুহাদ্দিসগণ যঈফ ও জাল নামে দুটি পৃথক শ্রেণীতে হাদীসের শ্রেণীভেদ করতেন না। বরং এই উভয় প্রকার হাদীসকে প্রত্যাখ্যাত বলতেন এবং একই শ্রেণীভুক্ত সাব্যস্ত করতেন। জাল হাদীস কোনো ক্ষেত্রেই আমলযোগ্য নয়। কিন্তু যঈফ হাদীস কোনো কোনো ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য ও আমলযোগ্য। এই জন্যই তাঁরা এই শ্রেণীভেদ করেছেন। কোন্ পর্যায়ের যঈফ হাদীস কোন্ ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য ও বর্ণনাযোগ্য আর কোন্ ক্ষেত্রে অগ্রহণযোগ্য ও বর্ণনা-অযোগ্য এবং সব যঈফ হাদীস একই পর্যায়ের কি না-সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানা থাকা একজন গবেষকের জন্য খুবই জরুরি।

দুই, তিন ও চার নম্বর শিরোনামে যা বলা হয়েছে তা ঠিক আছে। মসজিদের বাম পার্শ্ব থেকে আযান দেওয়া এবং ডান পার্শেব দাঁড়িয়ে ইকামত দেওয়া জরুরি নয়। যে কোনো পার্শ্বে দাঁড়িয়েই আযান ও ইকামত দেওয়া যাবে। আযানের পূর্বে দুআ দরূদসহ কোনো কিছু সংযোজন করাও  বিদআত। আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ-এর জবাবে শুধু এই বাক্যটিই বলা উচিত। সঙ্গে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংযোজন করা নিয়ম বহির্ভূত। আযান শেষে প্রথমে দরূদ পাঠ করবে, অতপর আযানের দুআ পাঠ করবে।

 

আস্ সালাতু খাইরুম মিনান নাওম-এর জবাবে সাদাকতা ওয়া বারারতা বলার রীতি নিয়ে আলোচনা

পাঁচ নম্বর শিরোনামে আস্ সালাতু খাইরুম মিনান নাওম-এর জবাবে সাদাক্তা ওয়া বারার্তা বলার পক্ষে কোনো  হাদীস না থাকার কথা লেখক যা বলেছেন তা ঠিক আছে। কিন্তু এর জবাবে কী বলতে হবে তা-ও স্পষ্ট করে কোনো হাদীসে বলা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। আযানের জবাবে কী বলতে হবে সে সম্পর্কে কোনো কোনো হাদীসে সংক্ষেপে এতটুকু বলা হয়েছে যে, মুয়ায্যিন যা বলবে তদনুরূপ বলবে। আর কোনো কোনো হাদীসে বিশদ বিবরণ আকারে মুয়ায্যিনের কোন্ বাক্য শ্রবণ করে কী বলতে হবে তা নির্দিষ্ট করে ব্যক্ত করা হয়েছে। এই দ্বিতীয় প্রকারের  হাদীসগুলোতে মুয়ায্যিনের সব বাক্যের ক্ষেত্রেই অনুরূপ বলতে বলা হয়েছে কিন্তু হাইয়া আলাস সালাহহাইয়া আলাল ফালাহ-এর ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে, এই বাক্য দুটোর পরে শ্রবণকারী বলবে, লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ

 

হাইয়া আলাস সালাহ ও হাইয়া আলাল ফালাহ-এর জবাবে লা হাওলা ওয়ালা কুও্ওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ বলার কারণ

তার কারণ সম্ভবত এই যে, হাইয়া আলাস সালাহ ও হাইয়া আলাল ফালাহ ব্যতীত আযানের অন্যান্য বাক্যগুলো পরোক্ষভাবে সালাতের দিকে আহক্ষান, প্রত্যক্ষভাবে নয়।  প্রত্যক্ষভাবে মূলত সেগুলো  সত্য সাক্ষ্য প্রদান ও যিক্র। এইজন্য ঐসব বাক্যের ক্ষেত্রে মুয়ায্যিন যা বলবে তা-ই বলতে বলা হয়েছে। কিন্তু হাইয়া আলাস সালাহ ও হাইয়া আলাল ফালাহ বাক্যদুটো যিক্র নয় বরং প্রত্যক্ষভাবে সালাতের প্রতি ও কল্যাণের প্রতি আহক্ষান। অতএব মুয়ায্যিন যখন বলবে, হাইয়া আলাস্ সালাহ (সালাতের দিকে আস), হাইয়া আলাল ফালাহ (কল্যাণের দিকে আস) তখন শ্রোতাও যদি হাইয়া আলাস সালাহহাইয়া আলাল ফালাহ বলে তাহলে তা হবে অসংগতিপূর্ণ। এই জন্য এই বাক্যদুটোর জবাবে বলতে বলা হয়েছে, লা হাওলা ওয়ালা কুও্ওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ (আল্লাহর তাওফীক ব্যতীত সাধ্য ও শক্তি নেই)। অর্থাৎ সালাত ও কল্যাণের দিকে গমন আল্লাহ তাআলার তাওফীক ব্যতীত সম্ভব নয়। মূলত সালাত ও কল্যাণের দিকে যাওয়ার জন্য আল্লাহ তাআলার তাওফীক কামনা করার উদ্দেশ্যেই মুয়ায্যিনের হাইয়া আলাস সালাহহাইয়া আলাল ফালাহর জবাবে লা হাওলা ওয়ালা কুও্ওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ বলার শিক্ষা দান করা হয়েছে।

 

আস্ সালাতু খাইরুম মিনান নাওম-এর জবাবে ছাদাকতা ওয়া বারারতা বলার অবকাশ আছে

এই নিরিখেই আমার বক্তব্য হল, আস সালাতু খাইরুম মিনান নাওম বাক্যটিও  যিক্র নয়। বরং বাক্যটি একটি সত্যের ঘোষণা যে,  নিদ্রা অপেক্ষা সালাত উত্তম। এই কথাটি মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদেরকে নিদ্রা পরিহার করে সালাতে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করতেই ফজরের সালাতের আযানে এই বাক্যটিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাক্যটি সালাতের প্রতি আহক্ষানও নয় আবার যিক্রও নয়। বাক্যটি একটি বিবৃতিমূলক বাক্য, একটি সত্য সংবাদ। অতএব প্রথম প্রকার হাদীসের দাবি অনুযায়ী মুআয্যিনের আস্-সালাতু খাইরুম মিনান নাওম-এর জবাবে আস্-সালাতু খাইরুম মিনান নাওম বলাই যুক্তিসংগত বলে মনে হয়। কিন্তু দ্বিতীয় প্রকার হাদীসে লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ বলার যে তাৎপর্য উল্লেখ করলাম সেই তাৎপর্যের  দৃষ্টিকোণ থেকে আস সালাতু খাইরুম মিনান নাওম বাক্যটির জবাবে বাক্যটির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ অন্য কোনো বাক্য বলারও অবকাশ আছে বলে মনে হয়। তবে এক্ষেত্রে হাদীসে যেহেতু স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি তাই আস্ সালাতু খাইরুম মিনান নাওম-এর জবাবে অন্য কিছু বলাকে সুন্নত বলে সাব্যস্ত করা যায় না। তবে অন্য কিছু বলাকে  না জায়েযও বলা যায় না বলে আমি মনে করি। মুয়ায্যিন যখন আস সালাতু খাইরুম মিনান নাওম বলে তখন মুয়ায্যিনের এই কথার সমর্থন করে  কখনও কখনও সাদাকতা ওয়া বারারতা বলার মাধ্যমে তাকে সাধুবাদ জানানোর অবকাশ আছে বলে আমি মনে করি।

দেখুন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সফরে একবার একজন মুয়ায্যিনকে আযান দিতে শুনলেন। মুয়াযযিন যখন বলল, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, عَلَى الْفِطْرَةِ   (স্বভাব দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত) এরপর সে যখন বলল,

أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বললেন, خَرَجْتَ مِنَ النَّارِ  (তুমি আগুন হতে বের হয়ে গেলে)।১ এই হাদীস দ্বারা মুয়ায্যিনের আযানের কোনো বাক্যের সাথে সংগতিপূর্ণ অন্য কোনো কিছু বলার অবকাশ বের হয়ে আসে। আমি শুধু অবকাশের কথা বলছি। সাদাকতা ওয়া বারারতা বলাকে নিয়মিত আমলে পরিণত করার কথা বলছি না। কারণ, তা হাদীস দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত নয়।

ঠিক এই একই যুক্তিতে ইকামতের জবাব দিতে গিয়ে কাদকামাতিস সালাহ-এর জবাবে আকামাহাল্লাহু ওয়া আদামাহা বলার অবকাশ বের হয়ে আসে। কারণ, কাদকামাতিস সালাহ বাক্যটিও একটি সংবাদ, প্রত্যক্ষভাবে সালাতের প্রতি আহক্ষানও নয় এবং যিকরও নয়। বিশেষত কথাটি যখন একটি হাদীসে আছে। হাদীসটি যঈফ হলেও তার সনদে মাতরূক বা মুত্তাহাম কোনো রাবী নেই। হাদীসটিকে মুনকার বলার মত অন্য কোনো কারণও বিদ্যমান নেই। হাদীসটির দুইজন রাবী শাহ্র ইবনে হাওশাব ও মুহাম্মাদ ইবনে ছাবেত যঈফ কিন্তু চরম পর্যায়ের যঈফ নয়। হাঁ এই দুইজন রাবীর মাঝখানে একজন মুবহাম (নাম অনুল্লেখিত) রাবী আছেন। আর মুবহাম রাবীর হাদীসকে যঈফ বলা হয় এ কারণে নয় যে, সে যঈফ রাবী। তার হাদীসকে যঈফ বলা হয় এজন্য যে, তার সম্পর্কে ভালো মন্দ কিছুই জানা যায় না। হতে পারে সে নির্ভরযোগ্য আবার এও হতে পারে যে, সে অনির্ভরযোগ্য। তার নির্ভরযোগ্যতা ও অনির্ভরযোগ্যতা উভয়টিই সম্ভাব্য, নিশ্চিত নয়। এই কারণে তার হাদীসটি মূলত ঝুলন্ত পর্যায়ের। তার বর্ণিত হাদীসকে চোখ বন্ধ করে যেমন গ্রহণ করা যায় না, তেমনই বর্জনও করা যায় না। যেহেতু তার হাদীসের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না ফলে কার্যত তা দলীলযোগ্য হয় না। এটাকেই ব্যক্ত করা হয় যঈফ শব্দ দ্বারা। কিন্তু সত্তাগতভাবে তার হাদীস যঈফ নয় বরং প্রাসঙ্গিক কারণে তার হাদীস শুধু আমল-অযোগ্য। অতএব যদি হাদীসটির সমর্থনে অন্য কোনো গ্রহণযোগ্য  যুক্তি বা লক্ষণ মেলে তবে তার হাদীসের উপর আমল করতে বাধা থাকার কথা নয়। এখানেও আমরা হাদীসটির সমর্থনে একটি গ্রহণযোগ্য যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি। এজন্য হাদীসটির উপর আমল করাতে তেমন দোষের কিছু দেখছি না।

ছয় নম্বর শিরোনামে আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ শুনে শাহাদত আঙ্গুলে চুম্বন করে চোখ মাসাহ করা সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা ঠিক আছে। এই আমলের পক্ষে কোনো সহীহ হাদীস নেই। এ সম্পর্কে যে হাদীসটির বর্ণনা পাওয়া যায় তা জাল। সাত নম্বর শিরোনামে যা বলা হয়েছে তা-ও সঠিক। আযানের পরে দুআ পাঠকালে হাত উঠানোর কোনো নিয়ম নেই। আযানের শেষে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ বলারও কোনো নিয়ম নেই।

 

আযানের দুআ ও তার তরজমা

আট নম্বর শিরোনামে আযানের দুআয় বাড়তি অংশ যোগ করা সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা-ও ঠিক আছে। পূর্বেই যেমনটা বলেছি যে, এসব ক্ষেত্রে লেখকের সঙ্গে আমি সহমত পোষণ করলেও তাঁর উপস্থাপন ও বাকরীতি আমার পছন্দ নয়। সহীহ হাদীস অনুসারে আমলের প্রতি দাওয়াতদানই  যদি লেখকের মিশন হয় তাহলে বলব যে, তাঁর বাকরীতি দাওয়াতী  মিশনের সাথে অসংগতিপূর্ণ। লেখক বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করবেন বলে আশা করি। যা হোক, সহীহ হাদীস অনুযায়ী আযানের দুআটি এইরূপ :

  اللهُمَّ رَبَّ هذِهِ الدَّعْوَةِ التَّامَّةِ وَالصَّلَاةِ القَائِمَةِ آتِ مُحَمَّدًا الْوَسِيْلَةَ وَالْفَضِيِلَةَ وَابْعَثْهُ مَقَامًا مَّحْمُوْدًا الَّذِيْ وَعَدْتَه.২

কিন্তু এর যে তরজমা মুযাফ্ফর বিন মুহসিন সাহেব করেছেন তাতে একটু ভুল আছে। উল্লেখ্য, এই তরজমাটিই রেডিও ও টেলিভিশনে আযানের পরে প্রচারিত হয়। মুযাফ্ফর বিন মুহসিন সাহেব রেডিও ও টেলিভিশন কর্তৃক প্রচারিত এই তরজমাটিরই অনুসরণ করলেন কি না জানি না। তরজমাটি হবে এইরূপ :                                   

এই পরিপূর্ণ আহক্ষান ও প্রতিষ্ঠিত সালাতের প্রভু হে আল্লাহ, আপনি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দান করুন অসীলাহ ও মর্যাদা। এবং তাঁকে পৌঁছে দিন মাকামে মাহমূদে, যার ওয়াদা আপনি করেছেন।

 আল্ডার লাইন করা অংশটি লক্ষ করুন। মুযাফ্ফর বিন মুহসিন সাহেব ভুলটা এখানেই করেছেন। তিনি তরজমা করেছেন : হে আল্লাহ, আপনিই এই পরিপূর্ণ আহক্ষান ও প্রতিষ্ঠিত সালাতের প্রভু। তিনি رَبَّ শব্দটিকে predicate বা বিধেয় বানিয়ে দিয়েছেন। অথচ শব্দটি বিধেয় হলে শব্দটি হত ربُّ  (বা হরফটিতে পেশসহ), رَبَّ  (বা হরফটিতে যবরসহ) নয়। আর তখন subject-এরও উল্লেখ থাকত। মুযাফ্ফর বিন মুহসিন সাহেব তরজমায় সাবজেক্ট উল্লেখ করেছেন। আর তা হল আপনিই। কিন্তু দুআটিতে সাবজেক্টের উল্লেখ নেই।  আসলে رَبَّ শব্দটি  اللهُمَّ শব্দটির মধ্যকার আল্লাহ শব্দের بدل  (বা apposition.  যেমন : Akram Ahmed, principal of our collage is a reputed person. ‘principal of our collage’ কথাটি Akram Ahmed এর بدل বা apposition)। এজন্যই আমি মনে করি বাক্যটির যথার্থ তরজমা ঐটিই যা আমি উল্লেখ করেছি। যদিও প্রচলিত তরজমাটির বক্তব্য সঠিক, কিন্তু দুআটিতে কথাটি যেভাবে ব্যক্ত হয়েছে তরজমায় তা ফুটে ওঠেনি। এই তরজমা দুআটির  ব্যঞ্জনা ও দ্যোতনাকে বিনষ্ট করে দেয়। কাজেই বিশুদ্ধ তরজমাই করা উচিত। বিশেষ করে মুযাফ্ফর বিন মুহসিন সাহেবের মত ব্যক্তির কাছ থেকে ভুল নয়, বিশুদ্ধ তরজমাই কাম্য।

 

ইকামতের বাক্যগুলো দুবার করে না একবার করে    

মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব এ ক্ষেত্রে শিরোনাম লিখেছেন এইভাবে : ইক্বামতের বাক্যগুলো জোড়া জোড়া দেওয়ার পক্ষে গোঁড়ামী করা 

এই শিরোনামের মধ্যে  ইকামতের বাক্যগুলো একবার করে দেওয়ার পক্ষে বরং তাঁরই গোঁড়ামির সন্ধান মেলে। হাদীস যখন দুই পক্ষেই আছে যেমনটা তিনি স্বীকার করেছেন তখন কোনো পক্ষেরই গোঁড়ামি করা উচিত নয়। যাঁরা ইকামতের বাক্যগুলো দুইবার করে বলার পক্ষপাতী তাঁরা যদি একবার করে যাঁরা বলেন তাঁদের বিরূদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করতেন তাহলে তা হত গোঁড়ামি। তিনি  যদি বলেন, সবসময় ইকামতের বাক্যগুলো দুইবার করে বলা এবং কখনও একবার করে না বলাটাই গোঁড়ামি তাহলে তাঁর নিকট আমার জিজ্ঞাসা, আপনারা কি মাঝেমধ্যে ইকামতের বাক্যগুলো দুইবার করে বলে থাকেন? আমার এবং অনেকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তো এই যে, যাঁরা ইকামতের বাক্যগুলো একবার করে বলার পক্ষপাতী তাঁরা কখনও দুইবার করে বলেন না। তাহলে সেটাও  তো আপনার চিন্তাধারা অনুযায়ী গোঁড়ামি হল। তাহলে গোঁড়ামির অভিযোগের তীর শুধু তাঁদের দিকে কেন ছুঁড়ে দিলেন যাঁরা ইকামতের বাক্যগুলো দুইবার করে বলার পক্ষপাতী?

এই শিরোনামের শুরুতে তিনি লিখেছেন : ইক্বামতের শব্দগুলো জোড়া জোড়া বলা জায়েয। এর পক্ষে দু একটি হাদীছ রয়েছে। কিন্তু এর উপর যদিও গোঁড়ামী করার কোন সুযোগ নেই। কারণ, ইক্বামত একবার করে বলাই উত্তম। এর পক্ষেই বেশী হাদীস বর্ণিত হয়েছে।

যাক লেখক স্বীকার করলেন যে, ইকামতের শব্দগুলো জোড়া জোড়া বলা জায়েয। দুই একটি হলেও এর পক্ষে হাদীস আছে এটাও তিনি স্বীকার করলেন। এতে অন্তত এতটুকু স্বস্তি পাওয়া গেল যে, এই দেশের ইকামত জাল হাদীসের কবলে পড়েনি।

লেখকের মতে ইকামতের শব্দগুলো দুইবার করে বলার পক্ষে দুই একটি হাদীস আছে। আর একবার করে বলার পক্ষেই বেশি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। ঘটনাটি কি তা-ই? তাহলে লেখক একবার করে বলার পক্ষে মাত্র দুইটি হাদীস উল্লেখ করলেন কেন?

 

 মুহতারাম, একে তো তিনি মাত্র দুইটি হাদীস উল্লেখ করেছেন, তাও আবার দ্বিতীয়টি সহীহ নয়। বেশির চেয়ে বেশি হাদীসটিকে হাসান বলা যায়। গবেষণার ক্ষেত্রে লেখকের আশ্রয়পুরুষ আলবানী সাহেবও হাদীসটিকে হাসান পর্যায়ের উপরে নিতে পারেননি। তো এই কি ইকামত একবার করে বলার পক্ষে বেশি হাদীস থাকার নমুনা?

হাদীস দুইটি উল্লেখ করার পর লেখক লিখেছেন : জ্ঞাতব্য : ইক্বামতের শব্দগুলো একবার করে বলা  যাবে না বলে যে বর্ণনা প্রচলিত আছে তা জাল। এরপর তিনি তাযকিরাতুল মাওযুআত থেকে একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন।

 আমার বক্তব্য হল,  ইকামতের শব্দগুলো একবার করে বলা যাবে না- এই কথা কোনো ফকীহ বা মুহাদ্দিস বলেছেন বলে আমার জানা নাই। এমনকি  সাধারণ কোনো লোকের মুখেও এরূপ কথা উচ্চারিত হয়েছে বা হয় বলে আমার জানা নাই। তারপর ঐ কথার পক্ষে আবার জাল হাদীস বর্ণনা করা তো অনেক দূরের ব্যাপার। লেখক প্রচলিত শব্দটির অর্থ কী তা জানেন না বলে ধারণা করার যথেষ্ট কারণ এখানে বিদ্যমান। প্রচলিত জাল হাদীসের একটি উদাহরণ হল এই হাদীস : أول ما خلق الله نوري  (আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম যা সৃষ্টি করেছেন তা হচ্ছে আমার নূর।) এটি একটি জাল হাদীস এবং অনেককেই হাদীসটি বলতে শোনা যায়। প্রচলিত অর্থ- চালু থাকা, চলন্ত থাকা। কিতাবে কোনো জাল হাদীস  থাকলেই তাকে প্রচলিত বলা  যায় না। মানুষের মাঝে এর চর্চা যদি না থাকে। যা হোক, এরপর তিনি আরেকটি জাল হাদীস এনেছেন হযরত বেলাল রাযি. জোড়া জোড়া শব্দে আযান ও ইকামত দিতেন মর্মে। লেখকের বিপক্ষ-মতপোষণকারীরা হাদীসটিকে কোথায় দলীল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন লেখক তা বলেননি। ইকামতের শব্দগুলো দুইবার করে দেওয়ার পক্ষে দু-একটি হাদীস আছে বলে লেখক বলেছেন। অথচ সেই দু-একটির একটাও উল্লেখ না করে তিনি একটি জাল হাদীস উল্লেখ করলেন। লেখকের আমানতদারী ও বিশ^স্ততা এখানে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। অবশ্য এটা নতুন নয়, পূর্বেও বারবার তাঁর আমানতদারী  প্রশ্নবিদ্ধ হতে আমরা দেখেছি। কুরআন ও হাদীসের আলোচনায় এইরূপ খিয়ানত যে কত মারাত্মক তা আপনাকে  বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন পড়ে না।

আপনি জানেন, একসময় প্রায় প্রতিটি বিষয়ে দাজ্জালদের কর্তৃক অথবা দাজ্জাল বর্ণনাকারীদের পক্ষ হতে জাল হাদীস রচনা করা হয়েছে। রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শরীয়ত সংক্রান্ত মাসআলা-মাসায়েল, আকীদা-বিশ্বাসসহ হেন কোনো বিষয় নেই যে বিষয়ে হাদীস রচনা করা হয়নি। নানা কারণে, নানা রকম উদ্দেশ্যে হাদীস রচিত হয়েছে। এমনকি বেগুন বিক্রেতা  তার বেগুনের বিক্রয় বাড়ানোর জন্য সনদসহ হাদীস বর্ণনা করা শুরু করেছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, اَلْبَاذِنْجَانُ شِفَاءٌ مِنْ كُلِّ دَاءٍ  (বেগুন সর্বরোগের মহৌষধ)। তবে মুহাদ্দিসগণ সেসব জাল হাদীসকে চিহ্নিত করে দিয়েছেন। এবং মুহাদ্দিসগণ সহীহ হাদীসের সংকলনের ন্যায় জাল হাদীসেরও সংকলন  তৈরি করেছেন। যাতে মানুষ কোন্টি জাল হাদীস কোন্টি সহীহ হাদীস তা সহজেই জেনে যেতে পারে। তো মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব যেসব মত পোষণ করেন জাল হাদীসের কিতাবে তালাশ করলে সেসবের পক্ষেও বহু জাল হাদীস পাওয়া যাবে। মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবের পোষিত মত উল্লেখ করে কেউ যদি জাল হাদীসের ঐ সকল কিতাব হতে ঐ মতের পক্ষে একটি জাল হাদীস উল্লেখ করে, আর বলে যে, এই মতটি জাল হাদীসের কবলে আক্রান্ত তাহলে মুযাফ্ফর বিন মুহসিন সাহেব কী জবাব দেবেন?  তিনি যে জবাব দেবেন সেই একই জবাব প্রযোজ্য হবে এ দেশে প্রচলিত অনেক মাসআলা-মাসায়েলের পক্ষে তাঁর কর্তৃক জাল হাদীস উল্লেখ করণের ক্ষেত্রে।

 লেখক যেহেতু ইকামতের বাক্যগুলো দুইবার করে বলার পক্ষে একটি হাদীসও উল্লেখ করেননি সেহেতু আমি আপনার জ্ঞাতার্থে সেসব হাদীস উল্লেখ করে আলোচনা পর্যালোচনা করতে চাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে যদিও হাদীসগুলো শুধু উল্লেখ করলেই চলত কিন্তু যেহেতু ইন্টারনেটে কোনো একজন লা মাযহাবী ভাই (সম্ভবত তিনি মুযাফ্ফর বিন মুহসিন সাহেবই হবেন) সেসব হাদীসের উপর আপত্তি উত্থাপন করেছেন সেহেতু হাদীসগুলোর এদিক সেদিক নিয়ে এবং ঐ বন্ধুর আপত্তিগুলোর যথার্থতা  কতটুকু তা নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনার প্রয়োজন উপলব্ধি করছি।

 

সূচনা কথা

মুহতারাম, আপনি জানেন যে, পূর্বে আযানের প্রচলন ছিল না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় আগমনের পর সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে পরামর্শ করলেন যে, কীভাবে সহজ পন্থায় লোকজনকে জামাআতে উপস্থিতির জন্য আহক্ষান করা যায়। কেউ পরামর্শ দিলেন যে, আগুন জ্বালিয়ে জানান দেওয়া হোক- জামাআত অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। কেউ  পরামর্শ দিলেন, নাকূস (একজাতীয় ঘণ্টা, কেউ বলেন, শিংগা) বাজিয়ে জানান দেওয়া হোক যে, জামাআত অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। কিন্তু এগুলো যেহেতু ইহুদী নাসারাদের সাথে সাদৃশ্য সৃষ্টি করে তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসব পরামর্শ গ্রহণ করলেন না। হযরত উমর রাযি. পরামর্শ দিলেন, الصَّلَاةُ جَامِعَةٌ  (সালাতের জামাআত অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে) বাক্য দ্বারা মানুষকে আহক্ষান জানানো হোক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরামর্শটি গ্রহণ করলেন এবং হযরত বেলাল রাযি.-কে নির্দেশ দিলেন এই বাক্যটি উচ্চস্বরে উচ্চারণ করে মানুষকে সালাতের জামাআতে উপস্থিত হতে আহক্ষান জানাতে। কিছুদিন এই অনুযায়ী আমল চলার পর অবশেষে বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন যায়েদ ইবনে আবদি রাবিক্ষহী রাযি. একদিন স্বপ্নে দেখলেন, একজন লোক হাতে নাকূস  নিয়ে যাচ্ছে। তিনি লোকটিকে অনুরোধ করলেন নাকূসটি তাঁকে দিতে। লোকটি জিজ্ঞেস করল, তুমি এটা দিয়ে কী করবে? আব্দুল্লাহ ইব্ন যায়েদ রাযি. বললেন, আমি এটা দিয়ে মানুষকে সালাতের জন্য আহক্ষান জানাব। লোকটি বলল, আমি তোমাকে এর চেয়ে উত্তম পদ্ধতি শিক্ষা দিচ্ছি। এরপর লোকটি   আযানের শব্দগুলো উচ্চারণ করল এবং বলল, তুমি এই বাক্যগুলো দিয়ে মানুষকে সালাতের প্রতি আহক্ষান জানাবে। লোকটি এরপর ইকামতের বাক্যগুলোও শিক্ষা দিল। পরদিন হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন যায়েদ ইবনে আবদি রাবিক্ষহী স্বপ্নটির বৃত্তান্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানালে তিনি এটাকে অনুমোদন দান করলেন এবং আব্দুল্লাহ ইব্ন যায়েদকে বললেন আযান ও ইকামতের বাক্যগুলো বেলালকে শিখিয়ে দিতে। কেননা, তাঁর গলার স্বর ছিল আব্দুল্লাহ ইবন যায়েদ অপেক্ষা উচ্চতর। এরপর থেকে সেই অনুযায়ী হযরত বেলাল রাযি. আযান ও ইকামত দিতে থাকলেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন যায়েদ ইবন আবদি রাবিক্ষহী রাযি.-এর ঐ স্বপ্নের বাক্যগুলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক আযান ও ইকামতের বাক্য হিসেবে অনুমোদিত হওয়ার কারণে তা শরীয়তের বিধানরূপে বিধিবদ্ধ হয়ে গেল।

আযানের এই সংক্ষিপ্ত ইতিহাস দ্বারা বোঝা গেল যে, হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন যায়েদ ইবনে আবদি রাবিক্ষহী স্বপ্নে যে বাক্যগুলো শিখেছিলেন সেই বাক্যগুলোই আযান ও ইকামতের বাক্যরূপে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক অনুমোদিত হয় এবং হযরত বেলাল রাযি. ঐ বাক্যগুলো দ্বারাই আযান ও ইকামত দিতেন।

অনুসন্ধানের বিষয় হল, আযান ও ইকামতের সেই বাক্যগুলো কী ছিল? তো আমরা হাদীসের ভা-ার তালাশ করে দেখতে পাই যে, যে বাক্যগুলো দ্বারা বর্তমানে সারা বিশ্বে আযান দেওয়া হচ্ছে এই বাক্যগুলোই   হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন যায়েদ ইবনে আবদি রাবিক্ষহীর স্বপ্নে দেখা আযানের বাক্য ছিল। এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত নেই। তবে ইকামতের বাক্যগুলো কী ছিল সে ব্যাপারে দুই রকম বর্ণনা পাওয়া যায়।

একরকম  বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, ইকামতের বাক্যগুলো ছিল একবার করে। অর্থাৎ শুরুতে দুই জোড়া আল্লাহু আকবার এর পরিবর্তে ইকামতে এক জোড়া আল্লাহু আকবার। অতপর আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ,  আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ,  হাইয়া আলাস সালাহ, হাইয়া আলাল ফালাহ একবার করে; এরপর কাদ কামাতিস সালাহ দুইবার, আল্লাহু আকবার দুইবার এবং লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ একবার।

আরেক রকম বর্ণনায় পাওয়া যায় যে,  ইকামতের বাক্যগুলো ছিল কাদ কামাতিস সালাহ বাক্যটিসহ আযানের অনুরূপ দুইবার করে।

 

জোড়া বাক্যে ইকামত দেওয়ার পক্ষে দলীল

দলীল-১

আব্দুল্লাহ ইব্ন যায়েদ রাযি.-এর দেখা স্বপ্নে ইকামতের বাক্যগুলো ছিল দুইবার করে

 জোড়া বাক্যে ইকামত : হাদীস-১

  عَنْ عَبْدِ الرَّحْمنِ بْنِ أَبِي لَيْلى قَالَ : حَدَّثَنَا أَصْحَابُ مُحَمد صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؛ أَنَّ عَبْدَ اللهِ بْنَ زَيْدٍ الأَنْصَارِيَّ جَاءَ إِلى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ : يَا رَسُولَ اللهِ، رَأَيْتُ فِي الْمَنَامِ كَأَنَّ رَجُلاً قَامَ وَعَلَيْهِ بُرْدَانِ أَخْضَرَانِ عَلَى جِذْمَةِ حَائِطٍ ، فَأَذَّنَ مَثْنَى ، وَأَقَامَ مَثْنَى ، وَقَعَدَ قَعْدَةً ، قَالَ : فَسَمِعَ ذَلِكَ بِلاَلٌ ، فَقَامَ فَأَذَّنَ مَثْنَى ، وَأَقَامَ مَثْنَى، وَقَعَدَ قَعْدَةً.

 আব্দুর রহমান ইব্ন আবী লায়লা বলেন, আমাদের নিকট মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বহু সাহাবী বর্ণনা করেছেন যে, আব্দুল্লাহ ইব্ন যায়েদ আলআনসারী রাযি. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসলেন এবং বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি স্বপ্নে দেখলাম, যেন সবুজ একজোড়া কাপড় পরিহিত এক ব্যক্তি একটি দেয়ালের ভগ্নাবশেষের উপর দাঁড়ালেন, অতপর আযান দিলেন জোড়া জোড়া শব্দে এবং ইকামত দিলেন জোড়া জোড়া শব্দে। আর (আযান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়ে) কিছুক্ষণ বসলেন। (তথা আযানের পরে কিছুক্ষণ বসে বিরতি দিলেন, তারপর ইকামত দিলেন।) -আল মুসান্নাফ, হাদীস ২১৩১; ত্বহাবী, ১ ম খ-, পৃষ্ঠা ৪২০; আস সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী, হাদীস ২০৫৪

মুহতারাম, হাদীসটি আমাদেরকে জানান দেয় যে, হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন যায়েদ ইব্ন আবদি রাবিক্ষহী স্বপ্নে আযান ও ইকামত উভয়টির বাক্যগুলো দুইবার করে দেখেছিলেন, আর হযরত বেলালও (রাযি.) তদানুসারে আযান ও ইকামত জোড়া জোড়া বাক্যে দিয়েছিলেন।

 

 হাদীসটির উপর উত্থাপিত আপত্তি ও পর্যালোচনা

জনাব মাওলানা আব্দুল মতিন সাহেবের বহুল সমাদৃত বই দলিলসহ নামাযের মাসায়েল বইটির জবাব লিখতে গিয়ে এই হাদীসটির উপর ইন্টারনেটে কোনো এক বন্ধু (আমার ধারণায় তিনি মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবই হবেন) বেশ কিছু আপত্তি উত্থাপন করেছেন। তিনি লিখেছেন : এই হাদীসটি তাবেঈ আব্দুর রহমান বিন আবী লায়লা থেকে নানারকম সন্দেহযুক্ত সনদে বর্ণিত হয়েছে। যেমন- (ক) কখনো বর্ণনা করেছেন নামহীন সাহাবীদের মধ্যস্থতায় সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে যায়েদ আলআনসারী (রা) থেকে। [এই সনদটিতে আমাশ আছেন। তিনি মুদাল্লিস এবং তিনি আন দ্বারা বর্ণনা করেছেন সুতরাং হাদীসটি যঈফ।] (খ) কখনো সরাসরি আব্দুল্লাহ ইবন যায়েদ আল আনসারী (রা) থেকে। (গ) কখনো সাহাবী মুআয বিন জাবাল (রা)-এর মধ্যস্থতায় সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে যায়েদ আলআনসারী (রা) থেকে। অর্থাৎ আব্দুর রহমান বিন আবী লায়লা নিজেই সনদটিকে বিতর্কিত করেছেন। তাছাড়া তিনি শেষোক্ত দুজন সাহাবীর কাছ থেকে হাদীস শোনেননি।

 

আমার বক্তব্য

মুহতারাম, আপত্তিকারী লিখেছেন যে, হাদীসটি নানারকম সন্দেহযুক্ত সনদে বর্ণিত হয়েছে। আমার বক্তব্য হল, নানারকম নয়, বরং সন্দেহযুক্ততার রকম একটিই। সেটি হল, তাবিঈ আব্দুর রহমান ইব্ন আবী লায়লা রাহ. আব্দুল্লাহ ইব্ন যায়েদ রাযি.-এর আযান ও ইকামত সংক্রান্ত বর্ণনাটি  কার নিকট থেকে শুনে বর্ণনা করেছেন। মুআয ইব্ন জাবাল রাযি.-এর নিকট থেকে, না সরাসরি আব্দুল্লাহ ইব্ন যায়েদ রাযি.-এর নিকট থেকে, না অন্য কোনো সাহাবী থেকে?

এর জবাব হল, তিনি মুআয ইব্ন জাবাল বা আব্দুল্লাহ ইব্ন যায়েদ রাযি.-এর নিকট থেকে বর্ণনাটি শোনেননি  তা নিশ্চিত। তবে এটাও নিশ্চিত যে, তিনি অন্যান্য বহু সাহাবী থেকে শুনেছেন। কারণ, তিনি  একজন জ্যেষ্ঠ, অগ্রজ ও প্রবীণ তাবিঈ।  একশত বিশজন সাহাবীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ লাভ হয়েছে। তিনি এই হাদীসটি বর্ণনা করতে গিয়ে বলছেন যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বহু সাহাবী আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন যে,...।  আর এই কথাটি যে সনদে বর্ণিত হয়েছে সেই সনদটি দেখুন কিরূপ শক্তিশালী। আবূ বাকর ইব্ন আবূ শায়বাহ রাহ. তাঁর আলমুসান্নাফ গ্রন্থে বলছেন যে,

حَدَّثَنَا وَكِيْعٌ قَالَ حَدَّثَنَا الْاَعْمَشُ عَنْ عَمْرٍو بْنِ مُرَّةَ عَنْ عَبْدِ الرَّحْمنَ بْنِ اَبِىْ لَيْلَى قَالَ حَدَّثَنَا اَصْحَابُ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إلخ

অতএব সন্দেহ ও সত্যতার অনিশ্চয়তা এখানে কর্পুরের ন্যায় উবে যায়। নিশ্চয়তা ও প্রত্যয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে দিবালোকের ন্যায়। আর এই কারণেই অন্য আরও দুটি পন্থায় আপত্তিকারী হাদীসটিকে ঘায়েল করতে চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, এক : কখনো বর্ণনা করেছেন নামহীন সাহাবীদের মধ্যস্থতায়। দুই : এই সনদটিতে আমাশ আছেন। তিনি মুদাল্লিস এবং তিনি আন দ্বারা বর্ণনা করেছেন। সুতরাং হাদীসটি যঈফ।

মুহতারাম, আপত্তিকারীর  আপত্তি দুইটি তাঁর জ্ঞানের অপ্রতুলতার অথবা তাঁর জ্ঞানপাপীতার এক মহা দৃষ্টান্ত। কারণ, নামহীন অন্য কোনো ব্যক্তির হাদীস যঈফ বলে গণ্য হয়ে থাকে এজন্য যে,  নামহীনতার কারণে লোকটি  সম্পর্কে জানা সম্ভব হয় না যে, তিনি নির্ভরযোগ্য কি না। কিন্তু সাহাবীদের সম্পর্কে উম্মতের সর্বসম্মত অভিমত হল তাঁরা সকলেই নির্ভরযোগ্য। কাজেই নামহীনতার কারণে কোনো সাহাবী সম্পর্কে এই সন্দেহ ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হতে পারে না যে, তিনি নির্ভরযোগ্য কি না। তারপরও দেখুন, মাত্র একজন সাহাবী নয় বরং আব্দুর রহমান ইব্ন আবী লায়লা বলছেন যে, বহু সাহাবী আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন। এর পরও কি কোনো সন্দেহ উত্থাপন করা যায়? তার পরও আপত্তিকারী দ্বিতীয় আরেকটি পন্থা অবলম্বন করেছেন । তিনি বলেছেন, আমাশ মুদাল্লিস এবং তিনি আন দ্বারা বর্ণনা করেছেন। সুতরাং হাদীসটি যঈফ।

মুহতারাম, এই জাতীয় মূর্খতাপ্রসূত কথা নিয়ে আলোচনা করার অর্থ হল সময় নষ্ট করা। আরে ভাই আপত্তিকারী! আমাশের আন দ্বারা বর্ণনা যদি হাদীস যঈফ হওয়ার কারণ হয় তাহলে বুখারী ও মুসলিমের একটি নয়, দুটি নয়, প্রচুর হাদীস যঈফ বলে গণ্য হবে। বুখারী ও মুসলিম খুলুন এবং পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকুন। দেখবেন যে, সহীহ  বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বহু হাদীস রয়েছে এরূপ যা আমাশ কর্তৃক আন দ্বারা বর্ণিত।  এই পর্যন্ত লেখার পর ইচ্ছা হল একটু খুঁজে দেখতে। তো কম্পিউটার আমাদেরকে জানান দিল যে,  মাশ কর্তৃক আন দ্বারা বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা বুখারী ও মুসলিমে মোট পাঁচশত পঁচিশটি। তন্মধ্যে বুখারীতে একশত আটাশিটি এবং মুসলিমে তিনশত সাঁইত্রিশটি। ঠিক আমাদের আলোচ্য সনদেই তথা আম্র ইব্ন মুর্রাহ থেকে আন দ্বারা বর্ণিত আমাশের হাদীসের সংখ্যা আটটি। সহীহ বুখারীতে দুইটি এবং সহীহ মুসলিমে ছয়টি। আপত্তিকারীকে বলছি, আমাশ কর্তৃক আন দ্বারা বর্ণিত বুখারী ও মুসলিমের ৫২৫ টি হাদীসকে  আপনি কী বলবেন? যঈফ বলবেন? বলুন। তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। আপনারা তো আপনাদের মতামত প্রমাণ করতে সহীহ হাদীসকেও জাল বলতে দ্বিধা করেন না। আবার  জাল ও যঈফ হাদীসকেও সহীহ বলতে দ্বিধা করেন না।

মুহতারাম, একমুখী অধ্যয়ন ও আংশিক অধ্যয়ন দ্বারা  সঠিক পথ প্রাপ্ত হওয়া যায় না। উল্টো তা দ্বারা ব্যক্তি নিজে বিভ্রান্তিতে নিপতিত হয় এবং অন্যকেও বিভ্রান্তিতে নিপতিত করে।

আল জারহু ওয়াত তাদীলের কিতাবাদিতে আমাশকে মুদাল্লিস বলা হয়েছে। এবং এটাকেই মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবগণ তাঁদের মত প্রমাণ করতে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছেন। বলেছেন, আমাশ যেহেতু মুদাল্লিস এবং তিনি আন দ্বারা বর্ণনা করেছেন, কাজেই হাদীসটি যঈফ। তাঁরা এ দেশের আলেমসমাজকে সম্পূর্ণ মূর্খ মনে করেছেন। তাঁরা মনে করেছেন, আলেমগণ এটা জানতে চেষ্টা করবে না যে, আমাশ মুদাল্লিস হওয়া সত্ত্বেও ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম রাহ. তাঁর মুআনআন হাদীসকে কেন গ্রহণ করেছেন।

 

মুদাল্লিস রাবীর স্তরভেদ ও ইমাম বুখারী ও মুসলিম কর্তৃক আমাশের মুআনআন হাদীস গ্রহণের কারণ

দেখুন, হাফেয ইব্ন হাজার আসকালানী রাহ. কর্তৃক প্রণীত  একটি  বিখ্যাত গ্রন্থের নাম তাবাকাতুল মুদাল্লিসীন।  এই গ্রন্থে তিনি মুদাল্লিস বর্ণনাকারীদেরকে পাঁচ স্তরে বিভক্ত করেছেন। আমাশকে তিনি দ্বিতীয় স্তরের মুদাল্লিসগণের  অন্তর্ভুক্ত  বলে  ব্যক্ত  করেছেন। আর  গ্রন্থটির ভূমিকায় তিনি দ্বিতীয় স্তরের মুদাল্লিসগণের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন :

الثَانِيَةُ مَنِ اِحْتَمَلَ الْأَئِمَّةُ تَدْلِيْسَهُ وَأَخْرَجُوْا لَهُ فِي الصَّحِيْحِ لِإِمَامَتِهِ وَقِلَّةِ تَدْلِيْسِهِ فِىْ جَنْبِ مَا رَوَى كَالثَّوْرِى أَوْ كَانَ لَايُدَلِّسُ  إِلَّا عَنْ ثِقَةٍ كَإِبْنِ عُيَيْنَةَ.

অর্থাৎ দ্বিতীয় প্রকার হল, ঐ মুদাল্লিস যাঁর তাদলীসকে মুহাদ্দিসগণ সহনীয় বলে গণ্য  করেছেন এবং তাঁর হাদীসকে তাঁরা সহীহ গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছেন। এর কারণ, ঐ মুদাল্লিস হয়তো এরূপ মুদাল্লিস যিনি হাদীসের ক্ষেত্রে ইমাম পর্যায়ের এবং তাঁর কর্তৃক বর্ণিত প্রচুর হাদীসের তুলনায় তাঁর তাদলীসের সংখ্যা নেহায়েতই স্বল্প। যেমন সুফইয়ান ছাওরী। অথবা তিনি এরূপ মুদাল্লিস যিনি শুধু ছিকাহ রাবী হতেই তাদলীস করে থাকেন। যেমন সুফ্ইয়ান ইব্ন উয়াইনাহ।

 মাশও ঠিক সুফ্ইয়ান ছাওরীর ন্যায়। তিনি হাদীসের ক্ষেত্রে ইমাম পর্যায়ের এবং তাঁর কর্তৃক বর্ণিত প্রচুর হাদীসের তুলনায় তাঁর তাদলীসের সংখ্যা নেহায়েতই স্বল্প। তাছাড়া তিনি তাঁর যে সকল উস্তায থেকে প্রচুর পরিমাণে হাদীস বর্ণনা করেছেন তাঁদের থেকে যখন তিনি আন দ্বারা হাদীস বর্ণনা করেন তখন তাঁর সেই বর্ণনা  সন্দেহাতীতভাবে  গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। আল্লামা যাহাবী তাঁর আল মীযান গ্রন্থে আমাশ সম্পর্কে এমনটাই বলেছেন।

আর এই কারণেই ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম রাহ. তাঁদের কিতাবে আমাশ কর্তৃক বর্ণিত মুআনআন হাদীস একটি দুটি নয়, বরং পাঁচ শতাধিক মুআআন হাদীসকে স্থান দিয়েছেন। এসব হাদীসকে মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবগণ কী বলবেন? যঈফ? বলুন। তাহলে আর বুখারী বুখারী করে চিৎকার করবেন না। কারণ, একজন রাবী কর্তৃক বর্ণিত একশত আটাশিটি হাদীসই যদি যঈফ হয় তাহলে বুখারী আর বুখারী থাকবে না।

অতপর আপত্তিকারী লিখেছেন, অর্থাৎ আব্দুর রহমান ইবনে আবী লায়লা নিজেই সনদটিকে বিতর্কীত করেছেন। তাছাড়া তিনি শেষোক্ত দুজন (তথা মুআয বিন জাবাল ও আব্দুল্লাহ ইবনে যায়দ আল আনসারী (রাযি.) সাহাবীর (রা) কাছ থেকে হাদীস শোনেননি। এরপর তিনি এর সমর্থনে ইমাম বায়হাকীর নিমেণাক্ত মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন।

قَالَ الْبَيْهَقِيُّ فِي كِتَابِ الْمَعْرِفَةِ: حَدِيثُ عَبْدِ الرَّحْمنِ بْنِ أَبِي لَيْلى قَدْ اُخْتُلِفَ عَلَيْهِ فِيه، فَرُوِيَ عَنْهُ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ زيد وَرُوِىَ عَنْهُ عَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ، وَرُوِيَ عَنْهُ، قَالَ: حَدَّثَنَا أَصْحَابُ مُحَمَّدٍ، قَالَ ابْنُ خُزَيْمَةَ: عَبْدُ الرَّحْمنِ بْنُ أَبِي لَيْلَى لَمْ يَسْمَعْ مِنْ مُعَاذٍ، وَلَا مِنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ زَيْدٍ، وَقَالَ مُحَمَّدُ بْنُ إسْحَاقَ: لَمْ يَسْمَعْ مِنْهُمَا وَلَا مِنْ بِلَالٍ، فَإِنَّ مُعَاذًا تُوُفِّيَ فِي طَاعُونِ عَمَوَاسَ سَنَةَ ثَمَان عَشرَةَ، وَبِلَالٌ تُوُفِّيَ بِدِمَشْقَ سَنَة عِشْرِينَ، وَعَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ أَبِي لَيْلى وُلِدَ لِسِتٍّ بَقيْنَ مِنْ خِلَافَةِ عُمَرَ، وَكَذلِكَ قَالَهُ الْوَاقِدِيُّ. وَمُصْعَب الزُّبَيْرِيُّ، فَثَبَتَ انْقِطَاعُ حَدِيثِه.

ইমাম বায়হাকীর এই ইবারতটুকুর তরজমা করার পূর্বে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি আপত্তিকারীর বক্তব্যের দিকে। আপত্তিকারী বলেছেন, অর্থাৎ আব্দুর রহমান ইবনে আবী লায়লা নিজেই সনদটিকে বিতর্কীত করেছেন। আবার ইমাম বায়হাকীর বক্তব্যের আন্ডারলাইন করা অংশটুকুর তরজমায় তিনি লিখেছেন, আব্দুর রহমান ইবনে আবী লায়লা হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে বিতর্কীত হয়েছেন।

এবার বুঝুন আপত্তিকারীর ভাষাজ্ঞান কতটুকুন? আরবী তো দূরের, বাংলা ভাষাজ্ঞানই বা তাঁর কতটুকুন তা দেখুন।  প্রথমে তো আব্দুর রহমান ইবনে আবী লায়লা নিজেই সনদটিকে বিতর্কিত করলেন, অতপর সনদটি বিতর্কিত হল না, তিনি নিজেই বিতর্কিত হলেন। তাও আবার সনদ বর্ণনার ক্ষেত্রে নয়, হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে ।

ইমাম বায়হাকীর মন্তব্যের সহীহ তরজমা : ইমাম বায়হাকী বলেন, আব্দুর রহমান ইব্ন আবী লায়লার (আলোচ্য) হাদীসটিকে তাঁর থেকে বর্ণনার ক্ষেত্রে বিভিন্নতার সৃষ্টি হয়েছে। কখনও বর্ণিত হয়েছে এভাবে যে, তিনি বলেছেন,  আব্দুল্লাহ ইব্ন যায়েদ থেকে;  কখনও এভাবে যে, তিনি বলেছেন, মুআয থেকে;  আর কখনও এভাবে যে, তিনি  বলেছেন, আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীগণ।  ইবনে খুযায়মাহ বলেন, আব্দুর রহমান ইব্ন আবী লায়লা মুআয থেকে শোনেননি এবং আব্দুল্লাহ ইব্ন যায়েদ থেকেও শোনেননি। মুহাম্মাদ ইব্ন ইসহাক বলেন, তাঁদের দুইজন থেকে তিনি শোনেননি এবং বেলাল থেকেও শোনেননি। কেননা, মুআয ইন্তেকাল করেন আঠারো হিজরীতে আমওয়াসের মহামারীতে, আর বেলাল ইন্তেকাল করেন বিশ হিজরীতে দামেস্কে। আর আব্দুর রহমান ইব্ন আবী লায়লা জন্মগ্রহণ করেন উমরের খেলাফতকাল শেষ হওয়ার ছয় বছর পূর্বে। ওয়াকিদী ও মুসআব আয্যুবাইরীও তেমনটাই বলেছেন। সুতরাং আব্দুর রহমান ইব্ন আবী লায়লার হাদীসটির সুত্রবিচ্ছিন্নতা প্রমাণিত হল। 

 ইমাম বায়হাকীর মন্তব্যের সারকথা হল, আব্দুর রহমান ইব্ন আবী লায়লা  হাদীসটি যার নিকট হতে শুনে বর্ণনা করেছেন বা অন্য ভাষায় বললে, এ ক্ষেত্রে তাঁর উস্তায যিনি তার ব্যাপারে বিভিন্ন রকম বর্ণনা পাওয়া যায় যে, তিনি কে? ইমাম বায়হাকী সেই বিভিন্নতার বিবরণ দান করেছেন।

 তো এই বিভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে পরবর্তী কোনো বর্ণনাকারী কর্তৃক, আব্দুর রহমান ইবন আবী লায়লা কর্তৃক নয়। তিনি সনদটিকে বিতর্কিত করেননি বা হাদীসের ক্ষেত্রেও তিনি বিতর্কিত হননি। হাদীসের সনদ বিভিন্ন রকম বর্ণিত হয়েছে, আর এই বিভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে পরবর্তী কোনো বর্ণনাকারী কর্তৃক।

 

ইমাম বায়হাকীর মন্তব্যের পর্যালোচনা

আমরা পূর্বেই বলেছি যে, সহীহ সনদ প্রমাণ করে যে, আবদুর রহমান ইব্ন আবী লায়লা হাদীসটি শ্রবণ করেছেন বহু সাহাবী হতে। ইমাম বায়হাকী কর্তৃক উদ্ধৃত ইব্নে খুযায়মাহর বক্তব্যে ইব্নে খুযায়মাহ রাহ. মুআয ইবনে জাবাল ও আব্দুল্লাহ ইবনে যায়দের বরাতে বর্ণিত হাদীসকে  সুত্রবিচ্ছিন্ন বলেছেন, কিন্তু যে সনদে আব্দুর রহমান ইব্ন আবী লায়লার উক্তি বর্ণিত হয়েছে যে, আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ সেই সনদ সম্পর্কে এখানে তিনি কোন মন্তব্যই করেননি। ইমাম বায়হাকীও সেই সনদ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি। একটু পরে ইবনে খুযায়মাহ রাহ.-এর বক্তব্য আমি উদ্ধৃত করব যদ্দারা আমার এই দাবি প্রমাণিত হবে ইনশাআল্লাহ। 

 বিষয়টি মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব বা তাঁর পক্ষের আপত্তিকারীও বোধ হয় বুঝেছেন। আর এ কারণেই আপত্তিকারী এরপর লিখেছেন, এক্ষণে অন্যান্য সাহাবীদের থেকে আব্দুর রহমান বিন আবী লায়লার হাদীসটি

(ক) মুদাল্লিস আমাশের মুআআন বর্ণনার কারণে যঈফ।

(খ) এছাড়া আবু দাউদ বর্ণিত আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ (রা) এর আযানের ইতিহাস সম্পর্কিত অপর একটি সহীহ হাদীসের বিরোধী।

‘‘মাশের  মুআআন বর্ণনার কারণে যঈফ’’ কথাটি তিনি পুনরাবৃত্তি করলেন। এ সম্পর্কে পূর্বেই আমি বিস্তারিত আলোচনা করে এসেছি যে, তাহলে বুখারী ও মুসলিমের পাঁচশতাধিক হাদীসকে যঈফ বলতে হবে। তাছাড়া হাদীসটি আমর ইব্ন মুররাহ থেকে শুধু আমাশ নয়, শুবাও বর্ণনা করেছেন। দ্রষ্টব্য, মুসান্নাফ, হাদীস ২১৩৭; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস ৫০৬

আর আব্দুর রহমান ইবন্ আবী লায়লার হাদীসটি আবূ দাউদের যে সহীহ হাদীসের বিরোধী বলে আপত্তিকারী  দাবি করেছেন সেই হাদীসটি সহীহ নয়, হাসান পর্যায়ের। আপত্তিকারী নিজেই হাদীসটির বিবরণদানের পর শুআইব আরনাউতকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, হাদীসটি হাসান। উল্লেখ্য, হাদীসটি আবূ দাউদের ৪৯৯ নং হাদীস। তো হাসান বর্ণনার বিপরীত হওয়ায় কোনো সহীহ হাদীসের প্রামাণ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায় না।

 

ইবনে খুযায়মাহর মন্তব্য নিয়ে আলোচনা

মুহতারাম,  ইবনে খুযায়মাহ রাহ. তাঁর সহীহ গ্রন্থে আব্দুর রহমান ইব্ন আবী লায়লার হাদীস সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন এই কথা বলে-

فَاَمَّا مَا رَوَى الْعِرَاقِيُّوْنَ عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ زَيْدٍ فَقَدْ ثَبَتَ مِنْ جِهْةِ النَّقْلِ وَقَدْ خَلَطُوْا فِيْ أَسَانِيْدِهِمْ.

অর্থাৎ ইরাকীরা আব্দুল্লাহ ইব্ন যায়েদ থেকে যা বর্ণনা করেছেন তা বর্ণনাগত দিক দিয়ে প্রমাণিত। তবে তাঁরা তাঁদের সনদে গোল পাকিয়ে ফেলেছেন।

ইব্ন খুযায়মাহর এই মন্তব্য আমার পূর্বের দাবিকে জোরালো করে যে, আব্দুর রহমান ইব্ন আবী লায়লার হাদীসটির যে সনদে তিনি এই কথা বলেছেন যে, আমার নিকট বর্ণনা করেছেন সাহাবীগণ সেই সনদটির সুত্রবিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে ইব্ন খুযায়মাহ কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি এখানে বলছেন যে, ইরাকীরা সনদে গোল পাকিয়ে ফেললেও  হাদীসটি বর্ণনাগত দিক থেকে প্রমাণিত। সনদে গোল পাকানো সত্ত্বেও হাদীসটি প্রমাণিত হল কেন? তার কারণ এটাই যে, ঐ সনদটি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং মুত্তাসিল সনদ।

যে ইরাকী বর্ণনাকারীগণ তা সঠিকভাবে ইয়াদ করতে না পেরে বর্ণনাতে ভুল করেছেন, তাদের ভুলের প্রভাব সহীহ বর্ণনার উপর কিছুতেই পড়বে না। 

এরপর আপত্তিকারী  বলেছেন, (গ) আব্দুল্লাহ ইবনে যায়েদের (রা) শেষোক্ত হাদীসটির (তথা ৪৯৯ নং হাদীস) সমর্থনে সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিমসহ অন্যান্য সুনান গ্রন্থে একাধিক সাহাবী থেকে বেজোড় ইকামতের হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যা থেকে বুঝা যায়, ইবনে আবী লায়লার আব্দুল্লাহ ইবনে যায়েদ (রা) এর জোড় ইকামতের হাদীসটি অধিকাংশ সহীহ বর্ণনার বিরোধী বিধায় শায হাদীস হওয়ায় বর্জনীয়। অর্থাৎ ইবনে আবী লায়লা রাহ. থেকে সনদ ও মতন উভয় দিক থেকেই হাদীসটির যঈফ ও অগ্রহণযোগ্য হওয়া সুস্পষ্ট।

এই আপত্তিটি এখানে প্রযোজ্য নয়। এবং এই আপত্তিটি আমার আলোচনাকে বাধাগ্রস্ত করে না। কারণ, আমার আলোচনা চলছে আযানের ইতিহাস সংক্রান্ত হাদীস নিয়ে। এই বিষয় নিয়ে যে, আব্দুল্লাহ ইব্ন যায়েদ রাযি. কর্তৃক স্বপ্নে দেখা আযান ও ইকামতের বাক্যগুলো কীরূপ ছিল। আর সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমসহ অন্যান্য সুনান গ্রন্থের যে হাদীসের কথা আপত্তিকারী বলেছেন তা আযানের ইতিহাস সংক্রান্ত নয়। সেটি ভিন্ন প্রকৃতির হাদীস। তা নিয়ে পরে আমরা আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। বাকি রইল শায হওয়ার দাবি। তো বলছি যে, কোনো হাদীস আরেকটি হাদীসের বিরোধী হলেই শায হয়ে যায় না। এই বিষয়টি নিয়েও আমরা পরে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

এরপর (ঘ) চিহ্নযুক্ত করে আপত্তিকারী দলীলসহ নামাযের মাসায়েল গ্রন্থের প্রণেতা মাওলানা আব্দুল মতিন ছাহেবের উপর আপত্তি উত্থাপন  করেছেন যে, তাছাড়া লেখক ইবনে হাযম রাহ. থেকে হাদীসটি সম্পর্কে আংশিক মন্তব্য উল্লেখ করেছেন। ইবনে আবী লায়লা রাহ. এর উক্ত হাদীসটি সম্পর্কে ইবনে হাযম রাহ. এর বক্তব্য নিমণরূপ :

وَهَذَا إسْنَادٌ فِي غَايَةِ الصِّحَّةِ مِنْ إسْنَادِ الْكُوفِيِّينَ فَصَحَّ أَنَّ تَثْنِيَةَ الْإِقَامَةِ قَدْ نُسِخَتْ؛ وَأَنَّهُ هُوَ كَانَ أَوَّلَ الْأَمْرِ؛ وَعَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ أَبِي لَيْلَى أَخَذَ عَنْ مِائَةٍ وَعِشْرِينَ مِنْ الصَّحَابَةِ؛ وَأَدْرَكَ بِلَالًا وَعُمَرَ -رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا-؛ فَلَاحَ بُطْلَانُ قَوْلِهِمْ بِيَقِينٍ.

এই সনদটি কুফীদের সনদের থেকে বেশী সহীহ। এ পর্যায়ে সহীহর দাবী হল, দুইবার করে ইকামত বলাটা মানসূখ হয়েছে। আর সেটা প্রথম দিককার হুকুম ছিল। আর আবী লায়লা একশত বিশজন সাহাবী থেকে বর্ণনা এবং বিলাল ও উমার (রা) দুজনের সাথে সাক্ষাত- এগুলো তাঁর উক্তি হিসাবে নিশ্চিত বাতিল। (আপত্তিকারীর অনুবাদ)

ইব্ন হায্ম (রাহিমাহুল্লাহ)-র বক্তব্য নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনার পূর্বে প্রসঙ্গত বলছি যে, এই সকল ডক্টরেট ডিগ্রীধারী ব্যক্তিরা না আরবী বোঝে, না সহীহ শুদ্ধভাবে বাংলা লিখতে জানে। আন্ডার লাইন করা  অংশের মধ্য হতে বোল্ড করা অংশটুকু দেখুন। বাংলা ব্যাকরণের কোন নিয়ম অনুযায়ী বাক্যটি গঠিত হয়েছে? আর আরবী না বোঝার ব্যাপারটি তো আরও শোচনীয়।

তরজমাটি হওয়া উচিত এইরূপ : আর এটা কূফীদের সনদের মধ্য হতে চূড়ান্ত পর্যায়ের সহীহ সনদ। সুতরাং সহীহভাবে প্রমাণিত হল যে, দুইবার করে ইকামত বলাটা মানসূখ হয়ে গেছে এবং তা ছিল প্রথম দিকে। আর আব্দুর রহমান ইব্ন আবী লায়লা একশত বিশজন সাহাবী থেকে হাদীস গ্রহণ করেছেন এবং হযরত উমার ও বেলালকে পেয়েছেন। অতএব তাদের মতটি বাতিল হওয়াটা নিশ্চিতভাবে স্পষ্ট হয়েছে।

 

ইব্ন হাযম রাহ.-এর মন্তব্য ও পর্যালোচনা

 মুহতারাম, আযানের ইতিহাস সংক্রান্ত আলোচ্য হাদীসটি  (যে হাদীসকে আমাশের মুআনআন বর্ণনার কারণে আপত্তিকারী  যঈফ বলেছেন) আল্লামা ইব্ন হাযমের মতে চূড়ান্ত পর্যায়ের সহীহ। আপত্তিকারী মাওলানা আব্দুল মতিন ছাহেবের উপর আপত্তি উত্থাপন করেছেন যে, তিনি ইব্ন হাযমের আংশিক মন্তব্য ঊল্লেখ করেছেন। এরপর তিনি এই পুরো বক্তব্যটি উদ্ধৃত করে তার তরজমা করেছেন এবং ভুল তরজমা করেছেন। 

মুহতারাম, আব্দুর রহমান ইব্ন আবী লায়লা কর্তৃক বর্ণিত হাদীসের যে সনদে আছে যে, আব্দুর রহমান ইব্ন আবী লায়লা বলেন, আমাদের নিকট হাদীস বর্ণনা করেছেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ সেই সনদে হাদীসটি যে অত্যন্ত সহীহ তা প্রমাণ করতেই ইব্ন হাযম রাহ. বলেছেন যে, আব্দুর রহমান ইব্ন আবী লায়লা একশত বিশজন সাহাবী থেকে হাদীস শুনেছেন। এবং হযরত উমর রাযি. এবং হযরত বেলাল রাযি.-এর সঙ্গেও তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে। সুতরাং তিনি যে বলেছেন, আমাদের নিকট মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ বর্ণনা করেছেন তাঁর এই কথাটি যথার্থ। কাজেই হাদীসটি সুত্রবিচ্ছিন্ন নয়, হাদীসটি সুপ্রমাণিত। আর এ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ইকামতের বাক্যগুলো দুইবার করে বলার বিষয়টি পূর্বকালের বিষয়। পরবর্তীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইকামতের বাক্যগুলো একবার করে বলতে হযরত বেলালকে নির্দেশ দেন। ইব্ন হাযম রাহ. বলছেন, সুতরাং প্রমাণিত হল যে, ইকামতের বাক্যগুলো দুইবার করে বলাটা মানসূখ হয়ে গেছে। আর এর দ্বারা ঐ সকল ব্যক্তিদের কথা নিশ্চিতভাবে বাতিল প্রমাণিত হল যারা বলে যে, ইকামতের বাক্যগুলো দুইবার করে। এই ছিল ইব্ন হাযম রাহ.-এর বক্তব্যের সারমর্ম। এগুলো তাঁর উক্তি হিসেবে নিশ্চিত বাতিল কথাটি মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবগণ কোত্থেকে বুঝলেন তা আল্লাহই ভাল জানেন। قَوْلِهِم  -এর মধ্যকার সর্বনামটি যে বহুবচন, একবচন নয় তা কি তাঁরা জানেন না? জানলে তো একটু চিন্তা করতেন আর কথাটির মর্ম কী তা-ও তাঁরা বুঝতে পারতেন। জনাব আব্দুল মতিন ছাহেব ইব্ন হাযম রাহ.-এর পুরো বক্তব্যটি উদ্ধৃত করেননি। কারণ, মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবরা যে এত স্বল্পজ্ঞানের অধিকারী তা তিনি বুঝতে পারেননি। ইব্ন হাযম রাহ. কী বুঝাতে চেয়েছেন তা বুঝতে আরও একটু আগে থেকে তাঁর বক্তব্য যদি আপত্তিকারী পাঠ করে নিতেন তাহলেও হয়তো এত বড় ভুলটা তিনি করতেন না। 

  যা হোক, পুরো বক্তব্যটি উদ্ধৃত করে আপত্তিকারী বরং উপকারই করেছেন। কারণ, ইব্ন হাযম রাহ.-এর দাবি হল, ইকামতের বাক্যগুলো দুইবার করে বলাটা মানসূখ হয়ে গেছে। কারণ, সেটা ছিল প্রথম দিকে। এর দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হল যে, আব্দুল্লাহ ইব্ন যায়েদ রাযি.-এর দেখা স্বপ্নে ইকামতের বাক্যগুলো ছিল দুইবার করে।  যদি আব্দুল্লাহ ইব্ন যায়েদ রাযি.-এর স্বপ্নে দেখা ইকামতের বাক্যগুলো একবার করে হত তাহলে ইব্ন হাযম রাহ. ইকামতের বাক্যগুলো দুইবার করে হওয়ার বিষয়টিকে মানসূখ বলতে পারতেন না। তখন বিষয়টি উল্টে যেত এবং একবার করে বলাটাই মানসূখ হিসেবে নিশ্চিত হয়ে যেত। তো  আমার আলোচনা  চলছিল এই বিষয় নিয়েই যে, আব্দুল্লাহ ইব্ন যায়েদ রাযি.-এর দেখা স্বপ্নে ইকামতের বাক্য কীরূপ ছিল। উপরের আলোচনা থেকে নিশ্চয়ই স্পষ্ট হয়েছে যে, তাঁর দেখা স্বপ্নে ইকামতের বাক্যগুলো দুইবার করে ছিল। বাকি রইল এটি মানসূখ হয়েছে কি না সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। তা নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

আপনি বলতে পারেন যে, সুনানে আবূ দাউদের ৪৯৯ নং হাদীস দ্বারা তো বুঝা যায় যে, আব্দুল্লাহ ইব্ন যায়েদ ইবনে আবদি রাবিক্ষহীর স্বপ্নে দেখা ইকামতের বাক্যগুলো একবার করে ছিল। এর জবাবে বলব যে, হাঁ তা বুঝা যায়। কিন্তু হাদীসটি হাসান, সহীহ নয়। আপত্তিকারীরাও এটা জানে। যেমনটা একটু পূর্বে আমি উল্লেখ করেছি।

দেখুন, যে হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, ইকামতের বাক্যগুলো দুইবার করে ছিল সুনানে আবূ দাউদের সেই ৫০৬ নং হাদীসের সনদটি এইরূপ :

حَدَّثَنَا عَمْرُو بْنُ مَرْزُوقٍ أَخْبَرَنَا شُعْبَةُ عَنْ عَمْرِو بْنِ مُرَّةَ قَالَ سَمِعْتُ ابْنَ أَبِى لَيْلَى ح وَحَدَّثَنَا ابْنُ الْمُثَنّى حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ جَعْفَرٍ عَنْ شُعْبَةَ عَنْ عَمْرِو بْنِ مُرَّةَ سَمِعْتُ ابْنَ أَبِى لَيْلى.

পক্ষান্তরে সুনানে আবূ  দাউদের যে হাদীসে ইকামতের বাক্যগুলো একবার করে ছিল বলে বুঝা যায় সেই ৪৯৯ নং হাদীসটির সনদ হচ্ছে এইরূপ :

حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ مَنْصُورٍ الطُّوسِىُّ حَدَّثَنَا يَعْقُوبُ حَدَّثَنَا أَبِى عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ إِسْحَاقَ حَدَّثَنِى مُحَمَّدُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ بْنِ الْحَارِثِ التَّيْمِىُّ عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ زَيْدِ بْنِ عَبْدِ رَبِّه قَالَ حَدَّثَنِي أَبِي عَبْدُ اللَّهِ بْنُ زَيْدٍ.

৪৯৯ নং হাদীসটির সনদে মুহাম্মাদ ইব্ন ইসহাক আছেন। তিনি আল জারহু ওয়াত তাদীল ও আসমাউর রিজালের কিতাবসমূহে বহুল আলোচিত একজন ব্যক্তি। তাঁর দোষ-গুণ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। তাঁর বর্ণিত কোনো হাদীসকে কেউ সহীহ বলেননি। মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবদের চিন্তাগুরু শায়েখ আলবানী রাহ. তাঁর  সিলসিলাতুল আহাদীসিস সহীহাহ গ্রন্থে মুহাম্মাদ বিন ইসহাক বর্ণিত কোনো  হাদীসকেই আমার অনুসন্ধান মতে সহীহ বলেননি। হাসান বলেছেন। ইয়াহইয়া ইব্ন মাঈন তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, صَدُوْقٌ وَلكِنَّهُ لَيْسَ بِحُجَّةٍ  (তিনি সত্যবাদী, তবে হুজ্জত নন)। আরেকবার ইব্ন মাঈন বলেছেন,لَيسَ بِذَاكَ هُوَ ضَعِيُفٌ (তিনি সেরূপ নন, তিনি যঈফ)।  আবূ হাতেম বলেছেন, يُكْتَبُ حَدِيُثُهُ  (তাঁর হাদীস লেখা যেতে পারে)। আবূ হাতেম যখন কোনো রাবী সম্পর্কে বলেন, তাঁর হাদীস লেখা যেতে পারে  তখন তিনি তাঁর এই কথা দ্বারা বুঝাতে চান যে, ঐ রাবীর হাদীস লেখা যেতে পারে কিন্তু হুজ্জত বা দলীল হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। মুহাদ্দিসকুল শিরোমনি ইমাম আহমাদ ইব্ন হাম্বাল রাহ. মুহাম্মাদ ইব্ন ইসহাক সম্পর্কে বলেছেন :

اَمَّا فِي الْمَغَازِيْ وَأَشْبَاهِه فَيُكْتَبُ وَاَمَّا فِي الْحَلَالِ وَالْحَرَامِ فَيُحْتَاجُ إِلَى مَثْلِ هذَا،  وَمَدَّ يَدَهُ وَضَمَّ أَصَابِعَهُ.

অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুদ্ধ ও এইজাতীয় বিষয়াদিতে তাঁর বর্ণনা লেখা যেতে পারে। কিন্তু হালাল হারামের ক্ষেত্রে এইরূপ প্রয়োজন। এবং (এই কথা বলাকালে)  তিনি তাঁর হাতকে মুষ্ঠিবদ্ধ করে প্রসারিত করলেন। (অর্থাৎ হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে তিনি বুঝালেন যে, এইরূপ মজবুত রাবীর প্রয়োজন)

তিনি বুঝাতে চাইলেন যে, যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে মুহাম্মাদ ইব্ন ইসহাকের বর্ণনা তো গ্রহণ করা যেতে পারে কিন্তু হালাল হারামের ক্ষেত্রে তথা বিধি বিধানের ক্ষেত্রে আরও মজবুত রাবীর প্রয়োজন। মুহাম্মাদ ইব্ন ইসহাক সেইরূপ মজবুত রাবী নন।

আর এইসব কারণেই ইমাম বুখারী রাহ. তাঁর সহীহ গ্রন্থে মুহাম্মাদ ইব্ন ইসহাক কর্তৃক বর্ণিত কোনো হাদীস সন্নিবেশিত করেননি। আর ইমাম মুসলিম রাহ.-ও  স্বীয় গ্রন্থে মুহাম্মাদ ইব্ন ইসহাক কর্তৃক একাকী  বর্ণিত কোনো হাদীস আনেননি।  হাঁ, অন্য কোনো রাবীর অনুগামী হিসেবে এনেছেন। অর্থাৎ যদি কোনো হাদীস অন্য কোনো বর্ণনাকারী কর্তৃকও বর্ণিত হয়ে থাকে এবং মুহাম্মাদ ইব্ন ইসহাক কর্তৃকও বর্ণিত হয়ে থাকে তখন মুহাম্মাদ  ইব্ন ইসহাকের নাম বর্ণনাকারী হিসেবে উল্লেখ করেছেন, সঙ্গে সঙ্গে অন্য বর্ণনাকারীর নামও উল্লেখ করে দিয়েছেন। যে হাদীস শুধু ইব্ন ইসহাক কর্তৃক বর্ণিত সেই হাদীস তিনি তাঁর কিতাবে আনেননি।

পক্ষান্তরে আমাশ কর্তৃক বর্ণিত আব্দুর রহমান ইব্ন আবী লায়লার  হাদীসটির সনদ দেখুন। এই সনদের প্রত্যেক রাবী বা বর্ণনাকারী হাফেযে হাদীস এবং অত্যন্ত উচ্চমানের নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী। তাদের সকলেই বুখারী ও মুসলিমের রাবী। অন্যান্য কিতাবের তো বটেই। আর এ কারণেই ইব্ন হাযম রাহ. এই হাদীসটিকে মুহাম্মাদ ইব্ন ইসহাক কর্তৃক বর্ণিত হাদীসের উপর প্রাধান্য দান করেছেন এবং বলেছেন, জোড়া জোড়া বাক্যে ইকামত দেওয়ার বিষয়টি প্রথম দিকে ছিল। অর্থাৎ প্রথম দিকে যে ইকামত ছিল তা ছিল জোড়া জোড়া বাক্যে, একটি একটি বাক্যে নয়।

এ বিষয়টিও প্রণিধানযোগ্য যে, আব্দুল্লাহ ইব্ন যায়দ ইব্ন আবদি রাবিক্ষহী তো আযান ও ইকামত সংক্রান্ত স্বপ্ন একবারই দেখেছিলেন, দুইবার নয়। যদি দুইবার দেখে থাকতেন তাহলে আবূ দাউদের ৫০৬ নং ও ৪৯৯ নং হাদীসের মাঝে সমন্বয় সাধন করা যেত। আমরা তখন বলতে পারতাম যে, এক স্বপ্নে তিনি ইকামতের বাক্যগুলো একবার করে দেখেছিলেন আর আরেকবারের স্বপ্নে দুইবার করে দেখেছিলেন। স্বপ্ন যখন একবারই দেখেছিলেন তখন এটা নিশ্চিত যে, তাঁর স্বপ্নে দেখা ইকামতের বাক্যগুলো হয় একবার করে ছিল নতুবা দুইবার করে ছিল। একবার করেও ছিল, দুইবার করেও ছিল তা কোনোভাবেই হতে পারে না। অতএব কোনো একটি বর্ণনাকে প্রাধান্য দিতে হবে। উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে, আবদুর রহমান ইবন আবী লায়লা কর্তৃক বর্ণিত জোড়া জোড়া বাক্যে ইকামতদান সংক্রান্ত আবূ দাউদের ৫০৬ নং হাদীসটি সহীহ এবং তা বেজোড় বাক্যে ইকামত দান সংক্রান্ত আবূ দাউদের ৪৯৯ নং হাসান হাদীসের উপর প্রাধান্য পায়। ইব্ন হাযম রাহ. এবং ইব্ন খুযায়মাহ রাহ. জোড়া বাক্যে আযান ও ইকামত স্বপ্নে দেখার বিষয়টিকে সুপ্রমাণিত বলেছেন। যেমনটা একটু পূর্বে আলোচনা করে আসলাম। 

মুহতারাম, উপরিউক্ত হাদীসটি ছিল স্বপ্নে আযান ও ইকামত দেখা সংক্রান্ত হাদীস। ঐ হাদীসেই এই কথা বর্ণিত হয়েছে যে, আব্দুল্লাহ ইব্ন যায়েদ ইবনে আবদি রাবিক্ষহী রাযি. স্বপ্নে যেভাবে আযান ও ইকামত দেখেছিলেন হযরত বেলাল রাযি. ঠিক সেভাবেই আযান ও ইকামত দিয়েছিলেন। আর সেই আযান ও ইকামত ছিল একই প্রকারের। তথা জোড়া জোড়া শব্দে।

উপরিউক্ত হাদীসটি ছাড়াও আরও কিছু হাদীস আমাদেরকে জানান দেয় যে, হযরত বেলাল রাযি. ইকামতের বাক্যগুলো জোড়া জোড়া বলতেন।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

 

 

advertisement