ভিক্ষুক পুনর্বাসন : একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত
মাঝেমধ্যে কিছু ইতিবাচক সংবাদ, কিছু সুন্দর উদ্যোগের ঘটনা প্রমাণ করে যে, এখনো আমাদের মাঝে প্রাণের স্পন্দন আছে। উদ্যোগ ও সঠিক নেতৃত্বের দ্বারা আল্লাহর ইচ্ছায় এখনো কিছু কাজ হতে পারে এই প্রত্যাশা জাগে।
গত ১৫ জানুয়ারি ২০১৭ প্রকাশিত দৈনিক নয়াদিগন্তের একটি রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, মাত্র দশ মাসের প্রচেষ্টায় গোটা নড়াইল জেলা এখন প্রায় ভিক্ষুকমুক্ত। ভিক্ষুকমুক্ত মানে ভিক্ষুকদের মাটির নীচে পাঠিয়ে দেওয়া নয়, মাটির উপরেই পুনর্বাসিত করা। এই পুনর্বাসিত ভিক্ষুকের সংখ্যা ৭৯৮। আমাদের সমষ্টিগত সামর্থ্যের বিচারে এই সংখ্যাটা অনেক বড় কিছু না হলেও এখন আত্মকেন্দ্রিকতা ও ভোগবাদী মানসিকতার যে সয়লাব সে হিসেবে বিষয়টি একেবারে ছোটও নয়। এই ঘটনায় কিছু মানুষের উদ্যোগী ও কর্মমুখী মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। একটি সুন্দর কাজের জন্য আমরা তাদের জানাচ্ছি আন্তরিক মোবারকবাদ।
এই ধরনের উদ্যোগ আসলে সীরাত ও সুন্নাহরই শিক্ষা। নড়াইলের ঘটনাটিতেও আমরা এই চেতনার প্রতিফলন দেখছি।
* * *
ইসলামে সম্পদের ক্ষেত্রে যেমন আছে ‘ইনফাক’ (সম্পদ ব্যয়ের) বিধান তেমনি হাত পাতার ক্ষেত্রে আছে ‘ইমসাক’ (নিবৃত্ত হওয়ার) আদেশ। অর্থাৎ ধনীকে বলা হয়েছে, আল্লাহর দেয়া সম্পদ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য খরচ কর আর দরিদ্রকে বলা হয়েছে, অন্যের কাছে হাত পাতা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহর উপর ভরসা করে মেহনত কর। প্রত্যেক শ্রেণি নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করলে একদিকে যেমন ধনী-দরিদ্রের অস্বাভাবিক ব্যবধান দূর হতে পারে অন্যদিকে উভয় শ্রেণি নৈতিকতা, মানবিকতা এবং সম্ভ্রম ও আত্মমর্যাদাবোধের মতো অত্যুচ্চ গুণাবলীরও অধিকারী হতে পারে। এটা আমাদের অনেক বড় প্রয়োজন।
সম্পদের বিষয়ে ইসলামের এক ফরয বিধান হচ্ছে যাকাত। কুরআন মাজীদে সালাত ও যাকাতের বিধান খুব তাকীদের সাথে দেওয়া হয়েছে এবং একে মুসলমানের পরিচয় সাব্যস্ত করা হয়েছে। যাকাতের অন্যতম প্রধান সুফল কুরআনের ভাষায় ‘তাতহীর’ ও ‘তাযকিয়া’ অর্থাৎ ব্যক্তি ও সম্পদের পরিশুদ্ধি। ধনীর সম্পদে গরীবের যে হক আছে তা যাকাতের মাধ্যমে আদায় হয় বলে যাকাতের মধ্য দিয়ে সম্পদ পরিশুদ্ধ হয় আর যথাযথ নিয়মে যাকাত আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর আনুগত্য, আখিরাতের চেতনা, সম্পদের ব্যাপারে মোহ-মুক্তি এবং দুস্থ-অসহায়ের প্রতি সহানুভূতির মতো নৈতিক বৈশিষ্ট্যগুলো বিকশিত হয় বলে যাকাতের মধ্য দিয়ে ব্যক্তির মন-মানসের পরিশুদ্ধি ঘটে। আর তাই যাকাত আদায় ব্যক্তির নিজের প্রয়োজন।
অন্যদিকে সুয়াল ও মানুষের কাছে হাত পাতাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং এর লাঞ্ছনা ও লাঞ্ছনাকর পরিণতি সম্পর্কেও সচেতন ও হুঁশিয়ার করা হয়েছে। এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ سَأَلَ النَّاسَ أَمْوَالَهُمْ تَكَثُّرًا، فَإِنَّمَا يَسْأَلُ جَمْرًا فَلْيَسْتَقِلَّ أَوْ لِيَسْتَكْثِرْ .
যে ব্যক্তি মাল বাড়ানোর জন্য মানুষের কাছে চায় সে তো (আসলে) আগুনের অঙ্গার চায়। সুতরাং তার ইচ্ছে, কম চাক বা বেশি। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৪১
অর্থাৎ সামান্য সুয়ালও জাহান্নামের আযাবের কারণ।
অন্য হাদীসে বলেছেন-
مَنْ سَأَلَ وَهُوَ غَنِيٌّ عَنِ الْمَسْأَلَةِ يُحْشَرُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَهِيَ خُمُوشٌ فِي وَجْهِه.
যে সুয়ালের প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও মানুষের কাছে সুয়াল করে সে কিয়ামতের দিন উঠবে মুখমণ্ডলে আঁচরের দাগ নিয়ে। -আলমুজামুল আওসাত, তবারানী, হাদীস ৫৪৬৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৬২৬; জামে তিরিমিযী, হাদীস ৬৫০
অর্থাৎ, দুনিয়ার জীবনে যেহেতু সে নিজের মুখে চুনকালি মাখতে দ্বিধা করেনি, আখেরাতেও তাকে অনুরূপ লাঞ্ছনার শাস্তি ভোগ করতে হবে।
এই ধরনের নসগুলোর ভিত্তিতে শরীয়তের বিধান হচ্ছে, মানুষের কাছে হাতপাতা সম্পূর্ণ অবৈধ। তবে হাঁ, একান্ত অপারগতা হলে সেটা ভিন্ন কথা।
এই অপারগতার ব্যাখ্যাও বিভিন্ন হাদীসে এসেছে। একটি হাদীস এই-
হযরত কবীসা ইবনে মুখারিক আলহিলালী রা. বলেন, আমি আর্থিক দায়ভারগ্রস্ত হয়ে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এলাম। তিনি আমাকে অপেক্ষা করতে বললেন এবং সদকার সম্পদ এলে আমাকে ভারমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। এরপর বললেন-
يَا قَبِيصَةُ إِنَّ الْمَسْأَلَةَ لَا تَحِلُّ إِلَّا لِأَحَدِ ثَلَاثَةٍ،رَجُلٌ تَحَمَّلَ حَمَالَةً، فَحَلَّتْ لَهُ الْمَسْأَلَةُ حَتَّى يُصِيبَهَا، ثُمَّ يُمْسِكُ، وَرَجُلٌ أَصَابَتْهُ جَائِحَةٌ اجْتَاحَتْ مَالَهُ، فَحَلَّتْ لَهُ الْمَسْأَلَةُ حَتَّى يُصِيبَ قِوَامًا مِنْ عَيْشٍ - أَوْ قَالَ سِدَادًا مِنْ عَيْشٍ - وَرَجُلٌ أَصَابَتْهُ فَاقَةٌ حَتَّى يَقُومَ ثَلَاثَةٌ مِنْ ذَوِي الْحِجَا مِنْ قَوْمِهِ: لَقَدْ أَصَابَتْ فُلَانًا فَاقَةٌ، فَحَلَّتْ لَهُ الْمَسْأَلَةُ حَتَّى يُصِيبَ قِوَامًا مِنْ عَيْشٍ - أَوْ قَالَ سِدَادًا مِنْ عَيْشٍ - فَمَا سِوَاهُنَّ مِنَ الْمَسْأَلَةِ يَا قَبِيصَةُ سُحْتًا يَأْكُلُهَا صَاحِبُهَا سُحْتًا.
হে কাবীসা! শুধু তিন প্রকারের লোক ছাড়া আর কারো জন্য যাঞ্চা করা হালাল নয়; এক. ঐ ব্যক্তি যে কোনো দায়ভার গ্রহণ করেছে; সে যাঞ্চা করে ভারমুক্ত হতে পারে। এরপর সে নিবৃত্ত হবে। দুই. যার সমুদয় সম্পদ কোনো দুর্যোগে ধ্বংস হয়ে গেছে; সে জীবন যাপনের প্রয়োজন পরিমাণ যাঞ্চা করে নিতে পারে। আর তিন. যে (বাস্তবেই) অতি দরিদ্র, যার দারিদ্রে্যর পক্ষে তার গোত্রের তিনজন বিচক্ষণ লোক সাক্ষ্য দিয়েছে- সে-ও জীবন যাপনের প্রয়োজন পরিমাণ যাঞ্চা করে নিতে পারে। এই তিন ছাড়া- হে কবীসা! অন্যদের জন্য এ হচ্ছে নিষিদ্ধ উপার্জন। যে তা খায় সে হারাম খায়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৪৪
কাজেই একান্ত অপারগতার অবস্থা ছাড়া মানুষের কাছে চাওয়া নিষিদ্ধ। ইসলামের পরিভাষায় মুনকার ও গর্হিত কাজ। আর মুনকারের বিষয়ে মুসলিমের করণীয় হচ্ছে, এক. নিজে তা থেকে বেঁচে থাকা, দুই. প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনোভাবেই এর সহযোগিতা না করা। আর তিন. সাধ্যমত দমন ও নির্মূলের চেষ্টা করা।
এই দমন-চেষ্টার ক্ষেত্রে যে নীতিটি মনে রাখা খুব দরকার তা হচ্ছে, ইসলামে অপরাধ দমনের বিধান যেমন আছে তেমনি আছে সে বিধান পালনের নিয়ম ও পদ্ধতি। কাজেই ‘অপরাধ দমন করতে হবে।’- এইটুকু হচ্ছে সংশ্লিষ্ট নীতি ও ব্যবস্থার অর্ধেক। বাকি অর্ধেক হল, ‘অপরাধ’ দমন করতে হবে শরীয়াসম্মত উপায়ে।
* * *
কুরআন ও সুন্নাহর বিধানের আলোকে দারিদ্র্য বা ভিক্ষাবৃত্তির অন্যতম প্রধান দায় বর্তায় সম্পদশালীদের উপর। এটি তাদের জন্য একটি পরীক্ষাও বটে। সুতরাং সবার আগে সম্পদশালীদের নিজ দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে হবে। দ্বিতীয়ত, যাঞ্চাকারীর বিষয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ কুরআনী বিধান হল, ধমক না দেয়া-
وَ اَمَّا السَّآىِٕلَ فَلَا تَنْهَرْ এবং সাইলকে ধমক দিও না। -সূরা দুহা (৯৩) : ১০
মুফাসসিরগণ এখানে ‘সাইল’-এর অর্থ ‘যাঞ্চাকারী’ ও ‘প্রশ্নকারী’ দুটোই করেছেন। অর্থাৎ দ্বীন শেখার জন্য যে প্রশ্ন করে আর প্রয়োজনের কারণে যে যাঞ্চা করে এদের সাথে রুক্ষ আচরণ করো না। ধমক দিও না।
প্রত্যেকের প্রকৃত অবস্থা যেহেতু আমাদের জানা নেই তাই এক্ষেত্রে সাধারণ ধারণার উপরই নির্ভর করতে হয়। কাজেই কোনো ভিক্ষুকের ব্যাপারে যদি ধারণা হয় যে, সে মজবুর-অপারগ নয়, ভিক্ষাবৃত্তি তার পেশা তাহলে তাকে ভিক্ষা দেয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। সেই সাথে সব রকমের রুক্ষ আচরণ থেকেও বিরত থাকতে হবে। এবং বাস্তবেই যারা অপারগ-মজবুর তাদের পুনর্বাসনের দায়িত্বও খুব গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। ভিক্ষুকের হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করা, কর্মহীনের কর্ম-সংস্থান করা এবং বৃদ্ধ, অসুস্থ, প্রতিবন্ধির ভার বহন করা সীরাতের বড় বড় অধ্যায়।
আমাদের মসজিদগুলোর সামনে বিশেষত জুমা-ঈদে এবং অন্যান্য বিশেষ সময়ে নারী-পুরুষ ভিক্ষুকের ভীড় ব্যাপকভাবে দেখা যায়। একেক জায়গায় একেক রকমের শরয়ী সমস্যার পাশাপাশি কখনো কখনো এদের মাধ্যমে নিরীহ মুসল্লীদের নিগৃহিত ও বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হতেও দেখা যায়। এই অবস্থাটা কাম্য নয়, এর পরিবর্তন দরকার। তবে সে পরিবর্তনটা হতে হবে আমাদের নিজস্ব চিন্তা ও আদর্শের ভিত্তিতে।
যে মানুষগুলো আমাদের সমাজে ভিক্ষুক নামে পরিচিত একদিক থেকে তারা আমাদেরই দায়িত্বে অবহেলা ও সমাজ-ব্যবস্থার দীনতার জীবন্ত ও বিচরণশীল ছবি। কাজেই এদের পুনর্বাসন এবং এদের মাঝে মানবীয় চেতনা ও কর্মবোধ বিকশিত করার উদ্যোগটিও আমাদেরকেই নিতে হবে।
নড়াইলের ঘটনাটা অন্যান্য শহর-নগরের প্রশাসন, গণ্যমান্য ব্যক্তি ও সচেতন বিত্তবান শ্রেণির জন্যও একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে ভালো কাজের তাওফীক দান করুন। আমীন।