রবিউল আখির ১৪৩৮   ||   জানুয়ারি ২০১৭

রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর নির্যাতন

আনওয়ার গাজী

২০১২ খ্রিস্টাব্দ থেকেই রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর এক ধরনের কিয়ামত শুরু হয়েছে। আরাকান ভূখ-টি কিছুদিন পরপরই রক্তাক্ত হয়ে উঠছে। তাদের অবস্থা এখন এতই করুণ যে, সেখানে শাহাদত বরণকারীদের সংবাদও প্রকাশিত হয় না। মায়ানমারের (বার্মা) রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর সীমাহীন যুলুম হচ্ছে। অথচ তাদের পক্ষে জোরালো কোনো প্রতিবাদ হচ্ছে না। প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও যেন মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে। বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের কথা বাদই দিলাম। মুসলিম বিশ্বও তাদের স্বজাতির দুঃখ অনুভব করছে না। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, আরাকানের মুসলিমরা কি তবে মুসলিম জাতিরও অংশ নয়?

প্রিয় পাঠক! প্রতিবেদন শুরু করার আগে বার্মার সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের উপর একবার নজর বুলিয়ে নিন। তাহলে প্রকৃত অবস্থা বুঝতে সহজ হবে।

মায়ানমারের অধিভুক্ত আরাকান মুসলমানদের পৈত্রিক ভূমি। ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত আরাকান ছিল এক স্বাধীন রাষ্ট্র। খ্রিস্টাব্দ চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত তা ছিল আরাকান মুসলিমদের স্বাধীন ভূমি। পরবর্তীতে বার্মার অধিবাসীরা তা দখল করে নেয়। বার্মার সামরিক শাসনের আমলে পৃথক আইনের মাধ্যমে মুসলমানদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলা হয়। নিজেদের জমিজমা, নাগরিকত্ব সবকিছু খুঁইয়ে তারা হয়ে পড়ে রাষ্ট্রহীন জাতি। এমন পরিস্থিতিতে বিপুলসংখ্যক মানুষ থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশে হিজরত করে চলে আসে। পাকিস্তানের সাথে বার্মার মুসলিমদের বিশেষ সম্পর্ক ছিল। সেই সুবাদে মায়ানমার স্বাধীন হওয়ার আগেই ১৯৪৬ সালে কিছু মুসলিম নের্তৃবৃন্দ কায়েদে আযম মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহর কাছে আবেদন করেন তিনি যেন মায়ানমারকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে সহযোগিতা করেন। এই লক্ষ্যে আরাকান মুসলিমলীগও প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু তাদের এই চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। পরে মুজাহিদগণ মায়ানমারের বিরুদ্ধে জিহাদের ঘোষণা দেন। আবদুল কাসেম ছিলেন এই বিদ্রোহীদের প্রধান। কয়েক বছর চেষ্টা-প্রচেষ্টার পর উত্তর আরাকান মুক্ত হয়। কিন্তু ১৯৪৮ সালে মায়ানমারে মার্শাল ল জারি হওয়ার পর সেনাবাহিনী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তারা উত্তর আরাকানের বন-জঙ্গলে আত্মগোপন করে। ১৯৫৪ সালে বিদ্রোহীরা নতুন করে অভিযান চালিয়ে পুনরায় কিছু এলাকা দখল করে নেয়। ১৯৭১ সালে রোহিঙ্গা মুসলিমদের আরো একবার অস্ত্র হাতে নেওয়ার সুযোগ আসে। ১৯৭২ সালে জাফর নামে এক ব্যক্তি রোহিঙ্গা লিবারেশন পার্টি গঠন করেন এবং বিক্ষিপ্ত মুসলিম সংগঠনগুলোকে একত্রিত করেন। ১৯৭৮ সালে নেওন অপারেশন কিং ড্রাগননামে আরাকানের অবৈধভাবে দেশত্যাগকারীদের গ্রেফতার করা শুরু করে। তখন বার্মার হাজার হাজার মানুষ বাংলাদেশে চলে আসে।

২০১২ সালের জুন মাসে একটি গুজবের ভিত্তিতে মুসলমানদের উপর চালানো হয় এক নির্র্মম হত্যাযজ্ঞ। তা ছিল কিছু রোহিঙ্গা মুসলমান কর্তৃক জনৈক রাখাইন নারীর উপর হামলা ও হত্যার গুজব। যা ছিল একেবারেই ভিত্তিহীন। এর আগেও বার্মার সামরিক জান্তা এ ধরনের আক্রমণের মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধদের উত্তেজিত করে। সেবার প্রথম আঘাতেই বহু রোহিঙ্গা মুসলমানকে শহীদ করা হয়। কিন্তু সরকার হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও তাদেরকে নিবৃত্ত  করার পরিবর্তে ১০ জুন দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি করে। বিভিন্ন প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ২২ জুন পর্যন্ত শত শত মুসলমানকে শহীদ করা হয়। ৯০ হাজার মানুষকে গৃহহীন করা হয়। আড়াই হাজারের বেশি ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়, যার মধ্যে মুসলমানদের ঘর ছিল ১৩ শয়ের বেশি।

এমন পরিস্থিতিতেও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৈষম্যপূর্ণ আচরণ করা হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে অ্যামন্যাস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা বার্মা সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করে। তখন থানসেন জাতিসংঘকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের অন্য দেশে স্থানান্তরের প্রস্তাব দিলে তা কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়। ২০১২ সালের অক্টোবরে অবস্থা আবারও নাজুক হয়ে উঠে। এই সহিংসতায়ও হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। চার হাজার ছয় শ ঘরবাড়ি জ্বালানো হয় এবং ২২ হাজারের বেশি মানুষকে বাস্তচ্যুত করা হয়। এ পর্যন্ত গৃহহারার সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে গেছে। মুসলমানদের বসতি লুটতরাজের কথা থানসেন স্বীকার করলেও ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করার ক্ষেত্রে এখনও বাধা রয়েছে। আর ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস (এম এস এফ, কানাডা) বর্ডারজ সংস্থা ২০১২ সালের নভেম্বরে তাদের কর্মীদেরকে সেসব এলাকা ছেড়ে আসার পরামর্শ দিয়েছে। কেননা, তাদের কর্মীদের উপর বৌদ্ধদের হামলা বেড়ে গিয়েছিল। পরিস্থিতি দিন দিন নাজুক হতে থাকে।

লক্ষ্য করুন। ২০১২ সালের জুন মাসে আরাকানে মুসলিম নিধন শুরু হলে বৌদ্ধরা হাজারও মুসলিমকে শহীদ করে এবং হাজার হাজার মুসলিম বসতিতে অগ্নিসংযোগ করে। আর যেসব মুসলমান সমুদ্রপথে বাংলাদেশে পৌঁছতে পেরেছিল তাদেরকে সে দেশের সরকার ফেরত পাঠালে তারাও বৌদ্ধদের হাতে নিহত হয়। এবারের চিত্রও একই। বিশ্ব মিডিয়ায় প্রচারিত ছবিতে মায়ানমার সংলগ্ন বাংলাদেশ সীমান্তে রোহিঙ্গা মুসলিমদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে বেশ তৎপর দেখা যায়।

৯ অক্টোবর ২০১৬ তারিখ দিবাগত রাতে সেনাবাহিনীর উপর অজ্ঞাত কিছু লোকের হামলা ও হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধ ও সেনাবাহিনীরা আরাকানের মুসলমানদের উপর নতুন করে নির্যাতন শুরু করে। দোষীকে শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে উল্টো মুসলমানদের উপরই এর দায়ভার চাপানোর চেষ্টা চলছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী আরাকানের মংডু অঞ্চলের পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। মোটকথা, সময় সময় তুচ্ছ কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুসলিম নিধনের সূত্রপাত করা হয়। ২০১২ সালের জুনেও বিপুল সংখ্যক মুসলমানের উপর হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। আর এখন দ্বিতীয়বারের মতো আমাদের আরাকানের মুসলিম ভাইদের উপর একই অবস্থা চলছে। বর্তমানে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নের্তৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি তাদের তদন্ত শুরুও করেছে। কিন্তু খুব সম্ভবত একটি গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুসলমানদের উপরই সহিংসতার দায় চাপিয়ে তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া হবে।

বিশ্বের অনেক অঞ্চল বিশেষ করে পাকিস্তান, সৌদী আরব, মালয়েশিয়া ও অন্যান্য দেশে বসবাসরত রোহিঙ্গা মুসলিমদের যুগ যুগ ধরে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণভাবে জীবন যাপন প্রমাণ করে যে, রোহিঙ্গা মুসলিম এক শান্তিকামী জাতি। তারা নিজেদের মাতৃভূমির জন্যও শান্তি ও নিরাপত্তা কামনা করে এবং নিজেদের মৌলিক অধিকার আদায় করতে চায়। সকল মুসলিম দেশ ও সংগঠন বিশেষত ওআইসির কর্তব্য রোহিঙ্গা মুসলিমদের পক্ষে শক্তিশালী প্রতিবাদ করা। বিশ্বের সকল ইসলামী দেশ যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে জোর প্রতিবাদ জানায় ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাহলে মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর চালানো নির্যাতন ও সীমালঙ্ঘনের ঘৃণিত পথ থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হতে পারে। 

 

[একটি বিদেশী পত্রিকা থেকে অনূদিত

 

অনুবাদ : মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ফাহাদ]

 

 

advertisement