জুমাদাল উলা ১৪৩১   ||   মে ২০১০

বাইতুল্লাহর ছায়ায়-(৪)

মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর) মদীনা শরীফে একদিন ইফতারের পর হাজী আব্দুল ওয়াদূদ- আল্লাহ তাকে ভরপূর রহম করুন- বললেন, ‘মজবূরির কারণে আমাকে তো জলদি ফিরে যেতে হবে। কিন্তু আমার দিল চায়, আপনার সফর আরো লম্বা হোক, আমি সব ব্যবস্থাকরে যাই, আপনি পুরা রামাযান হারামের নূর ও নূরানিয়াত যত পারেন হাছিল করে ঈদের পরে আসেন। হারাম শরীফের ই‘তিকাফ, আমি না পারলেও আপনি করে আসেন। আমি মনে করবো, আপনার মাধ্যমে আমারও ই‘তিকাফ হয়ে গেছে।’ ভালো মানুষ আল্লাহর ঘরে যে আরো ভালো হয়ে যায়, সোনার মানুষ সোনার মদিনায় আরো সোনালী হয়ে যায়, আজ আবার তা প্রত্যক্ষ করলাম। মানুষ কত ভালো হলে এমন ভালো কথা এমন ভালোভাবে বলে, বলতে পারে! আল্লাহর ঘরের ই‘তিকাফ, তার জন্য আবার অনুরোধ, তাও এমন আবদারের ভাষায়! সুবহানাল্লাহ! জানি না, কিসের সঙ্গে এ সৌভাগ্যের তুলনা করা যায়! আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া! না, এ সৌভাগ্য আরো বড়। হিরার খনি, সাত রাজার ধন! না, এ সৌভাগ্য আরো বড়। আসলে এ সৌভাগ্যের কোন তুলনা নেই। কিন্তু .. যুগে যুগে বড় বড় মানুষ জীবনের বিভিন্ন অঙ্গনে নানা ভাবে বহু বার যে কঠিন প্রশ্নটির সম্মুখীন হয়েছেন, আমার মত সামান্য এক মানুষ, ক্ষুদ্র একটি মাদরাসার ক্ষুদ্র একজন শিক্ষক সেই কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম। প্রশ্নটি হলো, সৌভাগ্য এবং দায়িত্ব, দু’টি যখন দু’দিক থেকে তোমাকে হাতছানি দেয়? চোখের পানি দিয়ে কাকে বারণ করবে, মুখের হাসি দিয়ে কাকে বরণ করবে? উত্তর হলো, সৌভাগ্যকে দাও চোখের পানি, দায়িত্বকে দাও মুখের হাসি। কারণ একটি সৌভাগ্য, হতে পারে তা অনেক বড়, কিন্তু তোমার জন্য নতুন কোন সৌভাগ্য বয়ে আনবে না, যদি তুমি দায়িত্ব থেকে সরে যাও। কিন্তু একটি দায়িত্ব, হতে পারে তা খুব সামান্য, তোমার জন্য খুলে দেবে বহু সৌভাগ্যের দুয়ার, যদি তুমি তার জন্য কোন সৌভাগ্য বিসর্জন দাও। লজ্জা যদি বাধা না হয়ে দাঁড়াতো, আমাদের বড়দের গৌরবের সুদীর্ঘ ইতিহাস থেকে বহু দৃষ্টান্ত এখানে তুলে ধরা যেতো, এমনকি কিছু উদাহরণের সম্পর্ক রয়েছে বাইতুল্লাহর সফরেরও সঙ্গে। সফরে রওয়ানা হওয়ার আগে মাদরাসাতুল মাদীনায় আমি একটি ঘটনা রেখে এসেছিলাম! বাবার অনুরোধে এবং আমার উপরোধে খুবই অনিচ্ছুক অবস্থায় একজন ছাত্র স্কুলজীবন ত্যাগ করে মাদরাসাতুল মদীনায় পড়তে এসেছিলো। আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম, তিন বছর পর যদি মাদরাসা তোমার ভালো না লাগে আমি নিজে তোমার বাবাকে বলে কলেজে ভর্তির ব্যবস্থাকরে দেবো। মাদরাসায় তার মনটা যেন বসে এজন্য বিভিন্নভাবে আমি তার মনরক্ষার চেষ্টা করতাম। এতে মাদরাসার পরিবেশে যথেষ্ট সমস্যাও হতো। তবু মোটামুটি তার পড়া হচ্ছিলো। তবে বিশেষ করে বিরতির সময় তাকে নিয়ে আমার মনে খুব উৎকণ্ঠা হতো, কখন কোন সঙ্গ কী সর্বনাশ করে! তাই তাকে বলেছিলাম, তুমি যদি রামাযানে মাদরাসায় থাকতে চাও তাহলে আমি তোমার খিদমতের জন্য সফর স'গিত করতে প্রস্তুত আছি। সে বললো, বাড়ী না গেলে, মাকে না দেখলে খুব খারাপ লাগবে । আমি বললাম, তা তো ঠিকই। তোমার জায়গায় হলে, হয়ত আমিও তাই বলতাম। তো এককাজ করো, পুরো রামাযান বাড়ীতে না থেকে রামাযানের পনের তারিখে চলে এসো, আমি সফর সংক্ষিপ্ত করে তোমার জন্য চলে আসবো, যাতে পড়ার দিক থেকে তুমি এগিয়ে থাকতে পারো। আল্লাহর ইচ্ছায় সে রাজি হলো। বিষয়টি হাজী ছাহেবকে খুলে বললাম, তিনি অবাক চোখে অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন, আর বললেন, ... যা বললেন, আল্লাহ যেন তা কবুল করেন। শেষে বললেন, কে এমন সৌভাগ্যবান তালিবে ইলম? আমি বললাম, জনাব হাবীবুল্লাহ মেছবাহর ছেলে জাবির কালীমুল্লাহ। সেদিনই জানলাম, মাওলানা হাবীবুল্লাহ মেছবাহ তার আত্মীয়। তিনি বললেন, জাবির কি আপনার এ কোরবানির কদর করতে পারবে? আমি বললাম, এটা তো কোরবানি নয়, এটা তো আমার কাছে একজন তালিবে ইলমের প্রাপ্য। যাই হোক একজন তালিবে ইলমের প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্য এত বড় সৌভাগ্যের হাতছানি আমি রক্ষা করতে পারিনি। চোখের পানিতে সৌভাগ্যকে বিসর্জন দিয়ে হাসিমুখে দায়িত্বকেই বরণ করে নিয়েছিলাম এবং আমার বিশ্বাস, সৌভাগ্য থেকে আল্লাহ আমাকে বঞ্চিত করেননি। *** এই সফরে একটি কিতাবের কথা না বললে একজন মানুষের প্রতি অকৃতজ্ঞতা হয়। হাদীছের শব্দ-ব্যাখ্যার বিষয়ে মাজমাউ বিহারিল আনওয়ার পাঁচখণ্ডের একটি মশহূর ও ‘না-য়াব’ কিতাব। বহু বছর ধরে বহু তালাশ করছি, পাইনি। মদীনা শরীফে ভাই মাছীহুল্লাহর ঘরে এক সাহরীর সময় কথাপ্রসঙ্গে কিতাবটির কথা উঠলো। হাজী আব্দুল ওয়াদূদ বললেন, ‘কুতুবখানায় দেখেন, সোনার দামে হলেও আমি কিনে দেবো।’ তার কথা এরকমই ছিলো এবং তিনি এরকমই করতেন। ভাই মাছীহুল্লাহ বললেন, ‘কুতুবখানায় পাওয়া যাবে না, তবে আমার কাছে একটি ‘বূসীদা’ ও জীর্ণ নোসখা আছে। আমি আপনাকে হাদিয়া করতে পারি।’ শোনো ভালো মানুষের কথা! তিনি যদি বলতেন, পাঁচটি হিরার টুকরো তোমাকে দান করবো, এত খুশী হতাম না। ভাই মাছীহুল্লাহ, আমার এ লেখা আপনার নযরে আসবে কি না, জানি না। যদিও একটি কারণে কয়েক সফরে আপনার সঙ্গে দেখা করা হয়নি, আপনার প্রতিটি ইহসানের কথা আমার মনে আছে। আল্লাহ আপনাকে এবং জীবনে যখন যেখানে যার যতটুকু ইহসান পেয়েছি তাকে উত্তম থেকে উত্তম বিনিময় দান করুন, আমীন। আরেকবার আমার মামা হাফেয খালেদ ছাহেব হজ্বের সফরে মদীনা শরীফ থেকে ফোনে আমাকে জানালেন, আরবী শিক্ষার একটি কিতাব দেখলাম, মনে হলো তোমার কাজে লাগবে। আমার হাতে ব্যবস্থাথাকলে অবশ্যই তোমার জন্য আনতাম। অনেকের কথা তখন মনে হতে পারতো, কিন্তু আমার মনে হলো ভাই মাছীহুল্লাহর কথা। মামাকে বললাম তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। ভাই মাছীহুল্লাহ ‘দারুয্যামান’ কুতুবখানায় গিয়ে তিনখণ্ডের কিতাবটি একশ রিয়াল দিয়ে সংগ্রহ করলেন। মামা তাকে বললেন, এত পয়সা দিয়ে নিচ্ছেন, দেখে নিন না, আসলেই কাজে লাগবে কি না। ভাই মাছীহুল্লাহ বললেন, ভাই মিছবাহ বাংলাদেশ থেকে আমাকে স্মরণ করেছেন, শুধু সাদা কাগজ হলেও তো এটা আমি তার কাছে পাঠাবো! শোনো ভালো মানুষের কথা! অনেকবারের মত তখনো মনে হয়েছে, এখনো মনে হয়, উপকার করার মানুষ পৃথিবী থেকে এখনো হারিয়ে যায়নি, তবে উপকার মনে রাখার মানুষ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। আমার মামাকে আল্লাহ উত্তম বিনিময় দান করুন, অনারবদের জন্য আরবীভাষা শিক্ষার ঐ কিতাবটি আমার অনেক উপকারে এসেছিলো, বিশেষ করে ‘এসো আরবী শিখি’র সর্বশেষ পরিমার্জনের সময়। *** সেবার আমরা ‘জামাল’-এর মদীনা থেকে আবার ফিরে এসেছিলাম ‘জালাল’-এর মক্কায়। আল্লাহর ঘরের ছায়ায় পরম আত্মিক প্রশান্তির দিনগুলো দেখতে দেখতে যেন ফুরিয়ে গেলো। দেখতে দেখতেই তো ফুরিয়ে যায়! চল্লিশের অধিক জীবনটাও তো অল্প ক’দিনেই গলে গলে শেষ হয়ে গেলো! এভাবেই একদিন জীবন- সফরের শেষ দিন এসে যাবে! এজন্যই বলা হয়েছে- ‘মৃত্যুর আগে মৃত্যুবরণ করো।’ হায় যদি জানতাম, মৃত্যুর আগে কীভাবে মৃত্যুবরণ করা যায়! হায়, যদি পারতাম! সফরের শেষ দিনটি এসে গেলো। সেদিনও ছিলো শুক্রবার। কীভাবে জুমার নামায পড়লাম, বিদায় তাওয়াফ করলাম, যামযামের পেয়ালায় ‘আখেরি’ চুমুক দিলাম এবং আল্লাহর ঘরের প্রতি বিদায়ের...। হায়, জীবনে কত সময় কত বিদায় নিতে হয়, কত বিদায় দিতে হয়! প্রিয় কারো থেকে এবং প্রিয় কিছু থেকে বিদায় যখনই হয়, যেভাবেই হয় তা ব্যথা দেয় এবং বেদনা সৃষ্টি করে, কিন্তু আল্লাহর ঘর থেকে বিদায়ের ব্যথা ও বেদনা! তুমি কি হে বন্ধু, কখনো বিদায় নিয়েছো আল্লাহর ঘর থেকে? তাহলে তুমি বোঝবে এ ব্যথার গভীরতা এবং এ বেদনার রক্তক্ষরণ। আমি কামনা করি তোমার জন্য, আমার জন্য এবং সকলের জন্য, বাইতুল্লাহ থেকে প্রতিটি বিদায়ের পর আবার যেন ফিরে আসে মিলনের আনন্দ এবং আনন্দের মিলন। আর যেদিন আসবে বাইতুল্লাহ থেকে শেষ বিদায়ের দিন সেটা যেন হয় ঘরের মালিকের সঙ্গে শুভমিলনের মহাসৌভাগ্যের দিন। ইয়ামানি কাফেলার সঙ্গে প্রিয়তমা যখন চলে যায়, জাহেলি যুগের আরব-কবি তখন বলেছিলেন, ‘অথচ শেকলে বাঁধা আমার দেহ মক্কায়’। কিন্তু সেদিন যখন হারামের চত্বর থেকে আমাদের গাড়ী রওয়ানা হলো, আর চোখের অশ্রুধারায় আমরা বিধৌত হলাম সেদিন বেলা ইখতিয়ার আরব-কবির সেই কবিতা স্মরণ করে বলে উঠলাম- ‘এ পোড়া দেহ শেকলে বাঁধো পড়ে থাক মক্কায়/ আমার প্রিয়তমা যে এখানে ওয়াদি বাক্কায়!’ কেউ শুনলো না, কেউ বেঁধে রাখলো না। গাড়ী নিজের গতিতে এগিয়ে চললো। বিষণ্ন সন্ধ্যায় সূর্য ডুবলো, আমরা জেদ্দায় পৌঁছে গেলাম। আমাদের বিমানে তুলে দেয়া হলো। রাতের বিমান আকাশে উড়লো এবং সকালে ঢাকার মাটিতে নামলো। আমি আবার ফিরে এলাম মিলনের ছায়াশীতল জীবন থেকে রোদে ঝলসানো বিরহের জীবনে। তবে সেই বিশ্বাসটুকু আমার অটুট ছিলো; বান্দাকে আল্লাহ আবার ডাকবেন তাঁর ঘরের আঙ্গিনায়। আর আল্লাহ সম্পর্কে বান্দা যে ধারণা করে আল্লাহ তা পূর্ণ করেন। আমার ধারণা ও বিশ্বাসও আল্লাহ পূর্ণ করলেন গায়বি কুদরতের আরো বড় প্রকাশ ঘটিয়ে। সে বড় দীর্ঘ কাহিনী, যার পরতে পরতে রয়েছে আমাদের মত দুর্বল বিশ্বাসের বান্দাদের জন্য বহু শিক্ষা ও সান্ত্বনা। কিন্তু সব কথা কি বলা যায়, না বলতে হয়! শুধু একদিনের একটি ঘটনা বলি, ভিসার জন্য দাঁড়িয়েছি দীর্ঘ সারিতে, সঙ্গে ছিলো আমার প্রিয় ছাত্র মুনির। তখনকার নিয়মে সেদিন ছিলো ওমরার ভিসা দেয়ার শেষ দিন এবং কী কারণে যেন রাজকীয় দূতাবাসটির আচরণ ছিলো খুব কঠোর। একজনকে ভিসা দেয় তো তিনজনকে ফেরত দেয়। কেন দেয়, কেন দেয় না, কিছুই বলে না। রাজার দেশের রাজকর্মচারী বলে কথা! বের হয়ে আসা ভাইদের চেহারা দেখেই বোঝা যায়, কে ভিসা পেয়েছে, কে দিশা হারিয়েছে। সে বড় মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতা। এখনো যেন আমি শুনতে পাই কাতারে দাঁড়িয়ে থাকা আমার বুকের ধুকপুকানি। আমি জানি না, কী আছে আমার ভাগ্যে। এই বুঝি হতাশার ঢেউ এসে ডুবিয়ে দেয়, কিন্তু আমি বেঁচে থাকার চেষ্টা করি শুধু একটি অবলম্বনকে আঁকড়ে ধরে, ‘তাকদীর বান্দার কল্যাণের জন্য, অকল্যাণের জন্য নয়। আমার প্রয়োজন শুধু আত্মসমর্পণ।’ মুনির এসে জানতে চাইলো ডাবের পানি খাবো কি না? গরম ছিলো খুব, পিপাসা ছিলো অনেক। কচি ডাবগুলো দেখে লোভ যে হলো না তাও নয়, তবু বললাম, থাক না একটু পিপাসা, তাতে যদি নছীব খুলে যায় এবং কিসমত হয়ে যায় আবে যামযামের ভরা পেয়ালা! সারিতে দাঁড়িয়ে ছটফট করছি, আর দু‘আ পড়ছি। হঠাৎ শুনি একটি বিলাপধ্বনি! উৎকণ্ঠিত হয়ে দূতাবাসের দরজার দিকে তাকালাম, একজন মাওলানা সাহেব বেরিয়ে এলেন। জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন ছিলো না, কী হয়েছে এবং কী হয়নি! পাসপোর্ট ফেরত দেয়া হয়েছে এবং ভিসা দেয়া হয়নি! বড় মায়া হলো অচেনা মাওলানার প্রতি। একবার ভাবলাম, সান্ত্বনা দিয়ে আসি। কিন্তু কোন্ ভাষায়, কীভাবে দেবো সান্ত্বনা! এমন বেদনার কি আছে কোন সান্ত্বনা! আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু বললাম, তোমার বান্দার কান্না শোনো হে আল্লাহ! তোমার বান্দাকে তুমি সান্ত্বনা দাও হে আল্লাহ! আজ না হোক, কাল তোমার বান্দার মনের আশা তুমি পূর্ণ করো হে আল্লাহ! একসময় এলো আমার সময়। দুরু দুরু বুকে ফটকের ভিতরে গেলাম। যার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, আমি তার দিকে তাকালাম কাতর দৃষ্টিতে, তিনি তাকালেন...। তাতে আমার হৃৎকম্প আরো বেড়ে গেলো। ঠোঁট তো আগেই শুকিয়ে ছিলো পিপাসায় এবং উৎকণ্ঠায়, এবার যেন ..., তবু কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে অনুচ্চ কণ্ঠে উচ্চারণ করছি, ইয়া মুঈনু! ইয়া মুঈনু! ভদ্রলোক নিস্পৃহ দৃষ্টিতে এবং নির্লিপ্ত কণ্ঠে জানতে চাইলেন, কী জন্য যেতে চাই সৌদি আরব? এ প্রশ্নের কী জবাব হতে পারে? মুখ ফসকে বের হয়ে গেলো, কে বললো সৌদি আরব যেতে চাই! আমি তো যেতে চাই মক্কা শরীফে আল্লাহর ঘরে এবং মদীনা শরীফে নবীর রওযা যিয়ারাতে! সৌদী ভদ্রলোক এমন আগুনঝরা দৃষ্টিতে তাকালেন যে, মোম হলে গলে যেতাম, আর কাগজ হলে স্রেফ ভস্ম হয়ে যেতাম। তিনি কিছু করলেন না এবং কিছু বললেন না, শুধু পাসপোর্টটা বন্ধ করে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। বুঝলাম, আমার ভাগ্য বাইরে বিলাপরত মাওলানা থেকে ভিন্ন নয়। অনেক কষ্টে কান্না সম্বরণ করলাম। বাংলায় কী বলে জানি না, উর্দূতে বলে, ‘দিল কা ডূব যানা’। শাব্দিক অর্থেই আমার দিল তখন ডুবে যেতে বসেছিলো, কিন্তু ঐ সান্ত্বনাটুকু আমাকে আশ্রয় দিলো, ‘তাকদীরের ফায়ছালা বান্দার কল্যাণের জন্য, অকল্যাণের জন্য নয়, প্রয়োজন শুধু আত্মসমর্পণ।’ আমি ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন’ বলে খোপে হাত ঢুকিয়ে সামনে পড়ে থাকা পাসপোর্টটা নিতে যাবো, এর মধ্যে ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে সেটা নিজের দিকে টেনে নিলেন এবং কিছু বোঝার আগেই খটাখট সিল মেরে দিলেন। শুনেছি, ইংরেজকে বলা হতো ভারতের ভাগ্যবিধাতা। সময় সুযোগে এদেশের দুর্ভাগা প্রজাদের সাথে তারা অনেক রকম কৌতুক করতেন। কানমলা দেয়ার ভান করে পুরস্কার দিতেন, আবার পুরস্কার দেয়ার অভিনয় করে দিতেন কানমলা! রাজার মর্জি বলে কথা! মক্কা-মদীনার খাদেম তো এখন একদিক থেকে আমাদের...। ভদ্রলোক নিজের রসিকতায় নিজেই শব্দ করে হেসে উঠলেন, আর আমি নিজের অজান্তে শব্দ করে কেঁদে উঠলাম। বাইরে বেরিয়ে এসেও আমার কান্না থামে না। ফলে যা সত্য নয়, আমার কান্না থেকে সবাই সেটাই বুঝলো। নিজেকে সম্বরণ করার চেষ্টা করছি এমন সময় ভিতর থেকে আবার ডাক এলো, আমার বুকটা আবার ধড়ফড় করে উঠলো। ইয়া আল্লাহ! কোন বিপদ নয় তো! ভিতরে গেলাম, ভদ্রলোক অবাক হয়ে,কিংবা অবাক হওয়ার ভান করে জানতে চাইলেন, তোমার তো ভিসা হয়েছে, তুমি কাঁদছো কেন? আমি বললাম, এটা খুশি ও কৃতজ্ঞতার কান্না, তবে তোমার অনুমতি হলে একটা কথা বলতে চাই। তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন, আমি বললাম, তোমাদের সমস্যাটা বুঝি! তবু যারা আল্লাহর ঘরে যাওয়ার নাম করে তোমার কাছে আসে, নিয়মের ভিতরে সম্ভব হলে কাউকে ফিরিয়ে দিয়ো না, আর কারো সঙ্গে এমন কৌতুক করো না। তিনি ‘আফওয়ান’ বললেন, আর বললেন, তুমি সউদী আরব যেতে চাও না বলায় আমার একটু কৌতুক করার ইচ্ছা হয়েছিলো। আমি বললাম, ‘কথাটা তো সত্য, আমার দিক থেকেও, তোমার দিক থেকেও। তুমি যে ভিসা দিয়েছো তাতে কি সৌদি আরবের যে কোন শহরে যাওয়ার অনুমতি আছে?’ ভদ্রলোক চায়ে আপ্যায়ন করতে চাইলেন, আমি ‘শুকরান’ বলে চলে এলাম। কাছাকাছি এক মসজিদে যোহর পড়লাম এবং দু’রাকাত শোকরানা আদায় করলাম। সিজদায় পড়ে অনেক্ষণ কাঁদলাম। সেদিনের সেই সিজদার কান্নায় এবং কান্নার সিজদায় অন্তরে যে স্বাদ ও শান্তি অনুভব করেছিলাম পরে আর কখনো তেমন করে হয়নি। সফরের আগের দিন ...। থাক, সব যদি বলা হয়ে যায়, তাহলে সঞ্চিত আর থাকবে কী মনের গোপন কোঠায়! *** ঢাকা উত্তরার বাইতুস-সালাম মাদরাসা তখন আমাদের খুব প্রিয় সন্তান। হযরত পাহাড়পুরী হুযূরের কিছুটা তত্ত্বাবধানে সেখানে তখন মাদানী নেছাব কিছু কিছু জারি হয়েছে। আমার প্রিয় ছাত্রদের একজন মাদরাসার মুহতামিম, আরেকজন নাযিমে তালিম। আমার আন্তরিক ইচ্ছা হলো, এবারের এই মুবারক সফর সেখান থেকে শুরু হোক। রামাযানের সম্ভবত তিন তারিখ সকালে একা একা বাইতুস-সালাম গেলাম। গোসলের পর ইহরামের লিবাস পরিধান করলাম এবং মসজিদে দু’রাকাত নামায পড়ে লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক বলে ইহরাম ধারণ করলাম। আবার আমি নতুন মানুষ হলাম। ইহরাম ধারণ করার পর আসলেই মানুষ নতুন মানুষ হয়ে যায়। না হলে সব মানুষ কেন এত ভক্তি করে! এমন অন্তরঙ্গ আলিঙ্গন করে! এমন কাকুতি-মিনতির সঙ্গে দু‘আ চায়! আফসোস শুধু এই যে, নতুন মানুষ হয়েও আমরা নতুন মানুষ থাকতে পারি না, আবার আগের মানুষে ফিরে যাই। আল্লাহর যারা নেক বান্দা তাঁরা একবার ইহরাম ধারণের পর নতুন মানুষ হয়ে নতুন মানুষই থেকে যান। শরী‘আতের নিয়ম মেনে তিনি ইহরামের লিবাস তো ত্যাগ করেন, কিন্তু মৃত্যু পর্যন্ত ইহরাম ত্যাগ করেন না, ইহরামের শিক্ষা থেকে কখনো বের হয়ে আসেন না। তাঁদের ইহরাম আসলে ইবরাহীমী ইহরামেরই ছায়া এবং মুহম্মদী ইহরামেরই প্রতিচ্ছায়া। ছাহাবা কেরাম এবং তাঁদের পর যুগে যুগে আল্লাহর পেয়ারা বান্দাগণ যে ইহরাম ধারণ করেছেন, এখনো করছেন, আল্লাহ যেন আমাদের তাওফীক দান করেন সেই ইহরামের সঙ্গে কিছুটা হলেও সাদৃশ্য গ্রহণের, সাদা লিবাস খুলে ফেলার পরো যে ইহরাম অব্যাহত থাকে ইবাদতে, বন্দেগিতে, মুআশারায়, মুআমালায় এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে। হে আল্লাহ তুমি কবুল করো, আমীন। একজন অসুস্থ বুড়ো মানুষ, বাইতুস-সালাম মসজিদের নিয়মিত মুছল্লী, কিন্তু তার সঙ্গে আমার পরিচয় নেই, দেখলাম, খুব কষ্ট করে এদিকে আসছেন। আমি দ্রুত এগিয়ে গেলাম। কান্না সংযত করার চেষ্টা করে তিনি বললেন, বহু আগে একবার আল্লাহর ঘরে গিয়েছিলাম, হজ্জ করেছিলাম। তারপর আর কিসমতে হলো না। সবাইকে বলি, বাইতুল্লাহর গিলাফ ধরে আমার জন্য দু‘আ করতে, নিশ্চয় তারা দু‘আ করেন, আমারই মন্দ নছীব। আপনি আমার জন্য খাছ করে দু‘আ করবেন, আল্লাহ যেন মৃত্যুর আগে আবার বাইতুল্লাহর যিয়ারাত নছীব করেন। সফরের ব্যস-তায় সাধারণত আমরা মানুষের দু‘আ চাওয়ার প্রতি মনোযোগ প্রদান করি না। যারা এভাবে দু‘আ চায় তাদের প্রতি আমাদের আগ্রহ থাকা উচিত এবং তাদের কথা মনে রাখা উচিত। এতে আমাদেরই ফায়দা। কারণ এভাবে আল্লাহ তা‘আলা বান্দাকে সুযোগ দান করেন, যেন সে আল্লাহর বান্দাদের দু‘আ ও সালামের নাযরানা বহন করার মাধ্যমে নিজের সফরকে কামিয়াব করতে পারে। আমার আমলের খবর তো জানাই আছে,অন্তত আল্লাহর বান্দাদের এইটুকু খিদমত যদি হয় তাহলে আশা করা যায়, আমার টুটা-ফাটা সফর-যিয়ারাতও আল্লাহ মেহেরবান কবুল করে নেবেন। মনে পড়ে, হযরত পাহাড়পুরী হুযূরের নিকটাত্মীয় মাওলানা সিরাজুল ইসলাম ছাহেব বহু দূর থেকে এসেছিলেন আমাকে বিদায় জানাতে। কীভাবে খবর পেয়েছেন, জানি না, তবে বিদায় জানানোর উদ্দেশ্যে তার আগমন আমার সফরের জন্য বড় সৌভাগ্যের কারণ হয়েছিলো। তিনি খুব মুবারক একটি খাব দেখেছেন। বললেন, বিশেষ করে খাবটি বলার জন্যই আমি এসেছি। কতভাবে যে, আল্লাহ বান্দার ‘দিলজুঈ’ ও মনোরঞ্জন করেন! বাইতুল্লাহর এক মুসাফির সম্পর্কে এক বান্দাকে এমন খাব তিনি কেন দেখালেন? সেই খাব বলার জন্য কেন তাকে পাঠালেন? শুধু এ জন্য যে বান্দাকে তিনি খুশী করতে চান। এমন ঘটনা আমার তোমার সবার সঙ্গেই ঘটে। আমরা যদি আল্লাহর প্রতি খুশী হতে চাই তাহলে দেখবে, খুশী হওয়ার মত বহু উপলক্ষ আমাদের চারপাশে তিনি ছড়িয়ে রেখেছেন। কিন্তু আমাদের স্বভাবে শিকায়েতের জযবা বড় বেশী, কৃতজ্ঞতার আবেগ খুব কম। আনন্দের আতিশয্যে আমার চোখে পানি এসে পড়লো। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বললাম, ইনশাআল্লাহ আপনার কথা মনে থাকবে। আপনার এবং আপনার পরিবার পরিজনের জন্য আমি দু‘আ করবো, আশা করি, আপনিও আমার জন্য দু‘আ করবেন। বাইতুস-সালামের ঐ যে বৃদ্ধ মুছল্লী! তার জন্য অনেক দু‘আ করেছিলাম এবং রওযা শরীফে তার সালামের নাযরানা পেশ করেছিলাম। সফর থেকে ফেরার সময় বিমানবন্দর থেকে বাইতুস-সালাম এসেছিলাম। নিয়ত ছিলো, খোঁজ নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করবো, যামযাম ও খেজুরের হাদিয়া পেশ করবো, আর বলবো, আপনার সঙ্গে দেখা হওয়া এবং আপনার সালামের হাদিয়া বহন করে নেয়া আমার জন্য খুব বরকতের কারণ হয়েছিলো। কিন্তু ..! বলতে পারো প্রিয় পাঠক, কিন্তুটা কী? হিসাব করে দেখি, আল্লাহর ঘরে মুলতাযামে দাঁড়িয়ে যখন তার জন্য দু‘আ করছি তার আগেই তিনি ঘরের মালিকের রহমতের ছায়ায় পৌঁছে গেছেন! আল্লাহ তাকে বেলাহিসাব জান্নাত নছীব করুন, আমীন। অন্যরকম একটি ঘটনা ছিলো বিমানবন্দরে। বাইতুল্লাহর মুসাফিরকে মানুষ মনে করে ফিরেশতা, কিন্তু .. অনেক সময় ইহরামের লিবাসের মধ্যে থেকেও আমরা ফিরেশতা দূরের কথা, মানুষ হওয়ারও পরিচয় দিতে পারি না। এটা সত্যি বড় দুর্ভাগ্যজনক। আমার তোমার ক্ষেত্রে যেন এমন না হয়। অন্তত মানুষ পরিচয়টুকু রক্ষা করার আল্লাহ যেন তাওফীক দান করেন। *** সেবার সফরে আমার কোন কাফেলা ছিলো না। আমি একা এক মুসাফির রওয়ানা হলাম আল্লাহর ঘরে। বিমানে ইহরামের লিবাসে বহু মুসাফির, তবু আমি একা। আমার পাশের আসনে যে মুসাফির ভাইটি, একবার তন্দ্রায় তার কাঁধের উপর মাথা ঢলে পড়েছিলো। তিনি এমনভাবে মাথাটা সরিয়ে দিলেন এবং এমন করে .., আমি লজ্জিত কণ্ঠে ক্ষমা প্রার্থনা করলাম, আর ভাবলাম, বাইতুল্লাহর সফরে মুসাফিরদের মজমায় সত্যি আমি বড় একা। আমি এবং আমরা সবাই। এরকম একা হতে পারা ব্যক্তির জন্য হয়ত ভালো, সমষ্টির জন্য কিছুতেই ভালো নয়। অন্য কোন পরিচয় ছাড়া শুধু মুসলিম পরিচয়ে যখন আমরা পরস্পরের প্রতি পরিচয় ও অন্তরঙ্গতা অনুভব করতে পারবো সেদিনই বোঝবো আমরা প্রকৃত মুসলিম। এখানে আরেকটি কথাও বলার প্রয়োজন বোধ করছি, মুসলিমের প্রতি মুসলিমের অন্তরঙ্গ তো থাকবেই, এমনকি তাকে শুধু মানুষ পরিচয়েই যে কোন ধর্মের যে কোন মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। এমনই ছিলো আমাদের পেয়ারা নবীর জীবন এবং ছাহাবা কেরামের আদর্শ। সন্ধ্যার আগে জেদ্দা বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম। আমার মা, আল্লাহ তাঁকে হায়াতে তাইয়েবা, হায়াতে তাবীলা দান করুন, আমাদের মাথার উপর তাঁর মমতার আঁচল-ছায়া দীর্ঘ করুন, আমীন, তিনি ইফতার তৈরী করে দিয়েছিলেন, আমি রক্ষা করতে পারিনি। অবস্থা এমন ছিলো যে, ইফতারের ব্যবস্থাকরা সম্ভব হলো না। কিন্তু আল্লাহ সাহায্য করলেন। একেবারে হঠাৎ করে দেখা হয়ে গেলো আমার মুহব্বতের মানুষ হাজী দিলওয়ার ছাহেবের সঙ্গে। তার ছেলে মাদরাসাতুল মদীনায় পড়ে। আমাকে দেখে কিছুক্ষণ তিনি দেখেই থাকলেন, তারপর আলিঙ্গনাবদ্ধ হলেন। আল্লাহর ঘরের সফরে তার সঙ্গে আমার এই প্রথম দেখা। ইফতারের সময় হয়ে গেছে। তিনি আমাকে ইফতারে শরীক করলেন। কিন্তু সত্যি কথা এই যে, মনের অবস্থা তখন এমন ছিলো যে, ইফতারে শরিক হওয়ার ইচ্ছা ছিলো না। শুধু তার মনরক্ষা করলাম। দোষটা তার নয়, আমার মনের। বিমানে আমার পাশে যে ভাইটি ছিলেন তিনি নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্বের এমনই যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি আমার মধ্যে জাগিয়ে দিয়েছিলেন যে, তখন একা ও নিঃসঙ্গ থাকতেই ইচ্ছা হচ্ছিলো। আচ্ছা, এই যে হাজী ছাহেব আমাকে ইফতারে শরীক করলেন তা কোন পরিচয়ে? আমাদের মূল পরিচয় তো উখুওয়াতে ইসলামী বা ইসলামী ভ্রাতৃত্ব, সেই পরিচয়ে, না অন্য কোন পরিচয়ে? ইফতার শুরু হয়েছে আরো আগে। আর কেউ তো আমাকে ডাকেনি। ঐ যে দূরে একজন পুরুষ ও মহিলা, বেশ বয়স্ক, বসে আছে, সম্ভবত তাদের ইফতারের ব্যবস্থানেই। এমন হয়, অনেক সময় পয়সা থাকে, ব্যবস্থাথাকে না। কই, কেউ তো তাদের ডাকেনি ইফতারের জন্য! কেন? তাদের সঙ্গে কারো পরিচয় নেই, এ জন্য? শুধু মুসলিম পরিচয় তাহলে যথেষ্ট নয়, এমনকি আল্লাহর ঘরের সফরেও! ছাহাবা কেরাম কেমন ছিলেন? ইসলাম তার অনুসারীদের কাছে কেমন আখলাক ও চরিত্র আশা করে! *** হাজী ছাহেবের মেয়ে ও জামাই এসেছেন তাকে নিতে। রাত্রটা জেদ্দায় থেকে সকালে তিনি যাবেন মক্কা শরীফে। দু’জনেই জোর অনুরোধ করলেন সঙ্গে যাওয়ার জন্য, আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এড়িয়ে গেলাম। হাজী ছাহেবের মেয়ের জামাই বেশ ভদ্র। তিনি আমার অনুরোধ রক্ষা না করে ছোট একটি গাড়ীতে কয়েকজনের সাথে তুলে দিয়ে তারপর নিজের গাড়ীতে উঠলেন। আল্লাহ তাকে উত্তম বিনিময় দান করুন। আমার প্রিয় ব্রিফকেসটি হাজী ছাহেব রেখে দিলেন সকালে নিয়ে আসবেন বলে। কথা হলো, উম্মেহানিতে দেখা হবে। আল্লাহ যা চান তাই হয় এবং তাই হলো; আমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনাটি ঘটলো মক্কা শরীফের কাছাকাছি এসে। আমাদের গাড়ীটি মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকার হলো। উল্টে গিয়ে চারটি চাকা যখন উপরে তখন আমরা বুঝতে পারলাম, দুর্ঘটনা ঘটেছে। কীভাবে ঘটেছে জানলাম না, আমরাও না, গাড়ীর চালকও না, তবে আল্লাহর কুদরত, আমরা কেউ সামান্য আঘাতও পাইনি! আরো আশ্চর্য! চালকের মুখে হামদ ও শোকর শুনে সবার খেয়াল হলো, আমাদেরও হামদ ও শোকর বলা দরকার! ছোট-বড়, বিশিষ্ট- সাধারণ, এমনকি ধার্মিক-অধার্মিক সকল আরবের যেন রক্ত-মাংসে মিশে আছে হামদ ও শোকরের জযবা! সবকিছু পরীক্ষা করে চালক গাড়ীটি চালিয়ে যাওয়া নিরাপদ মনে করলেন না। তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেন, আর আমাদের কাছ থেকে নেয়া ভাড়া সবটা ফেরত দিলেন। দিলেন মানে, জোর করে গছিয়ে দিলেন। কত ভালো মানুষ! তার রিযিকের প্রশস্থতার জন্য তখনো দু‘আ করেছি, এখনো করি। অন্যদের সঙ্গে যথেষ্ট সামান ছিলো, আমি ছিলাম ঝাড়া হাত-পা। তাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া সহজ হলো। অনেক দূর হাঁটার পরে একটি গাড়ী পাওয়া গেলো। এ গাড়ীর চালক অবশ্য আমাদের প্রতি দয়া করলেন এবং আগের ভাড়ার সঙ্গে আরো কিছু যোগ করলেন। সবাই তীব্র আপত্তি জানালো। আমি বললাম, হয়ত আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা করতে চাচ্ছেন। তখন গাড়ীর চালক আমাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করেছেন এখন গাড়ীর চালকের সঙ্গে আমাদের ভালো আচরণ করার পালা। আল্লাহ যে এত বড় দুর্ঘটনার মধ্যে হিফাযত করেছেন তার শোকর হিসাবেই এখন আমাদের কিছু খরচ করা উচিত। একজন নেননি, আরেকজন বেশী নিচ্ছেন; দু’টোই আল্লাহর পক্ষ থেকে। চলুন, আমরা খরচ করি, আল্লাহ খুশী হবেন। সবাই খুশি মনেই কথাগুলো গ্রহণ করলেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বুঝিয়ে বললে মানুষ বুঝ গ্রহণ করে, আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা বুঝিয়ে বলতে পারি না। হারাম শরীফে যখন পৌঁছলাম, ইমাম ছাহেবের কণ্ঠে তখন তারাবীর জামাতের সুমধুর তিলাওয়াত। আহা, কী কলজে ঠাণ্ডা করা তিলাওয়াত! সেদিন হারাম শরীফের চত্বরে প্রথম উপসি'তিতে মনের যে অনুভূতি হয়েছিলো তার সব তো এখন মনে নেই। যা মনে আছে তাও প্রকাশ করার ভাষা জানা নেই। পথে এত বড় দুর্ঘটনা থেকে আল্লাহ বাঁচিয়ে এনেছেন এবং নিরাপদে তাঁর পবিত্র হারামের চত্বরে উপস্থিত করেছেন, এটা আমার মনের জগতে যে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো এবং আল্লাহর দয়া ও করুণা অনুভব করার যে সুবর্ণ সুযোগ উপস্থিত করেছিলো তা কি আল্লাহর পক্ষ হতে বাইতুল্লাহর মুসাফিরের জন্য গায়বী তারবিয়াতের ব্যবস্থানয়?! আমরা বলি ‘দুর্ঘটনা’, কিন্তু সেদিন অন্তরের অন্তস্থল থেকে অনুভব করতে পেরেছিলাম, ঘটে যাওয়ার পর সব ঘটনাই বান্দার জন্য সুঘটনা। নইলে সেদিন হারাম শরীফে হাজির হয়ে যে স্বাদ ও শান্তি এবং আল্লাহর নৈকট্যের যে স্নিগ্ধ স্পর্শ অনুভব করেছিলাম তা কীভাবে সম্ভব হয়েছিলো! তবু কামনা করি, আল্লাহ যেন আমাকে এবং বাইতুল্লাহর সকল মুসাফিরকে সবদিক থেকে নিরাপদ রাখেন, আমীন। সফরে রওয়ানা হওয়ার যে দু‘আ তা যেন আল্লাহ সবাইকে পড়ার তাওফীক দান করেন। আমি দেখেছি, সফরের শুরুতে যদি পূর্ণ অনুভবের সঙ্গে দু‘আ পড়ার তাওফীক হয়, যদি বান্দার অসাহয়ত্ব ও মাসকানাত এবং আল্লাহ তা‘আলার করুণা ও কুদরতের অনুভূতি অন্তরে জাগ্রত থাকে তাহলে বান্দা নিজের চোখেই দেখতে পারে যে, আল্লাহ তা‘আলা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাকে নিরাপত্তার ছায়া দান করে রেখেছেন। অথচ অন্য সফরের কথা থাক, যারা বাইতুল্লাহর মুসাফির তাদেরও ক’জনের মুখস্থ আছে যবানে নবুওয়ত থেকে পাওয়া এত বড় একটি রক্ষাকবচ দু‘আ! আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন, আমীন। এই সফরের সব ঘটনা যদি লিখতে যাই, সেই একই কথা, অনেক লম্বা হয়ে যাবে আমার কথা। পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে সে আশঙ্কা অবশ্য নেই। কারণ পরিচিত অপরিচিত সবাই বলছেন সবকিছু লিখতে। আসলে বাইতুল্লাহর সফরের প্রতিটি ঘটনায়, থাকে কিছু না কিছু শিক্ষা। এ সফর তো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুধু আল্লাহর জন্য, যদিও আমরা অনেক নীচে নেমে গেছি এবং আমাদের নিয়ত অনেক নষ্ট হয়ে গেছে। তারপরো আমাদের নষ্ট হয়ে যাওয়া এই সফর তো শুধু আল্লাহর জন্য। মনে পড়ে গেলো আল্লাহর এক পেয়ারা বান্দার মহামূল্যবান একটি উপদেশ। তিনি বলেন, তোমার আমলকে তুমি এত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করো না যাতে অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায়। যেমনই হোক আল্লাহ যে তোমাকে আমল করার তাওফীক দিয়েছেন সে জন্য শোকর আদায় করো, তাহলে আল্লাহ আরো সুন্দর আমল করার তাওফীক দেবেন। তিনি বলেন, একজন দ্বীনদার ব্যক্তি একবার বললেন, হযরত, আমাদের নামায-সিজদার কথা কী আর বলবো! নামাযে সিজদায়ও দুনিয়ার সব গান্দা চিন্তা-খেয়াল আসতে থাকে। এমন নামায, এমন সিজদা আল্লাহর দরবারে পেশ করার উপযুক্ত কীভাবে হতে পারে! আমি বললাম, আচ্ছা, তো এককাজ করুন, এরকম একটা গান্দা সিজদা আমাকে করুন। বেচারা পেরেশান হয়ে বললো, হযরত, এ কী বলছেন। যত বড় পীর মুরশিদই হোন, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করা কীভাবে সম্ভব!? আমি বললাম, ভাই! তাহলে তুমি তোমার নামায-সিজদাকে এত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছো কেন? তুমি নিজেই তো বলছো যে, তোমার সিজদা আল্লাহ ছাড়া আর কারো জন্য হতে পারে না। সুতরাং গান্দা খেয়ালাতে ভরা ঐ সিজদাটুকুর জন্যও আল্লাহর শোকর আদায় করো যে, তিনি তাওফীক দান করেছেন। যদি শোকর করো তাহলে আল্লাহ তোমাকে আরো সুন্দর, এমনকি সুন্দরতম সিজদা করার তাওফীক দান করবেন। কোত্থেকে কোথায় চলে যাই! এটা আমার কলমের পুরোনো দুর্বলতা। তবে সব দুর্বলতা সবসময় দুর্বলতা সৃষ্টি করে না। কিছু কিছু দুর্বলতা কখনো কখনো শক্তি যোগায়। কারণ.. না, এবার অন্য দিকে যাবো না। তো বলছিলাম, আমরা অনেক নষ্ট হয়ে গেছি, আমাদের নিয়তে অনেক গান্দেগি এসে গেছে, আমাদের বাইতুল্লাহর সফরে এখন আর কোন সুঘ্রাণ নেই, বরং ... সব ঠিক, তবু আল্লাহর শোকর, এখনো, কলব ও নিয়তের এমন গান্দেগির যুগেও আল্লাহ তাঁর বান্দাদের তাওফীক দিচ্ছেন তাঁর ঘর যিয়ারাতের। এমন হওয়া তো অসম্ভব কিছু নয় যে, আমার সফরের ঘটনায় কোন সৌন্দর্য নেই, কোন সুঘ্রাণ নেই, কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা দয়া করে নিজের পক্ষ থেকে তাতে সৌন্দর্য ও সুঘ্রাণ দিয়ে দিলেন! বাইতুল্লাহর সামনে হাযির হওয়ার এবং বাইতুল্লাহর প্রতি প্রথম দৃষ্টিপাতের অনুভূতি প্রকাশ করা এবং লেখায় তুলে আনা, মনে হয় সবচে’ কঠিন এবং প্রায় অসম্ভব। তখনকার অনুভব-অনুভূতির বৈচিত্রেরও মনে হয় শেষ নেই। পৃথিবীতে কত মানুষ এ পর্যন্ত এসেছে, তারপরো আজকের জন্ম নেয়া শিশুটি কি একেবারে নতুন নয়! দেখতে সবকিছু অভিন্ন, কিন্তু আসলে সবকিছু নতুন। চোখ, মুখ, হাত, পা, এমনকি ভিতরের মন-মস্তিষ্ক, হৃদয় ও চিন্তা সবকিছু নতুন! তো আমার মনে হয়, একটি শিশুর নতুন জন্মের মত প্রত্যেক ইহরামের সময় আমাদের নতুন জন্ম হয়। হয়ত ইহরামের একই লিবাস বারবার পরিধান করি, কিন্তু প্রতিটি ইহরাম আমাদের নতুন ইহরাম, তাই বাইতুল্লাহর প্রতিটি যিয়ারাত হয়ে যায় নতুন যিয়ারাত। মনে হয়, আল্লাহর ঘরের এমন সৌন্দর্য আগে তো দেখিনি, এমন আলো, এমন তাজাল্লি, এমন প্রভা ও দিপ্তি, এমন নৈকট্য ও আপনত্ব আগে তো অনুভব করিনি! আসলে আল্লাহর ঘর তো প্রাচীন ঘর, তাতে নতুনত্বের কিছু নেই। নতুন জন্ম হয়েছে আমার। নতুন ইহরামে আমি আজ নতুন মানুষ হয়ে এসেছি। আমার চোখ নতুন। চোখের তারায় গোনাহের যা কিছু কলঙ্ক-কালিমা ছিলো, সাদা লিবাসের ইহরামের শুভ্রতায় তা মুছে গিয়ে যেন কাঁচের স্বচ্ছতা অর্জন করেছে। আমার চোখের তারায় বাইতুল্লাহর ছবি তাই আজ নতুন সৌন্দর্যে, নতুন মহিমায় উদ্ভাসিত। তাই আল্লাহর ঘরকে আমি আজ নতুন দৃষ্টিতে দেখতে পাই। আমার হৃদয় নতুন। তাতে কালো কালো যত দাগ পড়েছিলো, লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক-এর ‘আবে যামযামে’ ধুয়ে মুছে তা পাক-ছাফ হয়ে গেছে। আমার হৃদয়ের পর্দায় বাইতুল্লাহর তাজাল্লি তাই আজ নতুন জ্যোতির্ময়তায় নতুন ভাবে উদ্ভাসিত। কী দেখেছি, কী অনুভব করেছি তা জানি না, তবে নতুন কিছু দেখেছি, নতুন কিছু অনুভব করেছি এবং হয়ত ঘরের মালিকের কাছ থেকে নতুন কিছু পেয়েছি। ‘ওয়া আম্মা বিনি‘মাতি রাব্বিকা ফাহাদ্দিছ’। (চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

advertisement