মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী রাহ.-কে যেমন দেখেছি ও শুনেছি
মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী রাহ. এমন একটি নাম, যে নামের সাথে নেকীর পাহাড়ের একটি ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যখনই কারো মুখে তাঁর নাম শুনি অথবা কারো লেখায় তাঁর নামের উল্লেখ দেখি, তখনই নেকী ও পুণ্যের একটি আমেজ উপলব্ধি করি। সেইসাথে একজন ভালো মানুষের পরিচয়দানে সেই হাদীসখানি স্মরণ করি, যাতে বলা হয়েছে-
أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِخِيَارِكُمْ قَالُوا: بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ: الَّذِينَ إِذَا رُؤُوا، ذُكِرَ اللهُ تَعَالَى .
আমি কি তোমাদের জানাব না তোমাদের শ্রেষ্ঠ মানুষগুলো সম্পর্কে? সকলে আরজ করলেন, অবশ্যই বলুন, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বলেন, যাদের দেখলে আল্লাহর কথা মনে পড়ে। -মুসনাদে আহমদ, হাদীস ২৭৫৯৯; আলআদাবুল মুফরাদ, হাদীস ৩২৩
অন্যস্থানে এসেছে-
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ : قِيلَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، أَيُّ جُلَسَائِنَا خَيْرٌ؟ قَالَ: مَنْ ذَكَّرَكُمْ بِاللَّهِ رُؤْيتَهُ، وَزَادَ فِي عِلْمِكُمْ مَنْطِقَهُ، وَذَكَّرَكُمْ بِالْآخِرَةِ عَمَلُهُ.
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বলা হল, আল্লাহর রাসূল! আমাদের কোনো সঙ্গীরা শ্রেষ্ঠ? তিনি বললেন, যাদের দর্শনে আল্লাহর স্মরণ জাগে, যাদের কথায় জ্ঞান বাড়ে এবং যাদের কর্ম তোমাদের আখিরাতের কথা মনে করিয়ে দেয়। -শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৯০০০
মাওলানার স্মৃতিবিজড়িত কিছু লিখতে আজ আমি নিশ্চল, নিস্তব্ধ। তিনি ছিলেন আমার এক খাঁটি ও আন্তরিক বন্ধু। আমাদের শায়েখ হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর জামাতা। আর আমি শায়খুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হক ছাহেব রাহ.-এর জামাতা। সম্পর্ক খুবই নিকটবর্তী।
নিজ শায়েখের প্রতি মাওলানার শ্রদ্ধা ও মুহাব্বত ছিল অপরিসীম। সেই সাথে তাঁর মধ্যে সুন্নতের মুহাব্বতও ছিল অপরিমেয়। এ দুটি জিনিসের উপস্থিতি মাওলানার জীবনকে করে তুলেছিল মহীয়ান।
শায়েখের মুহাব্বত এবং সুন্নতের অনুসরণ
নিজ শায়েখের প্রতি মাওলানার ছিল অপূর্ব শ্রদ্ধা, ভক্তি ও মুহাব্বত। এরই ফলে তিনি শায়েখের সঙ্গে পবিত্র হজ্বে যাওয়ার সুযোগ পান। আর এর সাথে শায়েখের শর্ত ছিল হজ্বের সফরে পূর্ণ বুখারী শরীফ তাঁর নিকট অধ্যয়ন করতে হবে। অবশ্য সফর ছিল চার মাসের। শিষ্যের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা পোষণ করলেই না এরকম শর্ত করা যেতে পারে। এ ছিল ১৯৭৫ সালের কথা, যখন হযরত বয়সের ভারে দুর্বল হয়ে পড়েননি।
হযরত শায়েখ রাহ. মাওলানার ইলম ও এখলাসে নিদারুণ মুগ্ধ হয়ে তাকে নিজ মাদরাসা নূরিয়াতে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করার পূর্বে পাকিস্তান থেকে ডেকে পাঠাতে পত্রে লিখেছিলেন-
آپ جیسے مخلصین کا نوریہ محتاج ہے اور رہیگا، میرا خط ملتے ہی فورا آجائے.
(আপনাদের মত মুখলিস লোকদের জন্য মাদরাসায়ে নূরিয়া মুখাপেক্ষী আছে এবং থাকবে। আমার পত্র পাওয়া মাত্রই তৎক্ষণাৎ চলে আসুন।) পাহাড়পুরী রাহ. হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর স্মৃতিচারণে লেখেন, ‘তখন বার্ষিক পরীক্ষার মাত্র বিশ দিন বাকী। অপর দিকে হযরত হাফেজ্জী হুযুরের জরুরি তাগিদ দেয়া চিঠি। ...পরামর্শের জন্য স্বীয় উস্তায আল্লামা শরীফ কাশ্মিরী রাহ.-এর কাছে সব খুলে বললাম এবং তাঁর হাতে চিঠিটি তুলে দিলাম। চিঠিটি পড়ে তিনি বললেন,
حضرت حافظجی حضور تمکو اتنی محبت کی نظرسے دیکھتے ہیں، تمھیں دیر نہ کرنی چاہئے.
(হযরত হাফেজ্জী হুযুর তোমাকে অত্যন্ত স্নেহের দৃষ্টিতে দেখেন। তাই তোমার দেরি না করা উচিত।)[1]
এ তো গেল শায়েখের প্রতি মাওলানার শ্রদ্ধা-ভক্তি ও মুহাব্বতের কথা এবং মাওলানার প্রতিও শায়েখের স্নেহ-মুহাব্বতের কথা। এখন রইল সুন্নতের প্রতি মাওলানার আন্তরিক মুহাব্বতের কথা। একদিন দাওয়াতুল হকের এক সভায় দাওয়াতী মেহমান হিসেবে তিনি ওয়ায করছিলেন। মাওলানা সুন্নতের মুহাব্বতের বিষয় আলোচনা করছিলেন, আর শ্রোতারা অত্যন্ত মনোযোগের সাথে তাঁর অতি মূল্যবান তাকরীর শুনছিলেন। বাস্তব জীবনে সুন্নতের অনুসরণে যে কী শান্তি মাওলানা তাঁর জীবন থেকেই এর উদাহরণ পেশ করছিলেন। বলছিলেন, ‘আলহামদু লিল্লাহ! আমার বিবাহের সবকিছু সুন্নত মোতাবেক হওয়ায় আমাদের জীবনে কত শান্তি। আমার সামর্থ্য অনুযায়ী দেনমহর ধরা হয়েছিল, ফলে বিয়ের ব্যাপারটা আমার উপর বোঝা স্বরূপ হয়নি।’ পবিত্র হাদীসে যে রয়েছে, যে বিবাহে খরচ যত কম, তাতে বরকত তত বেশি- এরই বাস্তবতা তাঁর বিয়েতে কার্যকর হয়েছিল বলে তিনি মন্তব্য করেন।
জানতে পেরেছি তিনি নিজ সন্তানদের (যাদের সংখ্যা মাশাআল্লাহ অনেক) বিয়ে শাদী অত্যন্ত সাদেগীর সাথে পূর্ণ সুন্নত মোতাবেক আঞ্জাম দিয়েছেন। তাছাড়া যুহদ, তাকওয়া ও সকলের হক আদায়, যিম্মাদারী পালনে যথাযথ আমানত রক্ষা, আদব এবং তাওয়াযুসহ সুন্নতে নববীয়্যার বড় বড় দিকগুলোর অনুশীলন তার যিন্দেগীতে ছিল একটি স্পষ্ট বিষয়।
মাওলানার মধ্যে শায়েখের মুহাব্বত ও সুন্নতের অনুসরণ এই উভয় জিনিসের বাস্তবতা উপলব্ধি করে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রাহ.-এর একটি বাণীর প্রতি অধমের মন ধাবিত হচ্ছে। তাঁর এই বাণী হযরত হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. অত্যন্ত গুরুত্ব ও তাকীদের সাথে উদ্ধৃত করতেন। বাণীটি এই- ‘(কারো জীবনে) শায়েখের মুহাব্বত ও সুন্নতের অনুসরণ হতে থাকলে লাখো গহিন অন্ধকারও অন্ধকার নয়; বরং তা সবই নূর। আর এই দুটি জিনিসের (অর্থাৎ শায়েখের মুহাব্বত ও সুন্নতের অনুসরণ) কোনো একটিরও অভাব থাকলে লাখো নূরও অন্ধকারই বটে’। হযরত থানভী রাহ. হযরত হাফেয শিরাজী রাহ.-এর এই কবিতাও প্রায়ই উদ্ধৃত করতেন-
در طریقت ہر چہ پیش سالک آید خیراوست + بر صراط مستقیم اۓ دل کسے گمراہ نیست.
‘তরীকতের মধ্যে সালেক যা কিছুই অর্থাৎ যে হালতেরই সম্মুখীন হয়, তার জন্য তাই উত্তম। কেননা সীরাতে মুসতাকীমের উপর প্রতিষ্ঠিত অন্তর পথভ্রষ্ট নয়’।
তবে হযরত হাকীমুল উম্মত এ-ও বলতেন, এতে হালতের ‘আগমন’ ও ‘সিরাতে মুসতাকীম’ শব্দ দুটির শর্ত আছে। প্রথম শর্তটির অর্থ হচ্ছে, সেই হালত নিজ থেকে আসে, টেনে আনা হয় না। অর্থাৎ তা গায়রে এখতেয়ারী। তাই বাহ্যত শত কষ্ট হলেও তার কোনো কিছুই দোষণীয় নয়। দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, সীরাতে মুসতাকীমের উপর মজবুত থাকা। কবিতার মর্মার্থ এই যে, সীরাতে মুসতাকীমের উপর মজবুতির সঙ্গে কায়েম থাকলে প্রিয় বা অপ্রিয় গায়রে এখতেয়ারী যে কোনো হালই আসুক না কেন তা সালেকের জন্য শুভই বটে।
বলা বাহুল্য, মাওলানার জীবনে উল্লিখিত গুণাবলি আমরা (তাঁর দোস্ত-আহবাব ও তার সঙ্গে সম্পর্কধারীগণ) বিলক্ষণ দেখতে পেয়েছি। তিনি সারাটি জীবন শায়েখের মুহাব্বতে ও সুন্নতের অনুসরণে ছিলেন তৎপর, একনিষ্ঠ।
আপন শায়েখ ও উস্তায হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর জীবনের অসমাপ্ত কাজ আঞ্জাম দেওয়ার জন্য পাহাড়পুরী রাহ. নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন। হাফেজ্জী হুযুরের মহৎ এরাদা ছিল, তিনি ক্ষমতায় যেতে পারলে বাংলাদেশের আটষট্টি হাজার গ্রামে আটষট্টি হাজার মক্তব-মাদরাসা স্থাপন করবেন। আর রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায় যাওয়া ছাড়াও তিনি এ চেষ্টায় অদমিত ছিলেন। যেমন তিনি দেশে অনেক মাদরাসা-মসজিদ করেছিলেনও। মাওলানা পাহাড়পুরী রাহ. আপন শায়েখের সঙ্গে এমন কাজে শরীকও ছিলেন। আর শরীক থাকার ফলে তার প্রশিক্ষণও হচ্ছিল। শায়েখের ইন্তেকালের পর তিনি কোমর বেঁধে লেগেছিলেন শায়েখের অসমাপ্ত কাজ আঞ্জাম দেওয়ার জন্য। কিছু কাজ আঞ্জাম দিয়েওছিলেন। ইতিমধ্যে তার দৃষ্টিশক্তি হারাতে শুরু করে। এদিকে শায়েখের অসমাপ্ত আরো বহু কাজ বাকি থেকে যায়। ফলে তিনি একেবারে ভেঙ্গে পড়লেন। দৃষ্টিশক্তি হারানোর যে কী ফযিলত, মাওলানা তা বিলক্ষণ জানতেন। এ-ও জানতেন যে, আমাদের আকাবিরের মধ্যে কেউ কেউ উক্ত ফযীলতের অধিকারীও হয়েছেন (আল্লাহ তাআলার প্রতি আমাদের হুসনে যন এই যে, মাওলানাও তাঁদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।) কিন্তু তাঁর ভেঙ্গে পড়ার কারণ এই ছিল যে, আহা! আমি তো আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন শায়েখের অসমাপ্ত কাজগুলি শেষ করে যেতে পারলাম না।
শুনে অবাক হতে হয় যে, দৃষ্টিশক্তি একেবারে হারিয়ে ফেলার কাছাকাছি সময় পর্যন্ত মাওলানা লালমাটিয়া মাদরাসার শায়খুল হাদীস হিসেবে বুখারী শরীফের দরস দিতে থাকেন। সেইসাথে অপরাপর ইলমী প্রতিষ্ঠানেরও খেদমত করতে থাকেন। মাশাআল্লাহ, মাওলানার দুই ছেলে বড় আলেম হয়েছেন। তারা পিতার আখেরী কাজকর্মে সহযোগিতা করছিলেন। আর এখন তো শ্রদ্ধেয় পিতার পর সেসব কাজের কাণ্ডারি তাদেরকেই হতে হচ্ছে। তাদের বড়জন মাওলানা আশরাফুজ্জামান, দ্বিতীয়জন মাওলানা আবরারুজ্জামান। তাদের জন্য সকলে দুআ করবেন। তারা যেন পিতার যথোপযুক্ত সন্তান হিসেবে পিতার রেখে যাওয়া কাজগুলি আঞ্জাম দিতে পারেন।
মাওলানা রাহ.-এর হাতে গড়া, তাঁর হাতে তালীম ও তরবিয়াত পাওয়া, তাঁর বিশিষ্ট খলীফা যারা আছেন তারা যেন তাঁর রেখে যাওয়া কাজগুলি দেখেন এবং আঞ্জাম দেন- এ-ই আমার প্রত্যাশা।
[1] ১ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মাওলানার লিখিত একটি পুস্তকে তাঁর প্রতি শায়েখের স্নেহ মুহাব্বতের কথা বলতে গিয়ে তিনি লেখেন ‘আামার জীবন হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর যে কী পরিমান স্নেহ, মুহাব্বত ও আস্থায় ধন্য হয়েছে তা বলে বুঝানো যাবে না, লিখেও শেষ করা যাবে না। অজস্র ঘটনা রয়েছে।’