শায়েখ শুয়াইব আরনাউত রাহমাতুল্লাহি আলাইহি
বিশ্বের নানা প্রান্তের খ্যাতিমান আলিম একের পর এক বিদায় নিয়ে যাচ্ছেন। বাঁধভাঙ্গা ঢলের মতোই চলছে তাঁদের প্রস্থান। উত্তর হতে দক্ষিণ। পূর্ব হতে পশ্চিম সর্বত্রই যেন শুরু হয়ে গেছে বিদায়ের এক মহামিছিল। সবখান থেকে আসছে হৃদয়বান নিবেদিতপ্রাণ ইলমের ধারকবাহক সব ব্যক্তিত্বের ইন্তেকালের খবর।
মাত্র কিছুদিন আগে যে ঘটনাটি গোটা ইসলামী বিশ্বের ইলমী পরিম-লকে ঝাঁকুনি দিয়ে গেলো তা হলো, শায়েখ শুয়াইব আরনাউত রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মৃত্যুসংবাদ! এমন একজন মহারথীকে হারিয়ে ইলমী হালকাগুলো সত্যিই শোকে মুহ্যমান।
শায়েখ শুয়াইবের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় তাঁর তাহকীককৃত কিতাব ‘সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা’র মাধ্যমে। যখন জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া বিন্নুরী টাউন করাচিতে আমরা উলূমুল হাদীস বিভাগের তালিবে ইলম। সূচীপত্রসহ পঁচিশ খণ্ডের এই সুবৃহৎ গ্রন্থখানি তাঁর তাহকীকে (নিরীক্ষণ ও সম্পাদনায়) ছেপে প্রকাশিত হয়। কী সূক্ষ্ম সম্পাদনা! কী চমৎকার তাহকীক! এত বিশাল কলেবর হওয়া সত্ত্বেও সম্পাদনা কিংবা ছাপার ভুল খুব সামান্য। সেই সঙ্গে কিতাবটির বিভিন্ন স্থানে পাদটীকায় যুক্ত হয়েছে কত দামী-দামী নোট! আর ছাপাও সে কী সুন্দর! দৃষ্টিনন্দন!
তাহকীকুত তুরাছের কাজ তো করছেন অনেকেই। কিন্তু ইখলাছ ও ইতকান এবং নিষ্ঠা ও নিপুণতার সাথে এই কাজ সম্পাদন করেন- এমন মুহাক্কিক ও বিশ্বস্ততা রক্ষাকারী দায়িত্বশীল আলিম একবারেই নগণ্য সংখ্যক। শায়েখ শুয়াইব আরনাউত সেই হাতেগোনা ব্যক্তিত্বদেরই একজন ছিলেন, যাদেরকে আল্লাহ তাআলা এই মহৎ গুণাবলী দান করেছেন এবং যারা আল্লাহ প্রদত্ত এই গুণ ও যোগ্যতাকে ইলমে দ্বীনের সেবায়, বিশেষ করে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর সংকলিত ইলমী উত্তরাধিকারের সংরক্ষণ ও তার প্রচার-প্রসারে উজাড় করে দিয়েছেন। এভাবে তিনি সে সকল কীর্তিমান পুরুষদের কাতারে শামিল হয়ে গেছেন, ধরণীপৃষ্ঠ থেকে যাদের চিহ্ন মুছে দেওয়া কোনোদিনই সম্ভব নয়। আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক কালের উত্তরসূরীদের মাঝে তাদের পূর্বসূরীদের নমুনা পয়দা করে দিন এবং কিয়ামত পর্যন্ত উম্মতের হেফাযত ও সুরক্ষা নিশ্চিত করুন।
শায়েখ শুয়াইবের জন্ম যদিও দামেশকে হয়েছে, তবে তার বাবা মূলত ছিলেন আলবেনিয়ার বাসিন্দা। আলবেনিয়া একসময় উসমানী খেলাফতের অধীনে ছিল। কিন্তু আল্লাহ তাআলার নাফরমানী এবং নিআমতে খেলাফতের না-শোকরীর দরুণ উম্মতের উপর যে সকল আযাব আসতে থাকে তার অংশ হিসেবেই ১৩৩০ হিজরী মোতাবেক ১৯১২ ঈসাব্দে এই অঞ্চল উসমানীদের হাতছাড়া হয়ে যায় এবং গোড়া থেকেই একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রের মতো করে তার নতুন জীবন শুরু হয়। তারপর আহমদ জুগু, যে মূলত কামাল আতাতুর্কেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করছিল তার মন্ত্রী থাকাকালে এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালনকালে সেক্যুলারিজম সেখানে তুঙ্গে পৌঁছে। মন্ত্রী থাকা অবস্থায় (১৯২০-১৯২১ ঈ.) তিনি হস্তলিপি বদলে দেন আর রাষ্ট্রপ্রধান থাকাকালে ১৯২৪ ঈসাব্দে হিজাব নিষিদ্ধ করেন।
এমন পরিস্থিতিতে আলবেনিয়া থেকে হিজরতের উদ্দেশ্যে যে সকল দ্বীনদার পরিবার তখন বেরিয়ে পড়েন তাদের মধ্যে শায়েখ শুয়াইবের আব্বা জনাব মুহাররম এবং শায়েখ মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী রাহ.-এর বাবা হানাফী আলেম জনাব নূহ নাজাতী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এরা দু’জন অনেক দীর্ঘ ও কষ্টকর সফর শেষে ১৩৪৪ হিজরীতে (১৯২৬ ঈ.) দামেশক পৌঁছেন। হিজরতের সময় শায়েখ নূহ নাজাতীর সাথে তার বারো বছর বয়সের ছেলে মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীনও ছিল। এরা দু’জনেই ছিলেন আরনাউত বংশের। এদের পর ১৩৫৬ হিজরীতে আলবেনিয়া থেকে আরনাউত খান্দানের আরো এক পরিবার দামেশকে আসে। সেটা হল সুলাইমান আলগাউজীর পরিবার। ইনি হলেন ওয়াহ্বী সুলাইমান আলগাউজীর বাবা। এখন তো ওয়াহ্বীও আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেছেন। দামেশকে আরনাউত গোষ্ঠীর আরো অনেক পরিবার রয়েছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশ কসোভো ও মকদুনিয়া থেকে আসা। শায়েখ আব্দুল কাদের আরনাউতের বাবা কসোভোরই বাসিন্দা। তিনি তার তিন বছর বয়সী ছেলে (কাদরী পরবর্তীতে আব্দুল কাদের আরনাউত)-কে নিয়ে ১৩৫০ হিজরী (১৯৩১ ঈ.)-এ দামেশক পৌঁছেন।
দামেশক আসার দু’বছর পর ১৩৪৬ হিজরী মোতাবেক ১৯২৮ ঈসাব্দে, যখন জনাব মুহাররমের বয়স আনুমানিক সাতান্ন বছর, তখন তার ছেলে শুয়াইবের জন্ম হয়। শুয়াইবের বয়স পাঁচ বছর পূর্ণ হতেই তাকে দামেশকের ‘মাদরাসায়ে ইলমিয়া’তে ভর্তি করে দেন। স্কুলে কেন দিলেন না, এ সম্পর্কে জনাব মুহাররমের বক্তব্য, ওখানে গেলে দ্বীন-ঈমানের হেফাযত করা মুশকিল হয়ে পড়বে। মাদরাসায়ে আরাবিয়াতে শুয়াইব চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন। এরপর শায়েখ আমীন হানাফীর ‘মাদরাসাতুল আদাবিল ইসলামী’তে পঞ্চম শ্রেণী পড়েন। এরপর কোনো কারণে পড়াশোনায় বিরাম পড়ে। ১৩৬৩ হিজরী (১৯৪৪ ঈ.)-এ যখন তার বয়স ষোল, তখন আবু নাদের ইবরাহীম জানদালির দোকানে তিনি কাজ করা শুরু করেন। কিন্তু ঐ দোকানদারিই পুনরায় তার জন্য ইলম হাসিলের দরজা উন্মুক্ত করে দেয়। কিছু দিনের মধ্যেই তিনি দোকানের মালিক ইবরাহীম জানদালির সাথে তার উস্তায শায়েখ আরেফ দুয়াজির সবকে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন। এরপর দোকানের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শায়েখ সুলাইমান আলগাউজির এখানে দৈনিক বাদ মাগরিব উপস্থিত হতে থাকেন। তার কাছে নাহুর কিতাবাদি পড়েন। কাফিয়া ইবনে হাজেব এবং শরহে জামীও পড়েন। ফিকহে হানাফীর কিতাব মারাকিল ফালাহ এবং দ্বীন শিক্ষার চমৎকার ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ ‘আততারীকাতুল মুহাম্মাদিয়া’র দরসও গ্রহণ করেন। ছাহেবে হিদায়ার শাগরিদ বুরহান যারনুজী রাহ. রচিত ‘তালীমুল মুতাআল্লিম তরীকুত তাআল্লুমে’রও দরস নেন।
প্রসঙ্গত বলতে চাই, শেষোক্ত কিতাবটির দরস আমি আমার আম্মাজানের উৎসাহ প্রদানে আমার বড় ভাই মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ্র কাছে গ্রহণ করেছি। যতটুকু মনে পড়ে, কাফিয়ার বছর। রমযানুল মুবারকের বিরতিতে। আল্লাহ তাআলা আমার সকল মুরব্বিকে তাঁর শান মোতাবেক জাযায়ে খায়ের দান করুন। আমীন।
শায়েখ শুয়াইব কাফিয়া ও শরহে জামী পড়া সত্ত্বেও নাহুর প্রায়োগিক পাঠ গ্রহণের প্রয়োজন অনুভব করেন। যা তিনি জামে উমাবিতে মুহাম্মাদ আদীব আলকাল্লাসের কাছে লাভ করেন। তারপর তার মাধ্যমেই তিনি দামেশকের শায়খুল মাশায়েখ মুহাম্মাদ সালেহ ফারফুরের মজলিসে যাবার সুযোগ পান। জামে ফাতহীতে হতো তার দরসসমূহ। এশার পর তাফসীরের দরস। যা সর্বস্তরের জন্য ছিল। প্রতিদিন সকালে (জুমার দিন ছাড়া) রদ্দুল মুহতার (ফাতাওয়ায়ে শামী)-এর দরস। জুমার দিন সকালে ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন-এর দরস এবং প্রতি মঙ্গলবারে নিজ শাগরিদদের বাসায় একটি দরস, যেখানে কুরআন মাজীদ খতম করা হতো (ধারাবাহিক)। ঐ দরসে তিনি রিাসালায়ে কুশাইরিয়্যা থেকেও পড়ে শোনাতেন।
শায়েখ মুহাম্মাদ সালেহের দরসগুলোর মধ্যে তাফসীরে নাসাফীর দরস শুয়াইব আরনাউতের খুব প্রিয় ছিল।
এ পর্যন্ত মুহাম্মাদ আদীব আলকাল্লাস ও তার শাগরিদ শুয়াইব হালাল রোযগারের জন্য নিজ নিজ কর্মব্যস্ততার পাশাপাশি দরসে অংশ নিয়ে আসছিলেন। শায়েখ মুহাম্মাদ সালেহ ফারফুর যখন তাদের আগ্রহ-উদ্দীপনা এবং চেষ্টা ও নিষ্ঠা দেখতে পেলেন তখন তাদের জন্য জামে ফাতহীর একটি কামরা খালি করে দিলেন এবং দু’জনের জন্য ভাতা বরাদ্দ করলেন। কাজ ছেড়ে দিয়ে সর্বক্ষণ ইল্ম তলবে নিয়োজিত থাকার সুযোগ করে দিলেন এবং ইঙ্গিত করলেন যে, আমি অচিরেই ‘মা‘হাদুল ফাতহিল ইসলামী’ নামে মাদরাসা করতে যাচ্ছি। ইনশা আল্লাহ তোমরা সেখানে মুদাররিস হবে।
এই অবসরেই শায়েখ শুয়াইব শায়েখ মুস্তফা সিবায়ী, শায়েখ হাসান বান্না এবং সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নাদাবী ও অন্যান্যের লেখাসমূহ পড়বার সুযোগ পান। ১৩৭১ হিজরী (১৯৫২ ঈ.)-এ শায়েখ ফারফুর তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মা‘হাদুল ফাতহিল ইসলামীর ভিত্তি স্থাপন করেন। ১৩৭৪ হিজরী পর্যন্ত শায়েখ শুয়াইব এখানে সাফল্যের সাথে তাদরীসের খেদমত আঞ্জাম দেন। ১৩৭৫ হিজরী (১৯৫৬ ঈ.)-এ তিনি আল মা‘হাদুল আরাবীতে নিয়োগ পান। ১৩৮৪ হিজরী (১৯৬৪ ঈ.) পর্যন্ত এখানে দরস দান অব্যাহত থাকে।
‘মা‘হাদুল ফাত্হ’ এবং ‘আলমা‘হাদুল আরাবীতে’ পাঠদানকালে ইলমী তারাক্কীর জন্য তিনি মুতালাআ অব্যাহত রাখেন এবং বিশেষভাবে ইলমুল হাদীস ও তাহকীকুত তুরাছের দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করেন। মাসলাক ও মাশরাবের বিভিন্নতা ডিঙ্গিয়ে বহু উলামা ও মুফাক্কির-চিন্তাশীল ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে তিনি উপকৃত হয়েছেন। ঐ সময় তার যা বয়স ছিল, ইলমী যোগ্যতা যতখানি পোক্ত হয়েছিল এবং আমলী তাজরেবা ও বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষার যে সকল স্তর তিনি পার হয়ে এসেছিলেন, সে সব কিছুর বিচারে তার জন্য এ পথ এখতিয়ার করা ভুল ছিল না। শায়েখ শুয়াইবের প্রশংসনীয় দিক হল, কোনো শায়েখের কাছে যখন তিনি কোনো বাড়াবাড়ি দেখতে পেয়েছেন বা কোনো বিচ্ছিন্ন কথা তার কাছে শুনেছেন তখন সে ক্ষেত্রে তিনি তার সাথে সহমত হননি; বরং কঠোরতার সাথে স্পষ্ট ভাষায় সেটাই ব্যক্ত করেছেন, যেটা তার কাছে হক।
তার শাগরিদ ইবরাহীম যাইবাকের দেয়া তথ্য মতে, পরে কোনো সময় তিনি আফসোস করতেন যে, এতটা শক্তভাবে আপত্তি করা আমার উচিত ছিল না। ন¤্রতাই ভালো এবং এতেই ফায়েদা হয়। উস্তায আহমাদ রাতেব নাফফাখের কাছ থেকে তাহকীকুত তুরাছ বিষয়ে শায়েখ শুয়াইব উপকৃত হয়েছেন। কিন্তু একদিন দেখলেন, তিনি হেদায়ার শরাহ ফাতহুল কাদীরের রচয়িতা কামালুদ্দীন ইবনুল হুমামের সমালোচনা করছেন, শায়েখ শুয়াইব আর বরদাশত করতে পারলেন না। পরিষ্কার বলে দিলেন-
"من أنت حتى تتكلم في الكمال بن الهمام"؟!
(ইবনুল হুমামের সমালোচনা করার আপনি কে?!) এরপর আরো স্পষ্ট করে বললেন,
>هو مجتهد حقا، لو كنت تعرف حقا لما قلت بحقه ما قلت<
(যদি আপনি তাঁকে আসলেই চিনতেন তাহলে তাঁর সম্পর্কে এরকম বলতে পারতেন না)।
‘আলমা‘হাদুল আরাবী’তে থাকাকালেই তিনি তাহকীকুত তুরাছের কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৩৮৪ হিজরী (১৯৬৪ ঈ.) থেকে তিনি নিজেকে যেন এ কাজের জন্য উৎসর্গিত করে দেন। প্রথমে তিনি যুহাইর শাওয়েশের আলমাকতাবুল ইসলামীতে তাহকীকুত তুরাছের কাজ করেন। পরে ‘মুআসসাসাতুর রিসালা’য় এই খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যেতে থাকেন। তাফসীর, ফিক্হ ও আরবী সাহিত্যের অনেক মৌলিক গ্রন্থের তিনি তাহকীক-তা‘লীক তথা নিরীক্ষণ, সম্পাদনা ও টীকা রচনার কাজ করেছেন। কিন্তু জীবনের শেষ বছরগুলোতে শুধু হাদীসের কিতাবসমূহের তাহকীক ও তাখরীজের কাজেই নিজের সবটুকু মনোযোগ ব্যয় করেন। এই ধারায় তার সবচে’ বড় কর্ম হল, ‘মুসনাদে আহমাদ’, ‘শরহু মুশকিলিল আছার-ত্বাহাবী’ এবং ‘সহীহ ইবনে হিব্বান’-এর তাহকীক ও তাখরীজ (নিরীক্ষণ, সূত্রনির্দেশ ও রেওয়ায়েতসমূহের সনদগত মাননির্ণয়)। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সুনানে আবু দাউদ, জামে তিরমিযী, সুনানে কুবরা নাসায়ী ও সুনানে ইবনে মাজাহ-এর তাহকীকের কাজ করতে প্রয়াস পান। পরবর্তীতে সহিহ বুখারী এবং ফাতহুল বারী-ইবনে হাজার-এর তাহকীকও সম্পন্ন করেন।
তাহকীকুত তুরাছের কাজ খুবই সূক্ষ্ম ও গুরুভার। এর জন্য পরিপক্ক ইলমী যোগ্যতা, সূক্ষ্ম দৃষ্টি, ব্যাপক জানাশোনা, আরবী ভাষার বিস্তৃত ও পাকাপোক্ত জ্ঞান, যে শাস্ত্রের কিতাব তাহকীক করা হবে সেই শাস্ত্রের সাথে পূর্ণ অন্তরঙ্গতা ইত্যাদি গুণাবলী এবং তার চেয়েও বেশি করে পূর্ণ আমানত ও দ্বীনদারি এবং ইনসাফ ও ভারসাম্য রক্ষার গুণ থাকা জরুরি। নতুবা তাহকীককৃত কিতাব কখনোই ত্রুটিমুক্ত হতে পারবে না। ইলমের ধারক-বাহক ও তলাবায়ে ইলমে দ্বীনের জন্য খুশীর কথা যে, শায়েখ শুয়াইব রাহ. উপরিউক্ত গুণের অধিকারী ছিলেন। সেজন্য মাশাআল্লাহ, তাঁর তাহকীক ও তাখরীজকৃত কিতাবসমূহ প্রামাণ্য ও নির্ভরযোগ্য বিবেচিত হয়েছে। সমসাময়িক মুহাক্কিক আলেমগণ এ বিষয়ে তাঁর প্রতি সন্তুষ্টি ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
শায়েখ শুয়াইব হাদীস শরীফের যে সব কিতাবের তাহকীক করেছেন সেগুলোতে তিনি কেবল ‘তাহকীকুন নুসূসেই’ ক্ষান্ত থাকেননি, বরং হাদীসসমূহের বিস্তারিত তাখরীজ (পূর্ব-পরের হাদীসের মৌলিক গ্রন্থসমূহে আলোচিত হাদীসের স্থানসমূহ নিদের্শ) করেছেন। সংক্ষেপে বর্ণনাকারীদের মানগত অবস্থা লিখেছেন এবং প্রত্যেক রেওয়ায়েত ও বর্ণনার সনদের বিচার-বিশ্লেষণ উল্লেখ করেছেন। ‘তাখরীজ’-এর এই কাজ যদিও সবক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মানের হয়নি, তবুও সামগ্রিকভাবে তাঁর এই কর্মটিও সর্বজন সমাদৃত হয়েছে। উলূমুল হাদীসের গবেষকগণ এবং তলাবায়ে কেরাম এ দ্বারা অসামান্য উপকার পেয়ে আসছেন। এখানে মনে রাখা ভালো, যে সকল ক্ষেত্রে যওক ও ইজতিহাদের ভিন্নতার অবকাশ রয়েছে, সে সব ক্ষেত্রে অপর কোনো মুহাদ্দিসের মতামত ভিন্নতর হওয়া বিচিত্র নয়, নয় কোনো দোষেরও বিষয়। সেই সঙ্গে এটাও জ্ঞাতব্য যে, এই বড় বড় কাজগুলো সম্পাদনের মুহূর্তে তাঁর পাশে তরুণ আলেমদের একটি পরিষদও ছিলো তাঁর সহযোগীরূপে। যাদের করা কাজগুলো তিনি নযরে ছানী করতেন। হতে পারে, নযরে ছানীর সময় তাদের কোনো ভুল তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। এভাবে অন্যদের কিছু ভুলের দায়ও এসে পড়েছে তাঁর উপর!
‘মাখতুতাত’ (বা হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি) হস্তগত হওয়া বা ‘মাখতুতাতে’র খোঁজ পাবার ক্ষেত্রে শায়েখ শুয়াইব কখনো শায়েখ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ. (১৩৩৬ হিজরী-১৪১৭ হিজরী)-এরও সহযোগিতা পেতেন। তাঁর তাহকীককৃত কিতাবসমূহের মধ্যে মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম আলওযীরুল ইয়ামানী রাহ. (৭৭৫ হিজরী-৮৪০ হিজরী)-এর অসাধারণ গ্রন্থ ‘আল আওয়াছিম ওয়াল কাওয়াছিম ফিয যাব্বি আন সুন্নাতি আবিল কাসিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এর মাখতুতাহ শায়েখ আব্দুল ফাত্তাহই হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রশীদ নু‘মানী রাহ. (১৩৩৩ হিজরী-১৪২০ হিজরী)-এর ব্যক্তিগত কুতুবখানা থেকে জামিয়াতুল ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সউদ আলইসলামিয়া রিয়াদ-এর জন্য সংগ্রহ করেছিলেন এবং শায়েখ শুয়াইবকে এর খোঁজ জানিয়েছিলেন।
হাদীসের বিশাল ও বৃহৎ কিতাবসমূহের তাহকীক ও তা‘লীক (সম্পাদনা ও টীকা রচনা)-এর কাজ বর্তমান সময়ে শায়েখ আব্দুল ফাত্তাহ রাহ.-এর আদর্শ শিষ্য শায়েখ মুহাম্মাদ আওয়ামাহ্ও করে যাচ্ছেন। সুনানে আবু দাউদ ও মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বার উপর তাঁর তাহকীকী কাজ বেশ কিছু দিন হল আলোতে এসেছে এবং মুহাক্কিক আলেম সমাজের ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে। ‘মুসান্নাফ’ ও তার তাহকীকী খেদমত সম্পর্কে বান্দা নিজের অভিব্যক্তি মাসিক আলকাউসার জুমাদাল উখরা ১৪২৯ হিজরী (জুন ২০০৮ ঈ.) সংখ্যায় তুলে ধরেছি, যা এখন প্রবন্ধ সংকলন ‘নির্বাচিত প্রবন্ধে’ স্থান পেয়েছে।
শায়েখ মুহাম্মাদ আওয়ামার আরেকটি বড় কারনামা অতিসম্প্রতি আমাদের সামনে এসেছে। ‘উসূলে হাদীস’ বা হাদীস শাস্ত্রের নীতিমালা বিষয়ে জালালুদ্দিন সুয়ূতীর সুপরিচিত গ্রন্থ ‘তাদরীবুর রাবী’র তাহকীক ও তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা শায়েখের কলমে মোট পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে।
যাই হোক, শায়েখ শুয়াইব আরনাউতের অন্যান্য সদগুণের পাশাপাশি একটি বড় বিষয় এই যে, তিনি তাঁর তাহকীককৃত কিতাবসমূহে ভূমিকায় কিংবা টীকায় কোথাও -আমার জানা মতে- কোনো বিছিন্ন মতের পক্ষ সমর্থন করেননি। একইভাবে তার বিরোধীদের উপরও চড়াও হতে চেষ্টা করেননি। আবার ইলমী কোনো প্রসঙ্গে নিজের মতের পক্ষেও গোঁ ধরেননি। এ এমনই এক অনন্য গুণ তাঁর, যার জন্য তার উস্তাযপুত্র -যার কাছ থেকে আলাপ আলোচনার পর্যায়ে তিনি কিছু পরিমাণ উপকৃতও হয়েছেনÑ শায়েখ মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী রাহ. থেকে তিনি ভিন্ন এবং সে জন্যই তার ইলমী র্কীতিসমূহ সকল মাসলাক ও মাশরাবের লোকদের কাছে হয়েছে গ্রহণীয় ও প্রশংসনীয়। শায়েখ আলবানী রাহ. সম্পর্কে শায়েখ শুয়াইবের মতামত পাঠকবর্গ আলকাউসার রজব ১৪৩৭ হিজরী (এপ্রিল ২০১৬ ঈ.) সংখ্যায় পড়েছেন। ২৭/১০/২০১৬ ঈ. রাত সাড়ে দশটায় আমাকে মদীনা মুনাওয়ারা থেকে ভাই মুহিউদ্দীন ফারুকী বার্তা মারফত জানান তার ওয়াফাতের খবর। তিনি লেখেন:
"توفى اليوم المحدث العلامة الشيخ شعيب الأرنؤوط رحمه الله رحمة واسعة"
এরপর আরো অনেক বন্ধুই খবর দিতে থাকেন।
১৩৪৬ হিজরী মোতাবেক ১৯২৮ ঈসাব্দে দামেশকে তাঁর জন্ম হয়েছিল। আর মুহাররম ১৪৩৮ হিজরী (অক্টোবর ২০১৬ ঈ.) বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে অর্থাৎ জুমার রাতে তাঁর ইন্তেকাল হল। চান্দ্রবর্ষ হিসেবে তার বয়স একানব্বই বছরের কিছু বেশি হয়।
এখানে লক্ষ রাখা প্রয়োজন, কোনো বড় ব্যক্তির কোথাও কোনো ভ্রম হয়ে গেলে কিংবা তার ব্যক্তিত্বের মাঝে কোন খুঁত দৃষ্টিগোচর হলে সে কারণে তার প্রতি যেমন মন্দ ধারণা পোষণ করা উচিত নয়, তেমনি তার ভ্রম বা দুর্বলতার ক্ষেত্রেও তাকে অনুসরণ কাম্য নয়।
পরিশেষে এ কথাটিও উল্লেখ করতে চাই, আজকাল কিছু মানুষের মধ্যে এ নিয়েও আলোচনা হচ্ছে যে, শায়েখ শুয়াইব আকীদার বিচারে সালাফী না আশআরী ছিলেন? সত্যি বলতে, তিনি এই অর্থে সালাফী ছিলেন না, যেমনটা সাধারণভাবে হয়ে থাকে অন্য সালাফীরা। তিনি হচ্ছেন সঠিক ও বাস্তবিক অর্থে সালাফী। সে কারণে তিনি একই সঙ্গে নিষ্ঠা, ভারসাম্য ও উপলব্ধি সম্পন্ন আশআরীও। অতএব এখানে কোনো বিরোধ নেই এবং কোনো তর্কেরও অবকাশ নেই।
শায়েখ শুয়াইবের প্রিয় শিষ্য শায়েখ ইবরাহীম যাইবাক শায়েখ শুয়াইবের জীবৎকালেই তাঁর কাছ থেকে শুনে শুনে তার জীবনীর উপর চমৎকার একটি কিতাব তৈরী করেছিলেন, যা শায়েখ বেঁচে থাকতেই ছেপে প্রকাশিত হয়েছে। যার নাম-
"المحدث العلامة الشيخ شعيب الأرنؤوط سيرته في طلب العلم وجهوده في تحقيق التراث"
দারুল বাশাইরিল ইসলামিয়া, বৈরুত থেকে ১৪৩৩ হিজরী (২০১২ ঈ.)-এ এর প্রথম সংস্করণ বের হয়েছে। আমার এই লেখার অধিকাংশ তথ্য ঐ কিতাব থেকেই নেয়া। আল্লাহ তাআলা এর লেখক ও প্রকাশককে উত্তম বিনিময় দান করুন। আমীন
আল্লাহ তাআলা শায়েখ শুয়াইব আরনাউতকে ভরপুর মাগফিরাত নসীব করুন। তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউসে আ‘লা মাকাম নসীব করুন এবং তাঁর সুন্দর কর্ম ও কীর্তিগুলোকে আল্লাহ তাআলা কিয়ামত পর্যন্ত উপকারিতা ও গ্রহণযোগ্যতা সহকারে বাকি রাখুন, স্থায়িত্ব দান করুন। আমীন
১২/২/১৪৩৮ হিজরী, রবিবার