রবিউল আউয়াল ১৪৩৮   ||   ডিসেম্বর ২০১৬

মিয়ানমারে মুসলিম গণহত্যা

রাখাইন রাজ্যের মুসলিমদের উপর গণহত্যা চলছে। হাজার হাজার বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অসংখ্য মুসলিম নারী-পুরুষকে জবাই করে এবং অকল্পনীয় নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। মিয়ানমার থেকে কোনোভাবে পালিয়ে আসা মুসলিম নারী-পুরুষের করুণ আকুতিÑ আপনারা আমাদের গুলি করে মেরে ফেলুন তবু ওখানে ফিরিয়ে দিয়েন না। ওরা আমাদের চরম কষ্ট দিয়ে মারবে।

এই অকল্পনীয় জুলুম এমন এক জাতির দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে, যাদের ধর্মটি হচ্ছে, গৌতম বুদ্ধের প্রাণী হত্যা মহাপাপের ধর্ম, আর যাদের রাষ্ট্রটা নোবেল প্রাইজপ্রাপ্ত অং সান সূচির বার্মা। মিয়ানমারের এই মুসলিম গণহত্যায় একইসাথে যেমন বৌদ্ধ ধর্মীয় অহিংসার প্রায়োগিক রূপটি দেখা যাচ্ছে তেমনি দেখা যাচ্ছে গণতন্ত্রেরও বাস্তব রূপটি।

অতীতের ইতিহাসে ফিরে গেলে একটি যুগ এমন পাওয়া যায় যখন ক্ষমতাবান হিন্দুদের মাধ্যমে এ অঞ্চলের বৌদ্ধরা ব্যাপক নির্যাতনের শিকার ছিল। এরপর মুসলিম শাসনামলে তারা লাভ করেছে নিরাপত্তা ও পৃষ্ঠপোষকতা। হায়! সেই মুসলিমদের উপরই অহিংস বৌদ্ধদের কল্পনাতীত সহিংসতা।

বর্তমান বিশ্ব-পরিস্থিতিতে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং আরো কিছু সাজানো ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোটা মুসলিম জাতিকে জঙ্গি-সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত করার এবং নির্যাতন-নিপীড়নের লক্ষ্যবস্তু বানানোর এক সাধারণ ধারা রয়েছে। এর পরও কোথাও কোনো সহিংস ঘটনা ঘটলে উলামা-মাশায়েখ সেগুলোর প্রতিবাদ করে থাকেন এবং আপন জাতিকে সব রকমের অন্যায় ও জুলুম থেকে নিবৃত্ত থাকার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। এই নির্দেশনায় কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষাই হয়ে থাকে তাদের প্রধান অবলম্বন। এ কারণে শত প্রচারণার পরও এবং মুসলিম সমাজের নানা ত্রুটি ও দুর্বলতা সত্ত্বেও ইসলাম এখনো শান্তির ধর্ম, মুসলিম এখনো শান্তিপ্রিয়।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সাধারণ বৌদ্ধ জনগণ তো দূরের কথা, এ ধর্মের ভীক্ষু ও ধর্ম-প্রচারকদের তরফ থেকেও এই সহিংসতার কোনো প্রতিবাদ, ধর্মের সাথে এর বিরোধ-বর্ণনার উল্লেখযোগ্য কোনো প্রয়াস চোখে পড়ছে না। অন্তত এই লেখাটি লেখার সময় পর্যন্ত এমন কোনো নজির চোখে পড়েনি। শুধু বার্মাতেই নয়, আমাদের দেশে এবং পৃথিবীর বহু দেশে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীরা রয়েছেন, আছে বহু মঠ ও মঠাধ্যক্ষ। কিন্তু কই? বুদ্ধের অহিংসার সাথে এই চরম সহিংসতার যে কোথাও কোনো বিরোধ আছে তা তো কেউই বলছেন না! কেউ তাদের তাগাদাও দিচ্ছেন না!

মুসলিম-সমাজের কোথাও কোনো সংখ্যালঘু পীড়নের ঘটনা ঘটলে, যা নিঃসন্দেহে অগ্রহণযোগ্য, এর প্রকৃত কারণ ও হোতাদের চিহ্নিত করার পরিবর্তে যারা জঙ্গিবাদ-বিরোধিতার শ্লোগান দিতে থাকেন, কিংবা যারা আবেগঘন কলাম লিখে থাকেন, কিংবা যারা মসজিদে মসজিদে জঙ্গিবাদ বিরোধী আলোচনার জন্য ইমাম-খতীবদের তাগাদা দিতে থাকেন তাদের কেউই কেন অন্য ধর্মের ক্ষেত্রে এ কাজটি করেন না? যে যা-ই বলুন, বর্তমান বিশ্বে মুসলিম জাতিই তো সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার, একই সাথে তারা হিন্দু সন্ত্রাসী, খ্রিস্টান সন্ত্রাসী, ইহুদী সন্ত্রাসী এবং বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাসের শিকার। অথচ কী মর্মান্তিক ব্যাপার যে, সন্ত্রাস-বিরোধী সকল আলোচনার ভার মুসলিম ধর্ম-গুরুদের! আমাদের কলম-সেবকেরা মুসলিম ভ্রাতৃত্বের কারণে না হোক অন্তত মানবিকতার কারণেও তো ঐ সকল ধর্ম-জাতির ধর্ম-গুরুদের তাগাদা দিতে পারেন, তারা যেন স্বজাতিকে এই সন্ত্রাসের পথ থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন এবং তাদের ধর্মের শান্তি ও অহিংসার বাণীÑ যদি তাতে তাদের কিছুমাত্রও বিশ্বাস থাকেÑ প্রচার করেন। এ পর্যন্ত এই ধরনের উল্লেখযোগ্য কোনো প্রয়াস দেখা যায়নি। ভবিষ্যতে দেখা যাবে কি না তা ভবিষ্যতই বলতে পারে?

বার্মার অং সান সূচি নোবেল প্রাইজপ্রাপ্ত গণতান্ত্রিক নেত্রী। তার আমলে এই চরম নির্যাতনের ঘটনাটি ঘটল। সম্প্রতি কোনো কোনো মহল থেকে তার নোবেল প্রাইজ ফিরিয়ে নেয়ার দাবি উঠছে, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যারা তাকে নোবেল প্রাইজের জন্য নির্বাচিত করেছেন তারা কি মুসলিম-বিরোধী সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা সম্পর্কে অন্ধকারে ছিলেন? মিয়ানমারের মুসলমানদের উপর নির্যাতন তো এই প্রথম নয়, দশকের পর দশক ধরে তারা নির্যাতনের শিকার। তার দেশের এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর যুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি কখনো কি একটি শব্দও উচ্চারণ করেছেন? করেননি; বরং নানা সময়ে এর বিপরীত অবস্থানই তার দ্বারা প্রকাশিত হয়েছে। বিবিসির এক মুসলিম সাংবাদিকের সাক্ষাৎকার নেয়ার ঘটনায় তার মুসলিম-বিদ্বেষী মন্তব্য এখনো অনেকের মনে থাকার কথা। সুতরাং কেউ যদি বলেন, বর্তমান বিশ্ব-ব্যবস্থায় মুসলিম-নিধনকে কার্যত মানবাধিকারের বিরোধী মনে করা হয় না তাহলে তাকে দোষ দেয়ার উপায় নেই। মুসলিম সমাজের বাইরের এই বৈরী পরিবেশে খুব বেশি দমে যাওয়ার কারণ নেই। কারণ ইসলাম তার সূচনা থেকেই বৈরিতার মোকাবেলা করে এসেছে। তবে মুসলমানদের মাঝেই যখন এমন একটি শ্রেণির সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে যারা ধর্মপ্রাণ হয়েও পশ্চিমাদের বন্ধুত্ব ও মানবতায় বিশ্বাস করেন তখন সত্যিই তা হয় মর্মান্তিক বেদনার ব্যাপার। এতে শত্রুপক্ষ দুই জায়গায় বিজয়ী হয়; নির্যাতন করে এবং নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর সাথে প্রতারণা করে। কুরআন মাজীদে একশ্রেণির মানুষের পরিচয় কত স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছেÑ

(তরজমা) যখন ওরা মুসলিমদের সাথে মিলিত হয় তখন বলে আমরা ঈমান এনেছি আর যখন ওদের শয়তানদের কাছে ফিরে যায় তখন বলে আমরা তোমাদেরই সাথে, আমরা তো (ওদের সাথে) বিদ্রƒপ করছি মাত্র। Ñসূরা বাকারা (২) : ১৪

বর্তমান যুগে মুসলিমদের সাথে সর্বপ্রকার সহিংসতার পরও যারা মুসলিম সমাজে মানবাধিকারের কথা বলেন এদের মাঝে আর পূর্বযুগের মুনাফিক গোষ্ঠীর মাঝে বড় কোনো পার্থক্য আছে কি?

এদের এই সব আপ্তবাক্যে যারা বিশ্বাস করেন তারা যে ওদের কাছেও হাসি ও করুণার পাত্রে পরিণত হন তা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করা যায় তত তাড়াতাড়ি আমাদের লজ্জা নিরসনের উপায় হয়। আমাদের কর্তব্য, চারপাশের উচ্চারণগুলোর অর্থ বাস্তব দৃষ্টান্তের সাথে মিলিয়ে গ্রহণ করা। আমরা পরাজিত হতে পারি, কিন্তু প্রতারিত যেন না হই

বিশ্বব্যাপী এখন যে সময়টি আমরা অতিক্রম করছি এর সঠিক মূল্যায়ন এবং পরিস্থিতির উন্নতির জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে নিজেদের শেকড়েÑ কুরআন-সুন্নাহর কাছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জীবন ও জীবনীর কাছে। তাহলে আমরা দেখতে সক্ষম হব যে, বর্তমান বিশ্ব মুসলিমের নিপীড়িত অবস্থার সমতুল্য দৃশ্যটি রয়েছে পবিত্র সীরাতেও। ইসলামের দাওয়াত শুরু হওয়ার পর মক্কার দশটি বছর আমাদের পূর্বসূরী মুসলিমদের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন বয়ে গিয়েছে। শক্তি ও ক্ষমতার দর্পে দর্পিত হিংস্র মানব গোষ্ঠীর মাধ্যমে হক ও সত্যকে হৃদয়ে লালনকারী দুর্বল মুসলমানদের বরাবর নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। এটা ঐ জাহেলী সমাজেও ছিল, এই জাহেলী সমাজেও রয়েছে। শিক্ষা, সভ্যতা, উন্নতি ও উৎকর্ষতার সকল দাবির সাথেই মানবতা ও ন্যায়পরায়ণতার দিক থেকে বর্তমান বিশ্ব-সমাজও যে এক জাহেলী সমাজ, তার জ্বলন্ত প্রমাণ, মুসলিম নির্যাতনের মর্মান্তিক দৃষ্টান্তগুলো। তো মানবতার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ও রাহবার ঐ পরিস্থিতির মোকাবেলা কীভাবে করেছিলেন এবং কীভাবে সমগ্র মানবতার জন্য এক নিরাপদ পৃথিবী গড়ে দিয়েছিলেন তা আজ আমাদের গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। বর্তমানের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের অসার শব্দ-বাক্যে নয়, আমাদের মুক্তি নিহিত রয়েছে আমাদের শেকড়ে অর্থাৎ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাতে প্রত্যাবর্তনের মধ্যেই। তাঁর মক্কী জীবন পুরোটাই ছিল মাযলুমিয়্যাত ও মাকহূরিয়্যাতের যুগ। কিন্তু এ যুগের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, ‘হারাকা। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শত বিপদেও দমে যাননি। আল্লাহ তাআলার উপর তাঁর অটূট-আস্থা ছিল। আর ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ছিলেন চূড়ান্তরূপে উৎসর্গিত। তিনি কঠিনতম প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তাঁর দাওয়াতী কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন এবং হৃদয় থেকে হৃদয়ে আলো জ্বেলে গেছেন। একইসাথে দাওয়াতের বিস্তার, সাফল্য ও প্রতিষ্ঠার জন্য যোগ্য মানব-শ্রেণি ও উপযুক্ত ভূমির অন্বেষণ অব্যাহত রেখেছেন। এক ব্যক্তি দাওয়াত কবুল করেনি তো অন্য ব্যক্তিকে ডেকেছেন, এক গোত্র কবুল করেনি তো অন্য গোত্রকে ডেকেছেন এবং অবিরাম ডেকেই গেছেন। পরিশেষে ঐ মানব-শ্রেণির সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটেছে, যাদের জন্য ইসলামের আনসার হওয়ার সৌভাগ্য আল্লাহ তাআলা লিখে রেখেছিলেন। তো ইসলামী দাওয়াতের অতি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য যা, তা হচ্ছে, আশা ও সঞ্চরণ। হতাশা বা স্থবিরতা দাওয়াতের চরিত্রের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। আল্লাহ তাআলা যদি চাইতেন তাহলে তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কী জীবনের প্রথম বর্ষেই কিংবা বলুন চতুর্থ বর্ষেই ইয়াছরিবের অধিবাসীদের ঈমান ও নুসরতের তাওফীক দিতে পারতেন। কিন্তু তা হয়নি। এতে কিয়ামত পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহর সামনে ইসলামের জন্য প্রতিকূলতা মোকাবিলার ও ইসলামী পন্থায় প্রতিকূলতা জয়ের সর্বাত্মক চেষ্টার সবক রয়েছে। সকল পরিস্থিতিতে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, সমর্পণ ও আনুগত্য এবং দাওয়াতের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় পূর্ণ আত্মনিবেদন, পরিস্থিতির সঠিক উপলব্ধি ও সঠিক কর্মপন্থা নির্ধারণ এবং বুদ্ধি, কৌশল, অর্থ-বিত্ত, সামাজিক অবস্থান সব কিছু দাওয়াতের স্বার্থে ব্যবহারের ফেদায়ী মনোভাবের এক আলোকিত নমুনা রয়েছে। এক কথায়, চরম বিপর্যয়ের পরিস্থিতিতেও যেমন হতাশার অবকাশ নেই তেমনি বিদ্যমান পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করারও সুযোগ নেই।

পবিত্র সীরাতের এর পরের অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাই হিজরত ও নুসরতের এক অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মানে ও মহিমায় এবং সুফল ও সফলতায় যার সমতুল্য নজির পৃথিবীর ইতিহাসে আরেকটি নেই। ইসলামী ইতিহাসের এ প্রোজ্জ্বল অধ্যায়টির বর্ণনা হতে পারে শত পৃষ্ঠায়, আর এর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ হতে পারে হাজার পৃষ্ঠায়। তবে এখানে সেই বর্ণনা ও বিশ্লেষণের সারসংক্ষেপ কুরআন মাজীদের দুটি আয়াতের মাধ্যমে তুলে ধরা যায়। এই দুই আয়াতে সাহাবীগণের দুটি বিশেষণ উল্লেখিত হয়েছে। এক. মুহাজির, অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীনের জন্য ঘর-বাড়ি, সহায়-সম্পদ, আত্মীয়-স্বজনকে ত্যাগকারী। আর দুই. আনসার, অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের এবং তাদের কাছে হিজরত করে আসা মুসলিম নর-নারীর সর্বাত্মক নুসরতকারী। এই দুই বিশেষণের ব্যাখ্যার জন্য আপনি পাঠ করতে পারেন সীরাত ও তারিখের শত শত পৃষ্ঠা। এরপর উল্লেখিত হয়েছে মুহাজির ও আনসারী সাহাবীগণের ঐ অত্যুজ্জ্বল গুণাবলী যার মাধ্যমে মক্কার মজলুম ইসলাম জাযীরাতুল আরবের সিমানা ছাড়িয়ে চারদিকে দূর দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল এবং একসময়ের মজলুম ইসলাম ও মুসলিমীন-এর পরশ ও সান্নিধ্যে অর্ধ বিশ্বের মজলুম মানবতা মুক্তির স্বাদ আস্বাদন করেছিল। সেই গুণ ও বৈশিষ্ট্যগুলো কী?

মুহাজিরগণের সম্পর্কে কুরআন বলছেÑ

لِلْفُقَرَآءِ الْمُهٰجِرِیْنَ الَّذِیْنَ اُخْرِجُوْا مِنْ دِیَارِهِمْ وَ اَمْوَالِهِمْ یَبْتَغُوْنَ فَضْلًا مِّنَ اللهِ وَ رِضْوَانًا وَّ یَنْصُرُوْنَ اللهَ وَ رَسُوْلَهٗ  اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الصّٰدِقُوْنَ   وَ الَّذِیْنَ تَبَوَّؤُ الدَّارَ ...

...যারা নিজেদের ঘরবাড়ি ও সম্পত্তি হতে বহিষ্কৃত হয়েছে এই অবস্থায় যে, তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাহায্য করে। ওরাই তো সত্যনিষ্ঠ। (এরপর আনসারীগণের সম্পর্কে বলছে,) ‘মুহাজিরদের আগমনের আগে যারা এই ভূমির অধিবাসী হয়েছে এবং ঈমান এনেছে। তাদের কাছে যারা হিজরত করে এসেছে ওদের এরা ভালবাসে এবং ওদের যা দেওয়া হয়েছে তার জন্য এরা অন্তরে কোনো আকাক্সক্ষা পোষণ করে না। আর তারা ওদেরকে অগ্রাধিকার দেয় নিজেদের উপর, নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও। যাদেরকে অন্তরের কার্পণ্য থেকে রক্ষা করা হয়েছে তারাই তো সফল। Ñসূরা হাশর (৫৯) : ৮-৯

এই দুই আয়াতে মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণের যে কটি গুণের উল্লেখ হয়েছে এবং যে কারণে তাঁরা আল্লাহর পক্ষ হতে সাদিক ও মুসলিহ’-এর সনদ লাভ করেছেন, সেই গুণগুলোর বাস্তব ও প্রায়োগিক দৃষ্টান্তের বর্ণনায় সীরাত ও তারিখের শত শত পৃষ্ঠা আলোকিত হয়ে আছে। আর তা গভীরভাবে উপলব্ধি করবার জন্য রয়েছে অতীত ও আধুনিক সভ্যতার অসংখ্য বিপরীত দৃষ্টান্ত। এ নিবন্ধে শুধু আনসারী সাহাবায়ে কেরামের কুরআন-উল্লেখিত গুণগুলো খানিকটা বিশ্লেষণ করছি।

তাদের প্রথম বৈশিষ্ট্য, তাঁরা ছিলেন মদীনা-ভূমির আদি অধিবাসী। কুরআন এখানে গুণটি উল্লেখ করেছে মাত্র তিন শব্দে। এর তাৎপর্য উপলব্ধি করবার জন্য অতীত ও বর্তমানের ভূখ-ভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতাগুলো স্মরণ করা দরকার হবে। পৃথিবীর নানা ভূখণ্ডের ইতিহাসে মূল অধিবাসীবহিরাগতশব্দটি এক বহুল চর্চিত শব্দ। অধিবাসী ও অভিবাসীর দ্বন্দ্বে পৃথিবীর নানা ভূখণ্ডে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানী, সম্পদহানী ঘটেছে এবং অসংখ্য নারীর ইজ্জত লুণ্ঠিত হয়েছে। শত-হাজার পৃষ্ঠা মসিলিপ্ত হয়েছে এই অন্ধকারের সমর্থন ও পক্ষপাতে এবং শত-হাজার দিবস, সপ্তাহ, মাস অতিবাহিত হয়েছে এই জাহিলিয়াতের বিস্তার ও প্রতিষ্ঠায়। সভ্য থেকে সভ্য জাতির পক্ষেও এই সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ওঠা সম্ভব হয়নি, এমনকি এই সংকীর্ণতাকে সংকীর্ণতা বলে উপলব্ধি করাও সম্ভব হয়নি। এর অতি সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত হচ্ছে বর্তমান পৃথিবীর সভ্যতমদেশে ট্রাম্পের মত ব্যক্তির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া, যিনি আমেরিকান ও অভিবাসী প্রসঙ্গটি খোলামেলা ব্যবহার করে প্রেসিডেন্ট নির্র্বাচিত হয়েছেন। এই সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ওঠার ও ঊর্ধ্বে তোলার এক সফল ও স্থায়ী দৃষ্টান্ত যিনি স্থাপন করতে পেরেছেন তিনি হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁর আসমানী পরশে তাঁর সঙ্গীগণ মানব-স্বভাবের এই কঠিনতম সংকীর্ণতাকে জয় করতে পেরেছিলেন। সুতরাং কুরআন আনসারী সাহাবায়ে কেরামের বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় সবার আগে এই বাস্তবতা বর্ণনা করছে যে, লক্ষ কর, তারা ছিলেন এই ভূমির আগের অধিবাসী। এরপর বর্ণনা করা হয়েছে তাদের মানসিক উদারতা ও জীবনব্যাপী নিঃস্বার্থতার অনুপম বরং মুহাজির ভাইকে অগ্রগণ্য করার অনুপম বৈশিষ্ট্য। তাদের এই উদারতার মাত্রা ও স্বরূপ বোঝাবার জন্য আমাদের হাতের কাছে দ্বিতীয় কোনো দৃষ্টান্ত নেই, যার সাথে তুলনা করে তা সহজে বোঝানো যায়। তবে হাঁ, একটি দিক আছে, যে সম্পর্কে চিন্তা করতে পারলে এই উদারতার মাত্রা উপলব্ধি করা কিছুটা সম্ভব হতে পারে। দেখুন, আনসারীগণ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুহাজির সাহাবীগণকে বরণ করেছেন, ইসলামের জন্য জিহাদ করেছেন, জান মাল বিসর্জন দিয়েছেন এভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বিদায় নিয়েছেন, তখন ইসলাম এক প্রতিষ্ঠিত শক্তি এবং এক উদীয়মান বিশ্বশক্তি। আর মদীনা মুনাওয়ারা এই বিশ্বশক্তির রাজধানী। এ অবস্থায় আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তিকালের পর খিলাফতের মসনদে একের পর এক যারা এসেছেন অর্থাৎ হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা., হযরত ওমর ফারুক রা., হযরত উসমান ইবনে আফফান রা. এবং হযরত আলী ইবনে আবী তালিব রা.Ñ এঁরা কেউ আনসারী ছিলেন না। এরা সবাই ছিলেন মুহাজির। শুধু এই ইতিহাসটুকুই যদি গভীরভাবে উপলব্ধি করা যায় তাহলে বোঝা যাবে আনসারী সাহাবীগণের উদারতা কোন্ মাত্রার ছিল এবং তাদের মানসিক তরবিয়ত কত উন্নত মানের ছিল! এটা একদিকে যেমন ইসলাম ও ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অলৌকিকতা, অন্যদিকে কুরআনের সত্যতার এক অকাট্য প্রমাণ। কুরআনে আনসার সাহাবীগণের যে বাস্তব বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে পরবর্তী দশকের পর দশক জুড়ে তাদের বাস্তব জীবন তাকেই সত্যায়ন করে গেছে।

তো এই হচ্ছে সীরাতের শিক্ষা এবং আমাদের পূর্বসূরীদের জীবনের বাস্তব নমুনা। এই নমুনা থেকে কিছুমাত্র আলোও যদি আমরা গ্রহণ করতে না পারি তাহলে আমাদের জাতীয় সমস্যা থেকে উত্তরণের প্রত্যাশা আমরা কীভাবে করব?

অতি সাম্প্রতিক যে মর্মান্তিক পরিস্থিতির আমরা মুখোমুখি, আমাদের রোহিঙ্গা মুসলিম ভাই-বোন যে চরম নির্যাতনের শিকার এ বিষয়ে কি নিজেদের ইতিহাস থেকে আমরা কোনো শিক্ষা ও কর্মনীতি গ্রহণ করতে পারি না? এখন পরিস্থিতি এই যে, ওদের একদিকে বাংলাদেশের সীমান্ত, অন্যদিকে সাগর। বাংলাদেশের মুসলিমগণ যদি তাদের আশ্রয় না দেন তাহলে সাগরে ঝাঁপ দেয়া ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো পথ নেই। এখানে নীতির প্রশ্নটিই বড়, নীতিগতভাবে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, আমরা ওদের আশ্রয় দিব কি না? হাঁ, আশ্রয় দিলে কিছু দায়-দায়িত্ব বাড়বে? তা বাড়বে বলেই তো আশ্রয় দেয়াটা মহিমাপূর্ণ। হয়তো কিছু সমস্যারও সৃষ্টি হবে? তো সমস্যার সমাধান করতে পারাই তো শক্তিশালী নেতৃত্বের গুণ। সমস্যা এড়িয়ে যাওয়া তো ভীরুতা ও কাপুরুষতা। আমাদের নিজস্ব ইতিহাসের আলোকে যদি বলি তাহলে সেই সমস্যা কি মদীনার অধিবাসীদের ঐ সমস্যা থেকেও বড়, যার মোকাবেলা তারা করেছিলেন গযওয়ায়ে আহযাবে, যখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুহাজির সাহাবীগণকে আশ্রয় দেয়ার অপরাধেআরবের সকল সন্ত্রাসী গোত্র এই ভূখ-কে তছনছ করে দিতে একজোট হয়েছিল। না ঐ রকমের সমস্যার মুখোমুখী আমরা হব না; বরং এটা এক সুযোগ আমাদের ক্ষমতাসীন দল ও নেতৃত্বের ভাবমূর্তি উন্নয়নের। বহির্বিশ্বে মানবিক ভাবমূর্তি এবং দেশের ভেতরে ও মুসলিম জাহানে ধর্মীয় ভাবমূর্তি উন্নয়নের এই রকম সুযোগ কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি বা দলের রাজনৈতিক জীবনে দুইবার আসে না। এক্ষেত্রে আমাদের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গজার্মানীর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে পারেন। নানা বিপরীত দৃষ্টান্তের মাঝে জার্মানীর চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেলের অভিবাসী বিষয়ক অবস্থান বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, বর্তমান বিশ্বে উদ্বাস্তুবিষয়ক নীতি ও কর্মপন্থার তুলনায় নীতি, মানবিকতা, সুফল সবদিক থেকে হিজরতের শিক্ষা শ্রেষ্ঠ। হিজরতের ইতিহাসে আমরা দেখি, আত্তীকরণের এক বিরল দৃষ্টান্ত। মদীনার সমাজে মুহাজিরগণ উদ্বাস্তুছিলেন না। আলাদা উদ্বাস্তুশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করেননি। ঐ সমাজ তাদের এমনভাবে গ্রহণ করে নিয়েছিল যে, তাঁরা ঐ সমাজেরই অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছিলেন। তাদের সকল প্রতিভা ঐ সমাজের কল্যাণ, সমৃদ্ধি, প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে। এই আত্তীকরণের ধারা যদি অবলম্বন করা যায় এবং এই বাস্তুহারা মুসলিম পরিবারগুলোকেও সমাজের মূল শ্রোতে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া যায় তাহলে এমন অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে তা অনেকের কাছে অনেক বড় সমস্যা। এটা হতে পারে চাকরি-বাকরির দ্বারা, বিয়ে-শাদীর দ্বারা, এতীম-বৃদ্ধের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব গ্রহণের দ্বারা এবং আরো নানা উপায়ে। এক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিপ্লবী ও যুগান্তকারী মুয়াখাত’-ব্যবস্থাও আমাদের সামনে রয়েছে। একটি কর্মক্ষম পুরুষের কর্ম-সংস্থানের দ্বারা যেমন একটি গোটা পরিবারের প্রয়োজন পূরণ হয় তেমনি একজন গুণবতী নারীর বিয়ে-শাদীর ব্যবস্থার মাধ্যমেও একটি খান্দানের দাঁড়াবার জায়গা হয়। আজ আমাদের প্রয়োজন ঐ সাহসী নেতৃত্বের, যারা প্রচলিত চিন্তা-কাঠামোর ঊর্ধ্বে উঠে জাতিকে নতুন কিছু দিতে পারেন। এই ধরনের স্থায়ী ব্যবস্থার পাশাপাশি এই নিপীড়িত মানুষের, যারা কোনোভাবে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে সক্ষম হয়েছেন বর্তমান অবস্থায় তাদের নিরাপত্তা, বিশেষত যুবতী নারীদের ইজ্জতের নিরাপত্তা এবং সাধারণ প্রয়োজনাদি পূরণের জন্য ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনাও জরুরি। এই মর্মান্তিক মানবিক সংকটে আমরা সকল ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে যার পক্ষে যা সম্ভবÑ অর্থ, সময় ও শ্রম দিয়ে বিশেষত অনুকূল ও মানবিক পলিসি গ্রহণে দায়িত্বশীলদের উৎসাহিত করার মতো কাজগুলো সম্পাদনে শুধু আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে যেন আমরা তৎপর হই।

আর দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে এ সংকটের স্থায়ী সমাধান। এ প্রচেষ্টার প্রাথমিক দায়িত্ব বর্তায় মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সংগঠন ওআইসি এবং মুসলিম সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানগণের উপর। প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তর মুসলিম দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের দায়িত্ব এ ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে বেশি। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন বিশ্বমঞ্চের মাধ্যমে জালিম বার্মা সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করে আরাকানবাসীদের হত্যা-নির্যাতন বন্ধের ব্যবস্থা করানোর দায়িত্ব তো মুসলিম নেতাদেরকেই নিতে হবে। সম্প্রতি আমাদের নাসির নগরের ঘটনার পরপরই পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টির নোটিশ দিয়েছেন। এক দৃষ্টিতে তার স্বধর্মীদের অধিকারের বিষয়ে কথা বলা প্রশংসারই দাবি রাখে। যদিও তার দেশের কাশ্মীর, গুজরাটসহ বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিম নিরোধের কথাও একইভাবে তিনি ভাবলে ভাল করতেন।

তো মুসলিম নেতৃবৃন্দের কর্তব্য নিজেদের মধ্যে ধর্মীয় ও মানবিকবোধ জাগ্রত করে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতন বন্ধ করতে মিয়ানমার সরকারকে বাধ্য করা। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন। 

 

 

advertisement