সফর ১৪৩৮   ||   নভেম্বর ২০১৬

নিরাপত্তা : দুঃসাহসী চাপাতির ব্যবহার!

খসরূ খান

ছুরি, চাকু, বটি দিয়ে পশুর গোশতা কাটা হয়। আর গোশতের ভেতরের  হাড় কাটতে যে শক্ত ও ধারালো অস্ত্রটি ব্যবহার করা হয় তার নাম চাপাতি। সবসময় এই চাপাতি থাকার কথা পশুর গোশত-ব্যবসায়ীর হাতে। কসাই ও বাবুর্চির হাতে। কিন্তু গত কয়েক বছর যাবৎ এই চাপাতির ব্যবহার বদলে গেছে। কিছু সংখ্যক ছাত্রের হাতে হাতে শোভা পাচ্ছে এই অস্ত্র। তারা গোশতের ব্যবসা করে না, গোশতের হাড্ডিও কাটে না। তারা সরাসরি মানুষের গলা কাটে। কিংবা কাটে মাথার খুলি, মগজের হাড়। প্রতিপক্ষ নারী-পুরুষকে প্রকাশ্যে হত্যার কাজে এই চাপাতির ব্যবহার দিনে দিনে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।

চাপাতির এক নারকীয় ব্যবহারের মধ্য দিয়ে খবরের শিরোনাম হয়েছে বদরুল। সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পরে জানা গেছে, সে ছিল প্রভাবশালী একটি ছাত্র সংগঠনের সদস্য ও নেতা। কলেজে অধ্যয়নরত খাদিজা নামের একটি মেয়েকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর ওই মেয়েটিকে প্রকাশ্যে রাস্তায় ফেলে কোপাতে থাকে। চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে মেয়েটির মাথা ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলে। উপস্থিত নারী-পুরুষ প্রথমে হকচকিয়ে যায়। ভয়ে দূরে সরে যায় অনেকেই। একজন-দুজন দূর থেকে মোবাইলফোনে দৃশ্যটি ভিডিওতে ধারণ করে ফেলে। কোপাতে থাকার মধ্য দিয়ে কয়েক মিনিট পার হওয়ার পরও লোকজন আক্রমণকারী বদরুলকে ধাওয়া করে। তাকে উত্তম-মধ্যম দিয়ে পুলিশে দেয়। এরপর মেয়েটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। মৃত্যু-পথযাত্রী সেই মেয়েটিকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ঢাকা স্কয়ার হাসপাতালে এনে চিকিৎসা শুরু করা হয়। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, ঘটনার প্রায় দু সপ্তাহ পর মেয়েটির সংজ্ঞা ফিরতে শুরু করেছে। ঘটনাটি ঘটেছিল গত ৩ অক্টোবর।

অপরদিকে ঘটনার দু-তিন দিনের মাথায় বদরুল একে একে হত্যাচেষ্টার স্বীকৃতি ও বিবরণ দিতে শুরু করে। দেশজুড়ে তার বিরুদ্ধে ধিক্কার উচ্চারিত হতে থাকে। সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা তাদের এই চাপাতি ছাত্রনেতার’ (পরে বরখাস্তকৃত) কৃতিত্বে প্রথমে শরমের মধ্যে পড়ে যায়। পরে তারাও সেই নেতার বহিষ্কারের বিবৃতি দিয়ে তার চাপাতি কাণ্ডের শাস্তি দাবি করে। শুরু হয় প্রতিবাদী মানববন্ধনের মিছিল। কিন্তু সপ্তাহখানেক যেতেই সবকিছু ঠাণ্ডা হয়ে যায়। হারিয়ে যায় বদরুল ইস্যু। খুনে উদ্যত বদরুলের বিচার আদৌ হবে কি না- এ নিয়েও কেউ কেউ সংশয় প্রকাশ করতে শুরু করেন।

অমানবিক এ ঘটনাটিতে অনেকগুলো প্রশ্ন ও বিষয় রয়েছে বিবেচনার মতো। মানুষ ও মানবতার অবক্ষয় এবং নৃশংসতার স্তর কত নীচে নেমে গেছে- তার একটি ভয়ংকর দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে এটি। প্রশ্ন হচ্ছে দিনে-দুপুরে ঠাণ্ডা মাথায় একটি যুবতী মেয়েকে রাস্তায় ফেলে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করার চেষ্টা একজন যুবক কী কারণে করার সাহস পেতে পারে? কোন্ জিনিস বা বিষয়টি তাকে এত নিঃশঙ্ক ও দুঃসাহসী বানাতে সক্ষম হলো? এটা কি দেশের আইন-শৃঙ্খলা ও বিচার ব্যবস্থার অসাধারণ উন্নতির নিদর্শন? নাকি ক্ষমতাধর ছাত্রসংগঠনের স্থানীয় নেতৃত্বের পদে সমাসীন থাকার সুফল? দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, ঘটনার দিন এবং একদিন পর পর্যন্ত মূলধারার প্রভাবশালী কোনো গণমাধ্যম ভয়ংকর এ খবরটিকে প্রচার করতেই চায়নি। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ঘটনার খবর, ফুটেজ ও ছবি ছড়িয়ে যায় এবং লাখ লাখ মানুষের অভিব্যক্ত তীব্র ক্ষোভের মুখে দুদিন পরে খবরটি প্রচার করতে বাধ্য হয়। কয়েকদিন পর্যন্ত ঘাতক বদরুলের বিভিন্ন পরিচয় গোপন করার চেষ্টাও করা হয়েছিল। এক পর্যায়ে ঘাতককে বাঁচানোর জন্য তাদের মধ্যকার সম্পকর্এবং মেয়েটিকে দায়ী করে আজেবাজে খবরও প্রচার করা হয়। সংবাদমাধ্যমে এগুলো কেন হয়েছে? এসব কি দায়িত্বশীল গণমাধ্যমের পরিচয় বহন করে? তৃতীয় যে প্রশ্নটি সবার সামনে আসে, সেটি হচ্ছে, যুবক-যুবতীদের মাঝে পারস্পরিক নিরাপত্তা, দূরত্ব ও নৈকট্যের দিকটিতে খামখেয়ালির কারণে এ দেশের তারুণ্য কি বড় রকম কোনো বিপর্যয়ের দিকে নেমে যাচ্ছে? আমাদের কি এ বিষয়টিতে সুস্থ-সঠিক কর্মপন্থা ঠিক করার সময় এখনো আসেনি?

চতুর্থ প্রশ্নটি হচ্ছে, ছাত্ররাজনীতির উদ্দেশ্য ও চরিত্র কী? যা-ইচ্ছা তাই করার লাইসেন্স? একটা পরিচিত রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের নেতা হওয়ার সুবাদে এরকম বদরুলরাআরো কত জঘন্য ঘটনা ঘটাতে থাকবে? কে তাদের ফেরাবে? কে তাদের থামাবে?

এরকম আরো বহু প্রশ্ন এ ঘটনাটিকে ঘিরে সৃষ্টি হয়। সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া কঠিন। প্রয়োজনও হয়তো নেই। আমরা সেদিকে এখন যেতেও চাই না। এতটুকুই শুধু চাইতে পারি এখন যে, এরকম ঘটনা ঘটার পথ বন্ধ হোক। এরকম ঘটনার বিচার হোক। তারুণ্যের মাঝের সম্পর্কএবং এ নিয়ে যে ভ্রান্তি বেড়ে চলেছে সমাজে, তা বন্ধ হোক। আইন বিচার ও শাসনের নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠিত হোক। প্রতিষ্ঠিত হোক ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচার। ঠাণ্ডা মাথায় প্রকাশ্যে খুন করার সাহস করতে পারার মতো পরিবেশের সমাপ্তি ঘটানো হোক। 

 

 

advertisement