সফর ১৪৩৮   ||   নভেম্বর ২০১৬

এ যুদ্ধটা কার দরকার?

আনোয়ার গাজী

উরি হামলার পর থেকেই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশংঙ্কা গাঢ় হচ্ছে। প্রশ্ন হল, এই যুদ্ধটা কার প্রয়োজন? আজকের অবসরে এর একটি সমীক্ষা করা যাক। তবে এর আগে ইসলামের যুদ্ধ-নীতিটা জেনে নেওয়া উচিত। ইসলামের যুদ্ধ-নীতি এই হাদীস থেকে সুন্দর বোঝা যায়- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে সম্বোধন করে বললেন, (যার সারমর্ম হলো) তোমরা যথাসম্ভব যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে বিরত থাকতে চেষ্টা করবে। তবে যুদ্ধ যদি বাধিয়েই দেওয়া হয় তাহলে সত্যের জয় হওয়া পর্যন্ত দৃঢ়ভাবে লড়াই করে যাবে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্ণ চেষ্টা ছিল, মক্কার কাফের-মুশরিক ও তৎকালীন বিশ্বের দুই পরাশক্তি রোম-পারস্যের সাথে সন্ধি-সমঝোতার মাধ্যমেই বিষয়গুলো সমাধা করা। যেন যুদ্ধের প্রয়োজন না হয়। যুদ্ধটাকে অবলম্বন করা হতো সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে। ইসলামের শিক্ষা যেন শান্তি ও নিরাপত্তারই মূল পাঠ।

মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহীম আ.-ও বাইতুল্লাহ নির্মাণ করার পর মক্কা নগরী সম্পর্কে আল্ল­াহ তাআলার দরবারে দুই হাত তুলে দুআ করেছিলেন-

হে আল্লাহ! আপনি এই শহরকে পূর্ণ নিরাপদ করে দিন।

ইসলামের ইতিহাস সাক্ষী, মুসলমানদের সর্বাত্মক চেষ্টা ছিল যুদ্ধ-বিগ্রহ এড়ানোর। হুদায়বিয়ার সন্ধি এরই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। গোটা মানব ইতিহাসে যত মানুষ যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে তার ৭৮ শতাংশই ছিল বিগত সাড়ে পাঁচ শ বছরে। আর মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও ভয়াবহ যুদ্ধগুলো হয়েছে বিংশ শতাব্দীতে। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধটি ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই চার বছরে পঙ্গু ও আহতদের ছাড়াই ইউরোপের সাড়ে চার কোটি মানুষ নিহত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত। এই ছয় বছরে ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানের সোয়া ছয় কোটি মানুষ নিহত হয়। বস্তুত এ যুদ্ধগুলো আমেরিকা, ইউরোপ ও পশ্চিমাবিশ্ব নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্যই বাঁধিয়েছিল। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাঁধিয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা, পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্রই। মাইকেল ম্যন-এর দ্যা ডার্ক সাইড অব ডেমোক্র্যাসির তথ্য অনুযায়ী আমেরিকায় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ৫০ বছরে ১০ কোটির বেশি রেড ইন্ডিয়ানকে হত্যা করা হয়েছে। বস্তুত আমেরিকা আজ ১০ কোটি মানুষের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে আছে। পক্ষান্তরে ইসলামী ইতিহাসের পনের শ বছরে ১০ লক্ষ মানুষও নিহত হয়নি। ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন বিপ্ল­বেও ৮ কোটির বেশি মানুষ নিহত হয়। তিনটি বিপ্ল­বই ছিল সেক্যুলার। ল্যাটিন আমেরিকায় বিপ্ল­ব সৃষ্টির জন্য ২ কোটি মানুষ নিহত হয়। তেমনিভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও ছিল ধর্মহীন, সেক্যুলার। উভয় যুদ্ধে সামগ্রিকভাবে ১১ কোটির বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। এ সবই ছিল সেক্যুলার যুদ্ধ।

আমেরিকাও তার স্বাধীনতা লাভের দিন থেকেই হিংস্রতা ও বর্বরতার পথই বেছে নিয়েছে। ১৭৭৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আমেরিকার সশস্ত্র বাহিনী ২২৭ বার বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে সংঘর্ষে জড়িয়েছে। মাত্র ২৩৯ বছরে ২২০-এর বেশি সংঘর্ষের এই হার যে কোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি। তা এভাবে যে, চেঙ্গিস খানের ঘাড়ে ৩৪ মিলিয়ন ও হালাকু খার উপর ৪ মিলিয়ন মানুষ হত্যার দায় চাপানো হয়। আর তৈমুর লংয়ের তরবারিতে ঝরেছে ২৪ মিলিয়ন মানুষের রক্ত। এদিকে জার্মান নাৎসি নেতা এডলফ হিটলারকে বলা হয় ২১ মিলিয়ন প্রাণের হন্তারক। সব মিলে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৩ মিলিয়ন। অথচ আজ পর্যন্ত আমেরিকার ১৭১.৫ মিলিয়ন মানুষ হত্যার বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবেই প্রমাণিত। কেননা, রেড ইন্ডিয়ান ১০০ মিলিয়ন, আফ্রিকান ৬০ মিলিয়ন, ভিয়েতনামী ১০ মিলিয়ন, ইরাকী ১ মিলিয়ন ও আফগানী ০.৫ মিলিয়ন মিলে মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ১৭১.৫ মিলিয়ন। এবার আপনিই বলুন, ৭৩ মিলিয়ন  মানুষ হত্যাকারীকে যদি মানবতার হন্তারকআখ্যা দেওয়া হয় তাহলে ১৭১ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের রক্ত প্রবাহিতকারী আমেরিকাকে কী নাম দেওয়া উচিত?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা ২৪টি দেশে বোমা হামলা চালিয়েছে। সবচেয়ে বড় বোমা হামলাটি করেছে জাপানের উপর। জাপানে পারমাণবিক বোমা ফেলে পাশবিকতা ও বর্বরতায় বিশ্বের শীর্ষস্থানটিও আমেরিকা দখল করে নিয়েছে। আমেরিকার বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যদি এক বিন্দু মানবতাও অবশিষ্ট থাকত তবে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা হামলার পর তারা নিজেদের শাসকদেরকে আনবিক বোমা ধ্বংসের তাকিদ করত। কিন্তু বাস্তবে এমনটি ঘটেনি; বরং সমগ্র বিশ্বে কর্তৃত্ব¡ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৪৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত  ১০৮টি বড় যুদ্ধ করেছে। এসব যুদ্ধে প্রকাশ্যেই বারুদের ব্যবহার হয়েছে, ঘরবাড়ি পুড়েছে, শহরের পর শহর ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে, লাশের স্তুপ জমেছে, আর আহতের আর্তনাদ ও মুমূর্ষের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে।

বস্তুত এসব যুদ্ধের পেছনে একটাই উদ্দেশ্য ছিল। তবে এর কিছু যুদ্ধ আমেরিকা নিজেই লড়েছে, কিছু যুদ্ধে তারা অংশগ্রহণ করেছে আর কিছু যুদ্ধে তাদের সমরাস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে। আর যেগুলোতে আমেরিকা সরাসরি অংশগ্রহণ করেনি তাতেও নিহত মানুষের রক্তের দাগ আমেরিকার আঁচলেই দৃশ্যমান ছিল। এই ১০৮টি যুদ্ধে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ১ কোটি ৯০ লক্ষ ৭৩ হাজার মানুষ মারা গিয়েছে। সবগুলো যুদ্ধের পেছনেই ছিল আমেরিকা। সব যুদ্ধেই আমেরিকার অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের দোসর অস্ত্র প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো উভয় দেশ ও উভয় পক্ষকে প্রকাশ্যে-গোপনে যুদ্ধ-সরঞ্জাম ও প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ করেছে।

বর্তমান সময়েও সারা বিশ্বে ৬৮টি এমন বিরোধ বিদ্যমান রয়েছে, যা পৃথিবীর শতকরা ৪৩ ভাগ জীবনোপকরণ কব্জা করে রেখেছে। অথচ এসব বিরোধ-বিবাদ খুব সহজেই মীমাংসা করা সম্ভব। কিন্তু বিশ্বশক্তি এর মীমাংসাই চায় না।

বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার লোভ আমেরিকার আছে, কিন্তু এর জন্য যে চারিত্রিক উৎকর্ষ, উদারতা ও মানবিক গুণের প্রয়োজন তার দশ ভাগের এক ভাগও আমেরিকার নেই; বরং এ ক্ষেত্রে তার রেকর্ড এত খারাপ যে, বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হওয়া তো দূরের কথা, বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের শেষ কাতারে স্থান পাওয়াও আপত্তিমুক্ত নয়।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকার প্রতিষ্ঠিত নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার-এ বলা হয়েছে, ‘এখন থেকে সারা বিশ্বে আমাদের একক কর্তৃত্ব চলবে। যেখানেই আমেরিকার স্বার্থে আঘাত আসবে সেখানেই তার পদক্ষেপ নেয়ার অধিকার থাকবে।নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার-এর মাধ্যমে আমেরিকা চায় তার  বিশ্ব মোড়লিবহাল রাখতে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, আজ বর্তমান পরাশক্তি যে দাবি করছে, কায়সার-কিসরাও একসময় এই দাবি করেছিল, কিন্তু আজ তাদের নাম-নিশানাও নেই। ১৯৪৫ সাল থেকে জার্মানির দাবিও ছিল- সারা বিশ্বে কর্তৃত্ব করার অধিকার শুধু জার্মানির। ১৯৫০ সালের পর রাশিয়া এল এই অবস্থানে। আর এখন ১৯৯০-এর পর আমেরিকাও এমনটিই ভাবতে বসেছে। আর এ পথে তারা সবচেয়ে বড় হুমকি মনে করছে মুসলমানদের। কিন্তু পৃথিবীর বাস্তবতা বলে, আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হুমকি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ।

এসব প্রেক্ষাপট ও বিশ্লে­ষণ থেকে খুব সহজেই অনুমান করে নেওয়া যায়, পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধটা আসলে কার দরকার? আর সেই বিশ্বশক্তি ও বহুজাতিক দোসরইবা কারা, যারা উভয় দেশকে পর্যাপ্ত অস্ত্রও সরবরাহ করছে এবং উত্তেজনাও উসকে দিচ্ছে! 

[একটি বিদেশী পত্রিকা থেকে অনুবাদ : মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ফাহাদ]   

 

 

advertisement