সফর ১৪৩৮   ||   নভেম্বর ২০১৬

সর্বগ্রাসী সন্ত্রাস : মুক্তি কোন্ পথে

মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম

 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হে আদী! তুমি কি হীরা দেখেছ? ‘আদী রা. বললেন, না, দেখিনি। তবে হীরা সম্পর্কে শুনেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যদি তুমি দীর্ঘ হায়াত পাও, অবশ্যই দেখবে উটযাত্রী নারী হীরা থেকে একাকি সফর করে মক্কায় আসছে আর কাবার তাওয়াফ করছে। এক আল্লাহ ছাড়া আর কারও ভয় তার থাকবে না।[1] -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৫৯৫

হযরত আদী রা. ছিলেন বিখ্যাত দানবীর হাতিম তাঈ-এর পুত্র। খ্রিস্টধর্মের অনুসারী ছিলেন। হিজরী নবম সনে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণকালে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে লক্ষ করে এ ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন।

হীরা ইরাকের একটি শহর। হীরা ও মদীনা মুনাওয়ারার মাঝখানে ছিল হযরত আদী রা. ও তার গোত্র তাঈ-এর বাস। তার গোত্রে অনেক দস্যু-ডাকু ছিল। তাদের এলাকার উপর দিয়ে কোনো যাত্রীদল নিরাপদে যাতায়াত করতে পারত না। জানমালের প্রচণ্ড ঝুঁকি ছিল। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখে এ ভবিষ্যদ্বানী শুনে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। ভেবে পাচ্ছিলেন না এটা কী করে সম্ভব। একে মক্কা থেকে হীরা কত দূর! তার মাঝখানে রয়েছে তাঈ গোত্রের দস্যু দল। একা এক নারী কীভাবে এই বিপজ্জনক পথে মক্কার সফর করবে?

আদী রা. বলেন, আমি মনে মনে বললাম, তখন তাঈ গোত্রের ডাকুরা কোথায় থাকবে। তারা যে দেশজুড়ে অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে! তবে পরবর্তীকালে আল্লাহ তাআলা এর সত্যতা আমাকে দেখিয়ে দিয়েছেন। আমি দেখেছি হীরা থেকে মুসলিম নারী উটের পিঠে করে সুদূর মক্কা সফর করছে এবং বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করে আবার নিরাপদে ফিরে যাচ্ছে।

হযরত আদী ইবনে হাতিম রা.-এর ইন্তিকাল হয় হি. ৬৮ সালে। তখন উমায়্যার আমল এবং আব্দুল মালিক ইবন মারওয়ানের শাসনকাল। তার বহু আগে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর আমলেই হীরা জয় হয়ে গেছে।

ইসলাম যখন যে এলাকায় পৌঁছেছে তখন সেখানে ন্যায় ও ইনসাফেরও প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে এবং মানুষ তার জানমাল ও ইজ্জত-সম্মানের নিরাপত্তা পেয়ে গেছে। এ নিরাপত্তা ইসলামের আগে কখনও কোথাও ছিল না। এটা কেবল ইসলামেরই বৈশিষ্ট্য যে, সে তার অনুসারী বলে কেবল তাকেই স্বীকার করে, যার দিক থেকে মুসলিম-অমুসলিম নির্বশেষে সমস্ত মানুষ নিরাপদ থাকে। ইসলাম গ্রহণমাত্রই একজন মানুষ কর্মে ও বিশ্বাসে সকলের শান্তিকামী ও নিরাপত্তাবিধায়ক হয়ে যায়। যে ব্যক্তি তা হতে পারে না, সে সত্যিকারের মুসলিমই নয়। এই চেতনা ইসলাম তার সূচনাকাল থেকেই নিজ অনুসারীদের মনে সঞ্চার করে আসছে। আর এটা তারই ফল যে, ইসলামের রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে ন্যায়-ইনসাফও বিস্তার লাভ করেছে এবং প্রত্যেক এলাকার নিপীড়িত মানুষ সর্বপ্রকার জুলুম-নির্যাতনের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে গেছে। আর এ কারণেই এক সময় ইসলাম বিস্তার এবং মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা সমার্থবোধকে পরিণত হয়েছিল। মজলুম জনতা ইসলামকে তাদের মুক্তিদাতা হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছিল। কার্যত তারা মুক্তি পেয়ে গিয়েছিল সব রকম অন্যায়-অনাচার থেকে। এটা কেবল এ কারণে নয় যে, আইন-শৃংখলা বাহিনী আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সদা তৎপর ছিল এবং অপরাধীকে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হত। বরং তারও আগে ইসলাম খোদ অন্যায়-অপরাধের মূলেই কুঠারাঘাত করেছিল। ঈমান ও ইসলাম তো কেবল কালেমা পাঠের আনুষ্ঠানিকতা মাত্র নয়। এ এক চেতনার নাম, যা মানুষের অন্তরে সঞ্চারিত হয়ে গেলে সেখান থেকে অন্যায়-অপরাধের প্রবণতা আপনিই নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এক কঠোরপ্রাণ দস্যুও যখন বুঝে ফেলে সে কেবল আল্লাহরই বান্দা এবং শুধু বন্দেগীই তার কাজ তখন বন্দেগী-বিরুদ্ধ যে কোনো কাজে লিপ্ত হওয়াকে সে তার জন্য আত্মহত্যার শামিল গণ্য করে। কারণ সে রকম কোনও কাজে লিপ্ত হয়ে গেলে সে আল্লাহর বান্দা থাকল কই। সে তো তার কু-প্রবৃত্তির দাস ও শয়তানের গোলাম হয়ে গেল। ঈমানের এই মর্মবাণী প্রথমদিকে মুসলিম মাত্রেরই প্রাণের বাণী ছিল। ঈমান আনার সাথে সাথে এই চেতনা তখন সকলের মনে সক্রিয় হয়ে উঠত। ফলে জীবন ধারা বদলে যেত সম্পূর্ণরূপে। পবিত্র মক্কা-মদীনার ইতিহাস সেই জীবন বদলেরই ইতিহাস। ঈমানের ছায়াতলে এসে লড়াকু আওস-খাযরাজ তাদের জীবন বদলাতে বাধ্য হয়েছিল। জীবনের বদল ঘটেছিল কুরায়শের। বানূ কিনানার, বানূ ছাকীফের, গাতফান ও বানূ মুস্তালীকের এবং সেই একই ধারায় এক সময় বানূ তাঈ-এর। বানূ তাঈ-এর ডাকাতদের অন্তরে যখন ঈমানের ঝাঁপটা লাগল তখন আর তারা ডাকু রইল না এবং তারা ডাকু থাকতেই পারল না। তারা হয়ে গেল শান্তিকামী। তারা বনে গেল মানুষের সেবক। এখন আর সাধারণ মানুষ তাদের নামে আতঙ্কিত হয় না; বরং সুদূর পথের একা এক নারী যাত্রীও তাদের প্রতি পরম নির্ভরতায় পথ চলতে পারে। বস্তুত এই হচ্ছে প্রকৃত ঈমান। কারও অন্তরে যখন এর মর্মবাণী পৌঁছে যায়, তখন আর সে কারও পক্ষে ক্ষতিকারক থাকতে পারে না। সে হয়ে যায় গোটা মানবতার উপকারী বান্ধব। মানবতার পক্ষে উপকারী সেই মুসলিমই প্রকৃত মুসলিম নামের উপযুক্ত। সেই মুসলিমেরই পদচারণায় একদা মুখর ছিল হিজায, মিসর। তারাই একদা মাতিয়ে রেখেছিল স্পেন, আলমেনিয়া। হিম্স, ফিলিস্তিন, বুখারা, সমরকন্দ, কাবুল, লাহোর, দিল্লী, ঢাকা- কোথায় না আমরা তাদের দেখা পেয়েছি। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে তারা তাদের পদাঙ্কিত প্রতিটি লোকালয়ে।

কিন্তু আজ আমরা এ কী দেখছি। অমুসলিম তো অমুসলিম, যত মুখরোচক বোলই তারা বলুক আর যত মন ভোলানো প্রচারণাই তারা চালাক, প্রকৃতপক্ষে জান, মাল ও ইজ্জত, মানুষের এই তিন মৌলসম্পদের  নিরাপত্তায় তারা কোনওদিনই বিশ্বাসী ছিল না, আজও নেই। কিন্তু মুসলিম জনপদসমূহের এ হাল কেন!

যে কোনও দিনের একটি জাতীয় দৈনিকের পাতা খুলুন। তাতে দেখতেই হবে- একই দলের দুই গ্রুপে মারামারি। তাতে তাদেরই লোকের কিংবা অসহায় পথিকের প্রাণহানি; সম্পত্তি নিয়ে কোন্দলে ভাইয়ে-ভাইয়ে খুনোখুনি; পরকিয়ায় বাধা দেওয়ায় স্বামী বা স্ত্রী খুন; প্রেম-প্রস্তাব প্রত্যাখান করায় এসিড নিক্ষেপ; জোরপূর্বক কারও মেয়েকে তুলে নেওয়া; রাজনৈতিক দলের নামে চাঁদাবাজি, চাঁদা না দেওয়ায় ব্যবসায়ী খুন বা দোকানে ভাংচুর; বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে কলেজ ছাত্র নিহত ও তার জেরে রাস্তা অবরোধ ও গাড়ি ভাংচুর; বখাটে কর্তৃক স্কুল ছাত্রী বা পথচারিণীকে উত্ত্যক্ত ও তাতে বাধা দেওয়ায় ভাই, বাবা কিংবা মা লাঞ্ছিত; প্রতিবেশী কর্তৃক জমি দখল ও তা নিয়ে হানাহানি; বিধবার শ্লীলতাহানি; পুলিশের চাঁদাবাজি; লালফিতার দৌরাত্ম্য; টেন্ডারবাজি; দিনে দুপুরে ডাকাতি; ডাস্টবিন থেকে শিশুর কিংবা নদী থেকে বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধার; শিশু অপহরণ ও মুক্তি-পণ দাবি; ইজ্জত বাঁচাতে আত্মহত্যা। এ ছাড়াও আছে ত্রাস ও সন্ত্রাসের নানা বৈচিত্র্য, ঘরে-বাইরে, অফিসে-রাস্তায় সর্বত্র। অবাধ্য পুত্রের হাতে পিতা নাজেহাল, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাকের হুমকি, স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে নারী নির্যাতন মামলার ভয় দেখানো, মোড়লের স্বেচ্ছাচারিতা, যুবকের মাস্তানি, সাংবাদিকের অনৈতিকতা, সংবাদপত্রের মিথ্যাচার, হরেকরকমের ধর্মঘট এবং শক্তিমান কর্তৃক দুর্বলকে হেনস্থা। সর্বত্র শক্তির অপব্যবহার। হয়ত পেশিশক্তির সীমালংঘন, নয়ত অর্থশক্তির অপপ্রয়োগ অথবা বুদ্ধি ও বিদ্যাবলের দৌরাত্ম্য কিংবা পদ ও ক্ষমতার আস্ফালন। এক কথায় সর্বত্র ত্রাস ও সন্ত্রাস এবং জোর-জুলুমের জয়-জয়কার।

এতসব অঘটন কারা ঘটাচ্ছে? এর সবই বহিঃশক্তির চক্রান্ত কিংবা স্বাধীনতাবিরোধীদের ষড়যন্ত্র? বলা যাবে কি এসব নিরক্ষরতা বা শিক্ষায় পশ্চাৎপদতার অভিশাপ? নাকি এগুলো পুরুষশাসিত সমাজের পরিণতি কিংবা সর্বত্র আইনের শাসন বাস্তবায়ন না হওয়ার খেসারত?

হয়ত বলা যাবে এসবগুলো কারণই এর পেছনে সক্রিয়। কিন্তু ধরে নেওয়া যাক আমাদের দেশ থেকে এর প্রতিটি কারণ অপসারিত করা হল- শিক্ষার হার শতভাগে পৌঁছাল, বহিঃশক্তির চক্রান্ত নস্যাত করে দেওয়া হল, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি সম্পূর্ণ দমন হয়ে গেল, সর্বত্র নারীশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল এবং আইনের শাসনের শতভাগ বাস্তবায়িত হয়ে গেল; তাতেই কি সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়ে যাবে? সমাজ নারীশাসিত হয়ে গেলেই কি পারবে কোনও নারী একা নির্ভয়ে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া ভ্রমণ করতে? যদি দেশের সমস্ত মানুষ শিক্ষিত হয়ে যায় তাতেই কি দেশের নারীগণ তার সত্যিকারের ইজ্জত ও সম্মানের জায়গায় অধিষ্ঠিত হয়ে যাবে? শতভাগ শিক্ষিতের দেশগুলোতে কি তা হয়ে গেছে? হয়ে যে যায়নি, সচেতন লোকজন তা ভালোভাবেই জানে। বস্তুত আপাতদৃষ্টিতে যেসব কারণকে অন্যায়-অনাচারের জন্য দায়ী বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে তার কোনও কোনওটি কারণ বটে, কিন্তু মূল কারণ কিছুতেই নয়। কাজেই এসব কারণ অপসারণের যত চেষ্টাই করা হোক এবং সে চেষ্টায় যতই সফলতা আসুক আসল লক্ষ্য তা দ্বারা কিছুতেই অর্জিত হতে পারে না। মানুষের জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা এর দ্বারা নিশ্চিত হবে না। হতে পারে না। তাই তো দেখি জননিরাপত্তারনামে রচিত আইন প্রতিপক্ষ দমনে ব্যবহারের সুবাদে কালাকানুন নামে ধিকৃত ও নিন্দিত হয়। বস্তুত ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক এবং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক যে কোনও শক্তি-সামর্থ্যরে অন্যায় ব্যবহার হতে বাধ্য, যদি না রোগের মূলে হাত দেওয়া হয়। মূল রোগ হল ভোগ-দাসত্ব, পরকালীন জবাবদিহিতার চেতনালোপ থেকে যার উৎপত্তি।

আখিরাত আছে। মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত হয়ে সকলকে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে। সেখানে প্রতিটি কথা ও কাজের হিসাব নেওয়া হবে। সর্বপ্রকার শক্তি-সামর্থ্যরে ব্যবহার সম্পর্কে জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে। উত্তর সন্তোষজনক হলে পরমানন্দের স্থায়ী জান্নাত লাভ হবে, অন্যথায় আছে চির দুঃখের জাহান্নামবাস। এই চেতনা মানবজীবন হতে ভোগবাদের অবসান ঘটায়। মানুষকে আল্লাহর বান্দা হয়ে চলার উৎসাহ যোগায় ও আল্লাহতে সমর্পিত জীবন যাপনে উজ্জীবিত করে। সেই জীবনে অভ্যস্ত মানুষ কোনও অবস্থায়ই কারও কোনও ক্ষতি করতে পারে না। তার দ্বারা কারও কোনও ক্ষতি হওয়া সম্ভবই নয়। এই চেতনাসম্পন্ন মানুষ তার পেশীশক্তির অপব্যবহার করবে না। সে অন্যায় পথে অর্থোপার্জন করবে না। সে কখনও নারীনির্যাতন করবে না। সে পুরুষবিদ্বেষী হবে না। তার বিদ্যা বুদ্ধি পরের অমঙ্গল সাধনে ব্যয়িত হবে না। তার অর্থবল অন্যের অনিষ্ট বয়ে আনবে না। সে রাষ্ট্রক্ষমতার মালিক হলে প্রতিপক্ষ দমনে প্রয়াসী হবে না। এরূপ ব্যক্তির কোনওরূপ শক্তি-সামর্থ্য অন্যের ত্রাস ও দুশ্চিন্তার কারণ হবে না।

আজ যে সর্বত্র ত্রাসের রাজত্ব, মানুষ তার জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা নিয়ে উৎকণ্ঠিত তার মূল কারণ আখিরাতের জবাবদিহিতা ও পারলৌকিক চেতনার বিলুপ্তি। সেই চেতনার লোপ জন্ম দিয়েছে ভোগবাদের। মানুষ আজ  ব্যাপকভাবে ভোগ-দাসত্বের শিকার। যে যেভাবে পারছে তার সর্বগ্রাসী ভোগাসক্তি পূরণের চেষ্টা করছে।

মানুষের ভোগ-তেষ্টা বড় রকমারি। কারও তেষ্টা অর্থের, কারও ক্ষমতার, কারও পানাহারের, কারও বা যৌনতার। ভোগদাস বা ভোগদাসী যেভাবেই হোক তার এ তেষ্টা মেটাবেই। এ তার জীবন-মরণ পণ। এ ব্যাপারে সে কোনও বাধা মানতে রাজি নয়। সেই বাধা দূর করতে সে হয় মানুষ খুন করবে, নয়ত অন্যের ঘরে আগুন দেবে। স্বামীর হাতে যে স্ত্রী খুন হয় বা স্ত্রীর হাতে স্বামী তা সেই বাধা অপসারণেরই এক প্রচেষ্টা। নির্বাচনে যে মারামারি-হানাহানি হয় তাতেও এই প্রচেষ্টা কার্যকর। আদরের সন্তান আজ পিতামাতার বুকে ছুরি বসাচ্ছে কেবল এ কারণেই যে, তারা তার ভোগের পথে বাধা।

যারাই ভোগের পথে বাধা তাদের দমন কর, নয় সরিয়ে দাও’- এই নীতিতে চলছে আজ গোটা জগৎ। এই নীতি সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে; সমাজে, রাষ্ট্রে ও আন্তর্জাতিক সকল অংগনে। এটাই আজ বর্তমান বিশে^র বাস্তবতা। আর এ কারণেই শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার সকল উদ্যোগ ভেস্তে যাচ্ছে। বরং গভীর দৃষ্টিতে দেখলে এজাতীয় উদ্যোগের পেছনেও ওই ভোগবাদী মানসিকতাকেই সক্রিয় পাওয়া যাবে। যারাই যেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিচ্ছে তারা নিজেরাই হয়ত একদল ভোগাচ্ছন্ন মানুষ। তাদের ভোগের পথে বাধা বলেই এমন এমন আইন তৈরি করছে, যা দ্বারা সেই বাধার অপসারণ হবে কিংবা তৈরি আইনের এমন ব্যবহার করছে, যাতে বাধা নির্মূল হয়ে যাবে। এভাবে কেবল অশান্তিই বাড়ে আর মাত্রাযোগ হয় নিরাপত্তাহীনতার।

আজ চৌদিকে সন্ত্রাস দমনের বোল উচ্চকিত। ছাত্র-শিক্ষক-জনতা মাঠে নামছে। ঘরে বাইরে সেমিনারে- সেম্পোজিয়ামে আলোচনা হচ্ছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল কল-কব্জা নড়ে-চড়ে উঠছে। সকল ত্রাস ও সন্ত্রাস নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত যেন কোনও থামাথামি ও ছাড়াছাড়ি নেই। কিন্তু ত্রাস হয়ত অট্টহাসি হাসছে। যারা তার বিরুদ্ধে মাতামাতি করছে তারা নিজেরাই কি শান্তির পক্ষে একেকজন জলজ্যান্ত ত্রাস নয়? কোনওভাবে তার প্রতিবেশী তার দ্বারা তটস্থ নয় কি? তার পিতা, তার পুত্র, তার স্বামী, তার স্ত্রী, তার ছাত্র, তার শিক্ষক, তার সহপাঠী, তার সহযাত্রী, তার সহকর্মী, তার কর্মচারী, তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং এভাবে তার সাথে সংশ্লিষ্ট বা বিশ্লিষ্ট যে কেউ তার দ্বারা কি আতঙ্কিত নয়, যে কোনও ক্ষেত্রে, যে কোনও উপায়ে? তাহলে তার সন্ত্রাসবিরোধী তৎপরতা কেন হাস্যকর হবে না? এবং কেনই বা এই ধারণা জন্মাবে না যে, এ তৎপরতার পেছনেও হয়ত তার কোনও ব্যক্তিস্বার্থ লুক্কায়িত আছে? হয়ত এর ফাঁক দিয়ে সে তার কোনও ভোগের ঘাটতি পূরণ করতে চায়? আর কিছুই না হোক অন্তত খ্যাতি কুড়ানোর মোহ? বলাবাহুল্য নাম-ডাক কুড়ানোর ভোগ আর সব ভোগ অপেক্ষা কিছু কম ভয়ঙ্কর নয়। এতে লিপ্ত মানুষ বরং শান্তির পক্ষে কিছুটা বেশিই হুমকি এবং তাও ঘরে-বাইরে সব জায়গায়, সব মহলে।

কাজেই সকল ভয়-ত্রাস নির্মূল করে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে হাত দিতে হবে মূল কাজে আর তা হচ্ছে ভোগদাসত্বের উৎপাটন। মানুষকে এবং আরও গোড়া থেকে বলতে গেলে সর্বপ্রথম নিজেকে এই দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে হবে। তা কোথায় এর মুক্তি নিহিত? নিহিত যেমনটা আগেই বলা হয়েছে- আখিরাত-চিন্তার ভেতর, আখিরাতে প্রতিটি কথা ও কাজের জবাবদিহি করতে হবে- এই বিশ্বাসের ভেতরে, প্রতিটি শক্তি-সামর্থ্য কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তার হিসাব আল্লাহর দরবারে দিতে হবে- এই চেতনাকে শাণিত করার ভেতরে। এই বিশ^াস ও চেতনার ছবক রয়েছে কুরআন ও হাদীসের পাতায়-পাতায়। সেইসব পাতায় চোখ বুলাতে হবে। তার মর্মবাণী হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে এবং তার বার্তা চারিয়ে দিতে হবে প্রতিটি অন্তরে। কুরআন বলছে- یَوْمَىِٕذٍ تُحَدِّثُ اَخْبَارَهَا

সেদিন (কিয়ামতের দিন) পৃথিবী জানিয়ে দেবে তার যাবতীয় সংবাদ (অর্থাৎ ভূমি সাক্ষ্য দেবে তার পৃষ্ঠে কে কী ভালো-মন্দ কাজ করেছে)। কেননা তার প্রতিপালক সেই আদেশই তাকে করবেন। সেদিন মানুষ দলে দলে বিভক্ত হয়ে (তার প্রতিপালকের কাছে) ফিরে যাবে। কারণ তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম দেখানো হবে।

অন্যত্র ইরশাদ- (তরজমা) সেদিন সকলে (আল্লাহর সামনে) প্রকাশ্যে এসে যাবে। আল্লাহর কাছে তাদের কোনও কিছুই গোপন থাকবে না। (বলা হবে) আজ রাজত্ব কার? (উত্তর হবে একটিই যে,) কেবল আল্লাহর, যিনি এক, পরাক্রমশালী। আজ প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের প্রতিফল দেওয়া হবে। আজ কোনও জুলুম হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী। (হে রাসূল!) মানুষকে সতর্ক করে দাও আসন্ন দিন সম্পর্কে, যখন বেদম কষ্টে মানুষের প্রাণ হবে কণ্ঠাগত। জালেমদের থাকবে না কোনও বন্ধু এবং এমন কোনও সুপারিশকারী, যার কথা গ্রহণ করা হবে। আল্লাহ জানেন চোখের অসাধুতা এবং সেইসব বিষয়ও, যা বক্ষদেশ গোপন রাখে। আল্লাহ ন্যায় বিচার করেন -সূরা মুমিন (২৩) : ১৬-২০

কুরআন মাজীদে এ রকম আয়াত আছে অজস্র। আছে বহু হাদীস। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, শোন হে! তোমরা প্রত্যেকেই (কোনও না কোনও দায়িত্বে) দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪০৯

প্রিয়নবী সতর্ক করেন, ‘কিয়ামতের দিন কেউ আল্লাহর সম্মুখ থেকে নড়তে পারবে না, যাবৎ না তাকে পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। তার আয়ু সম্পর্কে, সে কোথায় তা নিঃশেষ করেছে, তার যৌবনকাল সম্পর্কে, কোথায় তা জীর্ণ করেছে, তার অর্থ সম্পদ সম্পর্কে, কী উপায়ে তা অর্জন করেছে এবং কোথায় কোথায় তা ব্যয় করেছে এবং সে যা জানত তদনুযায়ী কতটুকু কাজ করেছে।’ -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪১৬

তিনি আরও ইরশাদ করেন, কিয়ামতের দিন জুলুম (জালিমের পক্ষে) বহু অন্ধকারের সমষ্টি হয়ে দেখা দেবে-সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪৪৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৭৯

আরেক হাদীসে আছে, প্রিয়নবী জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কি জান হৃতসর্বস্ব কে? সাহাবীগণ উত্তর দিলেন, আমাদের মধ্যে হৃতসর্বস্ব হল সেই, যার কোনও টাকা-পয়সা ও মাল-সামগ্রী নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হৃতসর্বস্ব হল সেই ব্যক্তি, যে কিয়ামতের দিন নামায, রোযা ও যাকাত (প্রভৃতি) ইবাদত নিয়ে হাজির হবে। সেই সংগে সে হাজির হবে এই অবস্থায় যে, কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, কারও সম্পদ গ্রাস করেছে, কারও রক্তপাত করেছে এবং কাউকে মারধর করেছে। সুতরাং (এসবের প্রতিকার স্বরূপ) একেকজনকে তার পুণ্য থেকে দেওয়া হতে থাকবে। যখন তার পুণ্য শেষ হয়ে যাবে অথচ অন্যের হক বাকি থেকে যাবে তখন তাদের পাপরাশি তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। অনন্তর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮১; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪১৮

আখিরাতের চিন্তা জাগ্রত করার পক্ষে এ জাতীয় হাদীস আছে বেশুমার। আজ দরকার এর ব্যাপক চর্চা- নিজ ঘরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, অফিস-আদালতে, কল-কারখানায়। সর্বত্র, সকল মহলে। পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে এবং অতিরিক্ত পাঠ্য হিসেবে। এর আলোচনা দরকার পত্র-পত্রিকায়, সেমিনারে, জলসায়, রেডিও, টেলিভিশনে ও সর্বপ্রকার যোগাযোগ মাধ্যমে। সকল উপায়-উপকরণ ব্যবহার করে এই চেতনা এমনভাবে বিস্তার করে দেওয়া দরকার। যাতে ধারণা ও বিশ্বাসের স্তর পার হয়ে আখিরাত হয়ে ওঠে ব্যক্তির প্রত্যক্ষদর্শনের বিষয় এবং চিন্তা ও মনন ছাপিয়ে তা প্রত্যেকের বাস্তব কর্মে বিকশিত হয়ে ওঠে।

দাবি এই নয় যে, কেবল এর দ্বারাই সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে এবং মুহূর্তের মধ্যেই আমরা দেখতে পাব সব মানুষ ফিরিশতা স্বভাবের হয়ে গেছে। এরূপ দাবি এক রকম হঠকারিতা ও একদেশদর্শিতা। চিন্তার ভারসাম্য রক্ষা করা উচিত সব ক্ষেত্রেই। আমরা কেবল বলতে চাই, মানুষের আত্মসংশোধনের এটাই মূলমন্ত্র। আখিরাতের জবাবদিহিতার বিশ্বাস ও তার জাগ্রত চেতনাই সেই শক্তি, যা মানুষের পাশববৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং তাকে পারে ইন্দ্রিয় পরবশতা থেকে মুক্তি দিতে, যা কিনা সকল অন্যায়-অপরাধের মূল উৎস। তারপরও যে অপরাধ হবে না এমন নয়, কিন্তু এই চেতনার ব্যাপক চর্চা দ্বারা অপরাধের মাত্রা যে দ্রুত হ্রাস পেতে থাকবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সেই সংগে উপযুক্ত আইন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা এবং শান্তি-শৃংখলা রক্ষার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উপায়-উপকরণ তো সক্রিয় রাখতেই হবে। একটা সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ার পক্ষে এসবের আবশ্যকীয়তা কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। সমস্যা হয় তখনই যখন নির্ভর করা হয় কেবল এরই উপর আর তখনই সমস্ত উদ্যোগ আয়োজন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, যেমনটা আমরা প্রত্যক্ষ করছি। 


[1] ১. এটা ভিন্ন প্রসঙ্গ যে, কোনো বিশেষ ওযর ব্যতীত মেয়েদের জন্য স্বামী বা মাহরাম ছাড়া সফর করা নিষিদ্ধ। (দ্র. সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩৩৮, ১৩৪০, ১৩৪১; সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯৯৫, ৩০০৬)

 

 

 

advertisement