মুহাররম ১৪৩৮   ||   অক্টোবর ২০১৬

কৌশল : পোশাকের মতলবি জাতিভেদ

ওয়ারিস রব্বানী

ঘটনা নতুন হলেও রঙ পুরনো। এরা ছক ধরেই চলেন। ভিন্নতা তাদের আচরণে মোটেই নেই। আমরা কেবল ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আঁতকে উঠি। মনে করি নতুন কথা। নতুন ঘটনা। নতুন কোনো অভিপ্সা পূরণের জন্য উচ্চারিত হয়েছে কথাটি। আমাদের মনে হওয়ায় এই নতুনত্ব থাকলেও বাস্তব বিচারে এর সবই পুরনো এবং এককেন্দ্রিক। শব্দ ভিন্ন আর সময় ভিন্ন- এই যা পার্থক্য।

তিনি সুলতানা কামাল। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। এক বাক্যে তার পরিচিতি উল্লেখ করতে গিয়ে সংবাদ মাধ্যমের বর্ণনায় বলা হয়ে থাকে- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। তার পরিচিতি তো অনেক। তিনি প্রয়াত কবি সুফিয়া কামালের মেয়ে। এনজিও- আসক বা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রধান। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ চেপ্টারের অন্যতম প্রধান হিসেবেও তাকে কথা বলতে দেখা যায়। আবার পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক একটি পশ্চিমা পরিকল্পনা ও দেশগুলোর সহায়ক সংস্থারও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। দেশ উদ্ধারে তার কাজ ও ক্ষেত্রের কোনো শেষ নেই। সম্প্রতি ২৭ আগস্ট ২০১৬ রাজধানীর একটি হলে বামপন্থী যুবকদের একটি জঙ্গিবাদ বিরোধী কনভেনশনে বক্তব্য দিয়েছেন তিনি। বক্তব্য তিনি অনেকই দেন এবং যেখানেই বক্তব্য দিতে যান লাইন ও সূত্র ধরে অনেক কথাই তাকে বলতে হয়। এমনিতেও তিনি আইনজীবী মানুষ। কিন্তু সেদিনের বক্তব্যে তার গুরুত্বপূর্ণ দুটি কথা পাশাপাশি উল্লেখ হয়েছে। তিনি বলেছেন- মুক্তিযুদ্ধের ধারায় বাংলাদেশকে ফিরিয়ে এনে সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদকে মোকাবেলা করতে হবে। এক্ষেত্রে এদেশের তরুণ-মুক্তমনাদের ঐক্যবদ্ধ সহাবস্থান বাড়াতে হবে। কথিত মুক্তমনাদের ঐক্যবদ্ধ সহাবস্থান কিংবা জোটবদ্ধ তৎপরতা বাড়ানোর আহ্বানটা তার চূড়ান্ত কথা ছিল না। এর সঙ্গে তার আরেকটি কথাও গণমাধ্যমের উদ্ধৃতির উপাত্ত হয়। তিনি বলেন, এদেশে নারীদের পোশাকের মধ্যে পাকিস্তানী ভাবধারার পরিবর্তন করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটাতে হবে

হাঁ তার অনুকূল গণমাধ্যমগুলোতে দেশের একজন মানবাধিকার-কর্মী হিসেবেও তার পরিচিতি উল্লেখ করা হয়ে থাকে। সেই তিনিই বলেছেন, নারীদের পোশাকের মধ্যে পাকিস্তানী ভাবধারা পরিবর্তন করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটাতে হবে। তার এই কথা ও শব্দের আসল টার্গেট বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কারো ক্ষেত্রেই হয়নি। সবাই বুঝেছেন সাম্প্রতিককালে বোরকা ও হিজাব বিষয়ক বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলমান দমন-পীড়নে যৌক্তিক সহায়তা দিতেই তিনি কথাটি বলেছেন। তিনি জিন্সের বিরুদ্ধে বলেননি। শর্টসের বিরুদ্ধে বলেননি। এমনকি ভারতীয় সিরিয়ালের পাখিড্রেসের বিরুদ্ধেও বলেননি। ভারত বা পাশ্চাত্যের পোশাক ছাড়তে না বলে বাঙালি চেতনার দোহাই দিয়ে শুধু পাকিস্তানী ভাবধারার পোশাক ছাড়তে বলেছেন। কোনো কোনো সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্টের ভাষাতেও তাই হিজাব প্রসঙ্গটি এসেছে। প্রথম কথা, একজন মানবধিকারকর্মী বা নেত্রী হিসেবে যে কোনো নারীর পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে এভাবে চাপিয়ে দেওয়া কথা তিনি কীভাবে বলেন? এটা তো মানবাধিকারের যে কোনো সূত্রের বিরোধী কথা। দ্বিতীয়ত, ইসলামসম্মত পোশাকের বিরুদ্ধে বলার জন্য বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষের দোহাই তার মুখে কতটা মানানসই? তিনি যে বলেননি দাম্পত্য জীবনে সবাইকে বাঙালি চেতনার উন্মেষ ঘটাতে হবে- এতে তো তিনি বাঙালি মুসলিম নারীদের ওপর অনেক বড় দয়াই করলেন। তার বাঙালি চেতনার জীবনের দিকে তাকালে তো হিন্দু বরের গলায় মাল্য-অর্পণ ছাড়া এদেশের মুসলিম তরুণীদের সামনে কোনো উপায় খোলা থাকার কথা ছিল না। তার পুরো নাম কেউ কেউ লেখেন- সুলতানা কামাল চক্রবর্তী। আমরা অবশ্য এরকম লিখি না। বড়ই দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, দাম্পত্য ও নামের এত উন্নত বাঙালি চেতনা দেশে খুবই কম দেখা যায়। হাতে গুণে দেয়া যায় সে সংখ্যা।

তৃতীয় বিষয়টিই দুঃখের ও বেদনার। লোকে বলে, কিছু মতলবি মানুষ বাঙালি চেতনা আর মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেই ইসলামী অনুশাসন, রীতিনীতি, পোশাক ও শিক্ষার বিরুদ্ধে জোয়ার তৈরি করেন। তারা পাকিস্তানী ভাবধারা নামের একটি রহস্যময় ও অনুন্মোচিত সীমানার দোহাই দিয়ে যখন তখন ইসলামী বিধান ও ঐতিহ্যের উপর চেতনার হাতুড়ি পেটান। এই সারির মানুষ তিনিও কি না আমাদের জানা নেই। তবে এ সারির কেউ হলেও তিনি কিন্তু অনেক উঁচু মাপের মানুষ! বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক ও গণমাধ্যমের হিন্দু ও ভারত-অন্তপ্রাণ মেকি সেকুলারদের প্রায় সবারই চিন্তা ও বক্তব্যের লাইন মোটামুটি এরকম। এরা ইসলাম বিরোধী পাকিস্তানী আইন (১৯৬১ সনের তথাকথিত মুসলিম পারিবারিক আইন) বিরোধী কথা বলতে নারাজ। সেক্ষেত্রে পাকিদের পুরো অনুগামী থেকেও তারা কেবল ইসলামী অনুশাসনের ক্ষেত্রে সাদৃশ্য ও সাযুজ্যের দোহাই দিয়ে পাকিস্তান-বিদ্বেষের কথা বলেন। তাহলে কি পাকিস্তানে লোকে নামায পড়ে বলে আমাদের নামায পড়াও বাদ দিতে হবে? সেখানে মসজিদ, মাদরাসা, টুপি-পাগড়ি, দাড়ি, কুরবানি, রোযা, ঈদ আছে বলে আমাদের এখানেও এসব বাদ দিতে হবে? সে দেশে মুসলিম নারীর বিয়ে মুসলিম পুরুষের সঙ্গে হয় বলে কি এদেশে মুসলিম নারীদেরকে হিন্দু বরের সঙ্গে দাম্পত্য করতে হবে? এটাই কি বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ?

নারীর পোশাক নিয়ে পাকিস্তানী ভাবধারা বর্জনের এই আহ্বানটি নতুন। মতলব অবশ্য পুরনো।

নিজেদের মনগড়া তথাকথিত বাঙালি সংস্কৃতির নামে তারা যে মুসলমান সমাজকে শিরকী কর্মকা-ে যুক্ত করার কাজে সদা সচেষ্ট থাকেন এটা সচেতন মহল মাত্রই অবগত আছেন।

আমাদের কথা হল, মুসলমানদের পোশাক হবে ইসলামী; তা পাকিস্তানী, সৌদী, পশ্চিমা, বাঙালি কোনোটিই নয়। এখন যদি পৃথিবীর কোনো দেশের মুসলমান ইসলামী পোশাক পরে থাকেন তবে সেটির পরিচয় ইসলামী পোশাকই হওয়া উচিত। তা কোনো দেশের একক পোশাক নয়। আচ্ছা, বর্তমান পাকিস্তানের এক শ্রেণির বিজাতীয় মানসিকতার যুবক-যুবতীরা যে খোলামেলা পশ্চিমা পোশাকের চর্চা করছে সে ব্যপারে এ দেশের বুদ্ধিজীবীরা কী বলেন? তিনি কি এগুলোর বিরুদ্ধে বলবেন? যদি তাই বলতেন তাহলে তাকে এদেশের ওই শ্রেণির লোকদের পোশাক নিয়েও বলতে দেখা যেত। আসলে এ বিষয়গুলো অত বড় বড় পদের অধিকারীরা বুঝেন না- এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? তারা যে বুঝে শুনেই এমন মিশনগুলো চালাচ্ছেন, ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের শংকা সেখানেই।

মুসলমানদেরকে এসব মতলবী নসিহতকারীদের ব্যপারে সতর্ক থাকতে হবে এবং সরকারেরও সচেতন থাকা দরকার এসব বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের (!) কার্মকা- নিয়ে। এদের উদ্দেশ্য-মতলব নিয়ে। 

 

 

advertisement