গত ৩০ রবীউস সানী ’৩১ হি. মোতাবেক ১৬ এপ্রিল ’১০ ঈ. শুক্রবার বিকেল ৩টার পর এই নশ্বর জগতের আলো-বাতাস থেকে চির বিদায় নিয়ে মাওলায়ে কারীমের সান্নিধ্যে চলে গেলেন গোটা দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গের সর্বজনশ্রদ্ধেয় বুযুর্গ হযরত মাওলানা মাহমুদুর রহমান রাহ.।
তিনি ছিলেন শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ.-এর শাগরিদ। তাঁর ইন্তেকালের মধ্য দিয়ে হযরত শায়খুল ইসলাম রাহ.-এর স্মৃতি বহনকারী আরো একজন বুযুর্গের বা-বরকত সোহবত থেকে এই ভূ-খণ্ড বঞ্চিত হয়ে গেল।
انا لله وانا اليه رجعون اللهم اجرنا في مصيبتنا هذه واخلف لنا خيرا منه
তিনি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ধুরং গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নাজিরহাট মাদরাসায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর হাটহাজারি মাদরাসা ও দেওবন্দ মাদরাসায় পড়াশোনা করেন। দারুল উলূম দেওবন্দে তাঁর উস্তাদ ছিলেন শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী রাহ., হযরত মাওলানা ইবরাহীম বিলয়াভী রাহ., হযরত মাওলানা ফখরুল হাসান রাহ. প্রমুখ আকাবির। ১৯৫৬ ঈ.-এর মাঝামাঝিতে দেশে ফিরে আসেন। এর পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সুদীর্ঘ কর্মজীবনে যশোর নোয়াপাড়া মাদরাসা, বাগেরহাট সোনাতুনিয়া আলিয়া মাদরাসা, খুলনা আলিয়া মাদরাসা এবং খুলনা দারুল উলূম মাদরাসায় দ্বীন ও ইলমে দ্বীনের খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন।
খুলনা দারুল উলূমে তাঁর তিন দশকের ইহতিমাম-আমল ছিল এ প্রতিষ্ঠানের স্বর্ণযুগ। এই সময়েই তা একটি ক্ষুদ্র মাদরাসা থেকে গোটা দক্ষিণবঙ্গের উল্লেখযোগ্য দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
কওমী ও আলিয়া উভয় ধারার অসংখ্য তালিবুল ইলম তাঁর শীষ্যত্ব গ্রহণ করে ধন্য হয়েছেন।
খুলনা ডাক বাংল মসজিদে চার দশকেরও অধিক সময় ইমাম ও খতীব হিসাবে দায়িত্ব পালনের সুবাদে সর্বস্তরের মুসলিম জনগণ তাঁর দ্বারা উপকৃত হয়েছেন।
অত্যন্ত সাদামাটা ও যাহিদানা যিন্দেগী যাপন করেছেন। দীর্ঘ ৪০ বছরেরও বেশি সময় কাটিয়ে দিয়েছেন।
ডাক বাংলা মসজিদের একটি ক্ষুদ্র কুঠুরিতে।
গোটা খুলনা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহে সর্বস্তর আলিম-উলামা ও সাধারণ মুসলমানদের মাঝে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল প্রবাদতুল্য। বস্তুত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই অসিয়ত তাঁর জীবনে সত্য হয়েছিল-
ازهد في الدنيا يحبك الله وازهد فيما في أيدي الناس يحبك الناس
তুমি দুনিয়ার মোহ ত্যাগ কর তাহলে আল্লাহ তোমাকে ভালবাসবেন আর মানুষের সম্পদের প্রতি নিরাসক্ত হও তাহলে মানুষ তোমাকে ভালবাসবে।
দুই.
২০০১ সালের পর থেকে বিভিন্ন সময় তাঁর সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য হয়েছে। স্বভাবগতভাবে তিনি বেশ গম্ভীর ও মিতভাষী ছিলেন। তবে তার মাঝে কৌতুক ও রসবোধও ছিল। নাতী-নাতনীর সাথে খোশগল্পে মশগুল হতেন এবং তাদের শিশু-সন্তানদের আদর-সোহাগ করতেন।
নিজ পুত্র-কন্যার সাথেও তাঁর আচরণ ছিল বন্ধুর মতো। বিশেষত কন্যাদের খুব ভালবাসতেন। কন্যারাও ছিলেন পিতাঅন-প্রাণ! ঢাকায় এলে কন্যার বাসায় দু’চারদিন অবস্থান করতেন। তখন যেন উৎসবের পরিবেশ বিরাজ করত। পিতার প্রতি কন্যার যে অনুরাগ-ভালবাসা এবং কন্যার প্রতি পিতার যে মমতা ও বাৎসল্য তাঁদের প্রত্যেক সম্বোধনে ঝরে পড়ত তা না দেখলে অনুভব করা যাবে না।
স্ত্রীর সাথে তাঁর আচরণ ছিল অত্যন্ত কোমল। যে কাজ অন্য কেউ করলে খুব রাগান্বিত হন স্ত্রী তা করলে তাঁকে কিছুই বলতেন না, যেন তার সাত খুন মাফ। তার সকল সরলতা অম্লান বদনে সহ্য করতেন। ছোট ছোট বিষয়েও স্ত্রীর পছন্দ-অপছন্দের লেহাজ করতেন। আতরের ঘ্রাণ স্ত্রীর সহ্য হত না বলে ঘরে আতর ব্যবহার করতেন না। জুমার দিন ঘর থেকে বের হয়ে দূরে গিয়ে আতর দিতেন।
স্ত্রীর খরচাদির বিষয়ে তাঁর সজাগ দৃষ্টি ছিল। স্ত্রী দান করতে পছন্দ করেন বলে সব সময় প্রয়োজনের চেয়ে বেশি টাকা তাঁর জন্য পাঠাতেন। ১৯৮৯ ঈ. স্ত্রীকে সাথে নিয়ে হজ্ব করেছেন। প্রতিবছর কোরবানীর সময় অন-ত দু’টো গরু কুরবানী করতেন। একটি তাঁর নিজের জন্য এবং পিতামাতা ও উস্তাদদের জন্য, অন্যটি স্ত্রীর জন্য এবং শ্বশুর-শাশুড়ি ও আত্মীয়-স্বজনের জন্য।
পুত্রবধুদের আপন কন্যার মতো মনে করতেন। পারিবারিক আলাপচারিতায় জেনেছি যে, তাদের একজন প্রথম দিকে কাজকর্মে কিছুটা অপটু ছিলেন। কিন্তু তিনি সব সময় তাকে উৎসাহ দিতেন। চা নিয়ে এলে অত্যন্ত খুশি হয়ে বলতেন, মা! তোমার চায়ের দাম তো দশ টাকা চার আনা! চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতেন আর বলতেন, এত স্বাদের চা! আমাকে কি আরেক কাপ খাওয়াতে পার? উৎসাহ পেয়ে তিনি দৌড়ে যেতেন এবং আরেক কাপ বানিয়ে আনতেন। আর শ্বশুরও পুত্রবধুর কাঁচা হাতের চা অম্লান বদনে পান করতেন!
তাঁর মাঝে এক আশ্চর্য লাজুকতা ছিল। কারো চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারতেন না। অনেকবার লক্ষ করেছি যে, কেউ তাঁর দিকে তাকালে তিনি চোখ নামিয়ে নিতেন।
বার্ধক্যে হয়তো সব মানুষই শৈশবকে ফিরে পায়, তবে আল্লাহ ওয়ালাদের বার্ধক্য নূরানিয়াত ও রূহানিয়াতে এমন সমুজ্জল হয়ে ওঠে যে, সাধারণ মানুষও তা প্রত্যক্ষ করে আনন্দ অনুভব করে।
তিনি প্রায়ই নিজের সম্পর্কে বলতেন, ‘ভাই, আমি দেখতে কালো, দেহের গঠনও সুন্দর নয়, এলেম-কালামও নেই, শুধু উস্তাদদের দোয়ার বরকতে চলছি।’
উস্তাদদের প্রতি তাঁর গভীর মুহাব্বত ছিল, বিশেষত শাইখুল ইসলাম হযরত মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী রাহ. -এর প্রতি তাঁর ভক্তি-শ্রদ্ধা ছিল অনুসরণীয়। তিনি বলতেন, ‘ভাই, আমরা তো নঙ্গে হোসাইন আহমদ।’ অর্থাৎ তিনি আমাদের শায়খ-এ আমাদের গৌরব, কিন্তু আমরা তাঁর ব্যক্তিত্বের জন্য কলঙ্ক!
ঢাকায় অনেকবার তাঁর সাক্ষাৎ লাভের সৌভাগ্য হয়েছে। তিনি খুলনা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে এবং চট্টগ্রাম থেকে খুলনা ফেরার সময় সাধারণত ঢাকায় কিছু সময়ের জন্য যাত্রাবিরতি করতেন। তখন সাক্ষাতের সুযোগ হয়ে যেত। শেষ দিকে দেখা হলেই দুআ চাইতেন। তাতে কাতরতা ও ব্যাকুলতা ঝরে পড়ত। বার্ধক্যের কষ্ট ছিল, কিন্তু মুখে কোনো অভিযোগ ছিল না।
একবার তাঁর উস্তাদদের সম্পর্কে কিছু বলার জন্য আবেদন করেছিলাম। তিনি বেশ উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন এবং দীর্ঘ সময় ধরে স্মৃতিচারণ করতে থাকেন। প্রায় গোটা আলোচনা জুড়ে ছিল হযরত শাইখুল ইসলাম রাহ.-এর কথা। আলোচনা শেষে আমি তা লিপিবদ্ধ করলাম এবং তাকে পড়ে শোনালাম। তিনি অত্যন্ত খুশি হলেন এবং দুআ করলেন। লেখাটি আলকাউসারে প্রকাশিত হলে সে সংখ্যার অনেকগুলো নুসখা আগ্রহের সাথে চেয়ে নিয়েছিলেন। আজ এই কথাগুলি লিখতে গিয়ে শুধু মনে হচ্ছে, কত ক্ষণস্থায়ী মানুষের জীবন! কীভাবে তা শেষ হয়ে যায়! গতকাল যিনি আপন উস্তাদদের স্মৃতিচারণ করেছেন আজ তারও ঠাঁই হয়েছে শীষ্য-শাগরিদের স্মৃতির পাতায়! আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর বাণী সবার জন্যই সত্য-
كل يوم يقال مات فلان وفلان ولا بد من يوم يقال مات عمر
প্রতিদিন কারো না কারো মৃত্যু-সংবাদ ঘোষিত হয়। একদিন তো আসবে যেদিন ঘোষিত হবে উমরের মৃত্যু-সংবাদ!
তিন.
শনিবার যোহরের পর তাঁর জানাযার নামায হয়েছে। জানাযার নামায পড়িয়েছেন বাবু নগর মাদরাসার মোহতামিম হযরত মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ ছাহেব।
আশপাশের মাদরাসাগুলো থেকে অনেক আলিম-তালিবে ইলম জানাযায় শামিল হয়েছেন। এ সময় বিশিষ্ট কয়েকজন আলিম তাঁদের অনুভূতি ব্যক্ত করেন।
চট্টগ্রাম আন্দরকিল্লা জামে মসজিদের খতীব হযরত মাওলানা মামুনুর রশীদ ছাহেব বলেন, ‘হযরত মাওলানা হাফেয মাহমুদুর রহমান ছাহেব রাহ.-এর কর্মজীবন কেটেছে যশোর ও খুলনায়। এজন্য চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ, এমনকি তাঁর নিজ এলাকার লোকেরাও কল্পনা করতে পারবে না যে, তিনি কেমন ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। খুলনা আলিয়া মাদরাসায় আমরা সাত বছর এক সাথে ছিলাম। সে সময় খুলনা অঞ্চলে বড় কোনো কওমী মাদরাসা ছিল না। আমরা এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে আরম্ভ করি।
‘‘বর্তমানে যেখানে দারুল উলূম মাদরাসা, সেখানে একটি মসজিদ ও ছোট মাদরাসা ছিল। মসজিদের মুতাওয়াল্লি মরহুম আবদুল হাকীম ছাহেবের সাথে আমরা আলোচনা করলাম। তিনি বললেন, এই মসজিদ-মাদরাসা আপনাদের হাতে সোপর্দ করছি।
‘‘হযরত মাওলানা মাহমুদুর রহমান ছাহেব রাহ. ইহতিমামের দায়িত্ব নিলেন এবং দীর্ঘ দিনের শ্রম ও সাধনার দ্বারা সেই ছোট মাদরাসাটিকে খুলনা দারুল উলূমে পরিণত করলেন। হাজার হাজার ছাত্র এখান থেকে দ্বীনী ইলম হাসিল করে বের হয়েছেন।
‘‘তিনি চট্টগ্রামের মানুষ হয়েও খুলনাবাসীর এত আপনজন ছিলেন যে, গোটা দারুল উলূমের ব্যয়ভার খুলনাবাসী নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। তাঁর মতো একজন আলিমের মৃত্যু বাস-বিকই একটি জগতের মৃত্যু।’’
বাবুনগর মাদরাসার মুহতামিম হযরত মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ ছাহেব বলেন, ‘‘মরহুম আমার এক বছর আগে দারুল উলূম দেওবন্দ গিয়েছিলেন। তাই তিনি আমার অগ্রজ। সারা জীবন আকাবিরে দেওবন্দের তরযের উপর ছিলেন। খুলনায় তিনি যে বিশাল দ্বীনী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তা না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। আমি সেখানে গিয়েছি এবং তাঁর নিজ হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানটি দেখেছি। আমাদের চেয়ে অনেক বেশি কাজ তিনি করে গেছেন। তাঁর কর্মই তাঁকে জীবন- রাখবে।’’
নাজিরহাট মাদরাসার মোহতামিম মাওলানা ইদ্রীস ছাহেব বলেন, ‘‘মরহুম ছিলেন নাজিরহাট মাদরাসার একজন তালিবে ইলম। তাই আমরা তাঁকে নিয়ে গর্ববোধ করি। নাজিরহাট মাদরাসায় তিনি কুরআনে কারীম হেফয করেছেন এবং সম্ভবত জামাতে হাফতুম (হেদায়াতুন্নাহব) পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। এরপর হাটহাজারী মাদরাসা ও দেওবন্দ মাদরাসায় উচ্চ শিক্ষা লাভ করেছেন।
‘‘ছোট হিসেবে আমাকে তিনি স্নেহ করতেন এবং বড় হিসেবে তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করতাম। মাঝে মাঝে আবেদন করেছি যে, আপনি নাজিরহাট মাদরাসায় চলে আসুন। তিনি বলতেন, ‘খুলনাবাসী আমাকে ছাড়ে না। আর আমিও খুলনাবাসীকে ছেড়ে আসতে পারি না।’ তাঁর সঙ্গীদের আন্তরিক ইচ্ছা ছিল, তাঁর অন্তিম শয্যা খুলনায় হবে, কিন্তু আল্লাহর ফয়সালা, চট্টগ্রামের মাটিই তাঁর জন্য নির্ধারিত ছিল। কুরআন মজীদের ইরশাদ
وما تدرى نفس باى ارض تموت
অর্থাৎ কোনো প্রাণীরই জানা নেই কোন ভূমিতে তার মৃত্যু হবে।
‘‘তাঁর অনেক গুণ ছিল, সবচেয়ে বড় গুণ হল তিনি ছিলেন দ্বীনের একজন মুখলিস খাদিম।’’
খিলগাও মাখযানুল উলূম মাদরাসার মোহতামিম হযরত মাওলানা নূরুল ইসলাম ছাহেব বলেন, ‘‘তাঁর প্রতি উস্তাদগণের গভীর আস্থা ছিল। আমি হাটহাজারী মাদরাসা থেকে ফারেগ হওয়ার পর আমার কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে আমার উস্তাদ হযরত মাওলানা আবদুল কাইয়ূম ছাহেব রাহ. এর নিকট মশোয়ারা চেয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘এখন থেকে তোমার মুরব্বী মাওলানা মাহমুদুর রহমান। তাঁর পরামর্শ মোতাবেক চলবে।’
‘‘তিনি দারুল উলূম হাটহাজারীর মুফতীয়ে আযম হযরত মাওলানা মুফতী আহমদুল হক রাহ. এবং শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা আবদুল আযীয রাহ.-এর নিকট থেকে ইজাযতপ্রাপ্ত ছিল। আমি নিজে খুলনা দারুল উলূমের ঐ মাহফিলে উপসি'ত ছিলাম, যে মাহফিলে অসংখ্য মানুষের সামনে হযরত শায়খুল হাদীস ছাহেব রাহ. তাঁকে ইজাযত দেন। তিনি বলেছিলেন, আমার ভাই আহমদুল হক মাহমুদুর রহমানকে খিলাফত দিয়েছেন, আমিও তাকে চারো সিলসিলায় বাইয়াতের ইজাযত দিচ্ছি।’ এরপরও তাঁর তাওয়াজু ও বিনয় এমন ছিল যে, কেউ বাইয়াতের আগ্রহ প্রকাশ করলেও তিনি বাইয়াত করতেন না। অন্য কোনো শায়খে কামিলের পরামর্শ দিতেন।’’
তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী মাওলানা গোলামুর রহমান ছাহেব বলেন, ‘‘তাঁর মতো আমানতদার মোহতামিম আমি আমার জীবনে দেখিনি। প্রতিবার বাড়িতে আসার আগে তিনি সম্পূর্ণ হিসাব দিয়ে আসতেন। আমি মনে করি, মোহতামিম ছাহেবানের জন্য তাঁর জীবন থেকে শেখার মতো অনেক কিছু আছে। তিনি মাদরাসার স্বার্থের বিষয়ে ছিলেন আপোষহীন। এক্ষেত্রে কারো ব্যক্তিত্বের পরোয়া তিনি করতেন না এবং কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতেন না। এমন পর্বতসম দৃঢ় প্রশাসকও আমার জীবনে বেশি দেখিনি।
‘‘তিনি ছিলেন গোটা দক্ষিণবঙ্গের আলিম-উলামার ঐক্যের প্রতীক। বিগত ৮/৮/৯৬ তারিখে আমরা তাঁর নেতৃত্বে দক্ষিণবঙ্গের আলিম-উলামার এক অবিস্মরণীয় মহাসমাবেশ করেছিলাম, যারা তা দেখেছেন তারা অনুধাবন করতে পেরেছেন যে, এতদাঞ্চলে কী অপরিমেয় গ্রহণযোগ্যতা তাঁর ছিল। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণের তাওফীক দিন। আমীন।’’
চার.
গত ৩ জুমাদাল উলা মোতাবেক ১৯/০৪/২০১০ ঈ. রোজ সোমবার তাঁর মাদরাসায় তা’যিয়াতী জলসা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে মুহতামিম ছাহেব রাহ.-এর শাগরিদ ও মুহিব্বীন, আশেপাশের মাদরাসাসমূহের মোহতামিম ও শায়খুল হাদীস এবং দ্বীনদার দোস্ত-আহবাব তাদের আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন, যা মুছাজজিলের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হয়। আমার একজন বন্ধু ও সহপাঠী খুলনা মাদানী নগর মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা হাসান জামীল এবং ওই মাদরাসারই আরেকজন শিক্ষক মাওলানা মাছুম বিল্লাহ ঐ আলোচনার দুটি ক্যাসেট আলকাউসারের জন্য পাঠিয়েছিলেন। তাদের দু’জনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ক্যাসেট দু’টিতে সংরক্ষিত বক্তব্যের মূল অংশগুলো পাঠকবৃন্দের সামনে তুলে ধরছি।
হযরত মুহতামিম ছাহেব মরহুমের অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র মাওলানা মুজাম্মেল হোসাইন কামাল অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘১৯৯৭ সনে আমার আব্বা ইন্তেকাল করেন। আমি তাঁর জানাযার খাটিয়ার নিকটে দাঁড়িয়ে খুব কাঁদছিলাম। হুজুর তখন আমার দু’হাতের বাজু ধরে বলেছিলেন, ‘বাপের জন্য কাঁদছিস? আজ থেকে আমি তোর বাপ!’ তাঁর সান্নিধ্যে আমি পিতার অভাব ভুলতে পেরেছিলাম, কিন্তু আজ তাঁর ছায়াও আমার উপর থেকে উঠে গেল।
‘‘১৯৯৭ সালের হজ্বের সফরে তাঁর সঙ্গে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। সে বছর মিনায় অগ্নিকাণ্ড হল। আমি খুব অসি'র হয়ে গিয়েছিলাম। তিনি হঠাৎ আমাকে বললেন, ‘বাবা, জীবনে ফরয-ওয়াজিবের পর মোয়ামালাত-মোয়াশারাত ঠিক রাখবা। তাহলে জান্নাতে যাওয়া খুব সোজা।’ আরেক হজ্বের সফরে এক প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘যে মাদরাসার হিসাব-নিকাশ ঠিক থাকবে সে মাদরাসায় কোনো দিন অভাব হতে পারে না।’
এভাবে বিভিন্ন সময় এমন সব টুকরো টুকরো কথা বলতেন, যা স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো।’’
ইসলামপুর জামে মসজিদের ইমাম ও খতীব মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘‘তিনি পদ্মার এপারে, তথা গোটা দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গের আলিম-উলামা ও দ্বীনদার মানুষের মুরব্বী ছিলেন। বাতিলের মোকাবেলায় সর্বদা তাকে আপোষহীন দেখেছি। নিজেও ভূমিকা রেখেছেন, আমাদেরকেও উৎসাহিত করেছেন। অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে খুলনা ইমাম পরিষদের মাধ্যমে সকলকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছেন। গোটা জীবন তিনি দারুল উলূম দেওবন্দের তরযের উপর অটল-অবিচল ছিলেন।’’
জামেয়া রশীদিয়া ক্যাডেট মাদরাসা গোয়ালখালী-এর মোহতামিম মাওলানা আবদুল আওয়াল ছাহেব (খলীফা, পীর ছাহেব চরমোনাই) বলেন, ‘‘হযরত মুহতামিম ছাহেব রাহ.-এর একটি বিশেষ গুণ এই ছিল যে, যে কোনো শ্রেণীর মানুষকে তিনি আপন করে নিতে পারতেন। প্রত্যেকেই মনে করত, আমাকেই হুজুর সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন। এটা ছিল নবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আখলাক।’’
মীনা মসজিদের খতীব মাওলানা গোলাম কিবরিয়া ছাহেব বলেন, ‘‘আমরা এমন একজন মুরব্বীকে হারিয়েছি, যিনি খুলনার আলিমদের ঐক্যবদ্ধ রাখার ব্যাপারে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। আলিয়া ও দরসে নিযামীর পার্থক্য তাঁর কাছে ছিল না।’’
জনাব ডা. নাসীমুদ্দীন সাহেব বলেন, ‘‘আমি আলিম নই, তবে আল্লাহ তাআলার মেহেরবানী যে, হযরত মুহতামিম ছাহেব মরহুমের সোহবতে থাকার সৌভাগ্য হয়েছে। এই মাদরাসায় (খুলনা দারুল উলূমে) কিছু বিভাগ-ইফতা, তাফসীর, আদব ইত্যাদি চালু করার প্রসঙ্গে তাঁর সাথে পরিচিত হয়েছি এবং তাঁকে নিকট থেকে দেখার সুযোগ লাভ করেছি। তিনি অত্যন্ত বিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ ও সুদক্ষ মোহতামিম ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে আমরা অনেক বড় একজন ব্যক্তিত্বকে হারিয়েছি।’’
জামেয়া মাদানিয়া আসআদুল উলূম মাদানী নগর মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা মাছুম বিল্লাহ বলেন, ‘‘অনেক রমযান তাঁর সঙ্গে একানে- কাটিয়েছি। যৌবনে তো রমযানের রাতে ঘুমাতেই না, বৃদ্ধ বয়সেও অল্প সময় ঘুমাতেন। আমরা যুবকরাও তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারতাম না।
‘‘হজ্বের জন্য রমযান থেকেই বে-কারার হয়ে যেতেন এবং বলতেন, কোন্ বছর আল্লাহ তাআলা হজ্বের জন্য কবুল করবেন, তা রমযানেই বোঝা যায়। রমযান থেকেই হজ্বের জন্য জ্বালা-যন্ত্রণা আরম্ভ হয়।’’
আশরাফুল উলূম মাদরাসার মোহতামিম মাওলানা মুফতী আবুল কাছেম ছাহেব বলেন, ‘‘তাঁর জন্য আমাদের ছওয়াব রেসানী করা দরকার এবং আল্লাহর দরবারে দুআ করা দরকার
যে, তিনি যেভাবে হক্ককে হক্ক মনে করতেন এবং না-হক্ককে না- হক্ক মনে করতেন আমরাও যেন সেভাবে হককে হক্ক ও না-হক্ককে না-হক্ক মনে করতে পারি।’’
গওহরডাঙ্গা মাদরাসার মোহতামিম হযরত মাওলানা রূহুল আমীন ছাহেব (ছাহেবযাদা হযরত ছদর ছাহেব হুজুর) বলেন, ‘‘তাঁকে দেখে আমাদের মনে হত যে, খুলনা দারুল উলূম ছাড়া তাঁর আর কিছু নেই। বাড়ি-ঘর নেই, পরিবার-পরিজন নেই, আত্মীয়-স্বজন নেই। তাঁর
শুধু আছে খুলনা দারুল উলূম। মাদরাসার জন্য সব কিছু কোরবান করেছেন এবং যাহিদানা যিন্দেগী যাপন করেছেন। আমি তালিবে ইলমদেরকে তার জীবন থেকে যুহ্দ ও তাকওয়ার শিক্ষা নেওয়ার অনুরোধ করি।
‘‘আগে আমাদের কওমী মাদরাসা-অঙ্গনে ইলমের শোগল. ছাড়া অন্য কেনো দুনিয়াবী কাজে লিপ্ত হওয়াকে হালাকত মনে করা হত আর এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত। এখন তালিবে ইলমরা পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্য, সভা-সমিতি ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত। ইলম অর্জনে নিজেকে হামা-তন মশগুল করার পরিবর্তে আমাদের মাঝে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির সৃষ্টি হয়ে গেছে। আল্লাহ তাআলা হেফাযত করুন। অথচ হযরত মুহতামিম ছাহেবের দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রয়েছে। তাঁকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিত হত যে, এ যুগেও একজন মানুষ এত সাদামাটা জীবন যাপন করতে পারে। চট্টগ্রামে তাঁর বাড়িঘর দেখলে চোখের পানি রাখা যায় না। ডাক বাংল মসজিদের যে হুজরায় তিনি থাকতেন একবার আমি সেখানে গিয়েছিলাম। আমার চোখে পানি এসে গেছে। অথচ তিনি শুধু মৌন সম্মতি দিলেও খুলনা শহরে তাঁর বাড়ি-গাড়ির অভাব হত না। আমাদের কর্তব্য, তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা।’’
খুলনা দারুল উলূমের নায়েবে মুহতামিম মাওলানা রফীকুর রহমান ছাহেব বলেন, ‘‘হযরত মুহতামিম ছাহেব রাহ. এমন ব্যক্তি ছিলেন যে, আমরা সবাই মিলেও তাঁর সমান হব না। তাঁকে হারিয়ে আমরা এতীম হয়ে গিয়েছি।’’
নোয়াপাড়া মাদরাসার শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা তৈয়্যবুর রহমান ছাহেব বলেন, ‘‘তিনি এমন একজন ব্যক্তিত্ব, যার প্রশংসা করে শেষ করা যাবে না। প্রকৃতপক্ষে যারা নায়েবে রাসূল তাঁদের মধ্যে রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর গুণ ও বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ থাকাটাই স্বাভাবিক। তাঁর একটি বিশেষ গুণ ছিল কুরআন মজীদের তেলাওয়াত। ৮০ বছর বয়সেও তিনি খতম তারাবী পড়িয়েছেন। বর্তমান যুগে এমন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাঁর আরেকটি গুণ ছিল ইহতিমাম। আল্লাহ তাঁকে মাদরাসা পরিচালনার অতুলনীয় যোগ্যতা দান করেছিলেন।’’
পাঁচ.
হযরত মুহতামিম ছাহেব রাহ. এর দীর্ঘ জীবন ও কর্ম, বিশেষত তাঁর আখলাকে হাসানার খুব সামান্য অংশই এখানে উল্লেখিত হয়েছে। তাঁর জীবনাদর্শ থেকে গ্রহণ করার মতো আরো অনেক বিষয় আছে। আমাদের এই ভূখণ্ডের দুর্ভাগ্য যে, সময়মতো যথাযথ উদ্যোগের অভাবে এ অঞ্চলের মুরব্বী ও আকাবিরের জীবন ও আদর্শ যথাযথভাবে সংরক্ষিত হয়নি। তাদের সান্নিধ্যপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা যতদিন ছিলেন ততদিন ঐসব স্মৃতি তাদের সীনায় জমা ছিল, তাদের ইন্তেকালের মাধ্যমে তা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। আর এ কথা তো বলাই বাহুল্য যে, জাতির আদর্শ-সন্তানদের জীবন-চরিত সংরক্ষণ করা না হলে এর ক্ষতি হয় অত্যন্ত গভীর ও সুদূর প্রসারী। আমরা আন্তরিকভাবে কামনা করি, হযরত মুহতামিম ছাহেব রা.-এর জীবন ও কর্মের উপর তথ্যসমৃদ্ধ ও বস্তুনিষ্ঠ কাজ হবে। তাঁর সমবয়সী অনেক বুযুর্গ এবং তাঁর দোসত-আহবাব এখনো জীবিত আছেন, বিপুল সংখ্যক শাগরিদ, সহকর্মী ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার ভক্ত-অনুরক্তদের স্মৃতিতে এখনো তিনি সমুজ্জ্বল। তাই এখনই যদি তার জীবনী সংকলনের কাজে হাত দেওয়া হয় তাহলে তা অনেক সহজ ও সমৃদ্ধ হওয়ার আশা করা যায়। আর এর জন্য তাঁর নিজ হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান খুলনা দারুল উলূমের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গই সর্বাধিক হক্কদার।
আল্লাহ তাআলা তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউসে সন্তান দান করুন এবং যে বুযুর্গানে দ্বীনের ছায়া এখনো আমাদের উপর আছে তাদেরকে ছিহহত ও আফিয়াত এবং হায়াতে তাইয়্যিবা-তাবীলা নসীব করুন। আমীন।
هذا, وصلى الله تعالى وسلم على سيدنا ومولانا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين, وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.