হাদীসে নববীর পাঠ গ্রহণের উসূল ও আদাব
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
তৃতীয় কথা
দাওরায়ে হাদীসে আমরা যারা তাকরীরের খুব গুরুত্ব দিই। তাকরীরের পিছনে পড়ে আমরা দু’টি বিষয় থেকে গাফেল হই; বরং আমি বলবো আমরা কয়েকটি বিষয় থেকে গাফেল হয়ে যাই। খুব বেশি তাকরীর লিখতে গিয়ে, ইয়াদ করতে গিয়ে, তাকরীর থেকে আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে আমরা গাফেল হয়ে যাই। অথচ আদবের তাকাযা হলো ঐ জিনিসগুলোর প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া যেগুলো এখন আমি বলব।
এক. হাদীসের সনদ ও মতনের সহীহ ও নির্ভূল পাঠ, القراءة الصحيحة الراشدة الواضحة لمتون الحديث وأسانيدها
হাদীসের মতন ও সনদের নির্ভুল, সঠিক ও স্পষ্ট পাঠ- এটা হাদীসের জন্য সবচে’ বড় আদব। হাদীস পড়ার সময় যেন এমন ভাব না হয়, যেন ট্রেন ছুটছে। ট্রেন ছুটলে দৌড়াদৌড়ি করে কারা? অন্য দেশিরা নয়, বাংলাদেশিরা; ট্রেন আসলে কী একটা হুলুস্থুল করে! বিমানে নেয়ার জন্য বাস এল, বাস ভরে গেলে আরেকটা আসবে; নিবেই সবাইকে। এখানেও শুরু করে কার আগে কে উঠবে। আবার বাস থেকে নেমে কার আগে কে বিমানে উঠবে; অথচ আমার আসন আছেই। এটা হলো বাঙ্গালী লোকদের স্বভাব। এই হাদীসের কিতাব পড়ার সময়ও এমন করে হঠাৎ এমনভাবে পড়া শুরু করে! আরে ভাই তোমার কি জ্বর উঠল? কে যেন তাড়া দিচ্ছে পিছন থেকে। অথচ হাদীসে আছে- عَلَيْكُمْ بِالسَّكِينَةِ وَالْوَقَارِ
তোমরা মসজিদে যখন আসবে তখন ধীরস্থিভাবে আস, হুড়াহুড়া করে আসবে না। তাকবীরে উলা ছুটলে ছুটুক। মাসবুক হওয়া থেকে বাঁচতে হলে আগে থেকেই রওয়ানা হও। কিন্তু হুড়াহুড়ির কারণে একজনের উপর আরেকজন পড়ে কী অবস্থা! এতে অন্যান্য নামাযীদের সমস্যা সৃষ্টি হয়।
নামাযের ক্ষেত্রে নবীজী যে নসীহত করেছেন এই নসীহতটা ঠিক হাদীসের মতন পাঠের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য-
عَلَيْكُمْ بِالسَّكِينَةِ وَالْوَقَارِ
حدثنا الحميدي قال : حدثنا سفيان
পুরা বছর ঠিক এত তারতীলের সাথে পড়া যাবে না, তবে এমন হদরের সাথে পড়েন যাতে মাখরাজ যথাযথ আদায় হয়। পড়া দ্রুত হবে কিন্তু আপনার মাঝে তাড়াহুড়ার কোনো ছাপ থাকবে না। ফরীদাবাদে হযরত মাওলানা আবদুল হাফীয ছাহেব ছিলেন। পড়া খুব দ্রুত পড়তেন কিন্তু কেউ বুঝতো না যে তার মাঝে তাড়াহুড়ার কোনো ভাব আছে। তাড়াহুড়ার ভাব ছাড়া দ্রুত পড়া। তাড়াহুড়ার ভাব ছাড়া দ্রুত পড়া শিখতে হবে। বছরের শেষে যখন সময় থাকবে না তখন দ্রুত পড়েন, কিন্তু তাড়াহুড়ার কোনো ভাব থাকবে না। এরকম দ্রুত পড়াকে আমি নিষেধ করি না। আর যখন সময় থাকবে তখন ধীরে ধীরে পড়েন তারতীলের সাথে পড়েন। যাতে বুঝা যায় যে আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস পড়ছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইরশাদ যখন আপনি তাঁকে শুনাবেন তখন আপনি ভুল পড়বেন নাকি? এটা যেহেনে সব সময় থাকতে হবে। এজন্য কয়েকটি কথা বলেছি :
এক. পাঠ নির্ভুল ও বিশুদ্ধ হতে হবে। নির্ভুল ও বিশুদ্ধ হওয়া মানে নাহু ছরফ ও লুগাতের কোনো গলতি থাকতে পারবে না। নামগুলোর মধ্যে ضبط -এর গলতি থাকতে পারবে না এবং তাজবীদের গলতি থাকতে পারবে না। তাজবীদের গলতী বলতে মাখরাজ ও ছিফাতে লাযেমার رعايت করা। কুরআনের মত ষোলআনা রেয়ায়েত হাদীসের মধ্যে করা জরুরি নয়। যেমন إنما الأعمال بالنيات খুব গুন্নার সাথে পড়লাম এমন করা জরুরি নয় । তাজবীদের যেটা লাযেমী অংশ যেটা ছেড়ে দিলে লাহনে জলী হবে সেটা রেয়ায়েত করা জরুরি।
আরেকটা বিষয় হল ইবারত واضح হতে হবে। অর্থাৎ একেবারে সাফ সুতরা হতে হবে, এমন যেন না হয় একটা অক্ষর বুঝা গেল না, কী পড়ল দ্বিতীয় এবং তৃতীয় কাতারের ছাত্ররা বুঝল না। এজন্য
القراءة الصحيحة الراشدة الواضحة لمتون الحديث وأسانيدها
হতে হবে। এটার জন্য মেহনত তো তাইসীরুল মুবতাদী থেকে শুরু হয়েছে। এসো আরবী শিখি থেকেই তো এর মেহনত শুরু হয়েছে। যে যতটুকু মেহনত করেছে ততটুকু ফল পাবে। যদি আগে থেকে দুর্বলতা নিয়ে দাওরায় এসে থাকে তো তার القراءة الصحيحة الراشدة হবে না। এখন তার পেছনের জন্য আফসোস করতে হবে এবং নির্ভুল পাঠ শেখার জন্য عهد করতে হবে। তো বিশুদ্ধ পাঠের জন্য তাকে হরকতওয়ালা নির্ভুল সহীহ নুসখা সংগ্রহ করতে হবে।
কিছু সহীহ নুসখার বিবরণ :
যেমন নাসায়ীর সহীহ নুসখা, যা শায়েখ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ.-এর তাহকীকে ছেপেছে। তো আপনার জানতে হবে কোন্ নুসখাটা নির্ভুল হরকত লাগানো। যাদের নাহু ছরফে দুর্বলতা আছে তারা তো এখনই দুর্বলতা দূর করতে পারবে না। তাই তারা এ ধরনের নুসখা সংগ্রহ করলে ভাল।
বুখারী শরীফের এবং মুসলিম শরীফের সহীহ নুসখা আছে। বুখারী শরীফের তুর্কিয়ার একটা ছাপা। الطبعة السلطانية বা তার থেকে تصوير করে যে এডিশন ছাপা হয়েছে। চার খণ্ডে বুখারী, চার খণ্ডে মুসলিম ছেপেছে। এর মধ্যে পুরা হরকত লাগান আছে। আর সাধারণত যেটার মধ্যে বেশি হরকত লাগানো হয় সেখানে বেশি ভুল থাকে। কিন্তু এরা মাশাআল্লাহ এত বেশি মেহনত করেছে আমি একটা ভুলও পাইনি। এ কথা বলছি না যে, এর মধ্যে কোনো ভুল নেই। হয়তো এক দুইটা থাকবে। এমন কি সেখানে عن ও في -এর মধ্যে হরকত লাগানো আছে। তো প্রধান আদব হলো নির্ভুল স্পষ্টতম বিশুদ্ধ পাঠ।
দুই. হাদীসের তরজমা ভালো করে বুঝা
তরজমা উস্তায যদি বলে দেন, আলহামদু লিল্লাহ। কিন্তু অনেক লম্বা নেসাব- দুই বছরের দাওরা এক বছর করলে যা হয়। সেজন্য সব হাদীসের তরজমা তো উস্তাযগণ করতে পারবেন না কিন্তু কিছু কিছু উস্তায করে দেন। হয়তো পুরো কিতাবের তরজমা করে দেন নতুবা অধিকাংশ তরজমা করে দেন। আমরা তরজমার প্রতি খুব গুরুত্ব দেই। তরজমা বুঝা এবং শেখা দুটি কাজ। তরজমা শেখার জন্য দাওরার বছর যথেষ্ট নাও হতে পারে। এর জন্য বাংলার উপর মেহনত অব্যাহত রাখতে হবে। আর বুঝার মেহনত এখনই। আমি যা হাদীস পড়লাম তা আমি বুঝতে পারি- এতটুকু মেহনত এখনই করতে হবে।
শেখার কথা বললাম কেন? বুঝার পর এটা প্রকাশ করতে পারা। শুধু মাফহুম বুঝে গেলেই সুন্দরভাবে প্রকাশ করা যায় না। এটার জন্য আমার বাংলা ভাষা জানা থাকতে হবে। শব্দজ্ঞান থাকতে হবে। সাহিত্য জানা থাকতে হবে এবং বাংলার যে উসূলে তরজমা আছে সে সম্পর্কে আমার ধারণা থাকতে হবে। এগুলো যদি আমার আগ থেকেই মশক না হয়ে থাকে তাহলে কীভাবে চলবে? এগুলোর উপর তালিবুল ইলমরা তো এখন থেকে মেহনত করতে পারে। এই মরা যামানার মধ্যেও তো কিছু জোনাকির আলো জ্বলে! এই আলোগুলো থেকে ইস্তেফাদা করার লোক কম। মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ দা.বা.-এর সম্পাদিত বাংলা আলকলম-এর (পুষ্পের) মধ্যে এই মেহনত চলছে। পুষ্পকে অবলম্বন করে এই মেহনত করা যায়। আমি তাঁর কাছে জোরদার দরখাস্ত করবো, (এই মেহনত ওখানেও আছে) সেখানে একটা আয়াত ও একটা হাদীসের তরজমা থাকবে। এক পৃষ্ঠা যেন পুরা থাকে। অর্ধেক পৃষ্ঠা কুরআনের তরজমা আর অর্ধেক পৃষ্ঠা হাদীসের তরজমা। এবং এমন তরজমা যেটা দাওরায়ে হাদীসের ছাত্রদের জন্য আদর্শ তরজমা হয়। মানে তরজমার প্রকারভেদ আছে; একটি আদবী তরজমা, ইলমী তরজমা, ফন্নী তরজমা- এভাবে তরজমার প্রকারভেদ আছে। হাদীসের তরজমা হতে হবে কানূনী এবং ইলমী তরজমা। আর সাথে যেন ভাষার সালাসাত (সাবলিলতা) থাকে। আপনার মাদরাসার উস্তায থেকেও আপনি তা হাসিল করতে পারেন। যারা এমন উস্তায পেয়ে যাবেন যার বাংলাতেও দক্ষতা আছে এবং ফাহমে হাদীসের গভীর ইলম আছে তাহলে তো ভাল। তিনি যে তরজমা করে দেন সেটা মনে রাখার চেষ্টা করবেন। নোট করে রাখবেন। আমার অনেক কষ্ট হয় এ ধরনের উস্তায যেখানে আছেন তাদের ছাত্রদেরকে আমি জিজ্ঞাসা করি, এই হাদীসের তরজমা তোমার উস্তায কী বলেছেন? কিন্তু সে বলতে পারে না। অনেক উস্তায কিতাব বুঝিয়ে চলে যান তরজমার প্রয়োজন বোধ করেন না; যেহেতু সময় নেই। উস্তাযগণের আযমত কিন্তু থাকতে হবে। আল্লাহ একেকজনকে একেক মেযাজের বানিয়েছেন, একেক জনকে একেক যোগ্যতা দিয়েছেন। যে উস্তাযের কাছে যে মাহারাত আছে, যে কামালাত আল্লাহ দান করেছেন এটা তুমি উস্তায থেকে নেবে। আরেকজনের মধ্যে যেটা আছে তা নেবে, কিন্তু তুলনা করবে না- এই উস্তাযের মাহারাত বেশি, এই উস্তাযের কম। এরকম যদি তালিবুল ইলমরা তুলনা করতে থাক, যবানে বা দিলে, তবে তার যিন্দেগী বরবাদ হয়ে যাবে। একজন উর্দু তরজমা করেন তার থেকে আপনি উর্দু তরজমা শিখেন। এবং তাঁর অন্যান্য কামালাত আছে, আখলাক, আফকার থাকবে এগুলো তাঁর থেকে আপনি হাছিল করেন। কখনো তুলনা করব না। বরং তাঁর মাঝে যে গুণাবলী আছে আমি সেটার দিকে তাকাই, সেটা অর্জন করি। অযথা মুকারানা করে سوء أدب -এর ارتكاب করব না। আল্লাহ তোমাকে যদি এমন উস্তায মিলিয়ে দেন যার ভাষার যোগ্যতাও আছে আবার হাদীসের ফাহ্মও আছে। তিনি যে তরজমা করেন তা নোট করে রাখেন। যেমন, إنك لتحمل الكل و تكسب المعدوم
কী তরজমা করেছেন উস্তায? উস্তাযের তরজমা উস্তাযের কাছে রয়ে গেছে আর এখন তিনি উর্দু তরজমা দেখবেন, বাংলা তরজমা দেখবেন, আরবী তরজমা দেখবেন, এরপর নিজের থেকে একটা তরজমা করবেন। কেন আপনার ডায়েরীতে নোট নেই- আপনার উস্তায কী তরজমা করেছেন? আহাম আহাম جملة যেগুলোবা الكلم جوامع জাতীয় হাদীস যেগুলো এর তরজমা বিভিন্নভাবে হতে পারে, আমার উস্তায কোনটা করেছেন সেটা মনে রাখতে হবে, আমার কাছে নোট থাকতে হবে। এটা তরজমার প্রতি একটা মেহনত, এটা এক বছরেই হয়ে যাবে না। এখন থেকে মেহনত করতে থাকব, যাতে আমার মাঝে এ মেযাজ পয়দা হয় যে, আমি যখন কোনো হাদীসের তরজমা করব তখন কীভাবে আমি জাতির সামনে হাদীসের আদর্শ তরজমা পেশ করবো। আমি একটা হাদীস পড়ে তরজমা করলাম ওখানে শিক্ষিত লেকেরা আছে। তারা বলবে হুজুর তো হাদীস পড়ার পর তরজমা করেনি। অনেকে বলে, আমি তরজমা করছি; এরপর তরজমা না করে তাফসীর করে। তরজমা এক জিনিস আর তাফসীর ও র্শহ আরেক জিনিস। প্রথমে তরজমা করতে হবে আয়াতের, প্রথমে তরজমা করতে হবে হাদীসের; নির্ভুল তরজমা, সঠিক তরজমা। এটার জন্য বাংলা ভাষার মেহনত করতে হবে এবং কুরআন ও হাদীসের তরজমাগুলোর মধ্যে তুলনামূলক যেগুলো একটু মানসম্মত সেগুলো সংগ্রহ করতে হবে এবং মিলিয়ে মিলিয়ে মুকারানা করে দেখতে হবে। এটা দাওরার বছর মাত্র দশটি হাদীসেই করি আমি। এরপর মেহনত চালু রাখি। তরজমার প্রতি খুব খেয়াল রাখি। তরজমা বোঝা এবং আদর্শ তরজমা শেখা। দাওরার বছরেই সব হবে না, তবে এখন থেকেই এ মেযাজ তৈরি করতে হবে।
তিন. هدايات الحديث
الحديث تقرير -এর প্রতি খুব জোর দেই আর هدايات الحديث থেকে গাফেল হয়ে যাই। একটা তাফসীর আছে, আবু বকর জাবের আলজাযায়েরীর أيسر التفاسير। আশা করি এখনো তিনি জীবিত আছেন, মোয়াম্মার হুযুর। তাঁর এ তাফসীরের মধ্যে একটা শিরোনাম থাকে هدايات الآيات। এরকম আপনি যখন একটা হাদীস পড়বেন তো আপনার মাথায়ও هدايات الحديث থাকবে। একটা হলো এই হাদীসের কী কী ফাওয়ায়েদ ও আহকাম مستنبط হতে পারে। এটার তো সীমারেখা নেই,অনেক।
عبارة النص، إشارة النص، إقتضاء النص، دلالة النص
এ চারটা তো আমরা নূরুল আনওয়ারে পড়েছি এ ছাড়াوجوه الدلالة আরো আছে। এসব ওযূহ-এর ভিত্তিতে হাদীসের থেকে فوائد،أقسام، آداب উদ্ঘাটন হতে পারে অনেক।
يا أبا عمير! ما فعل النغير؟
এই হাদীস থেকে মিকনাসার এক আলেম ৪শত ফায়েদা ইসতিম্বাত করেছেন। মূসা আলাইহিস সালাম সফর করে খাযির আলাইহিস সালামের কাছে গিয়েছেন ইলম শেখার জন্যে। এই যে ঘটনা কুরআনে আছে, হাদীসে আছে, এসব আয়াত এবং হাদীস থেকে ইলম, তালিবে ইলম ও মুআল্লিমের এবং তালিম ও তাআল্লুমের কী কী আদব উদ্ঘাটন হতে পারে এর উপর মেহনত করে কিতাব লেখা হয়েছে। আল্লামা ইউসুফ বানূরী রাহ.-এর শাগরিদ এ বিষয়ে রিসালা লিখেছেন-إرشاد الحليم إلى ما في قصة الكليم
এটার মধ্যে কয়েক শত ফায়েদা। এ রকম শত শত ফায়েদা আছে, আমি এটার কথা বলছি না।
অনেক فوائد ইস্তিম্বাত হবে, এখন এরপর ভবিষ্যতে আরো নতুন প্রেক্ষাপট দেখা দিবে তখন ঘাটাঘাটি করে দেখবে ও বলবে, আরে এই হাদীস থেকেই তো এটার সমাধান পাওয়া যায়। আগে কোনো شارح এই হাদীস থেকে ঐ সমাধান নেননি। তখন এ ধরনের ঘটনা তাদের বুঝে আসেনি। এখন ঘটনা ঘটেছে। আপনি ঘটনা মাথায় রেখে যখন হাদীসের কিতাব মুতালাআ করলেন। তখন দেখলেন যে আরে এই হাদীসের মধ্যেই তো এর সমাধান আছে। এটা চলতে থাকবে। কিন্তু কিছু একেবারে আম-ফাহাম হেদায়েত, বড় দাগের হেদায়েত, যা একটা হাদীস থেকে বুঝে আসে; সেটা মুযাকারা করতে হবে, নোট করতে হবে। এবং হেদায়েতগুলো গ্রহণ করে আমার আমলী যিন্দেগীতে বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলে
تصحيح قراءة الحديث، القراءة الصحيحة الراشدة الواضحة لمتن الحديث وإسناده এবং ترجمة الحديث ترجمة فصيحة بلغة الوطن
তিন নম্বর হল هدايات الحديث
এ তিনটা মেহনত হল এক নম্বর।
৪ নম্বর মেহনত হলো ফিকহুল হাদীস।
৫ নম্বর হলো তাকরীর। কিন্তু আমরা প্রথম চারটি বাদ দিয়ে পাঁচ নম্বরটা নিয়েই ব্যস্ত থাকি। সময় বেশি লাগাই। আপনারা বলবেন আমাদের তাকরীর তো ফিকহুল হাদীস সম্পর্কে, না আপনাদের তাকরীর যা আপনারা বেশি পড়েন তা হলো ফিকহুল হাদীসের একটা অংশ। আপনাদের আলোচনা ইখতেলাফী মাসায়েলের মাযাহেব ও দালায়েল নিয়ে বেশি হয়।
আরেকটা কথা বলবো ইনশাআল্লাহ, যার দিকে মাওলানা আবদুল মতীন ছাহেব ইশারা করে গেছেন। ইখতেলাফী মাসায়েলের ক্ষেত্রে সব ইমামের কাছে দলীল আছে। ফিকহে হানাফীর দলীল অন্যদের দলীলের চেয়ে মজবুত বা সমান পাল্লার। অন্যদের দলীল থেকে ফিকহে হানাফীর দলীল দুর্বল- এটা দু-চারটা মাসআলার ক্ষেত্রে হতে পারে। আকছার মাসায়েল বা যেগুলো নিয়ে হাঙ্গামা করে সেগুলোর ক্ষেত্রে ফিকহে হানাফীর দলীল হয়তো সমান পাল্লার আর না হয় অধিক শক্তিশালী। বেশী أصح, أقوى ও واضح। কিন্তু আমাদের এইসব দালায়েল পড়া, এগুলো খুঁজে বের করা, ইয়াদ করা- এ সব ক্ষেত্রে আমাদের অবহেলা। আমরা আমাদের তাকরীরের মধ্যে জোর দেই- অনেকগুলো দলীল, অনেকগুলো জবাব, জবাবের জবাব, অনেকগুলো وجوہ ترجيح ইত্যাদির প্রতি। নতুন প্রেক্ষাপটে এখন যেটা দরকার তা হলো ترين صحيح এবং ترين راجح একটা দুইটা তিনটা দলীল ইনতেখাব করেন। وجوہ ترجيح অনেক আছে তার মধ্যে আপনি ترين راجح উযূহে তারজীহ ইনতেখাব করেন। এরপর এটা ইয়াদ করেন হাওয়ালাসহ এবং সনদসহ। পারবেন না?
এটা কত কষ্টদায়ক-যাদের ইলমী বিষয়ে এবং দ্বীনের সহীহ فهم-এর বিষয়ের কোনো শেকড় নেই। বা নামকে ওয়াসতে শেকড়,তারা হাদীস শোনায় বাহাওয়ালা;আর আমাদের যাদের শেকড় আছে,আমরা যারা মুসতানাদ,আমরা বলি যে আমাদের দলীল কিতাবে আছে,দেখে বলতে হবে- هو عندي في الصندوق
আমি দাওরা ও মেশকাতের ছাত্রদের খেদমতে হাত জোড় করে দরখাস্ত করছি। আপনারা দাওরার বছর কমপক্ষে এ ‘আযম’ করেন, নামাযের যে মাসায়েলের মধ্যে ‘তানাউয়ে সুন্নতে’র ইখতেলাফ আছে এবং ইমামদের মাঝে দালায়েলের ইখতেলাফ আছে, এক্ষেত্রে যেটার উপর ফিকহে হানাফীর মাদার, তার দুটি বা তিনটি দলীল সাহাবীর নামসহ ও হাওয়ালাসহ মুখস্থ করেন এবং কমপক্ষে একটি হাদীস সনদসহ মুখস্থ করেন। এর থেকে সহজ কী হতে পারে! আর এখন থেকে ডায়েরী বানান, যার নাম হবে محفوظات। এখানে নির্বাচিত হাদীসগুলো নোট করেন। মতনসহ, সনদসহ ও যে কিতাব থেকে নিয়েছেন তার হাওয়ালাসহ। হাটহাজারীর হযরত মাওলানা আব্দুল আযীয ছাহেব তাঁর শাগরিদদেরকে হাদীস মুখস্থ করতে বলেছেন। আমি তার এক শাগরিদকে দেখেছি, শুধু সাহাবীর নাম ও মত্নে হাদীস লিখে রেখেছেন। কিন্তু কোন কিতাব থেকে নিয়েছে তার উল্লেখ নেই। সে মনে করেছে আমার তো শুধু মতন দরকার। আরে ভাই! কত কিতাব আছে? তুমি কি বুখারী থেকে নিয়েছো না মুসলিম থেকে, না অন্য কোনো কিতাব থেকে, এটা কীভাবে বুঝবে? এখন থেকেই আমরা প্রত্যেক বিষয়ে হাদীস নোট করব সনদ মতন ও হাওয়ালাসহ। সাথে খ- ও পৃষ্ঠা নম্বর এবং হাদীস নম্বর লিখব। সবচেয়ে ভাল হবে সঙ্গে বাবও লিখলে। যেমন .كتاب الصلاة باب كذا এবং এটা সব সময় আমার সামনে থাকবে আমি মুখস্থ করতে থাকব। কিন্তু দাওরার বছর কমপক্ষে নামাযের ইখতিলাফী দালায়েলগুলোর মশহুর মশহুর মাসআলার তিনটি দলীল সাহাবীর নাম, মত্নে হাদীস ও হাওয়ালা এবং এই হাদীস কোন ইমাম সহীহ বলেছেন বা হাসান বলেছেন উক্তিসহ আমি মুখস্থ করব। এর মধ্যে কমপক্ষে একটি হাদীস সনদসহ মুখস্থ করব। পারবো না ইনশা আল্লাহ? এটা আরো সহজ হবে মাওলানা আব্দুল মতিন ছাহেবের দলীলসহ নামাযের মাসায়েল, যা মাকতাবাতুল আযহার থেকে ছেপেছে আর নবীজীর নামায, যা মাকতাবাতুল আশরাফ থেকে ছেপেছে এটা নিন। উম্মত যে মাসলাকের উপর আমল করছে, যে মাসলাকের দলীল আছে, তা সত্ত্বেও উম্মতকে ঐ মাসলাকের দলীল না শুনিয়ে অন্য মাসলাকের দলীল শুনিয়ে দিচ্ছে। এটা কোন فقيه -এর কাজ হতে পারে না। এসব যারা করে সে আপন জায়গায় অনেক বড় হতে পারে, আমার জানা নেই, কিন্তু তার মাঝে ফাকাহাত নেই। দ্বীনের ফাকাহাত যার মাঝে আছে, আদাবুল ইখতিলাফ নিয়ে যারা লেখাপড়া করেছে এবং এই মাসআলার ক্ষেত্রে সাহাবা ও তাবিয়ীনের মেযাজ যারা জানে, তারা এ কাজ কখনো করতে পারে না। উম্মতের যে বা যারা আমল করছে ترك القراءة خلف الإمام -এর উপর তাদের শোনাচ্ছেন قراءة خلف الإمام -এর হাদীস। আর বলছেন যে ترك القراءة -এর কোনো হাদীস নেই বা থাকলেও যয়ীফ।
এই ধরনের غير فقيه লোকেরা হাদীস শুনিয়ে দিচ্ছে হাওয়ালাসহ আর আপনি বলছেন, আছে, কিতাব খুলে দেখাতে হবে। ভাইয়েরা! তোমরা সময় ব্যয় করার ক্ষেত্র পাও না। গল্পগুজব করে, ঘুমিয়ে সময় নষ্ট কর। দাওরার মধ্যেও সময় পাও কিন্তু নষ্ট কর। অথচ مستشرقين -এর ফেতনা حديث منكرين -এর ফেতনা دشمنان اسلام -এর ফেতনা, ফেরাকে বাতিলার ফেতনা- এগুলো মোকাবেলা করার দরকার, সে প্রস্তুতি কারা নিবে? ছোট্ট ফেতনারই মোকাবালা করতে পারছ না, কারণ তোমরা নিয়তই করে রেখেছ যে এগুলো আমাদের কাজ না। অথচ এটা তোমাদেরই কাজ। যে মাদরাসায়ই তুমি থাক দাওরায়ে হাদীসের প্রতিটি তালিবে ইলম এসব ফিতনার মোকাবেলা করার যিম্মাদার এবং সে যদি হিম্মত করে তার জন্য তা সম্ভব। তোমরা হিম্মত বাড়াও নিয়ত কর। গাফলতের সাথে যদি থাক তাহলে তোমাদের অস্তিত্ব থাকবে না। এই আশায় বসে থাকলে চলবে না যে, পীরজী হুযুর, হাফেজ্জী হুযুর, ছদর সাহেব হুযুরের মেহনতের বরকতে ঢাকা শহর তোমাদের হাতে থাকবে। এখন অনেক মসজিদ এমন লোকদের তত্ত্বাবধানে, যাদের ফিকরী সমস্যা এবং যাদের আকীদা-ফিকির বক্র। তাদের মিডিয়া আছে। আপনাদের কোনো মিডিয়া নেই। মিডিয়া সব ওদের হাতে। আপনারা ঘুমিয়ে থাকবেন আর ছদর সাহেব ও হাফেজ্জী হুযুরের বরকতে আপনাদের অস্তিত্ব ঠিক থাকবে- এই ভুল ধারণার কোনো অবকাশ নেই। সজাগ হতে হবে, মেহনত করতে হবে। হিফযুন নুসূস ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মেহনতের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।
আল্লাহ তাআলা সবাইকে তাওফীক দান করুন। আমীন
(ধারণ ও লিখনে : মাওলানা আব্দুল হাকীম)