মুহাররম ১৪৩৮   ||   অক্টোবর ২০১৬

শরীয়তের মীরাসনীতি অনুসরণ না করার বহুমুখি কুফল

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

ইসলাম ভারসাম্যপূর্ণ দ্বীন। মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণের রক্ষাকবচ এটি। বৈধ পন্থায় অর্জিত ব্যক্তি-মালিকানাকে স্বীকার করে ইসলাম। আবার মালিকানাধীন সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও রয়েছে ইসলামের সুস্পষ্ট নীতিমালা। নিজ প্রয়োজনে খরচের পাশাপাশি পরিবার পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও অন্য আর কাকে কখন কী পরিমাণ সম্পদ দেওয়া দরকার তার নির্দেশনাও রয়েছে শরীয়তে। আর সম্পদ রেখে মারা গেলে কারা কী পরিমাণ হিস্সা পাবে তাও শরীয়ত বলে দিয়েছে। আবার কেউ তার সম্ভাব্য ওয়ারিসদেরকে নিজ হাতে কোনো সম্পদ দিতে চাইলে তার সহীহ নীতিমালাও শরীয়ত বাতলে দিয়েছে। এসব নীতিমালা অনুসরণের মাধ্যমেই একটি পরিবার ও সমাজ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের যোগ্য হয়ে থাকে। কিন্তু আফসোসের বিষয় হল, বর্তমানে কিছু কিছু মুসলিম কর্তৃক ঐসব মূল্যবান নীতিমালা ও নির্দেশনা অনুসরণ না করার কারণে সেসব পরিবার ও সমাজ হয়ে উঠে বিশৃংখল ও অশান্তিপূর্ণ। শুধু তাই নয় বরং সম্পদের মালিক নিজ জীবদ্দশাতেই বিপাকে পড়ে যায় অনেক ক্ষেত্রে। সম্প্রতি এ ধরনের কয়েকটি ঘটনা সামনে আসায় এ বিষয়ে কলম ধরার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছে।

ঘটনা এক : হাজ্বী আবুল কাসেম (ছদ্মনাম)। একজন বিত্তবান মানুষ। বেশ কয়েকটি বাড়ি-মার্কেট, ভূসম্পত্তি ও নগদ টাকার মালিক। তার ছিল এক ছেলে, দুই মেয়ে। জীবনের শুরুতে তিনি তার সহায়-সম্পদ ছেলের নামে লিখে দেন। অর্থাৎ ছেলেকে দিয়ে দেন। তিনি মৃত্যুবরণ করার পর সম্পদের বণ্টন শরীয়তের দৃষ্টিতে কীভাবে হবে তার জন্য অপেক্ষা না করে নিজেই এ কাজটি করেন। স্ত্রী, মেয়েসহ অন্য কাউকে কিছু লিখে দেননি। কিছুদিন পর যুবক বয়সে অবিবাহিত ছেলের মৃত্যু হয়। তার পরিকল্পনা নষ্ট হয়ে যায়। এরপর স্ত্রীসহ তার থাকে দুই মেয়ে। তিনি দুই মেয়ের নামে তার সমুদয় সম্পত্তি লিখে দেন। এখানেও তিনি তার মৃত্যুর পর সম্ভাব্য অন্যসব ওয়ারিসকে বঞ্চিত করে শুধু মেয়েদের নামে সম্পদ লিখে দেন। হয়ত তার মনের মধ্যে আশংকা ছিল যে তিনি মারা গেলে মেয়েরা তার সম্পদের দুই তৃতীয়াংশ পেলেও কিছু সম্পদের ওয়ারিস হয়ে যেতে পারে তার ভাইয়েরা। তিনি এটা রুখতে চেয়েছেন বলেই মেয়েদের নামে সব সম্পদ লিখে দিয়েছেন।

তিনি ছিলেন ভাইদের বড়। এর কিছুদিন পর তিনি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার চিকিৎসার জন্য টাকা-পয়সার টান পড়ে যায়। মেয়েদেরকে দেয়া সম্পদ তো এখন আর তার হাতে নেই। তিনি নিজের চিকিৎসা চালাতে পারেন না। মেয়েরাও পিতার চিকিৎসার জন্য অর্থ খরচে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তারা পিতার দেয়া অর্থ থেকে কোনোরকম সহযোগিতা পিতাকে করতে সম্মত হয় না। এমনকি পিতার চরম অসুস্থতাকালে ন্যূনতম ভদ্রতা ও সৌজন্যমূলক খোঁজখবরও তারা রাখতে অস্বীকার করে। ফলে সেই বৃদ্ধ হাজ্বী সাহেবকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা করানোর দায়িত্ব নেন তার ছোট ভাইয়েরাই। যাদেরকে তিনি ওয়ারিস হিসেবে বঞ্চিত করার জন্য মেয়েদের নামে সমুদয় সম্পদ লিখে দিয়েছেন। ভাইয়েরাই তাকে বারবার দেশ-বিদেশের হাসপাতালে ভর্তি করছেন এবং খোঁজখবর নিচ্ছেন। এখনও তিনি জীবিত আছেন। চিকিৎসা চলছে। কিন্তু অর্থকড়ির টানাটানির মধ্যে তার দিন কাটছে।

ঘটনা দুই : বুশরা খাতুন (ছদ্মনাম)। বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। কর্মজীবী নারী। মধ্যবিত্তের জীবন। আয়ের কিছু অংশ তাকে প্রায় প্রতিমাসেই বাবার কাছে পাঠাতে হয়। বাড়িতে বাবা-মা থাকেন ছেলের সঙ্গে। কিন্তু পিতা-মাতার দরকারি খরচ ছেলে তাদের দেন না। এদিকে বাবা তার স্থাবর সম্পত্তির প্রায় সবটুকুই কিছুদিন আগে ছেলেসন্তানের নামে লিখে দিয়েছেন। তার ইচ্ছা, মৃত্যুর পর ছেলেই যেন তার সমুদয় সম্পত্তির মালিক হয়ে যায়। কারণ, তার ধারণা ছিল, জীবনের শেষ পর্যায়ে ছেলের সেবা ও সাহায্যেই তার জীবন চলবে। তাই মেয়েসন্তানদের বঞ্চিত করেই তিনি সহায়-সম্পদের মালিক বানিয়ে দিয়েছেন ছেলেকে। এখন সেই ছেলেই তার পেছনে অর্থ খরচ করতে রাজি নয়। ছোটখাটো প্রয়োজন, চিকিৎসা-পথ্য, কোনো দরকারি জিনিসপত্রের জোগান কিংবা নগদ টাকার জন্য পিতাকে এখন কন্যা সন্তানেরই দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। মীরাস থেকে বঞ্চিত মেয়েই নিজের সঞ্চয় ও উপার্জন থেকে প্রতি মাসে পিতাকে টাকা পাঠাচ্ছেন। গ্রামে বসে পিতা মাস শেষে সেই টাকা হাতে পেয়েই প্রয়োজন পুরা করছেন।

ঘটনা তিন : প্রৌঢ় গিয়াসুদ্দীন (ছদ্মনাম)। ঢাকায় থাকেন। ঢাকায় বাড়ির মালিক। পরিণত বয়সে স্ত্রীর নামে নিজের বাড়িটি লিখে দিয়েছেন। স্ত্রীর প্রতি অধিক ভালোবাসার কারণে অন্য ওয়ারিসদের (সন্তানদের) না দিয়ে স্ত্রীকে বাড়িটি লিখে দিয়েছেন। তার মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছেলে ডাক্তারি পড়াশোনা শেষ করেছে। কিন্তু এরই মধ্যে ঘটে গেছে উল্টো ঘটনা। স্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বামী তালাক দিয়েছে বলে দাবি করে বিচ্ছেদের চেষ্টা করা হচ্ছে। স্বামী বেচারা পেরেশান। সে তার যুবক ছেলেকে স্বাক্ষী হিসেবে এনে হাজির করে বলছে, তালাক হওয়ার মতো কিছুই তিনি বলেননি এবং করেনওনি। তার স্ত্রীর নাকি মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। ওই লোকের ছেলেও একই রকম কথা বলছে। অর্থাৎ যে স্ত্রীর নামে তিনি বাড়ি লিখে দিয়েছেন, সেই স্ত্রীই এবার তার সংসার ভেঙ্গে ফেলতে উদ্যোগ নিয়েছেন।

ঘটনা চার : পশ্চিমা সমাজে বাস করেন এক বাংলাদেশী মুসলিম দম্পতি। সেখানে দম্পতির স্ত্রীর বিচরণ অত্যন্ত অবাধ। তার দিনরাত, চলাফেরা ও বন্ধু-বান্ধবের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। কোনো জবাবদিহিতা ও কৈফিয়ত নেওয়ারও সুযোগ নেই। স্বামী বেচারা যে স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করবেন সেই উপায়ও নেই। কারণ ওই দেশের আইন হচ্ছে, স্বামী স্ত্রীকে ডিভোর্স দিলে তার সমুদয় সম্পত্তির অর্ধেক স্ত্রীকে দিয়ে দিতে হবে। এটা বাধ্যতামূলক আইন।

শোনা গেছে, কোনো কোনো পরিবারে এখন উল্টো ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। সেখানে কোনো ছুতো কিংবা ছিদ্র ধরেই স্ত্রীর উদ্যোগে ডিভোর্সের মামলা করা হচ্ছে। এবং এভাবেই সংসার ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। সংসার ভাঙ্গার ফল হিসেবে ডিভোর্সপ্রাপ্ত স্ত্রী একসঙ্গে স্বামীর অর্জিত সম্পত্তির অর্ধেকের মালিক হয়ে যাচ্ছে। পরে সে স্বাধীন জীবন যাপন করছে। অথবা অন্য কোনো পছন্দের মানুষের সঙ্গে গাঁটছাড়া বাঁধছে।

 দুই।

এখানে চারটি ঘটনা উল্লেখ করা হল। এগুলো সবই ইফরাত-তাফরীত কিংবা শরীয়তের মীরাসনীতি অনুসরণের পরিবর্তে বাড়াবাড়ি-ছাড়াছাড়ির পন্থা অনুসরণের উদাহরণ। আর এ কারণেই বিভিন্ন বিশৃংখলা ও বিপর্যয়ের পথ তৈরি হয়েছে। মীরাসের ব্যাপারে শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক জোরালো ও দৃঢ়। অনেক বিশ্লেষিত ও সুষম। কুরআনে কারীমে কোনো বিধি বিধানের আলোচনা এলে সাধারণত দেখা যায়, সেখানে কিছু জরুরি মূলনীতির উল্লেখ থাকে। তাফসীল বা বিশ্লেষণ থাকে না। কিন্তু ফারায়েযের বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে কুরআনের বর্ণনাভঙ্গি অন্যরকম। সেখানে শুধু ফারায়েযের মূলনীতি কিংবা ইজমালী মাসআলা উল্লেখ করে সমাপ্ত করা হয়নি, বরং খুঁটিনাটি প্রতিটি প্রসঙ্গসহ অত্যন্ত বিশ্লেষণের সঙ্গে ফারায়েযের মাসআলা বর্ণনা করা হয়েছে। প্রশ্ন হতে পারে, এর পেছনে কী হেকমত রয়েছে? এর উত্তরে যে কথাটি বলা যায় তা হচ্ছে, একটি পরিবারে সাধারণত যেসকল বিষয়ে দ্বন্দ-কলহ সৃষ্টি হয় অনেক ক্ষেত্রেই তার মূলে থাকে ধন-সম্পদ; পিতা-মাতা কর্তৃক সন্তানদেরকে সম্পদ প্রদানে বৈষম্য অথবা উত্তরাধিকার বণ্টনে অনিয়ম। এগুলো ঝগড়া-বিবাদ ও অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এজন্যই মীরাসের আলোচনায় বিশ্লেষণের সঙ্গে অনেকগুলো আয়াত বর্ণিত হয়েছে। অন্য বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে সাধারণতঃ এমনটি দেখা যায় না।

পবিত্র কুরআনের সূরা নিসায় মীরাসের বিধি-বিধানের আয়াতগুলো বর্ণনার মাঝখানে একটি আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন,

اٰبَآؤُكُمْ وَ اَبْنَآؤُكُمْ لَا تَدْرُوْنَ اَیُّهُمْ اَقْرَبُ لَكُمْ نَفْعًا  فَرِیْضَةً مِّنَ اللهِ   اِنَّ اللهَ كَانَ عَلِیْمًا حَكِیْمًا.

তোমাদের পিতা ও সন্তানদের মধ্যে তোমাদের জন্য কে বেশি উপকারী তা তোমরা অবগত নও। নিশ্চয়ই এটা আল্লাহর বিধান; আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। -সূরা নিসা (৪) : ১১

সম্পদ থাকলে মানুষ চিন্তা করে, কে তার উপকারে বেশি আসবে? কখনো ভাবে, ছেলে। কখনো ভাবে, মেয়ে। কখনো ভাবে, তার স্ত্রী তার বেশি উপকার করবে। কখনো অন্য কারো ব্যাপারে চিন্তা করে। পরবর্তীতে এই চিন্তার ভিত্তিতেই সে তার সম্পদ বণ্টন করার চেষ্টা করে। তার এসব চিন্তাই মূলত মীরাসনীতির বিপরীত। আল্লাহ তাআলা এসব চিন্তা রদ করেছেন এই আয়াতে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, কে উপকারে আসবে সেটা তুমি জানো না। তুমি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নও। মীরাস ওই দৃষ্টিকোণ থেকে ধার্য হয়নি। আল্লাহ তাআলা তাঁর হেকমত ও প্রজ্ঞা দিয়ে এক্ষেত্রে যেভাবে উপযোগী মনে করেছেন সেভাবে সম্পদ স্থানান্তরের বিধান দান করেছেন। কে কার কতটুকু উপকারে আসবে- এই চিন্তার উপরে মীরাসের ভিত্তি রাখা হয়নি। মূলত এই আয়াতের মর্মের প্রতি যদি সব মুসলমান মনোযোগ দিতেন তাহলে মীরাসের ক্ষেত্রে নিজেদের তৈরি করা প্রান্তিকতা ও বাড়াবাড়ি থেকে অনেকেই বেঁচে যেতেন।

মীরাসের ক্ষেত্রে যেসকল শরীয়ত- বিরোধী প্রান্তিকতা ও বাড়াবাড়ি করা হয় তার ইহকালীন ফলাফলও ভালো হয় না। এসব প্রান্তিকতা নানা ধরনের বিপর্যয় ও বিশৃংখলা নিয়ে আসে। উপরে বর্ণিত ঘটনাগুলো থেকেও আমরা কিছু উপলব্ধি করেছি। বলে রাখা ভালো, উপরের ঘটনার সবকটিই বাস্তব। প্রত্যক্ষভাবে এসব ঘটনা জানা ও শোনার অভিজ্ঞতা হয়েছে। এখানে শুধু ঘটনার সম্পৃক্ত আসল নাম বদলে দিয়ে ছদ্মনাম দেওয়া হয়েছে। এটা করা হয়েছে তাদের গোপনীয়তা রক্ষার জন্যে। ঘটনাগুলো আবার বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।

প্রথম ঘটনায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেখানে মীরাসের মূলনীতি রক্ষা করা হয়নি। বারবার সে নীতি ভঙ্গ করা হয়েছে। প্রথমে মেয়েদেরকে না দিয়ে একমাত্র ছেলেকে সম্পদ লিখে দেওয়া হয়েছিল। আকস্মিকভাবে ছেলে মারা যাওয়ার পর সব সম্পদ লিখে দেওয়া হয় দুই মেয়েকে। তার নিজের বাড়ি, ব্যবসা, কোটি কোটি টাকার আরো কয়েকটি বাড়ি, মার্কেট-দোকান সব মেয়েদেরকে দিয়ে দিয়েছেন। যিনি এটি করেছেন তিনি করেছেন এই কারণে যে, মেয়েরা যেন তার মৃত্যুর পর তার সব সম্পদ পেয়ে যায়। শরীয়তের দৃষ্টিতে মেয়েদের পাওয়ার কথা ছিল তিনের দুই ভাগ। অপরদিকে তার সম্পদের কিছু অংশের মধ্যে তার ভাইদেরও হক সৃষ্টি হতো। কিন্তু তিনি হয়ত চাননি তার সম্পদ থেকে ভাইয়েরা সামান্য কিছুও পাক। এ উদ্দেশ্যেই তিনি সব সম্পদ দুই মেয়েকে লিখে দিয়েছেন। অথচ কিসমতের ব্যাপার হলো, যাদেরকে তিনি কোনো সম্পদ দিতে চাননি সেই ভাইয়েরাই তার অসহায়ত্বের মুহূর্তে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বৃদ্ধ বয়সে এখন তিনি অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে। তার পেছনে চিকিৎসাসহ বিভিন্ন খরচের প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ মেয়েদের কোনো খবর নেই। তারা কোনো খরচও দিচ্ছে না, দেখতেও যাচ্ছে না। ভাইয়েরাই তাকে উল্টো সহযোগিতা করছে এ দুঃসময়ে। তার বর্ণনামতে, একবার তিনি লন্ডনে এক মেয়েকে দেখতে গিয়েছিলেন। মেয়ে বা মেয়ে-জামাই তাকে রিসিভ করার জন্য বিমানবন্দরেও আসেনি। তিনি কিছুই চিনতেন না সেখানকার। শেষ পর্যন্ত পুলিশের হস্তক্ষেপে মেয়ে এসে তাকে বাসায় নিয়ে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু যে কয়দিন সেখানে ছিলেন খাবার-দাবারসহ নানারকম কষ্টে তার দিন পার হয়েছে। একদা বিত্তবান এই বৃদ্ধ তার সব সম্পদ মেয়েদের নামে লিখে দিয়ে এখন পুরোপুরি অভাবী জীবন যাপন করছেন। এ লেখা যখন ছাপার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল তখন খবর এসেছে, ভদ্রলোক হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন। আল্লাহ তাআলা তার মাগফিরাত করুন।

দ্বিতীয় ঘটনায় আমরা দেখতে পাচ্ছি,  বাবা তার সহায়-সম্পদ ছেলের নামে লিখে দিয়েছেন। মেয়েকে কিছুই দেননি। অথচ এখন সেই বাবার নানা রকম আর্থিক প্রয়োজনে তিনি নির্ভর করছেন মেয়ের উপরে। মেয়েকে ফোন করছেন। মেয়ে টাকা পাঠাচ্ছে তাকে। যেই ছেলের নামে সহায়-সম্পদ লিখে দিয়েছেন সে তার কোনো প্রয়োজন পূরণে এগিয়ে আসছে না। সমাজে এর উল্টোটাও কেউ কেউ করছেন। ছেলেকে না দিয়ে মেয়েকে লিখে দিচ্ছেন সবকিছু। উদ্দেশ্য একই। তার ধারণা, মেয়ে তার খোঁজ-খবর বেশি রাখবে। ছেলের উপর তিনি আস্থা রাখতে পারেননি। আসলে এর উভয়টিই প্রান্তিকতা।

তৃতীয় ঘটানর দিকে যদি আমরা নজর দিই তাহলে দেখব, চাকুরীজীবী স্বামী তার স্ত্রীর নামে একমাত্র বাড়িটি লিখে দিয়েছেন। অথচ তার সন্তান রয়েছে। আরো ওয়ারিস রয়েছে। কিন্তু স্ত্রীর প্রতি অধিক ভালোবাসা ও নির্ভরতার কারণে অথবা স্ত্রীর পক্ষ থেকে তাকে প্ররোচিত করার কারণে কিংবা স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীর অধিক নিরাপত্তা চিন্তার কারণে তিনি স্ত্রীর নামে বাড়ি লিখে দিয়েছেন। মূলত এভাবেই তিনি মীরাসের নীতি লংঘন করেছেন। অথচ এখন সেই স্ত্রী-ই তাকে  ছেড়ে যাওয়ার নানা বাহানা ও উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছে। এখন স্বামী বেচারা অস্থির। শুধু তালাক ফেরানোই তো তার লক্ষ্য নয়। এখন তিনি দেখছেন স্ত্রীর দাবিকৃত তালাক কার্যকর হলে তিনি এবং তার সন্তানরা বাড়িহারা হয়ে যাবেন। এখন দুশ্চিন্তার বোঝা অনেক বড়। এ সবকিছুই তো শরীয়তের মীরাসনীতি লংঘন করার ফল।

চতুর্থ ঘটনা। পশ্চিমা আইনে ডিভোর্সের ফলে স্ত্রী স্বামীর অর্ধেক সম্পদের মালিক হয়ে যায়। এ আইন নিঃসন্দেহে ইসলামের সম্পদ বণ্টন ও মালিকানা নীতির পরিপন্থী। কিন্তু তারা এই আইনটি এই লক্ষ্য নিয়েই করেছিল যে, তাদের এ আইনের ফলে দাম্পত্য জীবন মজবুত হবে। স্বামীরা স্ত্রীদের তালাক দেবে না। কিন্তু সময় তাদের এই চিন্তাকে উল্টো করে দিয়েছে। এ আইন করে তালাকের হার সেখানে কমানো যায়নি। এ আইনের ফলে তালাকের হার বরং বেড়ে চলেছে। এখন তালাকের ঘটনা ঘটাচ্ছে নারীরা উদ্যোগী হয়ে। তারা পারিবারিক আদালতে মামলা ঠুকছে। এর বিষময় ফল সেখানকার মুসলিম পরিবারগুলোতেও পড়ছে। পর্দা না থাকা, খোলামেলা চলাফেরা ইত্যাদি নীতিবিচ্যুত আচরণে যখনই কোনো বাধা আসছে, নারীরা মনে চাইলেই পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে স্বামীকে ডিভোর্স দিচ্ছে। আর ডিভোর্স কার্যকর হলেই স্বামীর কষ্টার্জিত যাবতীয় সম্পদের অর্ধেক ভাগ নিয়ে চলে যাচ্ছে বিচ্ছেদপ্রাপ্ত। কখনো অন্য কোনো পুরুষের ঘরে গিয়ে উঠছে। কখনো স্বামী-সংসারহীন স্বাধীন জীবন-যাপনের পথ বেছে নিচ্ছে। তার তো এখন আর আর্থিক চিন্তা নেই। এক ডিভোর্সেই কোটি টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছে। এভাবে এক ভিন্ন রকম স্বেচ্ছাচারিতার জগৎ তৈরি হচ্ছে অনেক নারীর জীবনে। এখানেও ইসলামের সম্পদ বণ্টননীতির প্রতি উপেক্ষা বিপর্যয়ের পথ তৈরি করেছে।

গত বছরের ঘটনা। বিশ্বের অন্যতম সেরা ধনীর স্ত্রীর বিচ্ছেদের মামলার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। বিচ্ছেদের দাবিতে স্ত্রীর ঠুকে দেওয়া মামলা দীর্ঘদিন চলছিল। বিলিয়নার স্বামী বহু চেষ্টা করেছে বিচ্ছেদ ঠেকাতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আদালতের রায়ে বিচ্ছেদ হয়েছে। আর অনিবার্যভাবেই সেই বিলিয়নারের অর্ধেক সম্পদের মালিকানা পেয়ে গেছে ডিভোর্সী স্ত্রী। হাজার হাজার কোটি ডলারের মালিক হয়েও বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্বামীর তখন কিছুই করার ছিলো না।

এ কয়েকটি উদাহরণ আমাদের সামনে। এ ধরনের আরো অসংখ্য ঘটনা বর্তমানে ঘটে চলেছে। এতে প্রমাণিত হলো, আল্লাহপ্রদত্ত বিধি-বিধানের পরিবর্তে অন্য কোনো নীতি অনুসরণ করলে সুফল আসে না। আরো প্রমাণিত হলো, আল্লাহর বিধান লংঘন করে মানুষের বিবেচনা সামনে নিয়ে কোনো আইন প্রণয়ন করলেও তার ফল কল্যাণকর হয় না। সুতরাং সম্পদ বণ্টন ও উত্তরাধিকার নীতির ক্ষেত্রে আল্লাহপ্রদত্ত বিধান মেনে চলাই মানবজাতির জন্য সর্বক্ষেত্রে কল্যাণ বয়ে আনবে।

 

তিন।

নিজের সম্পদে মনগড়া বণ্টন করে মানুষ নানা রকম ক্ষতির সম্মুখিন হয়Ñ এটা আমরা দেখলাম। মূলত এ ধরনের মনগড়া শরীয়তবিরোধী সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে প্রধানত কয়েক ধরনের মানসিকতা কাজ করে থাকে। কেউ কেউ সম্পদ আটকে রাখতে চায়। যাকাত দিতে চায় না। গরিবের হক দিতে চায় না। অন্য কেউ তার সম্পদের ভাগ পেয়ে যাক এটাও কামনা করে না। এটা চরম বাড়াবাড়ি। আল্লাহ তাআলা কুরআন শরীফে ইরশাদ করেছেন-

وَ فِیْۤ اَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِّلسَّآىِٕلِ وَ الْمَحْرُوْمِ

এবং তাদের ধন-সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতের হক। -সূরা যারিয়াত (৫১) : ১৯

সুতরাং কাউকে কোনো সম্পদ না দেওয়ার ইচ্ছা- এটা ইসলামসম্মত মানসিকতা নয়। এটা পরিত্যাজ্য।

নিজের সম্পদে মনগড়া বণ্টনের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় মানসিকতাটি হচ্ছে, এর উল্টো। পুরো সম্পদ সে কোনো আত্মীয়, স্ত্রী অথবা ছেলে অথবা মেয়ে- এমন কাউকে দিয়ে দিতে চাওয়া। আর এভাবে অন্যদেরকে বঞ্চিত করতে চায়। এটাও শরীয়তসম্মত মানসিকতা নয়। এর কয়েকটি উদাহরণই আমরা লেখার শুরুতে পেয়েছি। এ বিষয়ে এখানে আর দীর্ঘ আলোচনা প্রাসঙ্গিক নয়।

তৃতীয় আরেকটি মানসিকতা হলো, সব সম্পদ ওয়ারিসদের কাউকে না দিয়ে অন্য কোথাও দান করে দেওয়া। অনেকেই বৃদ্ধ বয়সে এসে যখন দেখেন মৃত্যু খুব কাছাকাছি তখন মনে করেন সন্তানের জন্য সম্পদ রেখে কী লাভ? ফলে পুরা সম্পদ দান করে দেন। এটাও শরীয়তের ভারসাম্যপূর্ণ উত্তরাধিকার ও বণ্টননীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল নয়। দেখুন, পবিত্র কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী কারুনকে মূসা আ. নসীহত করে বলেছেন-

وَ لَا تَنْسَ نَصِیْبَكَ مِنَ الدُّنْیَا وَ اَحْسِنْ كَمَاۤ اَحْسَنَ اللهُ اِلَیْكَ.

এবং দুনিয়া থেকে তোমার অংশ ভুলো না; তুমি অনুগ্রহ কর যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। -সূরা কাসাস (২৮) : ৭৭

অর্থাৎ তোমার দুনিয়ায় চলার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু তুমি হাতে রাখ। বাকিটুকু দান কর। আবেগ নিয়ে পুরো সম্পদ দিয়ে দেওয়া, নিজের জন্য, নিজের পরিবারের জন্য কোনো সম্পদ না রাখা- এটা শরীয়তের দৃষ্টিতে কোনো পছন্দনীয় কাজ নয়।

অপর এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ عَامِرِ بْنِ سَعْدٍ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: جَاءَنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَعُودُنِي مِنْ وَجَعٍ اشْتَدَّ بِي، زَمَنَ حَجَّةِ الوَدَاعِ، فَقُلْتُ: بَلَغَ بِي مَا تَرَى، وَأَنَا ذُو مَالٍ، وَلاَ يَرِثُنِي إِلَّا ابْنَةٌ لِي، أَفَأَتَصَدَّقُ بِثُلُثَيْ مَالِي؟ قَالَ: لاَ قُلْتُ: بِالشَّطْرِ؟ قَالَ: لاَ قُلْتُ: الثُّلُثُ؟ قَالَ: الثُّلُثُ كَثِيرٌ، أَنْ تَدَعَ وَرَثَتَكَ أَغْنِيَاءَ خَيْرٌ مِنْ أَنْ تَذَرَهُمْ عَالَةً يَتَكَفَّفُونَ النَّاسَ، وَلَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً تَبْتَغِي بِهَا وَجْهَ اللَّهِ إِلَّا أُجِرْتَ عَلَيْهَا، حَتَّى مَا تَجْعَلُ فِي فِي امْرَأَتِكَ

হযরত আমের ইবনে সাদ তাঁর বাবা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, বিদায় হজ্বের সময় আমার এক কঠিন পীড়ায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে দেখতে আসেন। তখন আমি বললাম, আমার মুমূর্ষ অবস্থা তো আপনি দেখছেন, এদিকে আমার অনেক সম্পদ আছে। আর আমার একমাত্র ওয়ারিস আমার মেয়েই। আমি কি আমার সম্পদের দুই তৃতীয়াংশ (গরীবদেরকে) সদকা করে দেবো? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না। আমি বললাম, তাহলে অর্ধেক? নবীজী বললেন, না। এক তৃতীয়াংশ? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এক তৃতীয়াংশ এবং এক তৃতীয়াংশও অনেক। নিশ্চয়ই তুমি যদি তোমার ওয়ারিসদেরকে স্বচ্ছল রেখে যাও

তাহলে সেটা উত্তম হবে তাদেরকে এমন দরিদ্র রেখে যাওয়ার চেয়ে যে, তারা মানুষের কাছে হাত পাতবে। তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্যেশ্যে যা ব্যয় করবে তার উত্তম প্রতিদান পাবে। এমনকি স্বীয় স্ত্রীর মুখে তুলে দেওয়া লোকমার বিনিময়েও। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১২০

এ হাদীসে দেখা যাচ্ছে, এক তৃতীয়াংশ দান করার বিষয়টিকেও রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। অর্থাৎ দান করলে এক তৃতীয়াংশ বা তার চেয়ে কম করা যেতে পারে। এখান থেকে ফকীহগণ বলেন, অসিয়ত সমুদয় সম্পদের এক তৃতীয়াংশের কিছু কম হতে হবে। এ হাদীসের শেষাংশে একটি বাক্য রয়েছে যেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়েছে, নিশ্চয়ই তুমি যদি তোমার ওয়ারিসদেরকে স্বচ্ছল রেখে যাও তাহলে সেটা উত্তম হবে তাদেরকে এমন দরিদ্র রেখে যাওয়ার চেয়ে যে, তারা মানুষের কাছে হাত পাতবে। এ বাক্যের মর্মার্থ হল, উত্তরাধিকারীদেরকে রিক্তহস্ত রেখে, পুরোপুরি বঞ্চিত রেখে সব সম্পদ দান করে দেওয়া উত্তম নয়, উচিত নয়। এ হাদীস থেকে এ কথাও স্পষ্ট যে, ইসলামে বৈরাগ্য নেই। ধন-সম্পদ সব দান করে দিলাম- এটা ঠিক নয়। এই হাদীসের ব্যাখ্যা অন্য বহু হাদীসেও পাওয়া যায়। নিজের পরিবারের জন্য খরচ করাকেও হাদীস শরীফে সদাকা হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এধরনের অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে, حَتَّى اللُّقْمَةُ تَجْعَلُهَا فِي فِي امْرَأَتِكَ

এমনকি সেই খাবারের লোকমা যা তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে তুলে দিচ্ছ (সেটিও সদাকা) -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬২৮

এই হাদীসে আরেকটি দিকে ইশারা রয়েছে। সব সহায়-সম্পদ যে কেবল পরিবার-পরিজনের জন্য রেখে যেতে হবেÑ এমনও নয়। বরং কিছু সম্পদ দ্বীনের পথে অথবা আর্তপীড়িত মানুষদের জন্য অসিয়্যত কিংবা ওয়াক্ফ করে যাবে। ইনসাফপূর্ণ শোষণমুক্ত মুসলিম সমাজ বিনির্মাণে একসময় ওয়াকফ ও অসিয়্যত বড় ভূমিকা রেখেছে। সঠিক দ্বীনী চিন্তা-চেতনা বিলুপ্ত হওয়ার কারণে এখন ব্যাপকভাবে ওয়াক্ফ ও অসিয়্যতের ধারা সেভাবে রক্ষিত হয় না। অথচ শোষণমুক্ত ইসলামী অর্থ-ব্যবস্থার জন্য শুধু যাকাত নয়, ওয়াক্ফ ও অসিয়্যতের ভূমিকাও অনেক বড়।

মানুষ নিজের সম্পদের বণ্টনে শরীয়তের বিপরীত চতুর্থ আরেকটি উল্টো নীতি গ্রহণ করে থাকে। সেটি হচ্ছে, কোনো সন্তানকে বেশি সম্পদ দান করে অন্য সন্তানকে সে পরিমাণ দান না করা। হাদীসের বর্ণনায় এটাকেও নিষেধ করা হয়েছে। হযরত নোমান ইবনে বাশীর রা.-এর এ বিষয়ক হাদীসটি বিখ্যাত।

حَدَّثَنِي النُّعْمَانُ بْنُ بَشِيرٍ، أَنَّ أُمَّهُ بِنْتَ رَوَاحَةَ، سَأَلَتْ أَبَاهُ بَعْضَ الْمَوْهِبَةِ مِنْ مَالِهِ لِابْنِهَا، فَالْتَوَى بِهَا سَنَةً ثُمَّ بَدَا لَهُ، فَقَالَتْ: لَا أَرْضَى حَتَّى تُشْهِدَ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى مَا وَهَبْتَ لِابْنِي، فَأَخَذَ أَبِي بِيَدِي وَأَنَا يَوْمَئِذٍ غُلَامٌ، فَأَتَى رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ، إِنَّ أُمَّ هَذَا بِنْتَ رَوَاحَةَ أَعْجَبَهَا أَنْ أُشْهِدَكَ عَلَى الَّذِي وَهَبْتُ لِابْنِهَا، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَا بَشِيرُ ‍ أَلَكَ وَلَدٌ سِوَى هَذَا؟ قَالَ: نَعَمْ، فَقَالَ: أَكُلَّهُمْ وَهَبْتَ لَهُ مِثْلَ هَذَا؟ قَالَ: لَا، قَالَ: فَلَا تُشْهِدْنِي إِذًا، فَإِنِّي لَا أَشْهَدُ عَلَى جَوْرٍ.

নোমান ইবনে বশীর রা. বর্ণনা করেন, তার মা নিজ সন্তানের জন্য তার বাবার কাছে কিছু সম্পদের আবেদন করলেন। এ নিয়ে এক বছর পর্যন্ত তার বাবা দ্বিধাদন্দে থাকেন। তারপর দেয়ার বিষয়ে সম্মত হলেন। তখন তার মা বললো, আমার সন্তানকে দেয়া সম্পদের উপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাক্ষী রাখতে চাই। তখন আমার বাবা আমার হাত ধরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে গেলেন, আমি তখন ছোট্ট বালক। বাবা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই ছেলের মা তাকে দেয়া সম্পদের জন্য আপনাকে সাক্ষী রাখতে চাচ্ছে। রাসূলুল্লাহ তখন বললেন, হে বশীর! এ ছাড়াও কি তোমার আরো সন্তান আছে? তিনি বললেন, হাঁ, নবীজী বললেন, তাদের সবাইকে কি তুমি এ পরিমাণ সম্পদ দান করেছো? তিনি বললেন, না। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম ইরশাদ করলেন, তাহলে এ ক্ষেত্রে আমাকে সাক্ষী রেখো না। আমি এমন যুলুমের সাক্ষী হতে চাই না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১২৪৩

এ হাদীস থেকে সূক্ষ্ম একটি বিষয় বুঝে আসে যে, সে যুগে নারীরাও ছিলেন ফকীহ। যে কারণে হযরত বশীরের স্ত্রী নোমান ইবনে বশীরের মা তার ছেলেকে সম্পদ দানের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাক্ষী বানানোর শর্ত করেছিলেন। অর্থাৎ বিষয়টি উচিত কি অনুচিত- এ বিষয়ে রাসূলে কারীমের মতামত অপরিহার্য বলে তিনি মনে করেছিলেন। এই হাদীস থেকেই ফুকাহায়ে কেরাম বলেছেন, সন্তানদের মধ্যে দান করতে চাইলে সমতা বজায় রাখতে হবে। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, দারুল ইফতাগুলোতে কিংবা আলেমদের কাছে এ বিষয়ক অসংখ্য প্রশ্ন আসে। পিতা-মাতা জীবদ্দশায় কোনো এক সন্তানকে বেশি সম্পদ দিয়ে গেছেন। এসব পরিস্থিতিতে পিতা-মাতার মৃত্যুর পর অন্য সন্তানরা প্রশ্ন নিয়ে আসে যে, পিতা-মাতা এটা (এক সন্তানকে বেশি দেওয়া) ঠিক করেছেন কি না? এখন তাদের গুনাহ হবে কি না? অন্য সন্তানদের মনের মধ্যে এক ধরনের অসন্তুষ্টি লক্ষ্য করা যায়। এসব ক্ষেত্রে আমরা অসন্তুষ্ট কোনো কোনো সন্তানকে নসীহত করি, পরামর্শ দিয়ে থাকি- মরহুম পিতা-মাতার জন্য দুআ করুন। মনে কষ্ট রেখে কী ফায়েদা! অবশ্য কোনো কোনো সন্তান মাসআলা জিজ্ঞাসা করার পর নিজ থেকেই বলে, মাফ করে দিলাম। আবার এমনও হয়েছে, যে সন্তানকে বেশি দান করা হয়েছে, সে এসে জানতে চেয়েছেÑ অতিরিক্তটুকু অন্য ভাই-বোনদের মাঝে বণ্টন করে দিলে কোনো সমস্যা নেই তো! আসলে বিনা ওযরে এভাবে কোনো সন্তানকে কম দেওয়া, কোনো সন্তানকে বেশি দেওয়া শরীয়তসম্মত নয়। অথচ আবেগ এবং অজ্ঞতার কারণে কোনো কোনো পিতা-মাতা এই ভুল কাজটি করে থাকেন।

মীরাসের ও সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে এখানে শুধু ঐসকল ভুল-ভ্রান্তিগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে যেগুলো সম্পদের মালিক নিজ জীবদ্দশায় করে থাকে। কিন্তু সম্পদ-মালিকের মৃত্যুর পর তার মীরাস বণ্টনের ক্ষেত্রে শরয়ী হুকুম লংঘন করার প্রবণতাও বর্তমান সমাজে ব্যাপক। মেয়ে, বোন, ফুফুদের অংশ তাদের হাতে বুঝিয়ে দিতে গড়িমসি করার ঘটনা তো অনেক শোনা যায়। এ সবকিছুই সংশোধনযোগ্য।

ইসলামের মীরাসের বিধি-বিধান এবং অসিয়্যত ও ওয়াক্ফের বিধি-বিধান সম্পর্কে সব পর্যায়ের মুসলমানদের জ্ঞান অর্জন করা উচিত। এবং এসব বিধান ও মাসায়েলের ব্যাপক চর্চা হওয়া উচিত। যারা ইসলামের খেদমত করেন, যারা খতীব, মুবাল্লিগ, মুআল্লিমের দায়িত্ব পালন করেন- তাদের দায়িত্ব এসব বিষয়ের মাসআলা মুসলিম জনসাধারণের কাছে তুলে ধরা। মুসলমানদের মনে রাখার বিষয়, মীরাস, ওয়াক্ফ ও অসিয়্যতের বিধি-বিধান তাদের একান্তই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। এটি মুসলমানদের ইমতিয়ায- এক্সক্লুসিভ সৌন্দর্য। সারা দুনিয়ায় উত্তরাধিকার ও উইল নিয়ে বহু উল্টাপাল্টা ও ভারসাম্যহীন বিধি-বিধান চালু ছিল। ইসলাম এসে এ বিষয়ে ভারসাম্যপূর্ণ ও সুষম বিধান দিয়েছে। সেই বিধান সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা এবং সে অনুযায়ী চর্চা করা প্রত্যেক মুসলমানেরই কর্তব্য। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে তাওফীক দান করুন। আমীন 

 

 

 

advertisement