যিলহজ্ব ১৪৩৭   ||   সেপ্টেম্বর ২০১৬

হাদীসে নববীর পাঠ গ্রহণের উসূল ও আদাব

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

[ওয়াজঘাট, পাটুয়াটুলি লেন জামে মসজিদে তালিবুল ইলমদের উদ্দেশে প্রদত্ত বয়ান। তারিখ : ১-১১-১৪৩২ হি. মোতাবেক ৩-৯-২০১১ ঈ.]

الحمد لله نحمده ونستعينه ونستغفر.. .

আলহামদু লিল্লাহ, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের শোকর। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে খালেছ ইলমী ও দ্বীনী বিষয়ে আলোচনা ও মুযাকারা করার জন্য বসার তাওফীক দিয়েছেন। তালিবে ইলম হাদীসের দরস কীভাবে গ্রহণ করবে, কী কী উসূল ও আদাবের رعايت করবে, কী কী উসূলের رعايت করা উচিত- এ বিষয়ে আজকের এ মজলিস। খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ বিষয়টা কিছুটা হলেও বিস্তৃত, এক মজলিসে সবদিক আলোচনা সম্ভব নয়। তারপরও হযরত মাওলানা আব্দুল মতিন ছাহেব দা.বা. বিষয়ের আহাম আহাম দিকগুলোর সুন্দর একটা খোলাসা আমাদের সামনে পেশ করেছেন। একটা বুনিয়াদী রাহনুমায়ী এ হেদায়াতগুলোর মধ্যে, এ খোলাসার মধ্যে আছে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ইস্তিফাদার তাওফীক দান করুন। আমীন।

আমার ইচ্ছা ছিল তাঁর আলোচনা আরো দীর্ঘ হোক, আর এ বিষয়ে আলোচনার তিনিই বেশি হকদার, কেননা তাঁর উসূলী معلومات -এর সাথে আমলী তাজরেবাও আছে, দীর্ঘদিন যাবৎ হাদীসের দরস দিয়েছেন এবং ফন্নী আন্দাযেই দরস দেয়ার চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে তিরমিযী শরীফের দরস অনেক দিন যাবৎ দিয়েছেন। তাই তার আলোচনাই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি যা বলেছেন আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তার উপর আমল করার তাওফীক দান করুন। আমি ইনশা আল্লাহ দুটি বিষয়ে কথা আরয করব। বিষয়টির দুটি দিক : এক. উসূল দুই. আদাব। হুযুরের আলোচনায় উসূলের দিকটা বেশি এসেছে এজন্য আমি শুরু করছি আদব দিয়ে।

বড় আদব হল, إخلاص تصحيح النيةআর এটা তো সব কাজেই দরকার। হাদীসের দরস আমি গ্রহণ করব সেক্ষেত্রে إخلاص تصحيح النية লাগবে সেটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আসলে আমি বলছি না, বরং আমার আসাতিযায়ে কেরামের কথা تكرار করছি আমার জন্য এবং সব সাথীদের জন্য। হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রশীদ নোমানী রাহ. বলতেন تجديد النية -এর কথা। দৈনিক সকালে তুমি তোমার নিয়তের নবায়ন কর, নিয়তের تجديد কর- হে আল্লাহ এ দিনটা আমি তোমার রেযামন্দিতে কাটাতে চাই। তোমার রেযামন্দির জন্য তোমার ওহীর ইলমের জন্য আমি এ দিনটা কাটাতে চাই, তুমি আমাকে তাওফীক দান কর। এটা ইজমালী হলো। আরো তাফসীলের সাথে কারো যেহেনে আসলে আরো ভাল। আমি দেখেছি যেদিন হুযুরের এ কথার উপর আমল করা হয় সে দিনটা অন্য দিনগুলো থেকে ভাল কাটে। দিনটা গাফলতের সাথে শুরু হওয়া উচিত নয়। গাফলত থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন أذكار শিখিয়েছেন। যেমন سيد الاستغفار অনুরূপ শোকর আদায় করার জন্য-

اللَّهُمَّ مَا أَصْبَحَ بِي مِنْ نِعْمَةٍ أَوْ بِأَحَدٍ مِنْ خَلْقِكَ، فَمِنْكَ وَحْدَكَ لَا شَرِيكَ لَكَ، فَلَكَ الْحَمْدُ وَلَكَ الشُّكْرُ.

অনুরূপ

الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَقَالَنَا يَوْمَنَا هَذَا، وَلَمْ يُهْلِكْنَا بِذُنُوبِنَا.

এগুলো তো এ জন্যই যাতে আমার দিনটা نشاط -এর সাথে, تيقظ -এর সাথে এবং استحضار -এর সাথে, আল্লাহর নিআমতের استحضار -এর সাথে এবং আল্লাহর রহমতের আশা নিয়ে শুরু হয় এবং এর আছর সারা দিনের কাজের উপর পড়ে। আমরা  تجديد النية -এর চেষ্টা করি- হে আল্লাহ তোমার ওহীর ইলমের জন্য আমি আমাকে ওয়াকফ করে দিয়েছি আমার এ দিনকেও ওয়াকফ করে দিয়েছি, আর তোমার রেযামন্দি মোতাবেক আমার এ দিনটা কাটাতে চাচ্ছি, তুমি আমাকে তাওফীক দান কর। বিশেষ করে এতদিন যা পড়েছি সেগুলো ছিল بالواسطة ইলমে ওহী আর মিশকাত ও দাওরার মধ্যে যা পড়া হয় তা بلا واسطة   সরাসরি ইলমে ওহী। সরাসরি ইলমে ওহী পড়তে এসেছি তখন তো আমার মাঝে একটা পরিবর্তন আসা দরকার। কলব, আমল ও ফিকির সব জায়গায় একটা পরিবর্তন আসা দরকার- এটা প্রথম আদব। এবং যে কোনো উসূলে হাদীসের কিতাবে آداب طالب الحديث  একটা শিরোনাম একটা فصل থাকে,  ওখানে تصحيح النية -এর কথা থাকে, থাকবেই স্বাভাবিক। আর تصحيح النية -এর সাথে বললাম تجديد النية-এর কথা।

দ্বিতীয় বিষয় হলো যা হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দা.বা. দরসে তিরমিযীর শুরুতে তাম্বীহ করেছেন এবং ইনআমুল বারীর শুরুতেও তাম্বীহ করেছেন। উর্দু শুরূহ পড়া অনেকেই পছন্দ করেন না, কিন্তু এটা এজন্য না যে শরহটা উর্দু ভাষায়; বরং এটা এজন্য যে দাওরার ছাত্রদের মাঝে থাকতে হয় তাহকীকী মেযাজ, আর উর্দু শুরূহের মধ্যে এমন তাহকীকী মেযাজের শুরূহ এবং تقرير কম এতো একটা বিষয় আর দ্বিতীয়ত : দাওরায়ে হাদীসের তালিবুল ইলমের মাঝে এতটুকু যোগ্যতা অবশ্যই থাকতে হবে বরং শরহে বেকায়া ও হেদায়ার মধ্যে তার এ ইস্তিদাদ পাকাপোক্ত হয়ে যাওয়ার কথা, যার দ্বারা সে আরবী শুরূহ মুতালাআ করতে পারে এবং আরবী র্শহ মুতালাআ করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। আরবী শরহ মুতালাআর ক্ষেত্রে তার কোনো وحشت না থাকে। কিন্তু এখন তালিবুল ইলমদের  কিতাব বুঝা ও ইবারত বুঝার যোগ্যতা এমন যে, আরবী শুরূহ থেকে ভাগে, দূরে থাকে। আরবী র্শহ থেকে দূরে থাকার জন্য  উর্দু র্শহ, এখন তো বাংলা র্শহও বের হয়ে গেছে, ওগুলোর দিকে رجوع করে। আরবী শরহ থেকে দূরে থাকার জন্য উর্দু বাংলা নোটের দিকে যাওয়া বিলকুল অপছন্দনীয়। কিন্তু যদি আরবী র্শহ থেকে দূরে থাকার জন্য না হয় বরং আপনি আরবী থেকেও বুঝতে পারেন, আরবীর সাথে الفت আছে  انس আছে, আর উর্দু ও বাংলা র্শহও এমন হয় যেখানে ইলমী فوائد আছে বা যেখানে কোনো বহসের খোলাসাকে منظم مرتب আকারে পেশ করা হয়েছে, যা বুঝতে এবং ইয়াদ করতে সুবিধা; তাহলে সহায়কগ্রন্থ হিসেবে তা দেখা যেতে পারে। বাংলায় এমন কিতাব আছে কি না তা আমার জানা নেই। অনেকে درس ترمذي পড়ে معارف السنن থেকে ভাগার জন্য- এটা ঠিক নয়। معارف السنن -এর সাথে انس বা সম্পর্ক থাকতে হবে আর দরসে তিরমিযীর মধ্যে معارف السنن -এর একটা সহজ সরল খোলাসা পেয়ে যাবে, পড়বে ইয়াদ করবে। আমরা দরসে তিরমিযী পড়ি معارف السنن থেকে فرار করার জন্য বা পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য- এ নিয়তগুলো ভাল নয়। বরং এটা মুতালাআ করতে হবে, একে তো আমি বললাম আলোচনার ملخص বা সারনির্যাস আমি পাব।  معارف السنن মুতালাআ করার পর আমি এটা মুতালাআ করব। বা এটা মুতালাআ করে معارف السنن মুতালাআ করি। এটা এজন্য যে,  একে তো হল খোলাসা নেওয়ার জন্য, আরেকটা হল কিছু কিছু জায়গায় তাঁর মেহনত আছে।

الملهم فتح تكملة -এ দেখা যায় তিনি ইমাম নববীর মুসলিমের শরহ আর فتح الباري  থেকে নিয়েছেন এজন্য সব জায়গায় নিজস্ব মেহনত করার প্রয়োজন মনে করেননি এবং তিনি যত ব্যস্ত এত ব্যস্ততার মধ্যে এটা সম্ভবও ছিল না; কিন্তু কিছু বহস তিনি লিখেছেন, যেখানে অন্য شارحين হক আদায় করেননি; আর এটা এমন বিষয় যা ছেড়ে দেয়া যায় না এবং এ বিষয়ে নতুন مواد তালিবুল ইলমদের হাতে আসা দরকার। তাকমিলাতে তিনি মেহনত করে এমন এমন فوائد  উদ্ঘাটন করেছেন দুই চারটা বা চার পাঁচটা বহস হবে, তাকমিলাতে আছে কিন্তু তার নযীর নেই। 

এর কিছু নমুনা :

এক. رجم -এর হাদীস মুতাওয়াতির কিন্তু তার প্রায় সব طريق একসাথে জমা করে হাওয়ালা দিয়ে দিয়েছেন।

দুই. ইমাম যুহরী রাহ.-এর সূত্রে বর্ণিত হাদীস, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

نحن معاشر الانبياء لا نورث، ما تركناه صدقة.

এ বিষয়ে মুসলিম শরীফে লম্বা রেওয়ায়েত আছে, তারীখের কিছু কথা যা যুহরীর থেকে منقطعا বর্ণিত, মূল ঘটনার সাথে কিছু تاريخي মুনকাতিরেওয়ায়েত مدرج হয়ে গিয়েছে। এ  إدراج-এর উপর নববী রাহ. তাম্বীহ করেননি। فتح الباري যেহেতু মুসলিমের র্শহ নয় তাই এখানেও তার উপর তাম্বীহ নেই। হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দা.বা. অনেক কিতাব ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন এবং হাদীস ও তারীখের পুরাতন কিতাবাদি ঘেটে তথ্য সংগ্রহ করে জমা করে এ বিষয়ের উপর تنبيه করেছেন।

তিন. এভাবে হযরত আলী রা. হযরত আবু বকর রা.-এর হাতে কবে বাইআত করেছেন এ বিষয়ে তারীখের কিতাবে اختلاف রয়েছে। কোনো রেওয়ায়েত ادراج-এর  সমস্যার কারণে معلولএকটি جملة মূল হাদীসে মুর্দারাজ হয়েছে হুযুর অনেক মেহনত করে এর وضاحت করে দিয়েছেন।

চার. نصاب حد السرقة ওখানে তাঁর নিজস্ব মেহনত রয়েছে, এরকম কিছু কিছু বহছ تكملة فتح الملهم  -এ আছে। এ ধরনের মেহনত দরসে তিরমিযীতে কম। কারণ এটি তাকরীর, তাসনীফ নয়, তাকরীরের মুরাত্তিব তারতীবের সময়ে নতুন মুদাররিস। তারতীবের  পর সাহিবে তাকরীর এটা নযরে ছানী করেননি। আবার তাকরীর সেই দরসের যে দরসের সময়ে দরস প্রদানকারীর বয়স মাত্র ২২ বছর। তারপরও এতে কিছু فوائد আছে। ঐসব فوائد -এর জন্য আপনি এসব কিতাব মুতালাআ করেন। আর যাল্লাত এবং তাসহীফাতের সমস্যার সমাধান মাসাদেরে আসলিয়্যার মুরাজাআত করে করেন।

আমি বলতে চাচ্ছি আপনি উর্দু র্শহ মুতালাআ করবেন কোন নিয়তে এবং তরীকা কী হবে? আরবী শরহ থেকে গাফেল হয়ে এগুলো পড়লে কীভাবে হবে?

যদি আপনি এজন্য نصر الباري দেখেন, যে ওখানে তরজমাটা সুন্দর করা হয়েছে তাহলে তো একটা হল। (অবশ্য نصر الباري থেকে ইস্তিফাদা করার আমার সুযোগ হয়নি।) কিন্তু فتح الباري  عمدة القاري থেকে فرار করার জন্য نصر الباري পড়ে, এটা কেন?

দাওরায়ে হাদীসে একজন তালিবে ইলমের আরবী শুরূহ মুতালাআ করার এত লম্বা সময় থাকে না, কিন্তু অভ্যাস করে নিতে হয়। কিছু কিছু নির্বাচিত বহছ فتح الباري থেকে পড়বেন, যাতে তার সাথে انس পয়দা হয়। কিছু কিছু বহস আপনি عمدة القاري  থেকে এবংفيض الباري থেকে পড়বেন, যাতে الفت  পয়দা হয়। এরপর যখন সবক বেশি বেশি হচ্ছে, মুতালাআর সময় কম পাওয়া যায়, খারেজী দরস শুরু হয়ে যায় তখন আপনি শুধু انعام الباري পড়েন। মাওলানা সালীমুল্লাহ খান ছাহেবের كشف الباري পড়েন। অর্থাৎ আরবী শুরূহের দিকেই আমার رجحان বেশি, এখন সময় কম বিধায় আমি إنعام الباري থেকে একটা খোলাসা লিখছি, كشف الباري থেকে একটা খোলাসা দেখছি বা إيضاح الباري থেকে দেখছি, যার কাছে যেটা সহজ মনে হয়। তবে দরসী তাকরীরটা অবশ্যই এমন হতে হবে যা সামগ্রিকভাবে, সার্বিক বিচারে মুসতানাদ এবং যার ব্যাপারে বলা যায় যে তালিবে ইলমের সামনে একটা মুফীদ কিছু আছে। এ ধরনের দরসী তাকারীর পড়তে নিষেধ নেই তবে সেটা হবে معاون হিসেবে, আর মূল মাদার হবে আরবী ইলমী ও তাহকীকী র্শহগুলো।

যাইহোক এসব فوائد-এর জন্য উর্দু র্শহ আমরা পড়ব। انعام الباري -এর كتاب البيوع  -এ মুআমালাতের আলোচনা যেমন পাব, অন্যান্য র্শহে আমি তা পাব না। এখন দেখা যায়

بيع ما لم يملك، بيع ما لم يقبض، تلقى الجلب

এবং "نهى عن النجش" এগুলো নতুন পদ্ধতিতে প্রকাশ পাচ্ছে। এসব আগের চেয়ে অনেক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এখন বুঝা যায় যে, রাসূলের তালীমের উপর আমল করলে সমস্যা কীভাবে দূর হবে। পশ্চিমারা যে নতুন ফর্মূলা দিচ্ছে তার দ্বারা সংকট দূর হচ্ছে না বরং সংকট বেড়েই চলেছে বিশ্বব্যাপী। এ হাদীসগুলো কীভাবে বর্তমান যামানার সাথে منطبق হবে, হয়ে আছে আমার খবর নেই। এ বিষয়গুলো انعام الباري তে পাওয়া যায়, এটা فيض الباري   তে পাওয়া যাওয়ার কথা নয়। সে সময় এ প্রেক্ষাপট ছিল না, এ হালত ছিল না। এটার জন্য আমি انعام الباري পড়ব। এমনভাবে জায়গায় জায়গায় যে فوائد  আছে সেগুলোর জন্য আমি এসব উর্দু শরহ পড়ব যা مفتاح -এর حيثيت রাখে। এরকম বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন বুনিয়াদি হেদায়াত থাকে।

 

দ্বিতীয় কথা

ঐ ধরনের হেদায়াতের মধ্যে একটা হল যা انعام الباري -এর শুরুতে আছে, দরসে তিরমিযীর শুরুতে আছে, হযরত সেখানে তাম্বীহ করেছেন- দাওরায়ে হাদীসে আমরা হাদীস পড়ছি, হাদীস মানে কি? রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তালীমাত এবং তাঁর সীরাত। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তালীমাত ও সীরাত নিয়ে আমি দিনরাত আছি। এখন আমার আখলাকের মধ্যে, আমার আমলী যিন্দেগীর মধ্যে, ফিকরী যিন্দেগীর মধ্যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন আসা জরুরি। এত বছর যেভাবে আমার যিন্দেগী কাটালাম দাওরায়ে হাদীসের বছর যদি ঐভাবেই কাটে এটা কেমন কথা হবে। এটা তো হাদীসের প্রতি বড় অবহেলা ও  سوء أدب হবে। আমাদের দাওরার উস্তাযগণ বলেছেন, আপনাদেরকেও আসাতিযায়ে কেরাম বলেছেন, দাওরায়ে হাদীসের বছর এমন একটি বছর, পিছনে যার  কোনো নযীর যায়নি, ভবিষ্যতেও এর কোনো নযীর আসবে না। দরসে নেযামিতে আপনার পেছনে কি এমন কোনো বছর গিয়েছে, যার আগাগোড়া হাদীসের কিতাব ছিল? মিশকাতের বছর তো শুধু একটা কিতাব, আর তার আগে الصالحين رياضতার আগে কোথাও কোথাও ألفية الحديث আছে। এটা তো চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এক ঘণ্টা বা আধা ঘণ্টা পড়া হয়। আর এ বছর চব্বিশ ঘণ্টা জরুরি কাজ ছাড়া

قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ...

পড়া হয়। এ বছর হাদীস পড়া ছাড়া অন্য কোন মাশগালা নেই। দাওরার পরের বছর যদি আল্লাহ তাআলা তাঁকে হাদীসের কিতাব পড়ানোর তাওফীক দান করেন, তো আর কয় কিতাব দিবে, পুরো দাওরায়ে হাদীসের সব কিতাব কি দিবে। আর দিলেও কি আপনি পারবেন? একটা কিতাব থাকবে বা অর্ধেক থাকবে বা কয়েক পৃষ্ঠা থাকবে। তাহলে ভবিষ্যতেও আমার এমন সম্ভাবনা নেই যে, চব্বিশ ঘণ্টা আমার হাদীসের সাথ সম্পর্ক থাকব, ইল্লা মাশাআল্লাহ। তাহলে দাওরায়ে হাদীসের বছর এমন যেখানে রাত-দিন সকাল-সন্ধ্যা চব্বিশ ঘণ্টা আমার মাশগালা হল হাদীস। তাহলে সত্য কথা হলো, (যদিও এটা বলার মতো হালাত আমার নেই) পুরো বছর আমরা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে আছি।

أهل الحديث همو أهل النبي وإن + لم يصحبوا نفسه  أنفاسه صحبوا

হাদীসের মাশগালা যাদের ওরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আহল, যদিও তারা সরাসরি রাসূলের মোবারক ছোহবত লাভ করতে পারেনি, কিন্তু তারা রাসূলের أنفاس قدسية -এর ছোহবত লাভ করছে।

হাদীসের কিতাব তো নববী দীর্ঘ তেইশ বছরের একটি নববী আয়না এবং সীরাতের কিতাবও। যদি দিলের اتصال -এর সাথে কেউ এ হাদীস পড়ে, তার তো এক অস্বাভাবিক كيفيت থাকতে হবে। দাওরায়ে হাদীসের তালিবে ইলমের তো কোনো গুনাহ হতে পারে না, হওয়া সম্ভব নয়। দাওরায় হাদীসের ছাত্রদের চিন্তা এদিক সেদিক যাওয়ার সুযাগ নেই; যদি হাদীসের কিতাবের সাথে তার মন থাকে। তার দিল ও দেমাগ পুরোটাকে হাদীস ঘিরে রাখবে, পাকড়াও করে রাখবে। কিন্তু আমরা তো এত গাফেল এত গাফেল, দাওরায়ে হাদীসের কিতাব আমার মাথার পাশে, যখন ঘুমাই পাশে টেবিলের উপর কিতাব, যখন খাবার খাচ্ছি তখন আমার পাশে কিতাব, যখন দরসে আছি তখন আমার সামনে কিতাব। হাদীসের মধ্যে সাহাবী জিজ্ঞাসা করছেন আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেদায়েত দিচ্ছেন,  নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নসীহত করছেন মিম্বরে বসে, নসীহত করছেন হেদায়েত দিচ্ছেন আর সাহাবী সে হেদায়েত ও নসীহত শুনছেন, মুহাব্বতের সাথে শুনছেন। তারপর তাঁরা তাবিয়ীদেরকে শুনাচ্ছেন। তাঁদের থেকে তাবিয়ীনরা মুহাব্বাতের সাথে শুনতেন এবং তারা তাবে তাবিয়ীনকে শুনাচ্ছেন-  এভাবে ধারাবাহিকভাবে সংকলক ইমামদের কাছে এসেছে। তারা কিতাবে হাদীস সংকলন করে দিয়েছেন আর আমাদের উস্তাযগণ সে কিতাব সামনে রেখে আমাদের পড়াচ্ছেন।

একজন তালিবে ইলম যদি পড়ে-

سمعت عمر بن الخطاب رضي الله عنه على المنبر يقول:  سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول : إنما الأعمال بالنيات، وإنما لامرئ ما نوى، فمن كانت هجرته إلى الله ورسوله فهجرته إلى الله ورسوله، ومن كانت هجرته لدنيا يصيبها، أو امرأة ينكحها فهجرته إلى ما هاجر إليه.

তার দিলে যদি এ কথা হাযির থাকে, মসজিদে নববীর চেহারা যদি তার যেহেনে এসে যায়; যে হযরত উমর রা. মিম্বারে বসে বলছেন,  সামনে সাহাবায়ে কেরামের কে বসা? সাআদ ইবনে  আবি ওয়াক্কাস রা., আলী ইবনে আবি তালিব রা. বসা, উসমান রা.- তারাই তো বসা বা অন্য সাহাবীরা। কারা কারা এ মজলিসে ছিলেন সুনির্দিষ্টভাবে তো আমরা বলতে পারব না। কিন্তু এতটুকু জানি যে, ওখানে সাহাবী-তাবেয়ীদের এক জামাত বসা। তাদের মধ্যে আলকামা ইবনে আবি ওয়াক্কাস লাইসিও ছিলেন। হযরত উমর রা. মিম্বরে বসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইরশাদ শুনাচ্ছেন, তিনি বলছেন,

سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم

কী দৃশ্যটা! কোনো কোনো রেওয়ায়েতে হাদীসটির  শব্দমালা এমন :

يا أيها الناس إنما الأعمال بالنية...

(সহীহ বুখারী, কিতাবুল হিয়াল, বাব ১) এতে মনে হয় হাদীসটি কোনো খুতবায় ইরশাদ হয়েছে :

يا أيها الناس إنما الأعمال بالنية...

আমি যদি নববী যুগের সেই দৃশ্য দেখতে পাই যে, মসজিদে নববীতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন আর সাহাবায়ে কেরাম শুনছেন তখন এই হাদীসের আবেদন আমাদের দিলে কীভাবে জাগ্রত হবে। প্রত্যেক হাদীসেই এই কথা আসছে,

رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم، قال رسول الله صلى الله عليه وسلم، فعل رسول الله صلى الله عليه وسلم

চৌদ্দশ বছর আগের সে মসজিদে নববীর  হালত সব সময় যার সামনে হাযির, সে গান্দা চিন্তা কীভাবে করতে পারে। মন্দ চিন্তা তার মাথায় এসে কয় সেকেন্ড থাকতে পারে? দাওরার বছর তো তাসাওউফের বছর। তাযকিয়ায়ে কলব ও তাযকিয়ায়ে ফিকিরের চমৎকার সময় এই বছর। শুধু এই অনুভূতিটা জাগ্রত যে রাখতে পারে যে, এই বছর আমি যেন সাহাবায়ে কেরামের সাথে আছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মজলিসে আছি। আমি আমার উস্তাযের কাছে যখন যাই তখন তো আমার দিলে গান্দা খেয়াল আসে না।

এই যামানার বুযুর্গদের মজলিসে যদি আল্লাহ কখনো বসার তাওফীক দেন- আধা ঘণ্টা, দশ মিনিট, পাঁচ মিনিট বা পনের মিনিট, তখন আমার দিলে গান্দা খেয়াল আসে না, ভালো খেয়াল আসে। তাহলে আমি যখন রাসূলুল্লাহর মজলিসে আছি তখন আমার দিলের হালতটা কেমন হওয়া উচিত?

আজকে সকালে পড়লাম المسلم من سلم المسلمون من لسانه ويده বিকেলেই যদি কোনো তালিবে ইলমকে আঘাত করি, কটাক্ষ করি, আরেকজনের গীবত করে ফেলি, তাহলে কেমন লজ্জাজনক কথা হবে! গীবত হারাম- এই সকালে পড়লাম, আর বিকালেই এ অবস্থা! এখন তো পরিবর্তন হওয়ার داعية আছে, একটু খেয়াল করলেই হয়ে যাবে। কারণ এখন واعظ ناصح খোদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি আপনাকে বলে যাচ্ছেন।

কোনো জায়গায় যাবেন, তো خَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ -এর উপর আমল করেন। আপনি রিকসাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করলেন এই, অমুক জায়গায় যাবেন, কত টাকা ভাড়া? না-মুনাসিব একটা ভাড়া চেয়ে বসলো। একেবারে ক্ষেপে গেলেন। আপনার দেমাগ গরম হয়ে গেল। দিলেন ধমক। আপনিও এমন কথা বললেন যা আপনার ক্ষেত্রে সাজে না। এই পড়ে আসলেন- خَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ আর বাহিরে তার উল্টা করলেন। দুদিন আমার বেখেয়ালিতে এবং আমার অনিচ্ছায় রিকসাওয়ালার সাথে আওয়াজ উঁঁচু হয়ে গিয়েছিল। এটার জন্য এখনো আমার আফসোস। দুজায়গায় আমাকে দুজন মানুষ দেখেছে। আমি তাদেরকে চিনি না। আমি এত লজ্জা পেয়েছি যে, এখনো আমার মনে হলে খুব লজ্জা লাগে। এটা হওয়া উচিত নয়। সে না-মুনাসিব ভাড়া চাইল, আপনি নরম ভাষায় বলেন, ভাড়া  তো এত না, ভাই আমরাও তো আসা যাওয়া করি, অনেক বেশি চেয়েছেন। আপনি হেসে হেসে বলেন। এটা অভ্যাস করতে হবে। নিজের তবিয়তের খেলাফ গায়রে মাকুল কিছু দেখলেই তবীয়ত গরম হবে, ভাষা পরিবর্তন হবে, লাহজা পরিবর্তন হয়ে যাবে, না-মুনাসিব কথা আমার যবান থেকে বের হবে- এটা  কেমন কথা? আমি চেষ্টা করবো ادفع بالتي هى أحسن-এর উপর আমল করতে। তাহলে তালিবে ইলম যে এখন পড়ে আসল-خَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ   অনুযায়ী আমল হবে। এই যে সিএনজির ভায়েরা কাছাকাছি হলে যেতে চান না, আমরা সবসময় তাদের সাথে কানুনি ভাষায় কথা বলি। যাবেন? এই খালি যাবে? আর ঢাকার তালিবুল ইলমরা শিখেছে সবসময় রিকসাওয়ালাদের সাথে ধমকিয়ে কথা বলতে। নিজের বয়সের কাছাকাছি  বা একটু বড় হলে তুমি বলে। আর একেবারে যদি মুরব্বী হয় তাহলে আপনি বলে। কী অধিকার আপনার তাকে তুমি করে বলার? বেশি বয়সের হোক বা কম বয়সের হোক, কোন্ অধিকারে আপনি তুমি করে বলেন? আপনি রিকসায় বসেন আর সে চালক সেজন্যে? এটা তো কুদরতের কারিশমা! এ তো ইলাহী তাকসীম, আল্লাহ পারতেন আমাকে আপনাকে ঐ জায়গায় বসাতে। আপনার আমার কোনো যোগ্যতা ছিল না। তো এখন সে ঐ সুরে বলে আর সিএনজিওয়ালা বলে যাব না। আমি বলি, السلام عليكم ورحمة الله  হাসিমুখে একটা সালাম দিয়ে বলি, ভাই ভাল আছেন। আমাদেরকে একটু দিয়ে আসবেন কষ্ট করে, এই তো সামনে। আমি দেখেছি কঠিন কোনো ওযর না থাকলে নাকরে না। যত কাছের থেকে কাছে যান। ভাই, কষ্ট করে আমাকে একটু দিয়ে আসবেন। কোথায়? এই তো কাছে, এখানেই। এরপর আপনি দিবেন কত। আপনার যদি সামর্থ্য থাকে আপনি দেন। সে আপনাকে একরাম করে এনেছে আপনি তাকে একরাম করে দেন। আমি দেখেছি এমন ব্যবহার হলে তার ওযর থাকলে বলে, ভাই আমি তো আপনাকে নিয়ে যেতাম কিন্তু গ্যারেজে গাড়ি জমা দেওয়ার সময় হয়ে গেছে। যাইহোক তার একটা ওযর আছে। এই যে خَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ এটা কি শুধু উস্তাযদের সাথে। যার মর্যাদা তোমার জানা আছে তার সাথে? না, বরং الناس এখানে لام الف টা استغراق -এর জন্য এসেছে। বড়-ছোট, ঘরে-বাইরে, পরিচিত-অপরিচিত সবার সাথে خَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ

মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ দা.বা.-এর সাথে মসজিদে হারামে এক ভাই খারাপ ব্যবহার করেছেন। পরে সে যখন পরিচয় জানতে পারল তখন এসে বলল, হুযুর আমি চিনতে পারিনি। খুব মাযেরাত করছে। তখন তিনি বললেন, চিনতে পারার পরে তো এটা خَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ নয়। একটা আম ভাল ব্যবহার সবাই পায়। পরিচিত-অপরিচিত, ছোট-বড় বুযুর্গ-সাধারণ সবাই পায়। এর চেয়ে আরো উপরের স্তরের ভালো ব্যবহার হল, أَنْزِلُوا النَّاسَ مَنَازِلَهُمْসাধারণ ভাল ব্যবহার সবাই আমার কাছে পাওনা। এজন্য কারো সাথে  মুআমালা করার সময় একটু খেয়াল করা দরকার, যাতে পরে আফসোস করতে না হয়। এমন না বলতে হয়- হুযুর আমি তো চিনিনি। হুযুর আমি চিনিনি- এটা কেন বলতে হবে আমাকে? আমি ন্যূনতম ভাল ব্যবহারটা তার সাথে করি। যাতে পরে আফসোস করতে না হয়। তো এইমাত্র পড়ে আসলাম خَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ আর বের হয়েই রিকসাওয়ালার সাথে খারাপ ব্যবহার করলাম! এটা কেমন হল। এ জন্য দাওরায়ে হাদীসে যেহেতু নগদ নগদ এরশাদ আমার সামনে আসছে। এক হাদীস কয়েকবার আসছে, এখনই আমার মাঝে ইনকিলাব আসা দরকার। এখন যদি আমার মাঝে এই অনুভূতি পয়দা না হয় তাহলে আর কবে হবে? 

(চলবে ইনশাঅল্লাহ)

(ধারণ ও লিখনে : মাওলানা আব্দুল হাকীম)

 

 

advertisement