মে-দিবসঃ মালিক-শ্রমিক সবার অধিকার সংরক্ষিত হোক!
১ লা মে আন-র্জাতিক শ্রম-দিবস। তাই প্রতি বছর যথারীতি তা উদযাপিত হয়। সভা-সেমিনার, বক্তৃতা-টক শো এবং বিভিন্ন ‘সাংস্কৃতিক’ অনুষ্ঠান হচ্ছে যে কোনো দিবস-উদযাপনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। মে দিবসেও এর ব্যতিক্রম কিছু হয় না।
একটি মুসলিম-দেশে বিভিন্ন দিবস উদযাপনকে কেন্দ্র করে মুসলিম নর-নারী যেসব কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে থাকে তাতে চেতনাহীনতা ও আত্ম-পরিচয় বিস্মৃতির এক মর্মান্তিক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়। কিন্তু যারা এসব দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তাদের জন্য নীতি ও নৈতিকতা এবং দ্বীন ও ধর্মের কথা বলা হচ্ছে বাহ্যত অরণ্যে রোদন। তবুও আমরা এ কথাগুলো বলি কারণ হেদায়েতের মালিক তো একমাত্র আল্লাহ তাআলা।
মে-দিবসে শ্রমের মাহাত্ম্য ও শ্রমজীবীদের অধিকার উচ্চ কণ্ঠে ঘোষিত হয়। দৈনিক পত্রিকাগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। দেশের সরকার প্রধান ও দায়িত্বশীলগণ মূল্যবান বাণী প্রদান করেন। সব কিছু হয়, শুধু হয় না অবস্থার পরিবর্তন।
পূর্ণ একটি দিন আমোদ-ফূর্তির মধ্যে কাটিয়ে মালিক-শ্রমিক উভয় পক্ষ পুনরায় ফিরে যায় তাদের চিরাচরিত ধারার মাঝেই। শুধু আমাদের দেশের কথাই যদি ধরা হয় তাহলেও প্রশ্ন দাঁড়াবে, কয় কোটি মানুষের কত কোটি শ্রম-ঘণ্টা শুধু দিবস-উদযাপনের পিছনে ব্যয় হয়? দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, কী এর প্রাপ্তি? আর শুধু আনন্দ-উৎসবই যদি মূল কথা হয় তাহলে বড় বড় বুদ্ধিজীবীদের এত উচ্চ উচ্চ বাণীর কী প্রয়োজন? শ্রমের মাহাত্ম ঘোষণার পরিবর্তে তারা যদি আমোদ-ফূর্তির মাহাত্ম ঘোষণা করেন তাহলেই তা হয় যথার্থ ও বাস্তবসম্মত। অন্যথায় শব্দ ও বাক্য-অপচয়ের এই সব দৃষ্টান্ত হবে অত্যন্ত লজ্জাজনক।
এই দিবসে শ্রমিক-অধিকারের কথা শত কণ্ঠে ঘোষিত হলেও অধিকারের ক্ষেত্র যখন চিহ্নিত করা হয় তখন কি আমরা বিবেকের দংশন অনুভব করি না? কোনো রকম প্রাণ-ধারণের মতো ন্যূনতম জীবিকার মৌখিক আশ্বাসই কি সমাজের একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর অধিকার হতে পারে? যে সমাজ-ব্যবস্থা সর্বশ্রেণীর জনগণের চিন্তা ও মূল্যবোধ এবং চরিত্র ও হৃদয়বৃত্তি বিকাশের কোনো প্রতিশ্রুতি দেয় না তা কেমন সমাজ-ব্যবস্থা? আর তাতে সর্বস্তরের জনগণের কল্যাণই বা কীভাবে সাধিত হতে পারে?
গোটা শ্রমজীবী শ্রেণীটিকে সর্বব্যাপী অজ্ঞতা ও মূর্খতার মাঝে নিমজ্জিত রাখার কুফল এই হয়েছে যে, যে কোনো সময় যে কোনো মহল এদেরকে নিজেদের হীন স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। সামান্য একটু গুজবের মাধ্যমে যে কোনো ধরনের তাণ্ডব ও নাশকতা সংঘটিত হয়ে যায়! এর কিছু দৃষ্টান্তও সমপ্রতি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
তদ্রূপ শ্রমজীবী শ্রেণীর অধিকার রক্ষায় সোচ্চার হওয়ার অর্থ কখনো এই নয় যে, অন্য পক্ষের উপর যে কোনো অন্যায় চাপ প্রয়োগ করা এবং অন্যায়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা বৈধ হবে! অথচ বিভিন্ন প্রসঙ্গে এই প্রান্তিকতা প্রকটভাবে চোখে পড়ে যে, এক পক্ষের স্বার্থ রক্ষার কথা বলে অন্য পক্ষকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। এটা যে সম্পূর্ণ অন্যায় তা তো বলাই বাহুল্য।
শ্রমজীবী শ্রেণীর অধিকার রক্ষার পাশাপাশি মালিকপক্ষের ন্যায়সঙ্গত স্বার্থরক্ষার প্রতিশ্রুতিও একটি সমাজ-ব্যবস্থায় থাকা উচিত। কোনো পক্ষের জন্যই শোষণ ও অবিচারের দ্বার উন্মুক্ত থাকা উচিত নয়। ইতিপূর্বে যেমন দেশের বহু প্রতিষ্ঠিত শিল্প খাতকে টুঁটি চেপে হত্যা করা হয়েছে তেমনি বহু সম্ভাবনাময় খাতের অকালমৃত্যুও ঘটেছে এবং সেগুলোর নেপথ্য কারণও অনালোচিত নয়।
বর্তমানে পোশাক শিল্প বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। অথচ এই খাতে প্রায়ই বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পত্রিকার পাতায় শিরোনাম হচ্ছে। এজন্য যারা দেশের স্বার্থ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন তাদের সোচ্চার হওয়া এবং ধারা-পরিবর্তনের চেষ্টায় অবতীর্ণ হওয়া আশু প্রয়োজন।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, শুধু কথার ফুলঝুড়ি ছুটিয়ে কোনো জাতি বেশি দিন তার অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে না।