বৃদ্ধাশ্রম : কিছু অনুযোগ, কিছু অনুরোধ
বৃদ্ধাশ্রম মানে বৃদ্ধদের আশ্রয়স্থল। বর্তমান সময়ের দিকে লক্ষ্য করে বললে, বলতে হবে- বৃদ্ধ পিতা-মাতার জন্য পরিবার ও স্বজনদের থেকে আলাদা আবাস বা আশ্রয়ের নাম বৃদ্ধাশ্রম। মূলত অসহায় ও গরীব বৃদ্ধদের প্রতি করুণার বোধ থেকেই হয়ত বৃদ্ধাশ্রমের সৃষ্টি- যেখানে বৃদ্ধদের প্রয়োজনীয় সেবা ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমের সেই ছবি এখন আর নেই। এখন যা আছে তা হল, ছোট বেলায় যে বাবা-মা ছিলেন আমাদের সবচে’ বেশি আপন, যাদের ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারতাম না, যারা নিজেদের আরাম হারাম করে আমাদের মানুষ করেছেন নিজের সব দুঃখ কষ্ট বুকে চেপে আমার হাসি মাখা মুখ দেখার জন্য যে মা ব্যকুল থাকতেন, আমি না খেলে যিনি খেতেন না, আমি না ঘুমালে যিনি ঘুমাতেন না, অসুস্থ হলে যিনি ঠায় বসে থাকতেন আমার শিয়রে, যে বাবা-মা তিলে তিলে নিজেদের সবকিছু বিসর্জন দিয়েছেন আমাকে মানুষ করার জন্য, সেই বাবা-মায়ের শেষ বয়সের ঠিকানা এখনকার বৃদ্ধাশ্রমগুলো। মানবতার প্রতি এ এক চরম উপহাস।
এক-দু’ দশক আগেও আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রম তেমন একটা ছিল না। সময়ের সাথে সাথে এর সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু কেন এই বৃদ্ধাশ্রম?
এ প্রশ্নের উত্তর বড়ই করুণ। যে সন্তান বাবা-মাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারত না, মা-বাবাই ছিল যার সারা জীবনের আশ্রয়স্থল, সে কিনা আজ বাবা-মাকে নিজের কাছে রাখার প্রয়োজন বোধ করছে না, বাবা-মাকে ঝামেলা মনে করছে। তাঁদেরকে রেখে আসছে বৃদ্ধাশ্রমে। অথবা অবহেলা ও দুর্ব্যবহার করে এমন অবস্থার সৃষ্টি করছে যেন তারা নিজেরাই ভিন্ন কোনো ঠাঁই খুঁজে নেন। অনেকের ভাব এমন, টাকা পয়সার অভাব না থাকলেও বাবা-মাকে দেওয়ার মত সময়ের তাদের অভাব আছে। তাদের সঙ্গে কথা বলার মতো পর্যাপ্ত সময় তাদের নেই। তাই বাবা-মা একা নির্জনে থাকার চেয়ে বৃদ্ধাশ্রমে অন্যদের সঙ্গে কাটানোই নাকি ভালো মনে হয়।
এ ধরনের নানা অজুহাতে বাবা-মাকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একসময় যারা নামী দামী বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক ও চাকরিজীবী ছিলেন, বর্ণাঢ্য ছিল যাদের জীবন, বৃদ্ধ বয়সে এসে নিজ সন্তানদের অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়ে বহু পিতা-মাতা এখন বৃদ্ধাশ্রমের স্থায়ী বাসিন্দা হতে বাধ্য হচ্ছেন। পরিবার ও সন্তান থেকেও ‘সন্তানহারা এতীম’ হয়ে জীবন যাপন করছেন। এরচে’ বড় দুঃখ মা-বাবার জীবনে আর কিছুই হতে পারে না। পত্রিকার পাতায় নজর বুলালেই এর প্রমাণ মেলে। বিভিন্ন সময়ই বৃদ্ধাশ্রম থেকে সন্তানের কাছে লেখা বৃদ্ধ পিতা-মাতার চিঠি পত্রিকায় ছাপা হয়। যা পড়ে চোখের পানি সংবরণ করা যায় না।
আমরা যারা বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে অবহেলা করছি, তাদেরকে বোঝা মনে করছি, বৃদ্ধাশ্রমে তাদেরকে ফেলে রেখেছি, তারা কি কখনো ভেবে দেখেছি- আজ তারা বৃদ্ধ। তারা তো বৃদ্ধ হয়ে পৃথিবীতে আসেননি। তারা তো পরিবারের বোঝা ছিলেন না। বরং আমরা সন্তানরাই তো তাদের ‘বোঝা’ ছিলাম। তারা তো কখনো আমাদেরকে বোঝা মনে করেননি। আমাদেরকে বড় করে তোলার জন্য তারা বিন্দু পরিমাণ কমতি করেননি। কত যতœ করে বুকে আগলিয়ে আমাদের লালন-পালন করেছেন ।
মা আমাদের জন্য কতই না কষ্ট করেছেন। গর্ভধারণের কষ্ট। প্রসবের কষ্ট। স্তন্যদানের কষ্ট। রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দেয়ার কষ্ট। এ তো প্রাথমিক কষ্ট। এরপর প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত মা আমাদের জন্য কত যে কষ্ট করেছেন, এর কোনো হিসেব নেই। পৃথিবীতে এমন মা নেই যার এ কষ্টগুলো হয় না। মায়েরা এ কষ্টগুলো সহ্য করেই থাকেন। আল্লাহ তাআলা মায়ের কষ্ট ও তাদের প্রতি সন্তানদের করণীয় বর্ণনা করে কুরআনে ইরশাদ করেন-
وَ وَصَّیْنَا الْاِنْسَانَ بِوَالِدَیْهِ حَمَلَتْهُ اُمُّهٗ وَهْنًا عَلٰی وَهْنٍ وَّ فِصٰلُهٗ فِیْ عَامَیْنِ اَنِ اشْكُرْ لِیْ وَ لِوَالِدَیْكَ اِلَیَّ الْمَصِیْرُ .
“আমি মানুষকে তার পিতা-মাতা সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছি- (কারণ) তার মা কষ্টের পর কষ্ট সয়ে তাকে গর্ভে ধারণ করেছে আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’ বছরে- তুমি শোকর কর আমার এবং তোমার পিতা-মাতার। আমারই কাছে তোমাদের ফিরে আসতে হবে।” -সূরা লোকমান (৩১) : ১৪
এ আয়াত তো একথাই বলে, হে মানুষ! তোমরা তোমাদের পিতা-মাতার শোকর কর। কারণ তারা তোমাদের জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। তোমাদেরকে আদর-যত্নে মানুষ করেছেন। হায় আমরা যদি এ আয়াতের মর্ম উপলব্ধি করতে পারতাম!
পিতা-মাতার শোকর আদায়ের সবচে’ উপযুক্ত সময় হল তাদের বার্দ্ধক্য। কারণ এ সময় তারাও শিশুর মত হয়ে যান। নিজেরা কিছুই করতে পারেন না। সন্তানই তখন তাদের অন্ধের যষ্ঠি। এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
وَ قَضٰی رَبُّكَ اَلَّا تَعْبُدُوْۤا اِلَّاۤ اِیَّاهُ وَ بِالْوَالِدَیْنِ اِحْسَانًا اِمَّا یَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ اَحَدُهُمَاۤ اَوْ كِلٰهُمَا فَلَا تَقُلْ لَّهُمَاۤ اُفٍّ وَّ لَا تَنْهَرْهُمَا وَ قُلْ لَّهُمَا قَوْلًا كَرِیْمًا وَ اخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَ قُلْ رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّیٰنِیْ صَغِیْرًا رَبُّكُمْ اَعْلَمُ بِمَا فِیْ نُفُوْسِكُمْ اِنْ تَكُوْنُوْا صٰلِحِیْنَ فَاِنَّهٗ كَانَ لِلْاَوَّابِیْنَ غَفُوْرًا.
“তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাকে ছাড়া আর কারও ইবাদত করো না, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো, পিতা-মাতার কোনও একজন কিংবা উভয়ে যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয় তবে তাদেরকে উফ্ (পর্যন্ত) বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না; বরং তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বল। এবং তাদের প্রতি মমতাপূর্ণ আচরণের সাথে তাদের সামনে নিজেকে বিনয়াবনত কর এবং দুআ কর, হে আমার প্রতিপালক! তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছেন, তেমনি আপনিও তাদের প্রতি রহমতের আচরণ করুন।” -সূরা বনী ইসরাঈল, (১৭) : ২৩-২৪
আল্লাহ তাআলা কী সুন্দর দুআ শিক্ষা দিয়েছেন- ‘হে আমার প্রতিপালক! তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছেন, তেমনি আপনিও তাদের প্রতি রহমতের আচরণ করুন।’ এ দুআ থেকে বুঝে আসে যে, সন্তান শৈশবে যে ধরনের লালন-পালনের মুখাপেক্ষী হয়, ঠিক তেমনি পিতা-মাতাও বৃদ্ধ বয়সে সে ধরনের মমতাপূর্ণ আচরণের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেন। তাই আল্লাহ তাআলা এ দুআ শিক্ষা দিয়েছেন। তাদের সাথে মমতাপূর্ণ আচরণের আদেশ দিয়েছেন। এ সময় তাদের সাথে দূর্ব্যবহার করা তো দূরের কথা উফ্ বলতে পর্যন্ত আল্লাহ নিষেধ করেছেন। তাদেরকে ধমক দিতে নিষেধ করেছেন।
অপরদিকে বার্ধক্যে মা-বাবার খেদমত করতে পারাটা যেমন জান্নাতে দাখেল হওয়ার কারণ তেমনি মা-বাবার খেদমত না করাটাও হতভাগা হওয়ার কারণ। এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,
أن النبي صلى الله عليه وسلم رقى المنبر، فلما رقى الدرجة الأولى قال: آمين، ثم رقى الثانية فقال: آمين، ثم رقى الثالثة فقال: آمين، فقالوا: يا رسول الله، سمعناك تقول: آمين ثلاث مرات؟ قال: لما رقيت الدرجة الأولى جاءني جبريل صلى الله عليه وسلم فقال: شقي عبد أدرك رمضان، فانسلخ منه ولم يغفر له، فقلت: آمين. ثم قال: شقي عبد أدرك والديه أو أحدهما فلم يدخلاه الجنة، فقلت: آمين. ثم قال: شقي عبد ذكرت عنده ولم يصل عليك، فقلت: آمين.
“নবীজী একবার মেম্বারে আরোহণ করলেন। প্রথম ধাপে উঠে বললেন, আমীন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে উঠেও বললেন, আমীন। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন (কী বিষয় আল্লাহর রাসূল!) আপনাকে (এভাবে) আমীন বলতে শুনলাম। তখন নবীজী বললেন, আমি যখন মেম্বারে আরোহণ করলাম তখন জিবরীল আগমন করলেন এবং বললেন, ঐ ব্যক্তি হতভাগা, যে রমযান মাস পেল, আর রমযান গত হয়ে গেল কিন্তু তার গোনাহ মাফ হলো না। আমি বললাম, আমীন। তারপর বলল, ঐ ব্যক্তি হতভাগা, যে তার মা-বাবাকে অথবা কোনো একজনকে বার্ধক্য অবস্থায় পেল অথচ তারা (মা-বাবা) তাকে জান্নাতে প্রবেশ করালো না (অর্থাৎ তাদের খেদমতের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সন্তান জান্নাতে প্রবেশ করতে পারলো না।) আমি বললাম, আমীন। তৃতীয় বার বললেন, ঐ ব্যক্তি হতভাগা, যার সামনে আপনার নাম উচ্চারিত হল আর সে আপনার উপর দরূদ পাঠ করল না। বললাম, আমীন।” -আলআদাবুল মুফরাদ, ইমাম বুখারী, হাদীস ৬৪৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭৪৫১
জিবরিল আলাইহিস সালামের বদদুআ আর নবীজীর আমিন বলা- দু’টি বিষয় লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় বৃদ্ধ মা-বাবার খেদমত কত বড় বিষয়। খেদমত না করাটা কত বড় অন্যায়!
আর উপরের আয়াতে তো আমরা এটা দেখেছি যে শিরকের পরেই আল্লাহ মা-বাবার প্রতি সদাচারের বিষয়টি অতি গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করছেন। এ সকল বিষয় যার উপলব্ধিতে আছে সে কি মা-বাবার প্রতি ‘বৃদ্ধাশ্রমের’ অবিচার করতে পারে।
শৈশবে সন্তানের একমাত্র ভরসাস্থল তার বাবা-মা। পৃথিবীর সকল সন্তানের ক্ষেত্রেই এমন। একটি প্রতীকী গল্প বলি-
বাবা তার ছোট মেয়েকে নিয়ে গ্রামের নদীর উপর তৈরি বাশের সাঁকো পার হচ্ছিলেন। মেয়ের জন্য বাবা ভয় পাচ্ছিলেন। তিনি মেয়েকে বললেন- “মা! শক্ত করে আমার হাত ধর।” মেয়ে উত্তর দিল: “না বাবা, বরং আপনিই আমার হাত ধরুন”। বাবা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি তোমার হাত ধরা আর তুমি আমার হাত ধরার মধ্যে পার্থক্য কী? তুমি ধরলে যা হবে, আমি ধরলেও তো তাই হবে। মেয়ে বাবাকে বলে: “অনেক বড় পার্থক্য বাবা! যদি আমি আপনার হাত ধরি এবং সাঁকো পার হতে গিয়ে আমার কিছু হয়, তাহলে আমি ভয়ে আপনার হাত ছেড়ে দিতে পারি। কিন্তু আপনি যদি আমার হাত ধরেন, আমি নিশ্চিতভাবে জানি যা-ই ঘটুক না কেন, জীবন গেলেও আপনি আমার হাত ছাড়বেন না! ”
আমরা যে বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে রাখছি শৈশবে তারাই কিন্তু ছিলেন আমাদের একমাত্র ভরসাস্থল। গল্পের মেয়েটির মত আমরাও কিন্তু বাবা-মায়ের কোলে নিজেকে সবচে’ বেশি নিরাপদ মনে করতাম। আর আজ কি না আমাদের সেই বাবা-মায়ের ঠিকানা হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রম।
সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসার একটি গল্প পড়েছিলাম এক কিতাবে-
অসহায় মা তার একমাত্র পুত্রকে নিয়ে বাস করেন শহরে। ছেলে বুঝ হওয়া অবধি দেখে আসছে তার মায়ের একটা চোখ নেই। এজন্য মাকে দেখতে কুৎসিত দেখায়। এ নিয়ে স্কুলে তার বন্ধুরা হাসাহাসি করে। একদিন মা স্কুলের পাশ দিয়ে কোথাও যাওয়ার সময়, ছেলেকে দেখতে স্কুলে গেলেন। ছেলে লজ্জায় দেখা করতে এল না। মা কিছু না বলে ফিরে এলেন।
ছেলে এক সময় বড় হলো। পড়ালেখা শেষ করে চাকুরি নিলো। বিয়ে শাদি করে আলাদা হয়ে গেলো। মায়ের সাথে আর কোন যোগাযোগ রাখলো না। খোঁজখবরও নিলো না।
অনেক দিন পর ছেলে তার স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রদের পুনর্মিলনীর দাওয়াত পেয়ে আসলো। কী মনে করে সে আগের এলাকা দেখতে এলো। এই ফাঁকে মা কেমন আছে সেটাও দেখা হয়ে যাবে। যে ভাড়া বাড়িতে মা থাকতেন সেখানে এসে দেখলো, এখন সেই বাড়িতে অন্য ভাড়াটিয়া থাকে। পাশের বাড়ির মায়ের বয়েসি এক মহিলা ছেলেটিকে দেখে বের হলেন। ছেলেটিকে একটি চিঠি দিয়ে বললেন : এটা তোমার আম্মু মারা যাওয়ার আগে তোমাকে দিতে বলে গেছেন। চিঠিটাতে লেখা ছিল :
‘বাবা! আমি জানি আমার একটা চোখ না থাকাতে আমাকে ভারি কুৎসিত দেখাতো। সেজন্য অন্যদের মতো তুমিও আমাকে পছন্দ করতে না। আমার চোখ না থাকার কারণটা জানলে নিশ্চয় তুমি আর আমাকে ঘৃণা করতে পারতে না। তুমি তখন ছোট। তোমার আব্বু, আমি আর তুমি অন্য এক শহরে থাকতাম। একদিন এক গাড়ি দুর্ঘটনায় তোমার আব্বু মারা যান। আমিও গুরুতর আহত হই। আর তোমার একটা চোখ একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। তখন আমার একটি চোখ তোমাকে দিয়ে দিই। এরপর আমরা এই শহরে চলে আসি। এই ঘটনা আর কেউ জানে না, আমি আর কাউকে বলিনি।’
এমনই হয় মায়ের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। এ তো একটি উদাহরণ মাত্র। মায়ের ভালোবাসা সন্তানের জন্য হাজারো গুণ বেশি। এমন মাকেও মানুষ ভুলে যায়। বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে।
হায় মানবতা! হায়রে মানুষ!! আমরা কেন বুঝি না, আজকের আমি ক’দিন পরেই বার্ধক্যে পা দেব। এটাই জীবনের ধর্ম। আমি কি ভেবে দেখেছি, আমি বৃদ্ধ হলে আমার আশ্রয় কোথায় হবে- যখন আমি আমার মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে রেখেছি। তাই বৃদ্ধাশ্রম নয়, পরিবারই হোক আমাদের সবার ঠিকানা।
একইসাথে পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থার দিকে লক্ষ্য করে এখানে আরেকটি বিষয় আলোচনা করা দরকার মনে করছি। আর তা হল, ‘বৃদ্ধাশ্রম মানবতার কলংকিত কারাগার’, ‘বৃদ্ধাশ্রম বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি এক নির্মম উপহাস’- এ কথাগুলো যেমন সত্য তেমনি একথাও সত্য যে, বৃদ্ধাশ্রম বর্তমান সময়ের এক তিক্ত বাস্তবতা। সামাজিক, মানসিক ও আদর্শিক নানা পরিবর্তনের কারণে বর্তমানে একান্নবর্তী পরিবার বা যৌথ পরিবার ব্যবস্থা ক্রমশই কমে যাচ্ছে। অবহেলিত হচ্ছেন বৃদ্ধ পিতা-মাতা। এতে করে তারা তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার অর্থাৎ আশ্রয় ও বাসস্থান হারাচ্ছেন। অবশেষে তাদের ঠাঁই নিতে হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে। তাই যারা সমাজের এই তিক্ত বাস্তবতাকে সামনে রেখে অসহায় বৃদ্ধ মানুষদের জন্য নিজের উদ্যোগে, নিজ খরচে বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করছেন, ভরণ-পোষণ ও চিকিৎসা সেবা দিয়ে বৃদ্ধদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, তাদের এই উদ্যোগ প্রশংসার যোগ্য। এ ক্ষেত্রেও দ্বীনদার বিত্তবানদের এগিয়ে আসা দরকার। সমাজে অবহেলিত ও অসহায় বৃদ্ধ ‘মা-বাবা’কে তাদের জীবনের শেষ দিনগুলোতে একটু ভালবাসা, মায়া-মমতা ও প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করে তারাও হতে পারেন অনেক বড় সাওয়াবের অধিকারী।
এক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-
من نفس عن مؤمن كربة من كرب الدنيا، نفس الله عنه كربة من كرب يوم القيامة، ومن يسر على معسر، يسر الله عليه في الدنيا والآخرة، ومن ستر مسلما، ستره الله في الدنيا والآخرة، والله في عون العبد ما كان العبد في عون أخيه.
“যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের পার্থিব কষ্টসমূহের একটি দূর করে দেয়, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার একটি কষ্ট দূর করে দিবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবীর অভাবের কষ্ট লাঘব করে, আল্লাহ তাআলা তার দুনিয়া ও আখেরাতের অভাবের কষ্ট লাঘব করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। আল্লাহ তাআলা বান্দার সহায়তায় থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সহায়তায় থাকে।” -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৮
যারা অবহেলিত ও অসহায় বৃদ্ধদের পিছনে নিজের অর্থ-সম্পদ ও সময় ব্যয় করবে, এই হাদীসের মর্মের ব্যাপকতায় তারাও শামিল হবেন। ইনশাআল্লাহ।
যারা অসহায় বৃদ্ধদের কিংবা সন্তানদের কাছে অবহেলিত বাবা-মায়ের সেবার উদ্দেশ্যে বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করছেন তাদের উচিত, ‘এক সন্তানের কাছে অবহেলিত বাবা-মায়ে’র শেষ দিনগুলো যেন বৃদ্ধাশ্রমে ‘আরেক সন্তানের ঘরে’র মতই কাটে। বৃদ্ধাশ্রমগুলো যেন বাস্তব অর্থেই শেষ সময়ে তাদের আরাম-আয়েশের ভরসাস্থল হয়। সে দিকেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া দরকার। পাশাপাশি নিচের বিষয়গুলোর প্রতিও লক্ষ্য রাখা অত্যন্ত জরুরি :
এক. বৃদ্ধাশ্রম শুরু থেকেই একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। তাই বৃদ্ধাশ্রমগুলো যেন শতভাগ সেবামূলক হয় সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। ব্যবসায়ী মনোভাব কিংবা দায়সারাভাব যেন বৃদ্ধাশ্রমের এ সেবামূলক কাজের স্বাতন্ত্র্য বিনষ্ট না করে দেয়।
দুই. বৃদ্ধাশ্রম যেহেতু বৃদ্ধ ও অসহায় মানুষের আশ্রয়স্থল, তাই সেবক সেবিকারা যেন তাদের সাথে মমতা ও সহমর্মিতাপূর্ণ আচরণ করেন সে বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। এ তো মানবতার দাবিও বটে। আসলে আমরা যদি এভাবে চিন্তা করি, এখানে যারা অবহেলিত হয়ে এসেছেন তারা তো অবশ্যই কোনো না কোনো সন্তানের পিতা-মাতা। আর আমরা যারা এখানে বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছি কিংবা বৃদ্ধাশ্রমে সেবার কাজে নিয়োজিত আছি আমরাও কিন্তু পিতা-মাতারই সন্তান। তাদের সাথে সন্তানসূলভ আচরণ করা এ শুধু সৌজন্যই নয় বরং মানবতার দাবিও। তাই বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে সেবার মান আরো উন্নত করা দরকার।
তিন. বৃদ্ধাশ্রমে যারা আসেন তারা যেহেতু জীবনের শেষ সময়টা এখানে কাটান তাই তাদের এই শেষ সময়টা যেন দ্বীনী পরিবেশে, ইবাদত-বান্দেগী ও তাওবা-ইস্তেগফারের মাধ্যমেই কাটে সে দিকেও বিশেষ যতœ নিতে হবে। বৃদ্ধাশ্রমে যদি দ্বীনী পরিবেশ কায়েম করা যায় তাহলে এর মাধ্যমে তারা আত্মিক প্রশান্তিও লাভ করবেন। আত্মিক প্রশান্তি মানুষকে হতাশা, দুঃখ ও বেদনা থেকে মুক্তি দেয়। মানুষ কষ্টের মাঝেও এক অনাবিল সুখের খোঁজ পায়। এজন্য বৃদ্ধাশ্রমকে যদি দ্বীনী তালীম ও ইবাদতের উপযোগী করে তোলা যায় তাহলে অন্তত শেষ জীবনে হলেও তারা নিজেদেরকে আখেরাতমুখী করে ঈমান-আমল নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পারবেন। এ তো একজন মুসলমানের জন্য মহা সফলতা। আল্লাহ তাআলা সূরা নাসরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জীবনের শেষ সময়ে আল্লাহ তাআলার হামদ ও তাসবীহ এবং বেশি বেশি তাওবা ইস্তেগফারের আদেশ করে উম্মতকে এ শিক্ষা দিয়েছেন, তারা যেন জীবনের শেষ সময়ে বেশি বেশি আল্লাহ তাআলার হামদ ও তাসবীহ, জিকির-আজকার করেন, ইবাদত-বন্দেগীতে রত থাকেন। আল্লাহ তাআলার দরবারে বেশি বেশি তাওবা-ইস্তেগফার করেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَ اسْتَغْفِرْهُ اِنَّهٗ كَانَ تَوَّابًا
“তখন আপনি আপনার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করুন ও তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয়ই তিনি অতি ক্ষমাশীল।” -সূরা নাসর (১১০) : ৩
চার. বৃদ্ধাশ্রমের পক্ষ থেকে ‘প্রবীণ নির্যাতনে’র বিষয়ে সচেতনতামূলক সভা সেমিনারের আয়োজন করা। এর মাধ্যমে যারা মাতা-পিতাকে অবহেলা করেন তাদের মানবিক চেতনা ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করা। বৃদ্ধাশ্রমের একটি কার্যক্রম এরকমও হতে পারে যে, যারা তাদের পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যেতে আসবে তাদেরকে পিতা-মাতার সেবা করার সাওয়াব ও তাদেরকে সময় দেওয়ার লাভের বিষয়গুলো বুঝিয়ে তাদের মানবতাবোধ ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে জাগিয়ে তোলা- যেন তারা তাদের পিতা-মাতাকে নিজেদের কাছে রাখার প্রতি উৎসাহী হন। আশা করি এর মাধ্যমে ‘প্রবীণ নির্যাতন’ কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফিক দান করুন।
আসুন পিতা-মাতার জন্য দুআ করি- رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّیٰنِیْ صَغِیْرًا
‘হে আমার প্রতিপালক! তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছে, তেমনি আপনিও তাদের প্রতি রহমতের আচরণ করুন।’ আমীন।