কাশ্মির : কাশ্মিরের ইশা কি ‘নোবেল’ পাবে?
কাশ্মিরের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্ভবত কারো অজানা নয়। ভূস্বর্গ-খ্যাত এই অঞ্চলটি এখন মজলুম মানবতার কারাগার। দশকের পর দশক যেখানে লুণ্ঠিত হয়ে চলেছে মানবতা। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ন্যায়-নীতির নানা মানদ- যেমন, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও মানবাধিকার- কোনটি সেখানে লুণ্ঠিত নয়!
কাশ্মিরের জনগণের অপরাধ, তারা ভারতীয়দের জুলুম-আগ্রাসন থেকে মুক্তি পেতে চায় এবং তারা আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের জন্য সংগ্রামরত। সাধারণত দেশে দেশে জালিম শাসকের পাঞ্জা থেকে মুক্ত হয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রাম বা স্বাধীনতার সংগ্রামকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখা হয়। স্বাধীনতার সংগ্রামীরা স্বজাতির চোখে ও অন্যান্যদের চোখেও বিশেষ মর্যাদার পাত্র হয়ে থাকেন। অথচ কাশ্মিরের ক্ষেত্রে মূল্যায়নের মানদ- আলাদা। স্বাধীনতা-সংগ্রামীরা যদি কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর চোখে ‘জঙ্গি’ ও ‘বিদ্রোহী’ সাব্যস্ত হন- এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু নিরপেক্ষ ব্যক্তি ও সমাজের চোখেও কেন তারা জঙ্গি ও সন্ত্রাসী? তারা তো অন্যায় ও আরোপিত শাসনের বিরুদ্ধে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের জন্য সংগ্রামে লিপ্ত।
‘ভারতের প্রথমসারির পাবলিক ইন্টেলেকচ্যুয়াল ও পশ্চিমবঙ্গের সাবেক অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র ২০১০ সালের ২৭ আগস্ট ডেইলি টেলিগ্রাফে কাশ্মির উপত্যকা সম্পর্কে যা লিখেছেন, তার বাংলা সরলার্থ হচ্ছে- ‘এই উপত্যকাটি একটি দখল করে রাখা ভূমি। এখান থেকে মাত্র এক দিনের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তাবাহিনী সরিয়ে নিলে এর পরমুহূর্তে কী ঘটবে তা পরিমাপ করা কঠিন।... ভারত জাতি কাশ্মির থেকে বিচ্ছিন্ন।’
‘১৯৪৭ সালের ২৭ অক্টোবর নেহেরু ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো টেলিগ্রামে লিখেছিলেন :
‘I should like to make it clear that the question of aiding Kashmir in this emergency is not designed in any way to influence the state to accede to India. Our view which we have repeatedly made public is that the question of accession in any disputed territory or state must be decided in accordance with wishes of people and we adhere to this view.’ (Telegram 402 Primin-2227, dated 27th October, 1947 to PM of Pakistan repeating telegram addressed to PM of UK).
এ টেলিগ্রাম তিনি এটলির কাছেও পাঠিয়েছিলেন। এ টেলিগ্রামের কথা উল্লেখ আছে ‘হোয়াইট পেপার অন জম্মু অ্যান্ড কাশ্মির ১৯৪৮-এর ৪৬ নম্বর পৃষ্ঠায়। এ ছাড়া এর চার দিন পর ৩১ অক্টোবর তিনি আরেকটি টেলিগ্রাম পাঠান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খানের কাছে, যাতে তিনি উল্লেখ করেন :
‘Kashmir’s accession to India was accepted by us at the request of the Maharaja’s government and the most numerously representative popular organization in the state which is predominantly Muslim. Even then it was accepted on condition that as soon as law and order had been restored, the people of Kashmir would decide the question of accession. It is open to them to accede to either Dominion (India or Pakistan) then.’
অধিকন্তু তিনি উল্লিখিত প্রথম টেলিগ্রামটিতে লিয়াকত আলী খানের কাছে এ নিশ্চয়তাও ঘোষণা করেছিলেন : ‘our assurance that we will withdraw our troops from Kashmir as soon as peace and order are restored and leave the decision about the future of the State to the people of the State is not merely a pledge to your Government but also to the people oF Kashmir and to the world.’
এগুলো সবই এখন বিতর্কহীন ইতিহাসের অংশ। এই দুটি টেলিগ্রামেই নেহরু কাশ্মিরের জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী তাদের পাকিস্তানের বা ভারতে অন্তর্ভুক্তি কিংবা সম্পূর্ণ স্বাধীন কাশ্মিরের পক্ষে অবস্থান নেয়ার সুযোগ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সে প্রতিশ্রুতি তিনি ও তার দেশ শতভাগ ভঙ্গ করেছেন।
জম্মু ও কাশ্মির হাইকোর্ট বলেছে, ‘জম্মু ও কাশ্মির ভারতের কোনো অংশ নয়।’ ২০১০ সালের দিকে ভারতের স্পষ্টবাদী লেখিকা অরুন্ধতী রায় ঠিক একই কথা বলেছিলেন : ‘কাশ্মির ইজ নট অ্যা পার্ট অব ইন্ডিয়া’। এই সত্য উপলব্ধির ওপর ভর করে ওই সময় নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে তিনি বলেছিলেন : ‘কাশ্মির শুড গেট আজাদি ফ্রম ভুখে নাঙ্গে ইন্ডিয়া’।” (দৈনিক নয়া দিগন্ত, ১৮ জুলাই ২০১৬, পৃ. ৭)
সুতরাং এটাই বাস্তবতা যে, এমনকি স্বাধীনতা-সংগ্রামের মূল্যায়নেও রয়েছে এক ‘গোপন’ মানদ--যে মানদ-ে এক জাতির সংগ্রাম ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ আর অন্য জাতিরটি বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সন্ত্রাসবাদ। অন্যথায় বেলুচদের তৎপরতা ‘স্বাধীনতা-সংগ্রাম’ হলে কাশ্মিরীদের আন্দোলন ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ কেন?
কাশ্মিরের অতি সাম্প্রতিক পরিস্থিতি এই উপত্যকায় আরো অনেক বর্বরতার স্বাক্ষর রেখে গেছে। এতে অর্ধশতাধিক কাশ্মিরী মুসলিম নিহত হয়েছেন আর শত শত কাশ্মিরী নিজ দেহে বহন করছেন এক ‘গণতান্ত্রিক’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় বর্বরতার ছাপ। এই বর্বরতায় ব্যবহৃত নানা উপাদানের একটি হচ্ছে, পিলেট নামক ছররা গুলি, যা থেকে রেহাই পায়নি শিশু-কিশোরেরা পর্যন্ত। কাশ্মিরী কিশোরী ইশা মালিকের দুই চোখসহ গোটা মুখম-ল ঝাঁঝরা হয়ে গেছে পিলেটের গুলিতে। চিকিৎসকেরা বলেছেন, ‘এই ছররা গুলি তার শরীরে ‘সেকেন্ডারি ইনফেকশন’ তৈরি করছে। যেহেতু এই ইনফেকশন ঘটেছে তার মস্তিষ্কের খুব কাছাকাছি তাই আমরা ধরে নিয়েছি এই ইনফেকশন তার মস্তিষ্কেও ছড়িয়ে পড়েছে।’ তারা আরো বলেছেন, ‘সেপটিক শকের ফলে তার অনেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অকেজো হয়ে যেতে পারে।’ ইশা যেন ভূস্বর্গ কাশ্মিরের ক্ষত-বিক্ষত মুখ।
ইশার মতো শত শত কাশ্মিরী কখনো ‘নোবেল’ পাবে না। কারণ ‘ইশা’রা কখনো নোবেল পায় না, ফেলানীরাও পায় না, কিন্তু সহানুভূতিও কি পাবে না? অন্যদের সহানুভূতি নয়, নিজ জাতির অর্থাৎ মুসলমানের সহানুভূতি? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো গোটা মুসলিম সমাজকে এক দেহের মতো বলেছেন। তাঁর বিখ্যাত বাণী-
مَثَلُ الْمُؤْمِنِينَ فِي تَوَادِّهِمْ، وَتَرَاحُمِهِمْ، وَتَعَاطُفِهِمْ مَثَلُ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى مِنْهُ عُضْوٌ تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ الْجَسَدِ بِالسَّهَرِ وَالْحُمَّى.
‘মুমিনগণ পরস্পর প্রীতি ও ভালবাসায় এক দেহের ন্যায়। যখন সে দেহের কোনো অঙ্গ ব্যাথাগ্রস্ত হয় তো গোটা দেহ জ্বর ও নিদ্রাহীনতায় ভোগে’। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮৬
একটা সময় যখন মুমিনগণ ছিলেন পূর্ণাঙ্গ মুমিন। আর ঈমান ও ইসলাম ছিল মুমিনের বাস্তব জীবনে, তখন সত্যিই মুমিনগণ ছিলেন এক দেহের মতো। কিন্তু ঈমানের দুর্বলতার কারণে অন্য অনেক বৈশিষ্ট্যের মতো ভ্রাতৃত্ববোধ থেকেও, যা ঈমানের এক গুরুত্বপূর্ণ শাখা, মুমিন-সমাজ ধীরে ধীরে রিক্তহস্ত হতে চলেছে। এখন আর মুমিনের অশ্রু মুমিনের চোখে অশ্রু আনে না। মুমিনের বেদনা মুমিনের হৃদয়কে স্পন্দিত করে না। বরং মুসলিম সমাজ এখন বিভক্ত হয়ে পড়েছে নানা চিন্তায়। এখন মুসলমানদের একটি শ্রেণি চিন্তা করে পশ্চিমা ও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের মস্তিষ্ক দ্বারা, কাজ করে ওদেরই মন্ত্রণায় পরিচালিত হয়ে। অথচ কুরআনে আল্লাহ তাআলা কত পরিষ্কার বলেছেন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تَتَّخِذُوا الْكٰفِرِیْنَ اَوْلِیَآءَ مِنْ دُوْنِ الْمُؤْمِنِیْنَ اَتُرِیْدُوْنَ اَنْ تَجْعَلُوْا لِلهِ عَلَیْكُمْ سُلْطٰنًا مُّبِیْنًا.
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা মুমিনদের পরিবর্তে কাফিরদের বন্ধুরূপে গ্রহণ কারো না। তোমরা কি আল্লাহকে দিতে চাও তোমাদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট প্রমাণ?’ -সূরা নিসা (৪) : ১৪৪
তাই সময় এসেছে, মুসলমানদের স্বকীয় চিন্তা-চেতনায় স্বাবলম্বী হওয়ার এবং নিজস্ব কর্ম-নীতি গ্রহণ ও অনুসরণ করার। সময় এসেছে নিজের পরিবারকে চেনার এবং ভাইকে ভাই বলে জানার।
আল্লাহ তাআলা এই উম্মাহকে আবারো দান করুন নিজস্বতা ও স্বকীয়তা এবং তাদের করুন আপন চিন্তা ও কর্মে স্বাবলম্বী। আমীন ইয়া রাব্বাল আলামীন।