আমাদের যুগের প্রধান নাবিক
তিনি চলে গেলেন। ১৯ রমযান সন্ধ্যায় তিনি চলে গেলেন। তাঁর চলে যাওয়াটা খুব আকস্মিক ছিল না। তিনি অসুস্থ ছিলেন। শয্যাশায়ী ছিলেন। তাঁর অসুস্থতার খবর ছড়িয়ে পড়েছিল। উদ্বেগ ও শংকা নিকটজনদের মনের কোণে কোণে বাসা বেঁধেই ছিল। তারপরও তাঁর চলে যাওয়ার ঘটনা অনেক বড় রকম বেদনা ও শূন্যতার কারণ হয়েছে। তাঁর অন্তর্ধানের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর যুগটিরও যেন সমাপ্তি ঘটে গিয়েছে। তাঁর চলে যাওয়ার পর পর হঠাৎ করেই মনে হয়েছে, তিনি একটি যুগ নিয়ে এসেছিলেন। একটি যুগ তৈরি করেছিলেন। আর যাওয়ার সময় একটি যুগ রেখে গিয়েছেন। গত পঞ্চাশ বছরের লিখিত বাংলা ভাষায় ইসলাম চর্চার তিনি অন্যতম কাণ্ডরি ছিলেন। তিনি মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রাহ.। আমাদের যুগের বাংলাভাষার প্রধান ইসলামী নাবিক। আমরা তাঁকে দেখেই আগের যুগের বাংলা ইসলামী সাহিত্যের প্রাণপুরুষদের মুখ দেখার চেষ্টা করেছি। তিনি মাসিক মদীনার সম্পাদক। বহু কালজয়ী গ্রন্থের অনুবাদক। অনুবাদের সংগঠক-সম্পাদক। বহু গ্রন্থের রচয়িতা। বহু রচনার প্রেরণা। তিনি এদেশে ইসলাম ও মুসলমানকে সামনে নিয়ে বলা ও লেখার বহু কাজের আয়োজক। ছিলেন কর্মমুখর এক মনীষী। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বহু দেশেই তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। বহু ইতিবাচক মনীষার সমন্বয়ক। বহু মনীষীর পৃষ্ঠপোষক। পড়ন্ত বেলায় জাতির এক দায়িত্ববান অভিভাবক। জীবনীকারদের ভাষায় তিনি হায়াত পেয়েছিলেন ৮১ বছর। তাঁর জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৯ এপ্রিল। ইন্তেকাল ২০১৬-এর ২৫ জুন। তাঁর সম্পর্কে যথাযথ ভাষায় কিছু বলা কঠিন। কঠিন তাঁর সম্পর্কে বলতে গেলে স্মৃতির হাতছানি উপেক্ষা করাও।
। দুই।
বাংলায় লেখাই ছিল তাঁর কাজ। আর সে লেখার বিষয় ছিল ইসলাম ও মুসলমান। টগবগে যুবক বয়সে হাতে তুলে নিয়েছিলেন শুধুই কলম। ছিলেন গ্রামের অভিজাত মধ্যবিত্ত দ্বীনদার পরিবারের সন্তান। শিশুবেলায় দেখেছেন অস্তমান ব্রিটিশ যুগের প্রতিনিধি জমিদার- জোতদারদের দাপট-উপেক্ষা। কোণঠাসা অবহেলিত পূর্ববঙ্গের মুসলিম মানসের পুরো প্রতিবাদী উত্তাপ তাঁর মগজজুড়ে ছড়িয়ে ছিল। গ্রামের পাঁচবাগ মাদরাসার পর ঢাকা আলিয়ায় এসে লেখাপড়া শেষ করেন। আলিয়া ধারায় দুটি শাখায় কামেল পাশ করেই কর্মের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। শিক্ষকতাসহ বিভিন্ন দিকে যাওয়ার সুযোগ তখন তাঁর সামনে ছিল। কিন্তু তিনি কলমের বন্ধন ছাড়তে পারেননি। তাঁর মনে হয়েছিল নিজের ধর্ম ও জাতির পক্ষে বলার-লেখার ময়দানে তাঁকে থাকতে হবে। অবহেলিত-উপেক্ষিত মুসলমান ও ইসলামী প্রেরণার প্রতিনিধিত্ব তাঁকে করতে হবে। অনিশ্চয়তার পাহাড় মাথায় নিয়ে ছাব্বিশ বছর বয়সে ‘মদীনা’ নামের একটি মাসিক ইসলামী সাময়িকী প্রকাশ করেন। তখন ১৯৬১ সাল। তখনকার সময়ে কাজটি সহজ ছিল না। তাঁর নিজেরও সঙ্গতির সমস্যা ছিল। কিন্তু তিনি দমে যাননি। তাঁর এ সাময়িকীই ইতিহাস ও কিংবদন্তিতে পরিণত হয়। ‘মদীনা’ একটি যুগের জন্ম দেয়।
একটি মাসিক পত্রিকা মানে তো একটি প্লাটফর্ম। সমন্বিত বহু আয়োজন। বহু কিছুর সংগঠন। বহু নবীন-প্রবীণ স্বপ্নবান লেখকের বিচরণ। তাঁর পত্রিকাটিকে তিনি সবগুলো অর্থেই কাজে লাগিয়েছেন। হঠাৎ করে আজকের বাংলাবাজার, চকবাজার, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পুস্তকভা-ার দেখলে তাঁকে বুঝতে কঠিন হবে। মাত্র কয়েক ডজন বাংলা ইসলামী বইয়ের যুগে তাঁর যুগ শুরু। পঞ্চাশ ও ষাটের দশক তখন। সেই উষর মাঠে ধীরে ধীরে সবুজের সমারোহ তৈরির পেছনে তিনি মেহনত করেছেন। বাংলা ভাষায় ইসলামচর্চার নিষ্ফলা মাঠের উদ্যমী কৃষক বলা যায় তাকে। তিনি যখন যুবক তখন মাওলানা আকরাম খাঁ বৃদ্ধ। আকরাম খাঁর দৈনিক আজাদে কিছুদিন কাজ করেছেন। তাঁর যৌবনে মোজাহেদে আযম মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রাহ.-এর অমূল্য গ্রন্থাবলি প্রকাশ হয়েছে। যৌবনে তিনি প্রবীণ এই আলেম-লেখককে দেখেছেন। তিনি ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য পেয়েছেন আরেক সাধক-আলেম মাওলানা নূর মুহাম্মাদ আজমী রাহ.-এর। তাঁদের জীবন, কাজ ও চিন্তার সঙ্গে তার পরিচয় গড়ে উঠেছিল। হযরত মাওলানা আতহার আলী রাহ., মাওলানা মুসলেহউদ্দীন রাহ.-এর স্নেহমাখা সংশ্রব ও তৎপরতার সঙ্গেও ছিলেন। তাঁকে বিংশ শতাব্দীর দুই অর্ধের ইসলামী সাহিত্য ও প্রকাশ্য ইসলামী কর্মকাণ্ডের একজন যোগসূত্র হিসেবে আখ্যা দেয়া যেতে পারে। চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাট দশকের বাংলায় ইসলামচর্চার সঙ্গে সত্তর-আশি-নব্বুইয়ের বাংলা ইসলামী সাহিত্যের সেতুবন্ধ তিনি রচনা করেছেন। বাংলা লেখালেখি ও সাহিত্য চর্চায় তাঁর বহু অনুজ ও সন্তানের যুগ চলছে এখন।
মাওলানা মুহিউদ্দীন খান বলতেন, বাংলাভাষায় ইসলামী পাঠোপকরণ ও পঠনসামগ্রি সরবরাহ করাই ছিল তাঁদের বড় সংগ্রাম ও প্রয়াস। অর্থাৎ বাংলায় পড়ার মতো ইসলাম বিষয়ক বেশি উপাত্ত-উপাদান তখন ছিল না। সে অবস্থা থেকে উত্তরণের নানামাত্রিক চেষ্টা তিনি এবং তাঁর যুগের মানুষেরা করেছেন। আজ তাফসীর, হাদীস, ফিকহ, সীরাত, আলোচনা, দর্শন, জীবনীসহ কত কত পৃথিবী বিখ্যাত কিতাবের বাংলা তরজমা পাঠকের হাতে। বাংলায় ইসলামী পাঠোপকরণের এই প্রাচুর্য গড়ে উঠেছে গত পঞ্চাশ বছরে। ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে। একা এবং দলবদ্ধ চেষ্টায়। ব্যক্তিগত প্রকাশনী, পেশাদার প্রকাশনী ও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক প্রকাশনী থেকে। এসবের পেছনে একটা অনুকূল আবহ নির্মাণ এবং স্বপ্নবান লেখক-অনুবাদক গোষ্ঠীর স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণা জাগ্রত করার বিষয় ছিল। সে ক্ষেত্রে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, তাঁর মাসিক মদীনা এবং সমকালীন অন্য ইসলামী লেখকদের একটি বড় রকম ভূমিকা ছিল। বাংলা ইসলামী সাহিত্যের আজকের যতটুকু সমৃদ্ধি তাঁর পেছনে সিঃসন্দেহে বহু কীর্তিমান মনীষী ও প্রতিষ্ঠানের মেহনত ও কৃতিত্ব অনস্বীকার্য। এসব কিছুর পাশাপাশি মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের প্রেরণা ও মাসিক মদীনার প্রভাবের বিষয়টিকেও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
। তিন।
নামের সঙ্গে তিনি নিজে ‘মাওলানা’ লিখতেন না। তাঁর পত্রিকায় ও বই-পত্রে আনুষ্ঠানিক নামের বেলায় লিখতেন শুধু ‘মুহিউদ্দীন খান’। কিন্তু মশহুর ছিলেন মাওলানা মুহিউদ্দীন খান নামে। ঢাকা আলিয়া থেকে তিনি কামেল পাশ করেছেন। এই ‘মাওলানা’ শব্দটির কারণে আলেম সমাজের সব অংশেই তার নামটি আপনত্বের অনুভূতি নিয়ে উচ্চারিত হতো। তাঁর আহরণ-যুগে এবং পরে কাজের যুগে দেশ-বিদেশের বড় বড় আলেম মনীষীদের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ যোগাযোগ ছিল। বৃহত্তর আলেমসমাজ তাঁকে তাদের একজন সক্রিয় প্রতিনিধি রূপে গ্রহণ করতেন। তার চিন্তা ও মতের ঝোঁক ছিল আকাবিরে দেওবন্দের অনুগামী। তাঁর বড় বড় অনুবাদকর্ম এ ধারার বুযুর্গদের কিতাবপত্রেরই। তাঁর রচনা ও প্রেরণায় আকাবির মনীষী আলেমদের ধারা ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব থাকতো বেশি। উঠাবসাও ছিল বৃহত্তর আলেমসমাজের সব রকম অংশের সঙ্গে। তিনি নিজে আলেম ছিলেন। ছিলেন আলেম সমাজেরই একজন। কিন্তু তাঁর আরেকটি রূপ ছিল আরো ব্যাপক। আলেম নন- এমন মুসলিম লেখক-সাহিত্যিক সাংবাদিকদেরও কাছের মানুষ ছিলেন তিনি। নবীন-প্রবীণ বহু লেখক-সাংবাদিক তার সান্নিধ্য পেয়েছেন। তারা অনেকেই জাতির গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক ইস্যুতে তাকে সহজগম্য অভিভাবক হিসেবে গণ্য করেছেন। এ দিক থেকে তিনি আলেম এবং আলেম নন- এমন মুসলিম লেখক সাংবাদিক সাহিত্যিক- উভয় ধারারই কাজ ও চিন্তার প্রতিনিধি ছিলেন।
মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রাহ. তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন তরজমা করেছেন। তরজমা সম্পাদনা করেছেন। সীরাতুন্নবী বিষয়ে বেশ কয়েকটি কিতাব নিজে তরজমা করেছেন। কিছু কাজ বিভিন্নজনকে দিয়েও করিয়েছেন। ফিকহের কিতাব তরজমা করেছেন। কুরআন শরীফ বিষয়ক রচনা ও সংকলনও করেছেন। এসব বিষয় নিয়ে মাসিক মদীনায় নিজে লিখেছেন। অন্যদেরকে দিয়ে লিখিয়েছেন। কিছু বিষয়ের উপর মদীনার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছেন। তবে তাঁর বিশেষ ঝোঁক ছিল মুসলমানদের সমৃদ্ধ ও বঞ্চনার ইতিহাস এবং মুসলমানদের অবদান নিয়ে লেখা প্রকাশের ব্যাপারে। বিশেষত পাক-ভারত উপমহাদেশ ও পূর্ববঙ্গের মুসলমান সমাজের ইতিহাস। এ বিষয়টা নিয়ে তার পড়াশোনা ও স্বতন্ত্র লেখালেখিও রয়েছে। এ বিষয়ে অন্যদেরও লিখতে অনুপ্রাণিত করতেন। এই অধমকেও একাধিকবার বালাকোটের অমর মুজাহিদ নোয়াখালীর ইমামুদ্দিন গাজী রাহ.-এর উপর মেহনত করে সবিস্তার লেখা তৈরির কথা বলেছেন। শমরিতা হাসপাতালে ২০১২ সালের দিকে একবার দেখা করতে গেলে বার বার এ প্রসঙ্গে লিখতে জোর দিয়েছেন। আরেকবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন। সে আরো আগে। দেখা করতে যাওয়ার জন্য খবর পাঠালেন। যাওয়ার পর পূর্ববঙ্গের কৃষক মুসলমানদের নিয়ে প্রয়াত নীরদচন্দ্র চৌধুরীর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের নানা বর্ণনা উল্লেখ করে বললেন, এসব লেখার উত্তর দেওয়া দরকার। এতদঞ্চলের মুসলমানদের অবদান, বঞ্চনা এবং তাদের ওপর ব্রিটিশ ও হিন্দু জমিদারদের উৎপীড়ন নিয়ে লেখার জন্য তোমরা প্রস্তুতি নাও। আমরা করে যেতে পারলাম না। তাঁর ‘জীবনের খেলাঘরে’ বইটিতে এ প্রসঙ্গটি নিয়ে অল্পসল্প লিখেছেন।
। চার।
মাসিক মদীনার সম্পাদকের দায়িত্বে থেকেই তিনি দেশ-বিদেশের বিচিত্র কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছেন। সব কাজের সঙ্গেই ছিল ইসলাম ও মুসলমানের সম্পৃক্ততা। রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক বহু প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হয়েছেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মূল প্রতিষ্ঠান- ইসলামিক একাডেমী প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে তিনি যুক্ত ছিলেন। রাবেতাতুল আলাম আলইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। মুতামারুল আলাম আলইসলামীর সদস্য ছিলেন। জাতীয় সীরাত কমিটি গঠন করে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশে নাস্তিক-মুরতাদ বিরোধী মোর্চা গঠিত হলে তিনি হয়েছেন সভাপতি। হযরত মুফতী ফজলুল হক আমিনী রাহ. হয়েছিলেন মহাসচিব। তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নির্বাহী সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন কিছুদিন। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ বন্ধের দাবিতে লংমার্চ করেছেন। জীবনের শেষদিকে বিভিন্ন ইসলামী দাবিতে উলামা-মাশায়েখ সংগ্রাম পরিষদ ও সর্বদলীয় ইসলামী ঐক্যের ব্যানারে বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়েছেন। বিভিন্ন সময় সতর্কীকরণমূলক বক্তব্য রেখেছেন। যৌবনকালে হযরত মাওলানা আতাহার আলী রাহ.-এর নেতৃত্বে তৎকালীন নেজামে ইসলামীতেও শ্রম দিয়েছেন। মূলত তাঁর জীবনে বহুমুখি রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সম্পৃক্ততার আধিক্য দেখা দেয় শেষ দশ-বারো বছর। তখন তাঁর বিকাল থেকে রাত ৯-১০টা কেটে যেত পুরানা পল্টনে নোয়াখালী টাওয়ারের দোতলার অফিসে। নানা দল ও শ্রেণীর মানুষ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। আর তাঁর অফিসের বর্ধিত অংশের একটি বড় কামরায় বিভিন্ন সভা-সেমিনার অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু এসবই ছিল তাঁর সংগঠন-প্রোগ্রাম ও রাজনৈতিক কর্মকা-বহুল শেষ দশ-বারো বছরের কথা। এর আগের চিত্র ছিল অন্য রকম।
আশি ও নব্বুইয়ের দশকে ৩৮ বাংলাবাজারের মদীনা অফিসে মাসের বেশিরভাগ দিন তার দিনমানের রুটিন ছিল প্রায় একই রকম। সকাল নয়টা-দশটায় দোতলায় নিজের কামরায় এসে বসতেন। বড় টেবিলের ওই পাশে ছিল তাঁর চেয়ার। একটানা যোহর পর্যন্ত লেখালেখি। প্রসঙ্গ এলে পাশের রেক থেকে নামিয়ে কিতাব দেখা। অফিসের তিনতলা/চারতলায় জামাতের ব্যবস্থা ছিল। যোহরের পর খানা খেয়ে ভেতরের কামরায় বিশ্রাম। আবার আসরের পর। আবার মাগরিবের পর। লেখা, লেখা-দেখা, ডজন ডজন চিঠিপত্র খুলে খুলে পড়া। কোনো কোনোটার উত্তর লেখা। একটা কলম ছিল এমন- একপাশে কলম, অপর পাশে ছুরির মতো। ডাকে আসা চিঠির খামের কিনারা কেটে চিঠি বের করতেন নিজেই। কলমের অপর অংশ দিয়ে লিখতেন। কাজের সময় তাঁর কম কথা, অনুচ্চ স্বর। এর মধ্যেই কেউ কেউ দেখা করতে আসতেন। ঢাকার ভেতর থেকে, ঢাকার বাইরে থেকেও। প্রবীণ-নবীন। আলেম-সাধারণ শিক্ষিত। বিচিত্র মেযাজ ও বয়সের। বিচিত্র স্বপ্ন ও পেরেশানির। তিনি তাদের কথা শুনতেন। হিম্মত দিতেন। সান্ত¡না দিতেন। আবার পরের মুহূর্তেই কাজে ডুবে যেতেন। যতদূর মনে পড়ে, বলপেন নয়- কালির কলমেই লিখতেন। জীবনে বহু মানুষের বহু ব্যক্তিগত চিঠির তিনি জবাব দিয়েছেন। টেবিলে বসে কিছু চিঠির জবাব মাসিক মদীনার ‘প্রশ্নোত্তর’ বিভাগে দিতেন। আর প্রায় প্রতিদিনই কিছু চিঠির জবাব ব্যক্তিগত পর্যায়ে দিতেন। নিজের হাতে লিখতেন, খামে ভরতেন। সেই চিঠিতে উত্তর থাকতো, পরামর্শ থাকতো, সান্ত¡না থাকতো, হিম্মত আফযায়ী থাকতো। অধমের কাছেও এমন চিঠি আছে। ধারণা করা যায়, তাঁর লেখা এ ধরনের চিঠির সংখ্যাও হবে কয়েক হাজার।
। পাঁচ।
তাঁকে কাছ থেকে দেখার শুরু একানব্বই-বিরানব্বই সালে। ‘মুসলিম জাহান’-এ লেখা দিতে যেতাম। একসময় সেখানে কাজে যোগ দিলাম। সর্বকনিষ্ঠদের একজন হিসেবে। আমি নবিশ লেখক-অনুবাদক। তিনি সেখানে সবার অভিভাবক। কোনো কাজের জন্য আমাকে পর্যন্ত ডাকার তাঁর কোনো প্রয়োজন পড়ে না। কিংবা তার কাছে যাওয়ার আমারও কোনো উপলক্ষ দাঁড়ায় না। এর মধ্যেও মাঝে-মধ্যে ডেকে এটা ওটা লিখতে বলতেন। কখনো কখনো লেখা দেখাতেও নিয়ে যেতাম। সে সময়ের অনেক কথা মনে পড়ে। একবার দিল্লী থেকে প্রকাশিত উর্দূ ‘নঈ দুনিয়া’ থেকে একটি লেখা অনুবাদ করে নিয়ে গেলাম। সেটি ছিল ভারতের উগ্র হিন্দুদের আক্রমণাত্মক বিভিন্ন ঘটনার ওপর একটি প্রতিবেদন। লেখার কয়েকটি বাক্যাংশে ছিল ‘হিন্দুরা’ জাতীয় ব্যাপক শব্দ। তিনি বললেন, এসব ক্ষেত্রে ‘একশ্রেণীর উগ্র হিন্দুরা’ লেখবে; ঢালাওভাবে কোনো সম্প্রদায়কে তিরস্কার না করে ‘একশ্রেণীর’ শব্দটি যুক্ত করে দেবে। আরেকবার একটি প্রতিবেদনের শব্দে শব্দে অনুবাদ এবং সে অনুবাদের বিড়ম্বনা ও অস্পষ্টতা দেখে তিনি বললেন, অনুবাদের ক্ষেত্রে বিষয়টা নিজে বুঝে নিজের মতো অনুবাদ করবে বা মর্মটা স্পষ্ট করে স্বাধীনভাবে লিখবে। শুধু নস (কুরআন-হাদীস)-এর অনুবাদ শব্দে শব্দে করবে। সেখানে কোনো স্বাধীনতা প্রয়োগ করবে না। এরকম বহু টুকরো টুকরো উপদেশ ও নির্দেশনা তার কাছ থেকে লাভ করার সুযোগ হয়েছে। বছর দুয়েক মদীনা ভবনে তাঁর ছায়ায় কাজের সে সুযোগটি ছিল নিঃসন্দেহে আমার জীবনের এক সোনালি অধ্যায়। অবশ্য এর পরের বিশ-বাইশ বছরেও বহুবার বহু জায়গায় যখনই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে তাঁর স্নেহ ও শফকতের পরশ পেয়ে ধন্য হয়েছি।
দেখতে তো তিনি সুন্দর ছিলেন। কথাও বলতেন সুন্দর করে। ঘরোয়া আলাপের সময় মিটিমিটি হেসে কথা বলতেন। একইসঙ্গে অত্যন্ত সিরিয়াস এবং রসবোধসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। কখনো কখনো অত্যন্ত জোরালো ভাষায় ভিন্নমত ব্যক্ত করতেন। বিভিন্ন অঞ্চলের পরিচিত মানুষ দেখা করতে এলে রসিকতা করে তাদের আঞ্চলিক ভাষায় দু-চারটা বাক্যও বলতেন। বক্তব্য দিতেন অত্যন্ত দৃঢ় ও সুগঠিত ভাষায়। নব্বুইয়ের দশকে যখন তিনি প্রৌঢ়, অত্যন্ত জলদ গম্ভীর স্বরে বক্তব্য দিতেন। বিষয় ও শব্দের দ্যোতনায় উপভোগ্য হয়ে উঠতো তাঁর কথা ও স্বর। প্রধানত লেখক-সম্পাদক ছিলেন; কিন্তু তাঁর স্বভাবে ছিল সংগঠক ও মজলিসী-দরবারী একটা আমেজ। মমতা, আবেগ, রাগ, স্নেহ, পৃষ্ঠপোষকতা, কাছে টানা, হিম্মতদান এবং অভিভাবকসুলভ চাপা নির্বিকারত্ব- সবই ছিল তাঁর মধ্যে। মদীনার পাঠকদের যে কারো ব্যক্তিগত যোগাযোগকেও তিনি খুব গুরুত্ব দিতেন। ইসলামী অঙ্গনের সংগঠন ও রাজনৈতিক তৎপরতার পরিণতিহীনতায় তিনি আক্ষেপ করতেন। ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষীদের যে কোনো অপতৎপরতার জবাব দেয়ার জন্য বিভিন্ন উপায় খুঁজতেন। জীবন যাপন ও চলাফেরায় তিনি ছিলেন বড় মাপের একজন মানুষ।
। ছয়।
তাঁর সাথে শেষ সাক্ষাৎ হয়েছে সম্ভবত তাঁর বাসায়। বছর দুয়েক আগে। এরও আগে একটি সাক্ষাৎ হয়েছে পান্থপথ শমরিতা হাসপাতালে। সে সাক্ষাতে আমি ছিলাম মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-এর আমীনুত তালীম ও মাসিক আলকাউসারের তত্ত্বাবধায়ক মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেবের সাথে। তাঁকে না জানিয়ে দূর থেকে ফোনে খোঁজ নিয়ে আমরা হাজির হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের দেখেই তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন। বিছানায় শুয়েই প্রায় দেড়ঘণ্টার মতো নানা বিষয়ে কথা বললেন। দু’য়েকটি বিষয়ে স্মৃতি একটু অস্পষ্ট হয়ে পড়েছে বলে মনে হচ্ছিল। বেশিরভাগ কথাই ছিল স্পষ্ট ও উজ্জীবনমূলক। মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেবের সঙ্গে কথা বলার সময় নব্বুইয়ের দশকে তাঁর পাকিস্তান সফর এবং ঢাকার প্রাচীন দুয়েকটি হারিয়ে যাওয়া কুতুবখানা নিয়ে অনেক কথা বললেন। এবং এক পর্যায়ে আশা প্রকাশ করে বললেন, সুস্থ হলে হযরতপুর মারকাযুদ দাওয়ার মাকতাবা তিনি দেখতে যাবেন। সেদিন আমরা চলে এলাম। এরপরের কিছু দেখা সাক্ষাৎ ছিল সংক্ষিপ্ত ও অন্যদের উপস্থিতিতে। নিরবচ্ছিন্ন সুস্থতা আর আসেনি তাঁর। মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেব অবশ্য আমাকে হুকুম করেছিলেন বার বার। যেন সময় নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করি। যেন ইতিহাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করার চেষ্টা করি। যেন হযরতপুর মারকাযে সফরের বিষয়ে ফিকির করি। কিন্তু কিছুই করা হয়নি। আক্ষেপের মধ্যেই, ব্যর্থতার মধ্যেই আমার সময় পার হয়েছে। এরপর তিনি যখন শেষবার হাসপাতালে, তখন তিনি কেবলই অচেতন, তখন তিনি কেবলই ঘুমন্ত। অস্থিতিশীল স্বাস্থ্যের নিবিড় পরিচর্যার বহু যন্ত্রপাতির মধ্যে নিথর শায়িত।
১৯ রমযান ১৪৩৭ হি. ইফতারের আগ মুহূর্তে শোকের খবর। রাতে অনেক দৃশ্যই মনের আয়নায় ভীড় করলো। হযরত খতীব উবায়দুল হক রাহ., হযরত শায়খুল হাদীস আজিজুল হক রাহ., হযরত মুফতী আমিনী রাহ., হযরত মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রাহ. সবাই চলে গেলেন। এ মানুষগুলোকে একসঙ্গে একসময়ে ঢাকায় দেখেছি। বছরের পর বছর। দেখেছি আরো অনেক মনীষীকে। কথাবলায়, পথচলায়, দ্বীনের জন্য। তাঁরা কেউ এখন নেই। একটা কাফেলাই যেন গায়েব হয়ে গেছে উপত্যকা ছেড়ে। অনুভূতি বড় ভয়ের, অনুভূতি বড় শূন্যতার। ২০ রমযান যোহরের নামাযের পর অশ্রুভেজা এক জানাযা। কম্পিত গলায় ইমাম সাহেব তাকবীর দিলেন। হৃদয়টা হাহাকার করে উঠলো। মুহূর্তেই দুচোখ ঝাপসা হয়ে গেল।
এরপর কাঁচের আড়াল থেকে তাঁকে একবার শুধু দেখলাম। হায়, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান চলেই গেলেন। রেখে গেলেন বাংলাভাষায় ইসলামী পাঠোপকরণ সরবরাহের একটি সংগ্রাম, কর্মের একটি ভুবন, কলমচর্চার একটি যুগ। রহমাতুল্লাহি আলাইহি।