প্রসঙ্গ : গুলশান-হত্যাকাণ্ড : “সর্বস্তরে দ্বীনী তালীমের বিস্তার ঘটানো সময়ের দাবি” : “কোনো অমুসলিমকে শুধু অমুসলিম হওয়ার কারণে হত্যা করা বৈধ নয়” : “জিহাদের সঠিক ব্যাখ্যা মুসলমানদের জানানো উচিত। এটি নিষিদ্ধ করলে সমস্যার সমাধান হবে না।”
গত রমযানুল মুবারকের শেষের দিকে গুলশানের একটি রেস্তোরায় হামলা ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। একদিকে যেমন ঘটনাটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারিত হয়েছে অন্যদিকে এ ঘটনার পর খোদ দেশে ধর্ম ও ধার্মিকতার বিষয়েও ভীতি, শংকা ও সন্দেহ-সংশয়ের আবহ তৈরি হয়েছে। কোনো কোনো জায়গা থেকে অনভিপ্রেত নানা সংবাদও আসছে। এ পরিস্থিতিতে বিষয়টির সঠিক মূল্যায়ন সর্বশ্রেণির মানুষের সঠিক করণীয় জানতে আমরা মুখোমুখি হয়েছিলাম মাসিক আলকাউসারের সম্পাদক, মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-এর মুদীর হযরত মাওলানা মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ছাহেব ও আলকাউসারের তত্ত্বাবধায়ক ও মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-এর আমীনুত তালীম হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব দামাত বারাকাতুহুমের। সাক্ষাৎকারটিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অতি প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণ এবং করণীয় সম্পর্কে দিক-নির্দেশনা রয়েছে।
সাক্ষাৎকার গ্রহণে : মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ ও মুহাম্মাদ ওলীউল্লাহ আব্দুল জলীল
প্রশ্ন : সম্প্রতি গুলশান হলি অর্টিজান রেস্তোরায় হামলার ঘটনাটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে এবং হচ্ছে। নানামুখী কথাবার্তা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আসছে। আপনাদের কাছে জানতে চাচ্ছি, একজন ইসলামপ্রিয় মুসলমানের এ ঘটনার মূল্যায়ন কীভাবে করা উচিত।
উত্তর : গুলশানের ঘটনার পর আরো ঘটনা ঘটেছে। শোলাকিয়াতেও ঘটেছে। একজন সাধারণ মুসলমানও ইসলামের সাধারণ জ্ঞান থেকে বোঝেন, কারো প্রাণ নেয়া ইসলামের বিধানে কত ভয়াবহ পাপ। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَ مَنْ یَّقْتُلْ مُؤْمِنًا مُّتَعَمِّدًا فَجَزَآؤُهٗ جَهَنَّمُ خٰلِدًا فِیْهَا وَ غَضِبَ اللهُ عَلَیْهِ وَ لَعَنَهٗ وَ اَعَدَّ لَهٗ عَذَابًا عَظِیْمًا .
যে ব্যক্তি কোনও মুসলিমকে জেনেশুনে হত্যা করবে, তার শাস্তি জাহান্নাম, যাতে সে সর্বদা থাকবে এবং আল্লাহ তার প্রতি গযব নাযিল করবেন ও তাকে লানত করবেন। আর আল্লাহ তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন। -সূরা নিসা (৪) : ৯৩
হাদীস শরীফে সুস্পষ্ট বলা হয়েছে-
لا يحل دم امرئ مسلم إلا بإحدى ثلاث : رجل زنى بعد إحصانه فعليه الرجم، أو قتل عمدا فعليه القَوَد، أو أرتد بعد إسلامه فعليه القتل.
অর্থাৎ তিন কারণের কোনো একটি ব্যতীত কোনো মুসলিমের রক্ত হালাল হয় না; যদি বিবাহিত ব্যক্তি যিনা করে তবে তাকে প্রস্তর নিক্ষেপ করে হত্যা করা হবে অথবা যে ইচ্ছাকৃত কাউকে হত্যা করে তাকে হত্যার বদলে হত্যা করা হবে অথবা যে ইসলাম গ্রহণ করার পর মুরতাদ হয়ে যায় তাকে হত্যা করতে হবে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৪৫২ ও ৪৩৭; সুনানে নাসায়ী ৭/১০৩; আরো দেখুন, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৩৬২১; সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৮৭৮, কিতাবুদ দিয়াত, অধ্যায় ৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬৭৬, কিতাবুল ক্বসামাহ, অধ্যায় ৬
এটা তো অবশ্য সবাই জানে যে, এসব অপরাধের শাস্তি (হদ বা কিসাস) বাস্তবায়ন করা ক্ষমতাসীন দায়িত্বশীলদের কাজ।
ইসলামী শরীয়তে শুধু মুসলিমকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হারাম তা নয়, যে কোনো মানুষকে সে মুসলিম হোক বা অমুসলিম, অন্যায়ভাবে হত্যা করা হারাম। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে-
مِنْ اَجْلِ ذٰلِكَ كَتَبْنَا عَلٰی بَنِیْۤ اِسْرَآءِیْلَ اَنَّهٗ مَنْ قَتَلَ نَفْسًۢا بِغَیْرِ نَفْسٍ اَوْ فَسَادٍ فِی الْاَرْضِ فَكَاَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِیْعًا وَ مَنْ اَحْیَاهَا فَكَاَنَّمَاۤ اَحْیَا النَّاسَ جَمِیْعًا وَ لَقَدْ جَآءَتْهُمْ رُسُلُنَا بِالْبَیِّنٰتِ ثُمَّ اِنَّ كَثِیْرًا مِّنْهُمْ بَعْدَ ذٰلِكَ فِی الْاَرْضِ لَمُسْرِفُوْنَ.
এ কারণেই আমি বনী ইসরাঈলের প্রতি ফরমান লিখে দিয়েছিলাম, কেউ যদি কাউকে হত্যা করে এবং তা অন্য কাউকে হত্যা করার কারণে কিংবা পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তারের কারণে না হয় তবে সে যেন সমস্ত মানুষকে হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কারও প্রাণ রক্ষা করে, সে যেন সমস্ত মানুষের প্রাণ রক্ষা করল। বস্তুত আমার রাসূলগণ তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী নিয়ে এসেছে, কিন্তু তারপরও তাদের মধ্যে বহু লোক পৃথিবীতে সীমালংঘনই করে যেতে থাকে। -সূরা মায়িদা (৫) : ৩২
আরো ইরশাদ হয়েছে-
وَ لَا تَقْرَبُوا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَ مَا بَطَنَ وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِیْ حَرَّمَ اللهُ اِلَّا بِالْحَقِّ ذٰلِكُمْ وَصّٰىكُمْ بِهٖ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُوْنَ .
আর তোমরা প্রকাশ্য হোক বা গোপন কোনও রকম অশ্লীল কাজের নিকটেও যেও না আর আল্লাহ যে প্রাণকে হত্যা করা হারাম করেছেন তাকে যথার্থ কারণ ছাড়া হত্যা করো না। হে মানুষ! এই হচ্ছে সেই সব বিষয়, যার প্রতি আল্লাহ গুরুত্বারোপ করেছেন, যাতে তোমরা উপলদ্ধি কর। -সূরা আনআম (৬) : ১৫১
হাদীস শরীফের পরিষ্কার ঘোষণা-
مَنْ قَتَلَ مُعَاهَدًا فِي غَيْرِ كُنْهِه حَرَّمَ الله عَلَيْهِ الْجَنَّةَ.
অর্থাৎ যে কোনো মুআহাদকে অন্যায়ভাবে হত্যা করবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২০৩৭৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৬০; সুনানে নাসায়ী ৮/২৪-২৫
অন্য হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-
مَنْ قَتَلَ نَفْسًا مُعَاهَدًا لَمْ يَرِحْ رَائِحَةَ الجَنَّةِ، وَإِنَّ رِيحَهَا لَيُوجَدُ مِنْ مَسِيرَةِ أَرْبَعِينَ عَامًا.
অর্থাৎ যে কেউ কোনো মুআহাদকে হত্যা করল সে জান্নাতের খুশবুও পাবে না। অথচ জান্নাতের খুশবু চল্লিশ বছর দূরের রাস্তা থেকেও পাওয়া যাবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৯১৪ কিতাবুদ দিয়াত, অধ্যায় ৩০
মুআহাদ বলতে যে বা যাদের সাথে আহ্দ বা চুক্তি হয়েছে তাদেরকে বুঝায়। ফিকহী ভাষায় সে যিম্মি হোক বা সুলাহকারী মুআহাদ বা মুসতা’মান (আশ্রয় গ্রহণকারী)। যারা মুসলিম দেশে ভিসা নিয়ে অন্য ভাষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে থাকছে তারা যে মুআহাদের অন্তর্ভুক্ত এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
আলী রাযিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি এ ধরনের অমুসলিমদের ব্যাপারে বলেছেন-
مَنْ كَانَ لَهُ ذِمَّتُنَا فَدَمُهُ كَدَمِنَا، وَدِيَتُهُ كَدِيَتِنَا.
অর্থাৎ যার সঙ্গে আমাদের আহদ বা চুক্তি রয়েছে তার জান আমাদের জানের মত এবং তার দিয়ত (রক্তপণ) আমাদের দিয়তের পরিমাণ। -কিতাবুল হুজ্জাহ আলা আহলিল মাদীনা, ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান, ৪/৩৫২-৩৫৫; মুসনাদে শাফেয়ী ১৬১৯
সুতরাং শরীয়তে যেসব কারণে প্রাণদণ্ডের বিধান রয়েছে ঐসব কারণ সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত হওয়া ছাড়া কাউকে হত্যা করা বৈধ নয়। অমুসলিমের ক্ষেত্রেও এই বিধান প্রযোজ্য। সুতরাং কোনো অমুসলিমকে শুধু অমুসলিম হওয়ার কারণে হত্যা করা বৈধ হয় না।
প্রশ্ন : ইসলামে যে অমুসলিমের সাথে মুসলিমের নিরাপদ সহাবস্থানের নীতি ও বিধান আছে তা তো একটি স্বতঃসিদ্ধ বিষয়। যে কথাগুলো আপনি সরাসরি কুরআন-সুন্নাহ থেকে বললেন তা তো শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এমন মূলনীতি, যা সম্পূর্ণ ইনসাফপূর্ণ। আমি এ বিষয়ে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগের প্রায়োগিক কোনো নমুনা এবং নির্ভরযোগ্য কোনো উদ্ধৃতি জানতে চাচ্ছি।
উত্তর : মদীনা সনদই দেখুন। মদীনার ইহুদীদের সাথে মুসলিমদের চুক্তির ধারাগুলোতে এটা পরিষ্কার। ইহুদীদের পক্ষ থেকে চুক্তিলংঘন ও বিশ্বাসঘাতকতার আগ পর্যন্ত বেশ কয়েক বছর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীগণ ঐ চুক্তি হরফে হরফে মেনে চলেছেন। তবে হাঁ, এখানে দু’টো দিকই পরিষ্কারভাবে আছে। মুসলিম-সমাজে বসবাসকারী অমুসলিমের অধিকার বা জান-মালের নিরাপত্তার প্রসঙ্গও যেমন আছে তেমনি তাদের দায়িত্ব-কর্তব্যের বিষয়টিও আছে। ইসলামে সহাবস্থানের যে বিধান আছে তা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং উভয় পক্ষের দায়িত্ব ও অধিকার ভিত্তিক সহাবস্থান। এতে অমুসলিম যেমন মুসলিম-সমাজে জান-মালের নিরাপত্তা লাভ করবে তেমনি ইসলাম ও মুসলমানের অধিকার সম্পর্কেও তাকে সচেতন থাকতে হবে। ইসলামের অবমাননা, ইসলামী শাআইরের অবমাননা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। সারকথা এই যে, উভয় পক্ষের দায়িত্ব ও অধিকার ভিত্তিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ইসলামে রয়েছে। মদীনা সনদে এই বিষয়ে বার বার তাকীদ করা হয়েছে এবং তার শেষ কথাও তাই। বলা হয়েছে-
وأنه لا يحول هذا الكتاب دون ظالم أو آثم، وأنه من خرج آمن ومن قعد آمن بالمدينة إلا من ظلم أو إثم، وأن الله جار لمن بر واتقى، ومحمد رسول الله.
-আসসিরাতুন নাবাবিয়্যাহ, ইবনে হিশাম, (২১৮ হি.) ২/১৪৬; কিতাবুল আমওয়াল, আবু উবাইদ কাসিম ইবনে সাল্লাম (২২৪ হি.) ১/৩০৯ বর্ণনা ৫৩০; কিতাবুল আমওয়াল, ইবনে যানজুইয়া (২৫১ হি.) ১/৩৯৭ বর্ণনা ৭৫০; মাজমুআতুল ওয়াসাইকিস সিয়াসিয়্যাহ, ড. হামীদুল্লাহ, পৃষ্ঠা : ৫৭-৬৪
প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, আমাদের আলিম-উলামা অন্য ধর্মাবলম্বীদের অধিকার রক্ষার বিষয়ে আগে থেকেই বলে আসছেন, লিখে আসছেন। তারা বিষয়টি সাধারণভাবেও আলোচনা করেন, বিশেষ ঘটনা বা প্রেক্ষাপট তৈরি হলেও করেন। আমরা মনে করি এই অনুশীলন শুধু মুসলিম আলিম-উলামার মধ্যে সীমিত না থেকে অমুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেও বিস্তার লাভ করা প্রয়োজন।
কোনো অমুসলিমের মাধ্যমে ইসলাম অবমাননার কোনো ঘটনা ঘটলে ঐ ধর্মের ধর্মগুরু ও সামাজিক নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকেও এর প্রতিবাদ হওয়া উচিত। যা সাধারণত দেখা যায় না। এই সংস্কৃতিটা এখন গড়ে ওঠা প্রয়োজন। মসজিদে মসজিদে যদি হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষার আলোচনা কাম্য হয় তাহলে মন্দিরে মন্দিরে, গির্জায় গির্জায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের ধর্মানুভূতি এবং ধর্মীয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা রক্ষার আলোচনাও কাম্য। অন্যথায় বিষয়টা একতরফা হয়ে যায়, যা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পক্ষে অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধকতা ও যৌক্তিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।
প্রশ্ন : আপনার জবাবের সূত্র ধরেই প্রশ্ন করতে চাই যে, আলোচিত ঘটনা বা ঘটনাগুলোর প্রকৃত কারণ বা অন্যতম কারণ কী বলে মনে করেন, যে সম্পর্কে সচেতনতা আমাদের সামাজিক শান্তির পক্ষে সহায়ক হতে পারে?
উত্তর : খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছেন। সমস্যার কারণ সঠিকভাবে চিহ্নিত না করার একটা খুব মন্দ কালচার আমাদের এখানে চালু রয়েছে। এই যে আলোচিত সমস্যা যেটাকে সাধারণত সন্ত্রাস বা ‘জঙ্গিবাদ’ নামে চিহ্নিত করা হয়, একসময় বলা হয়েছে এর কারণ, দারিদ্র্য ও দারিদ্র্যজনিত বঞ্চনার অনুভূতি। আবার দ্বীনী মাদরাসাগুলোকে ঢালাওভাবে আক্রমণ করে বলা হয়েছে, ‘কওমী মাদরাসা জঙ্গি প্রজনন কেন্দ্র’। কিন্তু আলোচিত ঘটনায় সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্রই দেখা যাচ্ছে। জড়িতরা উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান এবং বিভিন্ন নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র। আসলে বাস্তবতা সঠিকভাবে উপলব্ধি না করে পশ্চিমাদের দর্শন ও বুলি আউড়ে যাওয়া এবং পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্য-প্রণোদিত প্রচারণা একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়া-কর্মীর নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু সাম্প্রতিক ঘটনাটিই কেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন সংগঠন যেগুলোকে আমাদের মিডিয়া অনুক্ষণ জঙ্গি ও সন্ত্রাসী সংগঠন বলে যাচ্ছে, এসবের কর্ণধারদের অনেকেই তো জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত। এরপরও ঐসব প্রচারণা হয়েছে। আমরা এ জাতীয় ঢালাও সমীকরণে বিশ্বাসী নই। আমরা কওমী মাদরাসাকে জঙ্গি প্রজনন কেন্দ্র বলা যেমন অন্যায় ও ভুল মনে করি তেমন কেউ যদি এখন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোকে বা প্রাইভেট ভার্সিটিগুলোকে জঙ্গি প্রজনন কেন্দ্র বলেন কিংবা উচ্চ বিত্ত পরিবারের দ্বীনদার ছেলেগুলোকে ঢালাওভাবে সন্ত্রাসী আখ্যা দেন সেটাকেও আমরা ভুল ও অন্যায় মনে করি।
এ জাতীয় ঢালাও সমীকরণে সমস্যার কোনো সমাধান হবে বলে মনে হয় না।
একটি বিষয় লক্ষ্য করুন। সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী যে ঘটনাগুলো ঘটে চলেছে এ জাতীয় ঘটনা-পরম্পরা কিন্তু ইরাক ট্রাজেডির আগে এভাবে দেখা যায়নি। ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন আগ্রাসন এবং লক্ষ লক্ষ মুসলিমের রক্ত ও সম্ভ্রমহানী সমসাময়িক ইতিহাসের এক নযীরবিহীন ও হৃদয়বিদারক ঘটনা। অথচ গোটা বিশ্ব তখন নিরব থেকেছে। যেমন লক্ষ লক্ষ মুসলিমের রক্ত ও সম্ভ্রমের কানা কড়ি মূল্যও নেই, বিশ্বব্যাপী কোটি মুসলমানের ক্ষোভ ও যন্ত্রণারও কোনো তোয়াক্কা নেই। আরো ট্রাজেডি হচ্ছে, মুসলিম দেশগুলোর কর্ণধারদের পর্যন্ত সাধারণ মুসলমানদের এই যন্ত্রণা বোঝার সময়-সুযোগ নেই। ঐ সময় তো কোনো কোনো মুসলিম দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ইঙ্গ-মার্কিন জোটে অংশগ্রহণও করেছিল। মোশাররফ, কারজাই, মালেকীর মতন শাসকেরা তো শুধু যুদ্ধবাজ বুশ-ব্লেয়ারের সঙ্গই দেয়নি বরং নিজ নিজ দেশে অতি উৎসাহে দ্বীনদার মুসলমানদের হত্যা ও হয়রানী করেছে। এই পরিস্থিতিতে যদি দেশে দেশে মুসলিম তারুণ্য প্রতিশোধস্পৃহায় জেগে ওঠে এবং বিক্ষিপ্ত প্রতিকার চেষ্টার সূচনা ঘটে যায় তাহলে একে ভুল শুদ্ধ যা-ই বলা হোক, অস্বাভাবিক তো বলা যায় না। অথচ কী অপরাধ ছিল ইরাকী মুসলমানদের? কিছুদিন আগে বৃটেনের এক নিরপেক্ষ সরকারি তদন্তের পর এই স্বীকারোক্তি এসেছে যে, ইরাক অভিযান ভুল ছিল। আর জর্জ ডব্লিউ বুশের সাথে টনি ব্লেয়ারের ইরাক-আগ্রাসনে জড়িত হওয়া ছিল অতি বড় ভুল ও অন্যায়। সম্পূর্ণ হত্যাকা-টিই হয়েছে মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে (নাকি মিথ্যা তথ্য সাজিয়ে; আল্লাহই ভাল জানেন)
কিন্তু দেখুন! একটি গোটা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এত বড় অন্যায়ের পরও কোথাও কোনো আলোচনা নেই, ধিক্কার নেই। না বিশ্ব মিডিয়ায়, না ‘আমাদের’ মিডিয়ায়। মুসলিম দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধান, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ কোথাও কোনো সাড়া শব্দ নেই। জাতিসংঘ নিশ্চুপ, মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তেমন কোনো শব্দ নেই, কোনো আন্তর্জাতিক আদালতে বুশ-ব্লেয়ারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচারও শুরু হয়নি। যেন লক্ষ মুসলিমের প্রাণহানী-সম্ভ্রমহানীতে কিছুই যায় আসে না। একটি গোটা মুসলিম ভূখ- তছনছ হয়ে যাওয়াও কোনো ব্যাপারই নয়? বলুন, এ অবস্থার পরিরর্তন ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি কীভাবে সম্ভব?
মনে রাখতে হবে, এধরনের পরিস্থিতি জিইয়ে রাখলে কিছু আবেগী মুসলিম তরুণ-যুবক এ ধরনের কাজ করেই যাবে উলামায়ে কেরাম, মুফতীগণ ও মুরুব্বীদের ধৈর্যের নসীহতে হয়ত তারা কর্ণপাতও করবে না।
তো যে কথাটি বলতে চাই তা হচ্ছে, অন্তত মুসলিম নেতৃবৃন্দকে হতে হবে আত্মমর্যাদাশীল এবং স্বধর্ম ও স্বজাতির প্রতি মমতাশীল। সাধারণ মুসলমানের আবেগ অনুভূতির মূল্য দেয়া শিখতে হবে। এবং দেশে দেশে মুসলিম নিধন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে এর প্রতিবাদ জানাতে হবে। স্বদেশী মুসলমানের ধর্মীয় আবেগকে বুঝতে হবে এবং এর মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। ধামাচাপা দেওয়া গোছের বা বলপ্রয়োগে অবদমিত রাখার কোনো পদক্ষেপের পরিবর্তে রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা, সহিষ্ণুতা ও দূরদর্শিতার মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলায় সচেষ্ট হতে হবে।
প্রশ্ন : জাযাকাল্লাহু খাইরান। আপনি খুবই বাস্তবদর্শী আলোচনা করেছেন। এটাও তো সম্ভব যে, সহানুভূতি ও প্রতিকার বঞ্চিত আক্রান্ত মানুষগুলো অন্যদের দ্বারাও পরিচালিত হতে পারে...?
উত্তর : জী, হতে পারে। ইসলাম-বিদ্বেষী কুফফার গোষ্ঠী তো গোটা পৃথিবীতেই ইসলামকে ও ইসলামের জিহাদকে নিন্দিত ও সমালোচিত করতে সচেষ্ট এবং সব ধরনের সুযোগ ও পরিস্থিতি ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত। ইসলামের ছদ্মবেশ ধারণ করে নানা ঘটনার মাধ্যমে ইসলামকে ক্ষতিগ্রস্ত করার মিশন তো বিশ্বজুড়েই চলছে। খোদ আমেরিকায় এফবিআইয়ের ফাঁদে পা দিয়ে অনেক মুসলিম যুবকের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার নানা উদাহরণ তো অনেকেরই জানা। যাই হোক, এগুলোও বাস্তবতারই অংশ। তাই সর্তকতা কাম্য।
প্রশ্ন : এই নানামাত্রিক জটিলতাপূর্ণ পরিস্থিতিতে সঠিক পথে থাকার জন্য সাধারণ মুসলমান, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের কর্তব্য কী?
উত্তর : তরুণ প্রজন্মের কর্তব্যের আগে জিজ্ঞাসা করুন, বাবা-মা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের কর্তব্য কী? দেখুন, ইসলাম হচ্ছে আল্লাহপ্রদত্ত দ্বীন। ইসলামের প্রতি অনুরাগ মানুষের স্বভাবজাত। এই স্বভাব-ধর্মের দিকে মানুষ ধাবিত হবেই, বিশেষত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারী, মুসলিম-সমাজে লালিত পালিত তরুণটি এর দিকে আকৃষ্ট না হয়ে পারে না। সুতরাং কোনো না কোনো উপায়ে সে ইসলাম সম্পর্কে জানবে, জানার চেষ্টা করবে- এটাই স্বাভাবিক। অথচ দেখুন, আমাদের সমাজের অবস্থা এই যে, না পরিবারগুলোতে সঠিক দ্বীন শিক্ষার ব্যবস্থা আছে, না জাতীয় শিক্ষা-ব্যবস্থায়। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষগুলো ইসলামের যা কিছু বোধ ও শিক্ষা অর্জন করছেন তা ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় করছেন। হয়তো কোনো আলিমের কাছ থেকে শিখছেন বা দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে শিখছেন কিংবা ওয়াজ মাহফিল থেকে, বইপত্র পড়ে শিখছেন। মুসলিম জনগণের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে আমাদের শিক্ষা কমিশনের কর্তাব্যক্তিরা ইউরোপ-আমেরিকায় যান এবং ওখান থেকে ভবিষ্যত মুসলিম প্রজন্মের জন্য শিক্ষা-কারিকুলাম নিয়ে আসেন! আমাদের জাতীয় শিক্ষা-ব্যবস্থা হতে হবে আমাদের প্রয়োজনকে সামনে রেখে ইসলামী চেতনা ও আদর্শের আলোকে। তাহলে এখান থেকেই একজন শিক্ষার্থী ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা অর্জন করবে এবং সঠিক ইসলামী আদর্শে গড়ে উঠবে। একইভাবে একটা সময় ছিল যখন ছেলে-মেয়েরা দ্বীনের বোধ ও প্রেরণা মা-বাবা ও মুরব্বীদের কাছ থেকে লাভ করত। মা-বাবার জীবনেও ইসলাম ছিল, ইসলামপ্রিয়তা ছিল। ছেলে-মেয়ে ঐ জীবনধারায় প্রভাবিত হত। কিন্তু এখন তো অনেক মা-বাবা নিজেরাই ইসলাম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখেন না, তাদের জীবনেও ইসলাম নেই। বরং অনেক বাবা-মা এমনও আছেন যারা ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। ফলে সন্তান ইসলামের সাধারণ জ্ঞান থেকে বঞ্চিত থাকছে। এরপর যখন বোধ জাগছে তখন নানা সূত্র থেকে জ্ঞান আহরণের চেষ্টা করছে। সব ক্ষেত্রেই যে স্বচ্ছ ও সঠিক সূত্রের সন্ধান পাচ্ছে এমন নয়। এ কারণে কাঁচা বয়সে পরিবার থেকে ও নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে ইসলামের জ্ঞান যেন একটি শিশু পেতে পারে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা আমাদের কর্তব্য। মা-বাবা ও সকল পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের কতর্ব্য।
প্রশ্ন : তাহলে ইসলাম সম্পর্কে ও ইসলামের জিহাদ সম্পর্কে স্বচ্ছ, সঠিক ধারণার অভাবও একটি কারণ...?
উত্তর : জী, অনেক ক্ষেত্রেই তা কারণ। তবে এর সাথে ঐ যে বললাম, বিশ্বব্যাপী মুসলিম নিপীড়ন এবং অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এ বিষয়ে ন্যক্কারজনক নিরবতা, দেশে দেশে ইসলাম ও শাআইরে ইসলামের অবমাননা, মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও দায়িত্বশীলদের অমার্জনীয় অবহেলা ইত্যাদিও বড় কারণ।
প্রশ্ন : গুলশান-ঘটনার পর কোনো কোনো কর্তা ব্যক্তি বলেছেন, এই তরুণরা ইসলামের ভুল ব্যাখ্যায় প্রভাবিত হয়ে এমন কাজ করেছে।
উত্তর : জী, এ ধরনের কথা প্রায়ই শোনা যায়। হয়ত অনেক ক্ষেত্রে তা বাস্তবসম্মতও বটে। এখানে কিন্তু স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন যে, ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা বলতে তারা আসলে কী বোঝেন বা কী বোঝাতে চান। তারা যদি মনে করেন ইসলামে জিহাদের বিধানই নেই, নাহি আনিল মুনকারের প্রসঙ্গই নেই তাহলে তো এই ধারণার সাথে একমত হওয়া কোনো মুসলিমের পক্ষে সম্ভব নয়। মুসলিম কেন বাস্তববাদী কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। কারণ, কুরআন মাজীদের বহু আয়াতে জিহাদের বিধান ও ফযীলত আছে। কুরআনের বড় বড় দুই সূরা আনফাল ও তাওবার অধিকাংশ আয়াতই তো জিহাদ-সংক্রান্ত। হাদীস শরীফের বিশাল অংশ জুড়ে জিহাদের বিধান আছে। সীরাতের এক বড় অংশ জুড়ে জিহাদ। একে তো ‘নেই’ বলে দেওয়া যায় না। আমরা যে কথাটি বলতে চাই তা হচ্ছে, ইসলামী জিহাদ, এর প্রয়োগক্ষেত্র ও প্রয়োগ বিধি সম্পর্কে সঠিক ধারণা অর্জন করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে ভুল বা অস্পষ্ট ধারণা এবং ঐ ধারণা-ভিত্তিক পদক্ষেপ ইসলাম ও মুসলমানের জন্যই বিপদের কারণ হয়ে যেতে পারে।
প্রশ্ন : শেষের কথাটি যদি আরেকটু খোলাসা করেন।
উত্তর : কোন কথাটি?
প্রশ্ন : এই যে প্রয়োগ-ক্ষেত্র ও প্রয়োগবিধি...
উত্তর : বিষয়টি এভাবেও বুঝতে পারেন যে, ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ইবাদত। যেমন নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি। কে না জানে ইবাদত অতি গুরুত্বপূর্ণ ও ফযীলতপূর্ণ, কিন্তু তা কি যে কোনোভাবে আদায় করা যায়, না কুরআন মাজীদে এর যে বিধান রয়েছে, সুন্নাহয় যে প্রায়োগিত রূপ রয়েছে সেই অনুযায়ী হতে হয়? ইবাদত আল্লাহর কাছে ইবাদত হিসেবে কবুল হওয়ার জন্য যেমন ইখলাস ও আন্তরিকতার প্রয়োজন তেমনি সুন্নাহ ও নিয়মের অনুসরণও প্রয়োজন। নিয়ম ও সুন্নাহ অনুযায়ী না হলে শুধু আন্তরিকতার কারণে তা আল্লাহর কাছে ইবাদত হিসেবে কবুল হবে না। শরীয়তের সকল কাম্য ও করণীয় বিষয়ে একথা সত্য। জিহাদের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। এ কারণে জিহাদের বিধান ও ফযীলত সংক্রান্ত আয়াত-হাদীস অধ্যয়নের পাশাপাশি এই বিধান পালনের পদ্ধতি সম্পর্কেও স্বচ্ছ ধারণা অর্জন করা প্রয়োজন। দেখুন, যাকাত ইসলামের এক রোকন এবং যাকাত আদায় না করার বিষয়ে কুরআন-হাদীসে কঠিন হুঁশিয়ারি আছে- শুধু এটুকু জানাই কিন্তু সঠিকভাবে যাকাত আদায়ের জন্য যথেষ্ট নয়। সঠিকভাবে যাকাত আদায় করতে হলে জানতে হবে, কার উপর যাকাত ফরয, কী কী শর্তে ফরয, কোন কোন সম্পদ কী পরিমাণ হলে ফরয, যাকাতের মাসরাফ বা পাত্র কারা, আর কীভাবে তা আদায় করতে হয়। এসকল বিষয়ে স্বচ্ছ ও সঠিক ধারণা ছাড়া শুধু যাকাত ইসলামের ফরয বিধান, যাকাত আদায় না করলে কঠিন হুঁশিয়ারি- এটুকু জানা বাস্তব ক্ষেত্রে সঠিকভাবে যাকাত আদায়ের জন্য যথেষ্ট নয়।
প্রশ্ন : আপনার কথা থেকে বুঝতে পারছি, জিহাদের বিধান সঠিকভাবে পালন করার জন্য বেশ স্বচ্ছ ও বিস্তৃত জ্ঞানের প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমান পরিবেশ-পরিস্থিতি তো এর চর্চার জন্য অনুকূল নয়। জিহাদ শব্দটিই তো এখন -নাউযুবিল্লাহ- অনেকটা নিষিদ্ধ ও ভীতিকর শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জিহাদ সম্পর্কে স্বচ্ছ ও বিস্তৃত ধারণা অর্জনের জন্য তো যেমনটা আপনি যাকাতের উদাহরণ দিয়ে বললেন- উন্মুক্ত ও বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের মুসলিম দেশগুলোতেও পরিস্থিতি এই দাঁড়িয়েছে যে, এখানে জিহাদ বিষয়ক অধ্যয়ন ও আলোচনা উন্মুক্তভাবে হওয়ার পরিবেশ নেই...।
উত্তর : এটাও একটি ভুল ব্যবস্থা। এ যেন ব্যথা হওয়ার কারণে মাথাই কেটে ফেলার নামান্তর। দায়িত্বশীলদের কর্তব্য, এ বিষয়ে শান্ত মনে চিন্তা-ভাবনা করা। জিহাদের আলোচনা নিষিদ্ধ করে দিলেই কিন্তু এ বিষয়ে অধ্যয়ন ও জানার আগ্রহ বন্ধ হয়ে যাবে না। চলতে থাকবে। তবে তখন সেটা চলবে গোপনে, লুকিয়ে। এটা একদিকে যেমন বিষয় সম্পর্কে সঠিক ও বিস্তৃত ধারণা অর্জনের পক্ষে প্রতিবন্ধক অন্যদিকে নানা ভ্রান্ত ও প্রান্তিক মতামতের বিস্তার ঘটার পক্ষেও সহায়ক। এ কারণে শরীয়তের সালাত-যাকাতের ন্যায় বিধানগুলোর মতো জিহাদ ও নাহি আনিল মুনকারের বিধানগুলোও উন্মুক্ত উলোচনায় আসা প্রয়োজন। তাহলে এসব বিষয়ে সঠিক জ্ঞান-গবেষণার বিস্তার ঘটবে এবং ভ্রান্ত বা প্রান্তিক মতামতগুলোও সবার সামনে আসবে। তখন আহলে ইলমই ঐসকল মতামত খ-ন করে ইসলামী জিহাদের সঠিক কাঠামোটি গণ-মানসে সংরক্ষিত রাখবেন। যেমনটা আমরা সালাত-যাকাতের মতো বিষয়গুলোতে দেখছি।
প্রশ্ন : কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের দায়িত্বশীলগণ কি এই নীতি গ্রহণ করতে পারবেন?
উত্তর : আপনার প্রশ্নটা হতে পারে, ‘দায়িত্বশীলগণ কি এই নীতি গ্রহণ করবেন’? পারবেন কি না- এই প্রশ্ন যদি আসে তাহলে বলব, সৎসাহস ও আন্তরিকতা থাকলে অবশ্যই পারবেন। তবে তাদেরও তো জিহাদ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দরকার। তারা তো এই সমাজেরই অংশ, প্রচলিত শিক্ষা-ব্যবস্থা থেকেই তাদের উঠে আসা, যে শিক্ষা-ব্যবস্থায় ইসলামী বিধি-বিধান ও এর যৌক্তিকতা-যথার্থতা বিস্তারিতভাবে জানার সুযোগ নেই। এরপর রয়েছে পশ্চিমা মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীদের প্রচার-প্রপাগাণ্ডা যা সাধারণত ইসলামের বিকৃত উপস্থাপনার জন্যই নিবেদিত। তারা যদি পশ্চিমা প্রচারণায় প্রভাবিত হয়ে ইসলামের জিহাদকেই ‘ফাসাদ’ মনে করেন তাহলে এর উন্মুক্ত আলোচনার নীতি কীভাবে গ্রহণ করবেন? তাদের বুঝতে হবে, আলোচিত ঘটনাগুলোর জন্য ইসলামের জিহাদ-বিধান দায়ী নয়। এর জন্য দায়ী ইসলামী জিহাদ সম্পর্কে সঠিক ও পর্যাপ্ত ধারণার অভাব। সুতরাং জিহাদ বিষয়ক আলোচনা নিষিদ্ধ করা এর সমাধান নয়, বরং সঠিক আলোচনার বিস্তার ঘটানোই সমাধান। তাদের আরো বুঝতে হবে, ইসলামের জিহাদ ‘ফাসাদ’ (বিশৃঙ্খলা) নয়; বরং ‘ফাসাদ’ দূর করার জন্যই জিহাদ। আর এ কারণে জিহাদের বিধান মানবজাতির জন্য রহমত।
তাদের আরো বুঝতে হবে যে, তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের প্রিয় ধর্ম ইসলামের বিধান সমুন্নত রাখা এবং এর সঠিক চর্চা, বিস্তার ও প্রয়োগও তাদের দায়িত্ব। এ দায়িত্বের বিষয়ে তাদেরকে আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করতে হবে।
প্রশ্ন : একটু অন্য প্রসঙ্গে যাচ্ছি। সম্প্রতি মসজিদের খতীব ছাহেবদের ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রস্তুতকৃত বয়ান ও খুতবা সরবরাহ করা হচ্ছে এবং কোনো কোনো জায়গায় নির্ধারিত খুতবা পাঠের জন্য চাপ প্রয়োগের সংবাদও পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।
উত্তর : ভালো প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। এই পদক্ষেপ একটি অদূরদর্শিতাজনিত পদক্ষেপ বলেই আমাদের কাছে মনে হয়েছে। এর দ্বারা অনাস্থা ও অবিশ্বাস বাড়তে পারে এবং দ্বীনদার শ্রেণির সাথে সরকারের দূরত্বও বাড়তে পারে। নানা কারণেই তা হতে পারে। একটি কারণ তো পরিষ্কার। যারা এই সকল খুতবা প্রস্তুত ও সম্পাদনার সাথে নানাভাবে যুক্ত ইসলাম বিষয়ে তাদের সবার ধ্যান-ধারণা স্বচ্ছ ও সঠিক হওয়ার প্রত্যাশা করা যায় না। এর কিছু নমুনা আমাদের সামনেও আছে। একটি নমুনা দেখুন... এ জাতীয় ‘খুতবা’ যখন দেশের খতীব ছাহেবানের কাছে যাবে তখন তাদের কাছে দায়িত্বশীলদের সদিচ্ছা সম্পর্কে কিংবা অন্তত তাদের ইসলামী জ্ঞান সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত, গোড়ার দায়িত্বশীলদের কারো কারো হয়তো খতীব ছাহেবানের ধর্মীয় প্রভাব কাজে লাগানোর সদিচ্ছা আছে, কিন্তু বর্তমান পদ্ধতিতে তা কাজে লাগানো যাবে বলে মনে হয় না। কারণ তৈরি করে দেয়া ভাষণে স্বভাবতই জনগণের আগ্রহ থাকে না। সুতরাং এ পদ্ধতিতে খুতবাই প্রভাবহীন হয়ে পড়তে পারে। এর উদাহরণ হিসেবে আমাদের দেশে ‘রাষ্ট্রপতির ভাষণ’-কে আনা যায়। মাননীয় রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অভিভাবক। কিন্তু যেহেতু সবারই জানা আছে, এটি রাষ্ট্রপতির স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ নয়, বরং সরকারের তৈরি করে দেওয়া ভাষণ, তাই রাষ্ট্রপতির প্রতি শ্রদ্ধা থাকলেও তার ভাষণে সাধারণত আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় না। কিছুদিন আগে মাননীয় রাষ্ট্রপতি নিজেও তার ভাষণটি ‘পাঠ’ করার আগে নিজের পক্ষ থেকে দু’চার কথা বলেছেন। যাই হোক, সত্যি সত্যি যদি খতীব ছাহেবানের সহযোগিতা নিতে হয় তাহলে তাদেরকে আস্থায় নিয়ে তাদের মর্যাদা রক্ষা করেই তা নিতে হবে।
প্রশ্ন : আলোচিত ঘটনার কারণে অনেকের মনে একটা ধর্ম-ভীতি সৃষ্টি হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমার জানা আছে যে, একজন ছাত্র ‘ও’ লেভেলে পড়াশোনা করে। এই ঘটনার পর তার মা-বাবা তাকে মসজিদে যেতে নিষেধ করেছেন। এরকম অবস্থা অনেকের মধ্যেই তৈরি হচ্ছে।
উত্তর : তবে কি তাঁরা সব ছেড়ে দিবেন? মসজিদ-মাদরাসা, ইন্টারনেট, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, প্রাইভেট ভার্সিটি সব? সকল দ্বীনদার মানুষকে সন্দেহের চোখে দেখবেন? আজ প্রাইভেট ভার্সিটির কোনো ছাত্রের দ্বারা হচ্ছে আগামীকাল যদি পাবলিক ভার্সিটির কারো দ্বারা হয় তখন কি পাবলিক ভার্সিটিও ছেড়ে দিবেন? পরিস্থিতির নাযুকতা উপলব্ধি করা কাম্য, অমূলক ভীতি কাম্য নয়। পরিস্থিতি সঠিকভাবে উপলব্ধি করে সঠিক প্রতিকার-ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দেখুন, একটি ভুল পদক্ষেপ কিন্তু আরেকটি ভুলেরই জন্ম দিয়ে থাকে। আলোচিত ঘটনায় যে ছেলেগুলো অভিযুক্ত প্রচারিত তথ্য অনুযায়ী ওরা কিন্তু অনেক দিন থেকেই ঘরে ছিল না। ওরা বাইরে গিয়ে ওদের তৎপরতার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে। এজন্য ঘরের পরিবেশটাও সন্তানের ধর্ম-বোধের অনুকূল হওয়া উচিত। আপনার ধার্মিক ছেলেটিকে মসজিদে যেতে নিষেধ না করে ঘরের পরিবেশটাই ধর্মীয় আবহে গড়ে তুলুন এবং ধর্মের বিষয়ে ঘরোয়া আলাপচারিতা ও তালীম-তাআল্লুমের সংস্কৃতি গড়ে তুলুন। সাময়িক কোনো সমস্যা বা জটিলতার কারণে নয় সাধারণভাবেও তো মা-বাবাসহ পরিবারের সকল সদস্যের সাধারণ দ্বীনী বোধ প্রয়োজন। এ কারণে পরিবারগুলোতে যদি সহীহ দ্বীনী তালীমের ধারা গড়ে ওঠে এবং ধর্ম ও ধার্মিকতার প্রতি ইতিবাচক মানসিকতা, অন্তত সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয় তাহলে এর অনেক সুফল আসবে বলে আমরা মনে করি।
প্রশ্ন : আপনারা আমাদেরকে অনেক সময় দিয়েছেন জাযাকুমুল্লাহু খাইরান। এখন বিশেষভাবে তরুণ প্রজন্মের প্রতি এবং সাধারণভাবে সবার প্রতি যদি কোনো পরামর্শ বা নসীহত থাকে তাহলে তা জানতে চাই।
উত্তর : যে ঘটনা ঘটেছে এ ধরনের ঘটনার পেছনের কারণ সাধারণত অস্পষ্টই থাকে। আমরাও খুব ক্লিয়ার না। তবে দ্বীনের প্রতি তরুণ শ্রেণির এই যে আবেগ, প্রাণ দিয়ে দেয়ার জযবা এটা অবশ্যই সাধুবাদ পাবার মতো বিষয় ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে দ্বীনী কল্যাণকামিতা থেকে যে কথাটি বলতে চাই তা হচ্ছে, আমাকে নিশ্চিত হতে হবে যে, আমার প্রাণ সঠিক পন্থায় কুরবান হচ্ছে। একটু আগে যেটা মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেব বললেন, আল্লাহর কাছে কোনো আমল কবুল হওয়ার জন্য খুলুস ও ইখলাস তথা আন্তরিকতা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রত্যাশার পাশাপাশি সঠিক পদ্ধতিতে হওয়াও জরুরি। এর জন্য সহীহ ইসলামী তালীম ও সহীহ তরবিয়তের অতি প্রয়োজন।
তত্ত্বাবধায়ক : সহীহ তালীম-তরবিয়াতের এক সুফল হচ্ছে আবেগ ও জযবার সঠিক ব্যবহার। দেখুন, হুদায়বিয়ার সন্ধির ঘটনা আমাদের সামনে। সন্ধির সকল শর্ত সাহাবায়ে কেরামের মনপুত হয়নি বরং তারা একে অবমাননাকর মনে করেছেন। এরপরও আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সিদ্ধান্তের সামনে আবেগ ও জযবা নিয়ন্ত্রণ করেছেন। এটা তাদের জন্যও কল্যাণকর হয়েছে, দ্বীনের জন্যও, উম্মাহর জন্যও।
দ্বিতীয়ত দ্বীনের প্রজ্ঞা অর্জন করতে হবে কুরআন ও সুন্নাহয় পারদর্শী ব্যক্তিবর্গের সাহচর্যের মাধ্যমে। দ্বীন শুধু পড়া নয়, শেখাও প্রয়োজন। আর তা শিখতে হয় আহলে ইলম, আহলে দ্বীনের নিকট থেকে। শুধু ‘যন্ত্র’ বা ‘গ্রন্থ’ থেকে নয়।
দ্বীনী ইলমের মাহেরীনের সাহচর্যের মাধ্যমেই দ্বীনের সহীহ ইলম ও ফিকহ অর্জিত হতে পারে।
আর সামাজিকভাবে সবার কর্তব্য, প্রত্যেকে নিজের ইসলাহ ও সংশোধনের ফিকির করা, দাওয়াত, তালীম ও তাবলীগের মেহনত জোরদার করা, সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে সহীহ দ্বীনী তালীমের বিস্তার ঘটানো। মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রাহ. যে কাজটি করেছিলেন- সমাজের পরিচালক শ্রেণির মাঝে দ্বীনের তালীমের বিস্তার ঘটানো, যা আজ অনেকটাই অবহেলিত, সে বিষয়ে যতœবান হওয়া আজ সময়ের দাবি।