প্রতিবেশী : বিচারের পিকনিক!
যে যাই বলুক, বিচার কিন্তু হয়েছে একটা। শাস্তিও হয়েছে। কোনো শাস্তি না দিলেই বা কী করার ছিল। প্রমাণও তো না মিলতে পারতো! যেমন মেলেনি মহামতি মোদির ক্ষেত্রে। যিনি পশ্চিমা মিডিয়ায় ‘গুজরাট-কসাই’ বলে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। মামলার সব অভিযোগ থেকে তিনি কিন্তু বেকসুর খালাস! ওই যে তদন্তকারীরা বলেছে, প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আহমেদাবাদের একটি বিশেষ আদালত এই রায় দিয়েছে। বিচারকের নাম পি বি দেশাই। চৌদ্দ বছর আগের গুজরাট হত্যাকাণ্ডে দোষীদের দণ্ড ঘোষণা করা হয়েছে ওই রায়ে। গত ১৭ জুন খবরটি জানিয়েছে বিবিসি, এএফপি, এনডিটিভি। আর ১৮ জুনের ঢাকার দৈনিক পত্রিকাগুলো সে খবর ছাপিয়েছে বড়ই কৃপণ হাতে ও নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে। যেন এটা তেমন কোনো খবর নয়। যেন এ খবরটিতে অসঙ্গতি ও অমানবিকতার ছিঁটেফোটা উপাদানও নেই।
কী হয়েছিল গুজরাটে? আর কী রায় দেয়া হয়েছে এই বিচারে? গণমাধ্যমের রিপোর্টে প্রকাশ, ২০০২-এর গুজরাট হত্যাকাণ্ডে সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, যার প্রায় সবাই ছিলেন মুসলিম। কেবলমাত্র একটি আবাসিক অঞ্চল-গুলবার্গ সোসাইটি হত্যাকাণ্ডে ৬৯জন নারী-পুরুষকে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেখানে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয় কংগ্রেসদলীয় এক সাবেক সংসদ সদস্য এহসান জাফরীকেও। সে ঘটনায় প্রশাসনের পূর্ণ সহযোগিতায় উগ্র হিন্দুরা ব্যাপক তা-ব চালায়। রাজ্যের একদম উপর মহল থেকে তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকদের ‘নিষ্ক্রীয়’ রাখা হয়েছিল। আর সে সময়টিতে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন আজকের নরেন্দ্র মোদি। বিশ্ববিখ্যাত প্রধানমন্ত্রী! এহসান জাফরী নিহত হওয়ার পূর্বে তার সহযোগিতা চেয়ে ফোন করেছিলেন, কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি। ঘরে-বাড়িতে ঢুকে ঢুকে মুসলিম নারী-পুরুষ-শিশু হত্যার উৎসব হয়েছিল গুজরাটে। বিজেপি, আরএসএস, বজরংদল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্মীরা ত্রিশূল-কৃপাণ, তলোয়ার ও বন্দুক হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেই বর্বরতার বিচারের রায় হলো এই যে- একজনকেও মৃত্যুদ- দেওয়া হয়নি। এতগুলো হত্যার জন্য কোনো একজনেরও প্রাণদ- কিংবা ফাঁসির রায় ঘোষণা করা হয়নি। যেন প্রাণদ- দেওয়ার মতো অপরাধ সেখানে ঘটেইনি। যেন ভারতের আদালত ‘প্রাণদণ্ড’ দিতে বরাবর বড়ই কুণ্ঠিত! তবু সেই আদালত শাস্তি একটা দিয়েছে। সেই শাস্তির নমুনা হলো, ১১ জনের যাবজ্জীবন, ১২ জনের ৭ বছর, ১ জনের ১০ বছর কারাদ-। এছাড়া অভিযুক্ত আরো ৩৬ জনকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়। শাস্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে অতুলবৈদ্য নামের একজন রয়েছেন। যিনি কি না বিশ্ব হিন্দু পরিষদের একজন গর্বিত সদস্য।
এই হচ্ছে বিচার। এই হচ্ছে আদালত। ভারতের সব পর্যায়েই সাম্প্রদায়িক ভূত অল্প-বিস্তর বাসা বেঁধেছে। এটা জানা ছিল। জনগণ পর্যায়ে, প্রশাসন পর্যায়ে। রাজনীতি ও কূটনীতিতেও। কিন্তু কিছুদিন থেকে তাদের আদালতের পচনও এমন জায়গায় গিয়েছে যে তার দূর্গন্ধ দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। অবিচার ও সাম্প্রদায়িকতা সেখানেও জেঁকে বসেছে। ক’দিন আগে ‘নির্দোষ’ কাশ্মিরী মুসলিম আফজাল গুরুকে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে ফাঁসি দেওয়া হলো। কেবলই অনুমান, অভিযোগ আর মুসলিম হওয়ার ‘অপরাধ’ ছিল উপলক্ষ। কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি তার বিরুদ্ধে। নজিরবিহীন তাড়াহুড়া করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে। সারা দুনিয়ার বিবেক তার জন্য কেঁদেছে। টাডা আইনে বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘু লাখো মুসলমানকে জেলখানায় নিক্ষেপের ঘটনা ভারতে বিখ্যাত হয়ে গেছে। আইনের পোশাকে মুসলমানদের প্রতি অত্যাচার ও প্রাণদ- এখন সেখানকার সস্তা সংস্কৃতি। হায়! সেই ভারতেই গুজরাট হত্যাকাণ্ডের মতো দুনিয়া কাঁপানো বর্বর হত্যাকাণ্ডের বিচারে এখন দেখা গেল, একজন খুনীরও ফাঁসি হলো না। কয়েকজনের যাবজ্জীবন আর কয়েকজনের ৭ বছর/১০ বছর। সভ্যতার গোরস্তানে পিকনিকের আয়োজন! বিচারের পিকনিক! এজন্যই গুজরাটে নিহত এহসান জাফরীর স্ত্রী জাকিয়া জাফরি আর্তনাদ করে বলেছেন- ‘ন্যায়বিচার হয়নি। এ কোন ধরনের বিচার? কেন বেছে বেছে শাস্তি দেওয়া হলো? আমরা যেখান থেকে শুরু করেছিলাম- সেই অন্ধকারেই আবার ফিরে গেলাম।’ জাকিয়ার বেদনার্ত কণ্ঠের সঙ্গে মিলিয়ে এ প্রশ্ন কি এখন কেউ উচ্চারণ করতে পারে না ‘এসব পিকনিকের শাস্তি শাস্তি খেলা কি এজন্যই হয়েছে যে, গুজরাট গণহত্যার শীর্ষ খুনী বলে পরিচিতি পাওয়া ব্যক্তিটি এখন ওই দেশটিরই সবচেয়ে মহান চেয়ারে বসে আছেন? আজকের দুনিয়ার কোনো কোনো দেশে বিচার নিয়ে মতাদর্শিক, ক্ষমতাকেন্দ্রিক নতুন এ কোন প্রহসন শুরু হলো? ভারতে, মিসরে, ইরাকে কি আমরা সেটাই দেখছি না? এরপরও দেখুন, কেবল ‘বিচারিক দণ্ডের’ কথা বলে সেইসব ‘সাব্যস্তকৃত বর্বরতাকেও’ বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিচার কি তবে আধুনিক যুগে কোনো নতুন ব্লাসফেমীর বিষয়? বিচারের নামে অসঙ্গতি, অন্যায় ও অমানবিক পক্ষপাত কায়েম করলেও প্রতিবাদ করা যাবে না? গুজরাটের বিচার, কায়রোর বিচার, বাগদাদের বিচার দেখলে এ প্রশ্ন আপনা আপনি সামনে চলে আসে যে- এসব বিচার কি কোনো শাশ্বত ঐশীবাণী? বিচারের নামে পাহাড় গায়েব করে দিলেও প্রতিবাদ করা যাবে না! নিন্দা জানানো যাবে না! সমালোচনা করা যাবে না! বহু বহু দেশে দুনিয়ার নতুন সাম্রাজ্যবাদী ও নিপীড়নবাদী নিয়মের তল্পিবাহীতে পরিণত হয়েছে এখন বিচারব্যবস্থা। আর অনিবার্যভাবে এই ভুলভাল বিচারের সবচেয়ে বেশি শিকারে পরিণত হচ্ছে এখন নানা দেশের মুসলমান। শক্তি ও ক্ষমতাহীনতার কারণে।
গুজরাটের নৃশংস গণহত্যার দণ্ডের নমুনা হলো, মৃত্যুদ-হীন কতিপয় যাবজ্জীবন। সংখ্যালঘু মুসলমানের দেশ ভারতের একটি চিত্র এটি। সে ঘটনায় হত্যাকারী ছিল এমন উগ্র হিন্দু, যারা এখন ভারতের ক্ষমতায় সমাসীন। ওই দেশটিই না কি আবার বড় ধর্মনিরপেক্ষ! এমন কি আহলাদ করে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার বন্দনা বেশ উচ্চকিত করা হয়। ওই দেশেও, এই দেশেও। ভারতই এখন ধর্মনিরপেক্ষতার একমাত্র গয়া কাশি বৃন্দাবন! আহা! তার চেয়ে উত্তম ধর্মীয় ভেদ-বুদ্ধিহীন জায়গা না কি আর পৃথিবীতে হতে পারে না! অথচ একটু তুলনা সামনে আসুক। দেখুন কী দৃশ্য চোখে পড়ে। একদিকে ভারতের গুজরাটে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের উগ্রতার শিকার হাজার খানেক সংখ্যালঘু মুসলমান নারী-পুরুষ-শিশু হত্যার বিচারের রায় আমাদের সামনে। ১জনেরও মৃত্যুদ- নেই, অল্প কিছু যাবজ্জীবন। অপরদিকে গত কয়েক মাসে ভিন্ন ভিন্ন কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ও গুপ্ত হামলায় এদেশের এ পর্যন্ত একডজনেরও কম হিন্দু সংখ্যালঘু নিহত। এঘটনার পুরোপুরি বিচার হওয়ার আগেই প্রতিক্রিয়া স্বরূপ যে মহাযজ্ঞ পরিচালিত হচ্ছে- তার একটি ছোট্ট নমুনা হলো, এরই মধ্যে নিছক মামলা ও অভিযোগের ভিত্তিতে (বিচার অনুষ্ঠান হয়নি) পুলিশের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মাসখানেকের মধ্যে ডজনখানেক তরুণ ‘নিহত’ হয়েছে। সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে রমযান মাসে ১২ হাজারের বেশি মুসলমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মাগুরা, ঝিনাইদহ, খুলনার হিন্দুপ্রধান এলাকাগুলোতে লাঠি-বাঁশি জনগণের একটি অংশের হাতে তুলে দিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে ঘোষণা করে বলে দেয়া হচ্ছে ‘আপনারা নিজ হাতে সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধ করুন।’ অথচ এরপরও আমাদের দেশটিতে কেন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাখা হয়েছে- এ নিয়ে বিষোদগারের অন্ত রাখছে না একশ্রেণির সেকুলার পরজীবী।
লঘু পাপে গুরু দণ্ড আর গুরু পাপে লঘু দণ্ড। ভারত ও বাংলাদেশকে পাশাপাশি দাঁড় করালে তো আমরা এমনই দেখি। হিন্দু আর মুসলমানদের প্রতি বিচার-অবিচারের নমুনা দেখলে আমরা এমনই বুঝি। তারপরও আমরা সম্প্রীতির পক্ষে। প্রমাণহীন কোনো একটি আঙ্গুলতাকের ঘটনায় যেন ভিন্ন সম্প্রদায়ের একটি মানুষও কষ্ট না পান- আমরা সে কথা বলতে চাই। কিন্তু দেখছি তো কেবলই বিপরীত চিত্র। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মুসলিম নিপীড়নবাদী শক্তিগুলোর মুখোশ তো এখন খোলা। চারদিকের সব অপকর্মের দৃশ্য চোখে চোখে। তারপরও গায়ে জোরি ‘সাম্প্রদায়িক’ ধর্মনিরপেক্ষতার এক লজ্জাহীন অহংকারের নিচে আমরা খাবি খেতে খেতে চলছি।