দেশপ্রেম : কেউ কথা বলেনি
খবরটি বড় ছিল। ঘটনা তার চেয়েও বড় ছিল। কিন্তু ধামা ছাড়াই সে খবরকে চাপা দেওয়া হলো। ঘটনার উপরও ফেলে দেওয়া হলো ছাই। আমরা কেবল মাযু দর্শকের মতো সে কা- দেখলাম। কিছু করতে পারলাম না। না, তেমন কিছু করার ছিলও না। দেশে তাবড় তাবড় দেশপ্রেমিকের ছাউনি আছে। মস্ত মস্ত স্বাধীনতা রক্ষার মঞ্চ আছে। ঠিকাদারি তো তারা নিয়েই রেখেছেন। অন্যেরা আর কী করবে! সুযোগ পেলে তো!
প্রথমে খবরটি এসেছে ১২ জুন রোববার। বিভিন্ন অনলাইন খবরের পাতায়। এর পরের দিন একটি-দুটি ‘অ-প্রগতিশীল’ দৈনিকেও ছাপা হয়েছে। অবশ্য খুবই বিনয়ী অবয়বে। সিঙ্গেল কলামে। শেষ পাতাগুলোতে। শিরোনাম : বাংলাদেশী হিন্দুরা ভারত সরকারের হস্তক্ষেপ চায়/হিন্দুদের সুরক্ষায় নরেন্দ্র মোদির হস্তক্ষেপ চান রানা দাসগুপ্ত ও পীযূষ বন্দোপাধ্যায়। ভারতের সরকারি সংবাদ সংস্থা পিটিআই খবরটি সরবরাহ করেছে। আর সেটি প্রকাশ করেছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস অনলাইন ও হিন্দুস্থান টাইম্স। প্রকাশিত ওই খবরের প্রধান প্রতিপাদ্য হচ্ছে, বাংলাদেশে ‘মারাত্মক ঝুঁকির’ মধ্যে থাকা হিন্দুদের সুরক্ষা দেয়ার জন্য অতিসত্ত্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেন বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করেন- সেজন্য আবেদন জানিয়েছেন বাংলাদেশের দুজন হিন্দু নেতা। বাংলাদেশের গত কয়েক মাসের চার-পাঁচটি হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে ওই আবেদনে বলা হয়েছে- ‘বাংলাদেশের ওপর ভারত চাপ সৃষ্টি না করলে মৌলবাদীদের থামানো যাবে না। এ অঞ্চলে ভারত একটি বড় শক্তিধর দেশ। প্রতিবেশী দেশে (বাংলাদেশ) যখন হিন্দুদের নৃশংসভাবে জবাই করা হয় ভারত তখন অলস বসে থাকতে পারে না।’ ... ‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে আমাদের বড় আশা রয়েছে। তার উচিত এ বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের কাছে তুলে ধরে হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা’।
মূল প্রতিপাদ্য এতটুকু হলেও বিবরণটি ছিল বেশ দীর্ঘ। তো সেই খবরটি প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেটি একটি ঘটনায় পরিণত হয়। ঘটনা থেকে খবর নয়; খবর থেকে বড় রকম ঘটনায় পরিণত হওয়ার জ্বলন্ত উদাহরণ হলো এটি। ঘটনাটি রাষ্ট্রদ্রোহের। সরাসরি অন্যদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। এ-জাতীয় দেশদ্রোহাত্মক অপরাধ এ-দেশে সাম্প্রতিককালে ঘটেছে বলে কেউ মনে করতে পারবে না। কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে, এ খবর বা ঘটনাটি বাংলাদেশের প্রভাবশালী কোনো পত্রিকা প্রথম দিন (১৩ জুন) ছাপেইনি। এমনকি আগের দিন অনলাইন সংস্করণেও প্রকাশ করেনি। যেন এটি কোনো খবরই নয় তাদের কাছে। যেন এটি কোনো ঘটনাই নয়। আরেক দেশের প্রধানমন্ত্রীকে নিজের দেশে হস্তক্ষেপ করতে এবং চাপ দিতে সরাসরি আবেদন জানানোর মধ্যে যেন ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’র কিছুই নেই। দেশের প্রখর সচেতনতাবাদী (!) নব্বইভাগ প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের চোখেমুখে হঠাৎ করেই বিবমিষা লেগে গিয়েছিল! যেন কিছুই তাদের চোখে পড়েনি। কিংবা খুব কি লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলেন তারা? অথবা জাদরেল উকিল ও হিন্দুনেতা রানাদাসগুপ্ত তাদের কাছে ‘কোথাকার কোন যদুমধু’ বনে গিয়েছিলেন? না কি পীযূষ বন্দোপাধ্যায়ের মতো আলোচিত ব্যক্তিরও সব রকম পরিচয়ই তারা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন? হতেও তো পারে, এত বড় একটি খবরের ‘সূত্র ও বিশ্বস্ততা’ নিয়ে তারা বড়ই সংশয়ে ভুগেছেন। এজন্যই খবরটিও ছাপেননি। খবরের ঘটনা নিয়েও টু শব্দটি করেননি। আমাদের বড় দায়িত্বশীল গণমাধ্যম তো, এমন হতেই পারে। হয়তো এমনটাই হওয়ার ছিল!
তবে পরের দিন ঘটেছে অন্য ঘটনা। ১৪ জুনের সংবাদপত্র বেশ নড়েচড়ে উঠেছে। যেন খবরের আসল হাকীকত এবার তারা পেয়েই গেছেন। বিবিসি বাংলার ওয়েব পাতায় প্রকাশিত খবর নিয়ে প্রথম পাতায় শিরোনাম করেছে ‘সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় মোদির হস্তক্ষেপ চাওয়া নিয়ে বিতর্ক : রানা দাশগুপ্তের অস্বীকার।’ ভেতরের খবরের সঙ্গে মেলালে এই শিরোনামটাকে পুরোপুরি চাতুর্যপূর্ণ দাবি করাই যায়। কারণ শিরোনামে ‘বিতর্ক’ বলা হলেও মূলত শুধু রানাদাসগুপ্ত ও পীযূষ বন্দোপাধ্যায়ের পক্ষ থেকে খবরের একটি সামান্য অংশের প্রতি অস্বীকৃতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্য ওই রিপোর্র্টেই দেখা যাচ্ছে, পিটিআইয়ের পক্ষ থেকে তাদের অস্বীকৃতির বিষয়টিকে পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়ে বলা হয়েছে যে তাদের দুজনকে যথযথভাবেই উদ্ধৃত করা হয়েছে। তাদের কারো বক্তব্যই ভুলভাবে উল্লেখ করা হয়নি। এবং ওই দু’জন আনুষ্ঠানিকভাবে পিটিআই সরবরাহকৃত খবরের কোনো অংশেরই প্রতিবাদ জানাননি। জানাতে পারেননি। অর্থাৎ ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির হস্তক্ষেপ এবং বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টির আবেদন তারা স্পষ্টভাবেই করেছেন। পিটিআই সে কথাই বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছে। যে খবরে ভয়াবহ ‘রাষ্ট্রদ্রোহমূলক হস্তক্ষেপ কামনার’ ঘটনায় অভিযুক্ত দু’জনের দুর্বল ও মিথ্যা-সাব্যস্ত ‘অস্বীকৃতি’ ছাড়া অন্য কারো কোনো দ্বিমতমূলক অংশগ্রহণ নেই- সে খবরের শিরোনামে ‘মোদির হস্তক্ষেপ চাওয়া নিয়ে বিতর্ক’- এ জাতীয় শিরোনাম কি কোনোভাবেই প্রাসঙ্গিক হতে পারে? এখানে কি ‘বিতর্কের’ কিছু ঘটেছে? ঘটেনি যে এটিই তো স্পষ্ট। কিন্তু মহান প্রতিবেশী সাম্রাজ্য (!) হিন্দুস্তানের প্রতি এবং প্রধান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়-হিন্দুদের প্রতি রহস্যপূর্ণ দুর্বলতা পোষণকারী আমাদের গণমাধ্যমের চেহারা এমনই। এ গণমাধ্যম কেবল খবরটি চাপা দেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি বলেই এরকম দুর্বল ও মিথ্যা ‘অস্বীকারের’ খবরকে বড় করে এনেছে। অথচ মূল খবরটিই আগের দিন ছাপেনি।
জ্বী, বরাবরের মতো নিজের দেশের ভেতরে বাইরের দেশের হস্তক্ষেপ ও চাপের আবেদন জানানোর এ ঘটনায় আমাদের প্রগতিশীল সব মুখ ও মঞ্চকেই বধির ও নির্বাক থাকতে দেখা গেছে। কেউ কেউ বলেন, যেহেতু ঘটনাটির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে ভারত এবং ভারতের প্রতি ‘অনুগত’ এ দেশীয় সম্প্রদায় বিশেষের বিশিষ্টজনদের সম্পৃক্ততা সামনে এসেছে- তাই এ ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে থাকার নীতিই তারা গ্রহণ করেছেন। এদেশের মুখর সুশীল, বাম পণ্ডিত, চেতনাধারী সংস্কৃতিজীবী এবং সেকুলার (বিশেষ অর্থে) রাজনীতিকদের তেমন কেউ এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলার ফুরসত পাননি। যেমন তারা গত পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী বিএসএফ-এর গুলিতে হাজারো ‘সীমান্ত শহীদ’-এর পক্ষে কখনো একটি ‘শব্দ’ উচ্চারণের সময় পাননি। ভারত, ভারতের প্রতি আনুগত্য এবং ভারতীয় আধিপত্যের সামর্থ্য নিয়ে কথা বলতে তাদের বড় লজ্জা লাগে! আমাদের গণমাধ্যম, সুশীল এবং একদা-বাম বুদ্ধিজীবীদের চেহারা এরকমই। তারা এমনিতে খুব পারেন। কিন্তু ভারতের বেলায়? হাত কচলাতে কচলাতে নাক-মুখ ঘেমে নেয়ে যায়। সে কোনো খবর হোক, আর ঘটনাই হোক। এবারও আমরা তাই দেখলাম। দেখুন, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রতি দেশের সব হিন্দুর সমর্থন নেই- একথাটি কেউ স্পষ্ট করে বলেনি। কেউ তো এটাও বলতে চায়নি, নরেন্দ্র মোদিকে বাংলাদেশে হস্তক্ষেপের আবেদন জানানোর পক্ষে সব হিন্দুরা নন। তবু আমরা মনে করতে চাই না যে হিন্দু মাত্রই ভারতের কাছে আত্মসমর্পণকারী। বরং হিন্দু-মুসলিম বাবু-সুশীল সবারই বলা দরকার ছিল, হস্তক্ষেপ করার আবেদন জানানোর মতো অপরাধ যারা করেছে তাদের কোনো ‘ধর্ম’ নেই। তাদের কোনো গোত্র কিংবা পরিষদ কিংবা ফোরাম নেই। তারা অপরাধী পরিষদের সদস্য। তারা আলাদা। তারা বিচ্ছিন্ন। কিন্তু একথাটাও কোনো সুশীলের মুখে ফুটলো না।
‘নিজের দেশে হস্তক্ষেপ ও চাপ প্রয়োগের’ এ আবেদনের খবরে অবশ্য ‘জাতীয়তাবাদী’ বড় দলটিও কোনো আওয়াজ দেওয়ার সাহস পায়নি। লোকে বলে, অদ্ভুৎ ভীরুতার মধ্যেই তারা ডুবে গেছেন! তবে কি বিদেশী শক্তির কাছে হস্তক্ষেপের নালিশ জানানো ‘দেশপ্রেমের’ সামনে এখন সবাই অসহায়? বাস্তবতা তো তাই বলছে। অবশ্য কথায়-আচরণে দোদুল্যমান এক সাবেক রাষ্ট্রপতি, আকস্মিক সংসদীয় বক্তব্যে সরকার দলীয় এক সদস্য এবং একটি-দুটি ইসলামী দলের নেতা একবেলা কিছু কথা বলেছেন। কিন্তু কে সেদিকে কান দেয়! যাদের কথা বলার তারা কেউ কিছু বলেনি। যাদের রুখে দাঁড়াবার তারা কেউ ভ্রুক্ষেপই করেনি। এর মধ্যেই ঘটেছে অবশ্য অন্য ঘটনা। ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনের এক পুরোহিতকে উড়ো চিঠি দিয়ে ‘হুমকি’ দেয়ার খবর প্রকাশ হলে যথারীতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘সংবাদ শিরোনাম হওয়ার মতো’ উদ্বেগ জানিয়েছেন। সে উদ্বেগের ‘আপডেট’ পর্যন্ত প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে। বাংলাদেশে উড়ো চিঠির উড়ো হুমকি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী দয়া করে উদ্বেগ জানাতে শুরু করেছেন! আমাদের তো তাহলে আর উদ্বেগের কিছু নেই!!