মাদানীনগর মাদরাসা ঢাকা’র প্রবীণ উস্তায হযরত মাওলানা আবদুল আউয়াল রাহ.
চলে গেলেন হাজারো তালেবানে ইলমের ‘দরদি উস্তায’
مٹا دے اپنی ہستی کو اگر کچھ مرتبہ چاہے کہ دانہ خاک میں مل کر گل و گلزار ہوتا ہے
‘যদি কিছু হতে চাও, নিজেকে মিটিয়ে দাও/ বীজ মাটিতে নিজেকে মিটিয়ে দিয়েই বাগিচার ফুল হয়।’ আল্লামা ইকবালের এ চরণদ্বয়ই এখানে যথাযথ। ব্যাথিত হৃদয় নিয়ে যার কিছু স্মৃতিচারণ করতে বসেছি, তিনি ছিলেন ‘পংক্তিদ্বয়’-এর উজ্জ্বল ও বাস্তব নমুনা। শায়েখের হাতে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার এক অতুলনীয় উদাহরণ ও অনুপম আদর্শ। মাদানীনগর মাদরাসার প্রবীণ উস্তায হযরত মাওলানা আবদুল আউয়াল (আড়াইহাজার হুযুর) রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। ৫ রজব ১৪৩৭ হি. মোতাবেক ১৩ই এপ্রিল ২০১৬ ঈ. বুধবার দুপুর ২টা ৫ মিনিটে ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুতে আমরা হারিয়েছি আমাদের এক আদর্শ উস্তাযকে।
***
আড়াইহাজার হুজুর রাহ. ছোটবেলা থেকেই দ্বীনের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। প্রাইমারী স্কুলে পড়া অবস্থায় তিনি গ্রামের মসজিদে নিয়মিত আযান দিতেন। ফজরের আযানের পর মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে সকলকে নামাযের জন্য ডাকতেন। তাঁর ‘দাওয়াতে’র প্রভাব এতটাই ছিল যে, বাড়ির মহিলারা পর্যন্ত পুরুষদেরকে বলত- আমরা যদি পুরুষ হতাম তাহলে আবদুল আউয়ালের ডাকে আমরাও মসজিদে চলে যেতাম। এ কথা এখনো তার গ্রামের মানুষের মুখে প্রচলিত আছে।
১৯৬৫ সনে মেট্রিক পরীক্ষার পর তার মাদরাসায় পড়ার আগ্রহ জন্মায়। পরীক্ষার ছুটিতে নানা বাড়িতে বেড়াতে গেলে একদিন নানাকে বললেন, নানা আমি মাদরাসায় পড়ব। এ কথা শুনে নানা খুশিতে তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, যেদিন তুমি জন্মগ্রহণ করেছ সেদিন আমি আল্লাহর কাছে দু‘আ করেছিলাম, আল্লাহ তাআলা যেন তোমাকে আলেম বানান। পরে তিনি নিজের কিছু জমানো টাকা তাকে দিয়েছিলেন মাদরাসায় ভর্তি ও পড়াশুনার কাজে ব্যয় করার জন্য। প্রথমে তিনি লালবাগ মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখানে মক্তব থেকে মিযান পর্যন্ত পড়েন। তারপর হিন্দুস্তানের আশরাফুল উলূম রশীদী গাঙ্গুহ ও দেওবন্দ মাদরাসায় পড়াশুনা করেন। ১৯৮৫ সনে দেশে ফিরে আসেন এবং মাদানীনগর মাদরাসায় খেদমতে আত্মনিয়োগ করেন। এরপর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি মাদানীনগরেই ছিলেন। মাদানীনগরকে নিয়েই ছিল তার সব চিন্তা-ভাবনা।
***
আড়াইহাজার হুযুর রাহ. নিজের শায়েখ ও মুরব্বির জন্য ছিলেন জান-কুরবান। তাঁর এ গুণ ছিল প্রবাদতুল্য। নিজেকে তিনি শায়েখে স্বন্দ্বীপী রাহ.[1] -এর হাতে পরিপূর্ণ সঁপে দিয়েছিলেন। দেওবন্দে থাকাকালেই তিনি শায়েখে স্বন্দ্বীপী রাহ. -এর হাতে বাইআত হন। শায়েখের প্রতি তাঁর মুহাব্বত ও আকীদত এতটাই ছিল যে, দেশে ফেরার পর একবার তিনি লালবাগ মাদরাসায় হযরত মুফতী ফজলুল হক আমীনী রাহ.-এর সাথে দেখা করতে যান। মুফতী সাহেব রাহ. বললেন- আবদুল আউয়াল, আমার কাছে থেকে যাও। তখন উত্তরে আড়াইহাজার হুযুর রাহ. বলেছিলেন- হুযুর! আমি তো নিজেকে শায়েখ স্বন্দ্বীপীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছি। এ হল- আড়াইহাজার হুযুর রাহ.-এর শায়েখের প্রতি ভক্তি ও আনুগত্যের একটি দৃষ্টান্ত। প্রসঙ্গত, আড়াইহাজার হুযুর রাহ. লালবাগ মাদরাসায় পড়ার সময় মুফতী ফজলুল হক আমীনী রাহ.-এর খাস খাদেম ছিলেন।
***
একবারের ঘটনা, আড়াইহাজার হুযুর রাহ.-এর দ্বিতীয় ছেলে উবায়দুর রহমানের জন্ম হয়েছে সকালে। জন্মের পর থেকেই তার অবস্থা বেশি একটা ভালো না। মাদরাসায় পরদিন বিশেষ এক অনুষ্ঠান ছিল। আসরের পর বাড়ি থেকে হুযুরকে ছেলের অবস্থা জানানো হল। হুযুর হযরত রাহ.-এর কাছে গিয়ে ছেলের অবস্থা জানালেন। হযরত রাহ. বললেন- তুমি মাদরাসায় থাক আর দুআ করতে থাক। হযরতের কাছ থেকে এসে হুযুর অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির কাজ করছেন। তিনি হযরত রাহ.-এর আদেশ মনে প্রাণেই মেনে নিয়েছিলেন। তবে নবাগত সন্তানের এ অবস্থার কারণে মন কিছুটা খারাপ ছিল। মাগরিবের পর হযরত রাহ. হুযুরকে ডেকে বললেন- যাও ছেলেকে দেখে এসো। তবে ফজরের আগেই মাদরাসায় উপস্থিত হবে।
আড়াইহাজার হুযুর রাহ. অনেক রাতে বাসায় গিয়ে পৌঁছলেন। দেখা সাক্ষাত শেষ করে ফজরের নামায চিটাগাংরোড এসে পড়লেন। মাদরাসায় প্রবেশ করার সময় দেখলেন, নামায শেষে মুসল্লিগণ বের হয়ে যাচ্ছেন। তাদের চোখে মুখে কান্নার ছাপ। হুযুর কিছুটা ভয় পেলেন- না জানি কী হয়েছে! এক মুসল্লিকে জিজ্ঞাসা করলেন- মাদরাসায় কী হয়েছে? মুসল্লি বললেন- হযরতের এক খাস শাগরেদের সন্তান খুবই অসুস্থ। হযরত সবাইকে নিয়ে তার জন্য খুব দুআ করেছেন। ঐ দিন বিকাল থেকে হুযুরের ছেলের অবস্থা অনেকটা ভালো। এরপর থেকে যখনই তার পরিবারে কোনো সমস্যা দেখা দিত হযরত রাহ. তাকে মাদরাসায় থাকার কথা বলতেন এবং সকলকে নিয়ে সমস্যা সমাধানের জন্য খুব দুআ করতেন। হযরত এত বেশি দুআ করতেন যে, হুযুরের অনুপস্থিতিতেই অনেক বড় বড় সমস্যার সমাধান হয়ে যেত।
এ ছিল আল্লাহ তাআলা থেকে নেওয়া ও দুআর মাধ্যমে সকল সমস্যার সমাধানের নীরব তালকীন ও অনুশীলন।
***
আড়াইহাজার হুযুর রাহ.-এর আরেকটি অসাধারণ গুণ ছিল- তিনি তালিবে ইলমের প্রতি খুবই মুশফিক ছিলেন। তাঁর শফকত এতটাই ছিল যে, অনেক পিতাও ছেলের জন্য এতটুকু করতে পারে না। কোনো তালিবে ইলম মাদরাসা ছেড়ে চলে যাবে এটা কখনোই তিনি সহ্য করতে পারতেন না। একবার এক তালিবে ইলম মাদরাসা থেকে চলে যায়- সে আর মাদরাসায় পড়বে না। আড়াইহাজার হুযুর রাহ. তাকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কেন মাদরাসায় পড়বে না? সে উত্তরে বলল- হুযুর, আমার কিছু ইচ্ছা আছে, যেগুলো পূরণের জন্য অর্থের প্রয়োজন। তাই আমি মাদরাসায় পড়ব না। বাইরে গিয়ে টাকা উপার্জন করে আমি আমার ইচ্ছা পূরণ করব। আড়াইহাজার হুযুর রাহ. বললেন- তোমার যত টাকা লাগবে আমি যদি দেই তাহলে কি তুমি মাদরাসায় থাকবে? সে বলল, জ্বী হুযুর, আমি থাকব। এরপর থেকে ছেলেটি যখনই টাকা চাইত হুযুর দিয়ে দিতেন। এভাবেই চলতে থাকে। ছেলেটি যখন জালালাইন জামাতে পড়ে তখন তার মনে নিজের কৃতকর্মের উপর অনুশোচনা আসে। হুযুরের কাছে গিয়ে সে মাফ চায় এবং খুব কান্নাকাটি করে। এরপর থেকে সেই তালিবে ইলম পূর্ণ উদ্যমে লেখাপড়া শুরু করে এবং একজন ভালো ও যোগ্যতাসম্পন্ন আলেম হয়।
ছাত্রদের প্রতি আড়াইহাজার হুযুর রাহ.-এর স্নেহ ছিল অতুলনীয়। সকল ছাত্রই মনে করত হুযুর হয়ত তাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। হুযুর নিজ থেকেই ছাত্রদের খোঁজ-খবর নিতেন। আমি অধম হুযুরের দরসে বসার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারিনি। হুযুর ‘সালে আউয়ালে’র দরস করাতেন। আমি মাদানীনগর মাদরাসায় ‘সালে দুওমে’ ভর্তি হয়েছি। তাই তার কোনো দরসে বসার সুযোগ হয়ে উঠেনি। কিন্তু মাদানীনগরের দীর্ঘ সময়ে কখনো মনে হয়নি- আমি তার কাছে কিছু পড়িনি অথবা তিনি আমার দরসের উস্তায নন। মাদানীনগর থেকে চলে আসার পরও যখনই হুযুরের সাথে দেখা করতে যেতাম, হুযুর কাছে ডেকে বসাতেন। মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে হাল পুরসি করতেন। হুযুরের ইন্তেকালের তিন কি সাড়ে তিন মাস আগে আমি সর্বশেষ হুযুরের সাথে সাক্ষাত করতে যাই। আমাকে দেখেই হুযুর হাসিমুখে আমার হালপুরসি করেন। কাছে ডেকে নেন। কথার এক পর্যায়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, মাওলানা মঈনুদ্দিন কেমন আছে? ও কী করে? ওকে আমার সাথে দেখা করতে বলিস। মাওলানা মঈনুদ্দিন আমার ছোট ভাই। শরহেজামী জামাত পর্যন্ত মাদানীনগর পড়েছে। পরে ঢাকার চৌধুরীপাড়া মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদীস শেষ করেছে। ছোট ভাই মঈনুদ্দিন মাদানীনগর থেকে চলে যাওয়ার পরও যখনই আমি হুযুরের সাথে দেখা করতে যেতাম হুযুর তার খোঁজ খবর নিতেন। দেখা করতে বলতেন। এ শুধু সৌজন্য ছিল না- এ ছিল ছাত্রের প্রতি একজন দরদি উস্তাযের ভালোবাসা। ছাত্রের কল্যাণকামনা।
কোনো তালিবে ইলম মাদরাসা ছেড়ে চলে যাবে তা তিনি কখনোই চাইতেন না। আর কোনো কারণে যদি চলেও যেত তাদের খোঁজ খবর রাখতেন। তিনি মনেপ্রাণে চাইতেন এবং এর জন্য সবরকম ফিকির করতেন- মাদরাসা ছেড়ে চলে গিয়ে যেন ছেলেরা দ্বীন থেকেও ছিটকে না পরে। এজন্য আমরা দেখেছি, অনেক ছেলেরা মাদরাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার পরও হুযুরের সাথে সম্পর্ক রাখত। মাঝে মাঝে এসে দেখা সাক্ষাত করত। তার পরামর্শ নিয়ে চলত। এ ক্ষেত্রেও তার তুলনা পাওয়া ভার।
***
আকাবিরে দেওবন্দের প্রতি হুযুরের আকর্ষণ ও মুহাব্বত অনেক বেশি ছিল। বিশেষ করে মাদানী খান্দানের প্রতি তার মুহাব্বত ছিল অনেক বেশি। আকাবির উলামায়ে কেরাম ও বুযুর্গানে দ্বীনের সংস্পর্শ ও সান্নিধ্য লাভের প্রতি আগ্রহও ছিল যারপরনাই। আসাতিযায়ে কেরামের খেদমত ও মানশা অনুযায়ী চলা ও তাদের পূর্ণ অনুসরণ করার প্রতি তার আগ্রহের শেষ ছিল না। তিনি ছিলেন তালিবানে ইলমের জন্য দৃষ্টান্ত। আড়াইহাজর হুযুর রাহ. যখন যে মাদরাসায় পড়েছেন সেখানকার আসাতিযায়ে কেরামের জন্য ফেদা ছিলেন। আসাতিযায়ে কেরামের খেদমত করতেন। খেদমত করতে ভালবাসতেন এবং খেদমত করতে জানতেন। লালবাগ মাদরাসায় হযরত মুফতী ফজলুল হক আমীনী রাহ.-সহ অন্যান্য আসাতিযায়ে কেরামের খেদমত করেছেন। মাদরাসা আশরাফুল উলূম রশীদী গাঙ্গুহে পড়া অবস্থায় মাদরাসার মুহতামিম হযরত মাওলানা কারী শরীফ আহমদ গাঙ্গুহী রাহ.-এর খাস খাদেম ছিলেন। তিনি কারী ছাহেব রাহ.-এর পরিবারের লোকদের মত ছিলেন। সেখানে তিনি খলীল নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। কোনো প্রয়োজন হলেই কারী সাহেব রাহ. ডাকতেন, খলীল! দফতরে মেহমান এসেছে- খলীল! কোনো জায়গায় যেতে হবে- খলীল! সাহারানপুর যেতে হবে- খলীল! বোম্বাই যেতে হবে- খলীল! হযরত কারী সাহেব রাহ. সবসময় তাকে নিয়ে সফরে যেতেন। এককথায় তিনি হযরত কারী সাহেব রাহ.-এর খেদমতে ফেদা ছিলেন। আর কারী সাহেব রাহ.-ও হুযুরকে খুবই স্নেহ করতেন, খেয়াল রাখতেন। একবার আড়াইহাজার হুযুর রাহ. অসুস্থ হলে হযরত কারী সাহেব রাহ. দু’টি আপেল হাতে নিয়ে হুযুরের ইয়াদত করতে আসেন। এ ছিল আমাদের আকাবির ও আসলাফের উস্তায-শাগরেদ সম্পর্ক।
আড়াইহাজর হুযুর রাহ.-এর যোগ্যতার বহুমুখিতা বিশেষ করে আহলে খায়ের বিত্তবান ও সমাজের উঁচূ শ্রেণীর লোকদের সাথে কীভাবে সম্পর্ক রক্ষা করতে হয়, তাদের সাথে কীভাবে উঠাবসা করতে হয়, সামাজিক যোগাযোগ কীভাবে রক্ষা করতে হয়- এ সবই ছিল হযরত মাওলানা কারী শরীফ আহমদ গাঙ্গুহী রাহ.-এর সোহবতের বরকত।
মাদরাসা আশরাফুল উলূম রশীদী গাঙ্গুহের পর তিনি দারুল উলূম দেওবন্দে পড়াশোনা করেন। সেখানেও আসাতিযায়ে কেরামের স্নেহের পাত্র ছিলেন। আসাতিযায়ে কেরামের খেদমত করতেন। হুযুরদের কাছে কাছে থাকতেন। বিশেষ করে ফেদায়ে মিল্লাত হযরত আসআদ মাদানী রাহ. ও মুফতী সাঈদ আহমদ পালনপুরী দামাত বারাকতুহুমের খেদমত করতেন। দারুল উলূমের হাঙ্গামার সময় হযরত মাওলানা আরশাদ মাদানী দামাত বারাকাতুহুম কিছুদিন লোকচক্ষুর অন্তড়ালে ছিলেন। সেই সময় আড়াইহাজার হুযুর রাহ. আরশাদ মাদানী সাহেবের সাথে ছিলেন।
***
আড়াইহাজার হুযুর রাহ.-এর কর্মজীবন শুরু হয় মাদানীনগর মাদরাসায় এবং শেষ জীবন পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। হুযুর বেশিরভাগ সময় মাদরাসায় থাকতেন। মাদরাসা বন্ধ হয়ে গেলেও মাদরাসায় থাকতেন। মাদরাসা ‘পাহারা’ দিতেন। এমনকি ঈদের দিন নিজ এলাকায় ঈদের নামায পড়িয়ে মাদরাসায় চলে আসতেন। অসুস্থ অবস্থায়ও মাদরাসায় থাকতেন। মোটকথা, একান্ত অপারগতা ছাড়া মাদরাসায় অনুপস্থিত থাকতেন না। হাসপাতালে থাকাকালে বেশ কয়েকবার মাদরাসার টানে ছুটি নিয়ে চলে আসেন। বাড়িতে যাননি। মাদরাসায় ছুটে এসেছেন। যখন ক্যান্সার হুযুরের মাথায় ছড়িয়ে পড়ে এবং স্বাভাবিক মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তখনও মাদরাসার ফিকিরে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। মাদরাসার ও মাদরাসার প্রতিটি বস্তুর সাথে তার সম্পর্ক ছিল তুলনাহীন।
হুযুরের দিয়ানাতদারীও ছিল অতুলনীয়। এতেও রয়েছে আমাদের জন্য পাথেয়। এক্ষেত্রে হুযুরের অবস্থা ছিল- কখনো তিনি মাদরাসার টাকা ও ব্যক্তিগত টাকা এক পকেটে রাখতেন না। মাদরাসার টাকা আলাদাভাবে রাখতেন। মাদানীনগর মাদরাসার কাজে গিয়ে কখনো নিজের বাড়ির মাদরাসার কথা বলতেন না। যদি অগত্যা কেউ হুযুরের বাড়ির মাদরাসার জন্য কিছু দিতে চাইত তিনি রশিদ না থাকার অজুহাতে তা গ্রহণ করতেন না। বলতেন- কারো মাধ্যমে মাদরাসায় পাঠিয়ে দেবেন। মোটকথা, মাদানীনগর মাদরাসার কাজে গিয়ে নিজের মাদরাসার বিষয়ে ফিকির করা পছন্দ করতেন না। বাড়ির মাদরাসার যিম্মাদার ছিলেন তার ছোট ভাই। তিনি কখনো যদি হুযুরকে বলতেন- ভাইজান! অমুকের কাছে মাদরাসার কাজে যাচ্ছি আপনি যদি একটু ফোনে বলে দিতেন! হুযুর বলতেন- এটা খেয়ানত। তুমি নিজেই মাদরাসার পরিচয় দিয়ে ফিকির কর। হুযুর কখনো তা করতেন না। এ ছিল হুযুরের উঁচুস্তরের সর্তকতা ও আমানতদারী, যা আমাদের মত সাধারণের বুঝেও আসে না।
***
আল্লাহওয়ালা ও নেককার বান্দাদের একটি আলামত হল ইত্তেবায়ে সুন্নাত। সুন্নাতের পাবন্দী। তারা সবসময়, ঘরে কিংবা বাইরে, জীবনের সর্বক্ষেত্রে, সর্বাবস্থায় সুন্নতের পাবন্দ হয়ে থাকেন। আড়াইহাজার হুযুরও ছিলেন এমনই একজন মানুষ। তিনি সবসময় সুন্দর ও পরিপাটি চলা ফেরা করতেন। মাথায় বাবরী চুল আর সুদর্শন পাগড়ী। কখনো সবুজ আবার কখনো শুভ্র-সাদা। পোশাক-পরিচ্ছদে শুভ্রতাই হুযুরের পছন্দ ছিল। হুযুরের চেহারায় ভিন্ন ধরনের এক জ্যোতির্ময়তা ছিল- যা একদিকে মানুষের মাঝে শ্রদ্ধা-ভীতি জাগিয়ে তুলত, অপরদিকে কাছে যাওয়ার এক প্রবল আবেগ তৈরি করত। সবার সাথে তিনি হাসিমুখে কথা বলতেন। শত্রুর সাথেও তার ব্যবহার তেমনই ছিল যেমন ছিল পরমপ্রিয় বন্ধুর সাথে। আসলে আমরা যখন হুযুরের কাছে যেতাম তার কথা শুনতাম, তার স্নেহ পেতাম তখন যে কী পরিমাণ আনন্দিত হতাম তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এ সব কিছুর পিছনে ছিল তার কোমল ও সুন্দর আচরণ। তার সুন্দর আখলাকে মুগ্ধ হয়ে খিদমাহ হাসপাতালে কর্মরত এক ভাই বলেছিলেন- ‘মুসলমানদের আখলাক তো এমনই হয়’।
সর্বশেষ হুযুর যখন খিদমাহ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তখনও তার থেকে ছোট কোনো সুন্নাত ছুটে যাবে তা তিনি বরদাশত করতে পারতেন না। শেষ সময়ে হুযুর যখন খুবই অসুস্থ ছিলেন, নিজে কিছু করতে পারতেন না, দুই তিন জন ধরে হাম্মামে নিয়ে যেতে হত, সে সময়ও অসতর্কতায় যদি হুযুরের ডান পা আগে চলে যেত হুযুর খুব রাগ হতেন। বের হয়ে আবার প্রবেশ করতেন। পায়ে মোজা পরানোর সময় কেউ বাম পায়ের মোজা আগে পরালে রাগ করতেন। হাম্মামে যাওয়ার সময় টুপি পরার এহতেমাম করতেন। শেষ দিকে তো অবস্থা এমন হয়েছিল যে, নিজে এপাশ-ওপাশ হতে পারতেন না। তখনও কাছে যারা থাকতেন তাদেরকে বলতেন, আমাকে ডান কাতে শুইয়ে দাও।
হাসপাতালের বেডেও হুযুর পাগড়ি পরা ছাড়তে পারেননি। যখন তার ডান হাত অবস হয়ে যায় তখনও তিনি এত সুন্দর করে পাগড়ি বাধতেন তা দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না যে, তার অবস হাতে বাধা পাগড়ি। তখন তো তিনি ডান হাতে খাবার পর্যন্ত গ্রহণ করতে পারতেন না। এমনকি ইন্তেকালের সময় তিনি বড় ছেলে আব্দুর রহমানকে বললেন, ‘আমাকে ডান কাত করে শান্তির শোয়া শুইয়ে দাও।’ এ কথা বলার পর ‘আল্লাহু আকবার’ বলে তিনি ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ তাকে জান্নাতের উঁচূ মাকাম দান করুন। আমীন
আড়াইহাজার হুযুর রাহ.-এর মৃত্যুপরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে আশ্চর্য এক কথা বলেছেন ঐ সময় খিদমাহ হাসপাতালের দায়িত্বরত সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. তানভীর আহমাদ। তিনি বলেন- “ইন্তেকালের পর আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করি তাঁর পিউপিল (চোখের পুতলি) একটুও প্রসারিত হয়নি। আমরা যেসকল লক্ষণ দেখে রোগীর মৃত্যু নিশ্চিত করি তন্মধ্যে পিউপিল ডাইলেটেড ফিক্সড হয়ে যাওয়াও একটি বিশেষ লক্ষণ। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও দেখি হুজুরের পিউপিল ডাইলেটেড ফিক্সড (প্রসারিত ও অনড়) হয়নি। তখনও তা জীবিত ব্যক্তির মত স্বাভাবিক। আমরা বিষয়টি ফোনে প্রফেসর মুহিব্বুর রহমান সাহেবকে জানালে স্যার বলেন- অপেক্ষা করুন। আমি আসছি। প্রফেসর সাহেব এসে হুযুরকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে প্রফেসর সাহেব আমাদেরকে ডেকে বললেন- মৃত্যুর সময় পিউপিল ডাইলেটেড (প্রসারিত) হয় মৃত্যুর ভয়ে। হযরতকে মৃত্যুভয় ভীত করতে পারেনি। তাই রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক ছিল।”
এ তো কুরআনের এক আয়াতের বাস্তব নমুনা। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় বান্দাদের অবস্থা বর্ণনা করে বলেন-
اَلَاۤ اِنَّ اَوْلِیَآءَ اللهِ لَا خَوْفٌ عَلَیْهِمْ وَ لَا هُمْ یَحْزَنُوْن الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ كَانُوْا یَتَّقُوْن لَهُمُ الْبُشْرٰی فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَ فِی الْاٰخِرَةِ ؕ لَا تَبْدِیْلَ لِكَلِمٰتِ اللهِ ؕ ذٰلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِیْم
***
কর্মজীবনেও আসাতিযায়ে কেরাম ও আকাবির উলামায়ে কেরামের প্রতি হুযুরের আযমত আকিদত ও খেদমতের স্পৃহা ছিল অতুলনীয়। তাঁর দীর্ঘদিনের সাথী কারী নাওয়াব আলী সাহেব বলেন- মাওলানা আবদুল আউয়াল রাহ. আমাকে সবসময় বলতেন, নাওয়াব দেখ!
نہ کتابوں سےنہ وعظوں سے نہ زر سے پیدا + دین ہوتا ہے بزرگوں کی نظر سے پیدا
সাথী হয়ে সাথীকে নসিহত করা, সহকর্মী সহকর্মীকে নসিহত করা- এ তো বুযুর্গানে দ্বীনের প্রতি আড়াইহাজার হুযুর রাহ.-এর অধিক মুহাব্বতের প্রতিফলন। হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর জামাতা হযরত মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ দামাত বারাকাতুহুম মাদানীনগর মাদরাসার প্রাক্তন উস্তায। এখনো প্রায়ই মাদানীনগরে আসেন। আড়াইহাজার হুযুর রাহ. সম্পর্কে বলেন-
“মরহুমের কর্মজীবন সম্পূর্ণ কুরবানী ও মুজাহাদার জীবন ছিল। এই কর্মজীবনে মুরব্বিকে কীভাবে মানতে হয়, তার নযীর তিনি স্থাপন করে গেছেন। দ্বীনের জন্য কুরবানী কীভাবে পেশ করতে হয় তার দৃষ্টান্ত তার জীবন। মরহুম কেন যেন আমাকে বে-নযীর মুহাব্বত করতেন। আমি আমার নিজের প্রয়োজনে তাঁর কাছে যখনই ফোন করতাম, সাথে সাথে কেটে দিয়ে তিনি ফোন করতেন। কখনো আমার কলের মাধ্যমে কথা বলার সুযোগ তিনি আমাকে দেননি।
রাত বারটা কি একটা দুইটা! শুধু জানাতাম- মাওলানা আমি রাতে মাদানীনগরে আসছি, গেট তো বন্ধ থাকবে, পাহারাদারকে একটু বলে রাখবেন। তিনি পাহারাদারকে কী বলবেন, নিজেই আমি আসা পর্যন্ত বসে থাকতেন। চা-নাস্তা নিয়ে অপেক্ষা করতেন। খাবার নিয়ে অপেক্ষা করতেন। আমার পৌঁছতে কখনো দুইটা কখনো তিনটা হত। তিনি বসে থাকতেন। আবার চলে যাব ফজর পড়ে। প্রায়ই দূরের সফরের তাকাযা থাকত। ফজরের পর মসজিদে তালীম হয় ততটুকু সময় অপেক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তো ফজরের নামাযের সালাম ফিরিয়ে রুমে গিয়ে দেখি নাস্তা প্রস্তুত। আমি সকালে চলে যাব তাই তিনি রাতেই নাস্তার ইন্তেজাম করে রাখতেন।
মরহুমের জীবনে একটা জিনিস আমি পেয়েছি- দুনিয়ার প্রতি তার কোনো আকর্ষণ আমি দেখিনি। তাঁর সারা জীবন সারা কুরবানী ছিল দ্বীনের জন্য, প্রতিষ্ঠানের জন্য, মাদরাসার জন্য।”
***
আড়াইহাজার হুযুর রাহ.-এর বর্ণাঢ্য জীবনে এমন অনেক দিকই রয়েছে যা আমাদের জন্য জীবন পথের পাথেয় যোগাবে। আরেকটি ছোট্ট বিষয় আলোচনা করেই স্মৃতিচারণের ইতি টানব।
তাঁর আরেকটি গুণ ছিল, তিনি নিজেকে গোপন রাখতেন। মানুষের সামনে নিজেকে জাহির করতে চাইতেন না। হুযুর বিভিন্ন সময় শায়েখে স্বন্দ্বীপী রাহ.-এর প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাগুলোর পরিদর্শনে যেতেন, মাদানীনগর মাদরাসার মুহতামিম হযরত মাওলানা ফয়জুল্লাহ স্বন্দ্বীপী দামাত বারাকাতুহুমের সাথে বিভিন্ন মাহফিলের দাওয়াতে যেতেন, কোথাও তিনি বয়ান করতেন না। এমনকি মাদানীনগর মাদরাসার বার্ষিক ইছলাহী জোড়েও বয়ান করতেন না। কখনো কোনো এন্তেজামি বিষয়ে কিছু বলতেন। কিন্তু হুযুরের আলোচনা ও উপস্থাপন যোগ্যতা ছিল অসাধারণ। তারপরও তিনি বয়ান খুব কম করতেন।
মাদানীনগর মাদরাসার প্রবীণ উস্তায হযরত মাওলানা গিয়াসুদ্দীন ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম একবার আড়াইহাজার হুযুর রাহ.-এর সাথে হুযুরের শ্বশুর বাড়িতে বয়ান করতে গিয়েছিলেন। নিরব নিভৃত এক পল্লি। আড়াইহাজার হুযুর রাহ.-এর ঐ দিনের বয়ান সম্পর্কে গিয়াসুদ্দীন সাহেব হুযুর বলেন, আমাদের সকলেরই ধারণা হুযুর বয়ান করেন না। কিন্তু সেদিন নিভৃত ঐ পল্লিতে তিনি এমন বয়ান করলেন সাধারণত পল্লি-গ্রামের মাহফিলের ওয়ায়েজিনে কেরাম এ ধরনের বয়ান করেন না। এত দামি এবং এত উঁচু স্তরের কথা বলেছিলেন, সাধারণ কোনো মাহফিলে এমন বয়ান আমি কোনো দিন শুনিনি। মাহফিল শেষে ফেরার পথে রাস্তায় আমি তাঁকে বললাম, কত জায়গায় কত মাহফিলের আয়োজন হয়। মাহফিল তো আসলে সুখ্যাতির জন্য নয়, এ তো দ্বীনের জরুরত। উম্মতের ইসলাহ ও উম্মতের সংশোধন। আপনি কেন মাহফিলে বয়ান করেন না বা করতে রাজি হন না? তিনি সাথে সাথে উত্তর দিলেন, “ভাই! মাহফিলের মাধ্যমে মানুষ প্রসিদ্ধ হয়ে যায়, মাশহুর হয়ে যায়। আমি প্রসিদ্ধ হতে চাই না। আমি চাই আল্লাহর কাছে মাকবুল হতে।”
সত্যিই আড়াইহাজার হুযুর রাহ. যা চেয়েছিলেন, আশা করি আল্লাহ তাআলা তাকে তাই দান করেছেন। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তার দ্বীনের জন্য মাকবুল হওয়ার তাওফীক দান করুন। আড়াইহাজার হুযুর রাহ.-কে আল্লাহ তাআলা জান্নাতে উঁচু মাকাম দান করুন। আমীন।
[1] শাইখুল ইসলাম হযরত মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির অন্যতম খলিফা ও মাদানীনগর মাদরাসা ঢাকা’র প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইদরীস স্বন্দ্বীপী রাহ.। যিনি আমাদের মাঝে শায়েখে স্বন্দ্বীপী নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন।