পয়লা মে : আসুন, ১লা মে’র ‘শ্লোগান’ ব্যক্তিজীবনে কার্যকর করি
বছরের নানা দিবসের মতো মে দিবসটিও বেশ আড়ম্বরের সাথে উদযাপিত হয়। বাণী ও বক্তব্য মিছিল ও র্যালি, আর নানা বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয়। সরকারিভাবে এ দিন ছুটি থাকে। পত্র-পত্রিকায় বিশেষ প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। অন্যান্য প্রচার-মাধ্যমেও থাকে নানা অনুষ্ঠানমালা। এভাবে বেশ বিস্তৃত পরিসরে এ দিবসটি উদযাপিত হয়।
এই বিপুল-বিস্তৃত আয়োজনের উদ্দেশ্য কী? সচেতনতা সৃষ্টি। কীসের সচেতনতা? একেক বছর একেক প্রতিপাদ্য থাকলেও মূল উদ্দেশ্য, শ্রমিকের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা। বিভিন্ন শ্লোগানের মধ্য দিয়ে এ দিবস পালনের যে উদ্দেশ্য উচ্চারিত হয় তা ইতিবাচক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এ সকল ইতিবাচক বক্তব্য আমাদের মালিক-শ্রমিকের বাস্তব জীবনে কতটুকু প্রতিফলিত।
শ্রম একটি জাতির অর্থনৈতিক জীবন ও সামাজিক জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। শ্রমিক আপন জাতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সুতরাং জাতির সামষ্টিক জীবনের উন্নতি-অগ্রগতির জন্য শ্রম ও শ্রমিকের সঠিক মূল্যায়ন অতি প্রয়োজন। সঠিক শ্রম ও সঠিক মজুরিÑ এ দুটো বিষয় নিশ্চিত হওয়া শ্রমের ক্ষেত্রে ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠা ও শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্কের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু তা কীভাবে হতে পারে?
নানাবিধ আনুষ্ঠানিকতা সত্ত্বেও আর্থিক উন্নতি বিশেষ একটি শ্রেণির মধ্যেই সীমবাদ্ধ থাকার বিষয়টি আপাতত দূরে সরিয়ে রেখে যদি এ প্রশ্ন করা হয় যে, একটি জাতির উন্নতির জন্য শুধু অর্থনৈতিক উন্নতিই কি যথেষ্ট, তাহলে নিঃসন্দেহে এর উত্তর হবে, শুধু অর্থনৈতিক উন্নতিই যথেষ্ট নয়। জ্ঞানগত, চেতনাগত ও স্বভাব-চরিত্রগত উন্নতিরও প্রয়োজন। তাহলে শ্রমজীবী শ্রেণি যে জাতির একটি বড় শ্রেণি ঐ জাতির উন্নতি কীভাবে নিশ্চিত হবে এই শ্রেণিটির জ্ঞানগত, চেতনাগত ও স্বভাব-চরিত্রগত উন্নতি ছাড়া? সুতরাং মানবীয় সদগুণের বিকাশের ব্যবস্থাও শ্রমিকের এক বড় অধিকার। সুতরাং একজন শ্রমিকের জন্যও সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা, নিয়মানুবর্তিতা ও কর্তব্য-সচেতনতার মতো স˜ গুণের অধিকারী হওয়ার এবং মিথ্যা, অবিশ্বস্ততা ও অনৈতিকতার মতো মন্দ স্বভাব থেকে মুক্ত থেকে একজন আদর্শ মানুষ হওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা থাকতে হবে। এ তার অধিকার। শ্রমিক মানেই কি সে মানুষ হিসেবেও দ্বিতীয় শ্রেণির? সে কি সমাজের একজন ভালো মানুষ ও আদর্শ মানুষ হিসেবে পরিচিত হবার সুযোগ পাবে না? আর তার কি নেই আখিরাত? এবং আখিরাতের মুক্তি ও নাজাতের প্রয়োজন? সমাজ ও দায়িত্বশীলদের কাছে শ্রমজীবী মানুষের এই অধিকারগুলো আজ খুব বেশি উচ্চারিত নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দিনমান পরিশ্রম এবং সন্ধ্যার পর নানা চটুল ‘বিনোদন’Ñ এই তো শ্রমিক জীবনের গৎবাধা রুটিন।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের চেষ্টা দুই দিক থেকে হতে হবেই : শ্রমজীবী মানুষের মাঝেও তার শ্রম-সংক্রান্ত অধিকারের মতো ভালো মানুষ হওয়ার প্রয়োজন ও সম্ভাবনা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। তারও যে আখিরাত রয়েছে, তাকেও যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সামনে দাঁড়াতে হবেÑ এই চেতনা ও বিশ্বাস তার মধ্যে জাগ্রত করতে হবে। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত শুদ্ধির ক্ষেত্রে এর কোনো বিকল্প নেই। আর সর্বস্তরের দায়িত্বশীলদেরকে তাদের সদগুণের বিকাশের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
এই শুদ্ধি ও গঠনের ক্ষেত্রে দুই ধারার প্রচেষ্টাই অতি জরুরি; ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার ধারা ও সমষ্টিগত প্রচেষ্টার ধারা। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার ধারায় নিজের শুদ্ধি ও নিজের সংশ্লিষ্টদের শুদ্ধি দুটোই শামিল। আর এ ধারারই বিস্তৃত ও সম্প্রসারিত রূপ হচ্ছে সমষ্টিগত শুদ্ধির প্রয়াস। ব্যক্তির সমষ্টি এবং দায়িত্বশীলতার ক্রমবিস্তৃতির মাধ্যমেই তো ব্যক্তি থেকে সমাজ ও সমাজ থেকে রাষ্ট্র। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তিগত প্রয়াস ও ব্যক্তিগত কর্তব্য পালন যে কোনো বাঞ্ছিত পরিবর্তনের সূতিকাগার। শুধু আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমেও যেমন কোনো বিপ্লব সাধিত হতে পারে না, তেমনি ব্যক্তিগত কর্তব্য পালনে উদাসীন হয়ে শুধু ‘সামাজিক কর্ম-কা-ে’র দ্বারাও তা হতে পারে না। পরিবর্তনের সূচনা হতে হয় ব্যক্তি থেকে। এ পরিবর্তন যখন মানে ও পরিমাণে বিস্তৃত হয় তখন তা সামাজিক বিপ্লবের রূপ ধারণ করে। এটা সবক্ষেত্রেই সত্য, পয়লা মে’র ক্ষেত্রেও সত্য। তাই শ্রমিকের অধিকার-প্রসঙ্গটি শুধু দিবস-পালনের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ না রেখে ব্যক্তিগত চর্চায় বিস্তার লাভ করা উচিত। প্রত্যেকের মাঝে এই চেতনা জাগ্রত হওয়া উচিত যে, আমার দ্বারা যেন কারো হক নষ্ট না হয়, তার হক ও প্রাপ্য যেন আমি যথাযথভাবে পরিশোধ করি, অতপর তার বিশ্বাসগত, আচরণগত, রুচি ও চেতনাগত উন্নতিরও প্রয়াস গ্রহণ করি। বাড়ির কাজের ছেলে বা মেয়ে থেকে শুরু করে দারোয়ান, ড্রাইভার, কেয়ারটেকার, ব্যবসা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, মিল-কারখানার শ্রমিক, এমনকি সাময়িক প্রয়োজনে কাজে লাগানো শ্রমজীবী শ্রেণি-রিকসাওয়ালা, মুটে-মজুর, নির্মাণ-শ্রমিক ইত্যাদি সব শ্রেণির মানুষের হক ও প্রাপ্য আদায়ে এবং সময়-সুযোগ অনুসারে তাদের চেতনা-বিশ্বাস ও স্বভাব-আচরণের শুদ্ধির বিষয়ে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে সচেতনতা ও অনুশীলন প্রয়োজন। আর তা হতে পারে আল্লাহর ভয় ও আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার অনুভূতি সৃষ্টির মাধ্যমে এবং ইসলামের বিধি-বিধান ও জীবনযাপনের রীতি-নীতি শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে। ইসলাম আমাদের সামনে শুদ্ধ সঠিক পরিবর্তনের এই উপায় নির্দেশ করে। ইসলামের এই নির্দেশনা গ্রহণ না করে শুধু প্রচলিত সামাজিক আনুষ্ঠানিকতা যে অভীষ্ঠ লক্ষ্য অর্জনে সফল হবে না তার প্রমাণ তো লিখে বোঝাবার প্রয়োজন নেই। এর প্রমাণ চারপাশের চোখে দেখা বাস্তবতা।