একজন আলেমে রব্বানীর প্রতিকৃতি
[হযরত মাওলানা আবু সাবের আব্দুল্লাহ দামাত বারাকাতুহুমের এই শানদার ইলমী প্রবন্ধে তালিবে ইলমদের জন্য রয়েছে অনেক ইলমী, আমলী ও চিন্তার খোরাক। এজন্য আমি প্রবন্ধটি ‘শিক্ষার্থীদের পাতায়’ ছাপানো মুনাসিব মনে করেছি। কারণ, এ প্রবন্ধের মূল পাঠক তালিবানে ইলম। তাই প্রবন্ধের উর্দূ ইবারতসমূহের তরজমা উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে হয়নি। আল্লাহ তাআলা প্রবন্ধকারের হায়াতে আফিয়াতের সাথে বরকত দান করুন এবং তাকে জাযায়ে খায়ের দান করুন। আমীন। Ñআবদুল মালেক]
প্রতিটি দেশের একটি সীমানা থাকে, সীমান্ত প্রহরী থাকে। ইসলামেরও একটি সীমানা আছে। কর্মগত, চিন্তাগত সকল বিধি-বিধানের আছে সুস্পষ্ট চৌহদ্দি, সুনির্দিষ্ট অবকাঠামো। এর ভিতরে যা পড়ে তা ইসলাম, যা পড়ে না তা অনিসলাম।
তো ইসলামী বিধি-বিধানের এই সীমান্ত যারা প্রহরা দেন, যারা ইসলামকে স্বরূপে উপস্থাপন করেন, তারা হলেন আহলে ইলমের জামাত, উলামায়ে কেরামের জামাত। আল্লাহ তাঁর মনোনীত এই দ্বীন সংরক্ষণের জন্য যুগে যুগে অবিচ্ছিন্নভাবে ওলামায়ে কেরামের জামাত সৃষ্টি করে থাকেন। যারা সকল লোভ-লালসা, ভয়-ভীতি এবং চরম প্রতিকূলতা উজিয়ে দ্বীন রক্ষার মিশনে নিজেদের উৎসর্গ করে দেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত,
يَحْمِلُ هَذَا الْعِلْمَ مِنْ كُلِّ خَلَفٍ عُدُولُهُ، يَنْفُونَ عَنْهُ تَحْرِيفَ الْغَالِينَ، وَانْتِحَالَ الْمُبْطِلِينَ، وَتَأْوِيلَ الْجَاهِلِينَ .
প্রত্যেক প্রজন্মের নির্ভরযোগ্য নেককার উত্তরসূরীরা (পূর্বসূরীদের কাছ থেকে) এই দ্বীনী ইলম ধারণ করবে। আর গুলুকারীদের বিকৃতি, ইসলামবিরোধী বাতিলপন্থিদের মিথ্যাচার এবং মূর্খদের অপব্যাখ্যা বিদূরিত করবে (এবং দ্বীনের স্বরূপ সংরক্ষণ করবে)। Ñশরহু মুশকিলিল আছার, ৩৮৮৪
নবীজী ইরশাদ করেনÑ
لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي ظَاهِرِينَ عَلَى الْحَقِّ، لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ، حَتَّى يَأْتِيَ أَمْرُ اللهِ.
এই উম্মতের একটি দল সর্বদা হকের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। তাদের বিরুদ্ধাচরণকারীরা তাদের দ্বীনের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। যাবৎ না কেয়ামতের নির্ধারিত আলামত প্রকাশ পায়। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯২০
ইসলাম সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা । ফলে কোনো যামানাই আহলে ইলম থেকে শূন্য হয় না। ইসলামধর্মে বিকৃতি সাধন করে কেউ কখনো পার পায় না। আগের, পরের কিংবা সমকালের অধিকাংশ আহলে ইলম এবং শাস্ত্রজ্ঞ মনিষী ঐ বিকৃতি নস্যাৎ করে দেন। ইসলাম-অনিসলামের পার্থক্য দিন-রাতের মতই পরিষ্কার করে দেন। দ্বীন সংরক্ষণের কাজে ‘মিন জানিবিল্লাহ’ নিবেদিত প্রাণ সেই আল্লাহ প্রেমিক নিঃস্বার্থ আহলে ইলমগণের ধারাবাহিকতায় কালের অন্যতম ব্যক্তিত্ব হলেন আমাদের উস্তায ও মুরুব্বী হযরত মাওলানা কাজী মু‘তাসিম বিল্লাহ রাহ.। (জন্ম : ১৩৫২ হি. মৃত্যু : ১৪৩৪ হি.)
কাজী সাহেব হুযুর রাহ. ছিলেন একজন আলেমে রব্বানী। আজীবন তিনি নিজের আলেমানা দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিষয়ে সচেতন ছিলেন। নিজের আলেম পরিচয়ের মাঝে তিনি জীবনের যাবতীয় মাহাত্ম্য ও বৈভব খুঁজে পেতেন। যে সমস্ত আলেমানা গুণ হুযুরের ব্যক্তিত্বে পরিদৃশ্যমান ছিল, হুযুরের জীবন যে বৈশিষ্ট্যগুলো কেন্দ্র করে আবর্তিত ছিল, তার মাত্র কয়েকটি নিলেও আমাদের সামনে ভেসে উঠবে একজন আলেমে রব্বানীর প্রতিচ্ছবি, সালাফে সালেহীনের জীবন্ত নমুনা।
ইনাবাত ইলাল্লাহ ছিল হুযুরের বড় গুণ। সকল অবস্থায় আল্লাহ-মুখিতা এবং আখেরাত-মুখিতা প্রতিভাত ছিল হুযুরের প্রতিটি আচরণে। আর এতে কোনো বানাওয়াটি ছিল না। আল্লাহর সাথে হুযুরের সম্পর্কটা ছিল সরল শিশুর মত। পিতা-মাতার প্রতি একটি শিশু যেমন স্বভাব-সঞ্জাত আকর্ষণে সমর্পিত হয়, কাজী সাহেবও শিশুর সারল্যে আল্লাহর প্রতি সমর্পিত থাকতেন। সুখের সময় তার সর্বাঙ্গ থেকে শোকর যেন ঝরে ঝরে পড়ত। আর দুঃখের দিনে আল্লাহর প্রতি সমর্পণ ও সবর তাঁকে মহিমান্বিত করত। একবার হাসপাতালে হুযুর আমাকে স্মরণ করলেন। খবর পেয়ে ছুটে গেলাম। দুআ পড়লামÑ
لاَ بَأْسَ، طَهُورٌ إِنْ شَاءَ اللَّهُ.
দুঃখের কিছু নেই। আল্লাহ চাহে তো ভালো হয়ে যাবেন। এই রোগ-যন্ত্রণা গুনাহখাতা ধুয়ে মুছে সাফ করে দিবে। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৩৬১৬
أَسْأَلُ اللَّهَ الْعَظِيمَ رَبَّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ أَنْ يَشْفِيَكَ.
মহান আরশের মালিক মহামহিম আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন আপনাকে রোগমুক্ত করেন। Ñসুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩১০৬
হুযুর ‘আমীন আমীন’ বললেন। ব্যাকুল হয়ে আমাকে কাছে টেনে বললেন, মাওলানা! আখেরাতের ঘাটিগুলো কীভাবে পার হব? আরয করলাম, নবীজী বলেছেন, যে যাকে মুহাব্বত করে সে তার সঙ্গে থাকবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬১৬৮) আপনি ইনশাআল্লাহ আপনার মাহবুব আকাবির ও সালাফে সালেহীনের সঙ্গে থাকবেন। হুযুর শিশুর মত কাঁদলেন আর আকাশের দিকে দু’হাত তুলে বলতে লাগলেন, ‘কবুল করো আল্লাহ! কবুল করো!’
সাহাবায়ে কেরাম ইলমে দ্বীন গ্রহণ করেছেন নবীজীর কাছ থেকে। তাঁদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছেন তাবেঈনে কেরাম। তাবেঈনের কাছ থেকে গ্রহণ করেছেন তাঁদের পরবর্তীগণ। এভাবে প্রজন্ম পরম্পরায় এক অবিচ্ছিন্ন ¯্রােতধারায় আমাদের পর্যন্ত দ্বীন ও দ্বীনী ইলম পৌঁছেছে। সাহাবা-তাবেঈনের যামানায় সূত্রবিচ্ছিন কোনো ব্যক্তি দ্বীনের সংরক্ষক আহলে ইলমের কাতারে আসতে পারেনি। পরবর্তীকালেও বিচ্ছিন্ন সূত্র থেকে বিদ্যা অর্জন করে কেউ কখনও আহলে ইলম ও আহলে হক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারেনি। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
خُذُوا الْعِلْمَ قَبْلَ أن يَذْهَبَ، قَالُوا : وَكَيْفَ يَذْهَبُ الْعِلْمُ يَانَبِيَّ اللَّهِ، وَفِينَا كِتَابُ اللَّهِ؟ قَالَ : فَغَضِبَ، ثُمَّ قَالَ : ثَكِلَتْكُمْ أُمَّهَاتُكُمْ أَوَلَمْ تَكُنِ التَّوْرَاةُ وَ الْإِنْجِيلُ فِي بَنِي إِسْرَائِيلَ، فَلَمْ يُغْنِيَا عَنْهُمْ شَيْئًا؟ إِنَّ ذَهَابَ الْعِلْمِ أَنْ يَذْهَبَ حَمَلَتُهُ، إِنَّ ذَهَابَ الْعِلْمِ أَنْ يَذْهَبَ حَمَلَتُهُ.
তোমরা ইলম অর্জন করো তা বিদায় নেয়ার আগে। সাহাবীগণ আরয করলেন, ইলম কীভাবে বিদায় নেবে, হে আল্লাহর নবী! আমাদের মাঝে তো আল্লাহর কিতাব বিদ্যমান? বর্ণনাকারী বলেন, এ কথায় নবীজী রুষ্ট হলেন অতপর বললেন, তোমাদের মরণ হোক! বনী ইসরাঈলের মাঝে কি তাওরাত-ইঞ্জিল ছিল না? কিন্তু (ইলম অর্জন ও দ্বীন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে) শুধু কিতাব তাদের কোনো কাজে আসেনি। আরে! ইলম বিদায় নেয়ার অর্থ (আহলে ইলম থেকে ইলম শিখে নেয়ার আগেই) আহলে ইলমের মৃত্যু হওয়া, ইলম বিদায় নেয়ার অর্থ আহলে ইলম বিদায় নেওয়া! Ñসুনানে দারেমী, হাদীস ২৪৬
প্রখ্যাত তাবেঈ মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন (মৃত্যু : ১১০ হি.) রাহ. বলতেন,
إِنَّ هَذَا الْعِلْمَ دِينٌ، فَانْظُرُوا عَمَّنْ تَأْخُذُونَ دِينَكُمْ.
এই ইলম হল দ্বীন। সুতরাং তোমরা তোমাদের দ্বীন কার কাছ থেকে গ্রহণ করছো লক্ষ রেখো। Ñমুকাদ্দিমায়ে সহীহ মুসলিম
সুতরাং ইলম অর্জন করতে হবে আহলে ইলম থেকে। যার সূত্র নেই, যে নেককার নয়, তার কাছ থেকে ইলম গ্রহণ করা যায় না। ইলমে দ্বীন গ্রহণ করতে হয় রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রবাহিত নেককার উস্তায-শাগরিদগণের অবিচ্ছিন্ন ¯্রােতধারা থেকে। হযরত কাজী সাহেব রাহ. এমনই এক স্বীকৃত আহলে ইলমের ¯্রােতধারা থেকে ইলম অর্জন করেছেন। আর এ ধারার মহান আকাবির ও পূর্বপুরুষগণের প্রতি প্রেম ও ভালোবাসা তাঁর রক্ত-মাংশে মিশে গিয়েছিল। নিকটতম আকাবির হযরত মাদানী রাহ. থেকে উপরের দিকে শাহ ওয়ালি উল্লাহ রাহ. পর্যন্ত সাত স্তরের সালাফে সালেহীনের প্রতি কাজী সাহেব হুযুরের আস্থা ও শ্রদ্ধা ছিল এককথায় অপরিসীম। এঁদের দ্বীনদারী, তাকওয়া-পরহেজগারী, উলূম ও মাআরিফ এবং দ্বীনী খেদমতের আলোচনা-কল্পনাই ছিল তাঁর এশকের নিরালা জগৎ। বিশেষত তাঁর শায়খ ও মুরশিদ শাইখুল ইসলাম হযরত মাদানী রাহ.-এর প্রতি তাঁর ভক্তি ও ভালোবাসা তো প্রবাদতুল্য। মূলত, তিনি সালাফে সালেহীনের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বিরাট দৌলত লাভ করেছিলেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে দুআ শিখিয়েছেনÑ
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ حُبَّكَ، وَحُبَّ مَنْ يُحِبُّكَ، وَالعَمَلَ الَّذِي يُبَلِّغُنِي حُبَّكَ...
হে আল্লাহ! আমাকে দাও তোমার ভালোবাসা, যে তোমাকে ভালোবাসে তার প্রতি ভালোবাসা এবং এমন কাজের তাওফীক, যা আমাকে তোমার ভালোবنসায় উত্তীর্ণ করবে...। Ñজামে তিরমিযী, হাদীস ৩৪৯০
কুরআন মাজীদে আল্লাহ পাক মুমিনদেরকে সালাফের জন্য এভাবে দুআ করতে শিখিয়েছেনÑ
رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ.
হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ক্ষমা করে দাও এবং আমাদের ভ্রাতৃবৃন্দকেও, যারা আমাদের আগে ঈমান এনে গত হয়েছেন। আর ঈমানদারগণের বিষয়ে আমাদের অন্তরে কোনো দ্বেষ বাকী রেখো না। আমাদের মালিক! তুমি বড় ¯েœহময়, বড় দয়ালু। Ñসূরা হাশর (৫৯) : ১০
সবার জন্যই তাকওয়া-তাহারাত, যুহদ-কানাআত, ইখলাস-ইস্তেগনা ইত্যাদি শরীয়তের অত্যন্ত মাতলুব বিষয়। আর এগুলো অর্থাৎ দুনিয়াবিমুখতা, অল্পে তুষ্টি, নির্লোভতা, প্রচারবিমুখতা, খোদাভীতি ও যাহেরী-বাতেনী পবিত্রতা ইত্যাদি হল একজন আলেমে রব্বানীর অপরিহার্য গুণ, আহলে ইলমের কাতারে শামিল হওয়ার পূর্বশর্ত। হযরত কাজী ছাহেব হুযুর ছিলেন এসকল গুণাবলীর বাস্তব নমুনা। দেশ স্বাধীনের পর মরহুম আব্দুর রশীদ তর্কবাগিশ ছাহেব কাজী ছাহেব হুযুরের নামে বায়তুল মুকাররমের দু’টি দোকান বরাদ্দ নিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু হুযুর নিতে অস্বীকার করেন। মাদরাসার এক ছেলেকে হুযুর ফোনে কথা বলার জন্য পাঠালেন। সে অল্প টাকায় দীর্ঘসময় কথা বলে ফিরে এল। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ওটা চোরা লাইনের ফোন। হুযুর হিসাব করে পূর্ণ টাকার ডাক টিকেট কিনে ছিঁড়ে ফেললেন এবং বললেন, ‘রাষ্ট্রের টাকা রাষ্ট্রের কাছে পৌঁছে দিলাম।’ উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় কাজী সাহেব হুযুর ইরাকের পক্ষে ছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের উপস্থিতির বিরুদ্ধে ছিলেন। ইরাক সরকার তার পক্ষে জনমত গঠনের জন্য বিরাট ফান্ড সরবরাহ করেছিল। কাজী সাহেব হুযুর ঐ ফান্ড সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করেন।
আল্লাহকে অনুভব করার বিষয়টি মানুষের সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত। এজন্য পৃথিবীর প্রায় সকল মানুষ ¯্রষ্টায় বিশ্বাসী। এই সৃষ্টিগত সুপ্ত বৈশিষ্ট্যকে যে যত বিকশিত করতে পারে, সে তত সফল। হযরত কাজী সাহেব রাহ. এক্ষেত্রে বিরল সফলতার অধিকারী ছিলেন। যখন নামাযে দাঁড়াতেন, মনে হত আল্লাহর সাথে কানাকানি করছেন। পৃথিবীর সব ভার ফেলে দিয়ে শান্ত-সমাহিত চিত্তে দীর্ঘ নামাযে নিমগ্ন হয়ে যেতেন। সেজদায় গেলে মনে হত, শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, রক্তবিন্দু এমনকি পোশাক-আশাকসহ সব যেন একযোগে লুটিয়ে পড়েছে আল্লাহ তাআলার কুদরতী পায়ে। দুআর জন্য হাত তুললে মনে হত, আহা! আমাদের আল্লাহ আমাদের কত কাছে! আমাদের ¯্রষ্টা আমাদের কত নিকটে!
হুযুর আজীবন নিজের ইবাদত-বন্দেগী জিকির-আযকার লোকচক্ষুর অন্তরালে রেখেছেন। তিনি যে একজন বড় মাপের ব্যক্তি, কাউকে তা ঘুনাক্ষরেও জানতে দিতেন না বরং তা যেন নিজেই বেমালুম ভুলে থাকতেন। তবে তিনি আত্মমর্যাদা-সচেতন ছিলেন। কখনও আহলে ইলমের মর্যাদা ক্ষুণœ হতে দিতেন না। এমন কোনো কাজ করতেন না, যার ফলে ইলমের মর্যাদাহানি হয়।
বিনয়-ন¤্রতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, মার্জিত কথাবার্তা, শৃঙ্খলা-সুরুচি, ভদ্রতা ও সৌজন্যবোধ ইত্যাদির ক্ষেত্রে সচরাচর হুযুরের জুড়ি মেলা কঠিন। হুযুর কখনও অরুচিকর কোনো শব্দ মুখে আনতেন না। কারো ওপর দৃষ্টিকটু কঠোরতা করতেন না। অথচ তিনি যে পদে কাজ করতেন, সেখানে কঠোরতা ব্যতীত শৃঙ্খলা রক্ষা করা বেশ কঠিন। কিন্তু হুযুর নিজের গাম্ভীর্য, ভদ্রজনোচিত শাসন পদ্ধতি, উপদেশ-নসীহত ইত্যাদির মাধ্যমে কাজ উদ্ধার করতেন। কথা বলতেন শুদ্ধ ভাষায়, ভরাট গলায়। হুযুরের কাছে মানুষ মাত্রই ছিল শ্রদ্ধার পাত্র। তাঁর বিনয়-ন¤্রতা ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত।
হুযুরের সাধারণ কথাবার্তাও ছিল সাহিত্যরসপূর্ণ এবং প্রসাদগুণ-সম্পন্ন। মালিবাগ জামিয়ার সেক্রেটারী আলহাজ্ব হারুন-অর-রশীদ সাহেব একবার হাসপাতালে হুযুরকে দেখতে এলেন। আলেম-উলামার অনেক উপস্থিতি দেখে বললেন, আমি ‘নগণ্য’ মানুষ, এখন যাই। হুযুর পাশের একজনকে বললেন, ‘সেক্রেটারী সাহেবকে একটু ‘গনে’ নাও আর তাঁর জন্য গণ্য মান্য-জনোচিত পংক্তির ব্যবস্থা করো!’ অসুস্থ হুযুরের রসিকতায় সবাই হেসে কুটিকুটি হল।
ইলম অর্জন ও সংরক্ষণ আহলে ইলমের প্রধান শোগল, মূল ব্যস্ততা। এর পেছনেই বরাদ্দ থাকবে তার সিংহভাগ সময়। কাজী সাহেব হুযুর সবসময় তার শিষ্য-শাগরিদদের এ বিষয়ে জোর তাকিদ দিতেন। অন্য কাজে হুযুরের সময় কেটে যেত বলে যারপরনাই আফসোস করতেন। যা তিনি সুস্পষ্ট জানতেন কেবল তা বলতেন। অন্য ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টজনের নিকট রুজু করতেন। যে মজলিসে যে বিষয়ে বয়ান করতেন, কুরআন-সুন্নাহর স্বীকৃত বক্তব্যগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করতেন। সতর্কতার সাথে দুর্বল-অসমর্থিত কথা এবং গলত-মশহুর এড়িয়ে যেতেন।
দরসে হুযুর প্রথাগত তাকরীর করতেন না। যে বিষয়গুলো ছাত্রদের নিজেদের পড়া উচিত এবং বুঝা উচিত, সেগুলো বলে ছাত্রদের আরামপ্রিয় বানানোর মোটেই পক্ষপাতী ছিলেন না। হুযুর তাঁর তাকরীরের মাধ্যমে মূলত সে বিষয়গুলো ছাত্রদের মাঝে স্থানান্তরিত করার চেষ্টা করতেন, যার জন্য ব্যক্তিগত অধ্যয়ন যথেষ্ট নয় বরং বিশেষজ্ঞ আলেমের শিষ্যত্ব গ্রহণ জরুরি। যেমন, ইসলামের রূহ, শরীয়তের মেযাজ, তাফাক্কুহ ফিদ্ দ্বীন ইত্যাদি। আল্লাহ পাক বলেন,
فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ.
এমন কেন হয় না যে, প্রত্যেক বড় দল থেকে একটি ছোট দল বের হয়ে যাবে দ্বীনের বুঝ-সমঝ ও তাফাক্কুহ হাসিলের জন্য। Ñসূরা তাওবা (৯) : ১২২
হুযুর হাদীসের নান্দনিক তরজমা, সরল ফিকহী আলোচনা, হাদীসের রূহ ও সারনির্যাস উদ্ধার করে করে সরসভাবে উপস্থাপন করতেন এবং এর স্বাদে নিজে বিভোর হতেন, ছাত্রদের অভিভূত করতেন। ছাত্রদের নিয়ে যেতেন নবীজীর যামানায়। দ্বীন ও হামেলে দ্বীনের আজমত ও মুহাব্বতে ভরে দিতেন তাদের হৃদয়। খেদমতে দ্বীনের দূরপনেয় জযবা প্রোথিত করে দিতেন তাদের অন্তরে। আধুনিক রীতি-নীতি ও পশ্চিমা দর্শনের অসারতা খুলে খুলে বর্ণনা করতেন। তদস্থলে ইসলামের যথার্থতা ও স্বাভাবিকতা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট করে দিতেন। বাতিল ফেরকাগুলোর মধ্যে মওদূদীবাদ খ-নে বিশেষ দিলচছপি রাখতেন।
শিক্ষাঙ্গণ ছিল কাজী সাহেব হুযুরের মূল কর্মক্ষেত্র। তাঁর সময়ে তিনি একজন সফল শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা-সংস্কারক ছিলেন। বাংলাভাষায় পাঠদান এবং ভাষাচর্চায় উলামায়ে কেরামের দৃষ্টি আকর্ষণের ক্ষেত্রে তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। প্রচলিত নেসাবে তা‘লীমের মাঝে প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনের কাজও তিনি ত্বরান্বিত করেন। দ্বীনী শিক্ষার মূল ভিত্তি কুরআন, হাদীস ও ফিকহ। এ তিন বিষয়ে মুতাকাদ্দিমীনের কিতাব পাঠদান করা শ্রেয় এবং অপরিহার্য। হুযুর মুতাকাদ্দিমীনের আরও কিতাব পাঠ্যসূচির অন্তর্ভূক্ত করা এবং হাদীসের কিতাবসমূহ আরও বেশি সময় নিয়ে পাঠদান করার স্বপ্ন দেখতেন। আরবিভাষা, নাহু-সরফ, উর্দু-ফার্সি ইত্যাদি উলূমে আলিয়া আধুনিকতম নেসাবে সল্প সময়ে পাঠ দান করার পক্ষপাতী ছিলেন। বাংলা, অংক, ইংরেজি, ভূগোল-বিজ্ঞান ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ের প্রয়োজনীয় এবং সুচিন্তিত সংযোজন-বিয়োজন সমর্থন করতেন। এসকল বিষয় পাঠদানের জন্যও দ্বীনদার শিক্ষক এবং দ্বীনী মেযাজে তৈরী স্বতন্ত্র পাঠ্যপুস্তক অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করতেন। হুযুর বলতেন, আমাদের আকাবির সময়ের প্রয়োজনে মান্তেক-ফালসাফাকে দ্বীনী নেসাবের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। অতএব, দ্বীনী শিক্ষার মেযাজ, রুচি ও বৈশিষ্ট্য বহাল রেখে দ্বীনী দায়িত্ব পালনে সহায়ক পরিমাণ আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান নেসাবের অন্তর্ভুক্ত করা আকাবিরের চিন্তা-চেতনার সাথে খুবই সঙ্গতিপূর্ণ। হযরত মুফতী শফী রাহিমাহুল্লাহ বলেনÑ
اگر ہمارے متقدمین اپنے زمانہ کی ضروريات کے پيش نظر فارسي زبان کو اپنا سکتے ہيں يونانی منطق وفلسفہ اور رياضی کی تعليم کو نصاب کا ایک جزو بنا سکتے ہیں تو ان کا اتباع آج اس میں نہیں کہ ہم اس وقت بہی و ہی منسوخ شدہ سکے لے کر بازاروں ميں پھرے بلکہ وقت کی ضرورت کے مطابق انگريزی زبان اور فنون جديدۃ کو پڑھنا اور پڑھانا وہی درجہ رکھے گا جو اس زمانہ ميں فارسی زبان اور يوناني فلسفہ کا مقام تھا۔ (مجالس مفتي اعظم ص ৫৭৬... ميری نظر ميں اگر دونوں کے مضر اسباب سے مکمل پرہیز کرتے ہوے انگريزی زبان اور عصری علوم و فنون کو پوری کوشش اور توجہ سے حاصل کيا جاۓ تو پچھلے فلسفہ و منطق سے زيادہ اسلامی عقائد اور اسلامی علوم کے خادم نظر آّئيں گے ۔( مجالس مفتي اعظم ص৫৭৮)
হুযুর কওমী মাদরাসা সনদের সরকারি স্বীকৃতির প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করতেন না। তবে বিরাট সংখ্যক উলামায়ে কেরাম স্বীকৃতির পক্ষে কাজ করছেন বলে প্রকাশ্যে বিরোধিতাও করতেন না। যারা এর পক্ষে কাজ করছেন তাদের প্রতি হুযুরের পরামর্শ থাকত, কূটনৈতিকভাবে স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করুন, মাঠে-ময়দানে আন্দোলন করে নয়। আমাদের মত করে যদি সরকার সাগ্রহে স্বীকৃতি দেয় তাহলে নির্লিপ্তভাবে গ্রহণ করতে পারেন।
হুযুরের নিকট তা‘লীম-তরবিয়ত ছিল হেফাজতে দ্বীনের মূল মাধ্যম। এই মাধ্যম থেকে দ্বীনের অন্যান্য বিভাগ জিন্দা হয়। এইজন্য তা‘লীমী কাজের ওপর আঘাত আসে হুযুর এমন কাজের ঘোর বিরোধী ছিলেন। ছাত্রদের সক্রিয় রাজনীতি, দ্বীনী ইস্যুতে আন্দোলন, জিহাদী কার্যক্রম ইত্যাদি বিষয়ে পরিমিতি ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া চিন্তা করার প্রতি হুযুর অত্যন্ত জোর আরোপ করতেন।
হুযুর বলতেন, মাদরাসার তা‘লীমী মান উন্নত করার জন্য তিন কাজ জরুরিÑ যোগ্য উস্তায নির্বাচন, মেধাবী ছাত্র চয়ন এবং সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতকরণ। মালিবাগ জামিয়ায় হুযুর এ চিন্তাধারা প্রয়োগ করেছিলেন এবং আমরা তার সুফল পেয়েছি। এই জামিয়া আমাদের কাছে হুযুরের রেখে যাওয়া আমানত। আল্লাহ তাআলা একে হেফাজত করুন। উত্তরোত্তর এর শ্রীবৃদ্ধি করুন। দেশের সকল মাদারিস, মাসাজিদ ও দ্বীনী মারাকিযকে আল্লাহ তাআলা কবুল করুন। আমীন।
হযরত কাজী ছাহেব রাহ. রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁর মাহবুব উস্তায ও মুর্শিদ শায়খুল ইসলাম হযরত মাাদানী রাহ.-এর অনুসারী ছিলেন। বাংলাদেশে প্রচলিত বড় দু’টি দলের মধ্যে একটি দলের প্রতি হুযুরের সামান্য ব্যক্তিগত আগ্রহ ছিল। কিন্তু নিজের প্রতিষ্ঠান বা শিষ্য-শাগরিদদের মাঝে তিনি কখনও এর ন্যুনতম প্রভাব পড়তে দেননি। বরং ঐ দলের বেদ্বীনী আচরণের তিনি কঠোর সমালোচনা করতেন।
একবার গুলশানে হাজী মুনীর সাহেবের বাসায় ফিদায়ে মিল্লাত সাইয়েদ আস‘আদ মাদানী রাহ.-এর এক মজলিসে শামছুদ্দীন কাসেমী সাহেব, কাজী সাহেব হুযুর এবং নূর হুসাইন কাসেমী সাহেব প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। ফিদায়ে মিল্লাত রাহ. ঐ মজলিসে বলেছিলেনÑ
اگر عوامليگ اقتدار پر آۓ تو يہاں کے مسلمانوں کا دينی تشخص ختم ہو جاۓ گا۔
কাসেমী ছাহেব হুযুর নিজে এই লেখককে ঘটনাটি শুনিয়েছেন এবং স্মরণ রাখার জন্য তাকিদ করেছেন। আজকের প্রেক্ষাপটে ফিদায়ে মিল্লাত রাহ.-এর ঐ আশংকা ফিরাসাতুল মু’মিন বলে প্রতীয়মান হয়। বাকি আল্লাহ পাক ভালো জানেন। সকল ফেতনা থেকে দ্বীন, দেশ ও জাতিকে তিনি হেফাজত করুন। আমীন।
মূলত শায়খুল ইসলাম মাদানী রাহ.-এর রাজনৈতক চিন্তাধারা যা, কাজী সাহেব হুযুরের চিন্তাধারাও তা। হযরত মাদানীর রাজনিতিক চিন্তাধারাকে আমরা তিনটি শিরোনামে ভাগ করতে পারি।
১. ই‘লায়ে কালিমাতুল্লাহ। একমাত্র সত্যধর্ম ইসলামকে বিজয়ী করা। এর জন্যই তিনি বৃটিশবিরোধী মরণজয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। হযরত লিখেছেনÑ
اسلام نے کسی صورت ميں بھی غلامی پر قناعت نہیں کی، بہت سے نصوص سے دلالۃ اور صراحۃ ثابت ہو تا ہے کہ اسلام کا تقاضہ حکومت اور سربلندی ہے قرآن ميں فرمايا گيا : هوالذي ارسل رسوله بالهدى الخ جناب رسول اللہ صلی اللہ علیہ وسلم کی ارشاد ہيں الاسلام يعلو ولا يعلى .(مکتوبات شيخ الاسلام ج ـ২ ص (১০৯
অর্থাৎ ইসলাম কোনো অবস্থায় অধীন হয়ে থাকাকে পছন্দ করেনি। কুরআন হাদীসের বহু দলীল থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়, হুকুমত ও বিজয় ইসলামের একান্ত কাম্য। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) ‘আল্লাহই তো হিদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ নিজ রাসূলকে প্রেরণ করেছেন যাতে তিনি সব দ্বীনের ওপর তাকে জয়যুক্ত করেন।’ হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, ইসলাম বিজয়মুখী দ্বীন পরাজয়মুখী নয়। Ñমাকতুবাতে শায়খুল ইসলাম, ২/১০৯
হযরত মাদানী রাহ. আজীবন অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা লালন করেছেন। আপন সম্প্রদায়ের প্রতি অন্যায় টান, অন্যায় সমর্থন এবং শুধু ভিন্ন সম্প্রদায়ের হওয়ার কারণে কারো প্রতি অন্যায়-অবিচার হল সাম্প্রদায়িকতা। ইসলাম এই সাম্প্রদায়িকতা সমর্থন করে না। এটা দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার। তবে অসাম্প্রদায়িকতা আর ধর্মনিরপেক্ষতা এক নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থ হল সত্যধর্ম ইসলামের বিজয় এবং আল্লাহর আইনের কর্তৃত্ব অস্বীকার করা। সমাজ, রাষ্ট্র, আইন ও বিচার এবং শিক্ষাকে ধর্ম থেকে আলাদা রাখা। শরীয়তের আইনকে তুচ্ছ করে মানব-রচিত আইনে রাষ্ট্র-শাসন করা। কাজেই ধর্মনিরপেক্ষতা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক কুফুরী মতবাদ। কোনো মুসলমান জেনে বুঝে একে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে না। কমিউনিস্ট এবং বাম ঘরানার রাজনীতিকরা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির কথা বলে মূলত ধর্মনিরপেক্ষতা বুঝিয়ে থাকে। তাই তারা ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে চায়, ইসলামী আইন ও রীতি-নীতির বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ায়। সুতরাং হযরত মাদানীর অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি আর একালের ধর্মনিরপেক্ষতা এক কথা নয়।
২. অবিভক্ত ভারত-দর্শন। ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে উলামায়ে দেওবন্দ ছিলেন ঐক্যবদ্ধ এবং আপোষহীন। তবে স্বাধীনতার প্রক্রিয়া কী হবেÑ এ নিয়ে তাঁদের মাঝে দ্বিমত ছিল। হযরত মাদানী রাহ. তখনকার প্রেক্ষিতে সর্বভারতীয় ভৌগোলিক জাতীয়তার প্রবক্তা ছিলেন। অর্থাৎ ভারত-ভূখ-ের সকলকে এক জাতি মনে করতেন। এটা ভৌগোলিক জাতীয়তা, ধর্মীয় জাতীয়তা নয়। অবশ্য ধর্মীয় জাতীয়তার সাথে অন্য যে কোনো জাতীয়তার বিরোধ হলে ধর্মীয় জাতীয়তা প্রাধান্য পাবে। হযরত মাদানী এই ভিত্তিতে অখ- ভারত চেয়েছিলেন। তিনি ধর্মীয় জাতীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য বিসর্জন দেয়ার কথা কখনও বলেননি। (কবি ইকবালের মত অনেকে হযরত মাদানীকে এই ইস্যুতে ভুল বুঝেছিলেন। পরে অবশ্য কবি ইকবালের ভুল ভেঙেছিল।) হযরত মাদানীর মতে ধর্মীয় জাতীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষার নামে ভারত ভাঙার কৌশল যথার্থ ছিল না, তাঁর মতে অবিভক্ত ভারতই ইসলাম ও মুসলমানের জন্য অধিকতর কল্যাণকর। কিন্তু শায়খুল ইসলাম শাব্বির আহমাদ উসমানী রাহ. ও তাঁর অনুসারীগণ মুসলমানদের নিরাপত্তা ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্য ধর্মীয় জাতীয়তার ভিত্তিতে ভিন্ন রাষ্ট্রই একমাত্র সমাধান বলে মনে করেছিলেন। উভয় পক্ষের দলিল ছিল, যুক্তি ছিল। বিষয়টা ইজতেহাদী। মাওলানা সলিমুল্লাহ খান ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম লিখেছেন,
یہاں سوال پاکستان کی مخالفت يا حمايت کا نہيں تھا جبکہ پروپيگنڈائی شور و غوغا کے ذريعہ باور کيا اور کرايا جارہا ہے بلکہ سوال در اصل يہ تھا کہ ازادي کی کونسی صورت مسلمانوں کے لئے مستقبل میں مفيد بہتر اور کاميابی کی ضامن ہوگی اس ميں وحی تو کسی پر نازل نہيں ہو رہي تھی فيصلۂ انسانی سوچ اور رائے ہی کو کرنا تھا اور انسانی رائے ميں خطا وصواب دونوں کا احتمال ہوتا ہے۔ (کشف الباری ج১ ص(৬৫
এই উভয় জামাতের আকীদা-বিশ্বাস চিন্তা-চেতনা মাসলাক-মাশরাব ছিল এক ও অভিন্ন। উভয় দল ছিলেন মুখলিস। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম ও মুসলমানের কল্যাণ কামনা। হযরত মাদানী রাহ. মুসলিম জাতীয়তা কিংবা ইসলামী খেলাফত কোনোটার বিরোধিতা করেননি। তিনি শুধু দেশ বিভাগের বিরোধিতা করেন। হযরত মাদানী রাহ. ভারতের অখ-তা অক্ষুণœ রেখে ইসলামের বিজয়ের পথ প্রশস্ত করতে চেয়েছিলেন। মাওলানা সলীমুল্লাহ খান ছাহেব বলেন,
تقسيم کی مخالفت کرنے والوں کا کہنا تھا کہ انگريز سے صرف آزادی حاصل کرو اور کچھ نہ کراؤ اگر اس سے بٹوارہ کرايا گيا تو وہ یقينا مسلمانوں کے حق ميں ڈنڈی مارے گا اور پھر ساری زندگی پچھتانا پڑےگا، تقسیم کے حامیوں کو اس پر يہ اعتراض تھا کہ انگريز سے متحدہ طور پر آزادی لیگئی تو بعد ميں ہندوں ہم پر غالب آجائنگے اور ہميں کچہ بھی نہيں دينگے، تقسیم کی مخالفت کرنے والے کہتے تھے کہ اس خطرے کا سد باب پہلے کر ليا گيا ہے، متحدہ بنگال، آسام، متحدہ پنجاب کشمير سرحد، سنده، اور بلوچستان، يہ مسلم علاقے ہونگے جنکا اپنا قانون اور دستور ہوگا ۔
رہا ہندوؤں کا خطرہ تو وہ اکثريت ميں تھی ليکن وہ اتنے شير نہيں ہيں کہ مسلمانوں کی اتنے عظيم متحدہ طاقت کو زير کر ليں۔( کشف الباری ج১ ص(৬৫
জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সেক্রেটারী জেনারেল মাওলানা মুহাম্মাদ মিয়া রাহ. লিখেছেনÑ
جميعت علماء مسلمانوں کی مذہبی و سياسی اور تہذيبی آزادی کو کسي حال ميں چھوڑنے پر آمادہ نہیں وہ بيشک ہندوستان کی وفاقی حکومت اور ایک مرکز پسند کرتی ہے کیونکہ اسکے خيال ميں مجموعہ ہندوستان خصوصا مسلمانوں کے لئے يہ مفيد ہے وفاقی حکومت کا قيام اس شرط کے ساتھ مشروط ہے کہ صوبوں کے لئے حق خود آزاديت تسليم کر ليا جاۓ اور وفاقی کی تشکيل اسطرح ہو کہ مرکز کی غیر مسلم اکثريت کے مذہبی سياسی تہذیبی حقوق پر اپنی عددی اکثریت کے بلبوتے پر تعدی نہ کر سکے.
مسٹر جناح کا پر اسرار معمہ اور اس کا حل. ضميمہ ثانیہ ہندوستان کے موجودہ جمود کا حل جميعت علماء ہند کا فيصلہ ۔ص৪০ . علماۓ حق جـــ২ ص১৩৬¬-১৩৭ ص ২১৫ ص৪০৬থ৪০৭
মাওলানা সলিমুল্লাহ খান ছাহেব বলেনÑ
تقسيم کی مخالفت کی دوسری بڑی وجہ يہ تھی کہ حضرت شيخ الاسلام پاکستان کی قيادت جن ہاتھوں ميں متوقع تھي انسے مطمئن نہ تھے، انکا خيال تھا کہ اسلامی اقدامی بیگانہ یہ قيادت اسلام کے بارے ميں اپنے خواب کو شرمندہ تعبیر نہ کر سکے گی اور انگریز اپنے ناپاک مقاصد کے لئے بلا تکلف اسکا استعمال کريگا ۔ کشف الباری جـ ১ ص৬৬
হযরত মাদানী রহিমাহুল্লাহ লিখেছেনÑ
احمدآباد ميں تقریر کرتے ہوۓ مسٹر جناح نے حسب ذيل ارشاد فرمایا : اقليت کے صوبہ والوں (مسلمانوں ) پر جو گذرتی ہے گذر جانے دو، لیکن آو ہم اپنے ان بھایوں کو آزاد کراديں جو اکثريت کے صوبوں ميں ہيں تاکہ وہ شريعت اسلامی کے مطابق وہاں آزاد حکومت قائم کر سکيں. یہ بيانات نہایت ہي خوشکن اور امید افزا ہيں کاش یہ واقعيت کا کوئی درجہ رکھتے ۔ مگر ہم جب لیگ کے ہائکمانڈ کی زندگی اور اخلاق و عقائد کا معمولی درجہ پر بھی معاینہ کرتے ہيں تو بديہی طور پر معلوم ہوتاہے کہ یہ سب انکا ڈھونگ ہے جس کے وہ ہميشہ سے عادی ہيں ۔ پھر یہی بزرگ مذہبی حکومت کے مفاسد بیان کرتے ہوۓ فرماتے ہیں کہ : اگر پاکستان میں مذہبی حکومت بنا دی گئی تو اس سے عوام کی ترقی رک جائیگی۔ طبقات کی تفریق کاسلسلہ جاری رہیگی۔ انساں کی اجتماعی اور اقتصادی نجات کی راہ بند ہو جائیگی۔ مذہبی حکومت کے پیشرو مسلمان ہونگے اور وہ قابل نہيں ہيں۔ ہندو صوبوں کے مسلمانوں پر ظلم وستم ہونے لگيں گے۔ اس سے ہندوستان ميں خانہ جنگی کی آگ بھڑک اٹھیگی۔ پاکستان کیا ہے ج ২ ،صـ ১৩৯ ۔
উলামায়ে দেওবন্দের যে অংশ পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন তারা পাকিস্তানে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠায় আশাবাদী ছিলেন, হিন্দু-খ্রিস্টান তথা বিজাতির অধীনতা থেকে মুক্তির পথ খুঁজেছেন এবং এ পথে কঠোর সংগ্রাম করেছেন। কিন্তু ভারত যেমন ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা পায়নি, তেমনি আজো পাকিস্তানে খেলাফত-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। সবই আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা। হযরত মাওলানা সলিমুল্লাহ খান ছাহেব বলেনÑ
علماء حق کا وہ گروہ جو تحریک پاکستان کے لئے ہر اول دستے کا کام دے رہا تھا اور انکی مساعی کے نتيجے ميں یہ معرکہ کاميابی کی منزل کی طرف آگے بڑھ رہا تھا ہميں نہ ان کے اخلاص ميں شبہ ہے نہ ان کی حب الوطنی کو کبھی کسی نے مشکوک اور مشتبہ گردانا ہے .اور جہاں تک اسلام کی سربلندی اور آئیں قرآن و سنت کے نفاذ کے ساتھ انکی وابستگی کا تعلق ہے تو اس کا کہنا ہی کیا! عيان را چہ بیان!! ليکن يہ بھی ایک تلخ اور افسوسناک حقیقت ہے کہ ان حضرات نے پاکستان سےجو اميدیں وابستہ کی تھیں وہ پوری نہیں ہوئیں اور نہ ان کے پورا ہونے کی بظاھر کوئی اميد باقی ہے بلکہ ১৯৭১ ميں پاکستان کے دو لخت ہو جانے کےبعد بچے کچے پاکستان کا وجود بھی معرض خطر ميں پڑا نظر آیا ہے ۔کاش یہ نظر کادھوکا ہو اور پاکستان محفوظ رہے، مستحکم ہو اور فی الحقیقت اسلام کا قلعہ بنے۔ کشف الباری ج১ ص৬৭ ۔
যদি ধর্মীয় দ্বিজাতি-তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান গড়ে কোনো লাভ হয়নি বলা হয়, তাহলে হযরত মাদানী রাহ. অবিভক্ত ভারতে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার যে ফর্মূলা দিয়েছেন সেটাই বা কতটুকু বাস্তবায়িত হত? এ প্রশ্নের জবাব কি খুব সহজ? বর্তমান হিন্দু ভারতের আচরণের প্রতি লক্ষ্য করলে কী মনে হয়! মোটকথা এটা ছিল ইজতিহাদী বিষয়। রাজনৈতিক মতভিন্নতা। একে কেন্দ্র করে কাউকে তিরস্কার করা বা দেওবন্দের মূল ¯্রােতধারা থেকে বিচ্ছিন্ন বলা অভিপ্রেত নয়। ১
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হযরত মাদানী রাহ. পাকিস্তানকে সুদৃঢ় ও সুগঠিত করতে এবং ইসলামের মজবুত দূর্গ হিসেবে গড়ে তুলতে সকলের প্রতি আহ্বান জানান এবং বলেন, পাকিস্তানের উদাহরণ একটি মসজিদতুল্য, যার নকশা এবং ডিজাইন নিয়ে মতভিন্নতা ছিল। কিন্তু যখন মসজিদ হয়ে গেছে, তখন যে নকশার ওপরই হোক তা মসজিদ, সকলের সম্মানের পাত্র। হযরত মাওলানা সলিমুল্লাহ খান ছাহেব বলেন,
تقسيم کے ذریعہ پاکستان کے وجود میں آجانے کے بعد شيخ الاسلام نے اپنے موقف کی عملی ناکامی کو انا کا مسئلہ نہيں بنایا، بلکہ پاکستان ميں اپنے متعلقین کو ہدایت کی کہ پاکستان کو اسلام کاقلعہ بناؤ، اسکی حفاظت کرنے والے ہاتھوں کومظبوط کرو پاکستان کی مثال ایک مسجد کی ہے جس کے نقشے میں اختلاف ہو سکتاہے . ليکن جب مسجد بنگئی تو جس نقشے پر بھی وہ بنے وہ مسجد ہے اور سب کے لئے یکساں محترم ہے۔ لیکن افسوس ! ہم نے نصف صدی کی کاوشوں کے بعد مملکت خداداد کو تباہی کے اس دہانے پر لا کھڑا کیا ہے جس کی بھیانک تصویر سے حضرت شيخ الاسلام آزادی سے قبل ڈرایا کرتے تھے، مسلمانوں کی متحدہ طاقت چکناچور ہو گئی، بر صغير کےمسلمانوں کا مستقبل گويا تاريک ہوکر رہ گيا ۔۔ کشف الباری ج ১ ص৬৬
সুতরাং কাজী সাহেব হুযুর তাঁর শায়েখের নির্দেশ অনুযায়ী একনিষ্ঠভাবে পাকিস্তানের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। পাকিস্তানে খেলাফত-রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলনে হযরত কাজী সাহেব হুযুর নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯৬৬ সালে অল পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় সদস্য নির্বাচিত হন এবং জমিয়তের গঠনতন্ত্র প্রণয়ন সাব কমিটির অন্যতম সদস্য মনোনীত হন। ১৯৭১সাল পর্যন্ত তিনি জমিয়তের ব্যানারে ইসলামী রাজনীতিতে বিরাট অবদান রাখেন। একাত্তরের পর গতিরুদ্ধ দ্বীনী কার্যক্রমে গতি ফিরিয়ে আনার জন্য দেশব্যাপী সফর করেন এবং সাইয়েদ আসআদ মাদানী রাহ.সহ বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করে দ্বীনী মাদারিসের কার্যক্রম নির্বিঘœ করার চেষ্টা করেন। এরপর বিভিন্ন কারণে তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন।
কাজী সাহেব হুযুর রাহ. উদার মনের মানুষ ছিলেন। সকল হালকার মুরুব্বি ওলামায়ে কেরামের প্রতি অন্তরে শ্রদ্ধা রাখতেন। দুআর জন্য তাঁদেরকে নিজের প্রতিষ্ঠানে আনার এবং মেহমানদারি করার চেষ্টা করতেন। এতে উলামায়ে কেরামের বিভিন্ন হালকার মাঝে বিদ্যমান পারস্পরিক ওয়াহশাত ও আজনাবিয়্যাত কমে আসত। ছাত্রদের মাঝে সুপ্রভাব পড়ত।
হুযুরের প্রতিষ্ঠানে আইন-কানুন পরিমাণে কম ছিল না। কিন্তু সাধারণ ছাত্ররা কেমন যেন আইনের আতংক এবং কানুনের চাপ থেকে মুক্ত ছিল। আমল-আখলাক ও পড়াশোনার স্বাধীন, স্বতঃস্ফূর্ত এবং উৎসবমুখর একটি পরিবেশ বিরাজমান ছিল। বড় মন নিয়ে ছাত্ররা লেখপড়ায় ডুবে থাকত। এটা ছিল হুযুরের বিরাট ব্যক্তিত্ব এবং রূহানী তাওয়াজ্জুহের বরকত। দেশব্যাপী তালেবে ইলমগণের তালিম-তরয়িত ও পড়াশোনার উন্নতির জন্য হুযুরের সেরপুরস্তিতে ‘লাজনাতুত্ তালাবা বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠনও গড়ে উঠেছিল। যার কর্মসূচিগুলো আলেম সমাজে সাড়া জাগিয়েছিল। হুযুর কর্মসূচিগুলো সংগঠনের মাধ্যমে প্রয়োগ না করে স্ব স্ব মাদরাসার আসাতেযায়ে কেরামের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার পক্ষে ছিলেন। ঐ সংগঠনে হযরত মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ, হযরত মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী প্রমুখ নেতৃত্ব দিতেন। মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ ছাহেব-ও বিভিন্ন পরামর্শ সভায় অংশগ্রহণ করতেন। মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া, মরহুম মাওলানা ইসহাক ফরিদী রাহ. প্রমুখ ছিলেন এ সংগঠনের প্রধান কর্মী। আল্লাহ তাআলা সবার সকল নেক আমল কবুল করুন। আমীন।
তাসনীফ-তালীফ হল খেদমতে দ্বীনের একটি বড় আলেমানা পদ্ধতি। এই প্রকারের খেদমতের সঙ্গে হুযুরের রুচি-প্রকৃতির ভালো মিলও ছিল। হুযুর বলতেন, ‘অলসতার কারণে খেদমতে দ্বীনের এই শাখাতেও আমি পিছিয়ে পড়েছি!’ আসল কথা হল, আমাদের অঞ্চলের বহু বড় বড় আহলে ইলম সাধারণ মানুষের কালিমা সংশোধনের কাজে নিজেদের পুরো জীবন ওয়াক্ফ করে দিয়েছেন। শিরক-বিদআত ও কুফর-ইলহাদ বিদূরণের ময়দানি লড়াইয়ে নিজেদের পুরো যিন্দেগী কোরবান করে দিয়েছেন। নবী-ওহী ও সাহাবীর দেশ থেকে বহু দূরে অবস্থিত এতদঞ্চলের জনমানুষ, যাদের ঈমান ও ইসলামের অভিভাবক বলতে কেউ নেই, সেই এতিম উম্মতের অভিভাবকত্বের পিছনে নিজেদের সবটুকু জীবনী শক্তি নিঃশেষ করে দিয়েছেন। এখানে কাদিয়ানিরা মানুষের ঈমান নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, ওখানে মিশনারিরা তাদেরকে মিল্লাত-হারা করে দিচ্ছে। এক দিকে বিদআতিরা এলাকার পর এলাকা গোমরাহির পাঁকে ডুবিয়ে দিচ্ছে, আরেক দিকে সরকার জনগণের ঈমানের বুকে ছুরি চালিয়ে সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছে। ফলে এ অঞ্চলের অধিকাংশ অভিভাবক আলেমে দ্বীনের জীবন কেটেছে মাঠে-ঘাটে, পথে-প্রান্তরে। চরম আর্থসামাজিক অসঙ্গতির মোকাবেলা করে মৌখিকভাবে পরবর্তী প্রজন্মের নিকট দ্বীন পৌঁছানোর কঠিন সংগ্রামে। উম্মতের ব্যথা-বেদনা আর দরদ নিয়ে জীবনভর যাদের ছুটে বেড়াতে হয়েছে এবং এভাবেই একদিন পরকালের ডাক এসে পড়েছে। কাজী ছাহেব হুযুর ছিলেন সেই ব্যথিতজনদের অন্যতম, ‘তারীখে ওলামায়ে বাঙ্গাল’-এর এক স্বর্ণপুরুষÑ
آسمان ان کی لحد پر شبنم افشانی کرے
سبزہ نورستہ اس گھر کی نگہبانی کرے
আসমানি শিশিরে যেন সিক্ত হয় তাঁর ঐহী কবর।
শ্যামল বাগান যেন দেয় পাহারা সে মাটির ঘর।