“সদর ছাহেব হুযুর তো সদর ছাহেবই ছিলেন”
হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রাহ.-এর রূহানী সন্তান মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ (মুহাদ্দিস ছাহেব) রাহ.-এর উপরোক্ত বাণীটি আমার অন্তরে আজীবন অক্ষয় হয়ে থাকবে। হযরত মুহাদ্দিস ছাহেব রাহ. লালবাগ জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়ায় থাকাকালে মেশকাত শরীফ বা তিরমিযী শরীফের ছবকে এই উক্তিটি করেছিলেন। আমার সৌভাগ্য, সেই ছবকে আমিও ছাত্র হিসাবে উপস্থিত ছিলাম। মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুর রাহ. বড়দের কারো নাম নিয়ে কথা বললে অসন্তুষ্ট হতেন। একবার তাঁর সামনে হযরত সদর ছাহেব হুযুর সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে সম্ভবত এক ছাত্র হুযুরের নাম মুখে আনল। তখনি মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুর বললেন, সদর ছাহেব হুযুর বললে কে না চিনবে? অতএব নাম নেওয়ার দরকার কী? সুবহানাল্লাহ! উস্তাযের প্রতি কী আদব!
হযরত সদর ছাহেব হুযুরের ওয়াফাতের প্রায় অর্ধ-শতাব্দী পর তাঁর স্মরণে কিছু লিখতে যাচ্ছি। আর ওয়াফাতের আগে বিশ বছর নিকট থেকে তাঁকে দেখার ও তাঁর কথা শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। কিন্তু এত বড় মাপের একজন আলেমকে আমার মত অথর্ব ও না-লায়েক কতটুকুই চিনতে ও জানতে পারে? তাঁর ইলমী গভীরতা ও সূক্ষ্মতা উপলব্ধি করার যোগ্যতাও আমার নেই। কথায় বলে, ‘রতনে রতন চেনে’ । অতএব এই রতœকে চেনার মত চেনা তো আমার দ্বারা হতে পারে না। সে রকম চেনা হতে পারে হযরতের হাতে গড়া তাঁর রূহানী সন্তান হযরত মুহাদ্দিস ছাহেব রাহ. ও শায়খুল হাদীস মাওলানা আজিজুল হক ছাহেব রাহ.-এর দ্বারা। উল্লিখিত দুই মনীষীর প্রথম জনের উক্তি দিয়ে লেখাটি আরম্ভ করেছি। হযরত সদর ছাহেব হুযুরের মূল্যায়নে হযরত মুহাদ্দিস ছাহেবের উক্তিটি একেবারে চূড়ান্ত। বলাবাহুল্য, এ উক্তিতে তিনি যেন মহাসাগরকে কূপে ভরে দিয়েছেন। হযরত সদর ছাহেব রাহ. সম্পর্কে হযরত শায়খুল হাদীস ছাহেব রাহ. যা বলতেন, তা আমি নিজ কানে শুনেছি। তিনি বলতেন, “হযরত সদর ছাহেব রাহ.-এর মত আলেম বাংলাদেশে কেউই হয়নি, আর হবেও না”। তাঁর ‘কুরআন-ফাহমী’ সম্পর্কে বলেছিলেন, “আমার ধারণায় পাক-ভারত উপমহাদেশে সদর ছাহেব হুযুরের কুরআনী-ফাহম অদ্বিতীয়”। এ সম্পর্কে পরে আরো আলোচনা হবে।
যে ব্যক্তি ছিলেন (পাকিস্তান আমলে) পাকিস্তানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম এবং যাঁর সঙ্গে ছিল সদর ছাহেব হুযুরের এসলাহী সম্পর্ক, তিনি হলেন হযরত মাওলানা যফর আহমদ উছমানী রাহ.। সদর ছাহেব রাহ.-এর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে তাঁর শায়খ আল্লামা উসমানী ছাহেব মাদরাসার সকল শিক্ষক ও ছাত্রকে নিয়ে মাহফিলে মিলিত হন। সেই মাহফিলে হযরত উসমানী ছাহেব সদর ছাহেব রাহ. সম্পর্কে যে কথা বলেছিলেন তা সত্যিই উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, “আজ বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ আলেম ও ওলীআল্লাহর এন্তেকাল হয়ে গেল”। (শায়খুল হাদীস মাওলানা আব্দুল হাই দা. বা. থেকে)
আমি প্রথমেই বলেছি, হযরত সদর ছাহেব রাহ.-এর মূল্যায়ন করা আমার মত অযোগ্য শাগরিদের পক্ষে মোটেই সম্ভব নয়। তাই আমি উল্লিখিত তিনজন জাঁদরেল আলেমÑ যাঁরা সত্যিকারভাবে তাঁকে চিনতে পেরেছিলেন তাঁদের দ্বারা অতি সংক্ষেপে তাঁর যথাযোগ্য মূল্যায়ন পাঠকদের সামনে পেশ করে দিলাম।
হযরত সদর ছাহেব রাহ.-এর মতো আল্লাহর ওলী, মুরশিদে রাব্বানী বলেছিলেন, “আমাকে যদি পরকালে আল্লাহ জিজ্ঞাসা করেনÑ ‘শামছুল হক তুমি আমার সামনে পেশ করার মতো কী নিয়ে এসেছ?’ তখন আমি মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ ও মাওলানা আজিজুল হককে পেশ করে বলব, ইয়া আল্লাহ! আমি তোমার জন্য এদের দু’জনকে নিয়ে এসেছি”।
=২=
হযরত সদর ছাহেব হুযুর রাহ. মানুষের মধ্যে জাতীয় ও ব্যক্তিগতভাবে ইসলাম প্রচার ও প্রসারে ছিলেন সদাব্যস্ত ও নিবেদিতপ্রাণ। একবার তিনি মারাত্মক অসুস্থতা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। হযরতের প্রিয় শাগরেদ মাওলানা সালাহউদ্দিন ছাহেবসহ আমরা কয়েকজন খেদমতে উপস্থিত। মাওলানা সালাহউদ্দিন ছাহেব ছিলেন হযরতের শিয়রে, আমি পায়ের দিকে আর একজন আধুনিক ভদ্রলোক নিকটে দাঁড়িয়ে। তখন হযরত আমাকে ইশারায় ডেকে বললেন, এই ব্যক্তিকে দ্বীনের কথা বোঝাও। এ ব্যাপারে হযরত রাহ. আমাকে আরো কিছু বলবেন মনে হল। তাই জনাব সালাহউদ্দীন হুযুর আমাকে কাছে ডেকে আস্তে করে বললেন, হুযুর কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত কয়েক দিন ধরে বেহুঁশ ছিলেন, এই একটু আগে হুঁশে এসেছেন। অতএব আপনি এদিকে দাঁড়ান, যাতে হুযুর আপনাকে দেখতে না পান। কেননা, আরো কথা বললে হুযুরের মারাত্মক ক্ষতি হবে। তাই হুযুরের দৃষ্টির আড়ালে থাকলাম।
মানুষের দ্বীনী উন্নতির জন্য হযরত সদর ছাহেব রাহ. সারা জীবন কাজ করেছেন। দ্বীনী দিক থেকে দেশের বিভিন্ন অনুন্নত অঞ্চলে কাজ করার জন্য মুবাল্লেগ পাঠাতে থাকতেন। আমাদের দাওয়াতুল হকের বিশিষ্ট ব্যক্তি মাওলানা ফজলুর রহমান রাহ. ছিলেন হযরত সদর ছাহেবের হাতের লাঠি। দ্বীনী বিষয়ে হযরতের লিখিত ও সংগৃহীত বই-পুস্তকের বোঝা মাথায় নিয়ে তিনি সেসব অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে এ সমস্ত বই বিতরণ করতেন এবং মানুষকে দ্বীনী কাজ বা আমল শিখাতেন।
তদানীন্তন তাবলীগের আমীর মাওলানা ইউসুফ ছাহেব রাহ. বাংলাদেশে তাশরীফ আনলে হযরত সদর ছাহেব রাহ. তাবলীগী মারকায কাকরাইলে চলে যেতেন এবং তাবলীগের আমীর ছাহেব কে পরামর্শ দিতেন এবং তাঁর থেকে পরামর্শ নিতেনÑ কীভাবে আমাদের দেশে ও বিদেশে তাবলীগের মেহনত করা যায়।
দ্বীনী অবস্থার উন্নতিকল্পে দেশজুড়ে হযরত সদর ছাহেব রাহ. অসংখ্য মাদরাসা ও মসজিদ কায়েম করে গেছেন। সেইসঙ্গে মসজিদ-মাদরাসার খেদমতের জন্য লোক তৈরি করতে থাকতেন। তাঁর ঢাকায় আগমনের আগে এখানকার মসজিদসমূহে কুরআন মাজীদ শুদ্ধরূপে তিলাওয়াত করনেওয়ালা ছিল খুবই কম। তিনি এসে মাদরাসা-মসজিদ গড়ে তুললে মাশাআল্লাহ যোগ্য ইমাম ও শিক্ষকের কমি রয়নি; বরং উত্তরোত্তর তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
=৩=
ইলমে দ্বীনের প্রতি হযরত সদর ছাহেবের ছিল অপরিসীম আগ্রহ ও আকর্ষণ।
ইলমে দ্বীনের প্রতি ছোটবেলা থেকেই হযরতের অসামান্য আকর্ষণ ও আগ্রহ প্রকাশ পায়। বাল্যকালেই তিনি পবিত্র কুরআনের আশেক হয়ে যান। পিতার হুকুমে তিনি স্কুলে পড়তেন বটে। কিন্তু আল্লাহর কালামের ইশ্ক তখন তাঁকে পাগলপারা করে তোলে। তিনি কুরআন শরীফের জিল্দ বুকে ধারণ করে জঙ্গলে চলে যেতেন এবং উচ্চস্বরে কেঁদে কেঁদে বলতেন, “ইয়া আল্লাহ! আমাকে আপনার কালাম পড়ার ও বোঝার তাওফীক দিন এবং তার পথের সন্ধান দিন।” হযরতের অন্তরের আকুতি ও এখলাসের ফলে আল্লাহ রাহমানুর রহীম তাঁকে ‘ইলমে দ্বীন’-এর পথের সন্ধান দিলেন। তিনি কলিকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে দেওবন্দের পানে ছুটলেন এবং সেখানে পৌঁছে যথারীতি ইলমে দ্বীনের পড়ালেখা আরম্ভ করেন।
দেওবন্দে হযরতের ছাত্রজীবন এক আজীব জীবন। অন্য সময়ের তো কথাই নেই। আসর-মাগরিবের মধ্যবর্তী সময়েও তিনি এমন মনোযোগের সাথে কিতাব-বীনী করতেন যে, কোনো সাক্ষাৎপ্রার্থী এসে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সাহস পেত না। সদর ছাহেব হুযুর ছাত্রজীবনেই দেওবন্দে পড়ার সময় তাফসীরের আরবী কিতাবসমূহ পাঠ করেছিলেন। একারণে "فوائد عثماني" (তাফসীরে উছমানী)-এর মূল্যায়নে বলতে পেরেছেন, “কেউ যদি তাফসীরে উছমানীর মূল্যায়ন করতে চায় তবে যেন পূর্ববর্তী সমস্ত তাফসীরগ্রন্থ পড়ে নেয়। তাহলেই বুঝতে পারবে এ তাফসীর গ্রন্থের কদর ও কীমত কী! সংক্ষিপ্ত হলেও এ যেন সমস্ত তাফসীর গ্রন্থের সারাসার বা নির্যাস (short but comprehensive)! ইলমে দ্বীন হাছিল করার প্রতি আমাদেরকে আগ্রহী করে তোলার জন্য হযরত নিজে আমাদেরকে বলেছিলেন, “যখন হেদায়া কিতাব পড়ে শেষ করলাম তখন আমরা মনে করতাম ইসলামী আইনে ব্যরিষ্টারগণ আমাদের চেয়ে বেশি কী জানেন?” আমি অন্যের কাছে শুনেছি, হযরত সদর ছাহেব ছাত্রজীবনে হেদায়া কিতাব পয়ষট্টি বার মুতালাআ করেছিলেন।
হযরত মানুষের মধ্যে ইলমে দ্বীনের আগ্রহ ও আকর্ষণ সৃষ্টি করার জন্য কত মূল্যবান কথাই না বলতেন। একদিন ছাত্র-শিক্ষকদের অধিকতর উৎসাহী ও আগ্রহী করে তোলার জন্য দ্বীনী ইলমের ফাযায়েল বর্ণনা করতে থাকেন। হযরতের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি ইলমে দ্বীনের উপর খুবই গৌরব করতেন। তাই ইলমের ফাযায়েল বর্ণনার সময় যেন তাঁর বুকখানি ফুলে উঠত। তখন তিনি বুক টান করে কথা বলতেন। সেদিন তিনি এও বললেন, “আমরা যে ধন অর্জন করেছি তার সামনে সাত রাজার ধন কিছুই নয়”।
একদিন নীচের জামাতের কোনো এক ছবকে সম্ভবত শ্রেণী-শিক্ষক অনুপস্থিত ছিলেন। হযরত সদর ছাহেব জানতে পেরে নিজে গিয়ে সেই সবকে বসলেন। কিন্তু তিনি ছোট ছেলেদেরকে তালীম না করে তারবিয়াত করলেন। ছেলেরা তো হুযুরকে ছবকে পেয়ে মহাখুশী। ফার্সী কিতাবের ছবক হয়ে থাকবে। হুযুর ছেলেদের জিজ্ঞাসা করলেন, ফার্সী কি তোমাদের মাতৃভাষা? ছেলেরা উত্তর দিল, না হুযুর, ফার্সী আমাদের মাতৃভাষা নয়। ফের জিজ্ঞাসা করলেন, তবে কি ফার্সী কুরআন বা হাদীসের ভাষা? এতেও তারা উত্তরে ‘না’ বলল। তখন হুযুর তাদের বললেন, ফার্সী আমাদের মাতৃভাষা নয়, কুরআন-হাদীসের ভাষাও নয়। ঠিক বলেছ। তবে ফার্সী এমন এক ভাষা, যা আমাদের অনেক বুযুর্গ ও ওলীআল্লাহর ভাষা। তাঁরা এ ভাষায় দ্বীনী বহু কিতাব লিখেছেন। কুরআন-হাদীসের কথা, আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা। এসব কিতাব পড়ে আমরাও ইলমে দ্বীনের প্রতি উৎসাহিত হই। হুযুরের এসব কথায় ছেলেরা খুবই আনন্দিত হয়।
=৪=
ইলমে দ্বীনের প্রতি আগ্রহ ও আকর্ষণ ছিল হযরত রাহ.-এর মজ্জাগত। ছাত্রজীবনেই হুযুর সাব্যস্ত করে নিয়েছিলেন, আজীবন ইলমে দ্বীনের খেদমত করবেন। তাই তো ছাত্রজীবনের শেষে দেশে ফেরার পূর্বে তিনি তাঁর দুই সহপাঠী হযরত হাফেজ্জী হুযুর ও পীরজী হুযুরসহ থানাভবনে উপস্থিত হলেন। উদ্দেশ্য, তাঁদের শায়েখ ও মুরব্বী হযরত থানভী রাহ.-এর কাছে বিদায় আরয করা এবং ভবিষ্যৎ জীবনে নিজেদের করণীয় বিষয়ে পরামর্শ গ্রহণ করা। হযরত শায়েখ রাহ. তাঁদের জিজ্ঞাসা করলেন, দেশে গিয়ে তোমরা কী করবে? তাঁরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠলেন, ‘আমরা ইলমে দ্বীনের খেদমত করব। যদি কোনো ছাত্র আসে তবে তাকে পড়াব। আর যদি কেউ না আসে তবে আমরা নিজেদের মধ্যে কিতাবের তাকরার করব’।
হযরত সদর ছাহেব রাহ.-এর কোনো কিতাবে পড়েছি বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কোনো ব্যক্তি যদি দুনিয়াতে নাম কামানোর জন্য নয় বরং আল্লাহ তাআলাকে সন্তুষ্ট করার জন্য ইলমে দ্বীন শিখে এবং পরবর্তী জীবনে এখলাসের সাথে ইলমে দ্বীনের খেদমত করে, তবে আল্লাহ তাআলাই মান-ইজ্জতের সাথে খাওয়াবেন-পড়াবেন এবং তার জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করবেন।
প্রসঙ্গত একটি ঘটনা মনে পড়ছে। আমরা লালবাগ জামেয়া কুরআনিয়ায় পড়াকালে সম্ভবত ময়মনসিংহ জেলার একজন স্কুল ছাত্রের মনের ভাবের পরিবর্তন আসে এবং স্কুল ছেড়ে জামেয়া কুরআনিয়ায় এসে ভর্তি হয়। তখন তার সামনে ছিল সম্ভবত ম্যাট্রিক ফাইনাল পরীক্ষা। তাই আত্মীয়-স্বজন এসে তাকে বলল, তুমি মাদরাসায় পড়তে চাও পড়বে, কিন্তু সামনের ফাইনাল পরীক্ষাটি দিয়ে নাও। এতে ছাত্রটি ভাবনায় পড়ল, সে কী করবে। আমরা সহপাঠিদের কাছে সে পরামর্শ চাইলে আমরাও তার আত্মীয়-স্বজনের মতই প্রকাশ করলাম। কিন্তু সেইসাথে তাকে সদর ছাহেব হুযুরের সামনে বিষয়টি পেশ করে তাঁর পরামর্শ নিতে বললাম। তিনি ইলমে দ্বীনের উপর গুরুত্বারোপ করলেন এবং দূরদর্শিতার সাথে পরামর্শ দিলেন; মাদরাসা ছেড়ে না যেতে, বরং মাদরাসার লেখাপড়ার উপর জমে থাকতে। যতদূর মনে পড়ে হযরত রাহ. নসীহত করে এও বলেছিলেন, যদি সত্যিই আল্লাহর রাসূলের মহব্বতে মাদরাসায় এসে থাক, তবে যেয়ো না। কেননা তাতে পরীক্ষার পর মনের গতি পাল্টে যেতে পারে এবং শয়তানের ওয়াসওয়াসার শিকার হয়ে ইলমে দ্বীনের পথে ফিরে আসা সম্ভব নাও হতে পারে। মোটকথা, হযরত রাহ.-এর দূরদৃষ্টিতে আমরা মুগ্ধ হলাম এবং সেই ছেলে সম্ভাব্য বিপথ থেকে রক্ষা পেল।
=৫=
আমার ব্যক্তিগত জীবনে হযরত সদর ছাহেব রাহ.-এর ইলমী গভীরতা ও দূরদৃষ্টির একটি ঘটনা মনে পড়ছে। আমি তখন জেনারেল লাইনে লেখাপড়া করি। এক রমযান মাসে হযরত সদর ছাহেব রাহ. ও শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রাহ.-এর ছোহবতে থাকার জন্য লালবাগ মাদরাসায় রইলাম। সেখানে থাকার ফলে অন্য আলেমদের থেকেও
শিক্ষা-দীক্ষার ফায়দা পাচ্ছিলাম। হযরত শায়খুল হাদীস ছাহেব ও সদর ছাহেব হুযুর আমাকে খুব স্নেহ করতেন। পবিত্র রমযানের শেষ দশক আগত প্রায়। শায়খুল হাদীস ছাহেব হুযুর আমাকে বললেন, আমি তো মাদরাসা মসজিদেই এ‘তেকাফ করি। তুমিও আমার সঙ্গে থেকে দশ দিনের এ‘তেকাফ কর। এতে তোমার অনেক ফায়দা হবে।
আমি সদর ছাহেব হুযুরকে এ‘তেকাফের কথা জানালে হুযুর বললেন, ‘তুমি এ‘তেকাফে বসবে কেন?’ থাক! আমি ভাবলাম, হুযুর তো আর ‘না’ করেননি, তাই রমযানের বিশ তারিখে এ‘তেকাফের প্রস্তুতি নিয়ে সদর ছাহেব হুযুরের কাছে চূড়ান্ত অনুমতি আনতে গেলাম। হুযুর ফের আমার এ‘তেকাফে বসার কথা শুনে রাগতস্বরে বলে উঠলেন, তোমার কী হল? তোমার কি আর দ্বীনী কাজ নেই?’
ব্যস, আর কথা নেই। তখনই মসজিদে গিয়ে আমার বিছানাপত্র কামরায় নিয়ে এলাম। হযরত শায়খুল হাদীস রাহ. যথাসময়ে এ‘তেকাফের নিয়তে মসজিদে ঢুকে গেলেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কি এ‘তেকাফে বসছি না? আমি বললাম, সদর সাহেব হুযুর আমাকে যে ধমক দিয়েছেন এরপর আমার হিম্মত হচ্ছে না। শায়খুল হাদীস ছাহেব বললেন, সময় থাকতে মসজিদে এসে যেতে, তারপর আমরা হুযুরের সাথে আলাপ করতাম। জবাবে আমি সেই কথাই বললাম, হুযুরের ধমকের পর আমার কিছুতেই হিম্মত হয় না, থাক। এ‘তেকাফের দু’এক দিন গত হলে সদর ছাহেব হুযুর আমাকে ডাকলেন। আমি ভয়ে ভয়ে খেদমতে উপস্থিত হলাম। হুযুর জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এখন কী কর? আমার ভয় হচ্ছে, তোমাকে এ‘তেকাফে বসতে না দিয়ে আমি গোনাহগার হচ্ছি কি না’। আমি আমার প্রাত্যহিক কাজকর্মের কথা শুনিয়ে বললাম, ‘ফাঁকে ফাঁকে এ‘তেকাফকারীদের খোঁজ খবর নেই। তাঁদের জরুরী কাজকর্ম করে দেই। বিশেষ করে মাওলানা আজিজুল হক ছাহেবের খেদমত বেশি করে করি।
এতে হযরত সদর ছাহেব রাহ. খুবই খুশী হলেন এবং বললেন, ‘এ‘তেকাফ তোমার জন্য নফল, তোমার ছাত্রজীবনের আসল কাজ হচ্ছে উলামায়ে কেরামের খেদমতে আসা-যাওয়া করা। তাঁদের থেকে ইলম হাসিল করা এবং তাঁদের খেদমত করা।’ এরপর আমি শায়খুল হাদীস রাহ.-এর নিকট গিয়ে হযরত সদর ছাহেবের কথাগুলি শুনালে তিনি মুগ্ধ হন এবং বলেন, “দেখ, সদর ছাহেব হুযুরের ইলম ও আমাদের ইলমের মধ্যে কেমন পার্থক্য”।
সেই রমযান মুবারকের ছুটিতে মাদরাসায় অবস্থান করে আমি হযরত সদর ছাহেব হুযুরের ফয়েয ও বরকত লাভে ধন্য হই। তিনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে পবিত্র কুরআনের একখানি সুন্দর জিলদ তোহফারূপে দেন। এবং সমকালীন জাতীয় পর্যায়ের একটি বিষয়ে কয়েকজনের লেখার মধ্যে আমার লেখা আজাদ পত্রিকায় ছাপা হওয়ায় হযরত রাহ. আমাকে দশ টাকা পুরস্কার দেন। উল্লেখ্য, লেখাটি আমাদের কয়েকজনকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন। আর লেখাটি প্রস্তুত করার আগেই হুযুর দশ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন। মোটকথা, তিনি ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-দীক্ষার প্রতি কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের আকৃষ্ট ও মনোযোগী করার জন্য সম্ভাব্য সকল পথ অবলম্বন করতেন।
=৬=
হযরত সদর ছাহেব রাহ.-এর ইলমী শান ও মান সম্পর্কে আমার উপলব্ধি কতই না খাটো, তাই এ অযোগ্য হাতের লেখা তো সীমিতই হবে। কোনো যোগ্য ব্যক্তি এ বিষয়ে আলোচনা করলে একটি পুস্তক রচিত হতে পারে। তবুও আমি আর একটু বলি।
একদিন ঢাকা ইউনিভার্সিটির কয়েকজন ছাত্র হুযুরের নসীহত শোনার জন্য তাঁর খেদমতে এসেছিলেন। আমিও খেদমতে বসা ছিলাম। হুযুর রাহ. তাঁদের সম্বোধন করে বললেন, ‘হে আমার গ্রাজ্যুয়েট মূর্খ ভাইয়েরা।’ বলাবাহুল্য, এ সম্বোধনে আমরা সবাই হতবাক হলাম। সাথে সাথে হুযুর নিজের এ সম্বোধনের ব্যাখ্যায় বললেন, “আপনারা শিক্ষিত অথচ মূর্খ। এ কথা এজন্য বললাম, আপনারা নিজেদের ঘরে ইলমের মহাদৌলত রেখে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে পরের দ্বারে ঘুরছেন”। শব্দাবলি প্রায় এ ধরনেরই ছিল। তারপর পবিত্র কুরআন-হাদীসের গভীর জ্ঞান ও ইসলামের শিক্ষা-দীক্ষা সম্পর্কে এমন মূল্যবান কথাবার্তা বললেন, যাতে ছেলেরা অভিভূত হয়ে গেল এবং আধুনিক জ্ঞানের দীনতা স্বীকার করতে বাধ্য হল। শেষ পর্যন্ত তারা ইসলামী তথা কুরআন-হাদীসের জ্ঞান ও শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এবং কুরআনী জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে মজলিশ থেকে উঠল।
হযরত সদর সাহেব রাহ. ইসলামী জ্ঞানের উপর বিশেষ করে কুরআন-হাদীসের জ্ঞানের উপর খুবই গৌরব করতেন।
=৭=
হযরত সদর ছাহেব হুযুরের এসলাহ ও এসলাহের তাকমীল (পূর্ণতা) হয় হযরত হাকীমুল উম্মতের কাছে (তথা থানাভবনে)। হযরত শুরু থেকেই তালীম ও তারবিয়ত উভয়ের প্রতি মনোযোগী হন। তালীম হচ্ছিল সাহারানপুর ও দেওবন্দে আর তরবিয়ত হচ্ছিল হযরত হাকীমুল উম্মতের থানাভবনে।
এসলাহে বাতেনের পথে হযরত সদর সাহেবের সাধনা এবং তাতে সিদ্ধিলাভ ছিল এক বিরল ঘটনা। তাঁর পড়ার স্থান সাহারানপুর বা দেওবন্দ থেকে বৃহস্পতিবার আসরের নামাযান্তে থানাভবনে পায়ে হেঁটে রওনা করতেন এবং শেষ রাতে ফযরের নামাযের পূর্বে থানাভবনের খানকা-মসজিদে উপস্থিত হয়ে হযরত হাকীমুল উম্মতের সঙ্গে ফযরের নামায পড়তেন। সদর ছাহেব হুযুরের সঙ্গে আরো কিছু ছাত্র এসলাহে বাতেনের উদ্দেশ্যে থানাভবন আসতেন। তালিবে ইলমদের সঙ্গে হযরত থানভী রাহ. অত্যন্ত বেতাকাল্লুফ হতেন এবং হৃদয়ের দুয়ার খুলে বয়ান করতেন। হযরত সদর ছাহেব হুযুর থানাভবনে আসর পর্যন্ত থাকতেন এবং হযরত হাকীমুল উম্মতের তরবিয়ত হাছিল করতেন। ফের বাদ আসর থানাভবনে হযরতের নিকট বিদায় আরয করতেন এবং সারা রাত হেঁটে ফযরের পূর্বে মাদরাসায় এসে হাযির হতেন এবং যথারীতি লেখাপড়া শুরু করতেন।
ঠিক এভাবে প্রতি বৃহস্পতিবার রওয়ানা হয়ে শুক্রবার সকালে থানাভবন পৌঁছতেন এবং শুক্রবার রওয়ানা হয়ে শনিবার এসে মাদরাসায় পৌঁছতেন। কী আজীব মুজাহাদা!
তিনি নিজেকে অথর্ব, নাচিজ মনে করতেন। তিনি বলেন, ‘এক আধুনিক শিক্ষিত ব্যক্তি আমার খুবই ভক্ত। তিনি একদিন আমাকে নিজের নামের পূর্বে ‘নাচিজ’ না লিখতে অনুরোধ করেন। এ ব্যাপারে তিনি নাছোড় হয়ে আমাকে ধরলেন। তবে আমি তাকে অনেক কথা বলে বোঝাতে সক্ষম হই’। বলাবাহুল্য, এ ছিল হযরতের আবদিয়াতের মাকাম।
প্রসঙ্গত আরেকটি ঘটনা মনে হল। একবার হযরত শাব্বীর আহমদ উছমানীর সাথে সাক্ষাৎ হলে সদর ছাহেব হুযুরকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি মওলবী আজিজুল হককে চিনেন? জবাবে ছদর সাহেব হুযুর বললেন, ‘জ্বী, তিনি ও আমি একই মাদরাসায় খেদমত করি।’ ফানা আর কাকে বলে!
একদিকে এতো উচুঁ তাওয়াযু অপর দিকে দ্বীনী গায়রত এবং শাজাআত এতো বেশী ছিল যে, আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করতেন না। এমনকি তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এবং আরো কিছু উচ্চপদস্থ সামরিক শাসকের সঙ্গে তিনি লড়েছেন। এই লড়াইয়ের সিলসিলায় তাদের কাউকে হযরত বলেছিলেন, “আপনারা একটি সরকারের অধীনে চাকরী করেন আর আমিও একটি সরকারের অধীনে কাজ করিÑ আল্লাহ তাআলার সরকার। আমার এই দ্বীনী সরকারকেই আমি ভয় করি। আপনাদের সরকারের মোটেই পরোয়া করি না। আপনারা আমার কী করতে পারেনÑ বড়জোর ফাঁসি দিতে পারবেন, দেন আমাকে ফাঁসি”। সম্ভবত মুসলিম পারিবারিক আইন (family law ordinance)-এর বিরোধিতা করছেন শুনে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান হযরতকে তলব করেছিলেন। সাক্ষাতে হযরত রাহ. প্রেসিডেন্ট আইয়ুবকে এতদূর পর্যন্ত বলেছিলেন, “প্রেসিডেন্ট সাহেব! আপনার কি লজ্জা হয় না, আপনি কী করে কুরআনের উপর হস্তক্ষেপ করলেন?” মোটকথা, পবিত্র কুরআনের সপক্ষে সদর ছাহেব হুযুরের এসব হুংকারে উচ্চ পদস্থ সামরিক শাসকরা চুপ মেরে যায় এবং বিলক্ষণ বুঝে নেয় যে, আলেমদের মধ্যেও এমন লড়াকু ও জ্ঞানী আলেম রয়েছেন।
=৮=
এবার হযরত সদর সাহেব রাহ.-এর কুরআন-ফাহমী সম্পর্কে আমার জানা ও শোনা কয়েকটি কথা বলে শেষ করি। শায়খুল হাদীস ছাহেব বলেন, ‘তুমি বায়ানুল কুরআন খুলে দেখ, সূরা বাকারার রুকূ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ...-এর সঙ্গে সূরার প্রথমাংশের ‘রব্ত’ বা সম্পর্ক হযরত থানবী রাহ. কী লিখেছেন এবং হযরত সদর ছাহেব রাহ. এ দুয়ের রব্ত কী লিখেছেন। সদর ছাহেব হুযুর লিখেছেন, ‘সূরার প্রথমাংশে আল্লাহ তাআলা যে হুকুম-আহকামের নির্দেশ দিয়েছেন, তা তিনি কিসের বলে (বা কোন্ অথরিটিতে) দিয়েছেন? জওয়াবে সূরার শেষ রুকূতে বলা হচ্ছে, ‘আকাশ-পৃথিবীতে যা কিছু আছে, তার প্রকৃত ¯্রষ্টা ও মালিক আল্লাহই। অতএব তিনি এই অথরিটিতে হুকুম-আহকাম জারী করেছেন।’ কত সুন্দর ও চমৎকার ‘রব্ত’।
একদিন মাহফিলে পবিত্র কুরআনের একখানি সূরা (সূরা মুযযাম্মিল) পঠিত ও আলোচিত হল। এতে আছে দিনভর আপনার ব্যস্ততা মানুষের সঙ্গে। অতএব এ থেকে অবসর হয়ে রাতের বেলায় আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হোন। কুরআন-বিশারদ হুযুর বললেন, “মানবরচিত ধর্ম হলে বলা হত, অতএব রাতের বেলায় বিশ্রাম করুন। ছোট্ট একখানি সূরা বটে। কিন্তু তা ভাবের দ্বার খুলে দেয়।”
আরেকদিনের মাহফিল। কে একজন বললেন, হুযুর! প্রত্যেক মানুষের লেখার স্টাইল ভিন্ন ভিন্ন হয়। কিন্তু পবিত্র কুরআন একই সত্ত্বা আল্লাহ তাআলার কালাম হওয়া সত্ত্বেও তাতে বিভিন্ন বাচনভঙ্গি বা ভিন্ন ভিন্ন স্টাইল কেন? হুযুর রাহ. অতি সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে দিলেন। ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ের ভাষা কি এক হয়? আল্লাহ তাআলা তো কুরআনে সৃষ্টিরাজ্যের কত কত বিষয়ে আলোচনা করেছেন। অতএব এতে একাধিক স্টাইল হওয়াই সমীচীন।
=৯=
ইলমে দ্বীনের গৌরব করা ছিল হযরতের বিশেষ একটি গুণ। বিকালে হযরতের মজলিসে অনেক আধুনিক শিক্ষিত ব্যক্তিও আসতেন। কুরআন-হাদীসের বিষয়াদি আলোচিত হত। তাঁদেরকে আলোচনার প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য বললেন, “আমার এখানে কেউ আসেন মুরীদ হওয়ার জন্য, কেই ফতোয়া বা মাসআলা জানার জন্য। আমি তাঁদেরকে মুরীদ না করে হযরত হাফেজ্জী হুযুরকে দেখিয়ে দেই। ফতোয়া বা মাসআলা জানতে চাইলে বলি, আমাদের মাদরাসায় ফতোয়া ও মাসআলা জানার জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থা আছে। সেখানে গিয়ে আপনার দরকারি বিষয় জেনে নিন। আর আমার কাছে আসুন দ্বীনধর্ম ও পবিত্র কুরআন-হাদীস সম্পর্কে যদি কোনো প্রশ্ন থাকে, তার সমাধানের জন্য। এরপর অতি বিনয় কিন্তু সেইসঙ্গে গৌরবের সাথে বলতেন, “আলহামদু লিল্লাহ, আমি পবিত্র কুরআন-হাদীস বুঝেছি।”
সদর ছাহেব রাহ.-এর তাফসীর পবিত্র কুরআনের বিশাল জ্ঞানÑভাণ্ডার। তিনি তাঁর ইলমে লাদুন্নীর বরকতে কালামে পাকের তাফসীর প্রায় শেষ করেই তাঁর মাওলায়ে কারীমের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। তাঁর তাফসীর লেখার ধরন ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। হযরত শায়খুল হাদীস ছাহেব বলেন, ‘তিনি শুধু কুরআন শরীফ নিয়ে তাফসীর লিখতে বসতেন। কুরআনের আয়াতখানি পড়ে জিলদ বন্ধ করে বন্ধ কামরায় পায়চারি করতেন এবং আয়াতের মর্ম উদ্ঘাটনে রত হতেন। যখন আয়াতখানি বুঝে আসত, তখনি জিলদের সাথে রাখা কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে শুরু করতেন।
জাতির অতি বড় দুর্ভাগ্য, জ্ঞান-ভাণ্ডারের উল্লিখিত তাফসীর থেকে জাতি আজ বঞ্চিত। সদর ছাহেব হুযুরের জীবদ্দশায় তাফসীর ছাপা হয়নি। সে সময় এই বিশাল তাফসীর ছাপানো খুবই কঠিন কাজ ছিল। হুযুরের জীবদ্দশায় বা পরে শায়খুল হাদীস ছাহেবের সহযোগিতায় প্রথম ও শেষ পারা এবং পবিত্র কুরআনের কয়েকখানি বিশেষ সূরা ‘পাঞ্জ সূরা’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। সে সব পাঠ করে পাঠকগণ আন্দায করতে পারবেন, কী ছিল তাঁর কালজয়ী মেধা, প্রতিভা ও কুরআন-ফাহমীর অসাধারণ দক্ষতা। মুল তাফসীর ছিল এতই ব্যাপক যে, সদর সাহেব রাহ.-এর জীবনকালে যখন কম্পিউটার কম্পোজের বলা চলে নামগন্ধও ছিল না তখন এ তাফসীর ছাপানোর মত সাহসও কারো ছিল না। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। হযরত রাহ.-কে আল্লাহ তাআলা এর আযর ও ছওয়াব দান করুন। আমীন।
আলহামদু লিল্লাহ! এখন এই তাফসীরের আরো কিছু খ- গওহরডাঙ্গা মাদরাসার তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয়েছে। সম্ভবত মোট সাত খ- ছাপা হয়েছে। আরো খুশির বিষয় হল, হযরত সদর ছাহেবের বড় ছাহেবজাদা মাওলানা হাফেজ মুহাম্মাদ ওমর ছাহেব রাহ.-এর উদ্যোগে হুযুরের স্বরচিত ৫৫টি পুস্তক চারটি ভলিউমে প্রকাশিত হয়েছে। এতে করে ‘আলহামদু লিল্লাহ’ হযরতের তাফসীরের উলূমের অনেকাংশের ক্ষতিপূরণ হচ্ছে। এগুলোর প্রকাশক ‘বিশ্বকল্যাণ পাবলিকেশন্স’কে আমরা ধন্যবাদ ও সাধুবাদ জানাচ্ছি। মাওলানা আব্দুর রাযযাক রচিত হযরত সদর ছাহেবের একখানি জীবনীগ্রন্থও বিশ্বকল্যাণ পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে। মিরপুর মাদরাসা দারুর রাশাদ
থেকে হযরত সদর ছাহেব রাহ.-এর একখানি স্মারক গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। এতে সদর ছাহেব রাহ.-এর জীবনের অনেক কিছু পাওয়া যাবে বলে আমি মনে করি। উৎসাহী পাঠক তাঁর স্মারকগ্রন্থটিও সংগ্রহ করুন এবং মনোযোগের সাথে পাঠ করুন। উল্লিখিত তিনটি উপায়ে সদর ছাহেব হুযুর রাহ.-এর কিতাব পাঠ করে তাঁকে জানুন। তাঁর আদর্শ গ্রহণ করুন এবং সেই আদর্শে নিজেদের জীবন গড়ে তুলুন। ইনশাআল্লাহ এতে করে আমরা পরকালের নাজাত লাভ করব।
=১০=
হযরত সদর ছাহেব রাহ. সম্পর্কে বহু কথা বলা যায়। কিন্তু কলেবর বৃদ্ধির ভয়ে এখানেই শেষ করতে হচ্ছে। সুলুকের লাইনে হযরত রাহ.-এর ‘আবদিয়াত’ ও ‘রেযা বিল কাযা’ মুকাম্মাল বা পরিপূর্ণ পর্যায়ের ছিল। এ দুটি ‘মাকাম’ এতই কাছাকাছি যে, এ দুটিকে একই ‘মাকাম’ বলা যায়।
সামনে হযরত সদর সাহেবের কিছু কথা বিচ্ছিন্নভাবে তুলে ধরছি।
ক. হযরত শায়খুল হাদীস ছাহেব রাহ. থেকে শুনেছি, তিনি বলেন, ‘মাদরাসায় হযরত সদর ছাহেবের কাছে যখন তাঁর ছোট ছেলেদের আনা হয় তখন এদের প্রতি হুযুরের মায়া-মমতা, আদর-স্নেহ দেখে আশ্চর্য লাগে। কিন্তু এ কথাটিও বিলক্ষণ বুঝে আসে যে, ছেলেগুলি যদি একই সাথে মরে যায় হুযুর মোটেই বিচলিত হবেন না। এমনই ছিল হযরত রাহ.-এর ‘রেযা বিল কাযা’-এর স্তর।
খ. আরেকদিনের কথা। তখন আমি সম্ভবত কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। সে সময় প্রায়ই বিকালে হুযুরের খেদমতে গিয়ে বসতাম। সেদিন হুযুর তালেবে ইলমের দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলেন। একটি বিষয়ের প্রেক্ষিতে ছাত্রদের লক্ষ করে বললেন, “আল্লাহ তাআলা যে তোমাদেরকে গরীব বানিয়েছেন, এর শুকর আদায় করে সারতে পারবা না!” এমনি কিছু শব্দ হুযুর ব্যবহার করছিলেন। তাঁর শব্দাবলি দারিদ্র্যের ফাযায়েলের ইংগিতবহ ছিল। সেই সাথে হুযুর রাহ. ‘রেযা বিল কাযা’র প্রতি যেন ছাত্রদের উৎসাহিত করছিলেন। দারিদ্র্যের প্রতি হুযুরের এই দৃষ্টিভঙ্গি উপলব্ধি করে আমরা চমৎকৃত হয়েছিলাম।
গ. জীবনের শেষভাগে হযরতের চোখের জ্যোতি কমে যাচ্ছিল। সে অবস্থায় মাঝেমধ্যে তাঁর হাত ধরে মসজিদে নামাযে নিয়ে যাওয়ার সৌভাগ্য এ অধমের হত। সে সময়কার একদিনের কথা। সেদিনও আমি হযরতের নিকট ছিলাম। হাসিমাখা মুখে তিনি বলছিলেন, “আল্লাহ তাআলা যতদিন ইচ্ছা, এই চোখ দিয়ে কাজ নিয়েছেন এখন তাঁর ইচ্ছা দৃষ্টিশক্তি নিয়ে নিচ্ছেন।” শব্দাবলি মোটামুটি এ রকমই ছিল। যে বিষয়টি শ্রোতাদের অন্তরে আবেদন সৃষ্টি করছিল তা হল হুযুরের ‘রেযা বিল কাযা’। দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু তাঁর মনে কোনো দুঃখ- বেদনা বা আফসোস ছিল না। আজো তাঁর এসব অমিয় বাণী স্মরণ করে তৃপ্তি পাই।
=১১=
ঘ. হযরত রাহ.-এর তাকওয়া পরহেজগারি ও দ্বীনদারি সর্বজনবিদিত ছিল। আমি নিজে শায়খুল হাদীস রাহ. থেকে শুনেছি, তিনি অধমকে শুনিয়েছেন, ‘একদিন হযরত সদর ছাহেব হুযুর কোনো শহরে সভায় গিয়েছিলেন। তাঁর থাকার ব্যবস্থা মসজিদ থেকে দূরবর্তী স্থানে করা হয়েছিল। নামাযের ওয়াক্ত হলে হযরত খাদেমকে বললেন, মসজিদে চল। খাদেম বললেন, হুযুর! মসজিদ অনেক দূরে। ঘরেই নামায পড়তে হবে। এতে হযরত রেগে খাদেমকে বললন, ‘আমার বিছানাপত্র নিয়ে মসজিদের নিকটবর্তী কোনো স্থানে চল’। এই বলে হযরত বের হয়ে গেলেন।
ঙ. শুনেছি, একবার মুফতী দ্বীন মুহাম্মাদ খানসহ হযরত যফর আহমদ উসমানী, হযরত সদর ছাহেব ও হযরত হাফেজ্জী হুযুর কোনো এক কনফারেন্সে গিয়েছিলেন। সভা শেষে রাতের খাওয়া-দাওয়া করে বিছানায় যেতে ২টা বেজে যায়। মুফতী দ্বীন মুহাম্মাদ খান ছাহেব বলেন, আমি মনে মনে বললাম, ‘আজকে দেখে নেব, কে কেমন আল্লাহওয়ালা। তাই ২টার বেশ কিছু পরে তারা যে যে রুমে শুয়েছিলেন সেসবের নিকট গিয়ে কান পাতলাম। হাঁ, শোনা গেল, তিন আল্লাহওয়ালাই নামাযে দাঁড়িয়ে।’
হযরত সদর ছাহেবের সম্পর্কে শায়খুল হাদীস ছাহেব আমাকে শুনিয়েছিলেন, সদর ছাহেব হুযুর তাহাজ্জুদ পড়তে রাতে একাধিকবার উঠতেন।
চ. আল্লাহওয়ালাদের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, তাঁদের সম্পর্কধারীর সবারই মনে হয় তাকেই হুযুর সবচেয়ে বেশি মহব্বত করেন। যেমন সদর ছাহেব হুযুরের অসুস্থতার কথা শুনে তাঁকে তাঁর ভাড়াকরা টিনসেড বাড়িতে দেখতে গেলাম। হুযুর আমাকে দেখেই বলে উঠলেন, ‘গিয়াসুদ্দীন এসেছ’? এতে আমার মনে হল, এ হযরতের হৃদয়ের ডাক। আর কাউকে তিনি এমন করে ডাকেন না।
গওহরডাঙ্গা মাদরাসার কথা এসে গেল। হযরত সদর ছাহেবের বাড়ির সংলগ্ন নিজ হাতে গড়া মাদরাসা। হযরত রাহ.-এর মৃত্যুশয্যায় সর্বশেষ চিন্তা এই ছিল এবং বলতেন, লালবাগ জামেয়া কুরআনিয়ার জন্য কোনো চিন্তা আমার নেই। তবে গওহরডাঙ্গা মাদরাসার জন্য চিন্তা। হযরতের মুহিব্বীনের নিকট আমি অধমের অনুরোধ, সকলে হুযুরের বাড়ির মাদরাসার প্রতিও সুদৃষ্টি দেবেন ও খবরাখবর রাখবেন।
=১২=
ছ. লালবাগ শাহী মসজিদের (অর্থাৎ মাদরাসা মসজিদে)র ইমাম ছিলেন হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ.। কোনো দিন কোনো কারণে কোনো জেহরী নামাযের সময় হাফেজ্জী হুযুর অনুপস্থিত থাকলে আর সদর ছাহেব হুযুর সুস্থ অবস্থায় উপস্থিত থাকলে তাঁকেই নামায পড়াতে হত।
নামাযে হযরত সদর ছাহেব হুযুরের সূরা ফাতেহা পড়ার কাইফিয়্যাত যে কেমন ছিল তা আমার বর্ণনার বাইরে। সূরার প্রথম আয়াত থেকে শেষ আয়াত পর্যন্ত পড়তে বেশ সময় লাগত। প্রথম তিনখানি আয়াত পড়ার আওয়াজ ও গাম্ভীর্য উচ্চ থেকে উচ্চতর হতে থাকত। যখন মধ্যবর্তী আয়াতখানি إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ পড়তেন তখন হুযুরের অবস্থা কেমন হত আর আমরা মুকতাদীদের অবস্থাই বা কেমন হত তা প্রকাশের ভাষা আমার নেই। হুযুরের তেলাওয়াতের আওয়াজ বলিষ্ঠ থেকে বলিষ্ঠতর হতে থাকত। মনে হত হুযুর যেন মাটি ছেড়ে আকাশে আরোহণ করে যাচ্ছেন। শেষের তিনখানি প্রার্থনার আয়াত পড়ায় হুযুরের যেন বুকফাটা কান্না বের হয়ে আসত। প্রার্থনার আয়াতগুলি কেঁদে কেঁদেই পড়তেন। এ সময় ইমাম ও মুক্তাদী সবাই মোহিত সম্বিতহারার মত হয়ে যেতেন। সূরা ফাতেহার পর অন্য একখানি সূরা পড়তে পড়তে ভাবের তন্ময়তা কেটে যেত। মাটির মানুষ যেন মাটিতে ফিরে আসত।
দাওয়াতুল হকের বড় হুযুর মাওলানা ফজলুর রহমান ছাহেব রাহ. বলেছিলেন, ‘আমি শহরে থাকার জন্য একটু জায়গা খরিদ করতে যাচ্ছি।’ এ কথা শুনে সদর ছাহেব রাহ. বললেন, “তুমিও এই পার্থিব
মগ্নতায় লিপ্ত হচ্ছ?”
আমরা জানি, দ্বীনের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এই দুই মহান ব্যক্তির কেউই শহরে আরামে থাকার জন্য এক টুকরা জমিও কেনেননি।
জ. গওহরডাঙ্গা মাদরাসার হাদীসের শিক্ষক মাওলানা আব্দুর রউফ ছাহেব দা. বা. হযরতের খুবই প্রিয় ছাত্র ও শিষ্য। একদিন খেদমতে আসলে দেখা গেল শরীর বেশ মোটাসোটা হয়ে যাচ্ছে। হুযুর তাঁকে সম্বোধন করে বললেন, “দ্বীনের ফিকির নাই নাকি যে, এত মোটা হয়ে যাচ্ছ?”
=১৩=
ঝ. আমাকে একদিন বললেন, ‘ইংরেজী পড়ছ, পড়। দ্বীন প্রচারের জন্য তোমাকে ইংল্যান্ড-আমেরিকায় পাঠাব ইনশাআল্লাহ।’
আমার এক সহপাঠী আইএ পরীক্ষায় সারা দেশে তিন নম্বরে স্ট্যান্ড করেছিল। অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে আমার সঙ্গে থাকত। বিএ অনার্স পড়ার সময়েই তিনি দ্বীন-দুনিয়ার অনেক বিষয়ে ইংরেজীতে ইউনিভার্সিটি শিক্ষকদের ন্যায় বক্তৃতা দিতে এবং লিখতে পারতেন। আমাদের বিশ্বাস ছিল, তিনি অনার্স এমএ-তে প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে পাশ করে প্রথমে ইউনিভার্সিটির শিক্ষক হবেন। পরে সিএসপি-তে প্রথম হয়ে শিক্ষাসচিব হবেন অথবা সমমানের চাকরিতে ঢুকবেন এবং দেশে নামকরা পদে সমাসীন হয়ে দেশের ও দ্বীনের বিরাট খেদমত করবেন।
এমন সময় (অর্থাৎ অনার্স ক্লাশে পড়ার সময়) তার পোশাক ও ইবাদতের মধ্যে আশাতিরিক্ত পরিবর্তন এসে গেল। লম্বা কোর্তা, পায়জামা, কাপড়ের গোলাকৃতির টুপি পরতে লাগলেন এবং তার ডাঁটের অক্সফোর্ড জুতা বর্জন করে হলে কাঠের খড়ম ও বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বরে অতি সাধারণ সেন্ডেল ধারণ করলেন। ইবাদতে ফরয-ওয়াজিবসহ নাওয়াফেল এবং জামাতে বের হওয়ায় এমন মনোযোগী হলেন যে, ক্লাস না করা ও ক্লাশ পরীক্ষা বাদ দেওয়া তার সাধারণ অভ্যাসে পরিণত হল। ছাত্রভাইদের সঙ্গে শুধুই পরকালের কথা বলা, দুনিয়ার প্রতি অতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা তার একমাত্র কাজে পরিণত হল। শুনলাম তার গ্রামের বাড়ি থাকার সময় তিনি হাঁটু পানিতে নেমে ওযু করতেন এবং হাত কনুইয়ের অনেক উপর পর্যন্ত ধুইতেন। পা হাঁটু পর্যন্ত ধুইতেন। লেখাপড়ার প্রতি দারুন অবজ্ঞা ও অসহযোগিতার ফলে ক্লাশ থেকে নাম কাটা গেল। তারপর তিনি ইউনিভার্সিটি ছেড়ে কোথায় গুম হয়ে গেলেন তা আল্লাহ তাআলাই জানেন। অনেক দিন পর কার কাছে শুনতে পেলাম, তিনি কোনও কলেজ থেকে কোনো রকম বিএ পাশ করে একটা সাধারণ চাকরী নিয়ে জীবন ধারণ করছেন।
হযরত শায়খুল হাদীস রাহ. একদিন আমার কাছে ঐ ভাইয়ের কথা শুনে হযরত সদর ছাহেব হুযুরের নাম উল্লেখ করে বললেন, হুযুর বলতেন, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের মেধাবী ছেলের পিছনে শয়তান তার সর্বশক্তি নিয়ে নামে এবং সৎকাজে বাড়াবাড়ি করিয়ে পরিণামে তার পতন তরান্বিত করে। হযরত সদর ছাহেব রাহ. বলতেন, যে ছেলে ঈমান-আমল ঠিক রেখে আধুনিক লেখাপড়ায় এতদূর অগ্রসর হয়ে গেছে যে, সে আর মাদরাসা লাইনের লেখাপড়ায় আসবে না তাকে আধুনিক লেখাপড়ায় উৎসাহিত করে সামনে বাড়িয়ে দেওয়া দরকার। সে তখন ভালভাবে পাশ করে উচ্চ চাকরী নিয়ে উচ্চ পজিশন পেয়ে দ্বীনী খেদমত ভালোভাবে করতে পারবে। উল্লিখিত ছেলের গোড়াতে দ্বীনদারি থাকায় সে ভাল রেজাল্ট করে উচ্চ চাকরী নিতে পারত এবং নিজের পজিশন প্রতিষ্ঠা করে দ্বীন ও তাবলীগের লাইনে সারা জীবন কাজ করতে পারত।
=১৪=
(ঞ) হযরত সদর ছাহেব হুযুর রাহ. বাতেনের এসলাহ বা আত্মসংশোধনের ব্যাপারে হযরত হাকীমুল উম্মত রাহ.-এর একটি কথা শুনিয়েছেন। কথাটি এই যে, ‘হযরত হাকীমুল উম্মতকে একই বৈঠকে দেখেছি, একজনকে এসলাহ করতে তার প্রতি রাগতঃস্বরে কথা বলছেন। আর অন্যদের সঙ্গে হেসে কথা বলছেন।
তাসাউফের লাইনে সদর ছাহেব আল্লাহ তাআলার দাসত্ব অর্জনের সঙ্গে নিজের খুদী বা অহম ও আমিত্বকে কিরূপ মিটিয়েছেন তার কিছু আরয করতে চাই। হযরত সদর সাহেব রাহ. বলতেন, ‘সালেকের কলব থেকে সর্বশেষে যে রূহানী মরয বা আত্মিক ব্যাধি দূর হয় তা হচ্ছে ‘হুব্বে জাহ’ অর্থাৎ সম্মান ও খ্যাতির মোহ।’ বলা বাহুল্য, সকল সালেক বা আল্লাহর পথের পথিক এ আত্মিক রোগ থেকে মুক্তই হতে পারেন না। আর যদি পারেনও তবে সর্বশেষে এ থেকে নিরাময় হন।
ট. সদর ছাহেব হুযুরের মধ্যে ‘ইছার’ (অন্যকে নিজের উপর প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়) গালেব ছিল। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হযরত বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে বিকালের বৈঠক করছিলেন। তাদের মধ্যে আরেক ব্যক্তি হুযুরের অনুপস্থিতিতে তাঁর সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে বললেন, ‘হুযুর তো তাবীজ-কবজের মানুষ।’ আমরা সেই ব্যক্তির প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে পরদিন হুযুরকে এ কথা জানালাম। হুযুর হাঁসলেন। কিছু বললেন না। এর পরই সেই ব্যক্তির আগমন হল এবং তাঁর প্রতি হযরতের ব্যবহার আমাদেরকে স্তম্ভিত করল। তিনি আসামাত্র হযরত হেসে তার সঙ্গে মুসাফাহা করে টেনে এনে নিজের পাশে আপন বিছানায় বসালেন।
ঠ. শুনেছি, হযরত সদর ছাহেব রাহ. বলতেন, ‘মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় অভিশাপ হচ্ছে তার আকলের বিকৃতি। কেননা, আকলের বিকৃতি ঘটলে মানুষ পানিকে আগুন এবং আগুনকে পানি মনে করে।’ (মাওলানা আব্দুল হাই বরিশালী দা. বা. থেকে শোনা)
ড. হুযুর যার মধ্যে যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতা দেখতেন, নানাভাবে তার যোগ্যতার সমাদর ও মূল্যায়ন করতেন। ফলে তার মধ্যে কাজের আগ্রহ ও উৎসাহ বেড়ে যেত। যেমন মুফতী ফজলুল হক আমিনী রাহ. এবং লালবাগ জামেয়া কুরআনিয়ার বর্তমান শায়খুল হাদীস মাওলানা আব্দুল হাই ছাহেব দা. বা.-এর মধ্যে বাল্যকাল থেকেই সেরকম যোগ্যতা দেখে হযরত সদর ছাহেব নিজে তাঁদের তরবিয়ত করতেন এবং পাঠ্য কিতাবের বাইরে অন্য কিতাবাদির ব্যবস্থা করে দিতেন। এমনকি হযরত রাহ. এ দু’জনকে নিজের ছেলে হিসাবে গণ্য করতেন। ফলে পরবর্তীতে তারা দুজনই জনপ্রিয় ও দেশবিখ্যাত আলেম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন।
শায়খুল হাদীস রাহ. সদর ছাহেব হুযুরের ছাত্র। তিনি নিজের হাল বলতে গিয়ে বলেন, ‘মানতিক বা দর্শনশাস্ত্রের সর্বশেষ কিতাব ‘সুল্লাম’ পরীক্ষায় মোট তিনটি প্রশ্নের একটির উত্তর লিখে সেরেছি তখন পরীক্ষার সময় (৩ ঘণ্টা) শেষ হয়ে গেছে এবং জোহরের নামাযের আযানও হয়ে গেছে। আমি উস্তাযদের একথা বিনীতভাবে জানালে হযরত সদর ছাহেব হুযুর রাহ. তা অবগত হলেন। হুযুর অতি শফকত ও মহব্বতের সঙ্গে বললেন, ‘আচ্ছা, আজিজুল হকের অবশিষ্ট
পরীক্ষার গার্ড আমিই দেব।’ বাদ যোহর হুযুর যথাস্থানে বসে থাকলেন আর আমি লিখতে থাকলাম। এমন সময় আসরেরও আযান হয়ে গেল। এমনিভাবে আসরের পরও লিখলাম। অথচ আমার উত্তর লেখা তখনও শেষ হয়নি। কিন্তু হুযুর এতেও অধৈর্য হননি; বরং বললেন, ঠিক আছে বাদ মাগরিব আমার নিকট বসে উত্তর লিখে পরীক্ষা শেষ করবে। ঠিক তাই হল। আমার মনে আছে বাদ মাগরিব হুযুর তার স্থানে এসে আওয়াবীন নামায পড়তে থাকলেন এবং আমি তিনটি প্রশ্নের যথাযথ উত্তর লিখে এশার নামাযের পূর্বে খাতা জমা দিলাম। সদর ছাহেব হুযুর রাহ. আমার খাতা খুশীচিত্তে জমা নিলেন।’ সুহৃদ পাঠক, এমন বিরল ঘটনার কথা কোথাও কখনও শুনেছেন কি?
=১৫=
হযরত রাহ. ছাত্রদেরকে সম্ভাব্য সকল উপায়ে তরবিয়ত করতেন এবং শিক্ষকদের প্রতি আদব ও সম্মান জ্ঞাপনের তাগিদ করতেন। যেমন আমরা মাদরাসায় এক মাহফিলে জমায়েত হয়েছি। তখন সদর ছাহেব হুযুর উপরের শ্রেণীর একজন ছাত্রকে বলে পাঠালেন হযরত হাফেজ্জী হুযুর কোথায় আছেন তা জানতে। তিনি এসে বললেন, حضور نہيں ملا সদর ছাহেব হুযুর তৎক্ষণাৎ আপত্তি করে বললেন, نہيں، بلکہ يہ کہنا کہ حضور نہيں ملے অথবা حضور کو نہيں ملا۔
ছাত্রদের তরবিয়তের বিষয়ে সে যুগে জামেয়া কুরআনিয়ার আরেকটি ঘটনা মনে হল। সেকালে বছরে সম্ভবত শুধু কুরবানীর ঈদের পর ছুটি হত। ত্রৈমাসিক পরীক্ষার পর ছুটি হত না। খুব সম্ভব ত্রৈমাসিক পরীক্ষার শেষ দিনেই মাদরাসার উপরের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন ছাত্রের কথায় আমাদের সকল ছাত্রের স্বাক্ষর সম্বলিত এক সপ্তাহের ছুটি চেয়ে একটি দরখাস্ত কর্তৃপক্ষের হাতে দেওয়া হয় শুধু ছাত্রদের নিজস্ব রায়ে এমন একটি কর্ম সে যুগে উস্তায ও মুরব্বীদের নিকট ছিল এক অমার্জনীয় অপরাধ। আসাতেযায়ে কেরামের পরামর্শ মতে অনতিবিলম্বে ছাত্র-শিক্ষকদের মজলিশ আহ্বান করা হল এবং তাতে উস্তাযগণ ছাত্রদের তরবিয়তী লাইনে এমন মর্মস্পর্শী বক্তব্য রাখলেন যে আমরা সকল ছাত্র অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলাম। অধমের পরিষ্কার মনে আছে, সকল উস্তাযসহ হযরত সদর ছাহেব রাহ. সভায় উপস্থিত ছিলেন। আর হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ. ছাত্রদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে এক এক সারির ছাত্রদেরকে তওবার শব্দাবলি বলছিলেন এবং ছাত্ররা অনুতপ্ত ও কাতরকণ্ঠে সেসব শব্দ বলে যাচ্ছিল। মোটকথা, এমন ছিল সে কালের শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রদের তরবিয়ত কল্যাণের চিন্তাধারা ও ব্যবস্থাপনা।
ঢ. এ দেশে জাতীয়ভাবে ক্রিকেট খেলা শুরু হলে হযরত সদর ছাহেব রাহ.-এর বুকফাটা আহাজারি যারা দেখেছিলেন তারা বিলক্ষণ বুঝতেন, জাতীয়ভাবে খেলাধুলাকে সরকারের গ্রহণ করায় তিনি কী রকম মর্মপীড়ায় ভুগছিলেন। বুকে হাত মারছিলেন, আর্তনাদ করছিলেন। আর বলছিলেন, “হায়! কী পরিণাম হবে এই জাতির!”
ন. ‘মুনাজাতে মকবুল’ হযরত থানবী রাহ.-এর সংকলন। এতে কুরআন-হাদীসের দুআ সাত মনযিলে ভাগ করে সাত দিনে পড়ার সুন্দর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সদর ছাহেব হুযুর সংকনটির বাংলা অনুবাদ করেছেন। শেষ পর্যায়ে হাদীসের কিছু দুআ বাদে প্রথম মনযিলের সবই কুরআন শরীফের দুআ। সদর ছাহেব হুযুর দেখলেন, কুরআন পাকের একখানি দুআ যাতে সুসন্তান লাভের জন্য দুআ করা হয়েছেÑ সংকলন থেকে বাদ পড়েছে। শায়খুল হাদীস রাহ. থেকে শুনেছি, হযরত সদর ছাহেব বলেছেন, “কী জানি, কেমন করে হযরত থানবী রাহ.-এর যেহেন থেকে এ দুআটি বাদ পড়ল।” যাক, সদর ছাহেব হুযুর বাংলা মুনাজাতে মকবুলে দুআখানি সংযুক্ত করে দিয়েছেন। সদর ছাহেব রাহ. বলেছেন, মুনাজাতে মকবুলে সংকলিত হাদীসের দুআগুলি রেসালাতের একটি স্বতন্ত্র ‘মুজেযা’। কেননা আল্লাহর রাসূল ব্যতীত অন্য কোনো মানুষের পক্ষে এমন সব দুআ করা আদৌ সম্ভব নয়।
হযরত শায়খুল হাদীস রাহ. আমাকে বলেছিলেন, “আমি সদর ছাহেব হুযুরের নিকট মুনাজাতে মকবুল পড়েছি। তুমি আমার নিকট পড়”। আমি তাই করেছিলাম এবং সদর ছাহেবের তাকরীর তিনি লিখিয়ে দিয়েছিলেন। শায়খুল হাদীস রাহ. হযরত সদর ছাহেবের নিকট মেশকাত শরীফও একা পড়েছিলেন। তখন হুযুর বলেছিলেন, “যখন যে হাদীসখানি পড়বা, তখন থেকেই তার উপর আমল করতে শুরু করবা।”
সরকারী বেতনের চেয়ে পাবলিক চাঁদার বেতন অনেক ভাল
এক্ষেত্রে আহলে দুনিয়া তথা পার্থিব পদাধিকারী কিছু সরকারি বেতনভোগী লোকের মানসিকতা এই যে, তারা সরকারী বেতনে গৌরব বোধ করেন এবং পাবলিক চাঁদায় পরিচালিত মাদরাসার ওযীফা (বেতন)কে কিছুটা আড় চোখে দেখেন। এহেন মানসিকতার সমুচিত জবাব দিয়ে হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত হযরত থানবী রাহ. বলেন, সরকারী বেতনের উৎসও পাবলিক চাঁদাই। তবে আমাদের ও তাদেরটায় পার্থক্য এই যে, সরকার অনেক ক্ষেত্রেই পাবলিকের উপর জুলুম করে বিভিন্ন রকম কর ও ট্যাক্স ইত্যাদির নামে চাঁদা উঠিয়ে তা বেতন হিসাবে দেয়। আর জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের চাঁদা দিয়ে থাকে এবং তাদের অনেকে মাদরাসায় বা আলেমদের হাদিয়া দিতে পারাকে নিজেদের সৌভাগ্য মনে করে। এ জন্যই আমাদের প্রাণপ্রিয় শায়েখ একবার খুশীচিত্তে বলেন, “আলহামদু লিল্লাহ! আমাকে যে তিনি সরকারী বেতনভোগী করেননি।” প্রসঙ্গত তিনি এও বলেন, “আমাদের হযরত সদর ছাহেব হুযুরও তাকে সরকারী বেতন নিতে হয়নি বলে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করতেন”। আমি অধম উলামায়ে কেরামের খেদমতে আরয করে বলি, “হে আলেম ভাইয়েরা! আমরা আমাদের প্রাণপ্রিয় উস্তায হযরত শায়েখ ও তাঁর প্রাণপ্রিয় উস্তায ও মুর্শিদ হযরত সদর ছাহেব হুযুর রাহ. থেকে শিখি, অমূল্য সবক হাসিল করি।”
ত. হযরত সদর ছাহেব রাহ. বলতেন, দুনিয়াদাররা আলেমদের স্বচ্ছল অবস্থা দেখতে পারে না। কেননা তারা মনে করে আলেমরা তাদের সামনে বিনয়াবনত হয়ে থাকুক। হুযুরের প্রিয় রূহানী সন্তান মাওলানা আব্দুল হাই ছাহেব মারফত শুনেছি।
=১৬=
থ. একটি অনন্য ও অনির্বচনীয় অনুভূতি
হযরত সদর ছাহেব হুযুরের দরবারে বসলে এমন প্রশান্তি ও মনতুষ্টির ভাব অনুভূত হত, যা ছিল দুর্লভ ও অদ্বিতীয়। যা আমি এত পরিমাণে আর কোথাও অনুভব করিনি।
এ ছিল পরীক্ষিত যে, একজন মানুষ যত বড় পেরেশানকর অবস্থা নিয়েই হযরতের কাছে আসুক না কেন, কাছে বসেই এই প্রশান্তি লাভ করত যে, হুযুরের কাছে এসে গেছি আর কোনো চিন্তার কারণ নেই। আল্লাহ তাআলাই তাদের অন্তরে প্রশান্তি দিয়ে দিতেন।
বিজ্ঞ আলেম ও ওলিআল্লাহদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ একটি রহমত এই যে, কেউ যদি কোনো প্রশ্ন বা সমস্যা নিয়ে তাঁদের খেদমতে কিছুদিন চুপ করে বসে থাকে তবে প্রশ্নের জওয়াব ও সমস্যার সমাধান তাঁদের মুখ থেকে আল্লাহ তাআলা বের করে দেন।
বলাবাহুল্য, এই অবস্থা হযরত রাহ.-এর দরবারে ছিল সুস্পষ্ট ও দেদীপ্যমান।
ধ. হযরত সদর ছাহেব রাহ. গ্রামের বাড়িতে ইন্তেকাল করেন এবং তাঁর হাতের গড়া গওহরডাঙ্গা মাদরাসার ছোট্ট মাকবারায় সমাধিস্থ হন। লালবাগ জামিয়া কুরআনিয়ার অনেকেই জানাযার নামায থেকে মাহরূম হন। হুযুরের মৃত্যুর কয়েকদিন পর হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ. গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় যান। রাতে হুযুরের শোয়ার ব্যবস্থা করা হয় মাকবারার পাশে মাদরাসার একটি কামরায়। হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ. রাতের বেলায় কবর থেকে উত্থিত সুঘ্রাণ পেয়েছেন। পরবর্তীতে এ কথা তিনি অনেকের কাছেই বলেছেন।