স্বচ্ছতা : মুমিনের বড় গুণ
একটি প্রয়োজনে এক ভাইয়ের কাছে গিয়েছিলাম। সেখানে আরো দু’জন উপস্থিত ছিল। এক ব্যক্তি সম্পর্কে আলোচনা চলছিল- ‘আরে জানো না, তার একটু প্রশংসা করে দিলেই হয়। একদিন ভরা মজলিসে আমি তার খুব প্রশংসা করে দেই, এরপর থেকে আমার সাথে খুব ভাব। আর কোনো কঠোরতা করে না যা অন্যান্য অধীনস্তদের সাথে করে।’
একজন আরেকজনের প্রশংসা করলে ঐ ব্যক্তি প্রশংসাকারীকে আন্তরিক মনে করবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ এটা তার প্রতি আন্তরিকতা দেখানো এবং তার সাথে নিজের একাত্মতা প্রদর্শন করা। তবে এটাও সত্য যে, প্রশংসা কামনা করা, প্রার্থনা করা, অপেক্ষায় থাকা, ঘটা করে প্রশংসা করানো ইত্যাদি গুনাহ তো বটেই, সাথে সাথে খুবই হীনতা ও নিন্দনীয় কাজ। আর প্রশংসা শুনে ন্যায়-নীতি, সত্য-মিথ্যা ও বাস্তবতার জ্ঞান বিবেচনা হারিয়ে ফেলা তো আরো ভয়াবহ। এটি আজকের প্রসঙ্গ নয়, আজকের প্রসঙ্গ হলো পূর্বেরটি।
একটি মানুষের প্রশংসা করে তাকে খুশী করে দিলাম। অথচ আমার অন্তরে তার প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা নেই। একটি মানুষকে সহজ সরল পেয়ে তাকে কাবু করে ফেললাম। মানলাম সেও প্রশংসা কামনা করে, প্রশংসা শুনে খুশী হয়ে যায়, কিন্তু আমার মনে তো তার প্রতি শ্রদ্ধা নেই। তার পরও মুখে মুখে তার প্রশংসা করলাম। এটা তো অবশ্যই অস্বচ্ছতা, কুটিলতা, এমনকি প্রতারণা। এটা মুসলিম বৈশিষ্ট্যের পরিপন্থী।
সরাসরি মিথ্যা বলা, ওজনে কম দেওয়া, অন্যকে ঠকানো এগুলোকে সবাই প্রতারণা মনে করি, কিন্তু কতক বিষয় এমন আছে যেগুলোকে সাধারণত অস্বচ্ছতা মনে করা হয় না, অথচ তা মারাত্মক অস্বচ্ছতা।
একজনের নিকটস্থ হওয়ার জন্য তার প্রশংসা করে দেয়া, তার থেকে কোনো কিছু উদ্ধারের জন্য লৌকিক তারিফ করা, দেখা হলেই বলা আমরা আপনার কথা বলতেই থাকি। আমি তার প্রশংসা করলে সেও আমার প্রশংসা করবে এ মানসে তার স্তুতি গাওয়া, কর্তা বা বসের তোষামদ করা, কোনো পদ পাওয়ার জন্য অথবা অন্যান্য সহকর্মিদের থেকে বেশী নৈকট্যশীল হওয়ার জন্য ভনিতা করে কর্তা ও বসের তারীফ ও সেবা করা, ভালোবাসা দেখানো, তাদেরকে হাদিয়া, গিফট দেওয়া- এসব আজ ‘শিল্প’ বা ‘দর্শনে’ পরিণত হয়েছে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এর নিকট কিছু লোক এসে বললেন, আমরা আমীরদের দরবারে যাই, তখন তাদের সামনে (প্রশংসামূলক) এমন কিছু বলি, যা বাইরে বলি না। এ কথা শুনে হযরত ইবনে উমর রা. বললেন, كنا نعدها نفاقا আমরা এগুলোকে ‘নিফাক’ (কপটতা, মুনাফেকী) গণ্য করতাম। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৭১৭৮
মুসলমানদের আমীরদের কল্যাণকামিতার বিষয়ে যে হাদীস এসেছে তার ব্যাখ্যায় ইমাম নববী বলেন,
وأن لايغروا بالثناء الكاذب عليهم তাদেরকে যেন মিথ্যা প্রশংসা শুনিয়ে ধোঁকা না দেয়। এটাও কল্যাণকামনার অংশ।
কোনো ব্যক্তি আরেক ব্যক্তি থেকে এমন ভাব-সাব নিয়ে হাদীস বর্ণনা করছে যেন সে সরাসরি তার কাছ থেকে শুনেছে। আসলে সরাসরি শুনেনি। মুহাদ্দিসীনের পরিভাষায় একে তাদলীস বলা হয়। সেটিও এ অস্বচ্ছতার কারণে নিন্দনীয়। কবি সুন্দর বলেছেন-
دلس للناس حديثه + والله لا يقبل تدليساً
‘ম্যানেজ’ করে চলতে পারা, ‘ভাজ’ দিয়ে থাকতে পারা, ন্যায়নীতি ও আদর্শ বাদ দিয়ে কর্তা ও বসের মনোভাব উদ্ধার করে চলা, নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য অপরকে কৌশলে প্রতারণায় ফেলা ইত্যাদি সব কিছু আজ ‘বুদ্ধিমত্তা’, ‘দুরদর্শিতা’ ও ‘বিচক্ষণতা’য় পরিণত হয়েছে।
বাংলা অভিধানে ‘চালাকি’ ‘চতুরতা’ ‘কুটিলতা’ ইত্যাদি শব্দ রয়েছে। জানি না এসবের জন্য কোন প্রকারের শব্দ প্রযোজ্য।
مَلْعُونٌ مَنْ ضَارَّ مُؤْمِنًا أَوْ مَكَرَ بِهِ.
ধীকৃত সে, যে কোনো মুমিনের ক্ষতি করে অথবা তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯৪০
আরেক হাদীসে আছে,
إن أخوف ما أخاف على أمتي كل منافق عليم اللسان.
উম্মতের ব্যাপারে আমার যে বিষয়গুলোকে ভয় হয় তন্মধ্যে ভয়ংকরতম হচ্ছে বাকপটু মুনাফিক। -মুসনাদে আহমদ, ১/২২
সাহাবী হযরত আবু উমামা রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
يطبع المؤمن على الخلال كلها إلا الخيانة والكذب.
স্বভাবগতভাবে একজন মুমিন -এর মাঝে (ভালো-মন্দ) সকল চরিত্রই থাকতে পারে, দুটি চরিত্র ছাড়া এক. খিয়ানত, দুই. মিথ্যা। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২১৭০; মুয়াত্তা মালেক, শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৪৪৭১
খিয়ানত ও মিথ্যার মূল অস্বচ্ছতা, এটি ঈমানের সাথে মেলে না।
ঈমান ও নিফাকের পার্থক্যই এখানে যে, মুমিন স্বচ্ছ, মুনাফিক অস্বচ্ছ! তাবুক যুদ্ধে মুনাফিকদের অস্বচ্ছতা এবং ঐসব সাহাবী যারা যুদ্ধে যেতে পারেননি তাদের অবস্থার বিবরণ দিয়ে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের সম্বোধন করে বলেন,
يا ايها الذين آمنوا اتقوا الله وكونوا مع الصادقين.
“হে ঈমানদাররা! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক।” ‘সাদেকীন’ এখানে ‘মুনাফিকীন’-এর বিপরীতে এসেছে ‘কাফিরীন’-এর বিপরীতে নয়। কারণ আয়াতের উদ্দেশ্য মুনাফিকদের সঙ্গ ত্যাগ করার নির্দেশ দান। সাদেকীন দ্বারা উদ্দেশ্য এখানে মুমিন। অর্থাৎ তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং মুমিনদের সাথে থাক। তাদের সাথে জিহাদে শরীক হও, মুনাফিকদের সাথে থেকো না এবং জিহাদ থেকে লুকিয়ে থেকো না।
মুনাফিক অস্বচ্ছ,
يرضونكم بأفواههم وتأبى قلوبهم
[তারা মুখে তোমাদের সন্তুষ্ট রাখে, কিন্তু তাদের হৃদয় তা অস্বীকার করে। -সূরা তাওবা (১০) : ৮]
মুমিন স্বচ্ছ তাই তারা সত্যবাদী। মুমিনরাই যে সত্যবাদী আল্লাহ তাআলা তা অন্য আয়াতে এভাবে বলেছেন,
اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا بِاللّٰهِ وَ رَسُوْلِهٖ ثُمَّ لَمْ یَرْتَابُوْا وَ جٰهَدُوْا بِاَمْوَالِهِمْ وَ اَنْفُسِهِمْ فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ ؕ اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الصّٰدِقُوْن.
মুমিন তো তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে অতপর তাতে কোনো সন্দেহে পতিত হয়নি এবং তাদের জানমাল দিয়ে আল্লাহর পধে জিহাদ করেছে। তারাই তো সত্যবাদী। -সূরা হুজুরাত (৪৯) : ১৫
মুমিন এজন্যই সত্যবাদী যে, সে যা বলে তার অন্তরেও তা থাকে এবং কাজে কর্মে হুবহু সেটাই বাস্তবায়ন করে দেখায়। এতে কোনো লুকোচুরি বা অস্বচ্ছতা থাকে না।
হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে
التَّاجِرُ الصَّدُوقُ الْأَمِينُ مَعَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ
সত্যবাদী ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী সিদ্দীক ও শহীদগণের সাথে থাকবে।
সত্যবাদী ব্যবসায়ী কারা তা হাদীসে এভাবে বর্ণিত হয়েছে -
فَإِنْ صَدَقَا وَبَيَّنَا بُورِكَ لَهُمَا فِي بَيْعِهِمَا وَإِنْ كَذِبَا وَكَتَمَا مُحِقَ بَرَكَةُ بَيْعِهِمَا.
যদি ক্রেতা-বিক্রেতা সত্য বলে এবং ভালো-মন্দ প্রকাশ করে দেয় তাহলে তাদের লেনদেন বরকতময় হবে। আর যদি উভয়ে মিথ্যা বলে এবং দোষত্রুটি গোপন করে তাহলে এ লেনদেন থেকে বরকত উঠিয়ে নেওয়া হবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৩২
কুরআন হাদীসে স্বচ্ছতার প্রশংসা এবং অস্বচ্ছতার নিন্দা কতভাবে এসেছে তা একত্র করা মুশকিল। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম বলেছেন,
شَفَاعَتِي لِمَنْ يَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ مُخْلِصًا، يُصَدِّقُ قَلْبُهُ لِسَانَهُ، وَلِسَانُهُ قَلْبَهُ.
আমার সুপারিশ তার জন্য যে সাক্ষ্য দিবে ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই’। এমন ইখলাসের সাথে যে, তার অন্তর তার মুখকে সত্যায়ন করবে এবং মুখ অন্তরকে সত্যায়ন করবে। -মুসনাদে আহমদ, হাদীস ৮০৭০
এক মহিলা নবীজীর নিকট এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার একজন সতীন রয়েছে। তো আমি যদি চালচলনে, কথাবার্তায় সতীনের নিকট এমন ভাব প্রকাশ করি যে, স্বামী আমাকে অনেক কিছু দেয় এতে কি পাপ হবে? উত্তরে নবীজী বলেছেন,
الْمُتَشَبِّعُ بِمَا لَمْ يُعْطَ كَلَابِسِ ثَوْبَيْ زُورٍ.
যে লোক এমন বিষয়ে প্রাপ্তি ও তৃপ্তির ভাব প্রকাশ করে যা সে প্রাপ্ত হয়নি সে যেন মিথ্যার একপ্রস্থ কাপড় পরিহিতের ন্যায়।
কোনো ব্যক্তি আবেদ যাহেদের পোশাক পরে বুঝায় সে তাদের একজন এবং এমন তাকওয়া ও বিনয় প্রকাশ করে যা তার অন্তরে নেই। তাকে মিথ্যার কাপড় পরিধানকারী বলা হয়। মানুষ সাধারণত দুইটি কাপড় পরিধান করে। একটি শরীরের ঊর্ধ্বাংশে, অপরটি নি¤œাংশে। তাই দুই কাপড় পরিহিতের ন্যায় বলা হয়েছে। অর্থাৎ সে সম্পূর্ণরূপে মিথ্যায় আহত।
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِنَّ شَرَّ النَّاسِ ذُو الْوَجْهَيْنِ، يَأْتِي هَؤُلَاءِ بِوَجْهٍ وَهَؤُلَاءِ بِوَجْهٍ.
সবচে নিকৃষ্ট মানুষ হল দু’মুখো মানুষ। এর কাছে আসে এক চেহারায় ওর কাছে যায় আরেক চেহারায় । -মুসনাদে আহমদ, হাদীস ৮০৬৯
হযরত আসমা বিনতে উমাইস রা. বলেন, যেসব সখী আয়েশাকে সাজিয়ে নবীজীর বাসরে নিয়ে গিয়েছিল আমিও ছিলাম তাদের একজন। আল্লাহর শপথ, তখন তাঁর ঘরে শুধু এক পেয়ালা দুধ ছিল। প্রথমে নবীজী তা থেকে পান করেন অতপর আয়েশাকে দেন। সে খুব লজ্জা করছে এবং নিচ্ছে না দেখে আমরা বললাম, নবীজীর হাত ফিরিয়ে দিও না, নিয়ে নাও তখন সে খুব লাজুকতার সাথে নিল ও পান করল। অতপর নবীজী বললেন, তোমার সখীদের দাও। আমরা বললাম, আমাদের ক্ষুধা নেই। তখন নবীজী বললেন, দেখ, ক্ষুধা ও মিথ্যা একত্র করো না। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কোনো কিছুর প্রতি আমাদের চাহিদা আছে বটে তবে কেউ দিলে বলি, আমার এখন চাহিদা নেই এটা কি মিথ্যা হবে? তখন নবীজী বললেন,
إِنَّ الْكَذِبَ يُكْتَبُ كَذِبًا حَتَّى تُكْتَبَ الْكُذَيْبَةُ كُذَيْبَةً.
মিথ্যাকে মিথ্যা হিসেবে লিখা হয় এমন কি ছোট মিথ্যাকেও ছোট মিথ্যা হিসেবে লিখা হয়। -মুসনাদে আহমদ, হাদীস ২৭৪৭১
গরু ছাগল উট দুম্বা বিক্রি করতে গিয়ে দু’তিন দিন দুধ দোহন না করে ওলান ফুলিয়ে বিক্রি করতে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন, বরং ঐ লেনদেনকে অবৈধ ও ভেঙ্গে দেওয়া আবশ্যক বলেছেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার একজন শস্যব্যবসায়ীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সে সময় তিনি তার শস্যের স্তূপের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিলেন। তখন ভেতরের শস্যগুলোতে কিছু আর্দ্রতা অনুভূত হল। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কী? সেই ব্যবসায়ী উত্তর দিলেন, বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছিল। নবীজী তখন বললেন, ‘ভেজা অংশটা উপরে রাখলে না কেন?’ তারপর নবীজী আরো বললেন, যারা আমাদেরকে ধোঁকা দেয় তারা আমাদের নয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০২
বিচার ও সাক্ষ্যের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ইসলামে কাম্য। বিচারের ক্ষেত্রে ইনসাফ যেন ব্যাহত না হয়; ফয়সালা নিজের বিরুদ্ধে বা পিতা-মাতা ভাই-বোনের বিরুদ্ধে গেলেও, নিজের শত্রুর পক্ষে গেলেও। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন, হে মুমিনগণ! তোমরা ইনসাফ প্রতিষ্ঠাকারী হয়ে যাও আল্লাহর সাক্ষীরূপে, যদিও তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে হয় কিংবা পিতামাতা ও আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে। -সূরা নিসা (৪) : ১৩৫
আরো বলেন, কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রুতা তোমাদেরকে যেন বে-ইনসাফীর প্রতি প্ররোচিত না করে। -সূরা মায়েদা (৫) : ৮
কুরআন হাদীসে এ সম্পর্কিত সকল বর্ণনা একত্র করলে এক ভা-ার হয়ে যাবে। যার অবকাশ এখানে নেই। রিয়া, প্রতারণা, মিথ্যা, লৌকিকতা, ফন্দি আঁটা, কারো পিছে লাগা, নিফাক ইত্যাদি বিষয়ের ঘৃণ্যতার ক্ষেত্রে যত আয়াত ও হাদীস রয়েছে তা এ বিষয়েরই অন্তর্ভুক্ত। সবশেষে আরেকটি হাদীস উদ্ধৃত করছি, যার দ্বারা ইসলামে স্বচ্ছতা যে কত জরুরি তা আলোর মত পরিষ্কার হয়ে যায়।
মক্কা বিজয়ের দিন, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার সকল কাফেরকে সাধারণ ক্ষমা করে দিলেন, তবে সাত জন কাফের ব্যতিত। ওরা মুসলমানদেরকে এত কষ্ট দিয়েছে দয়ার নবী হওয়ার পরও এবং সকলে সাধারণ ক্ষমা পাওয়ার পরও তারা ক্ষমা পায়নি। এদের মধ্যে একজন হল, আব্দুল্লাহ ইবনু আবুস সারাহ। হযরত উসমান রা.-এর দুধ ভাই। তিনি হযরত উসমানের নিকট আত্মগোপন করলেন। নবীজী যখন মানুষদেরকে বায়আতের জন্য ডাকলেন তখন হযরত উসমান রা. দুধ ভাইকে সাথে করে আল্লাহর নবীর নিকট গিয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আব্দুল্লাহকে বায়আত করুন। আল্লাহর নবী তার দিকে তাকালেন এবং মাথা নীচু করে নিলেন, কিছু বললেন না। কিছুক্ষণ পর হযরত উসমান পুনরায় আবেদন করলেন। আল্লাহর নবী তেমনি করলেন, কিছু বললেন না। তৃতীয় বার যখন আবেদন করলেন তখন নবীজী পুনরায় তাকিয়ে তাকে বায়আত করলেন। অতপর সাহাবীদের লক্ষ্য করে বললেন, তোমাদের মাঝে কি কোনো বুঝমান লোক নেই? আমাকে যখন তার বায়আত থেকে হাত গুটিয়ে রাখতে দেখলে তখন তাকে হত্যা করে ফেলতে! সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার মনে কী আছে আমরা তো তা জানি না।
যদি একটু (চোখের) ইশারা দিতেন। তখন নবীজী বললেন,
إِنَّهُ لَا يَنْبَغِي لِنَبِيٍّ أَنْ تَكُونَ لَهُ خَائِنَةُ أَعْيُنٍ.
কোনো নবীর জন্য শোভনীয় নয় যে তার চোরা চোখ হবে। অন্য বর্ণনায় আছে "أن يومض" কোনো নবীর জন্য শোভনীয় নয় চোখ দিয়ে ইশারা করা। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৬৭৬
এতবড় দাগী শত্রু, হত্যা আবশ্যক এমন কাফির তাকে মারতে কৌশলের প্রয়োজন নেই। প্রকাশ্যেই মারা যায়, আর কৌশল করলেও গুনাহ নেই। আর কৌশলটাও সামান্য, চোখের ইশারা মাত্র। কিন্তু নবীজী কত স্বচ্ছতার পরিচয় দিলেন! স্বচ্ছতা তাকে এটুকুও করতে দেয়নি।
চোখ দিয়ে ইশারা করা আমাদের কাছে কত সাধারণ। কতক্ষেত্রেই তো উপস্থিত লোকদের কাছে কোনো বিষয় লুকানোর জন্য এমন করি। বরং তা করে সাবাসও পাই।
এসব হাদীসে আমাদের জন্য রয়েছে শিক্ষা। আমরা অনেকে আবার এসবকে ‘হিকমত’ বলি। ‘হিকমত’ আরবী, উর্দু ও ফারসি শব্দ, কুরআন-হাদীসে হিকমতের বহু ফাযায়েল রয়েছে। নবীজীকে পাঠানো হয়েছে হিকমত শেখানোর জন্য। আল্লাহ বলেন, ‘যাকে হিকমত দান করা হল তাকে বহু কল্যাণ দান করা হল’। শেখ সাদী রাহ.ও গুলিস্তাঁ কিতাবে বহু হিকমত লিখে গেছেন। অস্বচ্ছতা যদি হিকমত হয় তাহলে কুরআন-হাদীসে বর্ণিত হিকমতকে কী বলব! আর একটি শব্দকে সম্পূর্ণ তার বিপরীত অর্থে ব্যবহার করা কত ভয়াবহ কাজ তা ভাবা দরকার। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন।
জীবনের বাঁকে বাঁকে কত পদক্ষেপে এ অস্বচ্ছতার উপস্থিতি ঘটে। একটু খেয়াল করলেই তা অনুমান করা যাবে। এখানে শুধু একটি প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আশা রাখি, এর দ্বারা অন্য ক্ষেত্রেও সহযোগিতা পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন। আমীন।
মাসতুরাতের উদ্দেশ্যে...
(৪৬ পৃষ্ঠার পর)
نَصْبِرُ عَلَى الْجُوعِ وَلَا نَصْبِرُ عَلَى النَّارِআপনি আমাদের জন্য কামাই করতে যাচ্ছেন, সংসার চালানোর জন্য রোজগার করতে বের হচ্ছেন, আমরা আপনাকে আস্বস্ত করছি যে, আমরা দারিদ্র্যের উপর সবর করতে রাজী, ক্ষুধার কষ্ট সইতে প্রস্তুত, আজ এটা নেই কাল ওটা নেই, অভাব-অনটন চলছেই চলছে...এর উপর আমরা ধৈর্য ধরব। কিন্তু জাহান্নামের আগুন সহ্য করতে পারব না। সুতরাং হালালভাবে যা পাবেন কেবল ততটুকু আনবেন, হারাম কিছু আনার চেষ্টা করবেন না। আমরা না খেয়ে কম খেয়ে থাকতে পারব কিন্তু দোযখের আগুন সইতে পারব না। এই ছিল আগের কালের মহিলাদের ভাষা। আর এই যামানার মহিলারা স্বামীর হাতে লম্বা তালিকা ধরিয়ে দিয়ে বলে, এগুলো আমার চাই। তালিকা দেখে স্বামী বেচারা বিমর্ষ হয়ে পড়ে। স্ত্রীকে অনুনয় করে বলে, আমি এত কিছু কীভাবে আনব, আমার আয় তো তোমার সামনে? তুমি তো জান আমার কত আয়! স্ত্রীর এক কথা; তোমার কত আয় আমার তা জানার দরকার নেই। এই জিনিসগুলো আমার চাই, এগুলো ছাড়া দিন চলবে না। এই যুগে এমন মহিলা অনেক। কিন্তু আগে এমন ছিল না। কম হোক আপত্তি নেই, কিন্তু হারাম তারা সহ্য করতেন না। আল্লাহ তাআলা সকল মহিলাদেরকে এমন হওয়ার তাওফীক দান করুন। পুরুষদেরও আগের পুরুষদের মত নেককার হওয়ার তাওফীক দিন। আমীন।
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.
[মুসাজ্জিলা থেকে বয়ানটি পত্রস্থ করেছেন মাহমুদ হাসান মাসরূর। জাযাহুল্লাহু খাইরান]