বি. বাড়িয়ার ঘটনা : এমন যেন আর না ঘটে
অতি সম্প্রতি বি. বাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী জামেয়া ইউনুসিয়া মাদরাসায় ঘটে যাওয়া লোমহর্ষক ঘটনাটি খুব ঠাণ্ডা মাথায় বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। একটি বিবাদের জের ধরে গভীর রাতে একটি দ্বীনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে ঘুমন্ত ছাত্রদের উপর হামলা করা এবং একজন হাফেযে কুরআনকে উপরতলা থেকে নীচে ফেলে দেওয়ার ঘটনা খুব সাধারণ ঘটনা নয়।
এই ঘটনা এবং আগে-পরের ঘটনা-প্রবাহে সব পক্ষের জন্য চিন্তা ও উদ্বেগের ব্যাপার রয়েছে। এখানে প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, একজন মুসলিমের মাধ্যমে Ñযদি সে মুসলিম হয়ে থাকেÑ এই পাশবিক ঘটনা কীভাবে ঘটতে পারে? তাহলে মুসলমানেরই একটি শ্রেণিকে আজ কোথায় নামিয়ে আনা হয়েছে!
এই প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো প্রতিষ্ঠানও নয় এবং এগুলোর কার্যক্রমে লুকোছাপার কোনো কিছু নেই। প্রায় প্রতিটি কওমী মাদরাসায় পাঞ্জেগানা ও জুমা মসজিদ রয়েছে। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে, জুমা-জানাযায়, দুই ঈদে, তারাবীতে ও নানা ধর্মীয় অনুষঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানে মহল্লাবাসীর ব্যাপক ও উন্মুক্ত উপস্থিতি রয়েছে। বাংলাদেশের আর কোনো ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বস্তরের মানুষের জন্য এত উন্মুক্ত নয়।
একইভাবে এসব প্রতিষ্ঠান বিশেষ কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠির মাধ্যমেও পরিচালিত নয়। এখানে সকল শ্রেণি-পেশার এবং সকল মত ও পথের দ্বীনদার মানুষের অংশগ্রহণ রয়েছে। এই মাদরাসাগুলোর ছাত্র-শিক্ষকদের পারিবারিক প্রেক্ষাপটও বিশেষ কোনো শ্রেণি-পেশা বা রাজনৈতিক পরিচয়ের নয়। এখানে একতার একমাত্র সূত্র হচ্ছে ইলম ও ইলমের সেবা এবং ইসলাম ও ইসলামপ্রিয়তা। একারণে শত প্রচারণার পরও তৃণমূল পর্যায়ের জনসাধারণের মনে এসকল মাদরাসার প্রতি রয়েছে অপরিসীম দরদ ও শ্রদ্ধা। এই সাধারণ ধারার বাইরে কিছু মানুষের মনে কীভাবে ও কেন এই জিঘাংসাপূর্ণ ও মারমুখী মানসিকতা তৈরি হচ্ছে তা খুব গভীরভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন। অথচ ঐ মানুষগুলোও মুসলমান। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে, জুমায়-ঈদে তারাও এই মাদরাসা-মসজিদগুলোতে অথবা এই সকল মাদরাসার সন্তানদের পিছনেই ইক্তেদা করে থাকেন। এঁদেরই মুখে দ্বীন-ধর্মের ব্যাখ্যা শোনেন এবং জীবনের নানা বিষয়ে এঁদেরই দুআ ও পরামর্শ গ্রহণ করেন। একটি সিন্ডিকেটেড প্রচারণা যে ঐক্যের বহু সূত্র ও বন্ধন সত্তে¡ও কীভাবে একটি জাতিকে চিন্তা ও কর্মে বিভক্ত করে ফেলতে পারেÑ এ তারই একটি দৃষ্টান্ত। মিডিয়ার প্রচারণাকে যারা মনোযোগের ব্যাপার বলে মনে করেন না তাদের জন্য এসকল ঘটনায় চিন্তার উপাদান রয়েছে। ধীরে ধীরে মুসলমানেরই একটি শ্রেণিকে কীভাবে চরম মুসলিম-বিদ্বেষী ও ইসলাম-বিদ্বেষী করে গড়ে ফেলা হচ্ছেÑ তা আমাদের সকল পক্ষকেই গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, আমাদের এই ছোট্ট দেশখানি, পৃথিবী নামক গ্রহটিরই একটি অংশ। যত ছোটই হোক, এই দেশটির নানা ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের একটি হচ্ছে, এর বিপুল সংখ্যক ধর্মপ্রাণ ইসলামপ্রিয় জনগোষ্ঠী। তাই এই দেশ-জাতিও চলমান বৈশ্বিক তৎপরতা বা অপতৎপরতা থেকে মুক্ত নয়। আল্লাহ তাআলা ইলমে দ্বীনের সাথে আমাদের যাদেরকে যুক্ত করেছেন আমাদের বিম্মৃত হলে চলবে না যে, ইলমে দ্বীনের মানসিবটির কারণেই আমরা আমাদের চারপাশের কিছু লোকের ‘বিশেষ মনোযোগে’র লক্ষ্যবস্তু। সুতরাং নিজেদের স্বার্থে, দ্বীন ও ইলমে দ্বীনের স্বার্থে এবং এই জাতি ও উম্মাহর স্বার্থে আমাদের ছোট-বড় প্রত্যেকের চ‚ড়ান্ত সতর্কতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দেয়া অতি প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, একটি ছোট্ট ঘটনার পর বড় বড় যে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাবলী ঘটতে থাকে তা আর নিয়ন্ত্রণের ভিতরে থাকে না। ‘মনোযোগী’ লোকেরা এসময় তাদের পূর্ব-পরিকল্পিত কর্মকাÐ বাস্তবায়নের সুযোগ পেয়ে যায়। অথচ সব দায় এসে পড়ে ঐ ছোট্ট ঘটনাটির উপর। দেশে-বিদেশে এই ক‚টকৌশল ইতিমধ্যে বড় বড় ‘সাফল্য’ অর্জন করেছে বলে অনেকেই মনে করেন। সুতরাং সব ধরনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উসকানীর মুখেও আমাদের কর্তব্য, ইসলামী আচরণবিধি থেকে বিচ্যুত না হওয়া। দাঈর আচরণগত সামান্য ভুলও দাওয়াতের জন্য চরম ক্ষতিকর সাব্যস্ত হতে পারে। এবং প্রচারণাকারীদের নানা অসত্য প্রচারণার সুযোগ করে দিতে পারে। সংযম ও সতর্কতার অর্থ কর্মহীন থাকা নয়। ইতিবাচক ধারায় সুচিন্তিত ও ধারাবাহিক কর্ম-প্রয়াস এখন সময়ের দাবি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিছু কিছু মিডিয়া ও প্রতিষ্ঠানের ধারাবাহিক কর্ম-প্রয়াস খুব নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করা দরকার। আমাদের পঠন-পাঠনগত দায়িত্বের পাশাপাশি সর্বস্তরের জনগণের মাঝে সহীহ দাওয়াতী কাজের প্রসার ঘটানো এবং অজ্ঞতাবশত যারা বিরূপ তাদের মাঝেও সচেতনতা ও ভুল ধারণা অপনোদন প্রচেষ্টা এখন অতি প্রয়োজন।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সকল শ্রেণি, পেশা ও রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে সকল মুসলমানকে খাঁটি মুসলমান হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।