গণমাধ্যমে মেধাহীন পুঁজি ও অন্যান্য
গণমাধ্যমে সখের একটি যুগ গেছে। চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে। এ দেশে এবং দেশের বাইরে। কিন্তু এখন আর সখের সে যুগটি নেই। মন চাইল আর টেনেটুনে একটি দৈনিক পত্রিকা অথবা একটি টিভি চ্যানেল কিংবা একটি প্রাইভেট রেডিও খুলে ফেললাম- এমন অবস্থা এখন নেই। এই এখন মানে অন্তত গত দুই যুগ। এখন এসব খুলতে চালাতে প্রচুর টাকা লগ্নি করতে হয়। বিনিয়োগে সমান কিংবা গচ্চার পাল্লাই ভারি থাকে। লাভের অংকে যোগ হয় অল্প কিছু সময়।
প্রশ্ন হচ্ছে, এরপরেও গণমাধ্যমে এখন টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে কেন? আর নিত্যনতুন গণমাধ্যমের পালের হালই বা ধরছেন কারা? গণমাধ্যমের এই ‘বিত্ত-ঝুঁকি’র মৌসুমেও আদর্শিক দ্ব›দ্ব বা প্রধান ধর্মীয় অনুশাসন ও অনুসারীদের সঙ্গে বৈরিতার পটভুমিটা অক্ষুন্ন থাকছে কীভাবে? গণমাধ্যম নিয়ে কিংবা গণমাধ্যমের সঙ্গে এ-জাতীয় প্রশ্নগুলোকে মিলিয়ে নিয়ে কিছু ভাবতে চাওয়ার বিষয়টি আসলে বিষয়ভিত্তিক কৌতূহল কিংবা আগ্রহের কারণে নয়। এর সঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি শ্রদ্ধা-আনুগত্য এবং অবমাননা, উপেক্ষা ও বঞ্চনার একটি ব্যাপার গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। এবং দিন দিন সে ব্যাপারটির আয়তন ও আয়োজন স্ফীত ও দৃশ্যমান হচ্ছে। এড়িয়ে যেতে চাইলেও শুধু সে প্রাসঙ্গিকতার প্রয়োজনেই ছোট্ট পরিসরে হলেও এমন আলোচনায় যেতে হচ্ছে।
। দুই।
একথা মিথ্যা নয় যে গণমাধ্যমে একটি সখ ও স্বপ্নের যুগ পার হয়েছে। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ, ষাট, সত্তরের দশকে গণমাধ্যমে বড় পরিসরটি ছিল কেবল পত্র-পত্রিকার। সীমিত পরিসরে রেডিও-টেলিভিশনের কিছু প্রভাব বজায় ছিল। প্রধানত বাম রাজনীতির ধারা থেকে আসা নেতাকর্মীরাই এদেশে মিশনের অংশ হিসেবে গণমাধ্যম চর্চা তথা সাংবাদিকতায় জড়িয়েছেন। সংস্কৃতি, গান, মঞ্চ, সাংবাদিকতা তাদের কাছে ছিল মূল বিপ্লবের সহচর, পার্শ-ময়দান। কেউ কেউ কাব্য-সাহিত্যেও সেই বোধ নিয়েই সক্রিয় হয়েছেন। তখন গণমাধ্যমের বিত্ত ও প্রভাব এত প্রকট ও প্রাত্যহিক ছিল না। পত্রিকার পাঁচ কলাম শিরোনামের চেয়েও মাঠের বক্তব্যের জেল্লা ছিল বেশি। এ কারণেই গণমাধ্যমের এ অঙ্গনটি নিয়ে বিপরীত প্রান্তের মনোযোগ ততটা তীব্র হওয়ার সুযোগ পায়নি। কিছু কিছু চেষ্টা তো ডান প্রান্ত থেকে সচল ছিলই। সৌজন্য ও রুচিশীলতার মতো। কিন্তু এই অঙ্গনটি যে মারাত্মক দরকারি কিংবা বিনাশী হয়ে উঠতে পারে- এটা তখনও বোঝাই যায়নি। এর ফল দেখা গেছে পরের কয়েক দশক থেকে নিয়ে বর্তমান পর্যন্ত।
এজন্যই এখন গণমাধ্যমের দিকে চোখ মেললে কয়েকটি বিষয় খুব স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। যেমন : বিভিন্ন প্রভাবশালী গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রক শ্রেণি (সম্পাদক, সম্পাদকীয় গ্রুপের সদস্য, বার্তা সম্পাদক, প্রধান ও বিশেষ প্রতিবেদক) এবং টিম রিক্রুটার (গণমাধ্যমে কর্মী নিয়োগদাতা) বেশির ভাগই থাকছেন সাবেক বামপন্থী লেখক-সাংবাদিক, রাজনীতিক। কিংবা ইসলাম ও মুসলিম বিশ্বের প্রতি বিরুদ্ধভাবাপন্নরাই গণমাধ্যমের নীতি ও টিমসজ্জার কাজ করছেন। নিদেনপক্ষে ইসলাম ও মুসলিম সম্পর্কে উন্নাসিক ও নিস্পৃহ না হলে কোনো গণমাধ্যমকর্মীর পক্ষে প্রভাবশালী কোনো গণমাধ্যমে প্রবেশ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বিষয়টি বোঝা যায় পেশাগত ভ‚মিকা ও প্রকাশ্য আচরণ থেকেও। আর গণমাধ্যমের চরিত্র বা পলিসি (নীতি) থেকেও এটা পরিষ্কার হয়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে, ওই বাম ও সেকুলার ব্যক্তিবর্গ গণমাধ্যমের সামগ্রিক চরিত্রটাই দাঁড় করিয়ে দেন একটি মুসলিম-প্রধান জাতির বিপরীত আকাক্সক্ষার আঙ্গিকে। রাজনীতি, শিক্ষা, পোশাক, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা-অশ্রদ্ধা, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যু, নৈতিকতার মাপকাঠি এবং ধর্মীয়-সামাজিক অনুশাসনের বিভিন্ন ঘটনার খবর ও বিশ্লেষণে এসব গণমাধ্যমের দাঁড় করানো চরিত্রটা ধরতে একদমই বেগ পেতে হয় না। সচেতন নাগরিকরা সবকিছু অনায়াসেই অনুভব করেন। কিন্তু অব্যাহত ও দলবদ্ধ (সিণ্ডিকেটেড) প্রচার সব অনুভব ও সতর্কতা ভাসিয়ে নিয়ে যেতে থাকে।
। তিন।
এক্ষেত্রে দুদিক থেকে উল্টো দুটি ব্যাপার প্রায় সময়ই ছুটে থাকে। একটি হচ্ছে, গণমাধ্যমের পুঁজি বা বিনিয়োগটা যার কাছ থেকে আসছে দেখা যায়, তিনি ততটা ‘বাম-দুর্বল’ বা সেকুলার নন। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে ব্যবসা ও বিত্তের সঙ্গে কিছু প্রভাব ও দাপট অর্জনই থাকে তার প্রধান প্রত্যাশা। বরং অনেক ক্ষেত্রে তিনি কিছুটা ধার্মিক, কিছুটা মুসলিম-দরদী ও সামান্য হলেও ইসলামী অনুশাসনের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল। অথচ তার টাকায় করা গণমাধ্যমের সংবাদ ও ট্রিটমেন্ট-পলিসি যাচ্ছে মাদরাসা, হিজাব, কুরআনী মক্তব, ফতোয়া, শরীয়া নীতি ও উম্মাহর ইস্যুর বিরুদ্ধে। যেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিপরীতে ওই গণমাধ্যম খোলা কৃপাণ হাতে যুদ্ধে নেমেছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে ইসলামবিরোধী বিষোদ্গারের পক্ষে উগ্র ভাষায় কথা বলছে। জাতিদ্রোহী, ধর্মদ্রোহী চিহ্নিত কিছু সাম্প্রদায়িক ব্লগারের পক্ষে জোরালো অবস্থান তুলে ধরছে। রুটিন খবর, অনুষ্ঠান রুটিন আর রুটিন সাফল্যের বাইরে মালিক বেচারা এসব অপরিহার্য সূক্ষ্মতায় প্রবেশের চিন্তাই করছেন না। তিনি টাকা বিনিয়োগ করে এবং ভালো সার্কুলেশন বা টিআরপি দেখেই খুশি। অপর দিকে দেখা যাচ্ছে, ওই গণমাধ্যমেই মাঝারি বা নিচের দিকে ইসলামের প্রতি আস্থাশীল কোনো সংবাদকর্মীকে ঢুকতেই দেওয়া হচ্ছে না। পরিবেশটা এমন ‘অবরুদ্ধ’ ও ‘উন্মুক্ত’ করে রাখা হয় যে সেখানে ‘বামদুর্বল’ কিংবা কথিত সেকুলার ছাড়া চিন্তা-চেতনায় কোনো দুর্বল মুসলিমও ঢুকতে চাইলে তাকে ভেতর-বাইরের খোলনলচে আগাগোড়া বদলাতেই হচ্ছে। গণমাধ্যমের ‘পলিসি’ অনুসরণের নামে এ পর্বটি সহজেই সম্পন্ন করা হচ্ছে।
এই ‘মস্তক বদলের’ কাজ গণমাধ্যম-কর্মীদের মাঝে হরদম চলছে। নিরাসক্ত-নিস্পৃহ ও উন্নাসিক কিংবা ধর্মীয় চেতনা-বিরোধী মুসলিম না হলে এখনকার সময়ে এদেশের প্রভাবশালী কোনো গণমাধ্যমে কারো জায়গা পাওয়াই কঠিন। কাজ করা তো অসম্ভব। এবং চলমান ধর্মসংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলোতে বিবেক-বিবেচনা কাজে লাগিয়ে লেখালেখি করা মারাত্মক অপরাধ। এই ধারাটাই দুই যুগ ধরে চলছে। এটাই এখন এ দেশের গণমাধ্যমের কায়েমী ধারা-এস্টাবলিশমেন্ট। এ ধারার ওপরই একটি সংঘবদ্ধতা তৈরি করা হয়েছে। একারণেই গণমাধ্যমে অব্যাহত ও সংঘবদ্ধ কোরাসের ভাষায় এখন মূল্যবোধের স্থান চিহ্নিত করা হচ্ছে। এই ধারায় এরই মধ্যে নতুন অনেক নিস্পৃহ ও নিরাসক্ত ইসলামবৈরি মুসলিম সংবাদকর্মীর উদ্ভাবনও ঘটেছে। বর্তমানে এ ধারার প্রতিনিধিত্ব করছেন এমন অনেকেই বিশ বছর আগে ভিন্ন ধারার ‘মস্তকধারী’ মানুষ ছিলেন। প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে তিনিও এখন ‘বামদুর্বল’ সেকুলার ও নিরাসক্ত মুসলিম। অবশ্য তাদের বেশির ভাগই প্রগতিশীলতার ‘বৃত্তে’ ঢুকতে পেরে তুষ্টির মনোভাব লালন করেন। দুর্বল ধর্মপ্রাণ মুসলিমের বিনিয়োগে গড়ে উঠা বিভিন্ন গণমাধ্যমের দিকে তাকালে এই চিত্রটি সহজেই ধরা পড়বে। তবে এর যে সামান্য ব্যতিক্রমও নেই তা নয়। সংঘবদ্ধ বামদুর্বলতা ও ইসলাম নিস্পৃহার বাইরে গণমাধ্যমের একটি প্রয়াস তো বরাবরই ছিল ও আছে। কখনো খুব প্রভাবক, কখনো খুব মজলুম, কখনো খুব ভঙ্গুর। সংঘবদ্ধ চক্রের ধূর্ততায় তারা স্বমর্যাদায় টিকে থাকতে পারছে না- নিশ্চিতভাবেই এ কথাটি বলা যায়।
মূলত গণমাধ্যমের উপর (পুঁজি) এবং নিচ (কর্মী) নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে মাঝের মুষ্টিমেয় নীতিনির্ধারক শ্রেণির (সম্পাদক ও নিয়োগকর্তা বলয়) কৌশলী হাতে। ফলে গণমাধ্যমের চরিত্রও বদলে যাচ্ছে ওই মধ্যচক্রের মর্জিমতো। বিশ্বাসী পুঁজির সাহায্যে বিশ্বাসী কর্মীদের (পরিবর্তনের) চাপের মধ্যে রেখে লাখ লাখ দর্শক-পাঠককে একটি বিশেষ মতাদর্শ ও এজেন্ডার ভোক্তা-গ্রহীতায় পরিণত করা হচ্ছে। যে কেউ-ই হাতের কড়ায় হিসাব মিলিয়ে বলতে পারবেন, গণমাধ্যমের এ-জাতীয় মাঝের মুষ্টিমেয় চক্রের সদস্য সারা দেশে কয়েক হাজারের বেশি হবে না। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এই কয়েক হাজার জনেরই বামাসক্ত ইসলামবৈরী মানসিকতার উদগিরিত তথ্য ও মনস্তত্ত¡ গ্রহণ করতে বাধ্য হতে হচ্ছে দেশের কয়েক কোটি মানুষকে। এভাবেই নির্মিত হচ্ছে পরিবর্তিত সংস্কৃতি। এভাবেই ক্ষয়ে যাচ্ছে সুচিন্তার ভিত। এবং আঞ্জাম দেয়া হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রে দ্বীনবিরোধী ও স্বাধীন মুসলিম-প্রধান রাষ্ট্রের স্বাতন্ত্র্য ও নিরাপত্তাবিরোধী আবহে বাতাস দেয়ার ধূর্ত মিশন।
। চার।
গণমাধ্যমের পুঁজি তো এখন বড়। পরিসর ও অঙ্গনও বড়। সচল দৈনিক পত্রিকার সংখ্যাই তো পচিশের উপরে। চলমান টেলিভিশন-রেডিওর সংখ্যাও বিশ-পচিশের কম নয়। ডজন খানেকের কম নয় পাঠক-পরিচিত অনলাইন পত্রিকার সংখ্যাও। কাটতি ও বিজ্ঞাপনই এসবের আয়ের খাত। সে হিসেবে সবকটি সচল পত্রিকা ও চ্যানেলে বিনিয়োগকৃত পুঁজি যে লাভ নিয়ে ফিরে আসছে- এমন নয়। কিন্তু টাকার অংকে সরাসরি লাভ না হলেও অন্য লাভটাই থাকে বিনিয়োগকারীদের প্রধান টার্গেট। চালু গণমাধ্যমের প্রভাব নিয়ে প্রধান কাজ থাকে তার অন্য ব্যবসার সুরক্ষা দেয়া। সুবিধার জন্য চাপ সৃষ্টির সুযোগ দাঁড় করানো। ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীন রাজনৈতিক শক্তির পক্ষ-বিপক্ষের কাভারেজ দিয়ে নিজের গুরুত্ব বাড়ানো। প্রতিদ্ব›দ্বীর বিপরীতে নিজের সামর্থ তুলে ধরা। মতাদর্শিক কোনো সংকট কিংবা বিচ্যুতি না থাকলেও এসব পেয়েই খুশি থাকে মালিকপক্ষ। তার মাথায় ঈমানের পক্ষ-বিপক্ষ, মূল্যবোধ, ইতিহাস, চেতনা আর আদর্শের সূ² বিষয়গুলো কোনো অনুভ‚তিই জাগাতে পারে না। এ কারণেই ‘বামদুর্বল’ সম্পাদক ও পলিসি নির্মাতাদের হাতে পড়ে ডানপন্থী বিত্তবান রাজনীতিক কিংবা ব্যবসায়ীর গণমাধ্যমও হয়ে উঠে উগ্র সেকুলার ও ‘মুক্তচিন্তা’ তোষণের কড়া হাতিয়ার। বেচারা মালিক সেটা দেখেও যেন বুঝতে পারেন না।
অপর দিকে ‘বামদুর্বল’ নীতিনির্ধারক সংবাদকর্মীরা বেছে নেন অন্য সুবিধা। প্রথমত ইসলামবিরোধী, বস্তুতান্ত্রিক ও পশ্চিমানুরক্ত একটি গণমাধ্যমের বিস্তারে তারা মিশন সাফল্যের আনন্দ লাভ করেন। দ্বিতীয়ত অনৈতিক এ পক্ষপাতের মধ্য দিয়েই তারা নিজেরা গ্রহণ করেন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত। আর্থিক ও পরিবেশগত বিভিন্ন সুখের আয়োজনে তারা যুক্ত হতে পারেন সহজেই। পেশা ও সমাজের নিরাপত্তা পেয়ে উপকৃত হন। কেউ কেউ ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ব্যবসাও এভাবে স্ফীত করার প্রয়াস পান। বিনিময়ে তারা অকাতরে চিন্তা, আদর্শ, শিক্ষা ও জীবনযাত্রার ক্ষেত্রগুলোতে বিদেশী এজেণ্ডা ও ভাবধারার ব্যাপক, সূ² ও ধারাবাহিক আবেদনমূলক প্রচার দিতে থাকেন। কোনো কোনো দেশের ব্যবসা ও নিরাপত্তা স্বার্থের অনুক‚লেও দূর থেকে জনমত তৈরির কাজ করার অভিযোগ পাওয়া যায় তাদের বিরুদ্ধে। পশ্চিমা ও আঞ্চলিক দেশগুলোর কাছে সমাদৃত কিছু নাগরিককে সুশীল ও মেধাবী অভিজাত নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার একটি পর্যায়ক্রমিক অভিযান রচনায় ব্যস্ত হয়ে উঠেন তারা। পশ্চিমা-পছন্দ এনজিও ও ইস্যুর সঙ্গেও সহযাত্রী হয়ে সুর উঁচু করেন। আর এসব কিছুই করা সহজ হয়ে উঠে সংঘবদ্ধতা ও বামদুর্বল এবং ইসলাম নিস্পৃহ মানসিকতার ঐক্যের কারণে। এ ক্ষেত্রে যে দুয়েকটি গণমাধ্যম ও তার কর্মী-কর্ণধাররা ভিন্নধারায় টিকে থাকতে চান তারা সম্মিলিত উল্টো চিন্তার স্রোতের সামনে টিকতে পারেন না। গণমাধ্যমের এসব মতান্ধ কারিগররা বর্তমানে অবশ্য বাম আদর্শের মৌলিক কোনো কিছু অনুসরণ করেন না। বরং বিত্ত ও ভোগের সঙ্গে একাত্ম হয়ে এরা কেবল ইসলাম-অনুরক্ততার বিরুদ্ধে মেধা ও শ্রমের বড় অংশ ব্যয় করে তুষ্টি লাভ করেন। পুঁজি, সাম্রাজ্যবাদ ও ইসলামবৈরি বহুমুখি সাম্প্রদায়িকতার নিষ্ঠাবান কর্মী হতে পেরে আত্মপ্রসাদ অনুভব করেন।
গণমাধ্যমের বর্তমান ইসলাম-নিরাসক্ত ও কথিত মুক্তচিন্তাবান্ধব চেহারার পেছনের পটভ‚মি মূলত এগুলোই। ব্যবসার প্রভাব পেয়ে খুশি মালিক বেচারাকে অন্ধকারে রেখেই গণমাধ্যমের ধূর্ত চক্র এসব করে যায়। অভিযোগ উঠেছে, এভাবেই তারা কোটি কোটি দর্শক-পাঠকের সামনে অসরল ও অস্বচ্ছ একটি এজেণ্ডা চাতুর্যের সঙ্গে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষের ধর্মবিশ্বাস ও ঐতিহ্য চেতনা- যারা তাদের দর্শক-পাঠক-যেমন তারা আমলে নিচ্ছেন না তেমনি ধর্ম এবং আদর্শের জায়গাটাতে বিনিয়োগকারীর চিন্তা ও বোধেরও প্রতিনিধিত্ব করছেন না। বলা হয়ে থাকে, একশ্রেণীর সরল ও মেধাহীন পুঁজির জোরেই এই বামদুর্বল ও ইসলাম-নিস্পৃহ গণমাধ্যমের এজেণ্ডা বাস্তবায়িত হতে পারছে। অবশ্য সাম্প্রতিক বাস্তবতায় আরেকটু ভিন্নতাও সামনে আসছে। সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে, চিন্তায় ও দৃষ্টিভঙ্গিতে ইসলাম-নিষ্পৃহ, পশ্চিমানুরক্ত একশ্রেণির মালিকও গণমাধ্যমে পুঁজি বিনিয়োগ করছেন। এদের কেউ কেউ বহুজাতিক ব্যবসার স্থানীয় প্রতিনিধি। কেউ আবার বিত্তের সঙ্গে সেকুলার রাজনীতির নব্য ক্রিমসন্ধানী। সেক্ষেত্রে মালিক-কর্মীর মতে মতে পূর্ণ মিলনও ঘটেছে থাকে।
। পাঁচ।
গণমাধ্যম এখন আর হাতে গোনা কিছু মানুষের মনোযোগ-আকর্ষক অঙ্গন নয়। গণমাধ্যম বর্তমানে সার্বক্ষণিক বাস্তবতা। প্রতিদিন তথ্য ও চেতনা বিতরণ করছে। সংবাদপত্রে ও টিভি চ্যানেলে। নতুন নতুন ইস্যু আনছে। পুরনো অনেক কিছুকে ভুলিয়ে দিচ্ছে। সংস্কৃতির নতুন উপলক্ষ তৈরি করছে। ইতিহাস ও চেতনার নতুন শিরোনাম এঁকে দিচ্ছে। গতিপথ বদল করছে সভ্যতার। গণমাধ্যম কেবল এখন শিক্ষিতজনের পঠনীয় নয়। এখন সার্বজনীন পাঠের, দেখার, গেলার বিষয়। কোটি কোটি অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষও টেলিভিশনের পর্দায় আর মোবাইলের এফএমে এখন খবর ও আলোচনা দেখেশুনে সময় কাটায়। ওইসব খবর ও আলোচনার ফলাফল সরাসরি গ্রহণ করে। নিজের মত অজান্তেই অন্যের সরবরাহ করা মতের মধ্যে ঢুকে যায়। পক্ষের জন বিপক্ষে চলে যায়। নিজের ধর্ম ও বিশ্বাসকে অপ্রয়োজনীয় করে তুলে ধরা হয়। অন্যের ধর্ম ও অপরের কৃষ্টিকে আপন বানিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। নতুন করে জনগণ পর্যায়ে শেখানো হয় অনেক তত্ত¡। যখন তখন উত্তেজনা, ক্ষোভ, পক্ষ-বিপক্ষ দাঁড় করানো হয়। মুহূর্তের মধ্যেই ক্লেশের বারুদ আর ঘৃণার আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। গত দুই দশক ধরে গণমাধ্যম অনেক বেশি নির্মাণ ও ধ্বংসের ক্ষমতা নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
এজন্যই গণমাধ্যমকে এখন উপেক্ষাযোগ্য কোনো বিষয় মনে করা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় সাধারণ স্তরের আমলযোগ্য কোনো বিষয় হিসেবেও গ্রহণ করা। এর প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া অনেক দূর চলে গেছে। গণমাধ্যম হয়তো কড়া এন্টিবায়োটিক ও ভিটামিন হবে, নয়তো হবে অনেক শক্তিশালী ভাইরাস ও ইনফেকশন। গণমাধ্যমের এ দুই ভ‚মিকার বাইরে নয় সমাজ। তাই গণমাধ্যমের ভেতর-বাইরের কর্মকাণ্ড নিয়ে সচেতন হতে হবে দ্বীনদার শিক্ষিত মানুষকে। গণমাধ্যমে পুঁজির বিনিয়োগ ও গণমাধ্যমের কর্মী নিয়োগ এবং নীতি বিন্যাসের প্রতিটি বিষয় নিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষকেও ভাবতে হবে। ছাপা হওয়া ও সম্প্রচার হওয়া বিষয় মানেই অকাট্য সত্য কিংবা অবধারিত- এ চিন্তা বাদ দিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টি নিয়ে বিপরীত দিক থেকেও ভাবতে শেখাতে হবে জনসাধারণকে। ভাবতে হবে গণমাধ্যমের পুঁজি ও তার কর্মীদের সচেতনতা ও হেদায়েতের উপায় নিয়েও। পাত্র অনুযায়ী দাওয়াতের পদ্ধতি নিয়েও। গণমাধ্যম এখন নিছক সংবাদ-মাধ্যমের স্তরে আবদ্ধ নয়। বরং কার্যকারিতার দিক থেকে গণমাধ্যম বর্তমানে গণবিচ্যুতি কিংবা গণশিক্ষার বড় মাধ্যম। গণমাধ্যম এখন কেবল তথ্য জানার উপলক্ষ নয়। বরং গণমাধ্যম বর্তমানে জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা ধ্বংস বা গড়ারও বড় মাধ্যম। গণমাধ্যম কেবল খবর ও আলোচনার প্রাঙ্গন নয়। চরিত্র ও শালীনতা রক্ষা কিংবা ধ্বংসেরও বড় কেন্দ্র। সংস্কৃতি ও চেতনা বদলের জন্য এর চেয়ে সহজ ও স্বল্পমেয়াদী প্রক্রিয়ায় সাফল্যলাভ আর কোনো মাধ্যমের পক্ষে হয়তো সম্ভব নয়। এজন্যই গণমাধ্যমের পুঁজি-কর্মী ও নীতির বিষয়গুলোর প্রতি আলেম-দাঈ ও শিক্ষিত দ্বীনদার শ্রেণির সবারই সমান মনোযোগ দরকার।
গণমাধ্যম বিষয়ে সব অভিযোগ ও আশংকা থেকে পরিত্রাণের উপায় হতে পারে দাওয়াতী উপায়ে গণমাধ্যমের সাহায্য গ্রহণ। সঠিক কর্মীদের হাতে উপযোগী নতুন ও বিকল্প গণমাধ্যম নির্মাণ। গণমাধ্যমের উপর-নিচ ও মাঝের লোকদের মাঝে পরিকল্পিত দাওয়াত। গণমাধ্যমের অন্দর-বাহির নিয়ে সাধারণ দ্বীনদার মানুষের মাঝে উপযোগী আলোচনা। সতর্কীকরণ ও সতর্কতাগ্রহণ। গণমাধ্যমের ভাইরাসকে ভিটামিনে রূপান্তরের শ্রম ও সাধনাসাপেক্ষ মেহনত। চাহিদা ও ক্ষেত্র অনুযায়ী আল্লাহর নাম নিয়ে কাজ করার চেষ্টা। এটাই বান্দার কাজ। কাজের তাওফীক দান, কবুল করা এবং কাজকে পূর্ণতা দান করা আল্লাহ তাআলার কাজ। আল্লাহ তাআলা কবুল করুন।