রবিউল আউয়াল-রবিউল আখির ১৪৩৭   ||   জানুয়ারি ২০১৬

ইমাম গাযালীর কিতাব থেকে : প্রসঙ্গ : ক্ষমতাধরদের প্রতি আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি আনিল মুনকার

মাওলানা মুহাম্মাদ ইসমাঈল

ন্যায়ের লালন অন্যায়ের বিলালন। শিষ্টের লালন দুষ্টের দমন, সত্য, ন্যায় ও ভালোর আদেশ-উপদেশ, মিথ্যা-অন্যায় ও মন্দের নিষেধ-হিতাকাক্সক্ষা, সংগত ও সঠিকের পক্ষাবলম্বন এবং অসংগত ও বাতিলের প্রতিরোধ- এ সবই একটি মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বিভিন্ন শব্দে বহিঃপ্রকাশ। কুরআনী ভাষার আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকারএসব বিষয়েরই প্রাঞ্জল ভাষ্য, যা ইসলামী দ্বীন ও শরীআতের মূল অবকাঠামোর শীর্ষ পর্যায়ের স্তম্ভ। মূলত যুগে যুগে প্রেরিত নবী-রাসূলগণ (আলাইহিমুস সালাম) ও তাঁদের একান্ত অনুসারী হাওয়ারী-সাহাবীগণ এবং সর্বশেষ নবীর উত্তরসূরী ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া-আলিম সমাজের প্রধান কাজ। যার উপর নির্ভর করে সুশৃংখল আল্লাহভীরু মানব সমাজ বিনির্মাণের মাধ্যমে মানব সৃষ্টির মূল লক্ষ্য আল্লাহ তাআলার পসন্দনীয় ও অনুমোদিত খিলাফত (আলখিলাফাহ্ আলা মিনহাজিন নুবুওয়াহ)-এর সুদৃঢ় প্রতিষ্ঠা ও সুষ্ঠু পরিচালনা। কুরআন মাজীদের বহু আয়াত ও অসংখ্য হাদীসে রয়েছে এর গতি-প্রকৃতি ও রূপরেখার সারগর্ভ উপস্থাপন ও বিশদ আলোচনা।

যুগে যুগে বিজ্ঞ মনীষীগণ এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিয়েছেন এবং আল্লাহ ব্যতীত কাউকে ভয় করো না-

لا يخافون أحدا إلا الله

আল্লাহ ছাড়া কাউকে করি না কুর্নিশগুণে বিভষিত আল্লাহর দুঃসাহসী অকুতোভয় সৈনিকগণ বাস্তবে তা রূপায়িত করে দেখিয়েছেন।

ইসলামের ইতিহাসে ইমাম আবু হামিদ আহমাদ আল গাযালী (মৃত্যু : ৫০৫ হিজরী) যিনি ইমাম গাযালীনামে প্রসিদ্ধ এবং মুসলিম সমাজে সুপরিচিত ও সুবিদিত এক ক্ষণজন্মা মহান মনীষী। যার অবস্থান ছিল ইলম ও আমল বিশেষত ইসলামের দর্শন ও তাসাউফ-আধ্যাত্মিকতার শীর্ষ-চড়ায়। আর তাঁর কালজয়ী অনবদ্য গ্রন্থ ইহইয়া-উ উলূমিদ্দীন রচনাবলি থেকে আজ পর্যন্ত হাজার বছরের ব্যবধানেও প্রথম প্রকাশের সময়ের ন্যায় সমভাবে নতুনত্বের সুস্বাদমণ্ডিত এবং সর্বমহলের সময়োপযোগীরূপে সর্বজন সমাদৃত। আর আলিমদের জন্য তো তা জ্ঞানের বিশাল আধার ও বিস্ময়ের ভাণ্ডার।

বক্ষমাণ নিবন্ধে আমরা এ কিতাবের দ্বিতীয় খণ্ডের (যা মানব সমাজের স্বভাবজাত বিষয়াবলী ও বহুবিধ আচরণবিধির বিবরণ সম্বলিত) নবম অধ্যায় আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকার’-এর চতুর্থ উপঅধ্যায়ের নির্বাচিত অংশের অনুবাদ পেশ করেছি। বিষয়টি সমকালীন পরিবেশ-পরিস্থিতির জন্য অত্যন্ত উপযোগী বিবেচিত হওয়ায় তা পাঠকবৃন্দের খিদমতে পেশ করা হল।

গাযালী রাহ. বলেন, এর পূর্ববর্তী আলোচনায় আমর বিল মারূফ’-এর বিভিন্ন স্তর উল্লেখ করেছি। তাতে বলা হয়েছে যে, এর প্রথম স্তর হচ্ছে, এর পরিচিতি ও পরিধির বর্ণনা। দ্বিতীয় স্তর ওয়াজ-নসীহত ও উপদেশ। তৃতীয় স্তর শক্ত ভাষা প্রয়োগ। চতুর্থ স্তর প্রহার ও শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে ন্যায় ও সত্য গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে শক্তি প্রয়োগে বাধা প্রদান। ক্ষমতাধর শাসকের ক্ষেত্রে এর প্রথম দুটিই প্রযোজ্য। অর্থাৎ ন্যায়-অন্যায়ের পরিচয় ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা এবং সংগত উপদেশ দেয়া। শক্তি প্রয়োগে বাধা দেয়া- এ বিষয়টি ক্ষমতাসীন শাসকের সাথে, সাধারণ মানুষ ও প্রজা সাধারণের করণীয় নয়। কেননা তা বিশৃংখলা সৃষ্টি করে এবং দুষ্কৃতির উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়। এর দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতি লাভের চেয়ে অধিক হয়ে থাকে। তবে শক্ত কথা বলা- যেমন, হে যালিম! (নিপীড়ক, স্বৈরাচারী ইত্যাদি), আল্লাহর আযাবের ব্যাপারে নির্ভীক, দুঃসাহসী এবং এ ধরনের বাক্য দ্বারা যদি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির আশংকা থাকে, যার পরিণতিতে সমালোচনাকারী ব্যতীত অন্যদের উপরও বিপদ নেমে আসবে, তবে তা-ও সঠিক হবে না। আর যদি এমন হয় যে, এর প্রত্যাঘাত শুধু সমালোচনাকারী পর্যন্ত সীমিত থাকবে, অন্যরা এর শিকার হবে না। তখন ঐ বিশেষ ব্যক্তির জন্য তা জায়েয বটে; বরং তার জন্য তা পসন্দনীয় করণীয়। কেননা পূর্বসূরী মনীষীদের স্বভাব আচরণ এমনই ছিল যে, নিজেদের বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সমালোচনা করতেন এবং তাতে জীবনের আশংকারও পরোয়া করতেন না।

এভাবে বিভিন্ন নির্যাতন নিপীড়নের পরোয়া না থাকার কারণ ছিল এই যে তারা এটিকে শাহাদাতের মর্যাদা বলে বিশ্বাস করতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

خير الشهداء حمزة بن عبد المطلب، ثم رجل قام إلى إمام فأمره ونهاه في ذات الله تعالى، فقتله على ذلك .

 শহীদদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হামযা (রা.) এবং তারপরে যে ব্যক্তি কোনো শাসকের সামনে দাঁড়িয়ে আদেশ করে ও নিষেধ করে। এ কারণে তাকে হত্যা করা হয়। -মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৪৮৮৪

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

أفضل الجهاد كلمة حق عند سلطان جائر.

সর্বোত্তম জিহাদ কোনো যালিম শাসকের মুখের উপর সত্য কথা বলে দেওয়া। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১১১৪৩; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৭১৭৪; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৮৫৪৩

দ্বীনের ব্যাপারে অনমনীয় শক্ত অবস্থান গ্রহণকারীগণ যেহেতু জানেন যে যালিম বাদশাহর সামনে সত্য বলাই শ্রেষ্ঠ কথা ও শ্রেষ্ঠ জিহাদ এবং এরূপ ব্যক্তিকে হত্যা করা হলে সে শহীদ (মর্যাদায় ভূষিত) হওয়ার বিষয়টি হাদীসে বর্ণিত আছে। এ কারণেই তারা আল্লাহ তাআলার সত্তার প্রতি অর্থাৎ তাঁর সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত হয়ে বিভিন্ন ধরনের আযাব-নির্যাতনের ঝুঁকি নিয়ে এবং তাতে সবর করে, এমনকি জীবন নাশের আশংকার মুখেও প্রশান্ত অন্তর নিয়ে এ কাজে অগ্রণী ভমিকায় অবতীর্ণ হতেন এবং আল্লাহর নিকট ছওয়াব প্রাপ্তির আশায় তাদের জীবন কুরবান করতে উদ্যত হতেন।

শাসকবর্গ ও রাজা-বাদশাহের উপদেশ দেয়া এবং তাদের ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ে নিষেধের পদ্ধতি সেটিই যা পূর্বসূরী মহান আলিমদের সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। (এ কিতাবের হালাল-হারাম অধ্যায়ের শাসকবর্গের নিকট গমনাগমনপ্রসংগে এ বিষয়ের অনেক কথা আমি বর্ণনা করেছি।) এখানে দৃষ্টান্তরূপে এমন কতক ঘটনা উল্লেখ করছি যার দ্বারা শাসকদের লক্ষ্য করে উপদেশ প্রদান ও তাদের অন্যায়ের সমালোচনার পন্থা-পদ্ধতি সন্বন্ধে অবগত হওয়া যাবে।

ইমাম -শাফেয়ী রাহ.-এর সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার চাচা মুহাম্মাদ ইবনে আলী আমাকে এ বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমি আমীরুল মুমিনীন (খলিফা) আবু জাফর মানসুরের দরবারে উপস্থিত ছিলাম। সেখানে ইবনে আবি যুআইব ছিলেন এবং খলীফার শাসনকর্তা ইবনে যায়েদও সেখানে ছিলেন। সেখানে গিফার গোত্রের লোকেরা এসে খলীফা আবু জাফরের নিকট হাসান ইবনে যায়েদের কোনো কাজের ব্যাপারে অভিযোগ উত্থাপন করলে হাসান বললেন। আমীরুল মুমিনীন! আপনি এদের সম্বন্ধে ইবনে আবি যুআইবকে জিজ্ঞাসা করুন। বর্ণনাকারী বলেন, খলীফা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন-  হে ইবনে আবি যুআইব! তাদের সম্বন্ধে আপনি কী বলেন? তিনি বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তারা মানুষের মান-মর্যাদা চর্ণ করে এবং তাদেরকে  অনেক কষ্ট দেয়। আবু জাফর বললেন, (তোমরা  তোমাদের নিজেদের সম্বন্ধে) শুনলে তো? তখন গিফারীরা বলল, আমীরুল মুমিনীন! আপনি তাকে হাসান ইবনে যায়েদ সম্পর্কেও জিজ্ঞাসা করুন! খলীফা বললেন, হে ইবনে আবু মুসআব! হাসান ইবনে যায়েদ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী? তিনি বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, সে ন্যায়ের পরিপন্থী আদেশ-নির্দেশ দেয় এবং তার প্রবৃত্তির (মনচাহীর) অনুসরণ করে চলে। খলীফা বললেন, ইবনে আবু মুসআব তোমার সম্পর্কে যা বললেন তা তো তুমি শুনলে। তিনি তো একজন পুণ্যবান শায়খ। তখন হাসান বলল, আমীরুল মুমিনীন! আপনি তাকে আপনার নিজের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করুন! খলীফা বললেন, (ইবনে আবু মুসআব!) আমার সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী? তিনি বললেন, আমীরুল মুমিনীন! আমাকে মাফ করবেন। (আমি বলতে পারব না!) খলীফা বললেন, আল্লাহর কসম  (দোহাই) দিয়ে বলছি, আপনাকে বলতেই হবে। ইবনে আবু মুসআব বললেন, আল্লাহর কসম দিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন, যেন আপনি নিজের সম্পর্কে জানেন না! খলীফা বললেন, দোহাই আল্লাহর! আপনাকে বলতেই হবে। তখন আবু মুসআব রাহ. বললেন, আমার সাক্ষ্য আপনি এসব সম্পদ অন্যায় পন্থায় দখল করে তা অযোগ্য পাত্রে অর্পণ করেছেন।আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি, ‘আপনার দুয়ারে জুলুমের সয়লাব।বর্ণনাকারী বলেন, তখন খলীফা আবু জাফর নিজের স্থান থেকে উঠে এসে ইবনে আবু মুসআবের গ্রীবায় তার হাত রাখলেন এবং মুঠ করে ধরে বললেন, ‘আল্লাহর কসম! শুনুন! আমি এখানে (খলীফার মসনদে) আসীন না থাকলে পারসিক, রোমান, দায়লামা ও তুর্কীরা আপনার এ স্থানটিও দখল করে নিত! বর্ণনাকারী বলেন, উত্তরে ইবনে আবু মুসআব বললেন, ‘আমীরুল মুমিনীন! (আপনার কথা সঠিক নয়। কেননা) আবু বকর রা. ও উমর রা.-ও শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা ন্যায়কে ধারণ করেছিলেন এবং সাম্য ও ইনসাফের সাথে (সম্পদ) বণ্টন করেছিলেন। এরপরও পারস্য ও রোমের গ্রীবা চেপে ধরেছিলেন এবং তাদের নাক নিচু (করে অহমিকা চর্ণ) করে দিয়েছিলেন।

বর্ণনাকারী বলেন, খলীফা তখন তার ঘাড় ছেড়ে দিলেন এবং নিরাপদে চলে যেতে দিলেন। খলীফা বললেন, আল্লাহর কসম! যদি আমি এ সত্য না জানতাম যে আপনি সত্যবাদী তবে অবশ্যই আপনাকে হত্যা করতাম। ইবনে আবু মুসআব বললেন, আমীরুল মুমিনীন! আমি অবশ্যই আপনার জন্য আপনার সন্তান মাহদীর চেয়েও অধিক কল্যাণকামী।

বর্ণনাকারী বলেন, পরবর্তী বিষয়ে আমরা এ তথ্য পেয়েছি যে ইবনে আবু মুসআব খলীফা মানসুরের দরবার থেকে ফিরে আসার পর সুফিয়ান সাওরী রাহ. তার সাথে দেখা করতে এসে বললেন, ‘হে আবুল হারছ! এ একনায়ক স্বৈরাচারীকে আপনি যা বলেছেন তা আমাকে আনন্দিত করেছে। তবে আপনি যে তাকে আপনার পুত্র মাহদী...বলেছেন এটি আমার ভাল লাগেনি। তখন ইবনে আবু মুসআব আবু সুফিয়ান রাহ.-কে বললেন, হে আবু আব্দুল্লাহ! আমরা তো সকলেই মাহদী। কেননা আমাদের প্রত্যেকেই একসময় মাহদে’ (অর্থাৎ শৈশবের দোলনায়) ঝুলেছিলাম।

দুই.

আবু ইমরান জুওয়ানী সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, হারুনুর রশীদ খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করলে আলিমগণ তার সাথে সাক্ষাতের জন্য আগমন করলেন এবং খিলাফতের দায়িত্ব তার নিকট অর্পিত হওয়ার জন্য তাঁকে অভিনন্দন জানাতে লাগলেন। খলীফা অর্থ ও সম্পদের ভাণ্ডার খুলে দিলেন এবং সকলকে দামী দামী উপহার দিতে লাগলেন। খিলাফতের মসনদাসীন হওয়ার পূর্বেও তিনি আলিম ও দরবেশদের সঙ্গে উঠাবসা করতেন। এবং ইবাদত-বন্দেগী ও বিলাসিতামুক্ত কৃচ্ছতাপূর্ণ জীবনের প্রতি আগ্রহ প্রদর্শন করতেন। সুফিয়ান ইবনে সাঈদ ইবনুল মুনযির (অর্থাৎ সুফিয়ান) ছাওরীর সাথে ছিল তার দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব ও হৃদ্যতা। খলীফা হওয়ার পর সুফিয়ান রাহ. তার সঙ্গ বর্জন করলেন। এমনকি সাক্ষাৎ করার জন্যও আগমন করলেন না। হারুনুর রশীদ তার সাথে সাক্ষাতের জন্য প্রবল আগ্রহী হওয়ার কথা তাকে জানালেন, যাতে দুজন নির্জনে বসে আলাপচারিতা করার সুযোগ পান। কিন্তু সুফিয়ান রাহ. তার সাক্ষাতেও আসলেন না এবং তার সাথের সম্পর্ক ও তার বর্তমান অবস্থানকে পরোয়া করলেন না। এতে হারুনুর রশীদের মনে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। তখন তিনি সুফিয়ান রাহ.-কে একটি পত্র লিখলেন। যার ভাষ্য ছিল নিম্নরূপ-

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। মহা দয়ালু মহা দয়াবান আল্লাহর নামে। আল্লাহর বান্দা হারুনুর রশীদ আমীরুল মুমিনীনের পক্ষ থেকে তার ভাই সুফিয়ান ইবনে সাঈদ ইবনুল মুনযিরের প্রতি। পরকথা, ভাই! তুমি তো জান, আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলা মুমিনদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন কায়েম করেছেন। এই ভ্রাতৃত্ব তাঁরই জন্য তাঁরই সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। জেনে রাখ, তোমার সাথে আমার ভ্রাতৃত্ব ও  বন্ধুত্ব খুবই দৃঢ়, আমি তা ছিন্নও করিনি এবং তোমার থেকে বিচ্ছিন্নও হইনি। এখনও আমি তোমার প্রতি সর্বোত্তম ভালবাসা ও সদিচ্ছায় অবতীর্ণ। এই দড়িটি (খিলাফার দায়িত্ব) যদি না থাকত, যা আল্লাহ আমাকে জড়িয়ে দিয়েছেন, তাহলে আমি তোমার প্রতি আমার অন্তরে বিদ্যমান ভালবাসার কারণে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তোমার সান্নিধ্যে আসতাম।

আবু আব্দুল্লাহ! শোন, আমার ও তোমার বন্ধুদের মধ্যে এমন কেউই অবশিষ্ট নেই যে আমার এ দায়িত্বপ্রাপ্তির কারণে আমার সাক্ষাতের জন্য আসেনি এবং আমাকে অভিনন্দন জানায়নি। আমি তো ধন-সম্পদের ভাণ্ডারখানা খুলে দিয়েছি এবং তাদের এমন এমন দামী উপহার-উপঢৌকন দিয়েছি, যাতে আমার মন আনন্দিত হয়েছে এবং আমার চোখ শীতল হয়েছে।

তোমার আগমনের প্রতীক্ষায় আমার দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু তুমি আমার কাছে আসনি। এখন আমি তোমাকে পত্র লিখছি, তোমার প্রতি আমার প্রবল আসক্তির কারণে।

আবু আব্দুল্লাহ! তুমি তো একজন মুমিনের মর্যাদা এবং তার সাথে সাক্ষাৎ ও সংযোগ রক্ষার ফযীলতের বিষয়টি জানোই। সুতরাং পত্র প্রাপ্তিমাত্র অবিলম্বে অতি দ্রুত এসে পড়!

চিঠি লেখা সম্পন্ন করার পর খলীফা তার কাছে উপস্থিত লোকদের অবলোকন করলেন। দেখলেন যে, এদের সকলেই সুফিয়ানের মেযাজ সম্পর্কে অবগত। তিনি বললেন, দরজায় যারা আছে তাদের কোনো একজনকে আমার কাছে ডেকে আন। তখন আব্বাদ তালিকানী নামের এক ব্যক্তিকে তাঁর কাছে নিয়ে আসা হল। তিনি বললেন, এই আব্বাদ! আমার এ চিঠি নিয়ে কুফায় চলে যাও। সেখানে পৌঁছার পর তুমি ছাওর গোত্র সম্পর্কে লোকদের জিজ্ঞাসা করবে। পরে তাদের অবস্থান পেয়ে গেলে সুফিয়ান ছাওরীর কথা জিজ্ঞাসা করবে। তাকে পেয়ে গেলে এ চিঠি তাকে অর্পণ করবে এবং তোমার কান ও অন্তর দিয়ে তার সব কথা সংরক্ষণ করবে এবং তার ছোট বড়, সহজ ও নিগূঢ় সব কথা আয়ত্ব করবে, যাতে তুমি সবই আমাকে অবহিত করতে পার।

আব্বাদ চিঠি নিয়ে চলে গেলেন এবং কুফায় পৌঁছে গোত্রটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে লোকেরা তাকে তার সন্ধান দিল। পরে সুফিয়ান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তাকে বলা হল, তিনি মসজিদে আছেন। আব্বাদ বলেন, আমি মসজিদের দিকে চললাম। তিনি (সুফিয়ান) আমাকে দেখে সোজা দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেন,

أعوذ بالله السميع العليم من الشيطان الرجيم

আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি সর্বশ্রোতা মহাবিজ্ঞ আল্লাহর নিকট, বিতাড়িত শয়তান থেকে এবং ইয়া আল্লাহ! আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি আপনার নিকট সে আগন্তুক থেকে যে কল্যাণ ব্যতীত অন্য কিছু নিয়ে আগমন করে। আব্বাদ বলেন, কথাটি আমার অন্তরে বসে গেল এবং আঘাতপ্রাপ্ত হলাম। যখন তিনি আমাকে মসজিদের দরজায় নামতে দেখলেন তখন নামাযে দাঁড়িয়ে গেলেন। অথচ তা কোনো নিয়মিত (নফল) নামাযের সময় ছিল না। আমি মসজিদের দরজার কাছে আমার ঘোড়া বেঁধে মসজিদে প্রবেশ করলাম। দেখলাম তার মজলিসের লোকেরা এমনভাবে মাথা নত করে বসে আছে যেন তারা চোর-ডাকাত আর বাদশাহ (পুলিশ বাহিনী) তাদের সামনে এসে পড়েছে এবং তারা তার শাস্তির ভয়ে ভীত। আমি সালাম করলাম, কিন্তু তাদের কেউই আমার দিকে মাথা তুলল না এবং আঙ্গুলের মাথা দিয়ে আমার সালামের জবাব দিল। আমি দাঁড়িয়েই রইলাম। কিন্তু তাদের কেউই আমাকে বসার জন্য বলল না। তাদের প্রভাবে আমার ভিতর কম্পন ধরে গিয়েছিল। আমি তাদের দিকে আমার চোখ প্রসারিত করে বললাম, নামায আদায়রত ব্যক্তিই সুফিয়ান হবেন। এই বলে আমি চিঠিটি তার দিকে ছুঁড়ে দিলাম। তিনি চিঠি দেখে কেঁপে উঠলেন এবং এমনভাবে সরে দাঁড়ালেন যেন তা (চিঠি) কোনো সাপ, যা তার মিহরাবে ঢুকে পড়েছে। তিনি রুক-সিজদা করে সালাম ফেরালেন। পরে হাতার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে এবং আবা-জুব্বা দিয়ে হাত পেঁচিয়ে নিয়ে চিঠিটি ধরলেন এবং সেটি হাত দিয়ে উল্টে পাল্টে তাঁর পেছনের লোকদের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, তোমাদের কেউ সেটি নিয়ে পাঠ করুক। আমি আল্লাহর নিকট এমন কিছু স্পর্শ করা থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করছি, কোনো অত্যাচারীর হাত যা স্পর্শ করেছে।

আব্বাদ বলেন, তখন তাদের একজন চিঠিটি নিয়ে এমনভাবে খুলতে লাগল যেন সে কোনো সাপকে ভয় পাচ্ছে, যা তাকে কামড়ে দিবে। সে ব্যক্তি সেটি খুলে পড়তে লাগল। সুফিয়ান রাহ. কোনো কিছু দেখে অভিভূত ব্যক্তির মুচকি হাসির ন্যায় মৃদু মৃদু হাসছিলেন। চিঠি পড়া শেষ হলে তিনি বললেন, চিঠিটি উল্টিয়ে তার অপর পিঠে জালিমকে উত্তর লিখে দাও। এ সময় কেউ নিবেদন করল, হে আবু আব্দুল্লাহ! তিনি তো খলীফা (সম্মানিত ব্যক্তি) যদি আপনি কোনো পরিচ্ছন্ন কাগজে তার কাছে লিখতেন! তিনি বললেন, জালিমকে তার চিঠির অপর পিঠেই লিখে দাও। সে যদি তা হালাল পন্থায় উপার্জন করে থাকে তবে অচিরেই তাকে বিনিময় দেওয়া হবে। আর যদি হারাম সূত্রে উপার্জন করে থাকে তবে তা অচিরেই তাকে (আগুনে) পোড়াবে এবং জালিমের হাত লাগা কোনো জিনিস আমাদের কাছে থেকে গিয়ে আমাদের দ্বীন বরবাদ করবে না।

তখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, কী লিখব। তিনি বললেন, লিখ, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। মহান দয়ালু মহা দয়াবান আল্লাহর নামে, পাপী বান্দা সুফিয়ান ইবনে সাঈদ ইবনুল মুনযির ছাওরীর পক্ষ থেকে, বহুবিধ কামনা-বাসনায় ধোঁকাগ্রস্ত বান্দা হারুনুর রশীদের প্রতি। যার ঈমানের হালাওয়াত-মধুরতা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। অতপর আমি তোমাকে লিখছি- তোমাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছি যে, তোমার রশি ছিন্ন করেছি। তোমার বন্ধুত্ব কর্তন করেছি এবং তোমার অবস্থানকে নির্ঘাত অপসন্দ করেছি। তুমি তো তোমার চিঠিতে তোমার নিজের বিরুদ্ধে স্বীকারোক্তি করে আমাকে তোমার বিরুদ্ধে এ বিষয়ে সাক্ষী বানিয়েছ যে, তুমি মুসলমানদের জাতীয় সম্পদ-ভাণ্ডার বায়তুল মালজবর দখল করে তা অন্যায় পাত্রে ব্যায় করেছ এবং তা বিধানসম্মত ক্ষেত্র ব্যতীত অন্যত্র তসরূফ করেছ। এরপরও আমি তোমার থেকে দূরে অবস্থান করা অবস্থায়ও তোমার অপকর্মে তুমি তুষ্ট হতে পারনি এবং তোমার নিজের বিরুদ্ধে আমাকে স্বাক্ষী বানাবার জন্য আমার কাছে পত্র লিখেছ। শোন, আমি ও আমার বন্ধুগণ যারা তোমার চিঠি পাঠ করার সময় উপস্থিত ছিল, তোমার বিরুদ্ধে স্বাক্ষী রইলাম। জেনে রাখ, আগামী দিনে আল্লাহ তাআলার সামনে তোমার বিরুদ্ধে স্বাক্ষ্য দিব। ওহে হারুন! মুসলমানদের বায়তুল মাল তুমি তাদের সন্তুষ্টি ব্যতীত জবর দখল করেছ। তোমার এ কাজের প্রতি কি জাতীয় সম্পদের অংশীদার-হকদার- মনস্তুষ্টির জন্য প্রদেয় (আলমুআল্লাফাতু কুলুবুহুম) শ্রেণী, আল্লাহর যমিনে জাতীয় সম্পদ (এবং যাকাত ইত্যাদি) আহরণে নিয়োজিত কর্মজীবী শ্রেণী, আল্লাহর পথে জীবনবাজী রাখা মুজাহিদবর্গ ও অসহায়-নিঃস্ব পথচারীরা সন্তুষ্ট রয়েছে? অথবা, কুরআনের বাহক-জামাত ও আলিম সমাজ, বিধবা ও ইয়াতীমরা এতে সন্তুষ্ট রয়েছে? অথবা তোমার দায়িত্বে-কর্তৃত্বাধীন সাধারণ জনগণ এতে সন্তুষ্ট রয়েছে? সুতরাং হে হারুন! শক্ত করে তোমার কোমর বেঁধে নাও, (কিয়ামতের) সাওয়ালের জওয়াব ঠিক করে নাও এবং আসন্ন বিপদের জন্য আড়াল গুছিয়ে নাও। জেনে রাখ, তুমি অবিলম্বে ন্যায়পরায়ণ বিচারকদের আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াবে। তুমি তো নিজেকে সাংঘাতিক বিপদে নিপতিত করেছ; কারণ তোমার থেকে ইলম ও দুনিয়াবিমুখতা, দরবেশী, কুরআনের স্বাদাস্বাদন ও নেককারদের সংশ্রব-সান্নিধ্য ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে এবং তুমি নিজের জন্য জালিম হওয়া ও জালিমদের নেতা হওয়া পসন্দ করেছ।

হে হারুন! তুমি আসীন হয়েছ রাজকীয় সিংহাসনে। রেশমী পোশাক রয়েছে তোমার পরিধানে। দামী পর্দা ঝুলছে তোমার দুয়ারে। দারোয়ান-প্রহরী দিয়ে তুমি বিশ্বপালকের সাদৃশ্য রচনা করেছ এরপরেও তোমার অত্যাচারী নিষ্ঠুর বাহিনীকে বসিয়েছ তোমার দরজা ও পর্দার বাইরে। তারা মানুষের উপর জুলুম করে, ইনসাফ করে না; নিজেরা মদখোর, অন্য মদ্যপায়ীদের শাসন করে; নিজেরা ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়েও অন্য ব্যাভিচারীদের উপর হদ-দণ্ড প্রয়োগ করে। নিজেরা নির্দ্বিধায় চুরি করে, আর অন্য চোরদের হাত কাটে। অন্য মানুষের জন্য এসব বিধান প্রয়োগ করার পূর্বেই এগুলো তোমার ও তোমার সহযোগীদের উপর প্রযোজ্য ছিল না কি? অতএব হে হারুন! কী অবস্থা হবে তোমার, আগামীকাল যখন আল্লাহ তাআলার নিয়োজিত ঘোষক ঘোষণা দিবে-

احْشُرُوا الَّذِينَ ظَلَمُوا وَأَزْوَاجَهُمْ.

জালিমদের ও তাদের সহযোগীদের একত্রিত কর... -সুরা সাফফাত (৩৭) : ২১

অর্থাৎ যুলুম ও যুলুমবাজদের সাহায্যকারীদের...। তুমি আল্লাহ তাআলার সামনে এভাবে উপস্থিত হবে যে, তোমার দুই হাত তোমার ঘাড়ের সাথে বেড়িবদ্ধ থাকবে এবং তোমার ইনসাফ ও ন্যায় বিচার ব্যতীত কিছুই তোমাকে মুক্ত করতে পারবে না। অন্য পাতি জালিমরাও তোমার আশপাশে থাকবে আর তুমি হবে জাহান্নামের পথে তাদের অগ্রবর্তী ও নেতা।

হারুন! আমি যেন তোমাকে এ অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি যে, (কিয়ামতের ময়দানে) তুমি জীবন সংকটে সংকটাপন্ন, তুমি ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ধ্বংস গহ্বরের দিকে চলছ, আর তুমি দেখতে পাচ্ছ যে, তোমার নেকগুলো অন্যের দাঁড়িপাল্লায় (মীযানে) আর তোমার নিজের পাপসহ অন্যদের পাপগুলো তোমার পাল্লায়। বিপদের উপর মহাবিপদ! আঁধারের উপর মহা আঁধার!! সুতরাং তুমি আমার এ বিশেষ উপদেশকে ওসিয়্যাতের ন্যায়, মহামূল্যবান সম্পদের ন্যায় সংরক্ষণ কর এবং আমার নসীহত ও কল্যাণকামনা, যা আমি তোমাকে করলাম তা দিয়ে উপদেশ-শিক্ষা গ্রহণ কর।

জেনে রাখ, আমি তোমার চড়ান্ত ও একান্ত কল্যাণকামনা করলাম, যাতে বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট রাখিনি। সুতরাং হে হারুন! তোমার অধীনস্ত জনতার ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের উম্মতের ব্যাপারে তাঁর মান-মর্যাদা সংরক্ষণ কর ও তাদের উপর উত্তম পন্থায় খিলাফত পরিচালনা কর। জেনে রাখ, এ বিষয়টি তুমি ব্যতীত অন্য কারো জন্য অপেক্ষমান থাকলে তা অবশ্যই তোমার কাছে পৌঁছত না এবং  তা তুমি ব্যতীত অন্যের নিকট চলে যাবে। অনুরূপ, পৃথিবীও তার বাসিন্দাদের একের পর এক স্থানান্তরিত ও স্থলাভিষিক্ত করছে। তাদের কেউ তো এমন পাথেয় সংগ্রহ করেছে যা তার উপকারে আসবে এবং কেউ কেউ তার ইহকাল-পরকালকে ধ্বংস করেছে। আর হে হারুন! আমি মনে করছি, যেন তুমি তাদেরই অন্তর্ভুক্ত, যারা তাদের দুনিয়া ও আখিরাতকে বরবাদ করেছে। সুতরাং সাবধান! পুনঃসাবধান! এরপর যেন তুমি আমাকে কোনো পত্র লেখ না, তাহলে আমি তোমাকে তার উত্তর লিখব না। ওয়াস সালাম!

আব্বাদ বলেন, এরপর চিঠিটি ভাঁজ না করে এবং উন্মুক্ত ও সীলবিহীন পত্রটি আমাকে দেয়া হল। আমি সেটি নিয়ে কফার বাজারের দিকে গেলাম। সুফিয়ানের উপদেশ আমার অন্তরে দাগ কেটে ফেলেছিল। আমি সজোরে আওয়াজ দিলাম, হে কুফাবাসী! তারা আমার ডাকে সাড়া দিলে আমি বললাম, হে জনতা! এমন ব্যক্তিকে কে কিনবে, যে আল্লাহ থেকে আল্লাহর দিকে পলায়ন করছে। তখন তারা দীনার ও দিরহাম-স্বর্ণমুদ্রা ও রৌপ্যমুদ্রা নিয়ে এগিয়ে আসল। আমি বললাম, আমার তো মাল-সম্পদের প্রয়োজন নেই। আমার প্রয়োজন একটা পশমী মোটা জুব্বা এবং একটা কুতওয়ানী (সুতী) আবা।

আব্বাদ বলেন, আমাকে ঐসব দেয়া হলে আমি আমার সে পোশাক খুলে ফেললাম যা আমীরুল মুমিনীনের সান্নিধ্যে অবস্থানকালে আমার গায়ে ছিল। আমি ঘোড়াটিকে টেনে নিয়ে চললাম (আরোহণ করলাম না) এবং আমার বহন করা অস্ত্র ঐ ঘোড়ার পিঠে ছিল। এভাবে আমি পায়ে হেঁটে খালি পায়ে আমীরুল মুমিনীনের দরজায় পৌঁছলাম। তখন খলীফার দরজায় উপস্থিত লোকেরা আমাকে ঠাট্টা-উপহাস করল। এরপর আমাকে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হল। আমি খলীফার দরবারে প্রবেশ করলে আমাকে ঐ অবস্থায় দেখতে পেয়ে তিনি অস্থির হয়ে উঠা-বসা করতে লাগলেন এবং সোজা দাঁড়িয়ে নিজের মাথা ও চেহারায় চড় দিয়ে দিয়ে বিলাপ করতে লাগলেন। হায় দুর্ভোগ, হায় আফসোস! দূত তো লাভবান হয়ে গেল আর দূতের প্রেরক ব্যর্থ হল। এ দুনিয়া দিয়ে আমার কী হবে! যে রাজত্ব দ্রুতই আমার হাতছাড়া হয়ে যাবে তা দিয়ে আমার কী হবে! অতপর চিঠিটি আমাকে যেভাবে খোলা অবস্থায় দেয়া হয়েছিল সেভাবেই আমি তাঁর সামনে রেখে দিলাম।

হারুনুর রশীদ চিঠি পড়তে লাগলেন এবং তাঁর দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। তিনি চিঠি পড়ছিলেন এবং চিৎকার করে আর্তনাদ করছিলেন। তখন দরবারীদের কেউ তাঁকে বলল, আমীরুল মুমিনীন! সুফিয়ান আপনার ব্যাপারে দুঃসাহস দেখিয়েছে সুতরাং আপনি যদি বাহিনী পাঠিয়ে তাকে ভারী লোহা (হাতকড়া) পরিয়ে দিতেন এবং জেলের সংকীর্ণ কুঠুরিতে তাকে আবদ্ধ করতেন এবং জেল-জীবন তার জন্য দুঃসহ করে দিতেন তবে আপনি তার এ অবস্থাকে অন্যদের জন্যও শিক্ষণীয় বানাতে পারতেন। হারুন বললেন, হে দুনিয়ার গোলামরা! আমাকে নিজ হালে থাকতে দাও! আত্মপ্রতারিত সে ব্যক্তি, যাকে তোমরা প্রতারিত করেছ, দুর্ভাগা সে, যাকে তোমরা ধ্বংস করেছ। সুফিয়ান একাই এক জনগোষ্ঠী! সুতরাং তাঁকে তাঁর মর্যাদার অবস্থানে নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে দাও।

এরপর থেকে সুফিয়ানের এ পত্র হারুনুর রশীদের পাশেই থাকত এবং মৃত্যু পর্যন্ত প্রতি নামাযের সময় তিনি এটি পাঠ করতেন। আল্লাহ তাকে রহম করুন এবং আল্লাহ রহম করুন সে বান্দাহকে, যে নিজের সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তামগ্ন হয় এবং আগামী দিন -কিয়ামতে- তার সামনে আমল আগত হবে সে বিষয়ে আল্লহকে ভয় করে চলে। কেননা তা দিয়েই তার হিসাব-নিকাশ করা হবে এবং তার ভিত্তিতেই তাকে প্রতিদান দেয়া হবে। আল্লাহই তৌফিকের মালিক।

তিন.

আহমাদ ইবনে ইবরাহীম আল মুকরী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবুল হুসাইন নুরী ছিলেন অহেতুকবর্জনকারী মানুষ। যাতে তার কোনো স্বার্থ-উদ্দেশ্য নেই, সে সম্পর্কে কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করতেন না এবং যাতে তার কোনো প্রয়োজন নেই, তা নিয়ে সন্ধান-অনুসন্ধান করতেন না। কোনো গর্হিত অন্যায় দেখলে তা প্রতিরোধে সচেষ্ট হতেন। এমনকি তাতে তার পরম ক্ষতির আশংকা থাকলেও। একদিন তিনি নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে পবিত্রতা অর্জনের জন্য কয়লাওয়ালার ঘাটনামে পরিচিত একটি পানির ঘাটে নামলেন। সেখানে তিনি একটি নৌকা দেখতে পেলেন। যাতে ত্রিশটি মটকা ছিল। যেগুলোর গায়ে আলকাতরা দিয়ে লুতফ  (কোমল, কমনীয়) শব্দ লেখাছিল। তিনি শব্দটি পড়লেন, কিন্তু এটি তাঁর কাছে অপরিচিত ও প্রশ্নবোধক মনে হল। কেননা ব্যবসা-বাণিজ্য ও বেচা-কেনার জগতে লুতফনামের কোনো কিছু আছে বলে তাঁর জানা ছিল না। তিনি নৌকার মাঝিকে বললেন, এসব মটকায় কী আছে? মাঝি বলল, এতে তোমার কি? আপনা কামে যাও! (নিজের চরকায় তেল দাও)

মাঝির ঐ কথা শুনে নূরীর অনুসন্ধিৎসা ও বিষয়টি জানার তৃষ্ণা আরও বেড়ে গেল। তিনি বললেন, (দাদা) আমার মন চায় যে, তুমি একটু বল, এ মটকাগুলোতে কী আছে? মাঝি বলল, এ নিয়ে তোমার মাথা ব্যাথা কেন? তুমি তো একজন পরের কাজে নাক গলানো অহেতুক কর্মের সুফী-দরবেশ! এতে (খলীফা) মুতাযিদ-এর জন্য আমদানী করা মদ, যা দিয়ে সে তার আসর বসাবে। নূরী বললেন, তাহলে এগুলো মদ? মাঝি বলল, হাঁ। নূরী বললেন, আমার মন চায়, ঐ ডাণ্ডার ঝাড়টা আমাকে দাও! এতে মাঝি তাঁর উপর ক্ষিপ্ত হয়ে তার গোলামকে বলল, দে তো ডাণ্ডাটা, দেখি সে কী করে।  ঝাড়ডাণ্ডা হাতে পেয়ে নূরী নৌকায় উঠলেন, এক একটি করে মটকা ভাঙতে লাগলেন। এভাবে শুধু একটি বাদে সব মটকার দফা রফা করলেন। ওদিকে মাঝি সর্বনাশ সর্বনাশ বলে আর্তনাদ করে যাচ্ছিলেন। এসময় রক্ষী প্রধান ইবনে বিশর আব্দুল্লাহ নৌকায় উঠে নূরীকে ধরে ফেলল। তাঁকে মুতাযিদরে দরবারে উপস্থাপন করল। মুতাযিদের তলওয়ার চলত কথার আগে। সুতরাং কোনো মানুষেরই সংশয় ছিল না যে, মুতাযিদ এখনই নূরীকে হত্যা করবে।

আবুল হুসাইন নূরী বলেন, আমাকে খলীফার সামনে নিয়ে যাওয়া হল। সে তখন একটি লোহার চেয়ারে বসা ছিল এবং তার হাতে ছিল একটি লৌহদণ্ড, যা নাড়াচাড়া করছিল। সে আমাকে দেখে বলল, কে তুমি? আমি বললাম, ‘মুহতাসিব’ (অপরাধ নিরোধ কর্মকর্তা, ইন্সপেক্টর) খলীফা বললেন, তোমাকে এ (অপরাধ নিরোধক) পদে নিয়োগ দিল কে? আমি বললাম, হে আমরিুল মুমিনীন! যিনি আপনাকে আমীর (আমীরুল মুমিনীন-শাসক) নিয়োগ করেছেন তিনিই আমাকে মুহতাসিবপদে নিয়োগ দিয়েছেন। বর্ণনাদাতা (নূরী) বলেন, তখন খলীফা কিছু সময় মাটির দিকে মাথা নত করে রাখলেন, পরে আমার দিকে মাথা তুলে বললেন, তুমি যা করেছ তাতে কী তোমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে? আমি বললাম, আপনার প্রতি আমার মমতা! আপনার জন্য ক্ষতিকর বিষয় প্রতিহত করার জন্য যখন আমার হাত প্রসারিত করলাম তখন হাত তা সম্পাদনে অপারগতা দেখালো। তখন খলীফা মাথা নত করে আমার বক্তব্য নিয়ে চিন্তা করতে লাগল এবং পরে আমার দিকে মাথা তুলে বলল, তবে এসব মটকার মধ্য হতে এই মটকা রেহাই পেল কী রূপে? আমি বললাম, এটি রেহাই পাওয়ার কারণ ভিন্ন। আমীরুল মুমিনীন অনুমতি দিলে আমি তা অবহিত করব। সে বলল, ঠিক আছে বল আমাকে। আমি বললাম, আমীরুল মুমিনীন! প্রথম পর্যায়ে আমি মটকা ভাঙতে শুরু করেছিলাম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার পক্ষ থেকে আমার প্রতি এ কাজের নির্দেশ আসার কারণে। তখন আমার অন্তর পরিপূর্ণ ছিল- এক. আল্লাহ তাআলার মহান সত্তার মাহাত্ম্য দর্শনে এবং দুই. নির্দেশ প্রতিপালনের ভয়ে। এ কারণে মাখলুক ও সৃষ্টির প্রভাব-প্রতিপত্তি আমার অন্তর থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। মনের এ অবস্থা নিয়ে আমি ওগুলোর সাথে আচরণ করে যাচ্ছিলাম। এ মটকাটির নিকট পৌঁছলে আমার মনের মধ্যে এ অহং অনুভত হতে লাগল যে, আমি আপনার মত ব্যক্তির প্রতিপক্ষে দুঃসাহস দেখাতে পেরেছি। এ কারণে তখন আমি বিরত হই। আমি যদি আমার প্রথম অবস্থা নিয়ে ঐ মটকার সামনে যেতাম এবং দুনিয়া ভর্তি মটকাও আমার সামনে থাকত তবে অবশ্যই আমি সবই ভেঙ্গে ফেলতাম এবং তাতে কিছুরই পরোয়া করতাম না।

মুতাযিদ বললেন, যাও তোমাকে মুক্ত করে দিলাম। যে গর্হিত ও অন্যায়কে প্রতিরোধ করা তোমার পসন্দ হবে তা তুমি প্রতিরোধ করবে। আবুল হুসাইন বলেন, আমি বললাম, আমীরুল মুমিনীন, প্রতিরোধ করা এখন আমার কাছে অপসন্দনীয় হয়ে গিয়েছে। কেননা, এতদিন আমি প্রতিরোধ করতাম আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে (আল্লাহর সৈনিকরূপে) আর এখন আমি প্রতিরোধ করব পুলিশের রক্ষীরূপে।

মুতাযিদ বললেন, তোমার কিছু প্রয়োজন আছে? আমি বললাম, আমীরুল মুমিনীন! আমাকে নিরাপদে বের করে দেয়ার আদেশ দিন। তখন তার ব্যাপারে এরূপ আদেশ দেয়া হলে তিনি (নূরী বাগদাদ ছেড়ে) বসরায় চলে গেলেন এবং এ ভয়ের কারণে দীর্ঘকাল সেখানে অবস্থান করলেন যে, কেউ হয়তো কোনো প্রয়োজনের ব্যাপারে মুতাযিদের নিকট সুপারিশ করার জন্য তার নিকট আবেদন করবে। এজন্য মুতাযিদের মৃত্যু পর্যন্ত তিনি বসরাতেই বসবাস করলেন এবং পরে বাগদাদে ফিরে এলেন।

চার.

সঙ্গত-ন্যায়ের আদেশ প্রদান এবং অন্যায় ও গর্হিতের প্রতি নিষেধ এ-ই পূর্বসূরী আলিম মনীষীবর্গের স্বভাব ও জীবন চরিত। ক্ষমতাধরদের প্রতিরোধকে তাদের পরোয়া না করার সূত্র ছিল আল্লাহ তাআলার ফযল ও অনুগ্রহের প্রতি তাঁদের এরূপ একনিষ্ঠ ভরসা যে, তিনি তাদের  হেফাযত করবেন। এবং তারা আল্লাহ তাআলার এ ফয়সালাতেও রাযী ছিলেন যে, তিনি তাঁদের শহীদ হওয়ার মর্যাদা নসীব করবেন। তাঁদের নিয়ত যেহেতু আল্লাহ তাআলার জন্য খালেস ও ঐকান্তিক ছিল এজন্যই তাদের কথাবার্তা পাষাণ অন্তরেও প্রভাব বিস্তার করত এবং কাঠিন্য বিদূরীত করে সেগুলোকে কোমল করে দিত। কিন্তু এখন লোভ-লালসা আলিমদের বন্দী করে ফেলেছে। তাই তারা নীরব দর্শকের ভমিকা পালন করছে। আর কথা বললেও যেহেতু তাদের অবস্থা তাদের কথাকে সমর্থন করছে না, তাই তারা সফলতার মুখ দেখছেন না। তাঁরা সত্যনিষ্ঠ হলে ও ইলমের হক আদায়ের নিয়ত করলে অবশ্যই সফলকাম হবেন। কেননা, জনসাধারণ নষ্ট হয় শাসকদের নষ্ট হওয়ার কারণে, আর শাসকরা নষ্ট হয় আলিমদের নষ্ট হওয়ার কারণে। আলিমদের নষ্ট হওয়ার কারণ সম্পদের মোহ ও মর্যাদার মোহ (হুব্বে মাল ও হুব্বে জাহ) দ্বারা তাদের বশীভত হওয়া। দুনিয়ার মোহ ও প্রেম যাকে বশীভত করে সে তো নিম্নশ্রেণীর মানুষের উপরই তদারকী-খবরদারী করতে সক্ষম হয় না; সুতরাং উঁচু শ্রেণী, অভিজাত ও শাসকবর্গের তদারকী-খবরদারী করবে কী রূপে।

সর্বাবস্থায়ই আল্লাহ তাআলার নিকট সাহায্য প্রার্থনা।  

লেখক : সাবেক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বেফাক- কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড

 

 

advertisement