মাওলানা নোমান ছাহেব রাহ., হাজী নাজিমুদ্দীন রাহ. দেশের এবং দেশের বাইরের আরো কয়েকজন আকাবির এবং তাদের সান্নিধ্যধন্য ব্যক্তিবর্গ
গত কয়েক মাসের মধ্যেই আমরা দেশের এবং দেশের বাইরের অনেক বড় বড় কজন ব্যক্তিকে হারালাম।
শায়েখ সিদ্দীক আদ দরীর
গত রমযানে ১৪৩৬ হি. (মোতাবেক জুলাই ২০১৫ ঈ.) সুদানের মুহাক্কিক আলিম শায়খ সিদ্দীক মুহাম্মদ আমীন আদ দরীর ইন্তিকাল করেন। إنا لله و إنا إليه راجعون উচ্চতর ইলমুল ফিকহের তালিবুল ইলমগণ তাকে তার কিতাব "الغرر و أثره في العقود"-এর মাধ্যমে চিনেন। তিনি মালেকী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। ইলমের পরিপক্কতা ও গভীর দ্বীনী প্রজ্ঞা তার বিশেষ গুণ ছিল। ৯৭ বছর বয়সে তিনি ইন্তিকাল করেন। হযরতুল উস্তায ‘আল বালাগ’ যিলকদ ১৪৩৬ হি. (সেপ্টেম্বর ২০১৫) সংখ্যায় তার ব্যাপারে নিজের অনুভ‚তি প্রকাশ করেছেন, যা থেকে অনুমান করা যায়, তিনি কত উঁচু মাপের আলিম ছিলেন।
শায়খ ওহবা যুহাইলী (وهبة الزحيلي)
গত ৯/৭/২০১৫ ঈ. রবিবার সকাল আটটায় মোবাইল ফোনে ভাই মাওলানা আমীমুল ইহসানের বার্তা আসল যে, গত রাতে শায়খ ওহবা যুহাইলী ইন্তিকাল করেছেন। إنا لله و إنا إليه و راجعون
একই দিন সন্ধ্যা সাতটায় বেরাদারে আযীয মাওলানা ফয়যুল্লাহর বার্তা আসল, শনিবার দিবাগত রাতে দামেস্কে শায়খ ওহবা ইন্তিকাল করেছেন। তারপর মাওলানা ত্বহা দানিশের বার্তা আসল যে, শায়খ ওহবা ৮৩ বছর বয়সে ৮ আগস্ট আল্লাহর কাছে চলে যান। পরে মাসিক ‘আল বালাগে’র একই সংখ্যায় শায়খ ওহবার উপরও হযরতের লেখা পড়ি। শায়খ ওহবা শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু তা সত্তে¡ও তিনি চারও মাযহাবের উপর স্বতন্ত্র গ্রন্থ সংকলন করেন।
"الفقه الإسلامي و أدلته" ফিকহে মুকারানের উপর তার প্রসিদ্ধ কিতাব। ফিকহে মুকারানের বিষয়টি খুব নাযুক ও স্পর্শকাতর। ফিকহে মুকারানের কিতাবে প্রতিটি মাসআলায় সকল মাযহাবের সঠিক ও পরিপূর্ণ উপস্থাপন, মাযহাবের ইমামদের মূল দলীল ও তাদের পেশকৃত ওজহে ইস্তিদলাল, তারপর লেখকের পক্ষ থেকে কোনো একটি মতকে প্রধান্য দান- এ সবই একেকটি জটিল ও স্পর্শকাতর অধ্যায়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, "الفقه الإسلامي و أدلته" -এর উপর সমালোচনা ও পর্যালোচনার অনেক সুযোগ আছে। এই কিতাব থেকে ইস্তিফাদার সময় তালিবুল ইলম ভাইদের বিষয়টি স্মরণ রাখা উচিত। হাঁ, কিতাব খুবই সুবিন্যস্ত সহজবোধ্য ও উপকারী। জায়গায় জায়গায় বিভিন্ন মুফিদ তাহকীকাতও রয়েছে। হযরতুল উসতায শায়খ ওহবার "نظرية الضرورة الشرعية" কিতাবটির উচ্চ প্রশংসা করেছেন। তদ্রƒপ ড. সাইদ রমযান বুতীর "المصلحة و ضوابطها في الشريعة الإسلامية" কিতাবটিরও প্রশংসা করেছেন। এবং বলেছেন, ‘কিতাবটি অনেক ভাল লেগেছে।’
শায়খ ওহবার আরেকটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি হল,"التفسير المنير في العقيدة و الشريعة و المنهج"। আমার এখনো বিস্তারিতভাবে এ কিতাব থেকে ইস্তিফাদার সুযোগ হয়নি, তবে একদিন ঘটনাচক্রে এর ভূমিকায় এই লাইন কয়টি নজরে পড়ে-
"عدد آي القرآن ৬২৩৬ على طريقة الكوفيين، و على طريقة غيرهم ৬৬৬৬آية، وهي ما يأتي : الأمر ১০০০، النهي ১০০০، الوعد ১০০০، الوعيد ১০০০، القصص و الأخبار ১০০০، العبر و الأمثال ১০০০، الحرام و الحلال ৫০০، الدعاء১০০، الناسخ و المنسوخ ৬৬".
এই আলোচনায় শুধু প্রথম কথাটি সঠিক। বাদ বাকী সবগুলো ভুল। আমার খুব আশ্চর্য লেগেছে, এত বড় আলেম থেকে এমন স্পষ্ট ভুল কীভাবে হল? এ নিয়ে আমি তাকে চিঠিও লিখেছিলাম। জানি না, চিঠিটি তার কাছে পৌঁছেছে কি না। পরে অবশ্য কিতাবটির আরেক এডিশনে দেখলাম,
"و على طريقة غيرهم ৬৬৬৬ " কথাটি বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ‘হাযারী তাকসীম’ ঠিকই বহাল আছে। জানি না, এই অনারবের ভুলগুলো কিভাবে একজন আরব আলিমের কিতাবে ঢুকে পড়েছে!
শায়খ ওহবা রাহ. ছিলেন মুত্তাবিয়ে শরীয়ত, মু‘তাদিল মেযাজের অধিকারী বড় একজন আলিম এবং বহু গ্রন্থপ্রণেতা। তার জন্ম ১৯৩২ ঈ. এবং মৃত্যু ২০১৫ ঈ.। আল্লাহ তাআলা তাকে, শায়খ আমীন আদদারীর এবং আরো যে সকল আলিম আখেরাতের সফরে রওয়ানা হয়েছেন তাদের সকলকে পূর্ণ মাগফিরাত করে দিন। তাদেরকে জান্নাতুল ফেরদাউসের আ‘লা মাকাম দান করুন। উম্মাহকে তাদের মিরাছের মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন!
মাওলানা আসেম বিল্লাহ রাহ.
কিছুদিন আগে মাওলানা হিফযুর রহমান ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম (লাকসামের হুযুর) থেকে শুনলাম, প্রায় এক মাস আগে হযরত মাওলানা আসেম বিল্লাহ (ফেনুয়া, লাকসাম, কুমিল্লা)ও ইন্তিকাল করেন। তিনি ফেনুয়ার প্রসিদ্ধ আলিম ও বুযুর্গ হযরত মাওলানা দিলাওয়ার হুসাইন রাহ.-এর বড় ছাহেবযাদা। কয়েকবার আমার তার সাথে সাক্ষাৎ হয়। তিনি সূরত ও সীরাত উভয় দিক থেকে বিশিষ্ট বুযুর্গ ছিলেন। মাদরাসা আরাবিয়া খেড়িহরের মজলিসে শুরার সদস্য ছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউসের আ‘লা মাকাম নসীব করুন। তাঁর ভাগিনাদের অনেকে মাশাআল্লাহ আলেম। আশা করি, তারা মরহুমের জীবন ও কর্মের উপর লিখবেন।
মাওলানা নোমান ছাহেব রাহ.
গত ১৭ মুহাররম ১৪৩৭ হি. (মোতাবেক ৩১ অক্টোবর ২০১৫ ঈ.) শনিবার বাদ মাগরিব জামিয়া রাহমানিয়ার প্রবীণ উস্তায হযরত মাওলানা নোমান ছাহেবও ইন্তিকাল করেন। إنا لله وإنا إليه راجعون । ১৪১৬ হি. রজবে যখন সফর থেকে ফিরলাম, তখন সম্ভবত আমার ভাইজানের কাছেই সর্বপ্রথম তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হয়। হাটহাজারীতে তারা দুজন একই বছর দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করেন। মারকাযুদ দাওয়াহকে তিনি অনেক মুহাব্বত করতেন। বরং মারকায প্রতিষ্ঠার আগ থেকেই তিনি ভাইজানের সাথে এ বিষয়ের বিভিন্ন মশওয়ারায় শরীক থাকতেন। প্রতিষ্ঠার পরও কয়েক বছর লাগাতার মারকাযে তার আসা যাওয়া এবং সেই সাথে দুআ-ভালবাসা মশওয়ারা এবং উৎসাহ প্রদানের সিলসিলা অব্যাহত থাকে। মারকাযের সর্বপ্রথম যে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি প্রকাশিত হয়, তার ‘মুসাবিদা’ তাঁর হাতেই তৈরি। ১৪১৬ হি. শাওয়ালে যখন মারকাযের প্রথম শিক্ষাবর্ষের সূচনা হয়, তখন হযরত পাহাড়পুরী দামাত বারাকাতুহুম ও প্রফেসর হযরতের সাথে তিনিও উপস্থিত ছিলেন। তার ইলমী যোগ্যতা মাশাআল্লাহ মজবুত। স্বভাবগতভাবে তিনি বেশ উদ্যমী ছিলেন। সময়ের বড় মূল্য দিতেন। তাই অল্প হায়াত পাওয়া সত্তে¡ও তিনি কলমের ময়দানে উম্মাহকে অনেক গ্রন্থ উপহার দিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর রচনাবলীর মধ্যে স্বতন্ত্র গ্রন্থও আছে, আবার অনুবাদও আছে। কোন্ কিতাব বাংলায় অনুবাদ করার মত আর কোন্টি নয় এ ব্যাপারে তার নিজস্ব কোনো মত ছিল। এবং তিনি সে অনুযায়ীই কাজ করতেন। সম্ভবত তার এটা জানা ছিল যে, এ ব্যাপারে আমার কিছু ভিন্নমত রয়েছে। এজন্যেই হয়ত বিভিন্ন সময় দেখা হলে তিনি বলতেন, আমি আপনাকে মুহাব্বত করি। আপনি আমার কাজকর্মের ব্যাপারে নির্দি¦ধায় মতামত পেশ করতে পারেন। আমাকে মশওয়ারা দিতে পারেন। কিন্তু যেহেতু তিনি সমঝদার আলিম ছিলেন, তার নিজস্ব রায় আছে, তাই আমি এ ব্যাপারে তার সাথে কখনো কোনো কথা বলিনি। তবে তার থেকে সবচেয়ে বড় যে শিক্ষাটি আমরা নিতে পারি তা হল, ছাত্র ও জনসাধারণের কল্যাণে নিজেকে বিলীন করে দেওয়ার শিক্ষা। তিনি ছাত্র ও জনসাধারণের সেবায় সদা উৎসর্গিতপ্রাণ ছিলেন। তালীম ও রচনা- উভয় ক্ষেত্রে তিনি বিরামহীন মেহনতে অভ্যস্ত ছিলেন। তার উদ্যম ও কর্মতৎপরতা দেখে অতি গাফেল লোকদেরও প্রেরণা সৃষ্টি হত। তিনি কথার চেয়ে কাজে বিশ্বাসী ছিলেন। শুধু পরামর্শ ও পরিকল্পনা তৈরি করা আর কাজের বেলায় অলসতা ও উদাসীনতা- এসব তিনি মোটেও পছন্দ করতেন না। একটা কথা তাকে বারবার বলতে শুনেছি- কথাটি তার খোশমেযাজের পরিচয়ও বহন করে- ‘যদি মিটিং মিছিলে এত সময় ব্যয় হয় তাহলে কাজ হবে কখন?’!!
তিনি ছাত্রদেরকে বিশেষত নবীন আলিমদেরকে লেখালেখির ময়দানে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে উদ্বুদ্ধ করতেন। যদি কেউ বলত, আমি লিখতে পারি না। তাহলে বলতেন, আপনি বলতে পারেন, লিখতে কেন পারবেন না? যা মুখে বলেন, তাই কলমে লেখেন। এটার নামই তো লেখা। লেখা তো ভিন্ন কিছু না।
আফসোস! সময় মত সংবাদ না পাওয়ার কারণে আমি তার জানাযায় শরীক হতে পারিনি। ভাইজান মিরপুর ছিলেন। সময় মত সংবাদ পেয়ে তাঁর জানাযায় শরীক হয়েছেন। এটা খুব ভাল হয়েছে যে, মাগরিবের পর ইন্তিকাল হয়েছে আর তার কিছুক্ষণ পরই রাত দশটায় জানাযা হয়ে গেছে। আজকাল জানাযা দেরী করার রোগ এত ব্যাপক হয়ে গেছে যে, যে সকল বুযুর্গ জানাযা ও দাফন তাড়াতাড়ি হয়ে যাওয়ার সুন্নতের উপর খুব গুরুত্ব দিতেন, দেখা যায়, ইন্তিকালের পর খোদ তাদের সাথেই এর বিপরীত আচরণ করা হয়। শুনেছি, অল্প সময়ের মধ্যে জানাযা হওয়ার পরও সাত মসজিদের চত্বর এবং পাশের মাঠ পূর্ণ ভরে যায় এবং আশপাশের রাস্তায় মুসল্লীদের ভীড় থাকে। ইন্তিকালের কয়েক দিন পর ওদিকে যাওয়া হলে তার ছাহেবযাদাদের সাথে সাক্ষাৎ করি। মাওলানা রুমি এবং সাদীর সাথে সাক্ষাৎ হয়। শিবলী তখন অন্যত্র ছিল। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে এবং তাদের ওয়ালিদা মাজিদাকে সবরে জামীলের তাওফীক নসীব করুন। দ্বীনী ও দুনিয়াবী সকল বিষয়ে তাদের দেখভাল ও কাফালাত করুন। মাওলানা মরহুমের দারাজাত বুলন্দ করুন এবং তাঁর সকল দ্বীনী খেদমত মকবুল ও স্থায়ী করুন। আমীন!
হাজী নাজিমুদ্দীন রাহ.
হযরত মুফতী আব্দুর রহমান ছাহেবের জানাযার সাথে তাঁর এক সান্নিধ্যধন্য নেক লোকের জানাযা পড়েছিলাম। এর কয়েকদিন পরই হযরত মুফতী ছাহেবসহ দেশ ও দেশের বাইরের অনেক ওলামা মাশায়েখের প্রিয়ভাজন হাজী নাজিমুদ্দীন ছাহেব ইন্তিকাল করেন إنا لله و إنا إليه راجعون । ১৪১৬ হি. শাওয়ালে যখন মারকায প্রতিষ্ঠা হয়, তখন সর্বপ্রথম হাজ্বী ছাহেবের সাথে আমার পরিচয় হয়। মারকাযুদ দাওয়াহর উদ্বোধন হয় মুহাম্মদপুর নূরজাহান রোডে মাওলানা আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী ছাহেবের বাসায়। ১৪১৬ হি. রমযানে মুদীর ছাহেবের শাগরিদ হুসাইন আহমদ হিলাল এবং আমার শ্রদ্ধেয় মাওলানা রিযওয়ানুর রহমান ছাহেব এই বাসাটি খুঁজে বের করেন। সেই বাসায় একটি ল্যান্ড ফোন ছিল, কিন্তু তা কোনো কারণে কাজ করছিল না। ঐ বছর গণভবন মসজিদের ইমাম ও খতীব মাওলানা আবদুস সালাম ছাহেব মারকাযুদ দাওয়ার ইফতা বিভাগে দাখিলা নিয়েছিলেন। হাজ্বী ছাহেব ছিলেন তার মুসল্লী। হাজী ছাহেব তখন মুহাম্মদপুর হুমায়ুন রোডে ভাড়া থাকতেন। মাওলানা আব্দুস সালাম হাজ্বী ছাহেবকে বললে তিনি টিএন্ডটির অফিসে যোগাযোগ করে দিয়ে ফোনটি ঠিক করিয়ে দিলেন। ছয় মাস পর মারকায মুহাম্মদপুর মুহাম্মদী হাউজিংয়ের প্রধান সড়কের ৯ নম্বর বাড়িতে স্থানান্তরিত হল। সেখানে ফোনের দরকার ছিল। তাও হাজ্বী ছাহেব ব্যবস্থা করে দিলেন। কিছুদিন পর তিনি তাতে আইএসডি সুবিধারও ব্যবস্থা করে দিলেন।
মুহতারাম মাওলানা রিযওয়ানুর রহমান এবং মাওলানা হাবীবুর রহমান খান তার খুব মুহাব্বতের মানুষ ছিলেন। এ দু’জন যেহেতু মারকাযকে এবং আমাদেরকে মুহাব্বত করতেন এজন্যে সম্ভবত অল্পদিনের মধ্যেই মারকায এবং আহলে মারকাযের সাথে হাজ্বী ছাহেবের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। এক সময় মারকাযে তার খুব আসা যাওয়া হত। পরে ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে এবং বাসা দূরে হওয়ার কারণে আসা যাওয়ার সিলসিলা কমে যায়। কিন্তু সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত বাকি থাকে। পল্লবীতেও এক দু’বার এসেছিলেন এবং হযরতপুর প্রাঙ্গণেও আমরা তাকে একবার তকলীফ দিয়েছি। এটা হাজ্বী ছাহেবের শরাফাত যে তিনি বড় বড় আলিমদের সাথে যুক্ত থাকার পরও আমাদের মত অল্প বয়সী মৌলভীদেরকে ইকরাম করতেন।
হাজী ছাহেবের মধ্যে অনেক ভাল ভাল গুণ ছিল। তার জীবনে আদর্শপূর্ণ অনেক বিষয় রয়েছে এবং উপদেশ হাসিলের মতও বেশ কিছু জিনিস রয়েছে। ভাল হয়, যদি তার ছেলে বেরাদারে আযীয মৌলভী মুসলেহুদ্দীন রুমী তাঁর বিস্তারিত জীবনী লিখে তা সংরক্ষিত করে দেয়। আমি শুধু এখানে দু’একটি বিষয় আরয করব-
পাকিস্তান আমলে তার অনেক বড় ব্যবসা ছিল। পরবর্তীতে তিনি অনেক যুলুমের শিকার হন। এবং তার ব্যবসাও অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন কেউ কেউ তাকে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ব্যবসা পুনরায় দাঁড় করানোর পরামর্শ দিয়েছিল। তিনি হাফেজ্জী হুজুরকে এই মাসআলা জিজ্ঞাসা করলেন। হযরত না-সূচক জবাব দিলেন। তখন হাজ্বী ছাহেব সেটাকেই স্বতস্ফ‚র্তভাবে মেনে নিলেন। তার ব্যবসা শেষ হয়ে গেল এবং বাহ্যত তার সম্পদের প্রাচুর্য থাকল না। কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহ তার শামিলে হাল থাকল। তিনি প্রশস্ততার জীবনই যাপন করলেন। এবং নিজের সকল সম্পদকে আখেরাতের ভাণ্ডারে জমা করে দিলেন। কখনো কখনো লাগাতার কয়েক মাস তাকে সম্পূর্ণ করযের উপর চলতে হত। কিন্তু তখনও তার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া দান ও হাদিয়া অন্যসময়ের মতই চলতে থাকত। এমনই এক সময় তিনি মারকাযুদ দাওয়াহ পল্লবীতে তাশরীফ আনেন। সেখানে তৃতীয় তলার ছাদ হল টিনের। নীচে কোনো সিলিং ছিল না। তিনি বললেন, আমি সিলিং-এর ব্যবস্থা করে দিব। সম্ভবত সিলিং-এর খরচ ছিল তখন সত্তর হাজার টাকা। আমরা আদবের সাথে ওযর পেশ করে বললাম, আপনার জন্যে করয করে এত বড় অংকের খরচ বহন করা উচিত হবে না। আমরা ইনশাআল্লাহ বাঁশের সিলিং লাগিয়ে নেব। অবশেষে অনেক কষ্টে তিনি তা মেনে নিলেন।
তাঁর সাদাকায়ে জারিয়ার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল, দারুল উলূম ঢাকা এবং তার নেক সন্তানগণ। হাজ্বী ছাহেব একবার আমাকে বলেছিলেন, এই মাদরাসার নাম দারুল উলূম ঢাকা রেখেছেন ওলামা বাজার মাদরাসার সাবেক মুহতামিম হযরত মাওলানা আব্দুল হালীম রাহ.। দারুল উলূম দেওবন্দের নামের সঙ্গে মিল করে, নেক ফাল হিসাবে। আল্লাহ তাআলা তার নেক নিয়ত কবুল করুন। সন্তানদের মধ্যে ছোট ছেলে স্নেহের রুমিকে তো তিনি হাফেজও বানিয়েছেন, আলিমও বানিয়েছেন। জামিয়া রাহমানিয়ায় লেখাপড়া শেষ করার পর তাকে দারুল উলুম করাচী পাঠিয়েছেন। সেখানে সে দাওরাও পড়েছে তাখাসসুস ফিদ দাওয়াহ ওয়াল ইরশাদও। তারপর বিন্নুরী টাউনে ইফতা এবং ঢাকা মারকাযুদ দাওয়ায় উলূমুল হাদীস। তিনি চাইতেন, তার এই ছেলেই যেন দারুল উলূমের হাল ধরে। আশা করি এমনই হবে।
হাজ্বী ছাহেবের ভাল গুণাবলীর মধ্যে এই গুণটি আমার খুব পসন্দ ছিল- তিনি তার ছেলেদের মুআল্লিমগণ ও উস্তাযগণের খুব কদর করতেন। তাদের খোঁজ-খবর নিতেন। মাওলানা মুসলেহুদ্দীনের হিফজের উস্তাযকে তো তিনি -মাশা আল্লাহ- হজ্বও করিয়েছেন। অনেক গুণাবলীর পাশাপাশি তাঁর মাঝে কিছু দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতাও ছিল। তার কিছু তো স্বভাবগত, আর কিছু এমন যার দায় কিছুটা আমাদের উপরও পড়ে। আমাদের সাথে সম্পর্ক রাখেন এমন ইংরেজি শিক্ষিত দ্বীনদার ও সাধারণ দ্বীনদারদের যোগ্যতাগুলোকে যথাযথভাবে ব্যবহার করার এবং তাদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শনের তাওফীক দান করুন। আমীন!
৩ সফর ১৪৩৭ হি. (মোতাবেক ১৬ নভেম্বর ২০১৫ ঈ.) যোহরের সময় তিনি ইন্তিকাল করেন এবং মাশা আল্লাহ এশার পরপরই তার জানাযা হয়ে যায়। জানাযা তার ছেলে মুসলেহুদ্দীন রুমি পড়ান। তিনি যখন নাহবেমীর বা কাফিয়ার ছাত্র তখন তিনি তার আম্মার জানাযাও পড়িয়েছিলেন। এটা বড় সৌভাগ্যের কথা। উত্তরা ৭ নং সেক্টরের পার্ক মসজিদের চত্বরে তার জানাযা হয়। ভাই ছাহেব ও মাওলানা ইয়াহইয়া আগেই পৌঁছে গিয়েছিলেন। আমি হযরতপুর থেকে মাগরিবের পরে রওয়ানা হয়েছি কিন্তু আল্লাহর শোকর জানাযা পেয়েছি। আমরা হাজ্বী ছাহেবের সকল আওলাদ (তার বড় ছেলে ভাই মিনহাজুদ্দীন, ছোট ছেলে প্রিয় মুসলেহুদ্দীন, এবং তার মেয়ে ও মেয়ের জামাতা ভাই রহমতুল্লাহ) তার আত্মীয়-স্বজন এবং দারুল উলূম ঢাকার সকল ছাত্র-শিক্ষক, হাজ্বী ছাহেবের সকল মুহিব্বীনের খেদমতে তাযিয়াত পেশ করছি-
أحسن الله عزاءكم و عظم أجركم و غفر لميتكم.
আল্লাহ হাজ্বী ছাহেবকে মাগফেরাত করুন! তাঁর দারাজাত বুলন্দ করুন। তার সাদাকায়ে জারিয়াকে কিয়ামত তক বাকী রাখুন। আমীন!
হযরত মাওলানা ড. শের আলী শাহ
মাওলানা নোমান ছাহেবের ইন্তিকালের পরের দিন ১৮/১/১৪৩৭ হি. (মোতাবেক ০১/১১/২০১৫ ঈ.) পাকিস্তানের প্রসিদ্ধ আলিমে দ্বীন ও বিশিষ্ট বুযুুর্গ দারুল উলূম হক্কানিয়া আকুড়া খটকের শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা ড. শের আলী শাহ ইন্তিকাল করেন إنا لله و إنا إليه راجعون যখন আমরা বিন্নুরী টাউনে দাওরায়ে হাদীসের তালিবুল ইলম তখন তিনি দারুল উলূম করাচীতে ছিলেন। সম্ভবত সে বছর অথবা তার পরের বছর তার কিতাব "تفسير سورة الكهف" মুতালাআর মাধ্যমে তার পরিচয় লাভ করি। এটি তার মাস্টার্সের থিসিস। আরব আলিমদের মধ্যে শায়খ আবু বকর জাবের আল জাযায়েরী এবং উলামায়ে দেওবন্দের মধ্যে দারুল উলূম হক্কানীয়ার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা আব্দুল হক হক্কানী ছাহেব এই কিতাবের ভূমিকা লিখেছেন। মাস্টার্স ও ডক্টরেট ডিগ্রী তিনি জামিয়া ইসলামিয়া মদীনা মুনাওয়ারা থেকে অর্জন করেন। ড. শের আলী শাহ শায়খ বিন বায রাহ.-এর শাগরিদ। তিনি যখন দারুল উলূম করাচীতে ছিলেন তখন তাখাসসুসের ছাত্রদের মাকালাও তিনি সম্পাদনা করতেন। আমার মুহতারাম মুরুব্বী হযরত মাওলানা দিলাওয়ার হুসাইন ছাহেবের তাখাসসুসের মাকালা ‘আল আশবাহ ওয়ান নাযায়েরে’র ফন্নে আউয়ালের প্রকাণ্ড শরাহ (الشرح الناضر للأشباه و النظائر)-এর অংশবিশেষ তাঁর নযরে ছানীকৃত। হযরত রাহ.-এর বিস্তারিত জীবনী আমরা ইনশাআল্লাহ দারুল উলূম হক্কানিয়ার মুখপত্র মাসিক ‘আল হকে’ পড়তে পারব। এবং ইন্তিকালের পরের দিনের বিভিন্ন উর্দূ দৈনিকেও পাওয়া যাবে।
যখন মারকায মুহাম্মদপুর মুহাম্মদী হাউজিংয়ের ৯ নম্বর বাড়িতে তখন তিনি মাওলানা যর ওলী খান ছাহেব দামাত বারাকাতুহুমের সাথে বাংলাদেশে তাশরীফ আনেন এবং অল্প সময়ের জন্যে মারকাযেও তাশরীফ রাখেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে পরিপূর্ণরূপে মাগফিরাত করে দিন, তার দারাজাত বুলন্দ করুন। তাকে ইল্লীয়্যীনের আ‘লা মাকাম দান করুন। এবং তাঁর সকল খেদমতগুলোকে কবুল করুন। আমীন!
কারো আখেরাতের সফরের কথা লিখতে গেলে কখনো কখনো নিজের মৃত্যুর কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে হযরত ওমর রা. এর বাণীটি, যা ভালভাবে স্মরণ থাকার জন্যে শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ. ‘রিসালাতুল মুসতারশিদীনে’র শুরুতে লিখে দিয়েছেন-
" كل يوم يقال مات فلان و فلان ، و لابد من يوم يقال فيه مات عمر"
অর্থাৎ : প্রতিদিন কারো না কারো মৃত্যুর খবর শোনা যায়। প্রতিদিন বলা হয়- অমুক মারা গেছে, অমুক মারা গেছে। একদিন অবশ্যই এমন আসবে যেদিন বলা হবে- ওমর মৃত্যুবরণ করেছে।
কিন্তু এ কথার যে শিক্ষা ও মর্ম তা যে অন্তরে বসে না। আল্লাহ আমাকে হেফাযত করেন। আল্লাহ যেন আফিয়াত সালামতের সাথে, সিহহাত ও কুওয়াতের সাথে দীর্ঘ নেক হায়াত এবং খাতেমা বিল খায়ের দান করেন- সে জন্যে আমি সকলের নিকট দুআ প্রার্থী। আমিও সকলের জন্যে এই দুআ করি।
আবদুল মালেক
শনিবার
১৫/২/১৪৩৭ হিজরী