বান্দার প্রতি আল্লাহর খিতাব
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
নবম খিতাব-
يا عبادي! لَوْ أَنَّ أَوَّلَكُمْ وَآخِرَكُمْ، وَإِنْسَكُمْ وَجِنَّكُمْ، قَامُوا فِي صَعِيدٍ وَاحِدٍ فَسَأَلُونِي كُلُّ وَاحِدٍ مِنْكُمْ مَسْأَلَتَهُ، فَأَعْطَيْتُهُ، مَا نَقَصَ ذَلِكَ مِمَّا عِنْدِي , إِلا كَمَا يَنْقُصُ الْمِخْيَطُ إِذَا أُدْخِلَ فِي الْبَحْرِ
‘হে আমার বান্দাগণ! তোমাদের প্রথম ও শেষজন তোমরা মানব ও জিন সকলেই যদি এক সমতল ভ‚মিতে সমবেত হয়ে আমার কাছে প্রার্থনা করতে থাক আর আমি সবাইকে তার প্রার্থিত বস্তু দান করতে থাকি তাহলেও আমার কাছে যা আছে তা থেকে শুধু এটুকু কমবে, যতটুকু সমুদ্রে একটি সুঁই ডোবালে কমে।’
পৃথিবীতে আমরা খালি চোখে যা কিছু দেখি ও উপলব্ধি করি এর মধ্যে ক্ষুদ্রতম হচ্ছে সুঁইয়ের মাথা, আর প্রশস্ততম হচ্ছে, সাগর, মহাসাগর। তাই বলা হয়, অথৈ সাগর, অতলান্ত জলরাশি। আল্লাহ পাকের কাছে যা আছে তা বোঝানোর জন্য বলা হচ্ছে, আল্লাহর সম্পদ যেন এক মহাসমুদ্র। আর তোমাদের সবার প্রার্থিত বস্তু যদি আল্লাহ তোমাদের দান করেন তাহলে সেই সম্পদ কতটুকু কমবে? একটা সুঁই যদি মহাসমুদ্রে ডোবাও এরপর তা তোলো, যদি সুঁইয়ের মাথার দিকে তাকাও তাহলে হয়তো এক বিন্দু পানি তুমি দেখতে পাবে। কিন্তু যদি মহাসমুদ্রের দিকে তাকাও তাহলে মহাসমুদ্রের পানি কতটুকু কমল বলে মনে হবে? এই হচ্ছে আল্লাহর ‘গিনা’ ও অভাবমুক্ততার উপমা। অর্থাৎ আল্লাহ পাক স্রষ্টা। তাঁর কাছে কোনো কিছুরই কমতি নেই। সুতরাং বান্দার কর্তব্য, তাঁরই কাছে প্রার্থনা করা।
কুরআন-সুন্নাহ বোঝার জন্য আরবী ভাষা-জ্ঞান ও সাহিত্যের সাধারণ রুচি অতিপ্রয়োজন
কুরআন মাজীদ কোনো নিষ্প্রাণ ‘আইন-গ্রন্থ’ মাত্র নয়, এ হচ্ছে ‘কিতাবুল হিদায়াহ’ হিদায়াতের কিতাব। এতে যেমন আইন আছে, তেমনি উপদেশও আছে। আসমানী ফরমান যেমন আছে তেমনি পূর্বের জাতিসমূহের কর্ম ও পরিণামের বিবরণও আছে। এ কিতাব যেমন মস্তিষ্ককে সম্বোধন করে তেমনি হৃদয়কেও সম্বোধন করে। এতে যেমন আছে বিধান ও ফরমানের প্রতাপ, তেমনি আছে উপমা-উদাহরণের মাধুর্য। এ কারণে কুরআনকে বোঝার জন্য যেমন প্রয়োজন জ্ঞান ও প্রজ্ঞা তেমনি প্রয়োজন ভাষার রুচি ও সংবেদন। এ জিনিসের অভাব হলে শুধু যে কুরআনের বর্ণনা-মাধুর্য থেকেই বঞ্চিত হতে হয় তা-ই নয়, ছোট-বড় বিভ্রান্তিও ঘটে থাকে এবং ঘটেছে। কারো যদি সহজ-সুন্দর ভাষা-বোধ না থাকে তাহলে তার মনে অহেতুক এ প্রশ্ন জাগতে পারে যে, এ আয়াত থেকে বোঝা যাচ্ছে, আল্লাহর ‘সম্পদে’ও -নাউযুবিল্লাহ- সীমাবদ্ধতা আছে! কারণ যে বস্তু দ্বারা এর উপমা দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ সাগর, তা যত বড়ই হোক, সসীম বটে! অথচ ভাষা-বোধ যার আছে তার কাছে এ প্রশ্ন হাস্যকর। উপমার ক্ষেত্রে উপমান ও উপমিত সবদিক থেকে এক হওয়া জরুরি নয়। বিশেষ কোনো একটি বৈশিষ্ট্য সহজে বোঝানোই উপমার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে।
আমাদের আলোচ্য বিষয়টি আল্লাহর কুদরতের সাথে সংশ্লিষ্ট। আল্লাহর ইলমের ব্যাপারেও এ ধরনের উপমা সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। হযরত খাযির ও হযরত মূসা আ.-এর ঘটনা সবারই জানা আছে। কুরআন মাজীদে সূরা কাহফের শেষ দিকে এ ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। হাদীস শরীফে ঐ ঘটনার বিভিন্ন দিক বিস্তারিতভাবে আছে। সহীহ বুখারীর এক মওকুফ বর্ণনায় আছে যে, একটি পাখী সমুদ্র থেকে চঞ্চু দ্বারা পানি তুলল তখন খাযির আ. হযরত মূসা আ.-কে লক্ষ্য করে বললেন-
وَاللَّهِ مَا عِلْمِي وَمَا عِلْمُكَ فِي جَنْبِ عِلْمِ اللَّهِ إِلَّا كَمَا أَخَذَ هَذَا الطَّائِرُ بِمِنْقَارِهِ مِنَ البَحْرِ
আল্লাহর কসম! আল্লাহর ইলমের তুলনায় আমার ও তোমার ইলমের (সমষ্টির) উদাহরণ হচ্ছে এই যে পাখিটি, যে তার চঞ্চু দ্বারা সমুদ্র থেকে পানি নিল। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৭২৬
অথচ কে না জানে সমুদ্র যত বড়ই হোক তা সসীম। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইলম অসীম! তবে উপমার যে উদ্দেশ্য আল্লাহর জ্ঞানের সম্মুখে মানুষের জ্ঞানের অকিঞ্চিতকরতা প্রত্যক্ষ করে তোলা তাতে এ উপমা সফল। এই উপমা থেকে এ বিষয়টি উপলব্ধি না করে কেউ যদি সসীম-অসীমের তর্কে জড়িয়ে পড়ে, তবে তা যেমন হাস্যকর হয় তেমনি মর্মান্তিকও হয় বটে।
ইহুদী জাতির বিভ্রান্তি ও বেআদবী
কোনো কোনো সরলপ্রাণ-মুসলিমের মনে এ প্রশ্ন জাগতে পারে যে, পৃথিবীতে এমন দুর্ভাগা কে আছে, যে আল্লাহ তাআলার বিষয়েও অভাবের চিন্তামাত্রও করতে পারে? চারপাশের প্রকৃতিতেই তো আল্লাহ তাআলার গিনা ও অভাবমুক্ততার কত উদাহরণ! কিন্তু বাস্তবতা এই যে, কোনো কোনো জাতি এ বিষয়েও বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে, যার মূলে রয়েছে কুফর ও কিবর। কুরআন মাজীদে ইহুদীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে-
لَقَدْ سَمِعَ اللّٰهُ قَوْلَ الَّذِیْنَ قَالُوْۤا اِنَّ اللّٰهَ فَقِیْرٌ وَّ نَحْنُ اَغْنِیَآءُ ۘ سَنَكْتُبُ مَا قَالُوْا وَ قَتْلَهُمُ الْاَنْۢبِیَآءَ بِغَیْرِ حَقٍّ ۙ وَّ نَقُوْلُ ذُوْقُوْا عَذَابَ الْحَرِیْقِ
আল্লাহ অবশ্যই শুনেছেন ওদের কথা যারা বলেছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ অভাবগ্রস্ত আর আমরা অভাবমুক্ত। ওরা যা বলেছে তা এবং ওরা যে নবীগণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে তা আমি লিখে রাখব এবং বলব, ভোগ কর দহন-যন্ত্রণা। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৮১
তবারী ও ইবনে আবী হাতিম হাসান সনদে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আবু বকর সিদ্দীক রা. একদিন ‘বাইতুল মিদরাস’-এ গেলেন (এটি ছিল ইহুদীদের একটি ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র) ওখানে অনেক ইহুদী ওদের এক ধর্মগুরু ফিনহাসের কাছে বসে ছিল। আশইয়া‘ নামে আরেক ধর্মগুরুও উপস্থিত ছিল। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. ফিনহাসকে লক্ষ করে বললেন, ওহে ফিনহাস! আল্লাহকে ভয় কর এবং ইসলাম কবুল কর। আল্লাহর কসম! তোমার খুব ভালোভাবেই জানা আছে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, যিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছেন। যার কথা তোমরা তোমাদের কাছে তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত পাচ্ছ। ফিনহাস তখন বলল, হে আবু বকর! আল্লাহর কসম! আল্লাহর প্রতি আমাদের কোনো মুখাপেক্ষিতা নেই; বরং সে-ই আমাদের মুখাপেক্ষী। আমরা তার কাছে কাকুতি-মিনতি করি না, সে-ই আমাদের কাছে কাকুতি মিনতি করে। সে যদি আমাদের থেকে অমুখাপেক্ষী হত তাহলে আমাদের কাছে ঋণ চাইত না। যেমনটা তোমার সঙ্গী বলে থাকে! একদিকে সে আমাদের জন্য সুদ নিষিদ্ধ করে অন্যদিকে নিজেই সুদ দান করে। সে যদি অভাবী না হবে তাহলে সুদ দেবে কেন?! (নাউযুবিল্লাহ)
তার এ ধৃষ্টতাপূর্ণ কটূক্তি শুনে আবু বকর রা. ক্ষুব্ধ হলেন এবং ফিনহাসের মুখে সজোরে আঘাত করলেন এবং বললেন, ঐ সত্তার কসম! যাঁর হাতে আমার প্রাণ। আমাদের ও তোমাদের মধ্যে যদি ঐ চুক্তি না থাকত তাহলে হে আল্লাহর দুশমন! তোমাকে আজ শেষ করে দিতাম। ঠিক আছে তোমরা যদি সত্যবাদীই হয়ে থাক তাহলে যত পার আমাদের অস্বীকার কর। ফিনহাস আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, হে মুহাম্মাদ! দেখ, তোমার সঙ্গী আমার কী হাল করেছে! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কেন এমন করলে হে আবু বকর! আবু বকর রা. বললেন, আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর দুশমন অতি মারাত্মক কথা বলেছে। সে বলেছে, আল্লাহ অভাবী আর ওরা আল্লাহর মুখাপেক্ষী নয়। সে যখন এহেন উক্তি করল তখন আমি আল্লাহর জন্য ক্ষুব্ধ হয়েছি এবং ওর মুখে আঘাত করেছি। তখন ফিনহাস পরিষ্কার অস্বীকার করে বলল, জ্বী না, আমি এমন কথা বলিনি। তখন কুরআন মাজীদের এ আয়াত নাযিল হল। -তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৬৫১
দ্বীন-ধর্ম নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ইহুদীদের চরিত্র
এটা এক মর্মান্তিক বাস্তবতা যে, ইহুদীজাতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের সাথে এবং আসমানী কিতাব ও আসমানী দ্বীনের সাথে চরম ঔদ্ধত্য ও নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে অভিশপ্ত হয়েছে। শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর আনীত দ্বীনের সাথেও তাদের আচরণ একই রকম ছিল। কুরআনের অর্থ-বিকৃতি, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি উপহাস, দ্বীন ও শরীয়ত নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ছিল এদের জাতীয় চরিত্র। এ ঘটনাতেই দেখুন, কুরআন মাজীদের একটি বাণীর কী নির্মম বিকৃতি।
আল্লাহ তাআলার ঋণ চাওয়ার অর্থ
সূরা বাকারায় ইরশাদ হয়েছে-
وَ قَاتِلُوْا فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ وَ اعْلَمُوْۤا اَنَّ اللّٰهَ سَمِیْعٌ عَلِیْمٌ مَنْ ذَا الَّذِیْ یُقْرِضُ اللّٰهَ قَرْضًا حَسَنًا فَیُضٰعِفَهٗ لَهٗۤ اَضْعَافًا كَثِیْرَةً ؕ وَ اللّٰهُ یَقْبِضُ وَ یَبْصُۜطُ ۪ وَ اِلَیْهِ تُرْجَعُوْنَ
অর্থ: আল্লাহর পথে লড়াই কর এবং জেনে রাখ, নিঃসন্দেহে আল্লাহ সব কিছু শোনেন, সব কিছু জানেন।
কে আছে যে আল্লাহকে করয দিবে উত্তম করয; অতপর আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ-বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিবেন? আল্লাহই সংকুচিত করেন এবং তিনিই প্রশস্ততা দান করেন এবং তাঁরই নিকট তোমরা সবাই ফিরে যাবে। -সূরা বাকারা (২) : ২৪৪-২৪৫
কুরআন মাজীদের এ আয়াতেই বলা হচ্ছে যে, ধন-সম্পদ, রিযক সব আল্লাহর হাতে। তিনিই সংকোচন করেন, তিনিই প্রশস্ততা দান করেন। সুতরাং তিনিই যখন বান্দাকে লক্ষ্য করে বলছেন, কে আছে যে আল্লাহকে করয দিবে? তখন সহজেই বোঝা যায়, এর অর্থ তাঁর ‘অভাবী’ হওয়া নয় (নাউযুবিল্লাহ) এ তো বান্দার প্রতি তাঁর অনুগ্রহ যে, বান্দাকে তিনি এ ভাষায় উৎসাহিত করেছেন। এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে, বান্দাকে নেক আমলে ও দ্বীনের পথে জান-মাল কুরবানীতে উৎসাহিত করা। এতে বান্দার নিজের উপকার, এই কুরবানীর বিনিময় বান্দা নিজেই লাভ করবে। এক আরিফ তো আরো অগ্রসর হয়ে বলেছেন,
جان دى دى ہوئ اسى كى تھی + حق تو يہ ہے كہ حق ادا نہ ہوا
এই প্রাণ তো তাঁরই দেয়া + সুতরাং হক কথা এই যে, (তাঁর পথে প্রাণ বিসর্জন দ্বারা তাঁর) হক আদায় হয়নি। তাঁর অনুগ্রহের প্রতিদান হয়নি।
আলিমগণ বলেন, এখানে ‘করজ’ শব্দের উদ্দেশ্য হচ্ছে, যেভাবে করজ পরিশোধ করা অপরিহার্য-সেভাবে তোমাদের কর্মের বিনিময়ও আমি আমার উপর অপরিহার্য করে নিচ্ছি। আবার কেউ কেউ বলেছেন, আল্লাহকে করজ দেওয়ার অর্থ তাঁর বান্দাদেরকে করজ দেওয়া এবং তাদের অভাব পূরণ করা। আর এর বিনিময় আল্লাহ তাআলা নিজ অনুগ্রহে বহুগুণ বাড়িয়ে দান করবেন।
সহীহ মুসলিমে একটি দীর্ঘ হাদীসে কুদসী আছে, যাতে অন্নহীনকে অন্নদান, পিপাসার্তের তৃষ্ণা নিবারণ এবং অসুস্থের ইয়াদাতকেও এ ধরনের মহিমাপূর্ণ ভাষায় ব্যক্ত করা হয়েছে। ঐ হাদীসে কুদসীর ভাষা ও উপস্থাপনার পরম মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে কবি আব্দুল কাদির একে কাব্যরূপ দান করেছেন-
হাশরের দিন বলিবেন খোদা- হে আদম সন্তান/তুমি মোরে সেবা কর নাই যবে ছিনু রোগে অজ্ঞান।/মানুষ বলিবে - তুমি প্রভু করতার,/আমরা কেমনে লইব তোমার পরিচর্যার ভার?/বলিবেন খোদা- দেখনি মানুষ কেঁদেছে রোগের ঘোরে,/তারি শুশ্রƒষা করিলে তুমি যে সেথায় পাইতে মোরে।/খোদা বলিবেন- হে আদম সন্তান,/ আমি চেয়েছিনু ক্ষুধায় অন্ন, তুমি কর নাই দান।/মানুষ বলিবে- তুমি জগতের প্রভু,/আমরা কেমনে খাওয়াব তোমারে, সে কাজ কি হয় কভু?/বলিবেন খোদা- ক্ষুধিত বান্দা গিয়েছিল তব দ্বারে,/মোর কাছে তুমি ফিরে পেতে তাহা যদি খাওয়াইতে তারে।/পুনরপি খোদা বলিবেন- শোন হে আদম সন্তান,/ পিপাসিত হয়ে গিয়েছিনু আমি, করাও নি জল পান।/মানুষ বলিবে- তুমি জগতের স্বামী,/তোমারে কেমনে পিয়াইব বারি, অধম বান্দা আমি?/বলিবেন খোদা- তৃষ্ণার্ত তোমা ডেকেছিল জল আশে,/তারে যদি জল দিতে তুমি তাহা পাইতে আমায় পাশে।
যাই হোক, আসল কথা হল, কুরআনে বান্দার প্রতি আল্লাহ তাআলার যে খিতাব, তার মাধুর্য উপলব্ধি করা ও আপ্লুত হওয়ার জন্যও তো হৃদয়ে কিছু প্রাণ ও স্পন্দন থাকতে হয়। নির্জীব নিষ্প্রাণ হৃদয় কীভাবে উপলব্ধি করবে এই আসমানী খিতাবের মাধুর্য।
সাহাবীগণের জীবনে কুরআনের প্রভাব
একদিকে ইহুদী পণ্ডিত স্রষ্টার এই অনুগ্রহকে ব্যঙ্গ করল অন্যদিকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী হযরত আবুদ দাহদাহ রা.-এর অবস্থা দেখুন : এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গ হোক! আল্লাহ তাআলা কি আমাদের নিকট ঋণ চাচ্ছেন? তাঁর তো ঋণের প্রয়োজন নেই। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন, আল্লাহ তাআলা এর বদলে তোমাদেরকে বেহেশতে প্রবেশ করাতে চাচ্ছেন। আবুদ দাহদাহ রা. একথা শুনে বললেন, আল্লাহর রাসূল! হাত বাড়ান। তিনি হাত বাড়ালেন। আবুদ দাহদাহ বলতে লাগলেন, ‘আমি আমার দুটি বাগানই আল্লাহকে ঋণ দিলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, একটি আল্লাহর রাস্তায় ওয়াকফ করে দাও এবং অন্যটি নিজের পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য রেখে দাও। আবুদ দাহদা বললেন, আপনি সাক্ষী থাকুন, এ দুটি বাগানের মধ্যে যেটি উত্তম- যাতে খেজুরের ছয় শ’ ফলন্ত বৃক্ষ রয়েছে, সেটা আমি আল্লাহর রাস্তায় ওয়াকফ করলাম। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এর বদলে আল্লাহ তোমাকে বেহেশত দান করবেন।
আবুদ দাহদা রা. বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে বিষয়টি জানালেন। স্ত্রীও তাঁর এ সৎকর্মের কথা শুনে খুশী হলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘খেজুরে পরিপূর্ণ অসংখ্য বৃক্ষ এবং প্রশস্ত অট্টালিকা আবুদ দাহদাহের জন্য তৈরি হয়েছে’। -আবু ইয়ালা, তবারানী-মাজমাউয যাওয়াইদ ৯/৩২৪, হাদীস ১৫৭৯২
দেখুন, কুরআন মাজীদের এক আয়াতে দুই শ্রেণির মানুষের মাঝে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া হল। যারা কাফির তাদের কুফর বৃদ্ধি পেল আর যারা মুমিন, যাদের অন্তরে রয়েছে ঈমানের আলো, তাদের ঈমান আরো বৃদ্ধি পেল।
আমাদের যাদেরকে আল্লাহ ঈমান নসীব করেছেন তাদের কর্তব্য, নিজের পথ চিনে নেওয়া এবং কারা আমাদের পূর্বসূরী তা স্মরণ করা। নতুবা গাফলত ও উদাসীনতা অনেক মুসলিমকেও ইহুদি-নাসারার পথে নিয়ে যেতে পারে। আল্লাহ হেফাযত করুন। এরপরের খিতাব-
দশম খিতাব-
يَا عِبَادِي إِنَّمَا هِيَ أَعْمَالُكُمْ أُحْصِيهَا لَكُمْ، ثُمَّ أُوَفِّيكُمْ إِيَّاهَا
হে আমার বান্দাগণ! আমি তোমাদের জন্য তোমাদের কর্মগুলো গুণে গুণে সংরক্ষণ করছি। এরপর তোমাদের তা বুঝিয়ে দেবো’।
فَمَنْ وَجَدَ خَيْرًا، فَلْيَحْمَدِ اللهَ وَمَنْ وَجَدَ غَيْرَ ذَلِكَ، فَلَا يَلُومَنَّ إِلَّا نَفْسَهُ
‘ঐ সময় যে উত্তম পরিণাম লাভ করবে সে যেন আল্লাহর শোকরগোযারি করে (আল্লাহই তাকে তাওফীক দিয়েছেন)। আর যে এর বিপরীত কিছু লাভ করে সে যেন নিজেকেই ভর্ৎসনা করে (কারণ এটা তার কর্মফল)।
দেখুন হাদীস শরীফের শব্দগত সৌন্দর্য। এখানে বলা হচ্ছে ‘غير ذلك ’(-এর বিপরীত কিছু) উত্তম পরিণামের বিপরীত হচ্ছে মন্দপরিণাম, অশুভ পরিণাম। কিন্তু মন্দ ও অশুভ কথাটা উচ্চারণ করাও পছন্দ করা হয়নি। তাই তো বলা হচ্ছে, ‘যে এর বিপরীত কিছু লাভ করে’।
এই হল এই হাদীসে কুদসীর সরল তরজমা ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা। এখান থেকে আমরা আল্লাহ পাকের কিছু ছিফাত ও বৈশিষ্ট্য জানতে পেরেছি এবং আমাদের কিছু করণীয় সম্পর্কেও জানতে পেরেছি। আমাদের কর্তব্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে জানা, তাঁর সিফাত ও গুণাবলীর পরিচয় লাভ করা এবং আমাদের তিনি যে হায়াতটুকু দান করেছেন তা ঈমান ও আমলে ছালেহের সাথে অতিবাহিত করা। তাহলে ইনশাআল্লাহ আমাদের জন্য শুভ পরিণাম অপেক্ষা করছে।
আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে বিষয়গুলো বুঝার এবং আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
(ধারণ ও লিখনে : আনাস বিন সা‘দ)