হযরত মাওলানা মুফতী আব্দুর রহমান ছাহেব রাহ. : কিছু স্মৃতি
বাদ হামদ ও সালাত!
আকাবিরের শুধু নাম শুনে নেওয়াও অনেক বড় সৌভাগ্য। আর যদি পরিচয় লাভ হয় তাহলে তো আরো বড় সৌভাগ্য! তার উপর যদি তার হেদায়াত ও খেদমত থেকে উপকৃত হওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়, তাহলে তো নূর আলা নূর, সোনায় সোহাগা। আর যদি তার সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় থাকে এবং তার সোহবতে ও যিয়ারতে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়, তাহলে তো কোনো কথাই নেই!!
আমি গ্রামের এক মাদরাসার (মাদারাসা আরাবিয়া খেড়িহর, শাহরাস্তি, চাঁদপুর) অধম তালিবুল ইলম। স্বভাবগতভাবেই আমি কিছুটা বেখবর মানুষ, তার সঙ্গে যদি যুক্ত হয় উদাসীনতার আরো বিভিন্ন কারণ, তখন এক কম বয়সী তালিবুল ইলমের জন্যে আর কতটুকু বাখবর হওয়া সম্ভব! তারপরও আমি আল্লাহর শোকর আদায় করি, শোকর আদায় করি আমার ওয়ালিদাইন মাজিদাইনের এবং মুশফিক আসাতিযায়ে কেরামের, তাদের তাওয়াজ্জুহের বরকতে ছাত্রজীবনের অধিকাংশ সময় বেখবর পরিবেশে কেটে যাওয়ার পরও দেশের এবং দেশের বাইরের নিকট অতীতের অনেক আকাবির এবং অনেক বাহায়াত আকাবিরের ব্যাপারে আমার ইলম হাসিল হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমার ওয়ালিদাইনকে, আমার সকল আত্মীয় মুরুব্বিকে, আমার বড় ভাইকে এবং আমার সকল আসাতিযাকে নিজের শান মোতাবেক আজর দান করুন। তাদের তরবিয়ত ও তাওয়াজ্জুহের বরকতেই আমি আকাবিরের ব্যাপারে ইলম হাসিল করতে পেরেছি, অন্তরে আকাবিরের মুহাব্বত নিয়ে বড় হতে পেরেছি। তাদের সোহবত ও তরবিয়তের বরকতে অন্তরে এসকল বিষয় গেঁথে গেছে-
১. প্রত্যেক যুগের আকাবিরে উম্মত ইলমের সে সকল ধারক-বাহকদের অন্তর্ভুক্ত, যাদের মাধ্যমে আল্লাহ দ্বীন ও শরীয়তের সিলসিলা জারি রেখেছেন। সুন্নত যিন্দা রেখেছেন। শিরক-বিদআত কুফর ইলহাদ এবং সকল বাতিলকে হক থেকে পৃথক করে দিয়েছেন।
২. শরীয়তের পাবন্দ, সুন্নাতের অনুসারী আকাবিরে উম্মত আমাদের আদর্শ। তাদের হালকায় শামিল থাকা, তাদের সাথে নিজের নিসবত যুক্ত রাখা, এবং সেই নিসবতের লাজ রক্ষা করা- এতেই আমাদের সৌভাগ্য। নির্বুদ্ধিতার শিকার হয়ে অতি ইলমের বা অতি হিদায়াতের ধোঁকায় পড়ে তাদের ‘হালকা’ থেকে যদি কেউ দূরে চলে তাহলে -আল্লাহ পানাহ- এতে নিজেরই ক্ষতি। এ অবস্থায় যদি কোনো সহীহ খেদমতও হয়, তাহলেও তা বরকত ও মকবুলিয়াত থেকে মাহরুম থাকে।
৩. আকাবিরের কোনো এক ব্যক্তি ভিন্নভাবে মাসুম নন, কিন্তু আকাবিরের সকল ফরদ এমন, যার মধ্যে খায়ের ও নেকির দিকটাই প্রবল। তথাপি মাসুম নয় এমন ব্যক্তি থেকে কখনো কোনো ভুল প্রকাশ পাওয়া বা কোনো বিষয়ে কিছু বাড়াবাড়ি বা শৈথিল্য হয়ে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। এক্ষেত্রে শরীয়তের হুকুম হল, ভুলের ক্ষেত্রে কারো তাকলীদ করা যাবে না। এবং কারো ‘তাসামুহে’র কারণে ‘রাহে ইতিদাল’ পরিত্যাগ করা যাবে না। আবার ভুল বা তাসামুহের কারণে আকাবিরদের থেকে ইস্তিফাদা বন্ধও করা যাবে না। এতে নিজেরই ক্ষতি। আর তাদের কারো সাথে বেআদবীর অর্থ হল, নিজের দ্বীন ও ঈমান এবং নিজের আখেরাতকে বরবাদ করা। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন।
نَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الحَوْرِ بَعْدَ الكَوْرِ
৪. এটা স্পষ্ট যে, কোনো এক ব্যক্তির জন্যে নিজের ইলমী ও ইসলাহী তাআল্লুক সকলের সাথে রাখা মুশকিল। তবে হাঁ, আযমত ও মুহব্বত সকল আকাবিরের প্রতি থাকা জরুরি। এখানে অনেকে ভুল করে ফেলে। তারা ইত্তেবা ও তাআল্লুুক এবং আযমত ও আদবকে এক বানিয়ে ফেলে। অথচ এ বিষয়গুলোর মাপকাঠি হুবহু এক নয়। হাকীমুল উম্মত ও অন্যান্য আরো আকাবিরের বারবার তাকীদ করা একটি নসীহত আমাদের মনে রাখা দরকার। তা হল, নিজের আমলী মুরুব্বী বা ইসলাহী মুরুব্বীর তাহকীক ও যাওকের উপর আমার আমল করা উচিত। কিন্তু যে মাসআলায় আকাবিরদের মাঝে ইজতেহাদী ইখতেলাফ রয়েছে, বা যে বিষয়ে তাদের মাঝে যওকের ভিন্নতা রয়েছে, আমার জন্যে উচিত নয়, আমার ইসলাহী বা ইলমী মুরুব্বীর যওক অন্য কোনো বুযুর্গ বা তার অনুসারীর উপর চাপিয়ে দেব। এবং কারো এই অধিকারও নেই যে, শুধু যাওকী ও ইজতেহাদী ইখতেলাফের কারণে কোনো মুরুব্বীর নিন্দা করবে। আর গীবত ও সমালোচনা কারো ক্ষেত্রেই জায়েয নেই।
৫. আমাদের বড়রা আমাদেরকে এ শিক্ষাও দিয়েছেন যে, আমরা যেন ‘মুশাজারাতে আকাবিরে’র ক্ষেত্রে ‘মুশাজারাতে সলফে’র পন্থাই অবলম্বন করি। মুতাকাদ্দিমীনের মধ্যে ইবনে আবদুল বার ‘জামিউ বায়ানিল ইলমে’, এর পরবর্তী যুগে তাজুদ্দীন সুবকী ‘তবাকাতে শাফিইয়্যার’ মধ্যে এবং নিকট অতীতে শায়খুল হাদীস মাওলানা যাকারিয়া কান্ধলভী রাহ. ‘আল ইতিদাল’ ও ‘তাকমিলাতুল ইতিদাল’-এ এই কায়দা ও আদাব উল্লেখ করেছেন এবং তা গুরুত্বের সাথে ধারণের তাকিদ করেছেন।
আমি আমার আসাতিযা ও মুরুব্বীদের দিল থেকে শোকরিয়া আদায় করছি যে তারা ইত্তেবায়ে আকাবিরের ক্ষেত্রে আমাদেরকে এই ‘সিরাতে মুসতাকীমের’ রাহনুমায়ী করেছেন এবং তার উপর দৃঢ় থাকার তালকীন করেছেন। ভূমিকাটি লম্বা হয়ে গেল কিন্তু মনে হয়, বেফায়দা হয়নি, ইনশা আল্লাহ, এর থেকে কর্মজীবনের অনেক ক্ষেত্রে উপকার পাওয়া যাবে।
আকাবিরের অস্তিত্বই অনেক বড় নিআমত। তাদের কারো আখেরাতের সফরে রওয়ানা হয়ে যাওয়া জীবিতদের জন্যে অনেক বড় বিপদ। আরবীতে এই প্রবাদ প্রসিদ্ধ হয়ে গেছে- আলিমের মৃত্যু আলমের মৃত্যু। যোগ্য লোকের অভাবের এই যুগে বড় বড় ব্যক্তি তো এমনিতেই হাতে গণনা করার মত। ওদিকে দু’চার জন যারা আছেন তারাও একের পর এক বিদায় নিচ্ছেন। এবং অবস্থা এই যে, যিনি যাচ্ছেন, তার জায়গা পূরণ হওয়ার কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে না। আফসোস! আকাবিরের কাফেলার অনেক বড় ব্যক্তিত্ব হযরত মাওলানা মুফতী আব্দুর রহমান ছাহেব গত সপ্তাহে বিদায় নিয়ে গেলেন।
إنا لله و إنا إليه راجعون، إن لله ما أخذ و له ما أعطى و كل شيء عنده بمقدار.
হযরতের মাঝে আল্লাহ তাআলা অনেক গুণের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা তাকে দান করেছেন বৈচিত্রময় কর্মজীবন। ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর খেদমত করেছেন তিনি অনেক দিক থেকেই। তার খেদমতের ময়দান ছিল অনেক বিস্তৃত। যেসকল ওলামায়ে কেরাম তাকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন, তার কর্ম ও কীর্তির উপর তারাই লেখার সবচেয়ে হকদার। আমি একজন তালিবুল ইলম। শুধু বরকত হাসিলের জন্যে হযরতের সঙ্গে আমার কিছু স্মৃতির কথা আলোচনা করব।
আমি আগেই বলেছি, আমি স্বভাবগতভাবেই কিছুটা বেখবর। এবং প্রায় বেখবর মাহাওলেই আমার বেড়ে ওঠা। সম্ভবত ১৪০৬ হিজরী সনে সর্বপ্রথম আমি ওয়ালিদ ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম থেকে হযরত মুফতী ছাহেবের নাম শুনি। তখন আমি খেড়িহর মাদরাসার তালিবুল ইলম। সে বছর দারুল উলূম হাটহাজারীর সাবেক মুহতামিম হযরত মাওলানা হামেদ ছাহেব রাহ.-এর উদ্যোগে শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম ও দেশের প্রায় সকল মাদরাসার মুহতামিম ও নাযিমে তালিমাতকে নিয়ে একটি পরামর্শসভা আয়োজন করা হয়। যদ্দুর মনে পরে, এর বিষয়বস্তু ছিল তালিম ও তারবিয়াত এবং ইসলাহী খেদমতের ক্ষেত্রে মাদরাসাগুলোর উন্নতির বিষয়ে মুযাকারা ও মাশওয়ারা, ওয়ালিদ ছাহেব সেই মজলিসে যোগদান করেছিলেন। তিনি ওখান থেকে ফেরার পর সেখানকার কিছু কারগুযারী শোনাচ্ছিলেন। যতটুকু মনে পড়ে তখন সর্বপ্রথম হযরত মুফতী আবদুর রহমান ছাহেব রাহ.-এর নাম শুনি। কিন্তু আমার বেখবরীর হালত দেখুন, হযরতের ব্যাপারে বিস্তারিত জানি তারও আরো অনেক পরে -যখন আমি রিয়াদে- বেরাদারে মুহতারাম মাওলানা রিযওয়ানুর রহমান ইবনে হযরত প্রফেসর হামীদুর রহমান থেকে। হযরতের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ তার মাধ্যমেই হয়। ১৪১৬ হি. রজব মাসে শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ.-এর ওখান থেকে দু’মাসের জন্যে দেশে আসি, কিন্তু দ্বিতীয়বার আবার শায়খের খেদমতে যাওয়ার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হই। ১৪১৬ শাবানে হযরত ওয়ালিদ ছাহেব দা. বা. এবং করাচীর কয়েকজন আকাবিরের পরামর্শে ভাই ছাহেব কয়েকজন মুহিব্বীনসহ মারকাযুদ দাওয়াহ প্রতিষ্ঠার চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এবং আমাকেও তাতে শামিল করে নেন। এখানে ওয়াদাবদ্ধ হওয়ার পর ১৪১৬ রমযানুল মুবারকে মাওলানা রিযওয়ানুর রহমান যীদা মাজদুহুম-এর মাধ্যমে হযরত মুফতী ছাহেবের পয়গাম পৌঁছে। রিযওয়ান ভাই আমাকে নিয়ে গেলেন। সেই সাক্ষাতে হযরত সুধারণাবশত মারকাযুল ফিকরীল ইসলামীতে উলুমুল হাদীসের খেদমতের দাওয়াত দেন। হযরতের মত জালিলুল কদর উচুঁ মরতবার বুযুর্গ ও অভিজ্ঞ লোকের ছায়ায় খেদমতের সুযোগ কত উপকারী এবং অন্তর প্রশান্তকারী তা বলা বাহুল্য। কিন্তু আমি যেহেতু পূর্ব থেকে ওয়াদাবদ্ধ ছিলাম, তাই মাযিরাত করা ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না। হযরতও খুব স্পষ্ট ভাষায় বললেন, আমি চাই বাংলাদেশে ইলমে হাদীসের চর্চা হোক, শুধু আমার এখানেই হবে এটা জরুরি নয়। আপনি যেখানেই মাদরাসা করেন এবং এই ফনের চর্চা করেন কোনো বাধা নেই। আমার যদি সম্ভব হয়, আমি পাঁচ টাকা দিয়ে হলেও আপনার সহযোগিতা করব। সত্যি বলতে কি বড়দের কথাও অনেক বড় হয়। ঐ সাক্ষাতে হযরতের কাছে এ তথ্যটিও পেয়েছি যে, হযরত যে বছর দারুল উলূম দেওবন্দে দাওরা শেষ করলেন, সে বছর দারুল উলূমে সর্বপ্রথম তাকমীলে ইফতার বিভাগ খোলা হয়। এবং হযরত ও তার সাথীরাই এই বিভাগের প্রথম ছাত্র। যদ্দুর মনে পড়ে হযরত ১৯৫১ সনের কথাই বলেছেন। এতে বোঝা যায়, দ্বীন, ইলমে দ্বীন, ইসলাম ও উম্মতে মুসলিমার কল্যাণে হযরতের খেদমতের ব্যাপ্তি ষাট বছরেরও কিছু অধিক কাল।
তারপর দেখাসাক্ষাতের ধারাবাহিকতা চলতে থাকে। আমার নির্ধারিত ব্যস্ততা খুব বেশী বেড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বারবার সেখানে হাযির হওয়ার সৌভাগ্য হত। তার বয়ান থেকে ইস্তিফাদা করার সুযোগ হত। একসময় বেরাদারে আযীয মুসলেহুদ্দীন আহমাদ রুমি (হাজী নাজিমুদ্দীন ছাহেব রাহ.-এর ছোট ছাহেবযাদা) মারকাযুল ফিকরীল ইসলামীর জামে মসজিদে তারাবীতে কুরআন খতম শোনাত। আমি খতমের রাতে সেখানে তারাবীহ পড়তাম এবং হযরতের বয়ান ও মর্মস্পর্শী দীর্ঘ মোনাজাত থেকে উপকৃত হতাম। যাত্রাবাড়ীতে কয়েকবার দাওয়াতুল হকের মজলিসে হযরতের বয়ান শুনেছি। একবার এমন হয়েছে যে, বয়ানের আগে কেউ এলান করতে চাচ্ছিল। হযরত তার থেকে স্পীকার নিয়ে বললেন, এলানের কি দরকার! এলান করতে গেলে তো শুধু নাম নয়, নামের সাথে ফকীহুল মিল্লাত এবং আরো কত কী বলবেন! এটাও হযরতের বড়ত্বের একটি দলীল।
যাত্রাবাড়িতে একবার হযরত জনসাধারণের উদ্দেশ্যে বয়ান করতে গিয়ে এটাও বলেছেন যে, আপনারা যে সুন্নতের শিক্ষা গ্রহণ করছেন, যদি কোনো আলিমকে তার খেলাফ আমল করতে দেখেন তাহলে ধরে নিবেন, এটা হয়ত কোনো ওযরের কারণে করেছেন। যদি এমন না করে তার উপর বদগুমানী করেন তাহলে তা আপনার জন্যে ক্ষতির কারণ হবে। সুন্নতের তালীম ও তাবলীগ থেকে যতটুকু অর্জন করলেন, তা বরবাদ হয়ে যাবে।
হযরতের এই কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই এ বিষয়টি খেয়াল করে না। আর অনেকের তো একথা জানাই নেই যে, অনেক জায়গায় মাসনুন তরীকাই থাকে একাধিক। অর্থাৎ খোদ হানাফী মাযহাবেই একাধিক পদ্ধতি রয়েছে। সহজ হওয়ার কারণে অথবা নিজের কাছে রাজেহ মনে হওয়া কারণে কোনো বুযুর্গ যদি কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করেন, তাহলে অনেকে না জানার কারণে অন্য পদ্ধতি অবলম্বনকারী বুযুর্গের ব্যাপারে মন্দ ধারণা করে এবং কখনো কটু কথাও বলে যা একেবারেই ভুল।
মারকাযুল ফিকরিল ইসলামী থেকে প্রকাশিত হযরতের মালফুযাত এবং ‘মামুলাতে মাছুরা’ থেকেও ইস্তিফাদা করেছি। কুরআনী মক্তবের গুরুত্ব, তালীমে কুরআন, তাসহীহে কুরআন এবং তাযীমে হামিলীনে কুরআন বিষয়ক হযরতের মালফুযগুলো অনেক ভাল লেগেছে। সেখানে জরুরি এবং মুফিদ অনেক কথাই রয়েছে। যেহেতু কিতাবগুলো ছাপানো এবং প্রকাশিত, তাই এখানে কিছু উদ্ধৃত করলাম না।
আজ থেকে প্রায় বার তের বছর আগের কথা। সেন্ট্রাল হাসপাতালে হযরতের পায়ে অপারেশনের পর শুকাতে দেরি হচ্ছিল। দীর্ঘ সময় হযরতকে হাসপাতালে থাকতে হয়। অবশেষে চিকিৎসার জন্যে হযরত দুবাই তাশরীফ নিয়ে যান। কয়েক মাস পর যখন হযরত ফিরে আসেন তখন মাওলানা রিযওয়ানুর রহমান ও মাওলানা হাবীবুর রহমান খানের সাথে আমিও হযরতের ইয়াদাতে যাই বসুন্ধরা মারকাযুল ফিকরীল ইসলামীতে। অনেক লম্বা সময় মজলিস হয়। হযরতও খুব প্রফুল্ল ছিলেন। তখন হযরত একটা কথা বলেছিলেন- ডাক্তার আমাদের দেশেও আছে এবং ওখানেও আছে। কিন্তু এখানে কমার্শিয়াল মনোভাব বিস্তার লাভ করেছে আর ওখানে খেদমতের মেযাজ এখনো বাকি আছে। হযরত আরো বলেছিলেন, আমার ডাক্তার সর্বদাই আমার খবর নিতেন। হাসাপাতালে ভর্তি হওয়ার পর যখন প্রথম জুমাবার হল, তখন আমি মনে করেছিলাম, আজ ডাক্তার আসবেন না। কিন্তু দেখা গেল অন্যান্য দিনের মত যথা সময়ে ডাক্তার আসলেন। এবং পরে নিয়মিত আসতেই থাকলেন। ঈদের দিন মনে হল, আজ তো কোনো ক্রমেই আসবেন না। কিন্তু দেখা গেল, সেদিনও সময়মত ডাক্তার উপস্থিত!
যখন লেখা শুরু করলাম, তখন মনে হয়েছিল, হযরতের সাথে আমার স্মৃতি কয়টাই বা হবে। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি- একের পর এক টুকরো টুকরো অনেক স্মৃতিই মনে পড়ছে। তাই আজ এখানেই কলম থামিয়ে দিতে চাই।
হযরত রাহ. সেই সকল বুজুর্গদের একজন যাদেরকে আল্লাহ দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ সকল ময়দানে খেদমতের তাওফীক দান করেছেন। তালীম ও তারবিয়াত, দাওয়াত ও তাবলীগ, সুলুক ও ইহসান, এবং খেদমতে খলক- সকল ময়দানেই তাঁর খেদমত ছিল বিস্তৃত। হযরতের অনেক বড় একটি খেদমত ছিল, হযরত সকল শ্রেণীর লোকের কথা শুনতেন। তাদের সমস্যাবলী শুনে তাদেরকে নেক মশোয়ারা দিতেন। কত পেরেশানহাল লোক তার ছায়ায় গিয়ে সুকুন ও ইতমিনান হাসিল করেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ইলম ও আকল, ফাহম ও ফিরাসাত, এবং ¯েœহ-ভালবাসার অধিকারী আল্লাহওয়ালাদের সোহবতেই কেবল এই দৌলত হাসিল হতে পারে। মারকাযুল ফিকরীল ইসলামী তাঁর সকল খেদমতের জন্যে কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান ছিল। এই প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের আমলী তরবিয়তের উপর বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়। এটা আমাদের জন্যে একটি আদর্শ। ইনশাআল্লাহ এই প্রতিষ্ঠান এবং হযরতের অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠান ও দ্বীনী খেদমত সাদাকায়ে জারিয়া হিসাবে কেয়ামত পর্যন্ত বাকি থাকবে। আমরা আশা করব, মারকাযুল ফিকরিল ইসলামীর দায়িত্বশীলগণ হযরতের জীবনীর উপর শায়ানে শান কাজ করবেন। হযরতের গুণাবলী এবং খেদমত আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে শুধু কোনো স্মারকই নয় বরং স্বতন্ত্র গ্রন্থ প্রকাশ করা হবে। আর ‘আল আবরারে’র বিশেষ সংখ্যা তো বের হবেই।
আমার জন্যে অনেক বড় সৌভাগ্য। ইন্তিকালের প্রায় এক মাস আগে প্রফেসর হযরত হামীদুর রহমান ছাহেব দামাত বারাকাতুহুমের সাথে হযরতের ইয়াদাতের সৌভাগ্য হয়। হযরতের ছাহেবযাদাগণ এবং মাদরাসার অন্যান্য উস্তাযগণের সাথে সাক্ষাৎ হয়। হযরত তখন আরাম করছিলেন। তাই আমরা শুধু দুআ পড়ে চলে আসি।
গত ২৭ মুহাররম ১৪৩৭হি. মোতাবেক ১০ নভেম্বর ২০১৫ ঈ. মঙ্গলবার এশার আগে মারকাযুদ দাওয়ার কেন্দ্রীয় দফতর থেকে এক ভাই ফোনে জানালেন যে, এই কিছুক্ষণ আগে হযরত আখেরাতের সফরে রওয়ানা হয়ে যান।
إنا لله و إنا إليه راجعون، إن لله ما أخذ و له ما أعطى و كل شيء عنده بمقدار.
বুধবার সকালে হযরতের জানাযায় হাজির হলাম। জানাযায় অনেক লোকের ভীড় ছিল। অনেক লোক যানজটের কারণে গাড়িতেই আটকা পড়ে গেল। জানাযার নামায পড়ান হযরতওয়ালার বড় ছাহেবযাদা মুফতী আরশাদ রাহমানী ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম। দাফন হয় বসুন্ধরার নতুন কবরস্তানে। আল্লাহ তাআলা হযরতওয়ালাকে মাগফেরাতের চাদরে ঢেকে নিন! তাঁর দারাজাত বুলন্দ করুন! তাকে আ‘লা ঈল্লীয়্যীনে স্থান দিন! তাঁর প্রতিষ্ঠান ও খেদমতগুলোকে সমৃদ্ধির সাথে স্থায়ী করুন! পরবর্তীদেরকে (যাদের মধ্যে হযরতের আওলাদ ও আত্মীয়স্বজনের সাথে সকল মুতাআল্লিকীন মুহিব্বীন অন্তর্ভুক্ত) সবরে জামীলের তাওফীক দান করুন। আমীন!
১৩ সফর ১৪৩৭হি.