তা‘লীমের সাথে তাবলীগের এক বাস্তব উদাহরণ : হযরত মাওলানা আবদুল আযীয রাহ.
বৃহত্তর নোয়াখালীর যে কোনো মাদরাসায় শর্শদী মাদরাসার লাকসামের হুযুরকে চেনে না বা তাঁর নাম শোনেনি, এমন আলেম বা ছাত্র মনে হয় খুব কমই পাওয়া যাবে। তাঁর আসল নাম হয়ত অনেকেই জানে না, কিন্তু লাকসামের হুযুর বললে মানসপটে যে ছবিটি ভেসে ওঠে তা একজন নিরলস মোবাল্লেগ উস্তাযের ছবি। আমাদের অনেকেই মাদরাসার উস্তায হিসেবে খেদমত করার সৌভাগ্য লাভ করেছেন এবং উস্তায হিসেবে সফলতাও অনেকে লাভ করেছেন। আবার অন্যদিকে আমাদের অনেকে তাবলীগের সাথে জড়িত হয়ে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজও ভালোভাবে হয়ত আঞ্জাম দিচ্ছেন, কিন্তু তালীম ও তাবলীগের সফল সমন্বয়ের বিষয়টি খুবই বিরল। আমার জানামতে শর্শদী মাদরাসার মরহুম হযরত মাওলানা আবদুল আযীয ছাহেব (লাকসামের হুযুর) বড় সমন্বয়ধর্মী ব্যক্তিত্বের অধিকারী। যিনি তাঁর শিক্ষকতার মহান দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে তাবলীগ ও দাওয়াতের কাজটিও আঞ্জাম দিয়ে গেছেন। তাঁর শিক্ষকতা জীবনের পুরো ৪৫/৪৬ বছর একই মাদরাসায় কাটিয়ে দিয়েছেন। এই সুদীর্ঘ তালীমি জীবনে তিনি মনে হয় একটি দিনও তাবলীগ বা দাওয়াতী কাজ ব্যতীত ব্যয় করেননি। তালীম-তাদরীসই তার প্রধান কাজ ছিল। সঙ্গে তাবলীগের কাজেও যুক্ত থাকতেন। আমার বক্তব্যে ‘মনে হয়’ শব্দটি বলতে হল এজন্য যে, কখনো আমার শর্শদী মাদরাসায় পড়ার সুযোগ হয়নি। তবে ফেনীর প্রসিদ্ধ দুই বড় মাদরাসার অন্যতম ওলামাবাজার মাদরাসায় দীর্ঘ ছ’টি বছর পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। ফলে শর্শদী মাদরাসার খবরা-খবর আমরা সবসময় পেয়েই যেতাম। শর্শদী মাদরাসায় পড়া-লেখার সুযোগ হলে হয়ত ‘মনে হয়’ শব্দটি উচ্চারণ না করে নিশ্চিত ধরনের কোনো শব্দ প্রয়োগ করতে পারতাম।
লাকসামের হুযুরের খুব প্রিয় ছাত্র মরহুম মাওলানা আবদুল কাইয়ুম ছাহেব শর্শদী মাদরাসায় মেশকাত বা উলার জামাত সমাপ্ত করে সেখানে দাওরা বা তাকমীল না থাকায় দাওরা পড়ার জন্য ওলামাবাজার মাদরাসায় ভর্তি হয়েছিলেন। আমি তাঁর দু/এক জামাত নিচে থাকলেও তাঁর সাথে আমার খুব আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। লাকসামের হুযুর সম্পর্কে সর্বপ্রথম মনে হয় তাঁর কাছ থেকেই জানতে পেরেছি। তিনি তাঁর ঐ ছাত্রজীবনেই তাঁর প্রিয়তম উস্তাযের হুবহু অনুসারী ছিলেন। তিনিও তাবলীগের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দাওরার সবকের এত ব্যস্ততার মাঝেও দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ তাঁর কখনো ছুটত না। আমার স্পষ্ট মনে পড়ছে, একবার বৃহত্তর নোয়াখালীর মারকায চৌমুহনী মারকাযে তাবলীগের জোড় ছিল। আবদুল কাইয়ুম ছাহেব আমাকে নিয়ে এশার পর ওলামাবাজার মাদরাসা থেকে পায়ে হেঁটে চৌমুহনী রওয়ানা করেছিলেন। নদী পার হয়ে দাগনভুঁইয়া যখন আমরা এসে পৌঁছি, ততক্ষণে বাস সার্ভিস বন্ধ হয়ে যাওয়াতে দাগন ভুঁইয়া থেকে পাকা রোড ধরে আমরা দুজন সোজা চৌমুহনী চলে যাই। নিশিরাতে জোড়ে নাম কা ওয়াস্তে শরীক হয়ে আবার দুজন পাকা রোড ধরে হাঁটা আরম্ভ করলাম। ওলামাবাজার থেকে চৌমুহনী ঐ পথে ২৫ মাইলের কম হবে না হয়ত। আমরা দুজন ২৫ মাইল করে আসা-যাওয়াতে প্রায় ৫০ মাইল পথ পায়ে হেঁটে জোড়ে শরীক হয়ে আবার ফযরের আগেই মাদরাসায় উপস্থিত হয়েছিলাম। কারণ, ফজরের পর পরই তাঁর দাওরায়ে হাদীসের সবক ছিল। ছাত্র যদি এমন হয়, তাহলে তাঁর প্রিয় ওস্তায কেমন ছিলেন তা সহজেই অনুমান করা যায়।
মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম ভাই সারাটি জীবন এ শর্শদী মাদরাসায়ই শিক্ষকতা করেন। উস্তায-শাগরেদ মিলে তালীম ও তাবলীগের কাজ সবসময় চালিয়ে গেছেন। দু-এক বছর পূর্বে ফেনীতে মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম ছাহেবের ছেলের সাথে পরিচয় হওয়াতে তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারলাম, কয়েক বছর আগে তিনি তাঁর মাওলাপাকের ডাকে সাড়া দিয়ে প্রিয় উস্তাযের পূর্বেই পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। মহান আল্লাহ পাক তাঁর মাগফিরাত নসীব করুন এবং বেহেশতে উচ্চ মাকাম দান করুন। আমীন।
লাকসামের হুযুরের অভ্যাস ছিল, প্রতিদিন আছর অথবা ফজরের নামায এলাকার কোনো না কোনো মসজিদে গিয়ে পড়া এবং সেখানের মুসল্লীদের নিয়ে দ্বীনী আলোচনা করা এবং দাওয়াতী কাজে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করা। সমগ্র জীবনটাই তাঁর এভাবে কেটে যায়। ফলে তাঁর এলাকায় দূর-দূরান্ত পর্যন্ত গণমানুষের সাথে তাঁর একটা আত্মার সম্পর্ক হয়ে যায়। সাধারণ মানুষ তো বটেই; চোর, বদমাইশ-গুণ্ডা পর্যন্ত তাঁকে দেখলে অন্তর থেকেই সম্মান প্রদর্শন করত। ফলে গণমানুষের ওপর দ্বীনের একটা প্রভাব সবসময় বিস্তার করে থাকত। মানুষের সাথে দ্বীনী এই সম্পর্কের কারণে মাদরাসার সাথেও মানুষের একটা সুসম্পর্ক সবসময় বিদ্যমান থাকত।
তালীম জরুরি, নাকি তাবলীগ বেশি জরুরি- এ বিষয়ে ‘মাজালিসে হাকীমুল ইসলাম’ গ্রন্থে হাকীমুল ইসলাম ক্বারী তৈয়ব ছাহেব রাহ.-এর সুদীর্ঘ এক আলোচনা কয়েক পাতাব্যাপী বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে হযরত রাহ.-এর ভাষণের যে নির্যাস বেরিয়ে এসেছে তা হচ্ছে, তালীমের মাকসাদ বা উদ্দেশ্য হচ্ছে তাবলীগ। আর তাবলীগের উদ্দেশ্য হচ্ছে, তালীম। যে তালীমের পরে তাবলীগ থাকবে না তা সত্যিকারে তালীম নয়। আর যে তাবলীগের পরে তালীম আসবে না তাও সত্যিকারের তাবলীগ হবে না। অর্থাৎ তালীম আর তাবলীগ একে অপরের সম্পূরক বিষয় এবং একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।[1]
তাবলীগের অন্যতম মুরব্বী মরহুম হযরত মাওলানা লুৎফুর রহমান ছাহেবের সাথে একদিন কাকরাইল মসজিদে বসে আলোচনা করছিলাম। আমি বললাম, হুযুর! তালীম-তাবলীগ দুটিই যখন জরুরী তখন প্রতিটি মাদরাসায় এমন করলে কেমন হয়? যখন মাদরাসায় বেতন-ভাতা দিয়ে মোহাসসেল বা চাঁদা উসুলকারী রাখার নিয়ম রয়েছে তখন প্রতিটি মাদরাসায় একজন করে মোবাল্লেগ রাখলে ক্ষতি কী? চার মাস-তিন চিল্লা করে একেকজন চিল্লা শেষ হলে আরেকজন বেরিয়ে পড়বেন। যিনি তাবলীগে যাবেন তার কিতাবগুলো অতিরিক্ত শিক্ষক বা মুইনুল মুদাররিসের দ্বারা চালানো হবে। তাহলে ‘বাই রোটেশন’ একটি মাদরাসার প্রতিটি উস্তাযেরই তাবলীগের সাথে জড়িত হবার সুযোগ হয়ে যাবে। এতে করে তাবলীগে আসা সাধারণ মানুষ যেমন এই আলেমের মাধ্যমে উপকৃত হবে তেমনি ঐ আলেম ছাহেবেরও তাবলীগি দায়িত্ব আদায় হয়ে যাবে। সাথে সাথে সাধারণ মানুষ ও আলেম সমাজের মাঝে একটা দ্বীনী সম্পর্ক গড়ে উঠবে। এখন তো আমরা নিজ দেশে থেকেও পরবাস জীবন অতিবাহিত করছি প্রায়।
আমার প্রস্তাব শোনার পর হযরত মাওলানা লুৎফুর রহমান ছাহেব বললেন, আমরা তো হুব-হু এটাই চাই। তবে তিন চিল্লার পরিবর্তে এক বৎসরের কথা বলি। কারণ, একজনের কিতাব অন্যজন পড়ালে কিছু সমস্যা সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই বলি, এক বৎসরের জন্যই একেকজন বেরিয়ে যাক, তাতে কিতাবের সমস্যা যেমন থাকবে না তেমনি প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষ এক বৎসরের জন্য আরেকজন শিক্ষকের নিয়োগও দিতে সক্ষম হবেন। এভাবে একেকজন করে একেকটি মাদরাসার সব কজন উস্তাযই তাবলীগের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন।
আমার এই প্রস্তাব দু একটি বড় মাদরাসায় বাস্তবায়ন করার ব্যাপারেও আমি বলেছিলাম। দক্ষিণ চট্টগ্রাম হীলা বড় মাদরাসার মাননীয় মুহতামিম মরহুম মঞ্জুর ফকির ছাহেবকে বলায় তিনি খুব খুশি মনেই তা বাস্তবায়ন করার প্রোগ্রাম হাতে নেবেন বলে আমাকে জানান। তাঁর মৃত্যুর পর এখন তা কী অবস্থায় আছে তা আমার জানা নেই।[2] ইদানিং আমার এই প্রস্তাবের ওপর দলিলও পেয়ে গেলাম। আমার পড়ার টেবিলে আমার মুতালাআয় যে কিতাবটি আছে, তা হচ্ছে হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.-এর বয়ান-বক্তব্যের সংকলন ‘আল ইলমু ওয়াল উলামা’ কিতাবটি। সময় পেলেই সেখান থেকে পড়তে থাকি। কদিন আগে দেখলাম, হযরত থানভী রাহ. অত্যন্ত জোরালো ভাষায় বেশ কয়েকটি বক্তব্য বলেছেন। প্রতিটি মাদরাসায় নিয়োগপ্রাপ্ত একজন মুবাল্লেগ থাকা জরুরি। যার কাজই হবে শুধু আম-জনতাকে দ্বীনের দিকে আহ্বান করা ও তাদেরকে দ্বীন শেখানো। এই ওয়াজ বা তাবলীগের জন্য কোনো রকম বিনিময় তো দূরের কথা হাদিয়া-তোহফাও নেয়া উচিত হবে না। এমনকি মাদরাসার জন্য চাঁদা বা টাকাও উসূল করা ঠিক হবে না। কেউ যদি স্বেচ্ছায় মাদরাসায় দান করতে চায় তাকে মাদরাসার ঠিকানা বলে দেবে এবং সরাসরি মাদরাসায় পাঠিয়ে দেয়ার কথা ঐ মোবাল্লেগ ছাহেব বলে দিবেন। এতে মাদরাসার চাঁদা আরো বৃদ্ধি পাবে এবং বিনিময় ছাড়া তাবলীগ করার কারণে জনগণের ওপর তার প্রভাব পড়বে অনেক বেশি। মাদরাসা কর্তৃপক্ষকে মনে করতে হবে, এই মোবাল্লেগ ছাহেবও মাদরাসারই একজন উস্তায। অন্যরা হলেন খাছ কিছু ছাত্রদের উস্তায। আর তিনি হলেন আম-জনতার উস্তায। এটাও মাদরাসার উদ্দেশ্যের মধ্যেই শামিল। বরং পঠন-পাঠন তো এ-ই তাবলীগেরই ভ‚মিকা স্বরূপ। আসল মাকসাদ তো তাবলীগ। যা সমস্ত নবী-রাসূলদের সুন্নত।
হযরত রাহ. আরো বলেন, চাঁদা উসুলকারী মুহাসসেল আলাদাভাবেই থাকবে। আর এই মুবাল্লেগ আলাদা থাকবে। মাদরাসা যদি বড় হয়, যেমন দেওবন্দ মাদরাসা, তাহলে মাদরাসার পক্ষ থেকে প্রতিটি এলাকায় একাধিক মুবাল্লেগ থাকা চাই। হযরত আরো বলেন, এটা একটা প্রভাব বিস্তারকারী কার্যকরি ফর্মূলা। মাদরাসার চাঁদা বেশি হওয়ার ব্যাপারে কারো সন্দেহ থাকলে তা বাস্তবায়ন করে পরীক্ষামূলকভাবে হলেও দেখতে পারেন। যদি কার্যকরি না হয় তবে বন্ধ করে দেওয়ার এখতিয়ার তো আছেই। -আল ইলমু ওয়াল উলামা পৃ. ১০৬-১০৮
প্রস্তাবের স্বপক্ষে হযরত থানভী রাহ.-এর এই জোরদার বক্তব্য দেখে মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জ্ঞাপন করলাম।
আমাদের আলোচ্য ব্যক্তিত্ব হযরত লাকসামের হুযুর রাহ. আরো একধাপ ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি ভ‚মিকা ও উদ্দেশ্য দুটোকে একসাথে চালিয়ে দেখিয়ে গেছেন। [3]
কাকরাইল মসজিদ ও বিশ্ব ইজতেমার মাঠে ওলামাদের ক্যাম্পে মাত্র কয়েকবার তাঁর সাথে সাক্ষাৎ ও কথা বলার সুযোগ আমার হয়েছে। বড় সদালাপী, আকর্ষণীয় হাসি দিয়ে মানুষের সাথে তিনি কথা বলতেন। হৃদয়ের পুরোটাই শুধু দরদেভরা মনে হত। অনর্গল আরবীতেও কথা বলতে পারতেন এবং বয়ানও করতেন।
আমাদের আলেমদের মধ্যে যাঁরা শুধু তালীমি দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন তাঁদের পক্ষে যদি লাকসামের হুযুরের মত তালীম ও তাবলীগের মধ্যে সফল সমন্বয় করা সম্ভব নাও হয়, তবে কমপক্ষে তালীমি দায়িত্বের পাশাপাশি তাবলীগের কাজে সহযোগিতা ও সহমর্মিতা তো আমরা অবশ্যই করতে পারি। হযরত মুফতী ফয়যুল্লাহ ছাহেব রাহ. তাবলীগ জামাতের নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একদিনের জন্যেও কোথাও শরীক হয়েছিলেন কি না সন্দেহ আছে, কিন্তু মুফতী ছাহেব রাহ. তাঁর লেখনী ও বক্তব্য দ্বারা এই জামাতের পূর্ণ সমর্থনই শুধু করেননি; হক জামাত হিসাবে এই কাজে অংশগ্রহণ করার জন্য সকলকে রীতিমত উদ্বুদ্ধ করে গেছেন।
শায়খুল আরব ওয়াল আযম হযরত সাইয়্যেদ হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ. আযাদী আন্দোলনসহ বিভিন্নমুখী গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তাঁর স্কন্ধে থাকা সত্তে¡ও হযরতজ্বী মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-এর ডাকে যে কোনো সময় সাড়া দিতেন। হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-এর আন্তরিকতা ও লিল্লাহিয়াত দর্শনে তিনি তাঁর শত ব্যস্ততার মাঝেও বড় ভাই ও মুরব্বী হিসাবে দ্বীনের এই প্রচেষ্টার প্রতি পূর্ণ সমর্থন দান করে এর পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তা দানে এগিয়ে আসেন।
১৯৩৩ সালে কন্কনে শীতের প্রকোপ উপেক্ষা করে ২০০ জন মেওয়াতী হযরত মাওলানার দাওয়াতে উদ্বুদ্ধ হয়ে দুই মাসের জন্য সময় নিয়ে বের হন। বিভিন্ন এলাকার জন্য কয়েকটি জামাতে তাদের ভাগ করে দেয়া হয়। শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা মাদানী রাহ. দিল্লী জামে মসজিদে হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-এর অনুরোধে এদেরকে বিদায়ী দিক-নির্দেশনা দান করেন। হযরত মাদানী রাহ. ঐ নির্দেশনায় আবেগের সাথে বলেন, ‘আপনারা যে কাজের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তার ফলে বাতেল খতম হয়ে যাবে। ভারতবর্ষ থেকে বৃটিশের শাসন-শোষণের অবসান ঘটবে। দিল্লীর লালকেল্লার ওপরে যে ইন্ডিয়ান জ্যাক পতাকা উড়ছে সে পতাকা পড়ে যাবে।’ হযরত মাদানী রাহ.-এর এ কথা বলার সাথে সাথে কাকতালীয়ভাবে আকস্মিক লালকেল্লার পতাকাটি নিচে পড়ে যায়। জামে মসজিদ লোকে-লোকারণ্য ছিল, তারা এই অস্বাভাবিক কারামতি-ব্যাপার দেখে সকলে জোরে ‘নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে ওঠে। হযরত মাদানী রাহ. জোরের সাথে ভর্ৎসনা করে বললেন, আজকাল লোকেরা সব জোশ-জযবা ‘না‘রা’ লাগানোর মাঝে শেষ করে দেয়। একটি দ্বীনী আমলের কথা বলছি তা মনযোগ সহকারে শুনুন এবং বোঝার চেষ্টা করুন। -বৈচিত্রের মাঝে ঐক্যের সুর পৃ. ৫৭৮; তাবলীগ তাহরীকের সূচনা এবং মূলনীতি পৃ. ২৬,২৭; সীরাতে শাইখুল ইসলাম, মাওলানা নাজমুদ্দীন এসলাহীকৃত ২য় খণ্ড, পৃ. ৪০৭-৪০৮
হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-এর একান্ত বিশ্বস্ত সহকর্মী হযরত মাওলানা এহতেশামুল হাসান কান্ধলভী রাহ. আল জমিয়ত শায়খুল ইসলাম-এর বিশেষ সংখ্যার ৪৬ পৃষ্ঠায় তাঁর নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, হযরত মাদানী রাহ.-এর প্রতি হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ. অন্তরে যে শ্রদ্ধাবোধ পোষণ করতেন তা ছিল অতুলনীয়। প্রায়শই তিনি বলতেন, ‘যদি এই তাবলীগি কাজের যিম্মাদারী না থাকত তাহলে হযরত মাদানীর হাতে বাইয়াত হয়ে তাঁর কাজে শরীক হয়ে যেতাম। যদি কখনো কোনো কারণে এই তাবলীগের কাজ ছুটে যায় তখন আমি হযরত মাদানীর নেতৃত্বে কাজ করব। অনুরূপ কখনো কোনো কারণে যদি হযরত মাদানী রাহ. রাজনীতি ছেড়ে দেন তাহলে তখন তিনি এ কাজই করবেন।
দেখুন! হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-এর দৃঢ়তা কত! হযরত মাদানী রাহ.-এর ওপর অর্পিত দায়িত্ব ছুটে গেলে তিনি তখন তাবলীগের কাজই করবেন বলে দাবী করছেন। তাই বলছিলাম, তাবলীগ আসলেও অত্যন্ত গুরুত্ব বহনকারী একটি জরুরি কাজ।
হযরত মাওলানা আব্দুল আযীয (লাকসামের হুযুর) রাহ. যে সমন্বয়ের নমুনা আমাদের সামনে রেখে গেছেন তার রাজপথ ধরে চলা আমাদের জন্য খুব একটা কঠিন কাজ না। আল্লাহ আমাদের সকলকেই তালীম ও তাবলীগের জন্য কবুল করুন। আমীন।
[1] ১একথা শতভাগ সত্য। কিন্তু তাবলীগ হল তালীমের উদ্দেশ্যসমূহের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য; একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। এছাড়া হেদায়েতের নূর ব্যাপক করার জন্য তাবলীগের মত তালীমেরও ব্যাপক প্রসার ঘটানো দরকার। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাকে তার বর্তমান অবস্থায় ছেড়ে দিয়ে প্রচলিত পদ্ধতিতে তাবলীগের কাজ যতই ব্যাপক করা হোক আসল মাকসাদ হাসিল হবে না। প্রয়োজন হল, এর সাথে সাথে প্রত্যেক শ্রেণীর উপযোগী তালীম-তারবিয়াতেরও ব্যবস্থা করা। কারী তায়্যিব ছাহেব রাহ.-এর বক্তব্যের উদ্দেশ্যও এটাই। (আবদুল মালেক)
[2] ২ উবাইদী ছাহেব যীদা মাজদুহুম-এর এ প্রস্তাবনা তো মাদরাসা কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্যে। কাকরাইলে তিনি ঐ প্রস্তাবনা পেশ করতে পারতেন, যা হযরত মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী দামাত বারাকাতুহুম সেখানের কোনো মুরব্বীর সামনে পেশ করেছিলেন; তিন চিল্লা দিতে আসা ব্যক্তি তৃতীয় চিল্লা অথবা তিন চিল্লার পর চতুর্থ চিল্লা মাদরাসায় লাগাবে। এই চিল্লা সে কুরআন সহীহ করা, নামাযের মশ্ক, হালাল হারামের ইলম, আল্লাহর হক বান্দার হকের ইলমসহ ফরযে আইন ইলম অর্জনের পিছনে ব্যয় করবেন। (আবদুল মালেক)
[3]তালীমকে শুধু ভ‚মিকা বলা ঠিক নয়; তালীম স্বতন্ত্র মাকছ‚দ (উদ্দেশিত বিষয়) এবং প্রত্যেক দ্বীনী কাজের রূহ। (আবদুল মালেক)