প্রসঙ্গ : আকীদায়ে হায়াতুন্নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
[আকীদায়ে হায়াতুন্নাবী একটি শাশ্বত ও স্বীকৃত বিষয়। সম্প্রতি এ নিয়ে অহেতুক কিছু আক্রমনাত্মক বিভ্রান্তি তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিষয়টির স্বরূপ ও ব্যাখ্যায় গভীর ইলমী সূ²তা বিদ্যমান। শাস্ত্রীয় একটি বিষয় হওয়া সত্তে¡ও বিষয়টিকে সর্বসাধারণের জন্য সহজবোধ্য করে পেশ করার চেষ্টা করা হয়েছে এই নিবন্ধে। এতে পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফের বিভিন্ন দলিল উল্লেখ করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আকীদায়ে হায়াতুন্নাবীর সত্যতা এবং এর অস্বীকারকারীদের দাবির অসারতা। এতে কিছু দীর্ঘ আরবী টীকা রয়েছে, যা তালিবুল ইলমদের জন্য যুক্ত করা হয়েছে।]
গাইরে মুকাল্লিদ আলেম শায়খ আকরামুজ্জামান বিন আব্দুস সালাম সম্পাদিত ‘তাবলীগ জামাত ও দেওবন্দীগণ’ এবং মুরাদ বিন আমজাদ রচিত ‘সহীহ ‘আক্বীদার মানদণ্ড বেহেশতী জেওর’ বই দুটিতে তাদের ও দেওবন্দীদের যে আকীদা উল্লেখ করা হয়েছে তার সারসংক্ষেপ হল- (তাদের আকীদা) ১. বই দুটিতে কোথাও নবীগণ কবরে জীবিত একথা স্বীকার করা হয়নি। ২. নবীগণ কবরে জীবিত বিষয়ক হাদীসটিকে বিতর্কিত বলা হয়েছে। ৩. কবর থেকে সালাম শুনতে পাওয়াকে অস্বীকার করা হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত হাদীসকে জাল বলা হয়েছে। ৪. মুরাদ বিন আমজাদের বইয়ে মুত্যুর পর জীবন পাওয়ার বিষয়টাকে স্পষ্ট ভাষায় অস্বীকার করা হয়েছে।
আর দেওবন্দীদের নামে যে আকীদা লেখা হয়েছে তা হল- ১. নবীজি মৃত্যুবরণ করেননি। ২. তিনি কবরেও হুবহু দুনিয়ার মতই জীবিত। ৩. তাঁর কাছ থেকে আদেশ-নিষেধ উপদেশ এবং বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক সাহায্য সবকিছুই পাওয়া যায়। ৪. উপরিউক্ত বিষয় অন্যান্য মৃত আলেম ও মাশায়েখদেরও রয়েছে।
উপরোক্ত উদ্ধৃতি থেকে বুঝা যায় যে, ‘হায়াতুল আম্বিয়া’ বিষয়ে আহলে হাদীসগণ রয়েছেন সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিতে। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আকীদা থেকে তারা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। আর দেওবন্দীদের আকীদা নামে অন্যায়ভাবে যা বলা হয়েছে তা অবাস্তব ও দেওবন্দীদের উপর অপবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়। নিম্নে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।
‘হায়াতুল আম্বিয়া’র আক্বীদা ও পরিভাষার ইতিহাস
‘হায়াত’ মানে জীবন। আর ‘আম্বিয়া’ নবী শব্দের বহুবচন। শাব্দিক অর্থ ‘নবীগণের জীবন’। পরিভাষায়- ‘ইন্তেকালের পর কবরে নবীগণের বিশেষ জীবন লাভ করাকে হায়াতুল আম্বিয়া বলে’। ওফাতের পর সকল নবী কবরে জীবিত। এ কথা শরয়ী দলিল দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। তাই সাহাবা-তাবেয়ীন থেকে শুরু করে চার শতাব্দীর অধিককাল পর্যন্ত কেউ এ বিষয়ে কোনরূপ দ্বিমত করেননি। সর্বপ্রথম ৪৪৫ হিজরীতে মানছ‚র ইবনে মুহাম্মদ আল-কান্দারী নামক এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কবরে জীবিত থাকার উপর নানারূপ আপত্তি উত্থাপন করে। এবং এর উপর ভিত্তি করেই কিয়ামত পর্যন্ত নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালত বাকি থাকাকে অস্বীকার করে। তখন যুগের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ইমাম আহমদ ইবনে হুসাইন আল-বাইহাকী রাহ. (মৃত্যু ৪৫৮ হি.) তার মত খণ্ডন করে ‘হায়াতুল আম্বিয়া’ নামে একটি কিতাব রচনা করেন। এতে তিনি নবীদের কবরে জীবিত থাকা বিষয়ক আকীদার দলিল-প্রমাণ তুলে ধরেন। -মাকামে হায়াত, পৃ. ৫৪
এ থেকেই এ বিষয়টি ‘হায়াতুল আম্বিয়া’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। পরবর্তীতে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর সকল ইমাম, মুহাদ্দিস ও ফকীহ নবীদের কবরে জীবিত থাকার আক্বীদাকে ‘হায়াতুল আম্বিয়া’ নামেই উল্লেখ করে আসছেন।
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর বক্তব্য
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আকীদা হল, মৃত্যুর পর সকল নবীদের কবরে পুনরায় বিশেষ জীবন দান করা হয়েছে। ইমাম বাইহাকী রাহ. তাঁর ‘আল ই‘তিকাদ’ গ্রন্থে বলেন-
والأنبياء عليهم الصلاة والسلام بعدما قبضوا ردت إليهم أرواحهم، فهم أحياء عند ربهم كالشهداء.
“সকল নবীর রূহ কবজ করার পর তা আবার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই তাঁরা শহীদদের ন্যায় তাদের রবের কাছে জীবিত”। -আল ইতিকাদ পৃ.৪১৫ দারুল ফযীলাহ রিয়াদ; আত-তালখীছুল হাবীর ২/২৫৪; আল বাদরুল মুনীর ৫/২৯২
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. বলেন,
وقد تمسك به من أنكر الحياة في القبر، وأجيب عن أهل السنة المثبتين لذلك بأن المراد نفي الموت اللازم من الذي أثبته عمر بقوله: "وليبعثه الله في الدنيا ليقطع أيدي القائلين بموته" وليس فيه تعرض لما يقع في البرزخ، وأحسن من هذا الجواب أن يقال: إن حياته صلى الله عليه وسلم في القبر لا يعقبها موت بل يستمر حيا، والأنبياء أحياء في قبورهم، ولعل هذا هو الحكمة في تعريف الموتتين حيث قال :لا يذيقك الله الموتتين أي المعروفتين المشهورتين الواقعتين لكل أحد غير الأنبياء. (فتح الباري، باب لو كنت متخذا خليلا لتخذت أبا بكر خليلا)
“যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবরে জীবিত থাকাকে অস্বীকার করে তারা হযরত আবু বকর রা.-এর এ বক্তব্য দিয়ে দলিল পেশ করতে চায়-‘আল্লাহ আপনাকে দুইবার মৃত্যু দিবেন না’। আর আহলুস সুন্নাহ- যারা নবীর কবরে জীবিত থাকায় বিশ্বাস রাখেন, এদের পক্ষ থেকে এর জবাব দেয়া হয়েছে যে, হযরত আবু বকর রা.-এর বক্তব্যের উদ্দেশ্য ছিল উমর রা.-এর ভুল ধারণার খণ্ডন করা। উমর রা. বলেছিলেন, ‘আল্লাহ তাআলা নবীজীকে আবার দুনিয়াতে জীবিত করবেন ...’। এ কথার মধ্যে বারযাখে কী হবে এ বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। অবশ্য হযরত আবু বকর রা.-এর এ কথার সর্বোত্তম ব্যাখ্যা হল, কবরে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে জীবন পেয়েছেন তারপর আর কোনো মৃত্যু আসবে না। বরং তিনি বরাবরই কবরে জীবিত থাকবেন, আর নবীগণ কবরে জীবিত। ...।” -ফাতহুল বারী, আবু বকরের ফযীলত অধ্যায় ৭/৩৩
শাইখুল ইসলাম ইবনে হাজার এ বক্তব্যে স্পষ্টই বলেছেন, আহলুস-সুন্নাহর বিশ্বাস হল, নবীগণ কবরে জীবিত।
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকীদা
১. নির্ধারিত মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করার মাধ্যমে সকল নবীগণের দুনিয়ার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে।
২. মৃত্যুর পর তাঁরা আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে এক বিশেষ জীবন লাভ করেছেন। তাই তাঁরা কবরে জীবিত। তাঁদের কবরের জীবনের ধরণ বিষয়ে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর বিশ্বাস হল:
ক. আলমে বারযাখে সাধারণ মুমিনের জীবনের চেয়ে শহীদদের জীবন পূর্ণাঙ্গ। আর শহীদের জীবন থেকে নবীদের জীবন আরো পূর্ণাঙ্গ ও উন্নততর।
খ. দুনিয়ার জীবনের সাথে তাঁদের কবরের জীবনের কিছু কিছু বিষয়ে সাদৃশ্য রয়েছে।(১) যেমন কবরে তাঁদের দেহ মোবারক সুসংরক্ষিত রয়েছে। তাঁরা কবরে নামায আদায় করেন। যারা কবরের নিকট গিয়ে ছালাত ও সালাম পেশ করে তাঁরা তা সরাসরি শুনেন এবং যারা দূর থেকে সালাম পাঠান তা ফেরেশতা তাদের কাছে (কবরে) পৌঁছে দেন এবং তাঁরা আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ রিযিক প্রাপ্ত হন।
গ. কবরের জীবনের ধরণ সম্পর্কে যে বিষয়গুলো কুরআন-সুন্নাহয় পাওয়া যায় না সে বিষয়ে নিরবতা অবলম্বন করি।
৩. আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ এ-ও বিশ্বাস করে যে, তাদের কবর-জীবন হুবহু দুনিয়ার জীবনের মত নয়। কবর থেকে স্বাভাবিকভাবে যথা ইচ্ছা গমনাগমন করা, মৃত্যু-পূর্ববর্তী সময়ের মত আদেশ নিষেধ ও পরামর্শ দেওয়া, কারো সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ, কথোপকথন ও মুসাফাহা করা ইত্যাদি বিষয়ে শরয়ী কোনো দলিল নেই। তবে যদি স্বপ্ন, কাশফ বা কারামাতের মাধ্যমে এমন কোনো কিছু ঘটা প্রমাণিত হয়, তাহলে সেটি ভিন্ন বিষয়। হায়াতুল আম্বিয়ার আকীদার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
উলামায়ে দেওবন্দের বক্তব্য
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ্র সকল আকীদাই উলামায়ে দেওবন্দের আকীদা। উলামায়ে দেওবন্দ সর্বত্র স্পষ্ট বলেছেন যে, দেওবন্দ ও দেওবন্দীদের স্বতন্ত্র ও বিশেষ কোনো আকীদা-বিশ্বাস নেই। কুরআন -সুন্নাহর আলোকে প্রমাণিত সকল আকীদা-বিশ্বাসকেই উলামায়ে দেওবন্দ গ্রহণ করেন এবং কুরআন সুন্নাহয় নিষিদ্ধ সকল আকীদা-বিশ্বাস তাঁরা প্রত্যাখ্যান করেন। তাই নবীদের কবর-জীবন সম্পর্কেও উলামায়ে দেওবন্দ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আকীদাকেই গ্রহণ করেন। নিম্নে এর জন্য উলামায়ে দেওবন্দের রচিত কিছু বরাত উল্লেখ করা হল-
১. মাসআলায়ে হায়াতুল আম্বিয়া কি হাক্বীকত, মাওলানা মনযূর নোমানী রাহ. (পৃ. ১৩-১৫)
২. মাকামে হায়াত, ড. খালেদ মাহমূদ (পৃ.২২৮)
৩. হিদায়াতুল হায়ারান, মাওলানা আব্দুশ শাক‚র তিরমিযী রাহ. (পৃ. ৬০)
৪. তাসকীনুস ছুদূর, মাওলানা সারফারায খান ছফদর (পৃ.২১১)
৫. তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম ফি শারহি সহীহি মুসলিম (৫/১৭)
৬. সীরাতে মুছতাফা, মাওলানা ইদ্রীস কান্ধলবী রাহ. (৩/২৫৮)
৭. তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন, মুফতী মুহাম্মদ শফী রাহ. (২/৪৫)
৮. আশরাফুল জাওয়াব (পৃ. ২৩৮)
৯. উলামাউ দেওবন্দ ইত্তিযাহুহুমুদ-দ্বীনি ও মিযাজুহুমুল মাযহাবী (পৃ.১৯৯) (২)
১০. দারুল উলূম দেওবন্দ: মাদরাসাহ ফিকরিয়্যাহ তাউজীহিয়্যাহ, উবাইদুল্লাহ আল-আসআদী (পৃ.৬২৪) (৩)
১১. আল-মুহান্নাদ আলাল মুফান্নাদ (পৃ.৪৪) (৪)
মাওলানা মনযূর নোমানী রাহ. লেখেন, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর কারো অস্পষ্ট বক্তব্য থেকে কেউ যদি একথা প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, নবীগণ মৃত্যুবরণ করেননি তাহলে তা হবে নিতান্তই ভুল। বরং তা হবে মিথ্যা অপবাদ। -মাসআলায়ে হায়াতুল আম্বিয়া কি হাক্বীকত, মাওলানা মনযূর নোমানী রাহ.
কিছু সংশয়ের নিরসন
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর বিশ্বাস হল-
১. মুত্যুর মাধ্যমে নবীজীর দুনিয়ার জীবনের অবসান ঘটেছে। সুতরাং যারা ‘হায়াতুল আম্বিয়া আকীদার’ উপর এই বলে আপত্তি করে যে, জীবিত অবস্থায় নবীগণকে দাফন করা হল কী করে,(৫) তাদের আপত্তি অর্থহীন ।
২. কবরে নবীজীর জীবন কিছু কিছু বিষয়ে দুনিয়ার জীবনের সাথে সাদৃশ্য রাখে। তবে সকল বিষয়ে তাঁদের কবরের জীবন দুনিয়ার জীবনের মত নয়। বরং তাঁদের জীবনটা মূলত বারযাখী তথা আলমে বারযাখের জীবন- যা আমাদের দৃষ্টির আড়ালে। তাই স্বাভাবিকভাবে দুনিয়ায় জীবিত থাকতে যেমন নবীজীর কাছ থেকে আদেশ নিষেধ ও পরামর্শ পাওয়া যেত বারযাখী জীবন হওয়ার কারণে তা পাওয়া যায় না। এদিক থেকে তাঁদের কবরের জীবনের সাথে দুনিয়ার জীবনের কিছুটা বৈসাদৃশ্যও আছে। তবে স্বপ্ন, কাশফ ও কারামতের মাধ্যমে যদি কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটা প্রমাণিত হয় তাহলে সেটি স্বতন্ত্র বিষয়। যার বিধান সম্পূর্ণ ভিন্ন। সুতরাং যারা এই বলে আপত্তি করে যে, নবীজী যদি কবরে জীবিত থাকতেন তাহলে আবু বকর খলীফা হলেন কী করে, আর সাহাবীগণ আগের মত আদেশ নিষেধ ও পরামর্শের জন্য তাঁর কাছে কেন যেতেন না;(৬) তাদের এ আপত্তি একেবারেই অবান্তর। (দেখুন, মাকামে হায়াত, ড. খালেদ মাহমূদ পৃ.২৩৪-২৩৫)
কবরের জীবন ‘বারযাখী’ হওয়া সত্তে¡ও দুনিয়ার জীবনের সাথে সাদৃশ্য রাখে
বারযাখ শব্দের অর্থ পর্দা বা অন্তরায়। মুত্যু-পরবর্তী জগত সম্পর্কে মানুষ সরাসরি কিছু জানতে পারে না। তাই একে আলমে বারযাখও বলা হয়। সমস্ত মানুষ মৃত্যুর পর পৃথিবীর মানুষের দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। আড়ালে হওয়ার কারণে একে ‘বারযাখ’ও বলা হয়। সকল মানুষের মত নবীগণও মৃত্যুর পর বারযাখে তথা আড়ালে চলে যান। তাই কেউ কেউ সকল মানুষের বারযাখের জীবনের সাথে মিলিয়ে নবীদের কবরের জীবনকে তুচ্ছ ও হীন গণ্য করে থাকেন। অথচ নবীগণের জীবন দুনিয়ার জীবনের সাথে আংশিক সাদৃশ্যপূর্ণ, এবং সরাসরি তারা কবরেই বিশেষ জীবন লাভ করেছেন। যা অন্য সাধারণ মানুষের জীবন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই দুই জীবনকে এক করে ফেলা শরীয়ত বিরোধী চিন্তা। তাঁরা বলেন, নবীগণের মৃত্যু পরবর্তী জীবন বারযাখী, আর আমরা বারযাখী জীবন সম্পর্কে কিছুই জানি না।
কিন্তু বারযাখের জীবন হওয়া সত্তে¡ও শরয়ী দলিলের দ্বারা ঐ জগতের যা পাওয়া যায় তা জানতে সমস্যা কোথায়? তা অস্বীকার করার তো কোনো যুক্তি নেই। কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা একথা প্রমাণিত যে, নবীগণ কবরে স্বশরীরে দুনিয়ার সাথে আংশিক সাদৃশ্যপূর্ণ বিশেষ জীবন পেয়েছেন। যে সকল বিষয়ে দুনিয়ার জীবনের সাথে সাদৃশ্য রয়েছে তা হল: ১. দুনিয়ার দেহ সংরক্ষিত থাকা, ২. নামায আদায় করা, ৩. ছালাত ও সালাম শুনতে পাওয়া, ৪. সালামের জবাব দেয়া, ৫. রিযিকপ্রাপ্ত হওয়া। এ সবক’টি বিষয়ই একজন জীবন্ত মানুষের বৈশিষ্ট্য, যা মত্যুর পরও নবীদের মধ্যে পাওয়া যায়। তাই নবীগণের জীবন বারযাখী হলেও সাধারণ মানুষের বারযাখী জীবনের সাথে এর আকাশ পাতাল ব্যবধান রয়েছে। এ কারণেই বলতে হয়- নবীগণ কবরে স্বশরীরে জীবিত। কিন্তু অন্যদের বেলায় এ কথা বলার কোনো অবকাশ নেই। সুতরাং বারযাখী জীবন বলে নবীগণের কবর-জীবনকে সাধারণ মানুষের জীবনের সাথে একাকার করে ফেলা, জীবিত বলতে দ্বিধাবোধ করা শরীয়ত-বিরোধী চিন্তা।
কুরআনে হায়াতুল আম্বিয়ার দলিল
আল্লাহ তাআলা বলেন,
(তরজমা) “যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয় তোমরা তাদেরকে বলো না তারা মৃত, বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা উপলব্ধি করতে পার না।” -সূরা বাকারা (২) : ১৫৪
(তরজমা) “যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদের কখনই মৃত মনে করো না, বরং তারা জীবিত, এবং তাদের রবের নিকট হতে তারা রিযিকপ্রাপ্ত। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৬৯
উপরিউক্ত প্রথম আয়াতে মৃত্যুর পর শহীদদেরকে মৃত বলতে নিষেধ করা হয়েছে। আর বলা হয়েছে ‘বরং তারা জীবিত’। আর দ্বিতীয় আয়াতে মৃত ধারণা করতেও নিষেধ করা হয়েছে। জীবিত হওয়ার একটি নিদর্শন বলা হয়েছে ‘তারা রিযিকপ্রাপ্ত হয়’।
এ থেকে বুঝা যায়-
১. যদিও বারযাখে সমস্ত মানুষেরই এক ধরনের জীবন আছে, কিন্তু সাধারণের বরযাখের অবস্থানকে জীবিত বলা হয়নি যেমনটা শহীদদের বেলায় বলা হয়েছে। তাছাড়া এটা নিশ্চিত যে, শহীদের জীবন সাধারণের জীবনের চেয়ে উন্নত ও ভিন্নতর।
২. শুধু রূহ বা আত্মার বেঁচে থাকাকে জীবন বলে না। অন্যথায় জন্মের পূর্বেও আত্মা ছিল, মায়ের পেটেও আত্মা ছিল, মৃত্যুর পরও স্থান পরিবর্তন সত্তে¡ও আত্মা আগের অবস্থাতেই থাকে। কিন্তু তাই জীবন বলতে বুঝায় যখন আত্মা দেহের মধ্যে থাকে অথবা দেহের সাথে আত্মার সম্পর্ক থাকে (যেমন ঘুমন্ত মানুষ)।
৩. আয়াতে বলা হয়েছে ‘যাকে হত্যা করা হয়’ তাকে মৃত বলো না, আর হত্যা করা হয় দেহকে। সুতরাং শহীদ জীবিত থাকার অর্থ শুধু রূহের জীবনই নয়। বরং দেহের সাথেও এ জীবনের একটি সম্পর্ক রয়েছে।
৪. আরো বলা হয়েছে, ‘তারা রিযিকপ্রাপ্ত হয়’। এ থেকেও বুঝা যায় দুনিয়ার জীবনের সাথে শহীদদের বিশেষ জীবনের অনেক সাদৃশ্য রয়েছে।
৫. কিন্তু এ জীবনের কী ধরণ সে সম্পর্কে বলা হয়েছে- “কিন্তু তোমরা উপলব্ধি করতে পার না ”।
আয়াত দুটিতে ‘নস’ তথা স্পষ্ট বক্তব্যে শহীদের জীবনের কথা বলা হয়েছে। আর ‘ইশারা ও দালালাতুন নস’ তথা ইঙ্গিতে নবীদের জীবনের কথাও বলা হয়েছে। কেননা নিঃসন্দেহে নবীদের মর্যাদা আল্লাহর কাছে শহীদের চেয়েও বেশি। আর যে কারণে শহীদ শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী ও শহীদরূপে গণ্য হয় সে কারণ নবীদের মধ্যে বেশি বিদ্যমান। (সুবুলুল হুদা ওয়ার-রাশাদ ১১/৩৬০) তাই নবীদের জীবন শহীদের চেয়ে বেশি উন্নত হবে।
(দেখুন, হায়াতুল আম্বিয়া, বাইহাকী; আল-মুফ্হিম শারহু মুসলিম, কুরতুবী, নবুওত অধ্যায়; সিয়ারু আলামিন নুবালা, ইমাম যাহাবী, ওয়াকী ইবনুল জাররাহ-এর জীবনী অধ্যায় ৮/৯৯; ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার আসকালানী ৬/৬০৫; নাইলুল আওতার ৩/২১১; সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ ১১/৩৬০; ইম্বাউল আযকিয়া, আল্লামা সুয়ূতি (আল-হাবী) পৃ. ৫৫৪; খুতুবাতে ছফদর ৩/২২০)
তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক হাদীসে এ কথা স্পষ্ট যে, তিনি খায়বারে বিষমিশ্রিত যে গোস্ত খেয়েছিলেন, মৃত্যুকালীন সময়ে সেই বিষক্রিয়া আবার শুরু হয়েছিল। এ বিষও তাঁর ওফাতের একটা কারণ। তাই এ হিসেবে তিনি আক্ষরিক অর্থেও শহীদ। -সহীহুল বুখারী, হাদীস ৪৪২৮; আল-হাবী, সুয়ূতী, পৃ. ৫৫৪
বেশ কিছু হাদীসে নবীগণের কবরে জীবিত থাকার বিষয়টি স্পষ্টভাবে এসেছে। যা উপরোক্ত আয়াতদুটির এ ব্যাখ্যাকে অত্যন্ত শক্তিশালী করে। ফলে কুরআনের এ আয়াতদুটি দ্বারাই হায়াতুল আম্বিয়া আক্বীদা প্রমাণিত হয়।
(আরো দেখুন, সূরা সাজদাহ, আয়াত নং ২৩; সূরা যুখরুফ, আয়াত নং ৪৫; সূরা মারইয়াম, আয়াত নং ১৫ ও ৩৩; খুতুবাতে ছফদর ৩/২২০)
হায়াতুল আম্বিয়ার দলিল হাদীস থেকে
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরে জীবিত হওয়ার বিষয়ে অনেক হাদীস রয়েছে। হাদীস বিশারদদের দাবি অনুযায়ী এ বিষয়ক হাদীস ‘মুতাওয়াতির’-এর পর্যায়ভুক্ত। আল্লামা সুয়ূতী রাহ. বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সমস্ত নবীগণ কবরে জীবিত হওয়ার বিষয়টি অকাট্যভাবে প্রমাণিত। ... এ বিষয়ক হাদীস মুতাওয়াতির পর্যায়ের।” -ইম্বাউল আয্কিয়া বিহায়াতিল আম্বিয়া, আল-হাবী পৃ.৫৫৪; মিরকাতুছ ছাউদ-লিস সুয়ূতি; নাজমুল-মুতানাসির ফিল আহাদীসিল মুতাওয়াতির, মুহাম্মদ ইবনে জাফর আল-কাত্তানী, হাদীস ১১৫; সুবুলুল হুদা ওয়ার-রাশাদ ১১/৩৫৫
নিম্নে হায়াতুল আম্বিয়া বিষয়ক কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হল :
(এক) হযরত আনাস রা. বর্ণনা করেন,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
الأَنْبِيَاءُ أَحْيَاءٌ فِي قُبُورِهِمْ يُصَلُّون.
‘নবীগণ কবরে জীবিত, নামায আদায় করেন’।(৭) -মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ৩৪২৫; হায়াতুল আম্বিয়া লিল বাইহাকী, হাদীস ১-৪
যারা এ বর্ণনাকে সহীহ বলেছেন:
১. ইমাম বাইহাকী রাহ. (হায়াতুল আম্বিয়া, পৃ. ৫)
২. হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. (ফাতহুল বারী ৬/৬০৫)
৩. হাফেজ ইবনুল মুলাক্কিন রাহ. (আল-বাদরুল মুনীর ৫/২৮৫)
৪. হাফেজ নূরুদ্দীন হাইসামী রাহ. [এর বর্ণনাকারীগণ বিশ্বস্ত] (মাজমাউয যাওয়াইদ, ৮/২১১, হাদীস ১৩৮১২)
৫. আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহ. (ইম্বাউল আযকিয়া বিহায়াতিল আম্বিয়া, আল-হাবী, পৃ. ৫৫৫)
৬. আল্লামা মুনাবী রাহ. (ফায়জুল কাদীর, হাদীস ৩০৮৯)
৭. শাওকানী রাহ. (তুহফাতুয যাকিরীন পৃ. ২৮; নাইলুল আউতার, ৩/২৪৭)
৮. শায়খ নাসীরুদ্দীন আলবানী রাহ., সিলসিলাতুস সহীহা, হাদীস ৬২১; সহীহুল জামিইস সাগীর; আলজানাইয; আত-তাওয়াসসুল ইত্যাদি)
উল্লেখ্য যে, এ হাদীসকে কোনো মুহাদ্দিস দুর্বল বলেছেন বলে আমাদের জানা নেই। হাদীসটির একজন বর্ণনাকারী সম্পর্কে ইমাম যাহাবী রাহ.-এর যে বক্তব্য রয়েছে তার ভিত্তি ছিল ভুল ধারণার উপর। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. ‘লিসানুল মিযান’ গ্রন্থে বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছেন। সুতরাং হাদীসটি সর্বসম্মতিক্রমে সহীহ। এমন হাদীসকে সহীহ বলতে অস্বীকার করা মুর্খতা ও হঠকারিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।(৮)
হাদীস থেকে স্পষ্ট হল যে, “নবীগণ তাঁদের কবরে জীবিত। তাঁরা কবরে নামায আদায় করেন”। যদিও কোন নামায ও কত রাকাত পড়েন তা জানা যায় না, তবুও নামায আদায় করা দুনিয়ার জীবনের সাথে সাদৃশ্যের একটি উদাহরণ। পরবর্তী হাদীসে বিষয়টি আরো পরিষ্কার করা হয়েছে।
(দুই) হযরত আনাস রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَرَرْتُ عَلَى مُوسَى لَيْلَةَ أُسْرِيَ بِي، عِنْدَ الْكَثِيبِ الْأَحْمَرِ، وَهُوَ قَائِمٌ يُصَلِّي فِي قَبْرِهِ.
‘আমি মিরাজের রাতে (বাইতুল মাকদিসের পাশে) লাল বালুর ঢিবির কাছে মূসা আ.-এর পাশ দিয়ে অতিক্রম করেছি। তখন তিনি তাঁর কবরে দাড়িয়ে নামায আদায় করছিলেন’। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৩৪৭
হাদীস থেকে জানা গেল, ‘আল্লাহর কাছে’ নয় বরং মূসা আলাইহিস সালাম তাঁর কবরে নামায আদায় করছেন। রূহের জগতে নয় বরং তিনি স্বশরীরে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করছেন। নবীজী কবরের অবস্থানটিও উল্লেখ করে দিয়েছেন- লাল বালুর ঢিবির কাছে। তাই এখানে সালাত বা নামাযের বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়ার আর কোনো সুযোগ থাকে না’।
(তিন) হযরত আউস ইবনে আউস রা. বর্ণনা করেন,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ مِن ْأَفْضَلِ أَيَّامِكُمْ يَوْمَ الْجُمُعَةِ، فِيهِ خُلِقَ آدَمُ، وَفِيهِ قُبِضَ، وَفِيهِ النَّفْخَةُ، وَفِيهِ الصَّعْقَةُ، فَأَكْثِرُوا عَلَيَّ مِنَ الصَّلَاةِ فِيهِ فَإِنَّ صَلَاتَكُمْ مَعْرُوضَةٌ عَلَيَّ" قَالَ: قَالُوا: يَارَسُولَ اللَّهِ، وَكَيْف َتُعْرَضُ صَلَاتُنَا عَلَيْكَ وَقَدْ أَرِمْتَ؟ يَقُولُونَ: بَلِيتَ، فَقَالَ: "إِنَّ اللَّهَ حَرَّمَ عَلَى الْأَرْضِ أَجْسَادَ الْأَنْبِيَاءِ".
‘তোমাদের শ্রেষ্ঠ দিনগুলোর একটি হল জুমার দিন। এ দিনেই আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ দিনেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। এ দিনেই শিঙ্গায় ফুৎকার দেওয়া হবে, আর এ দিনেই সকল প্রাণী মৃত্যুবরণ করবে। সুতরাং এ দিনে তোমরা আমার উপর বেশি করে ছালাত ও সালাম পাঠাও। তোমাদের ছালাত আমার কাছে পেশ করা হবে। সাহাবাগণ বললেন, আমাদের ছালাত আপনার কাছে কীভাবে পেশ করা হবে, তখন যে আপনি (মাটির সাথে মিশে) ক্ষয়প্রাপ্ত (নিঃশেষিত) হয়ে যাবেন? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা মাটির জন্য নবীগণের দেহ খাওয়াকে হারাম করে দিয়েছেন’। (৯)
অর্থাৎ কবরে নবীগণের দেহ দুনিয়ায় জীবিত মানুষের মতই অক্ষত থাকে। এর সাথে রূহের গভীর সম্পর্কও থাকে। ফলে কবরে থেকেও সালাত ও সালাম পাওয়াতে কোনো অসুবিধা হবে না। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১০৪৭; সহীহ ইবনে খুযাইমা, ৩/১১৮ হাদীস ১৭৩৩; মুসতাদরাকে হাকেম, ১/২৭৮, হাদীস ১০২৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬১৬২
হাদীসটিকে যারা সহীহ বলেছেন
১. ইমাম হাকেম নিশাপুরী রাহ. বলেন, হাদীসটি বুখারীর শর্তানুযায়ী সহীহ। (মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ১০২৯)
২. ইমাম যাহাবী রাহ. হাকেমের সমর্থন করেছেন। (তালখীসুল মুসতাদরাক লিল ইমাম আয-যাহাবী, আলমুসতাদরাক, হাদীস ১০২৯)
৩. ইমাম নববী রাহ. (আল-আযকার, হাদীস ৩৩২)
৪. হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. (নাতাইজুল আফকার ৪/১৮)
৫. হাফেজ ইবনুল কায়্যিম রাহ.। তিনি বলেন, যে এ হাদীসের সনদে গভীর দৃষ্টি দেবে, তার মধ্যে এটি সহীহ হওয়ার বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকবে না। কেননা এর বর্ণনাকারীগণ বিশ্বস্ত ও প্রসিদ্ধ, ইমামগণ তাঁদের হাদীস গ্রহণ করেছেন।(১০) -জালাউল আফহাম পৃ.৮১-৮৫; যাদুল মা‘আদ ১/৩৫৪
৬. হাফেজ ইবনে কাসীর রাহ. (তাফসীরে ইবনে কাসীর, সূরা আহযাব, ৩/৫১৪)
৭. হাফেজ ইবনে আব্দুল হাদী (আছছারিমুল মুনকী পৃ. ২১০) (১১)
৮. শায়খ শুআইব আরনাউত (এর সনদ সহীহ, মুসনাদে আহমদের টীকা, ২৬/৮৪ হাদীস ১৬১৬২)
৯. ড. মুছতাফা আজমী (সহীহ ইবনে খুযাইমার টীকা হাদীস ১৭৩৩)
১০. শায়খ নাসীরুদ্দীন আলবানী রাহ. (সিলসিলাতুস সহীহা, হাদীস ১৫২৭; সহীহু আবি দাউদ, সহীহুত তারগীব, তাখরীজুল মিশকাত ইত্যাদি)
১১. গাইরে মুকাল্লিদ আলেম উবাইদুর রহমান মোবারকপুরী (মিরআতুল মাফাতীহ) (১২)
১২. শাওকানী রাহ. (তুহফাতুয যাকিরীন)
১৩. শায়েখ বিন বায (ফাতাওয়া নূরুন আলাদ দারব ১/৯৩)
১৪. শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. হাদীসটি দলিল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। (৪/২৯৬, ২৬/১৪৭)
উল্লেখ্য যে, কোনো কোনো মুহাদ্দিস একটি ভুল ধারণা বশত হাদীসটিকে মা‘লূল তথা দুর্বল আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্তু যেহেতু এর ভিত্তি ছিল ভুল তাই এ হাদীস বিষয়ে তাদের বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য। এর বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন, ইবনুল কায়্যিম, ইবনু আব্দিল হাদী, শায়খ শুআইব আরনাঊত, শায়খ নাসীরুদ্দীন আলবানী ও গাইরে মুকাল্লিদ আলেম উবাইদুর রহমান মুবারকপুরী প্রমুখ। সুতরাং বলা যায় এ হাদীসটিও মুহাদ্দিসীনে কেরামের সর্বসম্মতিক্রমে সহীহ।
হাদীসের অর্থ ও মর্ম
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন,
فأخبر أنه يسمع الصلاة والسلام منا لقريب وأنه يبلغه ذلك منا لبعيد.
এ হাদীসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়েছেন, তিনি নিকটবর্তী ব্যক্তির কাছ থেকে সালাত ও সালাম শুনেন, আর দূরবর্তী ব্যক্তিদের কাছ থেকে সালাত ও সালাম তাঁর কাছে পৌঁছে। -মাজমুউল ফাতাওয়া ২৬/১৪৭
সৌদী আরবের শায়খ আব্দুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে কাসেম আন-নাজদী রাহ. (মৃত্যু. ১৩৯২) ইবনে তাইমিয়া রাহ-এর এ বক্তব্যটিই সমর্থনপূর্বক উল্লেখ করেছেন। -আর-রাউজুল মুরবি এর টীকা ৪/১৯৩
ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেন, উপরোক্ত ব্যাখ্যাটি যথার্থ। কেননা, সাহাবায়ে কেরাম মনে করলেন, যার কাছে সালাত ও সালাম পেশ করা হবে তাঁকে তো স্বশরীরে জীবিত থাকতে হবে। আর মৃত্যুর পর তো সকলের ন্যায় নবীও মাটির সাথে মিশে যাবেন। তাহলে কীভাবে তাঁর কাছে সালাম পেশ করা হবে? উত্তরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘নবীদের দেহ মাটির জন্য হারাম’। অর্থাৎ আমি স্বশরীরেই জীবিত থাকব। কারণ যদি নবীজীর উদ্দেশ্য হত রূহের জগতে রূহের কাছে সালাম পেশ করা হবে, তাহলে তিনি বলতেন, সালাম তো রূহের কাছে পাঠানো হবে, দেহ মাটির সাথে মিশে যাওয়ার সাথে এর সম্পর্ক কী? তাছাড়া কবর থেকে সালাত ও সালাম শুনতে পাওয়ার বিষয়টি আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত অন্য একটি শক্তিশালী হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত যার বিবরণ সামনে আসছে।
এ হাদীসটি ভিন্ন সনদে হযরত আবুদ-দারদা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে। তাতে রয়েছে- (فنبي الله حي يرزق) : “সুতরাং আল্লাহর নবী জীবিত এবং রিযিক প্রাপ্ত”। -সুনানে ইবনে মাযাহ, হাদীস ১৬৩৭
এ বর্ণনার সকল রাবী নির্ভরযোগ্য।(১৩) হাফেজ বূছিরী (মিছবাহুয যুজাজায়) ইমাম নববী (আল-আযকারে), হাফেজ মুন্যিরী (আত-তারগীব ওয়াত-তারহীবে), ইবনে হাজার (তাহযীবুত তাহযীবে যায়েদ ইবনে আইমান-এর আলোচনায়), মুল্লা আলী কারী রাহ. (মিরকাতে) এবং শাওকানী রাহ. (নাইলুল আউতারে) ও শামসুল হক আযীমাবাদী (আওনুল মা‘বুদে) এর সনদকে জায়্যিদ তথা উত্তম বলেছেন। বিশেষত হাদীসের মূল অংশটি পূর্বোক্ত আউস ইবনে আউস বর্ণিত সহীহ হাদীস দ্বারা সমর্থিত। আর শেষ অংশটি সূরা বাকারার ১৫৪ নম্বর আয়াত ও সূরা আলে ইমরানের ১৬৯ নম্বর আয়াত দ্বারা সমর্থিত। তাই হাদীসের প্রথম অংশের ন্যায় শেষ অংশটিও সহীহ।
এ হাদীস থেকে স্পষ্ট হল- নবীদের দেহ কবরে দুনিয়ার জীবনের মতই সুসংরক্ষিত রয়েছে। স্বশরীরে জীবিত অবস্থায়ই তাঁর কাছে সালাত ও সালাম পেশ করা হয়। তিনি নিকটবর্তী ব্যক্তির কাছ থেকে সালাত ও সালাম শুনতে পান। এবং শহীদদের মত তাঁরাও আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ রিযিকপ্রাপ্ত হন।
(চার) হযরত আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেন,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ صَلَّى عَلَيَّ عِنْدَ قَبْرِي سَمِعْتُهُ، وَمَنْ صَلَّى عَلَيّ َنَائِيًا مِنْهُ أُبْلِغْتُه.
“যে আমার কবরের পাশে আমার উপর সালাত পেশ করে আমি তা শুনি। এবং যে দূরে থেকে আমার উপর দরূদ পড়ে তা আমার কাছে পৌঁছানো হয়”।(১৪)
(কিতাবুস সওয়াব, আবু হাইয়ান ইবনু আবিশ শায়খ ইছফাহানী, ফাতহুল বারী ৬/৬০৫, আল-কাওলুল বাদী পৃ. ১৬০)
যারা এ হাদীসকে শক্তিশালী বলেছেন-
১. হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. (ফাতহুল বারী ৬/৬০৫)
২. হাফেজ সাখাবী রাহ. (আল-কওলুল বাদী পৃ.১৬০)
৩. আল্লামা সুয়ূতি রাহ. (আল-লাআলিল মাছনূআহ ১/২৮৫)
৪. ইবনু র্আরাক্ব আল-কিনানী (তানযীহুশ্ শরীয়াহ, হাদীস ৫৪০)
৫. শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. সম্ভবত এ শক্তিশালী সূত্রটি পাননি। তাই অন্য একটি দুর্বল সূত্র উল্লেখ করে বলেন : হাদীসের এ সূত্রে দুর্বলতা সত্তে¡ও বর্ণনাটির বিষয়বস্তু প্রমাণিত। অন্যান্য হাদীস দ্বারা এর সমর্থন পাওয়া যায়। (মাজমূউল ফাতাওয়া ২৭/১১৬-১১৭, আর-রাদ আলাল আখ্নাঈ, হিদায়াতুর রুওয়াত ফি তাখরীজিল মিশকাত-এর টীকা, আলবানী রাহ. ১/৪২১) (১৫)
৬. আল্লামা ইবনু আব্দিল হাদী। তিনিও ইবনে তাইমিয়া রাহ.-এর মত অন্যান্য হাদীস দ্বারা এ হাদীসের বিষয়বস্তু প্রমাণিত সাব্যস্ত করেছেন। (১৬)
৭. মাহমূদ সাঈদ মামদূহ (রাফউল মানারাহ লিতাখরীজি আহাদীসিত তাওয়াসসুল ওয়ায্ যিয়ারাহ)
কোনো কোনো মুহাদ্দিস এ হাদীসের একটি সূত্রকে দুর্বল আখ্যায়িত করেছেন বর্ণনাকারী মুহাম্মদ ইবনে মারওয়ান-এর দুর্বলতার কারণে। আর উপরোল্লিখিত হাদীসটি ভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। এটি আ‘মাশ থেকে বর্ণনা করেছেন হাফেজে হাদীস আবু-মুআবিয়া মুহাম্মদ ইবনে খাযেম। এতে দুর্বল বর্ণনাকারী মুহাম্মদ ইবনে মারওয়ান নেই। তাই এ সূত্রে বর্ণিত হাদীসটিকে জাল বলার কোনই প্রমাণ নেই এবং কোনো মুহাদ্দিস এ বর্ণনাকে জাল বলার দুঃসাহস দেখানওনি। সুতরাং যারা মুহাম্মাদ ইবনে মারওয়ান সূত্রে বর্ণিত হাদীসটিকে দুর্বল বলেছেন তাদের বরাতে পূর্বোল্লিখিত মুহাম্মদ ইবনে খাযেম সূত্রে বর্ণিত হাদীসটিকে দুর্বল বলার কোনো সুযোগ নেই।
তাছাড়া এ হাদীসে উল্লিখিত সালাত ও সালাম শুনতে পাওয়ার বিষয়টি হযরত আউস ইবনে আউস রা. থেকে বর্ণিত তৃতীয় নম্বরে আলোচিত হাদীসটি দ্বারা সমর্থিত। আর দূরে থেকে সালাত ও সালাম পৌঁছার বিষয়টি অনেক সহীহ হাদীস দ্বারা সমর্থিত।
সুতরাং এ হাদীস থেকে বুঝা গেল- কবরের পাশ থেকে সালাত ও সালাম পেশ করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা সরাসরি শুনতে পান। সরাসরি সালাম শোনার বিষয়টি যারা স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন- শায়েখ ইবনে তাইমিয়া রাহ. ও তাঁর শিষ্যদ্বয় শায়খ ইবনুল কায়্যিম রাহ. ও ইবনে আব্দুল হাদী রাহ.। উলামায়ে নাজ্দের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আব্দিল ওয়াহ্হাব, আব্দুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে কাসেম, মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল লতীফ আলে শায়খ। গাইরে মুকাল্লিদ আলেমদের মধ্যে নবাব সিদ্দীক হাসান, আতাউল্লাহ হানীফ ও ইসমাঈল গায্নাবী প্রমুখ। (মাকামে হায়াত, ড. খালেদ মাহমূদ পৃ.৫৪৫-৫৫৭)
স্বাভাবিকভাবেই কারো মনে প্রশ্ন হতে পারে, মাটির নিচ থেকে সালাম কী করে শোনেন? এর উত্তরে দুটি কথা বলা যেতে পারে। (এক) এটি র্বাযাখের কথা কর্তব্য। হাদীসে সালাত ও সালাম শুনতে পাওয়ার কথা এসেছে তাই তা বিশ্বাস করা। কিন্তু কীভাবে শুনেন তা আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন। (দুই) তবে এতটুকু যে, নবীজী দুনিয়াতে জীবিত থাকা অবস্থায়ও অনেক সময় মাটির নিচে কবরে সংঘটিত আযাব শুনতে পেয়েছেন। যা বিভিন্ন সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। তদ্রƒপ কবর থেকে উপরের আওয়াজ শুনতে পান। কিন্তু কীভাবে শুনেন বিষয়টি আমাদের উপলব্ধির বাইরের। (মাকামে হায়াত পৃ.৫৩২-৫৩৩)
(পাঁচ) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ لِلَّهِ مَلائِكَةً سَيَّاحِين فِي الأَرْض ِيُبَلِّغُونِي عَنْ أُمَّتِي السَّلامَ.
“আল্লাহ তাআলার নির্ধারিত একদল ফেরেশতা রয়েছেন যারা দুনিয়াতে ঘুরে বেড়ান এবং আমার উম্মতের সালাম আমার কাছে পৌঁছে দেন”। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৯১৪
যারা এ হাদীসকে সহীহ বলেছেন:
১. ইমাম হাকেম হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। (মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৩৫৭৬, ২/৪২১)
২. ইমাম যাহাবী রাহ. হাকেমের সমর্থন করেছেন। (মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ২/৪২১)
৩. হাফেজ ইবনুল কায়্যিম রাহ. একে সহীহ বলেছেন। (জালাউল আফহাম পৃ.২৪)
৪. শায়খ শুআইব আরনাউত বলেন, হাদীসটি সহীহ মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহীহ। (সহীহ ইবনে হিব্বানের টীকা ৩/১৯৫)
(ছয়) হযরত আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেন,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
لَاتَجْعَلُوا بُيُوتَكُمْ قُبُورًا، وَلَاتَجْعَلُوا قَبْرِي عِيدًا، وَصَلُّوا عَلَيَّ، فَإِنَّ صَلَاتَكُمْ تَبْلُغُنِي حَيْثُ كُنْتُم.
“তোমরা তোমাদের ঘরকে কবর বানিও না। আর আমার কবরে উৎসব করো না (বার্ষিক, মাসিক সাপ্তাহিক কোনো আসরের আয়োজন করো না)।(১৭) আমার উপর সালাত পাঠাও। কেননা তোমরা যেখানেই থাক তোমাদের সালাত আমার কাছে পৌঁছবে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২০৪২; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৩৮৬৫
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. বলেন, এর সনদ সহীহ। (ফাতহুল বারী ৬/৬০৬, আরো দেখুন, মজমুউল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়া ২৬/১৪৭)
উপরিউক্ত ৫ ও ৬ নং হাদীস দুটি থেকে বুঝা গেল, দূর থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সালাত ও সালাম পাঠালে তা নবীজীর কবরে পৌঁছে দেওয়া হয়।
(সাত) হযরত আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেন,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
مَا مِن أَحَدٍ يُسَلِّمُ عَلَيَّ، إِلَّا رَدَّ اللَّهُ عَلَيّ رُوحِي حَتَّى أَرُدَّ عَلَيْهِ السَّلَام.
‘(মৃত্যুর পর) যে কেউ আমাকে সালাম করবে, সেই আমাকে এ অবস্থায় (জীবিত) পাবে যে, আল্লাহ তাআলা আমার মধ্যে (এর পূর্বেই) রূহ ফিরিয়ে দিয়েছেন। (অর্থাৎ মৃত্যুর পরই আমার রূহ আমার মধ্যে ফিরিয়ে দিয়ে জীবিত করে দেবেন) যাতে আমি তার সালামের জবাব দেই’। )সুনানে আবু দাউদ হা.২০৪১((১৮)
যারা হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন
ইমাম নববী ও ইমাম সাখাবী রাহ. বলেন, হাদীসটি সহীহ। (রিয়াযুস ছালিহীন; আল-মাকাছিদুল হাসানাহ) শায়খ নাসীরুদ্দীন আলবানী রাহ.ও বর্ণনাটি তাঁর ‘আস-সহীহায়’ উল্লেখ করেছেন। (সিলসিলাতুস সহীহা, হাদীস ২২২৬)
হাদীসের অর্থ
হাদীসের অর্থ হল মৃত্যুর পরই আমার মধ্যে রূহ ফিরিয়ে দিয়ে আল্লাহ তাআলা আমাকে জীবিত করবেন। আর এ জীবন কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী হবে। ফলে যে কেউ আমাকে সালাম করলেই জীবিত পাবে। আমি তার সালামের জবাব দেব। কেউ বলতে পারেন যে, হাদীসের বাহ্যিক অর্থ হল- যখনই কেউ আমাকে সালাম করবে তখনই আমার মধ্যে রূহ ফিরিয়ে দেওয়া হবে। আর এর পূর্বে আমি মৃত ছিলাম। কিন্তু এ অর্থ সঠিক নয়। কারণ, ‘আল্লাহ তাআলা আমার রূহ আমার মধ্যে ফিরিয়ে দেন’ এ কথার অর্থ যদি হয়, ‘এর পূর্বে আমি মৃত ছিলাম’, তাহলে পূর্ববর্তী সকল হাদীসের সাথে এ হাদীস সাংঘর্ষিক হয়ে যায়। নবী যদি শুধু সালামের উত্তর দেওয়ার জন্য জীবিত হন, তাহলে ‘নবীগণ কবরে জীবিত নামায আদায় করেন’- মর্মে বর্ণিত হাদীসের কী অর্থ বাকী থাকে। অথচ সবগুলোই নবীজীর কথা। তাই এগুলোর এমন অর্থই করতে হবে যাতে পরষ্পরে সাংঘর্ষিক না হয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
হাদীসের উল্লিখিত অর্থটি করেছেন শাস্ত্রের ইমাম আহমদ ইবনে হুসাইন আল-বাইহাকী রাহ. তাঁর ‘হায়াতুল আম্বিয়া’ গ্রন্থে ও হাফেজ ইবনে হাজার আস্কালানী রাহ. ‘ফাতহুল বারী’ গ্রন্থে। আল্লামা সুয়ূতী রাহ. আরবী ব্যাকরণ শাস্ত্র ও হাদীসের বর্ণনার আলোকে এ ব্যাখ্যার যৌক্তিকতা ও যথার্থতা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন হাদীসের শেষাংশের মূল রূপ হল- (إلا وقد رد الله علي روحي)। আল্লামা ইবনে হাজার হায়তামী রাহ.ও এটিকে হাদীসের যথার্থ অর্থ বলে উল্লেখ করেছেন। (আল-হাবী, সুয়ূতী রহ. পৃ. ৫৫৭, ৫৬১; ফাতহুল বারী ৬/৬০৬; আল-ফাতাওয়াল কুবরা, লিল হাইতামী ২/১৩৫ হজ্ব অধ্যায়; মাকামে হায়াত পৃ.৪৩৫)
এ হাদীসের আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য দেখুন- ফাতহুল বারী, আল-কাউলুল বাদী, আল-বাদরুল মুনীর-লিল ইমাম ইবনুল মুলাক্কিন, ইম্বাউল আযকিয়া, সুয়ূতী।
এ হাদীস থেকে বুঝা যায়- প্রথমত নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরে স্বশরীরে জীবিত। যে জীবনে দেহের মধ্যে রূহ বিদ্যমান থাকে। এ জীবন কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী থাকবে। দ্বিতীয়ত ‘যে কেউ তাঁকে সালাম দেয় তিনি উত্তর দেন’- কথা থেকে বুঝা যায় তিনি সালাম সরাসরি শুনেন এবং উত্তর দেন। তাছাড়া এ বিষয়টিও সকলেরই জানা যে, দিন রাত সর্বাবস্থায়ই কবরের নিকট থেকে ও দূর থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর সালাত ও সালাম অব্যাহত থাকে। সারাক্ষণ কেউ না কেউ কোন না কোনভাবে সালাত ও সালাম পেশ করতে থাকে। আর নবীজী এর উত্তর দিতে থাকেন। সুতরাং সব সময় যেহেতু সালাত ও সালাম চলতেই থাকে তাই এ হাদীসের বহ্যিক অর্থ ধরলেও বলতে হবে নবীজী কবরে জীবিত।
হয়াতুল আম্বিয়ার উপর উম্মতের ইজমা
হাফেজ সাখাবী রাহ. বলেন, হায়াতুল আম্বিয়া বিষয়ের উপর পুরো উম্মতের ইজমা রয়েছে। হাফেজ ইবনে হাজার মাক্কী আল-হাইতামী রাহ.ও তাই বলেছেন। -আল-কাওলুল বাদী পৃ. ৩৪৯; আল-ফাতাওয়াল কুবরা লিল হাইতামী ২/১৩৫, হজ্ব অধ্যায়; হিদায়াতুল হায়ারান; মাযাহেরে হক্ব; আনওয়ারে মাহমূদ
হায়াতুল আম্বিয়ার আকীদা বিষয়ে কয়েকজন ইমাম ও আলেমের উদ্ধৃতি
যেহেতু কুরআন-সুন্নাহয় স্পষ্ট ভাষায় নবীগণ কবরে জীবিত থাকার বিষয় রয়েছে, তাই সকল সাহাবা-তাবেঈন ও ইমামগণই এ বিষয়ে একমত ছিলেন। তবে প্রসঙ্গে ও অপ্রসঙ্গে এ বিষয়ে যারা স্পষ্ট উক্তি করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ.। তিনি বলেন, “শহীদগণ জীবিত, রিযিকপ্রাপ্ত হন। শহীদরা নিহত হওয়ার পরও জীবন্ত অবস্থায় তাদের রিযিক গ্রহণ করেন। নবীগণ তাদের কবরে জীবিত নামায আদায় করেন”। (আল-আকীদাহ, আবু বকর আল-খাল্লালের বর্ণনা পৃ. ১২১) (১৯)
তাদের মধ্যে আরো রয়েছেন-
১. ইমাম বাইহাকী (আল-ইতিকাদ ও হায়াতুল আম্বিয়া)
২. ইমাম কুরতুবী (আল-মুফ্হিম)
৩. শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (মাজমুউল ফাতাওয়া)
৪. শাইখুল ইসলাম ইবনে হাজার আসকালানী (ফাতহুল বারী)
৫. ইমাম সাখাবী (আল-কাউলুল বাদী)
৬. আল্লামা সুয়ূতী (ইমবাউল আযকিয়া বিহায়াতিল আম্বিয়া ও শারহু সুনানিন নাসাঈ)
৭. মুহাম্মদ ইবনে ইউসূফ ছালেহী (সুবুলুল হুদা ওয়ার-রাশাদ)
৮. ইবনে হাজার হাইতামী (আলফাতাওয়াল কুবরা)
৯. আল্লামা কাসতাল্লানী ও আল্লামা যুরকানী (শারহুয যুরকানী আলাল-মাওয়াহিব)
১০. আল্লামা শাওকানী (নাইলুল আউতার)
১১. শায়খ বিন বায (ফাতাওয়া নূরুন আলাদ্ দারব)
১২. শায়খ মুহাম্মদ বিন ছালেহ আল-উসাইমীন (তাফসীরুল কুরআন)
১৩. শায়খ ইসহাক ইবনে আব্দির রাহমান ইবনে হাসান আন্নাজ্দী (আদ্দুরারুস সানিয়্যাহ)
১৪. শায়খ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ
গাইরে মুকাল্লিদ আলেমদের মধ্যে-
১৫. মিয়া নযীর হুসাইন দেহলবী (আল-হায়াত বা‘দাল মামাত)
১৬. ওহীদুয যামান হায়দারাবাদী (হাদিয়্যাতুল মাহদী)
১৭. নবাব ছিদ্দীক হাসান খান,
১৮. শামসুল হক আজীমাবাদী (আউনুল মা‘বূদ)
১৯. উবায়দুর রহমান মুবারকপুরী (মিরআতুল মাফাতীহ) প্রমুখ। (মাকামে হায়াত, পৃ.৬২৩-৬২৭)
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া ও তাঁর শিষ্যদ্বয় ইবনুল কায়্যিম ও যাহাবী রাহ.-এর উদ্ধৃতিগুলো নি¤েœ তুলে ধরা হল:
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ.
১. ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেন-
فلا تتخذوا القبور مساجد، فإني أنهاكم عن ذلك. فهذه نصوصه الصريحة توجب تحريم اتخاذ قبورهم مساجد، مع أنهم مدفونون فيها، وهم أحياء في قبورهم، ويستحب إتيان قبورهم للسلام عليهم.
“...এ ধরনের হাদীসের সুস্পষ্ট উক্তি দ্বারা নবীদের কবরকে মসজিদ বানানো হারাম সাব্যস্ত হয়। তবে এ কথা সত্য যে, তারা তাতে সমাহিত আছেন এবং তাঁরা তাঁদের কবরে জীবিত। তাদের কবরে সালাম দেওয়ার জন্য উপস্থিত হওয়া মুস্তাহাব ”। -মাজমুউল ফাতাওয়া, ২৭/৫০২
২. তিনি বলেন, “নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- “নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা মাটির জন্য নবীগণের দেহকে গ্রাস করা হারাম করে দিয়েছেন’। এ হাদীসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তিনি নিকটবর্তী ব্যক্তির কাছ থেকে সালাত ও সালাম শুনেন, আর দূরবর্তী ব্যক্তিদের কাছ থেকে তাঁর কাছে সালাত ও সালাম পৌঁছে। -মাজমুউল ফাতাওয়া ২৬/১৪৭
আরো দেখুন, মাজমুউল ফাতাওয়া ৪/২৯৬; আর-রাদ আলাল আখনাঈ পৃ. ১৩১; জামিউ মাসাইলি ইবনে তাইমিয়া, ইশরাফ, বকর আবু যায়েদ ৩/১০৬ ৪/১৯১
৩. শায়খ আব্দুল্লাহ বিন ছালেহ বিন আব্দিল আযীয হায়াতুল আম্বিয়া বিষয়ে ইবনে তাইমিয়া রাহ.-এর আক্বীদার বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন, “নবীগণ কবরে জীবিত। তাদের জীবন শহীদদের জীবনের চেয়ে আরো পরিপূর্ণ। -সূরা বাকারা ১৫৪, সূরা আলে ইমরান ১৬৯
ইবনে তাইমিয়া রাহ.-এর উপর অপবাদ আরোপকারীদের এ কথা যে, তিনি ‘হায়াতুল আম্বিয়া’য় বিশ্বাস করেন না- একেবারেই মিথ্যা। বরং তিনি নবীদের কবরে জীবিত থাকার বিষয় সুস্পষ্টভাবে বলেছেন। ...হায়াতুল আম্বিয়ার দলিল হল নবীজীর হাদীস- ‘নবীরা কবরে জীবিত’।... -দা‘আবিল মুনাবীন লিশাইখিল ইসলাম পৃ.২৯৪ (২০)
ইবনুল কায়্যিম রাহ.
তিনি উদ্ধৃত করেন, “মৃত্যুর পর শহীদগণ তাঁদের রবের কাছে জীবিত এবং রিযিকপ্রাপ্ত ও আনন্দিত। এটি দুনিয়ায় জীবিত মানুষেরর বৈশিষ্ট্য। শহীদদের অবস্থাই যেহেতু এমন তো নবীগণ তো এর আরো বেশি হকদার। পাশাপাশি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সহীহ সূত্রে প্রমাণিত যে, মাটি নবীদের দেহ খায় না। ... অনুরূপ বর্ণনাগুলোর সারকথা হল, এটা নিশ্চিত যে, নবীগণের মৃত্যুর অর্থ তাঁদেরকে আমাদের থেকে এমনভাবে আড়াল করে নেওয়া হয়েছে যে, আমরা অনুধাবন করতে পারি না, যদিও তারা বিদ্যমান (জীবিত)। যেমন ফেরেশতাগণ জীবিত কিন্তু তুমি তাদেরকে দেখতে পাবে না।”। (২১) (কিতাবুর রূহ পৃ. ৩৬, ৪৪, আরো দেখুন, জালাউল আফহাম)
ইমাম শামসুদ্দীন যাহাবী রাহ.
ওয়াকী ইবনুল র্জারাহ-এর জীবনীতে প্রাসঙ্গিক আলোচনায় ইমাম যাহাবী রাহ. বলেন, “সাধারণ মৃতদের দেহ নষ্ট হয়ে যাওয়া, দুর্গন্ধ সৃষ্টি হওয়া এবং মাটিতে মিশে যাওয়ার মত নবীদের দেহেও তাই ঘটে এমন বিশ্বাস রাখা নিষেধ। বরং এক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমস্ত উম্মত থেকে ভিন্ন। তাঁর দেহ পঁচবেও না, মাটিতেও খাবে না এবং শরীরের ঘ্রাণও পরিবর্তন হবে না। বরং তিনি এখনো এবং সব সময়ই মিশক থেকে বেশি সুগন্ধিপূর্ণ। তিনি তাঁর কবরে জীবিত; বারযাখে তাঁর প্রাপ্য জীবনই তিনি পেয়েছেন যা সমস্ত নবীগণের চেয়েও পূর্ণাঙ্গতম। আর নবীদের হায়াত নিঃসন্দেহে শহীদদের হায়াতের চেয়ে পূর্ণাঙ্গতর ও উন্নততর যা কুরআনে স্পষ্ট উক্তিতেই বলা হয়েছে- “শহীদগণ রবের কাছে জীবিত ও রিযিকপ্রাপ্ত”। (আলে ইমরান : ১৬৯) বর্তমানে আলমে বরযাখে তাঁদের (নবীদের) জীবন সত্য। কিন্তু তা সবদিক থেকে দুনিয়ার জীবনের মত নয়, আবার জান্নাতের জীবনের মতও নয়। বরং আসহাবে কাহফের জীবনের সাথে তাঁদের জীবনের কিছুটা মিল পাওয়া যায় ”। (২২) (সিয়ারু আলামিন নুবালা ৮/৯৯)
(আগামীতে পড়ুন)
১. হায়াতুল আম্বিয়া বিষয়ে কয়েকটি প্রশ্ন:
ক. ‘হায়াতুল আম্বিয়া’ বা ‘হায়াতুন্নাবী’ পরিভাষাটা কি ভারতীয়?
খ. নবীগণের কবরের জীবনের সাথে দুনিয়ার জীবনের কি কোনোই সাদৃশ্য নেই?
গ. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি কবর থেকে কিছুই শুনতে পান না?
ঘ. ‘আল্লাহ আমার রূহ আমার মধ্যে ফিরিয়ে দেন’ এর দ্বারা উদ্দেশ্য কী?
২. হায়াতুল আম্বিয়া বিষয়ে দেওবন্দীদের উপরে আরোপিত আকীদা ভিত্তিহীন।
৩. দেওবন্দীদের নামে প্রচারিত এ আকীদা মিথ্যা।
৪. কাশফ ও কারামাত সত্য।
৫. উলামায়ে দেওবন্দের ঘটনাগুলো আকীদা নয় অলৌকিক।
৬. মিথ্যা স্বপ্ন, জাদু ও ভেল্কিবাজী থেকে সতর্ক থাকতে হবে।
৭. হায়াতুন্নাবী আকীদা নিয়ে উপহাস করার হুকুম কী?
টীকা
১. قال الذهبي في السير (৯/৯৯) : وهذه صفة الأحياء في الدنيا.
২. إنهم يعتقدون بحياته في البرزخ ولكنهم لايقولون بعيشه هناك كعيشه في الدنيا .
৩. حياة النبي صلى الله عليه وسلم بعد الوفاة أي في البرزخ.
৪. فثبت أن حياته دنيوية برزخية.
৫. দেখুন, তাবলীগ জামাত ও দেওবন্দীগণ পৃ. ৯০
৬. দেখুন, তাবলীগ জামাত ও দেওবন্দীগণ পৃ. ১০৮-১০৯
৭. وإسناده عند أبي يعلى : حَدَّثَنَا أَبُو الْجَهْمِ الأَزْرَقُ بْنُ عَلِيٍّ، ( ذكره ابن حبان في الثقات وقال ابن حجر : صدوق يغرب) حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ أَبِي بُكَيْرٍ (من رجال البخاري ومسلم)، حَدَّثَنَا الْمُسْتَلِمُ بْنُ سَعِيدٍ (قال في الفتح وثقه أحمد وابن حبان، وقال في التقريب : صدوق عابد ربما وهم، وقال الذهبي : صدوق)، عَنِ الْحَجَّاجِ (هو ابن أبي زياد البصري وثقه أحمد وابن معين، قلت: وأبو داود، وقال أحمد ثقة رجل صالح)، عَنْ ثَابِتٍ الْبُنَانِيِّ، عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، وقد تابع عبدُ الله بن محمد بن يحيى بن أبي بكير أبا الجهم الأزرقفي تاريخ أصفهان (ترجمة عبد الله بن إبراهيم بن الصباح)، وذكره الحافظ قاسم بن قطلوبغا في كتابه الثقات ممن لم يقع في الكتب الستة.
(تكلم عليه الإمام الذهبي في الميزان ورده الحافظ في اللسان : ( ৭৮৭ ) وأنما هو حجاج بن أبي زياد الأسود يعرف بزق العسل وهو بصري كان ينزل القسامل روى عن ثابت وجابر بن زيد وأبي نضرة وجماعة وعنه جرير بن حازم وحماد بن سلمة وروح بن عبادة وآخرون قال أحمد ثقة ورجل صالح وقال ابن معين ثقة وقال أبو حاتم صالح الحديث وذكره ابن حبان في الثقات)
৮. শায়খ আকরামুজ্জামান সম্পাদিত ‘তাবলীগ জামাত ও দেওবন্দীগণ’ কিতাবে (পৃ.৯১) বলা হয়েছে- “হাদীস বিশারদদের মতে এর সত্যতা বিতর্কিত”! কিন্তু কার মতে এবং কেন এ হাদীসের সত্যতা বিতর্কিত এর কোনো বরাত গ্রন্থকার উল্লেখ করেননি!! আল্লাহ তাআলা ভালো জানেন, একটি সহীহ হাদীস সম্পর্কে অহেতুক এমন সন্দেহ সৃষ্টি করা হল কোন্ উদ্দেশ্যে?! যা হাদীস নয় তাকে হাদীস বানিয়ে চালিয়ে দেওয়া যেমন অন্যায়, তেমনি যা হাদীস তাকে অস্বীকার করাও মহা অন্যায়। দেখুন, লিসানুল মিযান, ইবনে হাজার আসকালানী, হাজ্জাজ ইবনে আবি যিয়াদের তরজমা দ্রষ্টব্য, তরজমা নং ৭৮৭।
৯. وإسناده :حَدَّثَنَا هَارُونُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ (بن مروان الجمال، روى عنه الجماعة سوى البخاري قال في السير الإمام الحافظ الحجة) حَدَّثَنَا حُسَيْنُ بْنُ عَلِيٍّ (الجعفي الإمام الحافظ من رجال الشيخين) ، عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ يَزِيدَ بْنِ جَابِرٍ(الإمام الحافظ من رجال الجماعة) عَنْ أَبِي الْأَشْعَثِ الصَّنْعَانِيِّ (شراحيل بن آدة، ثقة من رجال الجماعة غير البخاري)
১০. ومن تأمل هذا الإسناد لم يشك في صحته, لثقة رواته وشهرتهم وقبول الأئمة أحاديثهم.
১১. قال ابن عبد الهادي في الصارم المنكي ص ২১০: عن أوس حديثا صحيحا لأن رواته كلهم مشهورون بالصدق
(বাকি অংশ ৩৪ পৃষ্ঠায়)
والأمانة والثقة والعدالة ولذلك صححه جماعة من الحفاظ كأبي حاتم بن حبان والحافظ عبد الغني المقدسي وابن دحية وغيرهم ولم يأت من تكلم فيه وعلله بحجة بينة.
১২. فالحق أن الحديث صحيح، ومن قال أنه ضعيف أو منكر، فكأنه اشتبه الأمر عليه لظنه أن الحديث من رواية ابن تميم. وقال ابن دحية: أنه صحيح بنقل العدل عن العدل، ومن قال: إنه منكر أو غريب لعله خفية به، فقد استروح؛ لأن الدارقطني ردها.
১৩. قال ابن ماجه (১৬৩৭) حَدَّثَنَا عَمْرُو بْنُ سَوادٍ الْمِصْرِيُّ (م رجال مسلم) حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ وَهْبٍ، عَنْ عَمْرِو بْنِ الْحَارِثِ، عَنْ سَعِيدِ بْنِ أَبِي هِلَالٍ، (الثلاثة حفاظ من رجال الجماعة) عَنْ زَيْدِ بْنِ أَيْمَنَ (من رجال ابن ماجه ذكره ابن حبان في الثقات وقال في التقريب : مقبول) عَنْ عُبَادَةَ بْنِ نُسَيٍّ (قال الذهبي في السير : الإمام، وقال ابن حجر في التقريب : ثقة فاضل) عَنْ أَبِي الدَّرْدَاءِ، وقد رواه المزي في تهذيب الكمال عن حرملة بن يحيى عن ابن وهب به. قال البخاري في التاريخ : زيد بن أيمن عن عبادة بن نسي مرسل،
قلت : توفي عبادة بن نسي سنة ১১৮هـ، وزيد بن أيمن من الطبقة السادسة كما في التقريب، وهذا طبقة من يمكن له أن يسمع من عبادة بن نسي وأقرانه. وقد روى سعيد بن هلال الذي روى هذا الحديث عن زيد بن أيمن عمن هو أكبر من عبادة بن نسي. فلعل البخاري سماه مرسلا على مذهبه المشهور من عدم ثبوت السماع، وإن كان كما قلت فمذهب الجمهور يدل على اتصاله، والله أعلم بالصواب.
১৪. رواه أبو الشيخ في الثواب وإسناده كما عند السيوطي في اللآلي المصنوعة : قال أبو الشيخ : حدثنا عبد الرحمن بن أحمد الأعرج حدثنا الحسن بن الصباح (من رجال البخاري قال أحمد ثقة) حدثنا أبو معاوية (الضرير محمد بن خازم من رجال الشيخين) عن الأعمش عن أبي صالح عن أبي هريرة عن رسول الله صلى الله عليه وسلم. فرجاله ثقات معروفون غير عبد الرحمن بن أحمد الأعرج الزهري،
قلت : عبد الرحمن بن أحمد الأعرج توفي سنة ৩০০ هـ، وروى عن أبي حفص عمر بن زياد الأزدي الزعفراني وحميد بن مسعدة وسلمة بن شبيب وحامد بن المساور وإبراهيم بن أحمد النابتي وروى عنه الحافظ أبو الشيخ ابن حيان وأبو أحمد محمد بن أحمد بن إبراهيم كما قال أبو الشيخ في "طبقات المحدثين بأصفهان" (৩/৫৪১) وأبو نعيم في "أخبار أصفهان" (২/১১৩)، وقال الذهبي في تاريخ الإسلام (২২/১৯২): عبد الرحمن بن أحمد بن يزيد، أبو صالح الزهري الأصبهاني الأعرج، أخو محمد بن أحمد الزهري، سمع: أبا كريب، وحميد بن مسعدة، ومسلم بن شبيب، وجماعة. وعنه: العسال، وأبو الشيخ، وأحمد بن بندار. توفي سنة ثلاثمائة.
وقال الشيخ محمود سعيد ممدوح في رفع المنارة (ص ৩১৯ ) ... فغاية ما في الرجل إنه مستور ، وهو على شرط ابن حبان لكن لم أجده في ثقاته . ومثل هذا الصنف من الرواة يقبل الجمهور حديثه ما لم يخالف كما صرح الذهبي بذلك في ترجمة مالك بن الخير الزيادي . وقال الذهبي في ترجمة زياد بن مليك (২ / ৯৩) : شيخ مستور ما وثق ولا ضعف ، فهو جائز الحديث انتهى، وقال في ترجمة الربيع بن زياد الهمداني (২ / ৪০) : ما رأيت لاحد فيه تضعيفا ، فهو جائز الحديث انتهى، وتوسع الزركشي فقال في المعتبر في تخريج أحاديث المنهاج والمختصر (ص ৬৯) : قال أهل هذا الشأن : إن جهالة الراوى لا توجب قدحا إذا كان من روى عنه ثقة ، فإن روايته عنه تكون تعديلا له انتهى، والحاصل أن رواية من كان هذا شأنه مقبولة ما لم يخالف أو يأت بمتن منكر ، ولا تجد هنا مخالفة ومتن الحديث ليس فيه نكارة . فالحديث بهذا الاسناد مقبول، وقد قال الحافظ أحمد بن الصديق الغمارى في المداوى لعلل المناوى (৬ / ২৭৭ / ১) إسناده نظيف ...انتهى.
وذكر له في اللآلي شواهد وقال ابنُ عراق في تنزيه الشريعة : (৫৪০)- [১ : ৩৩৫] ... ( قلت: ) وسنده جيد كما نقله السخاوي عن شيخه الحافظ ابن حجر والله أعلم. وله شواهد من حديث ابن مسعود وابن عباس وأبي هريرة ...
১৫. وقال شيخ الإسلام ابن تيمية في " الرد على الأخنائي " ( ص ২১০ - ২১১ ) : وهذا الحديث وإن كان معناه صحيحا ( لعله يعني في الجملة ) فإسناده لا يحتج به، وإنما يثبت معناه بأحاديث أخر، فإنه لا يعرف إلا من حديث محمد بن مروان السدي الصغير عن الأعمش وهو عند أهل المعرفة بالحديث موضوع على الأعمش .
وقال ابن تيمية في الرد على الأخنائي وفي المجموع ২৭/১১৬-১১৭ بعد هذا الحديث: وفي إسناده لين . لكن له شواهد ثابتة ...
১৬. قال ابن عبد الهادي في الصارم المنكي : وليس الاعتماد في سماعه ما يبلغه من صلاة أمته وسلامهم إلا على هذه الأحاديث الثابتة ، فأما ذاك الحديث وإن كان معناه صحيحاً فإسناده لا يحتج به ، وإنما يثبت معناه بأحاديث أخر ...
১৭. দেখুন আউনুল মা‘বুদ। হাদীসের এ তরজমা সঠিক নয় যে, (?) -‘ইবাদাহর যায়গা বানিয়ে নিও না’ (তাবলীগ জামাত ও দেওবন্দীগণ পৃ. ১০১)
১৮. হাদীসটির মারাত্মক ও হাস্যকর ভুল তরজমা করা হয়েছে- তাবলীগ জামাত ও দেওবন্দীগণ বইয়ে পৃ. ৯১
১৯. الشهداء أحياء يرزقون، ويقول: إن الشهداء بعد القتل باقون، يأكلون أرزاقهم، وكان يقول، إن الأنبياء أحياء في قبورهم يصلون.
২০. السادسة: أن الأنبياء أحياء في قبورهم، وحياتهم أكمل من حياة الشهداء، إذ أثبت الله - سبحانه - حياة الشهداء بقوله: وَلا تَقُولُوا لِمَنْ يُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتٌ بَلْ أَحْيَاءٌ وَلَكِنْ لا تَشْعُرُونَ} [البقرة: ১৪] ، وقال: وَلا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتاً بَلْ أَحْيَاءٌ عِنْدَرَبِّهِمْ يُرْزَقُون (آل عمران: ১৬৯) .أما المفترون على ابن تيمية رحمه الله بأنه لا يرى حياة الأنبياء فهذا باطل، بل هو صرح بحياتهم في قبورهم، لكن لما لم يوافقهم رحمه الله على ما ابتدعوه في الدين من جواز التوسل به بعد موته، أو الاستغاثة به، قالوا: بأنه لا يرى حياة الأنبياء في قبورهم؛ لأن هذا لازم حياة الأنبياء -كما يزعمون. قال ابن تيمية رحمه الله بعد أن تحدث عن تحريم اتخاذ قبور الأنبياء مساجد مستدلاً بكلام الرسول صلّى الله عليه وسلّم : (فهذه نصوصه الصريحة توجب تحريم اتخاذ قبورهم مساجد، مع أنهم مدفونون فيها، وهم أحياء في قبورهم) (ودليل حياة الأنبياء في قبورهم، قوله صلّى الله عليه وسلّم: الأنبياء أحياء في قبورهم (৩৪৬).
২১. قال ابن القيم : في الروح (ص৩৬) : ... ويدل على ذلك أن الشهداء بعد قتلهم وموتهم أحياء عند ربهم يرزقون، فرحين مستبشرين، وهذه صفة الأحياء في الدنيا وإذا كان هذا في الشهداء كان الأنبياء بذلك أحق وأولى، مع أنه قد صح عن النبي أن الأرض لا تأكل أجساد الأنبياء، وأنه اجتمع بالأنبياء ليلة الإسراء في بيت المقدس وفي السماء وخصوصا بموسى، وقد أخبر بأنه ما من مسلم يسلم عليه إلا رد الله عليه روحه حتى يرد عليه السلام، إلى غير ذلك مما يحصل من جملته القطع بأن موت الأنبياء إنما هو راجع إلى أن غيبوا عنا بحيث لا ندركهم وإن كانوا موجودين أحياء و ذلك كالحال في الملائكة فإنهم أحياء موجودون ولا تراهم.
و جاء (ص ৪৪) : ومعلوم بالضرورة أن جسده في الأرض طري مطرا وقد سأله الصحابة كيف تعرض صلاتنا عليك وقد أرمت فقال إن الله حرم على الأرض أن تأكل أجساد الأنبياء ولو لم يكن جسده في ضريحه لما أجاب بهذا الجواب. وقد صح عنه أن الله وكل بقبره ملائكة يبلغونه عن أمته السلام. وصح عنه أنه خرج بين أبي بكر وعمر وقال هكذا نبعث، هذا مع القطع بأن روحه الكريمة في الرفيق الأعلى في أعلى عليين مع أرواح الأنبياء، وقد صح عنه أنه رأى موسى قائما يصلى في قبره ليلة الاسراء ورآه في السماء السادسة أو السابعة فالروح كانت هناك ولها اتصال بالبدن في القبر وإشراف عليه وتعلق به بحيث يصلى في قبره ويرد سلام من سلم عليه وهي في الرفيق الأعلى، ولا تنافي بين الأمرين فإن شأن الأرواح غير شأن الأبدان...
২২. وقال الإمام الذهبي في السير في ترجمة وكيع ابن الجراح : وإنما المحذور أن تجوز عليه تغير سائر موتى الآدميين ورائحتهم وأكل الارض لأجسادهم، والنبي صلى الله عليه وسلم فمفارق لسائر أمته في ذلك، فلا يبلى، ولا تأكل الارض جسده، ولا يتغير ريحه، بل هو الآن، وما زال أطيب ريحا من المسك، وهو حي في لحده، حياة مثله في البرزخ، التي هي أكمل من حياة سائر النبيين، وحياتهم بلا ريب أتم وأشرف من حياة الشهداء الذين هم بنص الكتاب (أحياء عند ربهم يرزقون) ( آل عمران: ১৬৯) وهؤلاء حياتهم الآن التي في عالم البرزخ حق، ولكن ليست هي حياة الدنيا من كل وجه، ولا حياة أهل الجنة من كل وجه، ولهم شبه بحياة أهل الكهف.