যিলকদ ১৪৩৬   ||   সেপ্টেম্বর ২০১৫

হজ্ব : সাক্ষাৎকার : রওযার ছবি তো দিলে ধারণ করবে, ক্যামেরায় নয়

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

ইসলামের অন্যতম রুকন হজ্ব। এই মুবারক হজ্বের মওসুম চলছে। হজ্বের কিছু আমলের সৌন্দর্য এবং কিছু বিষয়ের সতর্কতা নিয়ে হৃদয়জাত কিছু কথা বলেছেন মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকার মুহতারাম আমীনুত তালীম ও মাসিক আলকাউসারের তত্ত¡াবধায়ক হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব। দুপর্বে নেওয়া সাক্ষাৎকারের পুরো বর্ণনাটি এবার প্রকাশ হল। এর অল্প কিছু অংশ গত যিলক্বদ ১৪৩৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়েছিল। একই সঙ্গে এবার হজ্বের ক্ষেত্রে প্রধান দুটি মতবিরোধপূর্ণ মাসআলার ক্ষেত্রে আমলের পদ্ধতি সম্পর্কেও তিনি তার পরামর্শ তুলে ধরেছেন।

 

? হজ্বের সময় কোন আমল বেশি করা ভালো?

A প্রথমত যখন যে আমল করণীয় সে আমল করতে হবে। তালবিয়ার সময় তালবিয়া, তাওয়াফের সময় তাওয়াফ। মসজিদে হারামে থাকা অবস্থায় তাওয়াফ সবচেয়ে ফযীলতপূর্ণ আমল। তবে কেউ যদি নফল তাওয়াফ করতে চান তখন তাকে লক্ষ রাখতে হবে, যারা ফরয-ওয়াজিব তাওয়াফ করছেন তাদের যেন কষ্টের কারণ না হয়, নফল তাওয়াফের কারণে ভিড় না বেড়ে যায়।

? মাতাফে ভিড়ের সময় নফল তাওয়াফ কীভাবে করবে বা করা উচিত?

A অস্বাভাবিক ভিড়ে নফল তাওয়াফ না করা ভালো। মাতাফের মধ্যে মূল ভিড়ে না থেকে একটু দূর দূর দিয়ে যদি করা যায় তাহলে করতে পারে। আসলে এসব ক্ষেত্রে সালীকা লাগে। লক্ষ রাখতে হয় যেন অন্যের অসুবিধা না হয়। নিজের পর্দা রক্ষা হয় এবং হজ্বের মূল আমলের সক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। হজ্বের আগে নফল তাওয়াফ বেশি করার কারণে ক্লান্তি কিংবা অসুস্থতায় হজ্বের মূল সময়ের আমলে যেন ব্যঘাত না ঘটে।

? মসজিদুল হারামে প্রবেশের পর তাওয়াফ ছাড়া তাহিয়্যাতুল মসজিদের নামায পড়ার কোনো সুযোগ বা বিধান আছে কি?

A تحية البيت الطواف মসজিদুল হারামের তাহিয়্যাহ হল, তাওয়াফ। মসজিদে হারামে প্রবেশের পর তাওয়াফ করলে তাহিয়্যাতুল মসজিদ আদায় হয়ে যায়। কিন্তু একথার অর্থ এ নয় যে, যার তাওয়াফ করার শক্তি বা উদ্যম নেই তিনি মসজিদে হারামে প্রবেশ করে চুপচাপ বসে যাবেন। বরং তাহিয়্যাতুল মসজিদের ২ রাকাত নামায তিনি পড়ে নেবেন। তখন সেটাই তার জন্য তাহিয়্যাহ। অনেকেই মসজিদে হারামে ঢুকেই বসে যান। না, তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়ন। তারপর বসুন। অনেকের ধারণা, মসজিদে হারামে তাহিয়্যাতুল মসজিদ নেই। ধারণাটি ঠিক নয়।

? অনেককেই দেখা যায়, মসজিদুল হারামে বসে দীর্ঘ সময় তিলাওয়াত করতে থাকেন। এই আমলের ফযীলত কিংবা অবস্থান সম্পর্কে যদি কিছু বলেন।

A তিলাওয়াতে কুরআন সাধারণভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। যে কোনো স্থান ও যে কোনো সময়ই এ আমলের গুরুত্ব রয়েছে। সেই আমলটিই মসজিদে হারামে করার মূল্য নিঃসন্দেহে বেশি। এটা মূলত মাহাওল বা পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে। মাহবাতে ওহী (ওহী অবতরণের স্থান)-এ বসে ওহীর কালাম তিলাওয়াত করার স্বাদই তো আলাদা। এমন নয় যে, হারামে বসে তিলাওয়াতের জন্য কোনো বিশেষ পরিমাণের  সওয়াবের ঘোষণা আছে, আমার জানামতে বিষয়টি এমন নয়। অবশ্য কেউ কেউ বলেন, হারামে নামাযের সওয়াব যেমন ১ লাখ গুণ তেমনি অন্যান্য ইবাদতের সওয়াবও। এ ধারণার কোনো স্পষ্ট দলিল আমার জানা মতে হাদীসে নেই। এর অনুকলে হয়তো কোনো আসার থাকতে পারে, আমার জানা নেই। তবে মা-হাওল কিংবা পারিপার্শিক কারণে যে কোনো ইবাদতের ঈমানী ফায়দা অবশ্যই অনেক বেড়ে যায়। হারামে অবস্থান করে বায়তুল্লাহর সামনে কোনো ইবাদত করার মূল্য তো পরিবেশের প্রভাবের কারণেই অনেক বেড়ে যায়।

? আরাফার দিনসহ যিলহজ্বের রোযা রাখার ক্ষেত্রে হজ্বের সময় করণীয় কী?

A আরাফার দিন রোযা রাখা হাজ্বী সাহেবানের জন্য মুস্তাহাব নয়। হজ্ব করছেন না যারা তারা ওই রোযা যার যার অঞ্চলে ৯ যিলহজ্ব আদায় করতে পারেন। আর যিলহজ্বের শুরু থেকে নফল রোযা রাখার ফযীলতের যে হাদীস রয়েছে সেটি দুর্বল হলেও আমলযোগ্য। তাছাড়া হাদীস শরীফে সম্মানিত মাসগুলোতে কিছু কিছু নফল রোযা রাখারও উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রেও হাজ্বী সাহেবদের জন্য করণীয় হল, নফল রোযা পালনের বেলায় হজ্বের মূল আমল পালনে ক্ষতি না হয়Ñ সেদিকে খেয়াল রাখা।

? শোনা যায়, হজ্বের সময় যিলহজ্বের ৮ তারিখ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত ভিড় ইত্যাদির কারণে কোনো কোনো সময় ঝগড়া-কলহ সৃষ্টি হয়। পারস্পরিক ছাড়ের মনোভাবও কমে যায় কারো কারো মধ্যে। এ পরিস্থিতির সংশোধনে কিংবা এ জাতীয় প্রবণতা থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য কী করা চাই?

A যার ব্যাপারে মনে রাগ আসতে চাইবে বা ছাড় না দেওয়ার চিন্তা আসবে তার ব্যাপারে এই চিন্তা করা যে, তিনি তো আল্লাহর মেহমান। আমি জানি না, হয়তো তার মেহমানি আল্লাহ তাআলার কাছে বেশি কবুল হয়ে আছে। সুতরাং তার প্রতি আমার সম্মান ও রেআয়েত বজায় রাখা উচিত।

? বাইতুল্লাহ শরীফের দিকে মহব্বতের নযরে তাকিয়ে থাকার কোনো ফযীলত রয়েছে? কিংবা এটা কি স্বয়ংসম্পূর্ণ কোনো আমল?

A বাইতুল্লাহ শরীফের প্রতি অন্তরে মহব্বত ও আযমত পোষণ অনেক বড় নেক আমল। এটি বরং ঈমানের অংশ। সে হিসেবে মহব্বতের সাথে তাকানো হচ্ছে অন্তরের ওই মহব্বত ও আযমতের বহিঃপ্রকাশ। ওই নযরের মধ্য দিয়ে অন্তরের মহব্বত-আযমত প্রকাশ হচ্ছে। কিন্তু তাকানোটাই কোনো নেক আমল কি না এবং বাইতুল্লাহর দিকে তাকানো সম্পর্কে বিশেষ কোনো সওয়াব বা ফযীলতের কথা সহীহ হাদীসে এসেছে কি নাÑ তাহকীক হওয়া দরকার। এমনি তো মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবায় (৮/৫৪৪) আতা রাহ.সহ একাধিক তাবেয়ী থেকে একথা বর্ণিত আছে যে,

النظر إلى البيت عبادة

বাইতুল্লাহর দিকে তাকানো ইবাদত। আমলের জন্য এটিও যথেষ্ট দলিল।

? বাইতুল্লাহ শরীফের দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় বান্দার দিলে কেমন অনুভতি থাকা দরকার?

A  [তিনি প্রথমে আয়াতে কারীমা তিলাওয়াত করলেন। সূরা আলে ইমরানের ৯৬ ও ৯৭ নম্বর আয়াত।] এরপর চারটি শব্দ বললেন, বাইতুল্লাহর দিকে নযর করে বিশেষভাবে হিদায়াত, বরকত, আমন ও রিযকে হালাল লাভের অনুভতি লালন করা দরকার এবং একই সঙ্গে এ অনুভতিটির দুআও করা যাবে নিজের জন্য, নিজের নিকটজন, পরিবার ও পুরো উম্মতের জন্য। সূরা আলে ইমরানের ৯৬ ও ৯৭, সুরা কাসাসের ৫৭ আয়াতে এবং সূরা কুরাইশে বাইতুল্লাহর এ সিফাতগুলোর কথাই বর্ণিত হয়েছে।

? হজ্বের সফরে খাস কোনো ব্যক্তিকে করণীয়-বর্জনীয় কিছু পরামর্শ দিলে কী বলবেন?

A  আমি তো আম-খাস উভয় শ্রেণীকে একই কথা বলব। মদীনা মুনাওয়ারায় যখন যাবে সালাত ও সালাম পেশ করার সময় রওযার দিকে কেউ উঁকি-ঝুকি মারবে না, নযর নিচে রাখবে। আওয়ায নিচু রাখবে। কথা বলবে না। ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কি করা হয়। এসব একদমই করা যাবে না। বিশেষত রওযার সামনে এগুলো মারাত্মক বেয়াদবি। এভাবেই সালাত ও সালাম পেশ করবে। জাওয়াল  (মোবাইল) বা ক্যামেরা দিয়ে কোনোভাবেই যেন রওযা শরীফের ছবি তোলা না হয়। ডিজিটাল ছবিও না। ডিজিটালের নামে ছবি তোলার পক্ষে কোনো বাহানা অবলম্বন করা ঠিক নয়। রওযার ছবি তো দিলে ধারণ করবে; ক্যামেরায় নয়। এই ডিজিটালের বাহানা দিয়ে হারামাইনের রূহানিয়্যাত নষ্ট করা হয়। যে কোনো ব্যক্তির বা তার ঘরের ছবি কেউ তুললে তো তার অনুমতি নিতে হয়। এটাই তো নিয়ম ও শরাফত। তো রওযার ছবি তোলার ক্ষেত্রে লোকেরা কার অনুমতি নেয়? ডিজিটাল ছবির বৈধতা তর্কের খাতিরে মেনে নিলেও এভাবে ছবি তোলা তো বেয়াদবি নিঃসন্দেহে।

আরেকটি বর্জনীয় বিষয় হচ্ছে, মিনা-আরাফায় অযথা কথা বলা ও ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়া। ব্যক্তিগত কিংবা মাসআলার ইখতেলাফের বিষয়ে কোনো ক্ষেত্রেই ঝগড়া করা যাবে না।

? মদীনা শরীফে অবস্থানকালে কোন আমলটি বেশি করা যায়?

A মদীনা শরীফে অবস্থানকালে সাধারণভাবে সবচেয়ে বেশি করার মতো আমল হচ্ছে, বেশি বেশি দরূদ শরীফ পাঠ করা।

? কোনো উম্মত যদি রওযার সামনে থাকা অবস্থায় এই কল্পনা করে যে, পর্দার ওই পাশে নবীজী শুয়ে আছেন, আমি তাঁর সামনে উপস্থিত হয়েছি। তিনি আমার সালাত ও সালাম শুনছেন্ এ চিন্তা করে সালাম পেশ করে এবং নিজের অনুভূতিকে জাগ্রত করেÑ তাহলে সেটি কি সঠিক হবে?

A সঠিক। কোনো সমস্যা নেই। নবীগণের বরযখি হায়াত খুব শক্তিশালী। আল আম্বিয়াউ আহইয়াউন ফী কুবূরিহীম

? হারামাইনে দিল তৈরির জন্য যদি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের কষ্ট-সহিষ্ণুতা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার ইতিহাসের ঘটনাগুলো স্মরণ করা হয় আর কল্পনা করা হয় সেটি কি অনুমোদনযোগ্য?

A এটি উত্তম আমল। এমনটিতে কোনো অসুবিধা নেই।

? বিভিন্নজনের কাছে শোনা যায়, হজ্বের সফরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কোনো কোনো সময় অসতর্কতার কারণে পর্দা বজায় রাখার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা তৈরি হয়। এটা থেকে বেঁচে থাকার উপায় কী হতে পারে?

A আগের চেয়ে এখন জায়গার প্রশস্ততা বাড়ানোর কারণে এ সমস্যা অনেক কমে গেছে। এরপরও অনিচ্ছাকৃতভাবে পর্দার মাসআলায় কিছু ত্রæটি-বিচ্যুতি ঘটে গেলেও হারামাইনের বরকতে সেখানে তার কোনো বদ প্রভাব পড়ে না। তবে চিন্তা ও কাজে না-মুনাসিব কোনো কিছু হলে সঙ্গে সঙ্গে আসতাগফিরুল্লাহ, আউযুবিল্লাহ ও লা-হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ পাঠের আমল করা চাই।

? এবার হজ্বের মতবিরোধপূর্ণ দুটি মাসআলার বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই। হজ্বের সময় কখনো কখনো কিছু মতবিরোধপূর্ণ মাসআলা নিয়ে তর্কের সৃষ্টি হয়। যেমন, মিনা-আরাফায় চার রাকাতের নামায ৪ রাকাত পড়বে নাকি ২ রাকাত পড়বেÑ এটা নিয়ে তর্ক হয়, তেমনি আরাফার ময়দানে তাবুতে যোহর-আসর যোহরের সময় একসঙ্গে পড়বে নাকি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এটা নিয়েও তর্ক হয়। এই দুক্ষেত্রে মতবিরোধ ও তর্কাতর্কির হাকীকত কী?

A শুধু এ বিষয়গুলোতেই নয়, যে কোনো মতবিরোধপূর্ণ বিষয়েই তর্কে লিপ্ত হওয়ার অবকাশ নেই। বরং বিষয়টিকে নিজের কাফেলার আমীরের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। আমীর যদি আলেম হনÑ তিনি যেভাবে আমল করেন অন্যরাও সেভাবেই আমল করবেন। আর যদি তিনি আলেম না হন, কাফেলার মধ্যে থাকা কোনো আলেমকে তিনি জিজ্ঞাসা করে নেবেন। সে হিসেবে অন্যরাও আমল করবেন। এরপরও যদি এ ব্যাপারে কাফেলাভুক্ত কারো দ্বিমত থাকে, তিনি নিজে ভিন্নভাবে আমল করে নেবেন। তবু তর্কে লিপ্ত হবেন না। মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ের ক্ষেত্রে এটা সাধারণ নীতি। এই নীতির ওপর আমল হলে ঝগড়া-ফাসাদের কোনো অবকাশ থাকবে না।

এবার প্রথমে আমরা মিনা-আরাফায় ৪ রাকাতের নামাযগুলো ২ রাকাত না কি ৪ রাকাত পড়া হবেÑ এই বিষয়ে আলোচনা করি। দু রাকাত-চার রাকাতের বিষয়টির একটি দিক এই যে, ইমামদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে যে, হজ্বরত ব্যক্তি মুসাফির না হলেও কি কসর করবে? কেউ কেউ বলেন, হজ্ব নিজেই কসরের কারণ, যেমন: শরঈ সফর কসরের কারণ। বাস্তবে হাজ্বী মুসাফির হোক কিংবা না হোক। তাই মিনা-আরাফায় সকল হাজ্বীই কসর করবেন। এটা হানাফী মাযহাবের মত নয়। হানাফী মাযহাবের মত হল এবং তা দলীলের দিক থেকে শক্তিশালীও বটে, মিনা-আরাফায় থাকাকালে হাজ্বী মুসাফির হলে চার রাকাতের নামায দুই রাকাত পড়বে। মুকীম হলে চার রাকাত পড়বে। তাই হানাফী মাযহাবের হাজ্বীদের মাঝে মতবিরোধ থাকার কথা ছিল না।

কিন্তু নতুন প্রেক্ষাপটে এখানে আরেকটি বিষয় বিবেচনায় এসে গেছে। তা হল, এটি তো জানা মাসআলা যে, কোনো শহরে কেউ ১৫ দিন থাকার নিয়ত করলে মুকীম হয়ে যায়। আগে মক্কা ভিন্ন শহর আর মিনা ভিন্ন জায়গা হওয়ার ব্যাপারে কোনো দ্বিমত ছিল না। কিন্তু এখন বসতি বেড়ে মিনা মক্কার সাথে মিলে যাওয়ার কারণে মক্কা-মিনাকে একই শহর ধরা না ধরার বিষয়টি উপস্থিত হয়েছে। তাই কোনো কোনো হানাফী ফকীহের মত অনুযায়ী মক্কা-মিনা মিলে ১৫ দিন হলেও মুকীম। আর কোনো কোনো হানাফী ফকীহের দৃষ্টিতে আগের মতো এখনও মক্কা ভিন্ন শহর, মিনা ভিন্ন আবাদি। তাদের কাছে দু জায়গায় মিলিয়ে ১৫ দিন হলে হাজ্বী মিনায় মুসাফির গণ্য হবে। নতুন এই প্রেক্ষাপটে হানাফী মাযহাব অনুসারীদের মাঝেও মতবিরোধ হয়েছে। একদিকে দারুল উলূম করাচী। তারা মিনাকে মক্কার সঙ্গেই গণ্য করেন। অপরদিকে দারুল উলূম দেওবন্দ এবং বিন্নৌরি টাউন। তারা মিনাকে ভিন্ন গণ্য করেন।

আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, এটি সম্পূর্ণ দ্বীনী বিষয়। লড়াই-ঝগড়ার কোনো অবকাশ এতে নেই। সবাই নিজেদের কাফেলার আমীরের সিদ্ধান্ত মেনে চলব। তারপরও যদি কেউ নিজের আস্থাভাজন আলিমের ফতওয়ার উপরই আমল করতে চায় সে আমীরের অনুমতি নিয়ে ভিন্নভাবে আমল করুক। কিন্তু অন্যদের সাথে বিবাদে লিপ্ত হবে কেন? এ ভিন্নতার একটা বাস্তব সুরাহা এভাবে হতে পারে, তাবুতে যদি এমন কেউ থাকেন যিনি উভয় পক্ষের দৃষ্টিতেই মুকীম (অর্থাৎ মক্কায় ১৫ দিন কাটিয়েছেন) তাকে ইমাম বানিয়ে অন্যরা তার পেছনে নামায পড়বেন। তাহলে আর সমস্যা থাকল না। উভয় পক্ষের সিদ্ধান্তই এতে পালিত হল।

? আরাফার ময়দানে তাঁবুতে যোহর-আসর একসঙ্গে পড়া না পড়ার বিষয়ে যে মতবিরোধ হয়Ñ এ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য?

A এ বিষয়ে প্রথম কথা তো হচ্ছে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ্জাতুল বিদার সময় আরাফায় যোহর-আসর একসঙ্গে (আসরকে এগিয়ে এনে) পড়েছেন। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হল, কেউ যদি ইমামুল হজ্বের পেছনে নামায আদায় না করে নিজের তাঁবুতে পড়ে সে-ও কি যোহর-আসর একসঙ্গে পড়বে না কি আলাদা পড়বে? উল্লেখ্য, মুযদালিফাতে একা, নিজেদের জামাতে কিংবা ইমামুল হজ্বের পেছনে পড়Ñ সর্বাবস্থায় মাগরিব-এশা একসঙ্গে (মাগরিবকে এশার সময় পিছিয়ে) পড়বে। কোনো মতবিরোধ নেই। আরাফায় যোহর-আসর একসঙ্গে পড়ার বিষয়টিও কি মুযদালিফার মতো স্বতঃসিদ্ধ? মতবিরোধহীন? এর উত্তর হচ্ছে, স্বয়ং খায়রুল কুরূনের  মধ্যেও (সাহাবী-তাবেয়ীগণের যুগেও) এ বিষয়ে ইখতিলাফ পাওয়া যায়। কেউ তাঁবুতে (ইমামুল হজ্বের পেছনে নয়) পড়লেও একসঙ্গে পড়েছেন। কেউ তাঁবুতে পড়লে ভিন্নভাবে পড়েছেন। ইমাম আবু হানিফা রাহ. আহাদীস ও আসার থেকে যা বুঝেছেন এবং উম্মাহর সামনে পেশ করেছেন তা হল, আরাফায় ইমামুল হজ্বের পেছনে পড়লে যোহর-আসর একসঙ্গে পড়বে আর নিজেরা ভিন্নভাবে পড়লে যোহরের সময় যোহর এবং আসরের সময় আসর পড়বে। এই হচ্ছে মাসআলা।

যদি তাঁবুতে অন্য মাযহাবের অনুসারী কোনো হাজ্বী থাকেন, সাধারণত বাঙালী হাজ্বী-ক্যাম্পগুলোতে অন্য মাযহাবের অনুসারী হাজ্বী থাকার কথা নয়। কিন্তু অনেক বাংলাদেশি আরবের হাম্বলী আলেমদের অনুসরণ করেন, যদিও উনারা তাকলীদ ও মাযহাবের কঠিন বিরোধী। তাদের অনেকেই একই তাঁবুতে থাকেন। তখন কেউ বাড়াবাড়ি করলে সমস্যা দেখা দিতে পারে। আমলি ক্ষেত্রে এর একটি সুরাহা এই হতে পারে যে, বড় তাঁবুর একদিকে এক মাসলাকের লোকেরা অন্যদিকে অন্য মাসলাকের লোকেরা যার যার মাসলাক অনুযায়ী আমল করবেন। এ বিষয়ে কেউ কাউকে কিছু বলতে যাবেন না। কোনো তর্ক-ঝগড়ায় যাওয়া যাবে না। ঝগড়া-বিবাদ এমনিতেই নিন্দনীয়। মতবিরোধপূর্ণ মাসআলা নিয়ে ঝগড়া আরো খারাপ কাজ। এ বিষয়ে সালাফী ভাইদের জানা থাকা উচিত, এখানে বিপরীত মতটিও একটি মুজতাহাদফীহ রায়। আর হানাফী ভাইদের জানা থাকা উচিত, এ বিষয়ে হানাফী মাযহাবের ইমামদের মধ্যেই কারো কারো অন্যমত রয়েছে। ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. এটিই বলেন যে, ইমামুল হজ্বের সাথে না পড়লেও যোহর ও আসরের নামায যোহরের ওয়াক্তে একসাথে পড়বে। ইমাম ত্বহাবী এ মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাই এ বিষয়ে বাড়াবাড়ি কোনোক্রমেই কাম্য নয়। বিশেষ করে  হজ্বের সময় সব ধরনের বিতর্ক থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা উচিত। আশ্চর্যের বিষয় হল, এসব পরিস্থিতিতে দেখা যায়, অনেক আল্লাহর বান্দা কিছু না জেনে না বুঝেও বিতর্কে লিপ্ত হয়। অভ্যাসটাই কেমন হয়ে গেছে। অথচ যিনি জানেন তার ওপর বিষয়টি হাওয়ালা করে দিলে আমি দায়মুক্ত হয়ে যেতে পারি। আর সেটাই তো নিরাপদ।

? এ বিষয়গুলোসহ হজ্বের সময় আরো কিছু মতবিরোধপূর্ণ বিষয় রয়েছে। সেগুলো নিয়েও তর্ক-ঝগড়া হয়। এসমস্ত বিষয় নিয়ে অদূর ভবিষ্যতে কোনো লেখা তৈরি করার ইচ্ছা কি আপনার আছে?

A ইনশাআল্লাহ এজাতীয় মতবিরোধপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে একটি মাকালা তৈরি করার নিয়ত আছে। কিন্তু সেটা অদূর ভবিষ্যতে না দূর ভবিষ্যতে তা আল্লাহ ভালো জানেন। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দিন। 

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : শরীফ মুহাম্মদ

 

 

 

 

advertisement