যিলকদ ১৪৩৬   ||   সেপ্টেম্বর ২০১৫

একটি হত্যাকাণ্ডের বিচার অন্তত ইসলামী আইনে করুন

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

মাস খানেকের মধ্যের খবর। একের পর এক ঘটে চলেছে। শেখ সামিউল আলম রাজনসহ বেশ কয়েকটি শিশুকে নিষ্ঠুর-নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করার ঘটনা। এসব ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় হয়েছে, এখনও হচ্ছে। ভয়ংকর ও অমানবিক এসব ঘটনায় হতবাক হয়ে যাচ্ছেন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা। প্রশ্ন জেগেছে, হঠাৎ করেই কি এসব অমানবিক ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে না সারা বছরই এ জাতীয় ঘটনা কিছু কিছু ঘটে থাকে? এখন কি গণমাধ্যমে এসবের খবর একটু বেশি আসছে? আজ (২৭/০৮/২০১৫)ও তিনটি শিশু হত্যার সংবাদ খবরের কাগজে ছেপেছে।

ঘটনা আসলে কিছু কিছু আগেও ঘটেছে। কিন্তু সম্প্রতি মনে হয় এ-জাতীয় বীভৎস ঘটনা নতুন মাত্রা পেয়েছে। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ সক্রিয় রয়েছে বলে অনুমিত হয়। এক. মারাত্মক সামাজিক অবক্ষয় ও অধঃপতন। যার ফলশ্রæতিতে কেবল হত্যা নয়- নির্মম ও নিষ্ঠুর প্রক্রিয়ায় শিশু হত্যার যেন উৎসব শুরু হয়েছে। দুই. আইনের শাসনের অনুপস্থিতি। আইনের দুর্বল হাত এবং আইন প্রয়োগকারীদের ইচ্ছাকৃত অমনোযোগ কিংবা অসততার নজিরই এখন বেশি। দিনের পর দিন পার হয়ে গেলেও হত্যা মামলার আসামী ধরা পড়ে না। এ দুটি বিষয়েই বিশদ আলোচনার দাবী রাখে।

এছাড়াও এ জাতীয় ভয়াবহ ঘটনা থেকে কীভাবে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় তাও সকলের ভেবে দেখা দরকার। আর এরকম জঘন্য বর্বর ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে ইসলামী বিধিতে বিচার করলে কী সুফল পাওয়া যেতে পারে- সেদিকেও নযর দেয়া প্রয়োজন।

সামাজিক অবক্ষয় ও অধঃপতনের বিষয়টি তো পরিষ্কার। রাজনকে দীর্ঘ সময় নিয়ে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এরপর সে হত্যার চিত্র হত্যাকারীরাই ভিডিও করে ইউটিউবে ছেড়ে দিয়েছে। বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে যে-ই এ হত্যার দৃশ্য দেখেছে চমকে উঠেছে। প্রত্যেককেই ঘটনাটি আতংকিত করেছে- নাড়া দিয়েছে। এর পরপরই দু-চারদিনের বিরতি দিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একের পর এক শিশুহত্যার খবর প্রকাশিত হয়ে চলেছে। প্রত্যেকটি খবরই মর্মান্তিক ও বর্বরতাপূর্ণ। পেটে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা, পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অত্যাচার করে হত্যা। এমনকি মাতৃগর্ভে থাকা শিশুকে গুলিবিদ্ধ করার মত জঘন্য কাণ্ডও সংঘটিত হয়েছে। এসব ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে মুষ্টিমেয় কিছু লোক। কিন্তু এসব কারণে একটি জাতি হিসেবে, মুসলিম পরিচয়ের অধিকারী হিসেবে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে সবারই। পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে এমন, যেন এসব বর্বরতার পেছনে আমাদেরও অংশগ্রহণ রয়েছে। অথচ অদ্ভুৎ ব্যাপার হচ্ছে, মানব উন্নয়নের বিভিন্ন সূচক উল্লেখ করে বেশ কিছুদিন যাবতই বেশ বাগাড়ম্বর করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, অমুক অমুক সূচকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। মা ও শিশু স্বাস্থ্যে এ বিশাল সাফল্য অর্জিত হয়েছে। অমুক ক্ষেত্রে আমরা নজির স্থাপন করেছি। আমাদের মডেল অন্যরা অনুসরণ করতে পারে। যে জাতির শিশুদের নিয়ে এ জাতীয় বর্বর হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতা চলে তারা কি এগিয়ে যাচ্ছে, না পিছিয়ে যাচ্ছে- সে চিন্তাটি নতুন করে করা দরকার। তারা নিজেদের বীভৎসতার নজির দুনিয়ার সামনে উপস্থাপন করছে কি না সেটা নিয়েই নতুন করে ভাবা দরকার।

ঘটনাগুলোর পরপর জনগণের মধ্যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এজন্য কয়েকদিন টানটান উত্তেজনা দেখা গেলেও এখন দেখা যাচ্ছে পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হয়ে আসছে। গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, রাজনহত্যার তদন্ত শেষে এজহার দাখিল হচ্ছে। কিন্তু দ্রæত বিচার কিংবা শাস্তি হতে যাচ্ছে- এমন কোনো আলামত এখনও দেখা যাচ্ছে না। বরং এদেশে অন্যসব দীর্ঘসূত্রিতাপূর্ণ মামলার ক্ষেত্রে যা হয়- এক্ষেত্রেও সম্ভবত তাই হতে যাচ্ছে। প্রথমে হৈ চৈ এরপর মামলা, তারপর তদন্ত, অভিযোগপত্র দাখিল এবং একসময় সবকিছুই হারিয়ে যাওয়াÑ এই হচ্ছে সাধারণ মামলার ধারাবাহিকতা। এখানেও তাই ঘটতে যাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। এর ব্যতিক্রম কিছু হতে পারে বলে দেখা যাচ্ছে না। মারাত্মক অবক্ষয় ও বর্বরতার প্রতিকারবিহীন এক পরিস্থিতি যেন আমাদের ওপর চেপে বসেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এসব বর্বরতা অব্যাহতভাবে ঘটেই চলেছে? এটা হঠাৎ করে ঘটে থাকলে কিংবা অপ্রত্যাশিতভাবে কোনো ঘটনা ঘটলে এমন ঘটনা তো বার বার ঘটার কথা ছিল না। তাহলে কেন ঘটছে? আর এসব ঘটনা বেড়েই যাচ্ছে কেন? বিভিন্নজন এর বিভিন্ন কারণ বিশ্লেষণ করছেন। এর একটি কারণের কথা জোর দিয়ে বলা হচ্ছে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানও বলেছেন, ‘এসব ঘটছে, কারণ আইনের শাসন উপস্থিত নেই।তার এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত না করেও আমরা বলতে পারি, একপ্রকারের আইনের শাসনের চর্চা তো দেশে বিরাজমান। দেশে আদালত আছে, সে আদালতে মামলা হয়, শুনানি হয়, সাক্ষী-সাবুদ পেশ করা হয়। জেল-যাবজ্জীবন-ফাঁসির আদেশও হয়। তাই প্রশ্ন জাগে, এরকম একটি সভ্য রাষ্ট্রে প্রকাশ্যে এতবড় বর্বর পদ্ধতিতে শিশুহত্যার সাহস কীভাবে পায় কিছু মানুষ? এতে বোঝা যায়, কিছু ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনের শাসনও কাজ না করার বিষয়ে কিছু লোকের মজবুত প্রত্যয় রয়েছে। সেজন্যই এ জাতীয় ঘটনা ঘটতে পারছে।

শুধু রাজনহত্যার ঘটনাটি বিচার করে দেখতে পারি। কী নির্মম! কী ভয়ংকর!! রাজনকে বেঁধে লম্বা সময় নিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে মারা হয়েছে। ছেলেটা চিৎকার করেছে। অনুনয়-বিনয় করেছে। আশপাশের কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে যায়নি। হত্যাকারীরা উল্লাস ও তামাশা করেছে। নিজেদের উদ্যোগে ওই বীভৎসতা ভিডিও করে ইউটিউবে আপলোড করেছে। নির্মম হত্যা, নিষ্ঠুর প্রকাশ এবং বীভৎস দম্ভ। একটি রাষ্ট্র, আইন, সমাজ ও মানবিকতার প্রতি চড়ান্ত বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের নামান্তর।

এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, এ ঘটনাটি এবং এ জাতীয় অন্য ঘটনাগুলোর কোনোটিই হঠাৎ করে ঘটে যায়নি কিংবা ভুল করে সংঘটিত হয়নি। এমন কোনো বিষয়ই এগুলো নয়। বরং এক শ্রেণির মানুষ নিজেদেরকে দেশের বিদ্যমান আইন ও আইনপ্রয়োগের সব ধরনের নিয়ম-কানুনের ঊর্ধ্বে ভেবে নিয়েছে। এজন্যই তারা এত মারাত্মক বর্বরতা ও ধৃষ্টতা দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে। সাম্প্রতিক কালে রাজনসহ বেশ কয়েকটি শিশুর নির্মম হত্যাকারীদের প্রত্যেককেই ওই মানসিকতার লোক বলেই ধারণা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে মায়ের গর্ভের শিশুকে গুলিবিদ্ধকারীরাও ওই মানসিকতার বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয়, ইসলামী আইন সম্পর্কে ন্যূনতম অবগতি যাদের রয়েছে এমন প্রতিটি মানুষই জানেন, ইসলামের ফৌজদারি বিধানগুলো যুগান্তকারী, দৃষ্টান্তমূলক এবং চ্যালেঞ্জিং। মূলত প্রচলিত দÐবিধি আর ইসলামী দণ্ডবিধির মূল বৈশিষ্ট্যের মাঝেই রয়েছে মৌলিক কিছু পার্থক্য। প্রচলিত দÐবিধি মানব কর্তৃক রচিত। আর প্রধান প্রধান ইসলামী দÐবিধির সবগুলোই আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক সুনির্ধারিত ও বিশ্লেষিত। পক্ষান্তরে প্রচলিত দÐবিধিগুলো স্থান-কাল-পাত্র হিসেবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তৈরিকৃত। এ ক্ষেত্রে কোন হত্যাকাণ্ডের বিচার কতটা নরম পন্থায় কিংবা কঠোর পন্থায় কতটা দ্রæত কিংবা ধীর লয়ে করা হবে- এটা অনেকটাই কর্তৃপক্ষের করুণার ওপর নির্ভর করে। কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে বিশেষ আদালত কিংবা দ্রæত আদালত গঠন করা হলে বিচার অনেক সময় দ্রæত হয়ে থাকে। তারা মনোযোগ না দিলে সেটা আর হয় না। কর্তৃপক্ষীয় মনোযোগ না পেলে যে কোনো নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচারও বছরের পর বছর ঝুলে থাকতে পারে।

উদাহরণ হিসেবে আমরা যদি রাজন হত্যার দিকে নজর দিই তাহলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। এ হত্যার পর বরাবরই আলোচিত হয়েছে এবং সরকারের বিভিন্ন কর্তা ব্যক্তিরাও বলেছেন, এ হত্যার বিচার বিশেষ আদালতে হবে। কিন্তু জনগণের আবেগ স্তিমিত হয়ে যাওয়া এবং মিডিয়ার প্রচার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর শোনা যাচ্ছে, মূল আসামীকে অনুপস্থিত বা ফেরারি দেখিয়েই মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ প্রচলিত আইনে এ ধরনের জঘন্যতম ঘটনার মামলারও গতি-প্রকৃতি ঠিক করা এবং কী ধরনের কোর্টে এর বিচার সম্পন্ন হবে তা সাব্যস্ত করার এখতিয়ার শাসকের হাতেই থাকে। পক্ষান্তরে ইসলামের ফৌজদারি দÐবিধিতে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক এ জাতীয় হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই। কোন হত্যাকাণ্ডের বিচার কীভাবে হবে, অভিযোগ কীভাবে প্রমাণিত হবে, শাস্তি কী হবেÑ সবকিছুই কুরআন-সুন্নাহতে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ রয়েছে। এজন্যই কোনো এক ফৌজদারি মামলায় একজন ভিআইপি মর্যাদার ব্যক্তি অভিযুক্ত হওয়ার পর তার হস্ত কর্তনের শাস্তি লাঘব করার সুপারিশ নিয়ে আসলে খুবই রাগান্বিত হয়েছিলেন মানবতার নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি এরশাদ করেন,

أَتَشْفَعُ فِي حَدٍّ مِنْ حُدُودِ اللَّهِ، ثُمَّ قَامَ فَاخْتَطَبَ، ثُمَّ قَالَ: إِنَّمَا أَهْلَكَ الَّذِينَ قَبْلَكُمْ، أَنَّهُمْ كَانُوا إِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الشَّرِيفُ تَرَكُوهُ، وَإِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الضَّعِيفُ أَقَامُوا عَلَيْهِ الحَدَّ، وَايْمُ اللَّهِ لَوْ أَنَّ فَاطِمَةَ بِنْتَ مُحَمَّدٍ سَرَقَتْ لَقَطَعْتُ يَدَهَا.

তরজমা : তুমি কি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত দÐসমূহের কোনো একটির বিষয়ে সুপারিশ করছ? তারপর তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বক্তব্য দিলেন। অতপর বললেন, নিশ্চয়ই তোমাদের পূর্বের জাতিসমূহ ধ্বংস হয়েছে এ কারণে যে, তাদের মাঝে কোনো অভিজাত লোক যদি চুরি করত তবে তারা তাকে রেহাই দিত। আর যদি তাদের মাঝের কোনো দুর্বল লোক চুরি করত তাহলে তারা তার উপর নির্ধারিত দÐ বাস্তবায়ন করত। আল্লাহ তাআলার কসম! যদি মুহাম্মাদের মেয়ে ফাতেমাও চুরি করত তাহলে আমি তারও হাত কেটে দিতাম!Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৩৪৭৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬৮৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৩৭৩

হাদীসের দীর্ঘ বক্তব্যের শেষাংশটি ঐতিহাসিক এবং নজিরবিহীন। মানবতার নবী সাইয়েদুল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে এমন একজন মহিয়সীর নাম উল্লেখ করেছেন যিনি সমগ্র জান্নাতী নারীদের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ। অর্থাৎ তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, অপরাধী যে কোনো পর্যায়ের ভিআইপি হোক, যে কোনো মান ও পর্যায়েরই হোক- যদি সে কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয় তাহলে তাকে শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি অবশ্যই ভোগ করতে হবে। এই নীতি ও আদর্শের ওপর আমরা আমল করলে আমাদের সমাজে প্রভাবশালী অমুক নিজে কিংবা অমুকের অমুক পুত্র অপরাধ করার কোনো রকম সাহস পেত না। অথবা যে যখন সরকারে থাকে তার সমর্থক ছাত্র-যুবকদের ধৃষ্টতা ও বর্বরতাও আমাদের দেখতে হত না। যেমনটি দেখতে হল কদিন আগে গর্ভবতী মা তার গর্ভের শিশুসহ গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায়।

এবার ফিরে আসি রাজন হত্যার বিষয়ে। রাজন হত্যাকাÐকে ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করতে গেলে প্রথমেই একটি বিষয় অনুধাবন করতে হবে। সেটি হচ্ছে, ইসলামের দৃষ্টিতে হত্যার বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে। ইসলামের ফৌজদারি বিধিতে সব হত্যাকে এক দৃষ্টিতে দেখা হয় না। কোনো কোনো হত্যা আছে যেগুলো হত্যার চেয়েও মারাত্মক। এজন্য তার শাস্তিও বেশি। এরকম একটি হত্যা হচ্ছে مجاربة  (মুহারাবা)। অর্থাৎ রাষ্ট্রের আইন-কানুন ও নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রকাশ্যে কারো জীবন-সম্পদ ও সম্ভ্রমের ওপর আক্রমণ করা। এ ধরনের হত্যা সাধারণ হত্যা হিসেবে গণ্য হয় না; বরং তার চেয়েও এক ধাপ বেশি অর্থাৎ মুহারাবা হিসেবে গণ্য হয়।

রাজনহত্যার পর্বগুলো দেখলে বোঝা যায়, এটাও মুহারাবার পর্যায়ভুক্ত একটি হত্যাকাÐপ্রথমত নির্মমভাবে পিটিয়ে প্রকাশ্যে তারা হত্যা করেছে। রাখঢাক করে কিছুই করেনি তারা। অস্বীকারও করেনি, প্রথমে পালিয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করেনি। উল্টো সে ঘটনা নিজেদের উদ্যোগে ইউটিউবে ছেড়েছে। ভিডিও করেছে, ব্যঙ্গ ও তাচ্ছিল্য করেছে। হত্যার অপরাধের সাথে মারাত্মক দম্ভ করেছে তারা। আইন, নিয়ম ও সভ্যতাকে থ্রেট করেছে, অবজ্ঞা প্রকাশ করেছে। এ দৃষ্টিতে এটি মুহারাবার আওতাভুক্ত। এ জাতীয় অপরাধী অর্থাৎ মুহারিবীনের শাস্তি কুরআনে কারীমে বর্ণিত হয়েছে,

اِنَّمَا جَزٰٓؤُا الَّذِیْنَ یُحَارِبُوْنَ اللّٰهَ وَ رَسُوْلَهٗ وَ یَسْعَوْنَ فِی الْاَرْضِ فَسَادًا اَنْ یُّقَتَّلُوْۤا اَوْ یُصَلَّبُوْۤا اَوْ تُقَطَّعَ اَیْدِیْهِمْ وَ اَرْجُلُهُمْ مِّنْ خِلَافٍ اَوْ یُنْفَوْا مِنَ الْاَرْضِ ؕ ذٰلِكَ لَهُمْ خِزْیٌ فِی الدُّنْیَا وَ لَهُمْ فِی الْاٰخِرَةِ عَذَابٌ عَظِیْمٌ.

তরজমা : যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করে এবং দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায় এটাই তাদের শাস্তি যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে অথবা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদেরকে নির্বাসিত করা হবে। দুনিয়ায় এটাই তাদের লাঞ্ছনা ও পরকালে তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তিÑসুরা মায়েদা (৫) : ৩৩

যেহেতু রাজনের হত্যাকারীরা নিজেরাই নিজেদের প্রকাশ করেছে এবং পরবর্তীতে গ্রেফতার হওয়ার পর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে তাই তাদের অপরাধ প্রমাণের জন্য প্রচলিত সাধারণ পর্যায়ের হত্যামামলার মত দীর্ঘ সূত্রিতার পথে যাওয়ার কোনো অর্থই হয় না। বরং সামান্য সময়ের মধ্যেই এ ঘটনার আসামীদের শাস্তি সুনিশ্চিত করা সম্ভব- যদি ইসলামী ফৌজদারি দণ্ডবিধিকে অন্তত এক্ষেত্রে অবলম্বন করা হয়।

ন্যূনতম পর্যায়ে এটি কতল বা হত্যাকাণ্ড হিসেবে তো অবশ্যই গণ্য হতে বাধ্য (যদি মুহারাবা হিসেবে গণ্য না-ও করা হয়।) এখানে ভিডিও ফুটেজসহ আসামীদের স্বীকারোক্তি বিদ্যমান। ইসলামী ফৌজদারি বিধি অনুযায়ী শাস্তি কার্যকর করে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার। দীর্ঘসূত্রিতা বা বিলম্বের সুযোগ দেয়া উচিত হবে না। ইসলামী ফৌজদারি বিধি অনুযায়ী দ্রæত ও প্রকাশ্যে শাস্তি নিশ্চিত করে কিসাস নেয়া হলে এজাতীয় বর্বর ঘটনার মাত্রা কমে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আইনের উর্ধ্বে নিজেদের ভাবার এত বেশি লোক তখন থাকবে না। এবং এতে বর্বরতা ও নির্মমতাও নিয়ন্ত্রিত হবে। পক্ষান্তরে যদি অন্য দশটি মামলার মতো এটিকে ধীর গতিতে এগিয়ে নেয়া হয় তাহলে হয়তো দেখা যাবে একদিন এই মামলা নিখোঁজ হয়ে যাবে। অথবা ১০/১৫ বছর পর কোনো একটি শাস্তির রায় হবে। তখন সে শাস্তি আর কোনো দৃষ্টান্ত বহন করবে না। অসহনীয় পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে সে শাস্তি কোনো সুফল দান করবে না। যেমন ২০ বছরেরও আগে এ দেশে বিষাক্ত প্যারাসিটামল সিরাপ খাইয়ে প্রায় শ খানেক শিশুকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়ার একটি ঘটনা ঘটেছিল। সম্প্রতি ওই ঘটনার জন্য কয়েকজন কর্মকর্তার বিভিন্ন মেয়াদে কারাদÐ হয়েছে। এভাবে ঘটনার কয়েক দশক পর বিলম্বিত দÐ ও শাস্তির কারণে অপরাধ কমার ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব পড়েনি। এতে অঘটনও নিয়ন্ত্রিত হয় না।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ইসলামী ফৌজদারি দÐবিধি আনা হয়েছে কেবল অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার জন্য নয়, বরং কঠোর শাস্তির মাধ্যমে ভয় সৃষ্টি করিয়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য। অপরাধে প্রবৃত্ত হতেই যেন যে কারো বুক কেঁপে উঠে। এতে অপরাধ ও অপরাধী কমে যায়। ফলে দণ্ড বাস্তবায়নের ঘটনাও কমে যায়। অপরাধীরা তখন স্ব-উদ্যোগে অপরাধ থেকে বাঁচার চেষ্টা করে। এর সুফল পায় সমাজ ও সমাজের মানুষ।

আলোচনার শেষে আমরা বলব, আমরা তো সমাজের অবক্ষয় ও নিষ্ঠুরতা নিয়ে কত চিৎকারই করি। কিন্তু কার্যকর পথ অবলম্বন করি না। ফলে আমরা নিষ্কৃতি পাই না। তাই এ জাতীয় ভয়ংকর নির্মমতা থেকে সমাজকে বাঁচাতে আমরা দুটি উপায়ের প্রতি মনোযোগ দিতে পারি।

এক. হত্যা এবং নির্মম হত্যাকাণ্ডগুলোর ব্যাপারে ইসলামী ফৌজদারি বিধানের অনুসরণ। দীর্ঘসূত্রিতা মুক্ত দ্রæত ও প্রকাশ্য শাস্তি বাস্তবায়ন। এবং দলমতের উর্ধ্বে সকল অপরাধী, অপরাধে নেতৃত্বদানকারী, ইন্ধনদাতা ও আইনশৃংখলার সাথে জড়িতদের অবহেলা ও অসততার দ্রæত ও কঠোর বিচার নিশ্চিত করা। দুই. জাতীয়ভাবে গণমানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে দ্বীনের শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়া। ইসলামের নৈতিকতা এবং পরস্পরের হকের দীক্ষা বা নিরাপত্তাদানের পাঠ বিকশিত করা। বিদায় হজ্বের ভাষণে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপর মুসলমানের জীবন ও সম্পদ ও রক্তের যে সম্মান ঘোষণা করেছেন, এ ঘোষণাটি যে ব্যক্তি অনুধাবন করবে সে কখনো কোনো মানুষের প্রতি নির্মম হতে পারবে না। বিদায় হজ্বে নবীজী ঘোষণা করেছেন-

 إِنَّ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ حَرَامٌ عَلَيْكُمْ، كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا فِي شَهْرِكُمْ هَذَا، فِي بَلَدِكُمْ هَذَا.

নিশ্চয় তোমাদের সকলের রক্ত (তোমাদের জান) তোমাদের মাল তোমাদের সকলের উপর নিষিদ্ধ ও সংরক্ষিত যেমন তোমাদের এই শহরে, এই মাসে তোমাদের এই দিনটি নিষিদ্ধ ও সংরক্ষিত। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস  ১৭৪২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১২১৮

গণমানুষের মাঝে ধর্মীয় শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে হবে। ইসলামের আদব কায়দা শেখাতে হবে। আল্লাহর ভয় জাগ্রত করতে হবে। ব্যক্তিগত ও বেসরকারি উদ্যোগগুলোর পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেও এসব ক্ষেত্রে সর্বাত্মক মনোযোগ দিতে হবে। এর জন্য লোকবল নিয়োগ, অর্থ বরাদ্দ এবং অগ্রাধিকার  ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। তাহলে ধীরে ধীরে সমাজ অবক্ষয় থেকে মুক্ত হতে পারবে ইনশাআল্লাহ। সেক্যুলার চিন্তা ও বোধের কুফল আমরা এখন ভোগ করছি। মানুষ আল্লাহমুখি না হলে, আল্লাহর ভয় মানুষের দিলে জাগ্রত না হলে মানবিক অবক্ষয় থেকে সমাজকে বাঁচানো সম্ভব নয়। এজন্যই দ্বীনের বিধি এবং দ্বীনের চেতনা অনুসরণ করে চলা আমাদের জন্য অপরিহার্য। এবং এটাই হচ্ছে নিষ্ঠুর শিশুহত্যাসহ সব নির্মমতা বন্ধের কার্যকর পথ। 

 

 

 

 

advertisement