শাওয়াল ১৪৩৬   ||   আগস্ট ২০১৫

পর্দা : সতীত্ব রক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায়

মাওলানা মুফতী আব্দুর রউফ সাখখারবী

 یٰۤاَیُّهَا النَّبِیُّ قُلْ لِّاَزْوَاجِكَ وَ بَنٰتِكَ وَ نِسَآءِ الْمُؤْمِنِیْنَ یُدْنِیْنَ عَلَیْهِنَّ مِنْ جَلَابِیْبِهِنَّ ؕ ذٰلِكَ اَدْنٰۤی اَنْ یُّعْرَفْنَ فَلَا یُؤْذَیْنَ ؕ وَ كَانَ اللّٰهُ غَفُوْرًا رَّحِیْمًا

সম্মানিত শ্রোতাবৃন্দ! ইনশাআল্লাহ আজ আপনাদের খেদমতে এ আয়াতের আলোকে পর্দার বিষয়ে সামান্য আলোচনা করব। যাতে পর্দার জরুরি মাসআলাগুলো নারীপুরুষ সকলেরই জানা হয়ে যায়।

নামায-রোযার মত পর্দাও ফরয

নারীদেরকে পর্দার আদেশ আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমের মাধ্যমে দিয়েছেন। আমি এখন যে আয়াতটি তিলাওয়াত করলাম তার মধ্যেও পর্দার আদেশ রয়েছে। এছাড়া আরো কয়েকটি আয়াতে পর্দার আদেশ পরিষ্কারভাবে আছে। আর শরীয়তের মূলনীতি হল, আল্লাহ তাআলা যখন কোনো কাজের আদেশ দিয়ে দেন, সেই কাজ ফরয হয়ে যায়। নামাযের আদেশ আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে দিয়েছেন তাই মুসলিম নর-নারীর উপর নামায পড়া ফরয। রমযান শরীফের রোযার হুকুম আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে দিয়েছেন। তাই রমযানের রোযা নারী-পুরুষ সকলের উপর ফরয। এমনিভাবে যাকাত ও হজ্বের হুকুমও কুরআনে কারীমে এসেছে। এ কারণে এ চারটি বিধানই ফারায়েযে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত। তো আল্লাহ তাআলা যেহেতু পর্দার আদেশ করেছেন তাই পর্দা করাও ফরয।

পর্দা না করার উপর কঠিন হুঁশিয়ারি

নামায না পড়া, রমযানের রোযা না রাখা, যাকাত ফরয হওয়া সত্তে¡ও আদায় না করা, হজ্ব ফরয হওয়া সত্তে¡ও আদায় না করা যেমন অনেক বড় গুনাহ, তেমনি পর্দা লঙ্ঘন করাও অনেক বড় গুনাহ। এ কারণেই পর্দা না করার উপর হাদীস শরীফে ভয়াবহ শাস্তির হুঁশিয়ারি এসেছে।

পর্দা করতে পারলে শোকরিয়া অন্যথায় ইস্তেগফার

সুতরাং নামায-রোযার মত শরয়ী পর্দাও একজন মুসলিম নারীর জন্য অপরিহার্য। যারা শরয়ী পর্দা করছেন তারা আল্লাহ তাআলার শোকরিয়া আদায় করবেন। কারণ, তারা আল্লাহর একটি হুকুম মানার তাওফীক লাভ করেছেন। আর যে সকল নারী শরয়ী পর্দা করে না তাদের কর্তব্য, শরয়ী পর্দায় এসে যাওয়া এবং একে অবশ্য-কর্তব্য মনে করা। এক্ষেত্রে যে ত্রুটি হচ্ছে, একে ত্রুটি মনে করা এবং নিজেকে গুনাহগার মনে করা। আর আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করা, হে আল্লাহ! আমি আমার ভুল স্বীকার করছি এবং আপনার এ বিধান যথার্থ ও অবশ্য-পালনীয় বলে বিশ্বাস করছি। আপনি আমাকে সৎসাহস দান করুন, যাতে আমি এই বিধান মেনে চলতে পারি।

গুনাহগারের মাঝে পার্থক্য

দেখুন, সব গুনাহগার এক প্রকারের নয়। এক প্রকারের লোক গুনাহ করে কিন্তু গুনাহকে গুনাহ মনে করে, নিজের ভুল স্বীকার করে এবং আল্লাহ তাআলার দরবারে মাফ চেয়ে বলে, আল্লাহ! আমাকে এই গুনাহ থেকে বাঁচার হিম্মত ও তাওফীক দান করুন। আরেক প্রকারের লোক যে গুনাহ করে কিন্তু গুনাহকে গুনাহ মনে করে না; বরং বলে যে, এটা শরীয়তের বিধান নয়। এটা তো হুযুরদের বিধান, হুযুররা বানিয়েছে। ইত্যাদি ইত্যাদি। এই দুই লোকের মাঝে আসমান-যমীনের ব্যবধান। দ্বিতীয় ব্যক্তি শরীয়তের বিধান মানতে ও তার উপর আমল করতে অস্বীকার করছে এবং এ বিধানকে মনগড়া বলছে। এ লোকের তো ঈমানই যাওয়ার পথে। আর প্রথম ব্যক্তি যে গুনাহ স্বীকারকারী অপরাধী তার তো কমপক্ষে ঈমান ঠিক আছে। আর যেহেতু সে গুনাহের কথা স্বীকার করছে তো ইনশাআল্লাহ একদিন তার গুনাহ থেকে সাচ্চা তওবা করারও তাওফীক হয়ে যাবে।

এটা ভয়াবহ কথা

পর্দার বিষয়টিও এরকম। কিছু লোক তো এমন যারা কুরআনে কারীম ও হাদীস শরীফ মানে না। অথবা বিধান তো মানে কিন্তু স্পষ্টভাবে বলে দেয় যে, আজকের যুগে এটার উপর আমল করা অসম্ভব। এরপর বিভিন্ন ধরনের অজুহাত খাড়া করে। এটা অত্যন্ত ভয়াবহ প্রবণতা। এ থেকে সকল মুসলিম নারী- পুরুষের বেঁচে থাকা চাই।

পর্দাকে মেনে নিন এবং তাওবা করুন

হাঁ, যদি নিজের দুর্বলতা কিংবা পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কারণে কোনো নারী শরয়ী পর্দা মেনে চলতে না পারে এবং তার জন্য একেবারে পুরোপুরি শরয়ী পর্দার উপর আমল করা কঠিন হয়ে যায়, তখন তার কর্তব্য, এ বিধানকে মনে প্রাণে মেনে নেওয়া এবং স্বীকার করা যে, হে আল্লাহ! নিঃসন্দেহে এটা আপনার আদেশ। আর আপনার আদেশ আমি শিরোধার্য করছি। কিন্তু আমি অপরাধী, গুনাহগার। হে আল্লাহ, এ মুহূর্তে এ বিধানের উপর আমল করা আমার জন্য কঠিন হচ্ছে, কিন্তু আমি অঙ্গীকার করছি, আমি এ বিধান মেনে চলব এবং মেনে চলার জন্য পুরোপুরি চেষ্টা করব। হে আল্লাহ! আমাকে সাহায্য করুন! আমার মনে সাহস দিন, আমার ঈমানকে শক্তিশালী করে দিন, যাতে আমি এ হুকুম পুরোপুরি মানতে পারি। অতপর যতদিন এ গুনাহ পুরোপুরি ছাড়তে পারছে না ততদিন বারবার তাওবা করতে থাকবে এবং ছাড়ার চেষ্টায় থাকবে। আর প্রতিজ্ঞা করতে থাকবে যে, ইনশাআল্লাহ, আমি আমার পরিবেশকে পরিবর্তন করব এবং  এ বিধানের উপর পুরোপুরি আমল করব।

ঘরের গাইরে মাহরামের সাথে পর্দা করার নিয়ম

কুরআন-হাদীসের আলোকে মুসলিম নারীদের জন্য মূল বিধান হল নিজের ঘরেই অবস্থান করা। তার ঘরে থাকাটাই পর্দার একটি প্রকার। তাই যথাসম্ভব মুসলিম নারীরা ঘরে থাকবেন এবং প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হবেন না।

এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, ঘরে যেসকল গাইরে মাহরাম (মাহরাম নয় এমন) পুরুষ থাকে তাদের সাথেও পর্দা করতে হবে। যেমন দেবর, ভাসুর ইত্যাদি। এমনিভাবে যে সকল গাইরে মাহরাম পুরুষ ঘরে আসা যাওয়া করে যেমন স্বামীর চাচা, জ্যাঠা, মামা, তাদের সাথেও পর্দা করতে হবে। এই আত্মীয়দের সাথে পর্দা করার পদ্ধতি হল, নিজ কামরা থেকে বের হওয়ার সময় যদি মনে হয় কামরার বাইরে গাইরে মাহরাম কেউ আছে তখন কারো মাধ্যমে বা কোনো সংকেত ব্যবহার করে তাদেরকে সরতে অনুরোধ করবে। তা যদি সম্ভব না হয় আর তাৎক্ষণিক বের হওয়া জরুরি হয় তাহলে বড় ওড়না বা চাদর দিয়ে মাথার চুল, ঘাড়, উভয় হাতের বাহু আবৃত করে নিবে। চেহারার উপরও নেকাব ফেলে নিবে। এভাবে জরুরতের সময় নিজ কামরা থেকে বের হওয়া যাবে।

বহিরাগত আত্মীয়দের সাথে পর্দার নিয়ম

কিছু গাইরে মাহরাম এমন আছে, যারা ঘরের লোক না হলেও আত্মীয়তার কারণে ঘরে আসা যাওয়া করে। যেমন স্বামী বা স্ত্রীর চাচাতো ভাই, জ্যাঠাতো ভাই, ফুফাতো ভাই, মামাতো ভাই, খালাতো ভাই ইত্যাদি। এদেরকে আত্মীয়ের ভাই বলে। অনেক ক্ষেত্রে এদের সাথে বিশেষ পর্দা মেনে চলা হয় না। অথচ এদের সাথেও পর্দা করা ফরয। এদের সাথে পর্দা রক্ষার উপায় এই যে, ঘরের কর্তাব্যক্তিরা সকলে একবার বসে স্থির করবে যে, এখন থেকে ইনশাআল্লাহ আমাদের ঘরে পর্দা পালিত হবে। সুতরাং গাইরে মাহরাম আত্মীয়-স্বজন যারা আছে, যারা ঘরে আসা যাওয়া করে, সামনে থেকে তারা যখন আসবে তাদেরকে বৈঠকখানায় বসানো হবে। যারা এখন সোজা ঘরের ভিতরে চলে যায় তাদেরকে এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে যেন সামনে থেকে তারাও পর্দা রক্ষায় সচেতন হয়।

পুরুষদের পুরুষের কামরাতেই বসানো হবে

কোনো গাইরে মাহরাম পুরুষ ঘরে এলে, তিনি আত্মীয় হোক বা অনাত্মীয়, তিনি পুরুষের সাথেই সাক্ষাৎ করবেন। ঘরের গাইরে মাহরাম মহিলাদের সাথে সাক্ষাৎ করবেন না। হাঁ, যদি মাহরাম হয়ে থাকেন তাহলে তার মাহরাম মহিলাদের সাথেও সাক্ষাৎ করতে মানা নেই। তো এভাবে একবার সবাই বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাহলে মহিলাদের জন্য গাইরে মাহরাম পুরুষদের সাথে পর্দা করা সহজ হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর গাইরে মাহরাম আত্মীয়-স্বজন, স্বামীর গাইরে মাহরাম আত্মীয় স্বজন, যেমন স্বামীর চাচা, জ্যাঠা, খালু, ফুফা, মামা অথবা স্ত্রীর খালু-ফুফা খালাতো ভাই, জ্যাঠাতো ভাই, চাচাতো ভাই, মামাতো ভাই প্রমুখ বেড়াতে এলে এদের সাথে শুধু ঘরের পুরুষরাই সাক্ষাত করবে এবং তাদেরকে পুরষদের কামরাতেই বসানো হবে। ঘরের মহিলাদের তাদের সাথে জরুরতবশত কথা বলতে হলে পর্দার আড়াল থেকে কথা বলবে। অথবা ফোনে বা ইন্টারকমে কথা বলবে।

তুমিই যদি না চাও তবে বাহানা হাজার হাজার

এই পদ্ধতি কিছু দিন একটু আশ্চর্যের মনে হবে। কিন্তু ভিতরে আপনার কাছেও স্বস্তিকর মনে হবে। মহিলারাও এতে শান্তি ও তৃপ্তি পাবে। সবচে বড় কথা হল, শরয়ী পর্দা পালিত হবে এবং বেপর্দার গুনাহ থেকে নারী-পুরুষ সকলেই রক্ষা পাবে। তাই এ জন্য নারীদের মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে হবে আর পুরুষদেরও তাদের সাহায্য করতে হবে। এভাবে পরস্পরের মাঝে সবকিছু সিদ্ধান্ত হয়ে জানাজানি হয়ে গেলে এরপর আর কোনো অসুবিধা থাকবে না। কিন্তু যদি নারী-পুরুষরা এ কাজের জন্য তৈরী না হয় তাহলে সারা জীবন পর্দালঙ্ঘনের গুনাহ হতে থাকবে।

تو ہی  اگر  نہ چاہے تو بہانہ  ہزار  ہیں

اے  خواجہ  درد  نیست  ورنہ  طبیب  ہست

তুমিই যদি না চাও তাহলে বাহানা তো হাজার হাজার, হে খাজা, ব্যথাই তো নেই, নতুবা চিকিৎসক তো প্রস্তুত

এখন যেহেতু গুনাহের অনুভতি নেই এবং ঐ গুনাহ থেকে বাঁচার চেষ্টা ও ফিকির নেই একারণে বাঁচাটা কঠিন মনে হয়। নতুবা গুনাহ থেকে বাঁচার সহজ উপায় তো আছে।  (চলবে ইনশাআল্লাহ)

[কিছুটা সম্পাদনাসহ]

অনুবাদ : মুহাম্মাদ মাকসুদুর রহমান

 

 

advertisement