শাওয়াল ১৪৩৬   ||   আগস্ট ২০১৫

আল্লামা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রাহ. : মহৎ মানুষ, আদর্শ পুরুষ

রাশেদুর রহমান বিন আতাউর রহমান

 

শীতকাল। সকাল দশটা। সূর্য ওঠেছে আজকের আকাশে, মৃদু রোদ, দেহ-মন প্রশান্ত করা আবহাওয়া। জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগের দফতর-কক্ষের সামনে একটি চেয়ারে বসে আছেন একজন প্রৌঢ় ব্যক্তিত্ব। হাতে লাঠি। গায়ে ধবধবে সাদা সুতি পাঞ্জাবী। তার ওপর হাল্কা আকাশী রংয়ের সদরিয়া। রোদের আলোয় চশমার ফ্রেমটা চিকচিক করছে। চেহারায় চিন্তার ছাপ। কী যেন ভাবছেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রখ্যাত বহু আলিমে দ্বীন তাঁর শাগরিদ কিংবা নাতি-শাগরিদ। কওমী মাদরাসাগুলোতে মাতৃভাষা বাংলায় পাঠদান আন্দোলনের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব তিনি। বহু কালজয়ী গ্রন্থের লেখক, অনুবাদক ও সম্পাদকও তিনি। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় কী ভাবছেন এই মহান পুরুষ?! প্রায়-ই তো বলেন, এক পা কবরে চলে গেছে। আরেকটি পা যেন নিরাপদে-সালামতে কবরে রাখতে পারি সে-ই দুআ করো।

আহা, মৃত্যুর আগেই মৃত্যুর ফিকির, পরকাল-ভাবনা। সুন্দর হবে তো আমার ওই পারের জীবন!

হযরত এখনো এগুলোই ভাবছেন, কিংবা ভাবছেন ছাত্র-সমাজ এবং আম জনতাকে নিয়ে। হুযুর-পত্নী আম্মাজানই তো ওই দিন বললেন, তোমাদের হুযুর ঘরে আসলেও শান্তিতে থাকেন না। অস্থির এবং বে-চাইন হয়ে পড়েন। ছটফট করতে থাকেন। বলেন, আল্লাহই জানেন, এই ছাত্রদের হক্ব আদায় হচ্ছে কি না? কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে এই আমানতের কী জওয়াব দিব?

হুযুরও একদিন বলছিলেন, এই বুড়োটাকে যে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াচ্ছে, মাদরাসার কিংবা ছাত্রদের কী ফায়দা হচ্ছে আমার দ্বারা? তোমরা আমাকে মাফ করে দিয়ো।

সুবহানাল্লাহ! বাহ্যিকভাবে যার কারণে আজকের এই জামিয়া; তিনি তো বলবেন, হামারি খূন ভী শামিল হ্যয় ইস গুলশান মেঁ, এই পুষ্পোদ্যান তো আমাদের রক্তেই নির্মিত।

এ কি! এই সাধক বলেন কি?! ক্ষমা চাইছেন তিনি। সৃষ্টির উল্লাসে তৃপ্তি ও প্রাপ্তির আনন্দে উল্লসিত না হয়ে অপরাধবোধ ও কৃতজ্ঞতার অশ্রু চোখে নিয়ে তিনি সিজদায় নতশির! এ যে কুরআনী শিক্ষার-ই বাস্তব রূপায়ন।

শুধু ছাত্র-শিষ্য কেন, জনতাকে নিয়েও তো তিনি এভাবে ভাবেন। জামিয়া মালিবাগের ৩০ বর্ষের কৃতী ছাত্রদের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের এক প্রস্তুতি সভায় তিনি বলছিলেন, অমুক অমুককে আমরা নাস্তিক বলে বলে শুধু দূরে সরিয়ে দেই। কদিন গিয়েছি তাদের কাছে? যান না তাদের কাছে। আলাপ করুন। তাদের সামনে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরুন। বেচারারা তো সারাজীবন ওই পরিবেশে কাটিয়েছে, ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা পায়নি। তাদের কাছে না গিয়ে-ই আপনি তাদের ব্যাপারে ঢালাও মন্তব্য করবেন, এতে তো লাভের চাইতে ক্ষতি-ই বেশি হবে। তারা আরো উদ্ধত হবে। আল্লাহ না করুন, একপর্যায়ে তাদের নাস্তিকতার দায় কিছুটা হলেও আপনাকে বহন করতে হতে পারে। আল্লাহ হিফাযত করুন।

উম্মতের জন্য ফিকিরমান্দ এই মহান ব্যক্তিত্বের নাম হযরত মাওলানা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রাহ.।

শীতের ওই সকালেই হুযুরের সাথে আমার প্রথম মুলাকাত হয়েছিল । দুরুদুরু বুকে ক্ষীণ পদে হুযুরের সামনে গিয়ে হাযির হলাম। ভীত-বিহ্বল কণ্ঠে সালাম দিলাম। হুযুর মাথা ওঠালেন এবং স্বভাব-সুলভ দরায কণ্ঠে সালামের জবাব দিলেন। নাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। পরিচয় জানার পর হুযুর বললেন, ও আচ্ছা, মাওলানা রশিদুদ্দীন আহমদ রাহ.-এর নাতি আপনি

হঠাৎ সম্বোধন পরিবর্তন। তুমি থেকে আপনি। প্রথমে ভেবেছিলাম, এমনিতেই হয়ত আপনি করে বলছেন। কিন্তু পরেও যখন কখনো দাদাজান রাহ.-এর প্রসঙ্গ এসেছে তখনো ঘটেছে সম্বোধন পরিবর্তন; তুমি থেকে আপনি

বড়রা এভাবেই বড়দের সম্মান জানান। কিন্তু বড়দেরকে সম্মান জানাতে গিয়ে মাঝের কেউ যদি সম্মান-প্রাপ্ত হয় তাহলে কখনো কখনো মাঝের ওই ব্যক্তিটি ধোকায় পড়ে যায়। মনে করে তাকেই হয়ত সম্মান জানানো হয়েছে। অথচ এই সম্মান তো মধ্যস্থ ব্যক্তিটিকে দান করা হয়েছে বড় ওই ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে। কথাগুলো আমি আব্বাজান থেকে শুনেছি।

এ প্রসঙ্গে আব্বাজান প্রায়ই একটি ঘটনা বলেন, তিনি যখন পাকিস্তান পড়তে যান তখন দাদাজান রাহ. তাঁর হাতে একটি চিঠি দিয়েছিলেন হযরাতুল আল্লাম মাওলানা ইউসুফ বানূরী রাহ.-এর নামে। চিঠি হাতে পেয়ে তিনি বললেন, আরে, আপ ওনকে ছাহেব যাদেঁ হেঁ, ইয়াহাঁ বেঠিয়ে একথা বলে বানূরী রাহ. আব্বাজানকে তাঁর পাশের সোফায় বসতে দিলেন। আব্বাজান বলেন, তখন বুঝিনি। এখন বুঝি, এ আমার প্রাপ্য ছিল না, আব্বাজান রাহ.-এর বরকতে এ ছিল আমার প্রাপ্তি এবং বানূরী রাহ.-এর শরাফত ও মহানুভবতা।

কাজী ছাহেব হুযুরের কাছ থেকেও ছাত্ররা এমন অনেক কিছু পেত, প্রাপ্য হিসেবে নয়, বরং প্রাপ্তি এবং হুযুরের মহানুভবতা হিসেবে।

জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া তেজগাঁও-এ হুযুর একবার গিয়েছিলেন বুখারীর শেষ দরস্ প্রদান করার জন্য। মাদরাসার অধিকাংশ  উস্তায হলেন হুযুরের মায়ায়েনায ও প্রবীণ শাগরিদ। মালিবাগ থেকে হুযুরের সাথে সেখানে গিয়েছিল হুযুরের এক নবীন ছাত্র। হুযুর প্রবীণদের সাথে ওই নবীনকে পরিচয় করালেন প্রায় সাড়ে তিন মিনিট ধরে। ছাত্রটি সেদিনের ঘটনা বলতে গিয়ে বলেন, ওই সময় আমার যে কী অবস্থা। লজ্জায় চোখ-মুখ লাল হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু হুযুর কোনো প্রকার তাকাল্লুফ বা কৃত্রিমতা ছাড়াই আমার কথা বলে যাচ্ছিলেন। নিজেকে ছোট মনে করেন যিনি, মুজাস্সাম তাওয়াযু যিনি, তিনি তো এমন হবেন-ই।

অনেক সময় ছাত্রদের সাথে হুযুরের আচরণ দেখলে ভ্রম হত, হুযুর কি তার শাগরিদদেরকে ছাত্র মনে করেন, নাকি সম্মানের পাত্র মনে করেন। এক তাফসীর মাহফিলে হুযুর বলছিলেন, শরীর অসুস্থ। মাত্র ডাক্তার দেখিয়ে এলাম। বন্ধুবর মাওলানা আব্দুল আখির সাহেবের মনোতুষ্টির জন্যই হাযির হয়েছি। হুযুরের আলোচনা শেষে মাওলানা আব্দুল আখির ছাহেব বললেন, হুযুর, আসলেই কি আমি আপনার বন্ধু? আমি তো আপনার এক নগণ্য ছাত্র। হুযুর বললেন, আচ্ছা আপনি যদি আমার বন্ধু না হন তাহলে কি শত্রু?

প্রকৃতপক্ষে হুযুরের হাস্য-রসিকতা থেকেও বিনয় ও তাওয়াযু পরিস্ফুটিত হত এবং অনেক শিক্ষা পাওয়া যেত।

মালিবাগ থেকে ফারিগ হওয়ার পর যখনই হুযুরের সাথে দেখা করতে যেতাম হুযুর আব্বার কথা জিজ্ঞেস করতেন এবং আব্বার পরিচালনাধীন জামিয়া মাদানিয়া কোলাপাড়ার খোঁজ-খবর নিতেন। হুযুর ওই মাদরাসার মজলিসে শূরার সদস্যও ছিলেন।

একবার আব্বার সাথে গেলাম হুযুরের সাথে দেখা করার জন্য। আব্বাজানও হুযুরের ছাত্র। আব্বাজানকে হুযুর তুমি করেই বলতেন। কিন্তু সেবার আপনি করে বলেছিলেন।

মজলিস শেষে আব্বাজান আমাকে বললেন, হুযুরের আদতই এমন, ছাত্রের সামনে যদি তার ছেলে কিংবা ছাত্র থাকে তাহলে হুযুর আপনি করে বলেন যেন ওই ছেলে বা ছাত্রের মনে বাবা/উস্তাযের তাজীম আরো বৃদ্ধি পায়। এ ছিল হুযুরের উত্তম আখলাকের একটি দৃষ্টান্ত।

লেখালেখির জগতের অনেকের মাঝে বিনয়ের অভাব দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে ওই পাড়ার প্রয়াত লেখক-বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, পরবর্তী জেনারেশনের মধ্যে বিনয় জিনিসটা নাই। কিছু বলতে গেলে -এর মত চিৎকার করে। এভাবে চলতে পারে না। এভাবে চলতে থাকলে এখানে কোনো মহৎ সৃষ্টি আশা করা যায় না। তবে অসাধারণ প্রতিভাবান অথচ বিনয়ী -এমন উপমা খুঁজতে দিল্লি যেতে হবে না। বৈচিত্রময় প্রতিভাধর মাওলানা কাজী মুতাসিম বিল্লাহই এর চড়ান্ত উপমা। বৈচিত্রের মাঝে ঐক্যের সুর গ্রন্থের আঁতুরকথনে তিনি বলেছেন, আমি কবি সাহিত্যিক  নই। লেখার অভ্যাসও নেই। তাই ভাষার মান ও বর্ণনাভঙ্গি পাঠকদের পীড়া দেবে। শুধু প্রেমের টানে, ভালবাসার তাগিদে আমি পাঁচ বছর এ নেশায় বুঁদ হয়ে ছিলাম। এভাবে শুধু হুযুরের বিনয়ের ঘটনাগুলোই জমা করে বড় কলেবরের একটি কিতাব তৈরি হতে পারে।

হুযুরের ইশকে মাদানী (হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ.)-এর বিষয়টি তো ছিল সুপ্রসিদ্ধ। মাদানী রাহ. নাম যখন বলতেন তখন মনে হত, হুযুর বুঝি তার প্রেমাষ্পদের নাম উচ্চারণ করছেন। শায়খুল আরব ওয়াল আজম হুসাইন আহমদ মাদানী নাওওয়ারাল্লাহু মারকাদাহু এভাবে পুরো নাম উচ্চারণ করতেন। হুযুরের অন্যান্য আসাতিযায়ে কেরামকেও হুযুর অনেক মুহাব্বত করতেন। তাঁদের কারো আলোচনা এলে হুযুর ভক্তি ও শ্রদ্ধায় বিগলিত হয়ে যেতেন।

আব্বাজান বলেন, একবার আব্বার সাথে গেলাম যাত্রাবাড়ি মাদরাসায়। দফতরে আব্বাজান রাহ. শায়খ তাজাম্মুল আলী রাহ.-এর সাথে কথা বলছিলেন। কিছুক্ষণ পর কাজী ছাহেব হুযুর দফতরে আসেন। উস্তায তাজাম্মুল আলী রাহ. এবং তাঁর সহপাঠী রশিদুদ্দীন আহমদ রাহ.-কে কথা বলতে দেখে কাজী ছাহেব হুযুর দরজার পাশেই আত্তাহিয়্যাতুর ছরতে বসে পড়েন ।

উস্তায-পুত্রদের সাথে হুযুরের আচরণ দেখলে মনে হত ইনি-ই বুঝি হুযুরের উস্তায।

একবারের ঘটনা, হযরত কাজী ছাহেব রাহ. উস্তায-পুত্র সাইয়্যেদ আরশাদ মাদানীর ইস্তেকবালের জন্য বিমান বন্দরে গেলেন। অভ্যর্থনা পর্ব শেষেই হুযুরের মাদরাসায় ফেরার কথা। আরশাদ ছাহেবের সাথে মুসাফাহা করা মাত্র তিনি হুযুরকে বললেন, ইনশাআল্লাহ, দস্তরখান পর বাত হো-গী। হুযুর বললেন, জ্বী আচ্ছা। বয়সে কাজী ছাহেব হুযুর কত বড়! শরীরও খারাপ। ওযর করতে পরতেন। কিন্তু উস্তায-পুত্র বলেছেন, দস্তরখানে কথা হবে। হুযুরের অবস্থা দেখে মনে হল, যেন উস্তাযই আদেশ করেছেন। গাড়িতে ওঠে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, كلام الملوك ملوك الكلام   উস্তায-পুত্রের কথা কি টালা যায়?

আসলে আমাদের আকাবিরের মাঝে উস্তায-ভক্তিটা ছিল এমনই। আব্বাজানের কাছে শুনেছি, স্বাধীনতার পর আসআদ মাদানী রাহ. যখন প্রথমবার বাংলাদেশ সফরে আসেন তখন তিনি জোয়ানই ছিলেন। অথচ যাত্রাবাড়ি মাদরাসায় আমরা দেখেছি, মাদানী রাহ.-এর প্রধান বয়োবৃদ্ধ শাগরিদরাও আসাআদ মাদানী রহ. -এর সামনে বসেছিলেন আত্তাহিয়্যাতুর ছরতে, যেন উস্তাযের সামনেই বসে আছেন।

হুযুরকে আমরা পেয়েছিলাম হুযুরের একেবারে শেষ বয়সে। এ সময়েও তিনি মুতালাআ করতেন নিয়মিত। দীর্ঘদিন সহীহ বুখারী পড়িয়েছেন। তা সত্তে¡ও  মুতালাআ ছাড়া দরসে যেতেন না।

শেষ বয়সে হুযুরের চোখে সমস্যার কারণে অপারেশন করানোর প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। কিন্তু কোনো কোনো ডাক্তারের পরামর্শ ছিল, এত ডায়াবেটিস নিয়ে অপারেশ করানো ঠিক হবে না। তবুও হুযুর অপারেশন করাতে চাচ্ছিলেন। মালিবাগ জামিয়ার নায়িবে মুহতামিম উস্তাযে মুহতারাম মাওলানা আনোয়ার শাহ ছাহেব একদিন হুযুরকে জিজ্ঞেস করলেন, হুযুর, এই অবস্থায় অপারেশন করানোর কী দরকার? হুযুর বললেন, হাদীস পড়াতে হবে না? মুতালাআ ছাড়া কীভাবে পড়াবো? শাহ ছাহেব বললেন, হুযুরের কি এখন আর মুতালাআ করা লাগে? হুযুর জবাব দিলেন, কোনো দিন মুতালাআ ছাড়া দরসে যাইনি। কোনো কারণে যদি সময় না পাই তাহলেও কমপক্ষে ফয়যুল বারীটা দেখা হলেই তবে দরসে যাই।

হুযুরের উপস্থাপনাভঙ্গিও ছিল অসাধারণ। কখনো কখনো দরসে বলতেন, কিতাবখানা বন্ধ কর। এরপর নাতিদেরকে গল্প বলার মত করে সামনের হাদীসটি ব্যাখ্যাসহ শুনিয়ে দিতেন। কিতাব খোলার পর দেখা যেত, হাদীসের কিছু অংশ হয়ত ওখানে আছে। কিন্তু ইতিমধ্যেই হুযুর বুখারীর সকল বর্ণনা জমা করে আমাদের শুনিয়ে দিয়েছেন। ফলে ইশকাল পয়দা হওয়ার সম্ভাবনা যেখানে থাকত তাও দূর হয়ে যেত। হুযুরের দরস এতটাই শানদার ও মযাদার ছিল যে, হুযুর নিজেই বলতেন, আমার দরস ছাত্ররা চেটে-পুটে খায়।

হুযুর এক সময় মুনাযারাতেও যেতেন। জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের হয়ে বিভিন্ন মুনাযারায় শরীক হয়েছেন। হুযুরের কাছেই শুনেছি, জমিয়তের পক্ষ থেকে নরসিংদীতে একবার আমাকে পাঠানো হল, জামাতে ইসলামীর সাথে মুনাযারা করার জন্য। আমার গঠন-গড়ন দেখে কেউ কেউ বলে ওঠে, এই পুচকারে দিয়ে কী হবে? এরপর যখন আমি টানা আড়াই ঘণ্টার আলোচনায় জামাতে ইসলামীর স্বরূপ ব্যাখ্যা করি এবং তাদের আসল চেহারা উন্মোচন করে দেই তখন উপস্থিত জনতার অনেকে বলাবলি শুরু করে দেয়, পিচ্চি মরিচে দেখি অনেক ঝাল।

মাদীনাতুর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি হুযুরের দিলে যে টান ছিল স্বাভাবিক অবস্থায় তো তা বুঝা যেত না। কিন্তু একদিন আমরা তা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলাম। ১৪৩০ হিজরী সনে হুযুর সর্বশেষ হজ্বে যান। হজ্বে যাওয়ার আগে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে উস্তাযে মুহতারাম মাওলানা জাফর ছাহেব হুযুরসহ অন্যান্য আসাতিযায়ে কিরাম মূল্যবান কিছু নসীহত পেশ করেন। সবশেষে কাজী ছাহেব হুযুর বললেন, আমি একটা হাশিয়া যোগ করব, আলাদা কোনো ওয়াজ করব না। এই সফরে যাওয়ার আগে আমি সে-ই দুআ করি যে দুআ করতেন হযরত ওমর রা.। আপনারাও আমার জন্য সে-ই দুআ কইরেন

 اللهم ارزقني شهادة في سبيلك واجعل قبري في بلد حبيبك

হুযুর যেভাবে এ কথা কটি বলেছিলেন তা তো আর আমার পক্ষে কাগজে কলমে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। কিন্তু তাঁর এ কটি কথা শুনেই মজমার অনেকের চোখে পানি চলে এসেছিল।

এক বিকালে কি সন্ধ্যায় হুযুর আগের এক হজ্বের স্মৃতিচারণ করছিলেন-

কাঠফাঁটা রোদ। এর মধ্যেই সবাই তওয়াফ করছে। তওয়াফ শেষে আমি দাঁড়িয়ে দেখছিলাম আল্লাহ প্রেমিকদের পবিত্র দৃশ্য। অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল,

 لو رأى هذا المنظر أحد من المشركين لصاح بقول لا إله إلا الله 

(অর্থ: কোনো মুশরিক যদি দেখত এ দৃশ্য তাহলে চিৎকার করে বলে ওঠত, লা ইলাহা  ইল্লাল্লাহ. (আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই।) পাশেই ছিলেন একজন আরব শায়খ। আমার কথা শুনে বলে ওঠলেন, সত্যই বলেছ, সত্যই বলেছ

হাদীস এবং ফিকহের কিতাবে নামাযের যে বর্ণনা দেয়া আছে হুযুরের নামায ছিল তার জীবন্ত রূপ। দেখলে মনে হত, সত্যি যেন হুযুর তাঁর রবের সাথে কানাকানি করছেন। ইজতেমায়ী দুআর সময় হুযুরের নিঃশব্দ বোবা১ কান্না ও রোনাযারীর এত বেশী তাসীর হত যে, পুরো মজমা জারজার হয়ে আল্লাহর দরবারে চোখের পানি ঝরাতো।

হুযুর যখন কুরআনে কারীমের কোনো আয়াত তিলাওয়াত করতেন মনে হত, হয়ত আল্লাহ তাআলা এই আয়াতে হুযুরকেই সম্বোধন করেছেন। কখনো কখনো এভাবে বলতেন, এই যে দেখেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাকে বলেছেন, এই কাজী মুতাসিম বিল্লাহকেই বলেছেন,

وَ اعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللّٰهِ جَمِیْعًا وَّ لَا تَفَرَّقُوْا

আর তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর, বিচ্ছিন্ন হয়ো না। -সূরা আলে ইমরান : ১০৩

জাতির বিভিন্ন সমস্যার কারণ হিসেবে হুযুর প্রায়ই সেই হাদীসটিই উদ্ধৃত করতেন, (কিয়ামতের একটি আলামত হল), إعجاب كل ذي رأي برأيه প্রত্যেকে নিজের মতটাকেই প্রাধান্য দিবে। (সুনানে  ইবনে মাযাহ, হাদীস ৪০১৪) নিজেরটাকেই সাব্যস্ত করতে চাইবে। অন্যের কারো রায়কে কোনো গুরুত্ব দিবে না। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা-সহমর্মিতা থাকবে না।

বাস্তবেও বর্তমানে দেশ-বিদেশের চিত্র তা-ই। হয়ত এজন্যই হুযুরের আদত  ছিল, তিনি অন্যের মতকে খুব-ই গুরুত্ব দিতেন। চাই সে ছোট হোক না কেন।

ব্যক্তিগত জীবনে হুযুর ছিলেন মিতব্যয়ী, অপচয় কখনো পছন্দ করতেন না। তবে আপ্যায়ন এবং মেহমানদারির ক্ষেত্রে হুযুর ছিলেন অসাধারণ এবং উদারহস্ত। দেশের বাড়ি যশোর থেকে আনা কাঁঠাল তো হুযুরের অনেক শাগরিদ-ই খেয়েছে। আমাদের যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল হুযুরের গ্রামের বাড়ি ঝুমঝুমপুর, যশোরে। হুযুরেরও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে অপারগতা প্রকাশ করেন। তখন আমরা বললাম, সফরে যদি হুযুরের সঙ্গ-ই না পাই তাহলে আর সফর করে কী লাভ? খালি বাড়িতে গিয়ে আমরা কী করব। তার চে ভাল, এখানে থেকে বন্ধের এ কটা দিন হুযুরের পরশ গ্রহণ করি। হুযুর বললেন, আরে বেওকফ! তোমরা তো হুযুরের বাড়িতেই যাচ্ছ। বুঝেছি, মরলে পরে আর এই বুড়োটার কোনো খোঁজখবর নিবে না। আমরা লজ্জিত হলাম এবং আদেশ অনুযায়ী দুআ নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলাম। রাতের ট্রেনে সফর করে ফজরের কিছুক্ষণ পর হুযুরের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলাম। বাড়িতে ছিলেন হুযুরের বড় ছেলে ও তাঁর পরিবার। যেভাবে তাঁরা আমাদের আদর-যত্ন করলেন তা দেখে মনে হল, না জানি আমরা তাদের কত পুরনো আত্মীয়। এত আয়োজন করা সত্তে¡ও হুযুর-পুত্র বললেন, আব্বা তো আরো ওই ওই জিনিসের কথা বলেছিলেন। কিন্তু সময়ের অভাবে পারলাম না। কথাগুলো তিনি বলেছিলেন এমনভাবে যেন ওযর পেশ করছেন। মহৎ মানুষেরা হয়ত তার আশপাশটাকেও এভাবে মহৎ করে তোলেন।

ছাত্ররা যেন এসব গুণাবলী অর্জন করতে পারে সে-ই লক্ষ্যে হুযুর ইসলাহী তাআল্লুকের ব্যাপারে খুব জোর দিতেন। ছাত্রদেরকে উৎসাহিত করতেন। কিন্তু আল্লাহর এ বান্দা নিজে কাউকে বায়আত করতে চাইতেন না। অন্যান্য ক্ষেত্রের মত এ ক্ষেত্রেও নিজেকে গুটিয়ে রাখতেই বেশি পছন্দ করতেন। প্রকাশ করতে চাইতেন না। এমনকি হুযুর মাদানী রাহ.-এর ওফাতের পর কার হাতে বায়আত হন এবং কার কাছ থেকে খেলাফত লাভ করেন সে বিষয়টিও ছিল অনেকের অজানা। আমরা শুধু এটুকু জানতাম, হুযুর মাদানী রাহ.-এর হাতে বায়আত হয়েছিলেন। শেষদিকে মাদানী রাহ. তাঁকে যে সবক দিয়েছিলেন তা আদায় করতে কখনো কখনো হুযুরের আট ঘণ্টার মত সময় লেগে যেত। এ প্রসঙ্গে আমরা এতটুকুই শুনেছিলাম হুযুরের কাছ থেকে।

এ দিকে মালিবাগ জামিয়ার ৩০ সালা দস্তারবন্দী উপলক্ষে প্রকাশিত ডায়েরী আল মুতাসিম-এ জামিয়ার আসাতিযায়ে কিরামের মধ্যে কে কার থেকে খেলাফত লাভ করেছেন তার একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়। হুযুর কার মুজায সে বিষয়টি যেহেতু অজানা ছিল, তাই ওই তালিকায় হুযুরের নাম অলিখিতই থেকে যায়। হুযুর তালিকাটি দেখে মৃদু হেসে বললেন, আমি কী দোষ করলাম?

সে সময়েই আমরা জানতে পেরেছিলাম, হুযুর তাঁর উস্তায মাওলানা তাজাম্মুল আলী রাহ.-এর কাছ থেকে খেলাফত লাভ করেছিলেন। এরপর আমরা রাত জেগে তালিকায় কাজী ছাহেব হুযুর এবং শায়খ তাজাম্মুল আলী রাহ.-এর নাম সংযোজন করি এবং ওই ভুলটির সংশোধন করি।

নিজেকে হুযুর এভাবেই আড়াল করেছিলেন। ১৪৩০ হিজরী পর্যন্ত সারা জীবনে হুযুর মাত্র একজনকে বায়আত করেছিলেন। মালিবাগের দস্তারবন্দীর সময় সাইয়্যেদ আরশাদ মাদানী যখন বায়আত করছিলেন তখনো হুযুর বায়আত হওয়ার জন্য অনেককে উৎসাহ দান করেন।

আমাকে বায়আত হতে না দেখে  জিজ্ঞাসা করলেন, কী রে বায়আত হলে না যে? চুপ করে রইলাম এবং মনে মনে বললাম, বায়আত তো আপনার হাতেই হব।

১৪৩১ হিজরী-এর খতমে বুখারীর পরদিন বাদ ফজর আল্লামা আহমদ শাফী ছাহেবের কাছে অনেকে বায়আত হল। বায়আত চলাকালীন কাজী ছাহেব হুযুর বসেছিলেন দফতরের সামনে একটি চেয়ারে। আমি হুযুরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। এবারো হুযুর জিজ্ঞাসা করলেন, কীরে বায়আত হলে না যে? এবার সাহস করে বলেই ফেললাম। হুযুর! বায়আত তো আপনার হাতে হব। হুযুর মৃদু হেসে বললেন, আমি কি কাউরে বায়আত করি রে? বললাম, হুযুর যে বায়আত করেন না তা তো জানি। কিন্তু একজনকে তো করেছেন। হুযুর বললেন, তাহলে কি আপনাকেও বায়আত করতে হবে? আমি হাসি হাসি মুখ নিয়ে চুপ করে রইলাম।

দাওরা পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। সুযোগ পেলেই হুযুরকে বিরক্ত করতে লাগলাম। হুযুর আপনার হাতে বায়আত হব। অনেকেই উৎসুক ছিল হুযুরের হাতে বায়আত হওয়ার জন্য। অবশেষে হুযুর মোট পাঁচজনকে বায়আত করে নেন।

বায়আতের ওই মজলিসে হুযুরের একজন বিশিষ্ট খাদিমেরও থাকার কথা ছিল। কিন্তু কোনো কারণে তাঁর আসতে একটু বিলম্ব হয়ে যায়। হুযুর তাঁকে বলে দিলেন, এখন এ মজলিসে আসা যাবে না, তুমি দেরি করেছ। তাই এটা তোমার শাস্তি। বায়আত চলাকালীন মালিবাগ জামিয়ার নায়িবে মুহতামিম উস্তাযে মুহতারাম আনোয়ার শাহ ছাহেব হুযুরও এসেছিলেন। হয়ত কোনো কাজে, কিন্তু হুযুর বায়আতের কাজেই মশগুল থাকেন। বুঝলাম, বায়আতের গুরুত্ব হুযুরের কাছে অনেক এবং রসবোধ সম্পন্ন এই ব্যক্তিটি নীতিতেও অত্যন্ত কঠোর।

দৃঢ়তা এবং নীতিতে কঠোরতা প্রসঙ্গে হুযুরের আরেকটি ঘটনা মনে পড়ছে। হুযুরের মুখেই শুনেছিলাম। সে সময় হুযুর ছিলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সম্পাদনা বিভাগের সদস্য। ই.ফা.বা এক কিতাবের টীকায় একটি বিষয় সংযোজন করতে চাচ্ছিল, যা ছিল হুযুরের তাহকীক মতে ইসলাম-বিরোধী। হুযুর ই.ফা.বা-এর লোকদেরকে প্রকাশ্যে জানিয়ে দেন যদি এটা করা হয় তাহলে আগামী শুক্রবার বাদ জুমা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ বায়তুল মুকাররমে জনসমাবেশ করবে। এতে ই.ফা.বা তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে।

তাকওয়া-তাহারাত, ইখলাস ও লিল্লাহিয়্যাত, বিনয় ও তাওয়াযু এবং আখলাক ও চরিত্রে এমনই অনন্য, অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন আমাদের হযরত কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রাহ.। হুযুরের সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ হয়েছিল আমার অল্প কিছুদিন। গ্রহণ করবার মত যোগ্যতা থাকলে এই অল্প কিছু দিনেও অনেক কিছু গ্রহণ করা যেত। কিন্তু পাত্র ছিল ছিদ্র। তাই ঝুলিতে কিছু রাখতে পারিনি। হুযুর আজ আমাদের মাঝে নেই। আছে তাঁর চিন্তা-চেতনা এবং কর্ম ও আদর্শ। আল্লাহ তাআলার দরবারে ফরিয়াদ জানাই, তিনি আমাদের আদর্শ পূর্বসূরীর উত্তম উত্তরসূরী হবার তাওফীক দান করুন এবং হযরতকে জান্নাতুল ফিরদাউসের সুউচ্চ মাকাম নছীব করুন।  আমীন।

 

 

 

 

 

advertisement