রবিউল আখির ১৪২৯   ||   এপ্রিল ২০০৮

মেরী ‘ইলমী ও মুতালা‘আতী যিন্দেগী

মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আরবী তালীম শুরু হওয়ার পর আমার উস্তাদ শায়খ খলীল আরব ইবনে মুহাম্মদ ইবনে শায়খ হুসাইন ইয়ামানী মুহাদ্দেসে ভূপাল রহ. কুরআন মজীদের যে সূরাটি পড়িয়েছেন তা হল সূরা যুমার। ছাত্রের হৃদয়-ফলকে তাওহীদের বাণী খোদিত করতে অত্যন্ত আগ্রহ ও উদ্দীপনা এবং গভীর যত্ন ও মনোযোগের সঙ্গে তিনি এ সূরাটি পড়িয়েছেন।

আরবী সাহিত্যে, বিশেষত কবিতায় আরব ছাহেবকে আল্লাহ যে স্বভাব-রুচি দান করেছিলেন তার নজির খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আর তিনি ছিলেন ওই কওমেরই একজন, যাদের সম্পর্কে দরবারে নবুওয়ত থেকে শাহাদাত দেওয়া হয়েছিল যে, ঈমান তাদের ঘরের সম্পদ। (হাদীস শরীফে এসেছে-

الإيمان يمان

ঈমান হল ইয়ামানী।)

মাতৃসূত্রে পেয়েছেন আজমের সৌন্দর্য। আর পিতৃসূত্রে লাভ করেছেন আরবের উত্তাপ। যখন কুরআন পড়তেন তো নিজেও কাঁদতেন, অন্যদেরও কাঁদাতেন। আর যখন কসীদা পাঠ করতেন তখন যেন মূর্ত হয়ে উঠত ওকাজ মেলার ছবি।

তাওহীদ ছিল  তার রুচি ও  স্বভাবের  অন্তর্গত। সূরা যুমারে বিষয়টি মন উজাড় করে পড়িয়েছেন। আর হৃদয়ের সকল দ্বার তাওহীদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। সেই শিক্ষালাভের বহু বছর পর আজও-আল্লাহ তাআলার অসংখ্য অগণিত শোকর-হৃদয়পটে এই আসমানী ঘোষণা-

اَلَا لِلّٰهِ الدِّیْنُ الْخَالِصُ ؕ

খোদিত হয়ে আছে। আর এই অমোঘ সত্যের সামনে মুশরিকদের যুক্তি-

مَا نَعْبُدُهُمْ اِلَّا لِیُقَرِّبُوْنَاۤ اِلَی اللّٰهِ زُلْفٰی ؕ

আমরা আমাদের উপাস্যদের শুধু এজন্য উপাসনা করি যে, তারা আমাদেরকে খোদা তালার নিকটবর্তী করে দিবে!- মাকড়সার জালের মতোই ক্ষীণ ও অসার মনে  হয়।

আরবী সাহিত্যে শায়খ খলীল আরবের একটি ইজতিহাদী নেসাব ছিল, যা সে সময়ের হিন্দুস্তানে ছিল একেবারে নতুন। আর তার একটি বৈশিষ্ট্য ছিল যে, তিনি তার রুচি ছাত্রদের মধ্যেও বিকশিত করতে পারতেন। ইলমে ছরফের প্রাথমিক পাঠ এবং আরবী রচনা অনুশীলনের পাশাপাশি তিনি পড়িয়েছেন বৈরুতের রিডার্স আলমুতালাআতুল আরাবিয়্যা আতত্বরীকাতুল মুবতাকারা (১৫ খন্ড) মাদারিজুল কিরাআ (১ খন্ড)। এরপর ইবনুল মুকাফফা-এর কালীলা ওয়া দিমনা মাজমু্আতুম মিনান নাজমি ওয়ান নাছর নাযম (পদ্য) অংশের একটি অংশ মুখস্থ করিয়েছেন এবং নাহজুল বালাগাহ কুতুব অংশ। আর নাযম (পদ্য) সাহিত্যে হামাছা, মাআররী-এর সাকতুয যানাদ এবং দালাইলুল ইজায জুরজানী। আরো পড়িয়েছেন মুখতাসারু তারীখি আদাবিল লুগাতিল আরাবিয়্যা

আরবী কাওয়াইদের অনুশীলনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছি আবুল হাসান আলী আদদরীর-এর পুস্তিকা আদদরীরী  থেকে।  কয়েক  পৃষ্ঠার  পুস্তিকা কিন্তু আরব ছাহেব এর আমলী অনুশীলন করিয়েছেন। সেই অনুশীলন এখনও কাজে আসছে।

 

এই তালীমের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, এতে একই সময়ে একাধিক বিষয় পাঠ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এ পর্যায়ে শুধু আরবী ভাষা ও সাহিত্যের তালীম ছিল। এরই চর্চা, এরই আলোচনা এবং এটাই ছিল সার্বক্ষণিক ধ্যান-জ্ঞান।

আরব ছাহেবের আরেকটি বৈশিষ্ট্য এই ছিল যে, তিনি তাঁর পসন্দের ব্যক্তিত্ব ও তাদের নির্বাচিত রচনাবলি এমনভাবে ছাত্রদের সামনে উপস্থিত করতেন, যেন তারাই ভাষা ও সাহিত্যের সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত এবং রুচিশীলতার চূড়ান্ত বিকশিত রূপ। ফলে এঁরা ছাত্রদের মন-মানসকে আচ্ছন্ন করে ফেলতেন এবং ছাত্ররা তাদেরই অনুকরণ করত।

গদ্য সাহিত্যে ইবনুল মুকাফফা ও জাহিয এবং পদ্য সাহিত্যে মুতানাববী ও বুহতারী ছিলেন তাঁর নির্বাচিত ব্যক্তিত্ব। সাহিত্যের বিচার ও সমালোচনার ক্ষেত্রে আবদুল কাহের জুরজানীকে তিনি সনদ মনে করতেন। এজন্য এঁদের রুচির সঙ্গে একাত্ম হতে পারাকে ছাত্ররা নিজেদের পরম সৌভাগ্য ও সর্বোচ্চ সাফল্য বলে বিশ্বাস করত। আমিও ইবনুল মুকাফফা, ছাহিবে নাহজুল বালাগাহ এবং কখনো কখনো জুরজানীকে অনুকরণ করার চেষ্টা করেছি এবং এতে অনেক ফায়দা হয়েছে।

ছাত্রদের উৎসাহিত করতে আরব ছাহেবের একটি বিশেষ ভঙ্গি এই ছিল যে, ছাত্রদের মন মগজে তিনি এ কথা বদ্ধমূল করে দিতেন যে, রুচি ও সাহিত্যের মনোরম দৃষ্টান্তগুলো রুচিশীল ছাত্রেরই মৌরুসী সম্পদ। অতএব এগুলো নিজ রচনায় সংযুক্ত করতে দ্বিধাবোধ করা উচিত নয়। তার এ কথায় উৎসাহিত হয়ে সাহিত্যের এই রত্নসম্ভার আমিও আহরণ করেছি এবং কখনো কখনো নিজ রচনাকে রত্নখচিত করে পুরস্কার লাভ করেছি।

 

এই তালীমের শেষ পর্যায়ে আরব ছাহেব পড়তে দিলেন প্রথিতযশা মিসরী সাহিত্যিক সাইয়্যেদ মুসতফা লুতফী মানফালুতীর রচনা-আননাযারাত । ফল এই হল যে, শতাব্দীর এই জাদুকর দিল-দেমাগকে মোহাবিষ্ট করে ফেলল এবং হৃদয়ের অভ্যন্তরে স্থান করে নিল। তার শিরোনামগুলো সামনে রেখে কলম বুলানোর চেষ্টা করেছি। বলা যায়, পাকা ঘোড়সওয়ারের পিছনে ছুটে অনেক দূর পর্যন্ত ধুলি উড়িয়েছি।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement